Full premium theme for CMS
মঞ্চের ভালোবাসায় সিক্ত নাজমা আনোয়ার
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
শিল্পী নাজমা আনোয়ার আর আমাদের মাঝে নেই। তাঁকে নিয়ে এতো দ্রুত স্মরণ প্রবন্ধ লিখতে হবে তা কল্পনাতেও ভাবিনি। কিন্তু বাস্তবে তাই ঘটলো। নাজমা আনোয়ার একজন মহান শিল্পী ছিলেন। তাাঁর অভিনয় পারদর্শিতা, সৃজনশীলতা ও অভিনয় ক্ষমতা দীর্ঘদিন আমাদের ইতিহাসে লেখা থাকবে। কিছু কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীকে আমরা জাত শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করে থাকি- নাজমা আনোয়ার ছিলেন তাঁদের দলভুক্ত। তাঁর রক্তের মধ্যে ছিলো অভিনয় ক্ষমতা। নাজমা আনোয়ারের অভিনয়দক্ষতা নিয়ে দীর্ঘ রচনা তৈরি হতে পারে- সে সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলা যায় তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক অভিনেত্রী। নাজমা আনোয়ারের মঞ্চ, টেলিভিশন, রেডিও এবং চলচ্চিত্রে ছিলো সমান পদচারণা। একথা আমরা হয়ত অনেকেই জানি যে, মঞ্চ ছিলো তাঁর প্রথম ভালোবাসা। ষাটের দশকে বাংলাদেশে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘ড্রামা সার্কেল’র কথা অনেকেই জানেন। ‘ড্রামা সার্কেল’ ছিলো আমাদের এই ভূখণ্ডে প্রথম গ্রুপ থিয়েটার নাট্যভাবনার নাট্যদল। ‘ড্রামা সার্কেল’র বজলুভাইকে এখনো নাট্যকর্মীরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। নাজমা আনোয়ার ছিলেন সেই ড্রামা সার্কেলের সদস্য এবং সেই স্বশিক্ষিত নাট্যপরিচালক বজলুল করিমের সরাসরি ছাত্রী। তারপর নাট্যচর্চায় একটি দীর্ঘ বিরতি আসে।
আশির দশকে এসে নাজমা আনোয়ার যুক্ত হন ‘আরণ্যক নাট্যদল’র সঙ্গে। ‘আরণ্যক নাট্যদল’এ একনাগাড়ে অনেকগুলো মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন তিনি। তার অভিনীত ইবলিশ, গিনিপিগ, সমতট, কোরিওলেনাস ইত্যাদি নাটকগুলো তৎকালীন সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উল্লিখিত নাটকগুলো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে নাজমা আনোয়ারের একক অভিনয়দক্ষতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
নাজমা আনোয়ার অভিনেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের বাইরেও ‘আরণ্যক নাট্যদল’এ কিছুদিন সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তখন খুব কাছ থেকে দেখেছি তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা, দক্ষতা, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা। সংগঠনের অর্থনৈতিক হিসাব থেকে শুরু করে মহড়া কক্ষের আয়োজন- কোনোটিই তাঁর দৃষ্টি এড়াতো না। নাজমা আনোয়ারকে খুব কাছ থেকে মনে হতো তিনি যেন আমাদের জন্য মায়ের দায়িত্ব পালন করছেন। নাট্যদলের সব সদস্য-সদস্যাদের তিনি পুত্র-কন্যাসম জ্ঞান করতেন। যেকোনো অভিযোগ-অনুযোগ তিনি ধৈর্যসহকারে শুনতেন এবং সাংগঠনিকভাবে ও কখনো কখনো ব্যক্তিগতভাবে তা সমাধান করতে চেষ্টা করতেন। আমি আবারও উল্লেখ করতে বাধ্য হচ্ছি- নাজমা আনোয়ারের স্পর্শ ছিলো দলের কর্মীদের কাছে মায়ের পরশ। নাজমা আনোয়ারের অভিনয় দক্ষতা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের ক্ষমতা আমার নেই। ইবলিশের ‘আতশী’ থেকে শেক্সপীয়ারের কোরিওলেনাস’র ‘মা’ চরিত্রে তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। সাধারণ গ্রামীণ চরিত্র থেকে যেকোনো অভিজাত চরিত্র রূপায়নে তাঁর ছিলো অসাধারণ ক্ষমতা। চরিত্র নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে ও নাট্যকারের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলা, মতবিনিময় ও প্রয়োজনে বিতর্কে অবতীর্ন হওয়া, সবই করতেন তিনি। এমনিভাবে গভীর অনুশীলনের মধ্যদিয়ে একটি চরিত্র নির্মাণ করতেন তিনি। নাজমা আনোয়ার যে চরিত্রে রূপদান করতেন, মঞ্চে তাঁর অভিনয় দেখতে দেখতে মনে হতো তা যেন অন্যের জন্য দুঃসাধ্য। তাঁর নিজস্ব কিছু অভিনয়শৈলী তাঁকে নির্মিত চরিত্রে অনন্য করে তুলতো আর সেখানে নাজমা আনোয়ার হয়ে উঠতেন মহান শিল্পী। অতিথি শিল্পী হিসেবে নাজমা আনোয়ার ‘দেশ নাটক’র লোহা নাটকে অসাধারণ অভিনয় করেন এবং তা দিয়ে বিপুলভাবে দর্শকনন্দিত হন। লোহা-ই ছিলো তাঁর শেষ মঞ্চনাটক।
নাজমা আনোয়ারের মৃত্যুর পর অনেক পত্রিকায় তাঁর জীবনবৃত্তান্তে তুলে ধরা হয়েছে তাঁর টেলিভিশন নাটকের কথা কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে নাজমা আনোয়ার প্রথমত একজন মঞ্চশিল্পী এবং মঞ্চই ছিলো তাঁর প্রথম ভালোবাসা। অবশ্যই টেলিভিশন নাটকে এবং বিকল্পধারার কিছু চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
মান্নান হীরা : নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা। সদস্য, আরণ্যক নাট্যদল।