Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কীভাবে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছানো গেল

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

একজন নাট্যকর্মী হিসেবে হাতেকলমে কাজ করতে করতে কী ক'রে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছানো গেল যাতে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি নাটকের মঞ্চরূপারোপ করা সম্ভব হোল, সেই সম্পর্কে অনেকেই কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। তাই এই চেষ্টা।

কিন্তু বোধটা যখন বিবর্তিত হচ্ছিল, কিংবা হয়তো বলা যায়, বিবর্ধিত হচ্ছিল, তখন তো পরপর কোন হিসাব রাখা হয়নি, ফলে আমার নিজের কাছেও ব্যাপারটা একেবারে অঙ্কের মতো স্পষ্ট নয়। বিশেষ করে, বিজ্ঞানীরা বলেন, আমরা যখন কোন জিনিস দেখি, বা জানি, বা অনুভব করি, তখন নন্বরওয়ারী হিসাবে সেটা উপলব্ধি করি না। আমাদের বোধ যেন স্পঞ্জের মত বিষয়টাকে সম্পূর্ণ শুষে নিয়ে আত্মসাৎ ক'রে নেয় আমাদের উপলব্ধিতে। এবং তারপরে প্রয়োজনমতো আলাদা আলাদা স্তর থেকে সেই বোধ আসতে থাকে আমাদের চেতনায়।

তেমনি কতো উপলব্ধি যে আমার বোধের কতো বিভিন্ন স্তরে একই সঙ্গে কাজ ক'রে যাচ্ছিল তা এতদিন পরে আমার পক্ষেও বিবৃত করা সম্ভব নয়। আমি শুধু একটা শীর্ণ আন্দাজ করতে পারি মাত্র। অবশ্য তখন আমাদের চারপাশে যেসব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক, ও শৈল্পিক ঘটনা ঘ'টে যাচ্ছিল, এবং যার সংঘাতে নানা উত্তেজিত তর্ক তখন থেকে থেকেই আমাদের মাথার চারপাশের হাওয়াকে অতিতানিত ক'রে দিচ্ছিল, সেসবের পরম্পরা যদিও আমার কিছু-কিছুটা মনে আছে, তবু সেগুলো বর্ণনা করা এই আলোচনায় সম্ভবই নয়। (যদিও সেগুলো আমার ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত) কারণ তাহলে, আমার ধারণা, নাট্যের এই বিশেষ বিবর্তনের কথা পর্যন্ত পৌঁছুবার আগেই বেলা পুইয়ে যাবে।

সুতরাং এইসব অসুবিধে, ও তার সঙ্গে আমার অক্ষমতারও কারণে, আপনারা এই বিবরণকে বীজগণিতের X-এর মতো একটি নির্বিশেষ এককের অভিজ্ঞতার খণ্ডিত ইতিহাস ব'লে গণ্য ক'রে নেবেন। যেন, একটা যাত্রার সামান্য কিছু বর্ণনা।

‘সাধারণ মঞ্চ’ থেকে গণনা করলে সেটা আমার নাট্যজীবনের দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথমে ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘের উদ্যোগে ল্যাবরেটরী। যদিও নির্দেশনার ভার সেই প্রথম আসলো আমার ওপর, এবং সেই কাজে কিছু মজার অভিজ্ঞতাও লাভ হয়েছিল আমার, তবু সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলবার নেই এই ক্ষেত্রে।

জবানবন্দী মহলার সময়ে সম্মেলক অভিনয়ের গ্রন্থনার দিকে বিশেষ চেষ্টা করেছিলুম, কারণ সাধারণ শৌখীন অভিনয়ে এইদিকগুলো অত্যন্ত আলুথালু থাকে। ফলে, অভিনয়ে হাঁটা-বসা ও সংলাপ বলার মধ্যে সেই পরিমিতি ও তীক্ষ্মতা থাকে না যাতে দৃশ্যের নিহিত নাটকীয় তীব্রতা স্পষ্ট হয়। এবং সেই কাজেই এত ব্যস্ত ছিলুম যে মঞ্চসজ্জা সম্পর্কে ভালো ক'রে ভাবাই হয়নি। সে-চিন্তা এলো একেবারে শেষ মুহূর্তে।

মহলার সময়ে যে-সজ্জার কথা আবছায়া কল্পনার মধ্যে ছিল সেটা খানিকটা বাস্তব কুঁড়েঘর ও বাস্তব পার্কের ধারের রাস্তা, আর খানিকটা সাধারণ মঞ্চের দৃশ্যসজ্জা। এই দুপ্রকারের ছবি আবছা ভিত্তিতেই ছিল। কিন্তু সেটা ঠিক ক'রে করাতে গেলে যতো পয়সা খরচ হবে ততো পয়সা তখন গণনাট্য সংঘের ছিল না। আর আমারও সাহস ছিল না চাইবার। শেষ পর্যন্ত যে-থিয়েটারে অভিনয় করা হয়েছিল তাদেরই পুরানো ফ্ল্যাটগুলোকে উল্টো ক'রে দাঁড় করানো হোল একটা দৃশ্যে। অর্থাৎ আঁকা দিকগুলো পিছন-দিকে। দর্শকদের দিকে ছিল সেই দিক যেখানে পাইন কাঠের ফ্রেমটা দেখা যাচ্ছে। তাও নানারকম রং ও ময়লা প'ড়ে বেশ এক কিম্ভুত নগ্ন চেহারা হয়েছে। মনে হোল, নাটকটার মধ্যে পরাণ মণ্ডলদের সম্পর্কে সমাজের ঔদাসীন্যের যে-নগ্ন প্রকাশ আছে, ঐসব চাষীদের অসহায়তার যে-নগ্ন প্রকাশ আছে, তার কিছুটা হয়তো কিছু কিছু লোকের কাছে স্পষ্ট হবে। অন্তত সেখানকার আঁকা-পটের চেয়ে অর্থপূর্ণ হবে।- আর পরাণ মণ্ডলের বাচ্চা নাতির মৃত্যুর দৃশ্যে সমস্ত আলো জ্বালিয়ে স্পষ্ট ক'রে রাখাছিল পুরো ঘটনাটা। মনে হয়েছিল, কিছু মানে হয়তো হবে কিছু লোকের কাছে।

কী হয়েছিল ঠিক জানি না। তবে কিছুটা খ্যাতি বোধহয় হয়েছিল। অনেকবার অভিনয় করবার সুযোগ হয়েছিল। মানে, তখনকার হিসেবে অনেকবার।- আর আমারও অনেক প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা হোল মঞ্চে দৃশ্যসজ্জার ও আলোর আচরণ সম্পর্কে। কিছু ভুল ভাঙলো, কিছু নতুন জ্ঞান হোল।

এতে আমার আম্বা বেড়ে গেল। বলা গেল যে, নবান্ন-র জন্যে খরচ হবে অনেক বেশী। শেষ পর্যন্ত কম্যুনিষ্ট পার্টির তৎকালীন প্রধান সম্পাদক শ্রী. পি. সি. জোশীর আগ্রহে ও সুপারিশে কিছু টাকা পাবার কোনরকম একটা ব্যবস্থা হোল।

নবান্ন যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন যে এতে অনেক দৃশ্য। কোনো নাটকে বেশি দৃশ্য থাকলে তার নাট্যপ্রয়োগের একটা পদ্ধতি ছিল। ঘুর্ণমঞ্চ আসার আগে থেকেই। তাকে থিয়েটারে বলা হোত কাভার-ডিসকাভার পদ্ধতি। অর্থৎ একটা দৃশ্য সাজানো হোত মঞ্চের গভীরতা নিয়ে- যেমন ধরা যাক, এক বিরাট রাজসভা, -এবং সেই দৃশ্যের অভিনয় শেষ হ'লে যখন রাজসভা ভেঙে হয়তো একটা বৃহদায়তন তাঁবুর দৃশ্য সাজানো হচ্ছে সেই জায়গায়, তখন সামনের দিকে একটা গ্রাম্যপথ বা ঐরকম কিছু আঁকা একটা পট ফেলে দেওয়া হোত। বা পরবর্তীকালে, পটক্ষেপণ না ক'রে দুপাশ থেকে দুটো ‘ফ্ল্যাট’ ঠেলে দিয়ে মঞ্চের ওপর জোড় লাগাতেন। তাতেই আঁকা থাকতো রাজপ্রাসাদের অলিন্দ, বা ঐরকম কোনো কিছু। যতোক্ষণ এই পটের বা ফ্ল্যাটের সামনে কোনো দৃশ্য অভিনয় হোত, (কিংবা কোনো অভিনয় ছাড়াই হয়তো একজন বৈষ্ণব বা পাগল বা ভিখিরী, একদিক থেকে ঢুকে একটা পূরো গান গাইতে গাইতে অপরদিক দিয়ে বেরিয়ে যেত) ততক্ষণে পিছনের গভীর দৃশ্যসজ্জা সম্পূর্ণ হয়ে যেত, এবং সামনের পটটা গুটিয়ে ফেলে বা ফের দুপাশে সরিয়ে নিয়ে পরবর্তী দৃশ্য শুরু হোত। -এইযে সময়টা খাপাবার জন্যে সামনে একজন পাগল সেজে গান গেয়ে যেত, এটা আমি ভাদুড়ীমশায়ের রমা (শ্রীশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ) নাটকেও দেখেছি। সেখানে, যতদূর মনে পড়ে, শ্রীণৃপেশনাথ রায় পাগল সেজে ‘মোর স্বপনতরীর কে তুই নেয়ে’ গানটি গেয়ে যেতেন। (এটি রক্তকরবী নাটকে বিশু, বা নন্দিনী যাকে বলে ‘পাগল ভাই’, তার গান।)- মনে এখন বড় কৌতুহল জাগে যে ভাদুড়ীমশায় কী ভেবেছিলেন বিশুর সম্পর্কে।

তিরিশের দশকের শুরুতেই শ্রীসতু সেন আমেরিকা থেকে এসে ঘুর্ণমঞ্চ তৈরি করালেন। তাতে মঞ্চের গোল চাকাটিতে মোটামুটি তিনটে দৃশ্য সাজানোর জায়গা হোত। কিন্তু আয়তনে তারা পুরো মঞ্চের তুলনায় বড়ই ছোট হয়ে গেল। অবশ্য বসবার ঘর শোবার ঘর সাজাবার পক্ষে খুব একটা অসুবিধে হোত না। এবং ঠিক তখনি অনেক নাটক লেখা হ'তে থাকলো যা ঐ ঘূর্ণমঞ্চেরই উপযুক্ত। তখনি দৃশ্যসজ্জার তিনটে দেওয়াল দেখানো শুরু হোল। এবং কোনো কোনো নাট্যে ঘরের সীলিং থেকে লাইট ঝুলছে- এমনও দেখানো হয়েছিল।- এসব ঘটনা পশ্চিমে এর অন্ততঃ একশো বছর আগে ঘটে গিয়েছে। এবং বাস্তবানুকৃতি হিসেবেও মঞ্চসজ্জায় এলাহি পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।

সকলেই জানেন নবান্ন-এ চটের পর্দা ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ আগমনের পর আমাদের যে মঞ্চ-ও দৃশ্যপট সম্বলিত আধুনিক থিয়েটারের পর্যায় শুরু হয়েছে- যার ভালোমত শুরু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে- সেখানে এতদিন আঁকা-পটের ওপর, বা পরে কাঠের ফ্রেমে কাপড়-আাঁটা ফ্ল্যাটের ওপর, দৃশ্য এঁকেই সর্বদা সাজানো হোত। সেখানে কিছু না এঁকে শুধু পর্দা ঝুলিয়ে সাজানোর কথা মাথায় এলো কোন প্রভাবে?- এটা কিছু লোকের প্রশ্ন।

তখন কিন্তু মাথায় আসাটা এতোই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল যে তার উৎপত্তির হিসাব করাটা কারোরই প্রয়োজন বোধ হয়নি। পরে ভেবে মনে হয়েছে যে প্রভাব বোধহয় রবীন্দ্রনাথেরই। তাঁর অনেক অনুষ্ঠান নাকি শুধু পর্দা ঝুলিয়েই হোত। দেখেছি অল্প, শুনেছি বেশি। কিন্তু তপতী নাটকের শুরুতে দৃশ্য-সজ্জা সম্পর্কে তাঁর লেখা তো পড়া ছিল বটেই। তাছাড়া পশ্চিমের দৃশ্য-সজ্জার কিছু বর্ণনা ও ছবিও তখন আমার গোচরে এসেছে। এবং ‘স্টেজ লাইটিং’ সম্পর্কে প'ড়ে আমার তখন এ জ্ঞানও হয়েছে যে কালো ভেলভেটের পুরু পর্দা হ'লে তাতে আলো প্রতিফলিত হয় না, বরঞ্চ আলো শুষে নেয়। তাই প্রথমে মনে হয়েছিল যে ঐরকম গাঢ় কালো অন্ধকারের সামনে যদি উজ্জ্বল আলোতে ঐ চাষাদের দূর্ভাগ্যের মিছিল দেখা যায় তো তার যেন একটা গভীর মানে উপলব্ধি হবে।

কথায় বলে, ইচ্ছে হয় জামবাটিতে একবাটি গরম দুধ নিয়ে ফুঁ দিই আর খাই, খাই আর ফুঁ দিই। কিন্তু দুধও নেই, আর জামবাটিও নেই, শুধু ইচ্ছেটি আছে, আর ফুঁ-টি। -তাই সেই দুঃখের কথা বলছিলুম মহর্ষির কাছে। আর কোন উপায় তখন আসছেই না মাথায়। সব শুনে মহর্ষি বললেন- পর্দাই দাও।

আমি আঁতকে উঠে বললুম-কিন্তু সে যে অনেক খরচা। মহর্ষি বললেন-চটের পর্দা দাও। আমরা গরীব দেশের লোক, আমাদের ভেলভেট নেই, কিন্তু চট আছে। লাগাও। চটের পর্দা।

এসব কথা আজ অনেকেই জানেন, কিন্তু এই দৃশ্যসজ্জার অনুভব-উৎস যেটা ছিল সেটাও খুব অর্থময়। যেমন একটা দৃশ্য ছিল দাতব্য চিকিৎসালয়ের। সেখানে একটা টেবিল, একটা কি দুটো কাঠের চেয়ার, ও একটা বেঞ্চি,- এই ছিল আসবাব। আর, স্থান বোঝাবার জন্যে পিছনে চটের পর্দায় লাল শালুতে সাদা অক্ষরে সাঁটা ছিল ‘দাতব্য চিকিৎসালয়’। ব্যাস।- এইতেই সমস্ত দর্শক মেনে নিয়েছিল যে, স্থানঃ একটা দাতব্য চিকিৎসালয়।- এবং সেই দৃশ্যেই বিজনের (বিজন ভট্টাচার্য) সবচেয়ে মহৎ অভিনয় হোত।

এর পূর্বে আর কখনো এমন সোজাসুজিভাবে দর্শকের কাছে অকুস্থলের পরিচয় দেওয়া হয়েছে ব'লে আমার জানা নেই। এবং এর ফলে দেখিছি দর্শক যে শুধু ওপর ওপর বুঝতে পারলো তা নয়, তার কল্পনাকে উৎসারিত ক'রে অনেক গভীর উপলব্ধি গ্রহণ করার প্রস্তুতিতে সে পৌঁছিয়ে গেল।

এই কথাটিই একরকমভাবে বলেছিলেন শ্রীমানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি লেখাতে। সেই সময়ে যে-সমস্ত আলোচনা আমাকে কৃতজ্ঞ করেছিল, তাঁর নবান্ন সম্পর্কিত লেখাটি তার অন্যতম।

এই-যে দর্শক মেনে নিল, মেনে নিল শুধু নয়, তার মনের কাছে যে আমরা পৌঁছুতে পারলুম,- এই থেকেই দৃশ্যসজ্জা সম্পর্কে একটা ধারণা আমার মনের মধ্যে স্পষ্ট হ'তে থাকে। যার অনেক পরীক্ষার চিহ্ন আছে পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার, চার অধ্যায়, এমনকি বিভাব নাটকের বড়ো রাস্তায় ট্টাম বাস রিকশাকে দেখানোর মধ্যেও।

তখন থেকে একটা কথা কিছুদিন মুখে মুখে খুব চালু হয়ে গিয়েছিল যে, আমাদের যাত্রাতেই ফিরে যাওয়া উচিত, যাত্রার পুনর্চলন হলেই আমাদের দেশীয় নাট্যরূপ আমরা খুঁজে পাবো।

দৃশ্যসজ্জা সম্পর্কে আমার আনুপূর্বিক প্রয়োগের ধারা দেখলে বোঝা যাবে যে আমার মন যাত্রার রিভাইভ্যালে সায় দেয়নি। মনে হয়েছিল, সংস্কৃতে নাট্যাভিনয় হচ্ছে দৃশ্যকাব্য। যাঁরা সেটা উপভোগ করতে আসেন তাঁরা দর্শক, প্রেক্ষক। Audience নয়। এবং যেখানে তাঁদের আসন সেটা প্রেক্ষাগৃহ, Auditorium নয়। আধুনিককালেও সেই দৃশ্যকাব্য রচনা করার সুযোগ রয়েছে আধুনিক মঞ্চে- যদিও সেটা সংস্কৃত যুগের ধরনে নয়- তবু এ সুযোগটা ছেড়ে দিলে কি নাট্যাভিনয়ের ঐশ্বর্য বাড়বে, না কমবে?

তবে, কেউ যদি মনে করেন যে দূরবর্তী গ্রামে গ্রামে গিয়ে তিনি নিরক্ষর তপশীলী বা উপজাতীয়দের সচেতন করার জন্যই নাট্যাভিনয়কে ব্যবহার করবেন তাহলে সেটা তো দেশের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয় কাজ। গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক দেশভক্ত বিজ্ঞানী তো গ্রামে সারাজীবন কাটিয়ে সেখানকার মানুষদের ভালবেসে কাজ ক'রে গেছেন।

কিন্তু এসব তর্ক যখন উঠে পড়ে, তখন প্রায়শই, তত্ত্বের অন্তে কর্মের কোনো এষণা থাকে না। শুধু তত্ত্ব নি'য়ে তর্ক করাটাই যেন মুখ্য কার্য ব'লে মনে হয়।

নবান্ন-র পর এইসব তর্ক যেন তুমুলভাবে ঘনিয়ে ওঠে। প্রোপাগাণ্ডা বনাম বিশুদ্ধ শিল্পকলা। জনগণের হিতার্থে মাঠেময়দানে, না গজদন্ত--মিনারে।- বিভেদের এতো সহজ বিন্যাস কিন্তু জীবনে ছিল না। এগুলো শুধু তার্কিকদের সৃষ্টি।- এরকম আরো অনেক।

কিন্তু নবান্ন-র অচিন্তিত সাফল্যের পর আমার মধ্যে আরো একটা প্রশ্ন কেবলই পাকিয়ে উঠতে থাকে। সেটা হোল যে, এতটা সাফল্যের কারণ কী? তখনি মনের মধ্যে একটা বোধ তৈরি হ'তে শুরু করে।- সমাজে যখন কোনো বড় ঘটনা ঘটে, তখন তাকে কেন্দ্র ক'রে সমাজ একটা সম্বন্ধতা পায়। সেই কেন্দ্রের অনুভব যে-গানের, যে-লেখার, যে-অভিনয়ের মধ্যে থাকে সেটা তখন লোকের গভীর মনকে স্পর্শ করে। যে-সমাজে কেন্দ্র বিলুপ্ত, যে-সমাজ নানা আকর্ষণে দীর্ণ, সেখানে শিল্পীর কথা ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে আটকে থাকে, বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে কথোপকথনের সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। কিছু বিচক্ষণ ব্যক্তিদের কথা শুনে আমারও মনে হোল যে, সেই কেন্দ্রের সুযোগ পাবার জন্যেই বোধহয় কিছু কবি- ফ্যাশিস্ট বা নাৎসী বা ঐরকম কোনো কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যবস্থার প্রতি- আকৃষ্ট হন। কেউ হয়তো বা গির্জের প্রতি।- বাংলাদেশে পঞ্চাশের মন্বন্তরে সমাজের মানসকেন্দ্রে, যেখানে সমাজের ন্যায়ান্যায় বোধ বিধৃত, সেখানে যে গভীর ধিক্কার আর বেদনাবোধ জেগেছিল, অজান্তে আমরা সেই কেন্দ্র থেকে কথা বলছি, তাই মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো জাগাতে পেরেছি। এটা কেবল শিল্পের বা প্রয়োগের কৌশলবশত নয়।

কিন্তু সেই কেন্দ্রের বোধকে আমরা সচেতনভাবে বুঝবো কী ক'রে? নাট্যের কোন রূপে, কোন গঠনসৌকর্যে, মানুষের মনগুলোকে ঐরকম তীক্ষ্মবোধসম্পন্ন ক'রে তুলতে পারবো?

সকল সংস্কৃতিতেই কলাশিল্পের নিজস্ব প্রয়োজনে কিছু distortion, কিছু abstraction থাকেই থাকে। আমাদের দেশে কীভাবে নাট্যে সেই বাস্তবাতিরিক্ত বিন্যাস আনা যায়, যাতে বাস্তবেরই গভীরতা উপলব্ধিতে আসে?

এই সময়ে কবি শ্রীবিষ্ণু দে এমন একটি কথা আমাকে বলেছিলেন যা আমার বোধকে বড়ো সাহায্য করেছিল। তিনি বলেছিলেন যে, বাঁকুড়ার ঘোড়া তো বাস্তব ঘোড়া নয়, কিন্তু ওটা গড়েছে একেবারে গ্রামীণ শিল্পী। যাদের আমরা অশিক্ষিত ব'লে থাকি। আর কতো যুগ ধরে গ্রামের আপামর জনসাধারণ ওর মধ্যেই আসল ঘোড়াটাকে দেখতে পেয়েছে।

ঠিকই। তবু একটা প্রশ্ন থাকে। নাট্যে তো চরিত্রগুলো জীবন্ত হওয়া চাই, একেবারে রক্তমাংসের ব'লে মনে হওয়া চাই। যার চিন্তার স্রোতটা দর্শকের বোধগম্য হওয়া চাই। সেখানে এই distortion কী ক'রে আনা যাবে? অভিনয়ে শিল্পীকে তো concrete হ'তে হয়। concrete হ'লে তার মানসিক অনুভবের ধারা, তার চিন্তার ধারা দর্শকের কাছে পৌঁছয় না। অতএব?

এর বহুদিন পরে বিষ্ণুবাবুর বাড়িতে ওপরতলায় বুঝি কাজ হচ্ছিল রাজমিস্ত্রির। এবং যে ‘যোগাড়ে’ ঝুড়ি ক'রে মালমসলা নিয়ে যাচ্ছিল মিস্ত্রিদের জন্যে, সে যাবার আসবার পথে নীচের বৈঠকখানার দরজায় প্রত্যেকবারই কিছুক্ষণ ক'রে দাঁড়িয়ে কিছু দেখছিল। ঘরের মধ্যে অন্যান্য জিনিসের মধ্যে শ্রীযামিনী রায় মশায়ের কিছু ছবি টাঙানো ছিল। বারে বারে তাকে দাঁড়াতে দেখে বিষ্ণুবাবু কৌতুহলী হয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, কী দেখছো?

মজুরটি লাজুকভাবে হেসে একটা ছবি দেখিয়ে বললে-ঐ ছবিটা।

ছবিটি (এখন আমার মনে নেই একটি কি দুটি) স্ত্রীলোকের। সাদার ওপর খুব স্বল্প ও হাল্কা রেখায় আঁকা।

বিষ্ণুবাবু আরো কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করেন যে, কিসের ছবি বল তো?

মজুরটি খুব সহজেই উত্তর দেয়- বিধবার-।

বিষ্ণুবাবু তার দু-একদিন পরে ঘটনাটা আমাকে বর্ণনা ক'রে বলেন যে- আমাদের কোনো পাশকরা বাবু হ'লে কতো কথা বানাবার চেষ্টা করতো। আর এ- যামিনীদা যেমন সহজ ভাষায় কথা বলেন- তেমনিভাবে ব'লে দিলে।

ঘটনাটা শুনে আমার মনে হোল যে ঐ ছবির মধ্য দিয়ে নিশ্চয় ঐ মজুরটি তার পরিচিত কোনো স্ত্রীলোকের বৈধব্যের দুঃখটা মূর্ত দেখতে পাচ্ছিল। সম্ভব হ'লে সেই মজুরটিকে জিজ্ঞাসা করতুম যে ছবিটিতে সে কি কেবলই একটা দুঃখের অনুভব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, না তার সেই পরিচিত মহিলাকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল- ছবির মধ্যের বসার ভঙ্গীতে বা শাড়ির বিন্যাসের ভেতর দিয়ে? বা অন্যকোনো ভাবে? অর্থাৎ কোন পড়হপৎবঃব কে আশ্রয় ক'রে তার মনটা ধনংঃৎধপঃরড়হ পর্যন্ত পৌঁছালো?

অর্থাৎ অভিনয়ে একটা চরিত্রকে যখন জীবন্ত ক'রে তোলা হবে তখন তাকে যেমন বাস্তব ব'লে মনে হওয়া চাই তেমনি বাস্তবাতিরিক্ত একটা মাত্রাও তার মধ্যে থাকা চাই।-

কিন্তু এসব আরো পরের চিন্তা। আমি হঠাৎ লাফিয়ে চলে এসেছি। সুতরাং আবার নবান্ন-র কথায় একটু ফিরে যাই।

সকলেই মনে করেন যে নবান্ন-এ চটের পর্দা দেওয়া হয়েছিল মানে, মঞ্চের এধার থেকে ওধার পর্যন্ত খাটানো হয়েছিল, যেমন সাধারণত সব পর্দা খাটানো হয়।

অনেকেই তো জানেন যে নবান্ন-এ ঘূর্ণমঞ্চ ব্যবহার করা হয়েছিল, সুতরাং এভাবে পর্দা খাটালে মঞ্চটা বিভিন্ন দৃশ্যের জন্যে ঘোরানো যেত কীভাবে?

আসলে ঘূর্ণমঞ্চের নিয়মানুযায়ী মঞ্চের চাকতিতে তিনটে দৃশ্যই সাজানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। একটি অপেক্ষাকৃত বড় আয়তনের, আর অন্য-দুটি ছোট। এবং সেই কারণে পর্দা খাটানো হয়েছিল চাকতির কেন্দ্র ও কিনারের তিনটে জায়গায়। আর সেই তিনটে ব্যাসার্ধে (বোধহয় তলতা বাঁশ দিয়ে) তিনটে বাহু লাগিয়ে ফ্রেমের মত করা হয়েছিল। তার নীচেই দড়ি টানা ছিল। আর পর্দাগুলোয় কড়া লাগানো ছিল। যাতে চট ক'রে গুটানো বা মেলে দেওয়া যায়।- এই কাজটা জানবাজারের এক ডেকরেটর কোম্পানীর সঙ্গে কথা ক'য়ে তাঁদের দিয়ে করাই।

প্রথম দৃশ্যে পর্দাগুলো গুটানো থাকতো কিনারের দিকে। পূরো মঞ্চটা ব্যবহারের জন্যে। আবার তেমনি খুলে দেওয়া হোত পুরো মঞ্চটা- একেবারে শেষ দৃশ্যে।

নবান্ন নাটকটা যদিও তখন দেশের অবস্থার এক বাস্তব চিত্রণ ব'লে সকলের মনে হোত, তবু ভালো ক'রে নাটকটা পড়লে বোঝা যায় যে ওটা ঠিক রিয়্যালিস্টিক লেখার ধরনে লেখা নয়। বরঞ্চ বহু জায়গায় কাব্যসৃষ্টির মতো উপাদান ছড়িয়ে আছে। এবং অনেক চরিত্র খুবই বাস্তবানুগভাবে রচিত হলেও কতকগুলি চরিত্রের সংলাপ- বিশেষ ক'রে বিজন যে চরিত্রটা অভিনয় করতো, সেই প্রধান সমাদ্দারের সংলাপ- বহুল পরিমাণেই কাব্যময়। আর সেটা বিজনের অভিনয়ভঙ্গীর সঙ্গে অত্যন্ত ভালো খাপ খেত। ফলে ওটা একটা রূপকের মাত্রা পেয়ে যেত। যেন একটা archetypal চরিত্র।

রূপকই বলি আর archetypal বলি, এর অবস্থান তো জাতির চেতনায় বা অবচেতনায় বা অর্ধচেতনায়। ফলে, মানস-কেন্দ্র অনুভব করার প্রয়াস আমার উৎসাহ পেয়ে যায়।

কিন্তু এই যে সমাজ-মানসের কেন্দ্র খোঁজা, যেখানে চাষা-মজুর-জমিদার-জোতদারকে আলাদা করা হচ্ছে না- তাদের সবাইকে নিয়ে যে-সমাজ, তারই কেন্দ্রে নৈতিকতার যে হিসাব থাকে তারই খোঁজ করা,- এটা স্বভাবতই অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। কিছু লোক বলেন যে, জমিদারের বিরুদ্ধে চাষাদের পক্ষ নেওয়া, মালিকদের বিরুদ্ধে মজুরদের পক্ষ নেওয়া, এবং সমাজটা ভেঙে বিপ্লবের জন্যে একটা `Civil War’ ঘটানোর মতো হিংসে জাগিয়ে তোলাই হচ্ছে প্রগতিবাদী শিল্পীর একমাত্র কাজ। এবং তাই এক নতুন শিল্পকলা, এক নতুন সংস্কৃতি সৃষ্টি করার সময় যখন এসে গেছে,- যা নাকি প্রোলেটেরিয়ান শিল্পকলা, প্রোলেটেরিয়ান সংস্কৃতি- তখন এই সমাজের মানসকেন্দ্র খোঁজা খুবই বড় একটা প্রতিক্রিয়াশীলতার লক্ষণ।

যাই হ'ক, ১৯৪৬ থেকে হুড়মুড় ক'রে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকলো আমাদের জীবনে। ‘ধরতি-কে-লাল’ ছবির কাজ শেষ ক'রে যখন বোম্বে থেকে ফিরছি তখন, যতোদূর মনে পড়ে, ভি. টি স্টেশন থেকে তোপের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলুম। ভারতীয় নাবিকদের বিদ্রোহের লড়াই চলছিল। সারা শহর যেন উত্তাল।

ফিরে এলে মুক্তধারা-র ভার পড়ে। ব্যর্থ হই। সাম্রাজ্যাবাদীদের আচরণ জানা সত্ত্বেও, নাৎসীদের কাহিনী জানা সত্বেও, মনে হোল এ-নাটক যেন কোনো পুরাকাহিনীর মতো, আমাদের জীবনের সঙ্গে যেন কোনো সংলগ্নতা নেই।- তখন তাই স্পষ্ট মনে হোল যে রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়েই আমরা গভীর নাট্যের সৃষ্টিতে পৌঁছে যাবো। যে-নাট্য আমাদের আধুনিক কালকে জীবন্ত ক'রে প্রকাশ করবে আমাদের ভারতীয় নাট্যরীতিতেই।

জুলাই মাসের শেষের দিকে কলকাতায় বিরাট বড় এক হরতাল হয়। এর পূর্বে এত বড় সফল ধর্মঘট আর নাকি হয়নি। মনে হয়েছিল আমরা এতদিনের প্রতীক্ষিত সেই ক্রান্তিকারী কালের সামনে এসে যেন দাঁড়িয়েছি।

কিন্তু একমাসও পেরুলো না। একমাস কেন পক্ষাধিক কালের মধ্যেই ১৬ই আগস্ট শুরু হোল অকল্পনীয় দাঙ্গা। হিন্দুমুসলমানের। এতদিনের চিন্তা, স্বপ্ন, দেশের সম্পর্কে কল্পনা, সমাজ সম্পর্কে কল্পনা, প্রগতির রূপ রীতি চলন সম্পর্কে এতদিনের এতো ঘোষণা, এতো নিশ্চিত উক্তি, এতো স্পর্ধিত বিশ্বাস,- সব কিরকম যেন এলোমেলো হয়ে গেল। জুলাইয়ের হরতালের পর যে একমাসও পার হোল না!

তবু মনে হচ্ছিল যে আমার চারপাশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়, তর্ক ক'রে বোঝানো যায় দাঙ্গার সর্বনাশ সম্পর্কে। কিন্তু সেই প্রথম দেখলুম পাড়ায় পাড়ায় কেমন মস্তানরা গজিয়ে উঠলো। পাড়ার ওপরে তাদের ক্ষমতা কেমন বেড়ে গেল। কিছুদিন আগে পর্যন্ত যে সমস্ত ব'য়ে-যাওয়া ছেলেরা পাড়ার ভদ্রলোকদের চোখ একটু এড়িয়ে এড়িয়ে থাকতো, তারা এখন পাড়ার মাঝখানে লাঠি নিয়ে কাটারি নিয়ে খোলা গলায় আড্ডা জমালো। পাড়ার কর্তারাই এখন বরঞ্চ তাদের একটু এড়িয়ে চলেন। একটু তোয়াজ ক'রে কথা বলেন। বোঝা গেল, তর্ক ক'রে লোককে ভালো কথা বোঝাতে গেলে এরাই সর্বপ্রথম বাধা দেবে। (এ ইতিহাস আজও ঘটে চলেছে। বরঞ্চ সর্বঘটে বেড়ে চলেছে।)

৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমি বোম্বেতে। জোহরা সেগল সেদিন সকালে অপেরা হাউস থেকে ফ্লোরা ফাউন্টেন পর্যন্ত রাস্তা দিয়ে নাচতে নাচতে গিয়েছিল, একবারও না থেমে। পৃথীরাজজীর সম্প্রদায়ের অন্য সকলেই মাঝে মাঝে থেমেছে, কিন্তু জোহরা বেগম এক মুহূর্তের জন্যেও থামেননি। কেন নেচেছিল জোহরা? কী আশা তিনি করেছিলেন যা হোলো না?

আর তখন কম্যুনিস্ট পার্টীর নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে- এই আজাদী ঝুট কিনা তাই নিয়ে। আরো নানা ব্যাপার নিয়ে।

শ্রী পি.সি জোশীর আমন্ত্রণে আমি বোম্বে গিয়েছিলুম। ধরতি-কে লালের মতো আর একটা ছবি করতে। একটা কমিটি হয়েছিল- সাজ্জাদ জহীর, বলরাজ সাহনী, মোহন কুমারমঙ্গল, আমি আর হামীদ বাট ও বোধহয় রমেশ সিনহা- সে তখন ‘জনযুদ্ধ’ (হিন্দির) সম্পাদক। গল্প বিজনের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর। টাকা দেবে কামপুরের এক যুবক শিল্পপতি। পি.সি-র ভক্ত।

কিন্তু পার্টীর ভিতরকার দ্বন্দ্বে শ্রীযোশী অপসারিত হন। এবং এ ছবির পরিকল্পনা বাতিল হয়। আমার ও হামীদের অনেক পরিশ্রমের পর। (হামীদ পৃথী থিয়েটার্সের প্রধান অভিনেত্রী আজরার স্বামী।)

ডিসেম্বরের শেষে কলকাতায় ফিরি। জানুয়ারীর শেষদিকে স্বাধীনতার ছ’মাসও পেরোতে পারেনি- গান্ধীজীকে হত্যা করা হোল। এরই ঠিক সাতদিন পরে গণনাট্য সংঘের এক মিটিঙের পরে ঐ সংঘ ছাড়তে হোল। ...

তারপর আবার কাজ শুরু হোল। শ্রীতুলসী লাহিড়ীর পথিক নাটক নিয়ে। এবারেও সব নতুন ছেলেমেয়ে। তাদের নিয়ে মহলা দেওয়া হয়েছিল ন্যুনাধিক এক বৎসর। এবং তাতেই যেন আধুনিক একটা অভিনয়ভঙ্গীর রূপ হ'তে থাকলো। যেটা নিঃসন্দেহে তৎকালীন সকল অভিনয়-ভঙ্গীর মধ্যে একটা আধুনিকতার জন্যে লোকের কাছে আদৃত হয়েছিল।

তারপর ‘উলুখাগড়া’ তারপর ‘ছেঁড়াতার’। প্রযোজনার ও অভিনয়ের যেন একটা নতুন তাক পাওয়া গেল। দর্শকদের শ্রদ্ধাও পাওয়া গেল।

বিভাব নাট্যে নিরস্ত্র মিছিলের ওপর পুলিসের গুলি চালনার দৃশ্যে তীব্র অনুভব জাগিয়ে তোলা গেল প্রায় উপকরণবিহীন এক প্রয়োগ পদ্ধতিতে। এ যেন নবান্ন নাট্যের ‘দাতব্য চিকিৎসালয়’ লিখে দেওয়ার চেয়েও এক পা এগিয়ে।

আর তখনই নানা সামাজিক কারণে চার অধ্যায় অভিনয় করার কথা মনে হোল। মুক্তধারা অন্যদের অনুরোধে অন্যদের জন্যে করা হয়েছিল। কিন্তু চার অধ্যায় আমরা নিজেরা বেছে নিজেদের জন্যে করলুম।

একটা কথা হয়তো খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যেদিন সন্ধ্যায় মহর্ষি (বিঃদ্রঃ- মহর্ষি হচ্ছেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য, যিনি শিশিরকুমার ভাদুড়ির সমসাময়িক বিশিষ্ট অভিনেতা, গণনাট্য সংঘের মতাদর্শের নট এবং বহুরূপী’র প্রথম সভাপতি) ঘরে ঢুকতেই বললুম যে, মহর্ষি, আমরা চার অধ্যায় করবো ব'লে মনে করছি, সেদিন মহর্ষি প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করেছিলেন। বললেন- ওটা করবে! ওটা নিয়ে আবার নানারকম কথা চালু আছে...।

বলা গেল যে, বেশ, আপনি পড়–ন। প'ড়ে যদি আপনার মনে হয় যে করা উচিত নয় তাহলে করবো না।

মহর্ষি বললেন- না না করো। মনে যখন হয়েছে তখন ক'রে দেখা যাক।

বলা হোল যে না মহর্ষি, সে-ভাবে করতে পারবো না, আপনি তো জানেন। আপনি পড়–ন, প'ড়ে যদি আপনার কোথাও কোনো অন্যায় উক্তি আছে বলে মনে হয়, আর আমাদের যদি তা না মনে হয়, তাহলে তর্ক করবো, আর তর্কে যদি কোনো সমাধানে না পৌঁছুতে পারি, তাহলে করবো না, বন্ধ ক'রে দেব।

বইটা মহর্ষিকে দেওয়া হোল। এবং পরের দিন সকালে তাঁর বাড়ি গিয়ে হাজির হলুম।

মহর্ষি বললেন- না হে, কোথাও কোনো ভুল কথা, বা অন্যায় কথা তো নেই।- তবু প্রথম যখন পড়েছিলাম তখন কেন যে মনে হয়েছিল! বোধহয় চারিদিকে সকলে খুব বলছিল- তাতেই মনে একটা ইমপ্রেশন হয়ে গিয়েছিল। না, না করো। খুব করা যায়। তার বেশ কিছুদিন পরে, যখন আমি অতীন করতে আরম্ভ করেছি, তখন একদিন নিউ এম্পায়ারে একটা দৃশ্যের পরে আমি ছুটি সাজঘরে গিয়ে মেক-আপ বদল করছি, তখন যেন হন্তদন্ত হয়ে মহর্ষি এলেন। চোখের শিরাগুলো উত্তেজনায় লাল হয়ে ফুটে উঠেছে, নিশ্বাস দ্রুত। অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে বললেন- ‘এ-নাটক ক'রে আমরা ভালো কাজ করেছি। খু-ব ভালো কাজ করেছি। এ বারবার করা উচিত। বার বার।’- এর চেয়ে বড় আশীর্বাদ আর আমি কী পেতে পারি!

একটা নাটক অভিনয় করতে গেলে, আমি দেখেছি, যে প্রথম পড়ার পর যতোটা বুঝেছিলুম অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি বুঝি। এবং যেহেতু চার অধ্যায়- এর লেখক একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান ও অসাধারণ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ তাই মহলা দিতে দিতে ও অভিনয় করতে করতে এর অনেক নিগূঢ় অর্থ আমাদের কাছে যেন স্পষ্ট হয়েছে। এবং পরতে পরতে এইরকম জ্ঞানকে উপলব্ধি করার জন্যে মন যেন তখন উন্মুখ হয়েই ছিল।

চার অধ্যায়- এর মহলা শুরু করবার কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল যে এর সংলাপ বলতে ততো অসুবিধে হচ্ছে না। সহজ কথা বলার মতোই ব'লে নেওয়া যাচ্ছে।- এর একটা কারণ হ'তে পারে যে এর সংলাপের ভাষা খুব শহুরে। রবীন্দ্রনাথের অন্য নাটকের মতো- যেমন, রক্তকরবী বা রাজা-র মতো নয়। তাই হয়তো সহজ হয়েছিল।

আরো একটা কারণও হয়তো ছিল। শুরুতেই একবছর ধ'রে মহলা দেওয়া ও তারপর পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার-এর মতো বিভিন্ন ধরনের নাটক অভিনয় করার ফলে, আমাদের চেতনার মধ্যে অভিনয়ের যে নতুন প্রযুক্তিবোধ গ'ড়ে উঠছিল সেটাও সাহায্য করেছিল মনে হয়। তাছাড়া অভিনয় তো কেবল কৌশলের প্রয়োগ নয়, এতদিন যতো তীব্র ঘটনা-ধারার মধ্য দিয়ে চ'লে এসেছি তাতেও হয়তো রবীন্দ্রনাথের অনেক কথা অনেক স্পষ্টভাবে তখন ‘উপলব্ধি করতে পারছিলুম। অর্থাৎ এই বাস্তব জীবনটাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতেই রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক চিন্তার ও উপলব্ধির কাছে সাহায্য পেতে থেকেছি।

আর একটা কথাও হয়তো উল্লেখ করা যায়। আমি যাঁর কাছে প্রথম অভিনয় সম্পর্কে শিক্ষা পেয়েছি, বলতে গেলে তিনিই আমার অভিনয় শেখার গুরু, তিনি একটা কথা বলেছিলেন। তখন আমার বয়স ষোল। তিনি বলেছিলেন যে- উপন্যাসে লেখা থাকে যে কথাটা শুনিয়া তাহার মুখটা কেমন যেন বিষণ্ন হইয়া উঠিল। সে উঠিয়া জানালার সামনে যাইয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বাহিরের দিকে তাকাইয়া রহিল। পরে মুখ ফিরাইয়া আস্তে আস্তে বলিল... ইত্যাদি। কিন্তু নাটকে এতোসব বিবরণ কিছুই লেখা থাকে না। শুধু সে যা বললে, সেই ডায়ালগটুকুই লেখা থাকে। বাকি সবটা অভিনেতাকে ভেবে তৈরি ক'রে নিতে হয়।- আমার সেই ষোল বছর বয়সে কথাটা শুনে যেন চমক লেগেছিল।

তাই চার অধ্যায়-কে নাটকিত করার সময়ে যখন একে কেটেছেঁটে সাজানো হচ্ছিল তখনি এর চিন্তার ধারাটা, এর অনুভবের ধারাটা, জীবন্ত হয়ে বোধের মধ্যে আসছিল।- ফিল্মে যেমন গল্পটাকে সিনারিও ও শ্যুটিং স্ক্রিপ্টে বাঁধতে হয়, মঞ্চাভিনয়েও ঠিক তাই করতে হয়। এমন কি লিখিত নাটকের ক্ষেত্রেও। (বিশ্লেষণ করলে বোঝা যারে যে লিখে কোনো কথা প্রকাশ করবার প্রণালীর মধ্যে তার একটা নিজস্ব লজিক আছে; আর অভিনয়ে প্রকাশ করার প্রণালীর মধ্যেও একটা নিজস্ব লজিক আছে, যেটা ভিন্ন।)

দৃশ্যসজ্জাও করা হয়েছিল, আমাদের পূর্বাপর ধারা অনুযায়ী। সেসব বিবরণের মধ্যে এখন যাবার বোধহয় প্রয়োজন নেই।

কিন্তু এ নাটকে অভিনয় করতে করতে আরো অনেক কথা মনে হতে থাকে। ধর্মীয় উপলক্ষে আমাদের দেশে নানা জায়গায় নানা মেলা বসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ধর্ম বহুসময়েই মানুষকে মেলায় না। পৃথক করে। তাই আমাদের এই নানা ধর্মের দেশে যদি সামাজিক ক্রিয়াকলাপকে কেন্দ্র ক'রে এই উৎসব ও মেলাগুলো হয় তাহলে সকল ধর্মের লোকই নির্বাধা হয়ে মিলতে পারে। তাই কবি বৃক্ষরোপণ, হলকর্ষণ, বসন্তোৎসবের মতো secular উৎসবের প্রচলন করেন। কিন্তু আমাদের সমাজ সেগুলো গ্রহণ করেনি। বরঞ্চ হাতে যতো পয়সা বাড়তে থেকেছে ততোই নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জাঁকজমক বারোয়ারিভাবে বাড়তে থেকেছে।

কিন্তু কবি যে এই চেষ্টা করেছিলেন এটা যেদিন হৃদয়ঙ্গম হোল সেদিন যে কী পরিমাণ অভিভূত হয়েছিলুম তা বলতে পারি না। কি মহৎ লোক!

এর থেকেই একদিন মনে হতে থাকে যে কতো বড়ো বড়ো লোক, কতো বড়ো বড়ো সাহিত্যিকরা, যাঁরা দ্রষ্টা, তাঁরা যখন এই জীবনের কথা বলতে চেয়েছেন, এই জীবনের অন্তরের কথাটি প্রকাশ করতে চেয়েছেন, তখন তাঁদের ভাষা যেন কেমন রূপকের ভাষা হ'য়ে গেছে। ‘মীথ’-এর ভাষা। সমাজের চেতনার গভীর স্তরে স্তরে যে বোধ আছে, যে কল্পনা আছে, যতো গূঢ় অনুভবের উপলব্ধি জড়িয়ে আছে, সেসব যেন একমাত্র মীথ-এর পথেই আমাদের অন্তরের অন্ধকার অজানা তন্ত্রীগুলোকে গিয়ে স্পর্শ করে। তেমনিই এই আধুনিক যুগের এক মীথ-এর মতো বর্ণনা হচ্ছে রক্তকরবী।

এই সূত্রেই মনে হয় যে, তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের নামকরণ সম্পর্কে তিনি যেন বহুক্ষেত্রেই রূপকের আশ্রয়ে চ'লে গেছেন। মুক্তধারা-য় এক পাগল মা তার হারিয়ে-যাওয়া ছেলেকে ডেকে ডেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে ছেলের নাম সুমন। আজ উত্তরক'ট থেকে সেই সুমন হারিয়ে গেছে। সু-মন। এবং যে তাকে আর্তভাবে ডেকে ডেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে সে হোল অম্বাা। যার মানে হোল মাতা।

তেমনি এলা-র ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দেখলুম-যে ক্ষেপণ করে, দূর করে। অর্থাৎ সে যে বার বার অতীনকে দূরে সরিয়ে দেয়- সেই চিন্তা থেকেই কি কবি তার নামকরণ করেছিলেন? কী জানি! মনে বড়ো ভয় হয় যে, আমি এগুলো নিয়ে বাড়াচ্ছি না তো! হয়তো তিনি সবসময়েই এতো ভাবেননি। (এটা ভাবলে স্বস্তি পাওয়া যায়। কারণ আমরা তো এতো ভাবতে পারি না।) কিন্তু যদি না-ভেবেই তাঁর মনে এই নামগুলো ভেসে উঠতো তাইলে অবাক হ'তে হয় তাঁর অচেতন আর চেতন মনের সুছন্দ সাযুজ্য দেখে।

রক্তকরবী-র কিশোর নাম কি সে কিশোরবয়স্ক ব'লে, না তার নামই কিশোর? বাস্তব হিসেবেই তার নাম হ'তে পারে ‘কিশোর’, আবার সে কিশোরবয়স্ক ব'লে রূপকের মতো তার অভিধা হতে পারে ‘কিশোর’।- এই যে নানাস্তর এক সঙ্গে মিশে যাওয়া, একেবারে দেখ্তা-সত্যি থেকে গভীর দর্শনের সত্য পর্যন্ত এই-যে দোলন, এইটেই আমি এতাদিন ধ'রে সন্ধান ক'রে এসেছি। তাতেই তিনি যখন বলেন যে এ কাহিনী সত্যমূলক, বলেন যে এ কাহিনী কবির জ্ঞানবিশ্বাসমতে সম্পূর্ণ সত্য, তখন আমার সমস্ত মন সায় দিয়ে ব'লে ওঠে, ঠিক। আমারও জ্ঞানবিশ্বাসমতে এ কাহিনী অক্ষরে অক্ষরে সত্য।

তাছাড়া, তখন রবীন্দ্রনাথের নাটকের ভাষা সম্পর্কে কুসংস্কার এড়িয়ে বুঝতে শিখেছি যে প্রত্যেক বড়ো লেখকের লেখা পড়তে গেলে মনোযোগের সঙ্গে তাঁর বাকছন্দটা ধরবার চেষ্টা করতে হয়। নইলে কিছুতেই তাঁকে বোঝা যায় না। যেমন মেঘনাদ বধ কাব্য পড়তে আমাদের পিতৃপুরুষকে চেষ্টা করতে হয়েছিল। এবং যে-শিল্পী যতো মহৎ, যতো অরিজিন্যাল, ততোই তাঁর ছন্দ বোঝবার জন্যে বেশি ক'রে চেষ্টা করতে হয়। কারণ সে-ভাষার ছন্দ একটু বেশি রকম আলাদা হবেই।

এবং চার অধ্যায়ে পৌঁছবার আগেই আমরা এটা তো বুঝতে পেরেছি যে রবীন্দ্রনাথ লোকটি আমাদের মতো লোকের চেয়ে অন্তত হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান। সুতরাং তাঁর সংলাপের সেই ধারালো বুদ্ধিটা যদি না বোঝাতে পারি লোককে, যদি সেই সংলাপ বুদ্ধিবর্জিত ‘কাব্যিক-কাব্যিক’ সুরে পড়ি, তাহলে নিজেদের যে-টুকুও বুদ্ধি আছ, তারও অপমান ঘটাই।

অর্থাৎ অভিনয়ে একটা চরিত্রকে বাস্তবভাবে ফোটাতে শেখার পরই এই বাস্তবাতিরিক্ত প্রকাশভঙ্গী আয়ত্ত করতে হয়। সত্য হয়ে উঠতে শিখতে হয়।

এই বোধহয় মোটামুটি একটা বিবরণ। রবীন্দ্রনাথে পৌঁছবার অনেকগুলো চিন্তা স্পষ্টতর হোল।

তবু রাজা নাটককে ঠিকমতো সাজিয়ে নিয়ে অভিনয় করাতে আমার আরো দশ বছর লেগেছিল।

[কয়েকটি বক্তৃতার ভিত্তিতে (১৯৭৬-৭৮)]

শম্ভু মিত্র : বাঙলানাট্যের প্রবাদ পুরুষ।

[প্রবন্ধটি শম্ভু মিত্রের প্রবন্ধ সংকলন ‘সন্মার্গ সপর্যা’ গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো। অনেকের মন্তব্য, আমাদের সকল নাট্যকর্মীদের এই গ্রন্থটি অবশ্য-পাঠ্য হওয়া উচিত। সেই অভিপ্রায়ে নাট্যকর্মীদের আগ্রহ তৈরির জন্যই থিয়েটারওয়ালার এই পুনর্মুদ্রণ। বইটি ঢাকার -আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ ও বেইলী রোডের বুকস্টলগুলোতে পাওয়া যায়- সম্পাদক]