Full premium theme for CMS
বেহুলার ভাসান : এক নগর গায়েনের ভাষ্য
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
স্বপ্ন পূরণের আনন্দ অনেক। নাট্যকলা স্নাতকোত্তর পর্বে লোকনাট্যের নাটগীত ধারায় কাজ করা এবং নিজেই আবার সেই নাটগীতের গায়েনের ভূমিকায়- এ আমার অনেক স্বপ্নের মধ্যে অন্যতম এক স্বপ্নপূরণ।
এখনো বেহুলা ভাসে শ্রাবণের জলে
কলার মান্দাস যেন আকাশে-পাতালে
বেহুলার সেই ভাসানের সঙ্গে মিশে আছে বঙ্গনারীর রোজনামচা- নারী, এই আমার জীবন। আমার যাত্রাও যেন বেহুলার মতই সাত ঘাটের অভিজ্ঞতা অর্জন। আর তাই বেহুলার কষ্টকান্না যেন আমার বুক থেকেই বের হয়ে আসে।
শুরু যখন করি তখনও ঠিক জানতাম না আদলটা কেমন হবে, কোন আকারে কোন প্রকৃতিতে। ১০ মে ২০০৪ যখন প্রথম আমরা সকলে কলাভবনের তিন তলায় বসি, তখন শুধু এটুকু জানতাম যে আমরা লোকনাট্য করব- কাহিনী হতে পারে মনসামঙ্গল। কাণ্ডারী আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সৈয়দ জামিল আহমেদ ও সহযোগী আমাদের বড়ভাই সাইদুর রহমান লিপন।
শুরুতেই আমরা মনসামঙ্গলের ছয়টি নাটলিপিকে উপজীব্য করে এর কাঠামো নির্মাণে তৎপর হই। নারায়ণ দেব, বিজয় গুপ্ত, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিপ্রদাস পিপিলাই, বাইশ কবি ও তন্ত্র বিভূতির নাটলিপি পাঠ ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা সবাই একটি বিষয়ে একমত পোষণ করি যে, আমরা কে কোন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের নিজস্ব নাট্য আঙ্গিকের দিকে ফিরে তাকিয়েছি, সেটা অন্বেষণ করতে হবে। মনসামঙ্গল তথা পদ্মাপুরাণের মূল প্রতিপাদ্য হলো পূজা প্রাপ্তির মাধ্যমে দেবী হিসেবে মনসার উচ্চ সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ। বেহুলার ভাসান নাটগীত উপস্থাপন করতে গিয়ে আমরা পূর্বে দেখা বিভিন্ন অঞ্চলের লোকনাট্যের অভিনয় বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। খুঁজেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি লোকনাটক আসলে কেন। ‘লোক’ বৈশিষ্ট্যের কোন বৈচিত্র্যের কারণে তা দর্শকের দৃষ্টি এত সময় ধরে আকর্ষণ করে রাখতে পারে। উত্তর যা পেয়েছি তা হলো নাটকগুলো খুব বেশি তাদের নির্দিষ্ট এলাকার সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পর্কিত। ঘটনাগুলো খুব বেশি তাদের নিজেদের জীবনের ভালো লাগা, মন্দ লাগার প্রতিচ্ছবি।
যে প্রয়োজনের তাগিদে গ্রামের একজন কৃষক শ্রমজীবী মনসার গান শুনবে, নিশ্চিতভাবেই নাগরিক সুবিধাভোগী কোনো দর্শক সেই তাগিদ অনুভব করবে না। সঙ্গত কারণেই শহুরে জীবনে সাপের উপদ্রব বা ভয়বহতা ততটা প্রকট নয় বা ভয়াবহতা নেই বললেই চলে। গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি নাট্যানুষ্ঠানের সময়কেও। কারণ আজ এই আকাশ সংস্কৃতির ব্যস্ত আধুনিক শহুরে নাগরিক জীবনে আটঘন্টা, ছয়ঘন্টা বা ন্যূনতম চারঘন্টা বসে বসে নাটক দেখার সময় কোনো দর্শক বের করতে পারবেন কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তাই আমরা কাহিনীর বিষয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের জায়গা থেকে সরে গুরুত্ব দিয়েছি অভিজ্ঞতালব্ধ বোধকে, দেবী মনসা থেকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছি বাস্তবের নারী বঙ্গবালা বেহুলাকে, জীবন চেতনা দিয়ে লালন করেছি নাট্যকাঠামো, করেছি একান্ত আপন ব্যক্তিগত সত্তার বাহন। গর্ভের মতোই ধারণ করেছি আপন হৃদয়ে, আনন্দাশ্রুর মতোই তা ভূমিষ্ট হবে, এই আশা রেখেছি মনে।
লোকনাটককে যখন শহুরে রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপন করা হয়, তখন তাতে কিছুটা ভিন্নতা আসবে বৈকি! খোলা কোনো চত্বরের পরিবর্তে যখন তা মিলনায়তনের গণ্ডীর মধ্যে উপস্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তখন নিশ্চিতভাবেই মঞ্চ পরিকল্পনা আলোক পরিকল্পনা ও পোষাক পরিকল্পনার মতো কিছু বিষয় আমাদের সামনে চলে আসে।
মঞ্চ পরিকল্পনায় শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের ‘কান্দে না বিষহরির’ আঙ্গিক অনুযায়ী চৌদিকে দর্শকাসন এবং মধ্যখানে ভূমি সমতল বৃত্ত (এরেনা) মঞ্চ ব্যবহারে নির্দেশকের ভাবনা ছিল যার নাগরিক-নান্দনিক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন শিক্ষক কামালউদ্দিন কবির। শুরুতেই ভাবনা ছিল মঞ্চ মিলনায়তন সমতল থেকে এক ফুট উঁচু কাঠের দ্বারা নির্মিত হবে। এরপরই ধীরে ধীরে তাতে মাটির রং এর সাজেশন হিসেবে চটের প্রলেপ ও আলপনা দিয়ে লোকভাবটি এসেছে আরো নান্দনিকতার ছোঁয়ায়। এছাড়া শুরুতে সাধারণ খড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে লখিন্দরের মৃতদেহ। যা পরবর্তী সময়ে মঞ্চে ব্যবহৃত হয়েছে নাট্যস্থিত বিভিন্ন বাঁকের স্থান বোঝাতে- যা নাট্যের শেষে আবারও লখিন্দরের মৃতদেহতে রূপান্তরিত হয়। মঞ্চের চারপাশে গায়েন, দোহার ও বাদকদের বসার স্থানে খড়ের ব্যবহার বরায় দর্শকবৃন্দ স্মৃতিতে আরেকবার ফিরে গিয়েছেন বাংলার চিরন্তন সেই লোকজ নাট্যনুষ্ঠানের আবহে। এছাড়া মঞ্চে ব্যবহার করা হয়েছে তিনটি কাঠের বাক্স, সেখানেও রয়েছে লোকজ আঙ্গিকের আলপনা।
লোকনাট্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এ নাট্যের আলো ছিল সবসময়ের জন্যই ফ্লাড কোয়ালিটি সম্পন্ন। আলোর মাধ্যমে কোনো প্রকার মুড, সময় ও স্থান বোঝানোর চেষ্টা করা হয়নি। এক কথায় আলো কোনোভাবেই মায়া বিভ্রম সৃষ্টিকারী ছিল না।
উল্লেখ্য, লোকনাট্যের কোনো দল তাদের পালা বা নাট্যানুষ্ঠান উপস্থাপনের চারদিকে চারটি খুঁটিতে হ্যাজাক লাইট, ইদানিং বৈদ্যুতিক বাতি সুবিধা ও সাধ্যমতো ব্যবহার করেন। একজন শিক্ষিত নাগরিক অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমরাও আমাদের সুবিধাগুলোকে কাজে লাগিয়েছি।
পোশাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সমানভাবে। মাঠ পর্যায়ে লোকনাট্য পর্যবেক্ষণে আমরা দেখেছি যে, সেখানে পোশাকের দিকটি ভাবা হয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে, তারা তাদের সাধারণ জ্ঞান ও নান্দনিক বোধের মাধ্যমেই এই কাজটি সুচারুরূপে করে থাকেন। পোশাকে দেখা যায় বাহারি রং ও নকশা। নাট্যকলার শিক্ষার্থী হিসেবে এর পিছনের যুক্তিগুলোকে অনুধাবনের চেষ্টা করি। স্নাতকোত্তর প্রযোজনার জন্য বেহুলার ভাসান করতে গিয়ে গায়েন হিসেবে আমি আরেকবার সেই যুক্তিকে উপলব্ধি করেছি। লোকনাট্যে যেহেতু মঞ্চ ও আলোর বাহারি ব্যবহার নেই, তাই অভিনেতা এবং শুধু অভিনেতাই এখানে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তাই অভিনেতাকে সর্বাধিক গুরুত্বদানের প্রচেষ্টায় পোষাকে রং ও নকশায় রাখা হয় বৈচিত্র্য ও উজ্জ্বলতার ছোঁয়া-যেন সহজেই দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। আরেকটি দিক হলো দর্শকের নানারকম পোশাকের ভিড়ে যেন তা হারিয়ে না যায়। সবার আগে নির্দেশক একটি বিষয়ে দৃষ্টি রেখেছেন, সেটা হলো পোশাক দেখতে যেন ভালো লাগে, পুরো ব্যাপারটি যেন একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ও চরিত্রের প্রদত্ত ভাবের যথাসঙ্গত হয়। মঞ্চের চটের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই দোহার ও বাদক দলের পোশাকে রয়েছে হালকা শ্যাঁওলা রঙের ছোঁয়া। পোশাক পরিকল্পনায় দোহার ও বাদক দলের পোশাকের ছাঁটে রাখা হয়েছে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সর্বজনীনতা- সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই যেন না বোঝা যায় তারই প্রচেষ্টা করা হয়েছে। ফতুয়ার সঙ্গে নিচে পরিধেয় কাপড়ের ছাঁটে রাখা হয়েছে একই সঙ্গে পাজামা ও ধূতির সাজেশন। দোহার, বাদক দলের পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই গায়েনের পোশাক শাড়িতে রাখা হয়েছে গাঢ় শ্যাওলা রঙের ছোঁয়া, সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ। ব্লাউজের ডিজাইন ও শাড়ি পরার ধরনে রয়েছে বাঙ্গালি আটপৌড়ে ধাঁচ। ঘাড়ে কমলা ও লাল(মেরুন) টাই-ডাই চুন্দ্রি করা ওড়না। নকশায় ও রঙে তা রেখেছে ভিন্নতর বৈশিষ্ট ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। পরার ধরনে রয়েছে বরিশাল পটুয়াখালি অঞ্চলের রয়ানি গানের গায়েনের সঙ্গে সাদৃশ্য। বেহুলার পোশাকে রাখা হয়েছে গ্রামীণ নববধুর সাজ ও রঙ। কমলা রঙের জমিনে গাঢ় কমলার জলছাপ শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ, একইভাবে ব্লাউজের ছাঁটে ও পড়ার ধরনে রয়েছে আটপৌড়ে বাঙালি নববধুর ছাপ। সপ্তপুরুষের মূল পোশাকে রয়েছে বাদক-দোহারের পোশাকের অভিন্নতা। কিন্তু চরিত্রান্তরে লক্ষ্য করা যাবে সংস্কৃত নাটকের পোশাকতত্ত্ব অনুযায়ী প্রদত্ত ভাব, রস ও সামাজিক স্তর অনুযায়ী উত্তরীয়ের ব্যবহার। যেমন শুরুতেই চাঁদ সওদাগরের উত্তরীয়ের রঙ নীল, হরিসাধু ও নারায়ণ দানীর উত্তরীয় ও কোটির রঙ যথাক্রমে ফিরোজা ও নেভী-ব্লু। এভাবে চরিত্রের বয়স, বৈশিষ্ট অনুযায়ী রঙ ও বুনট নির্বাচন করা হয়েছে। গোদার চরিত্রে দেয়া হয়েছে নেভী-ব্লু ও পেস্ট টাই-ডাই সুতি চুন্দ্রি ওড়নার পাগড়ি, চাঁদ সওদাগর ও হরিসাধুর উত্তরীয় হয়েছে নীলের গাঢ় ও হালকা শেডের সার্টিন ওড়না, ভণ্ড তপস্বী ফিরোজা রঙের কাপড়ে গোলাপী ব্লক, শকুন চরিত্রে বেগুনী পলেস্টার কাপড়ে একই সঙ্গে উত্তরীয় ও পাখির ডানার ছাঁট। নারায়ণ দানীর চরিত্রে নেভী-ব্লু রঙের শক্ত রাফ কাপড়ের ছোট কোটি।
বেহুলার ভাসান প্রযোজনায় অভিনয় শিল্পীদের কোনো রূপ-রচনা (মেক-আপ) ব্যবহার করা হয়নি, তারপরও বিশেষ করে গায়েনের মুখে ছিল রয়ানী গানের গায়েনের অনুরূপ বড় লাল টিপ ও আলপনা, মাথায় সিঁথি ও খোপা। বেহুলার চুলে তেল, সিঁথিতে ও কপালে ল্যাপ্টানো সিঁদুর এবং মুখে তেল দিয়ে তেলতেলে করা; গায়েন ও বেহুলা দুই চরিত্রেরই হাতে ও পায়ে আলতা দিয়ে আলপনা আঁকা। এছাড়া আর কোনো প্রকার প্রসাধনের ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল- এমনকি হাত ও পায়ের নখ ছোট রাখা হয়েছে কিনা নিদের্শক প্রতিদিন তা পরীক্ষা করতেন।
লোকনাট্যে পোশাক ও দ্রব্য-সামগ্রী ব্যবহারে লক্ষ্য করা যায় বিশেষ মুন্সিয়ানা। আমাদের প্রাচ্য লোকরীতিতে দ্রব্য-সামগ্রী ব্যবহারে কখনো মূুকাভিনয়ের আশ্রয় নেয়া হয় না। এক্ষেত্রে বরং সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষনীয় নাট্যিক দিক হলো একই দ্রব্যের বহুভিন্ন ব্যবহার। যেমন একটি মাত্র বালিশই কখনো বই, কখনো পত্র, কখনো ঘোড়া, কখনো কোদাল রূপে ব্যবহৃত হয়। আবার একইভাবে হয়তো গলার মালা ব্যবহৃত হয় চাবুকের বিকল্প হিসেবে অথবা বায়েনের ঝাঁঝ দ্বারা থালা বা খেলনা পুতুলের সাহায্যে বাচ্চা বোঝানো হয়। বেহুলার ভাসান-এ-ও দ্রব্য-সামগ্রী ব্যবহার ও নির্মাণে দেয়া হয়েছে সবিশেষ গুরুত্ব। গোঁদার বড়শি, জুয়াড়ির কলস বা ভণ্ড তপস্বীর ছড়ি ও জপমালায় আনা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন উজ্জ্বলতা ও সৌন্দর্য এবং একইসঙ্গে সামঞ্জস্য। কাজটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও মতামতের ফলে তা সম্ভব হয়েছে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
বহিরঙ্গ থেকে আসি অন্তরাত্মায়- অভিনয়শিল্পী ও অভিনয় প্রসঙ্গে। নাট্যশিক্ষার্থী ও গবেষক হিসেবে আমরা নির্মাণ করার চেষ্টা করেছি আমাদের নিজস্ব নাট্য আঙ্গিকের অভিনয় তত্ত্ব। মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ থেকে খোঁজার চেষ্টা করেছি অভিনেতা-গায়েনের প্রস্তুতি ও চরিত্র নির্মাণ কৌশল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নাট্যকর্মী হিসেবে দেখতে চেয়েছি অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত গ্রামের একজন শ্রমিক, প্রান্তিক চাষি প্রায় নিরক্ষর অভিনয়শিল্পী কীভাবে তাঁদের নিজের মতো করে চরিত্র নির্মাণ (Charactarization), বর্ধন (Dialation), অথবা অভিনয় প্রস্তুতিপর্ব (Preparation) সম্পাদন করেন। মিলিয়েছি পাশ্চাত্যরীতির অভিনয় তত্ত্বগুলোর সঙ্গে আরেকবার। স্তানিস্লাভস্কি, গ্রটস্কি, মায়ারহোল্ড, ইউজিন ’ও বারবা প্রমুখ নাট্যবিদদের নাট্যাভিনয়ের তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়েছি এই দেশীয় অভিনয়রীতি। সেলিম আল দীনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী ও প্রাচীন অভিনয় শাস্ত্র ‘ভরত নাট্যশাস্ত্র’ অভিনয় তত্ত্বের সঙ্গে। বেহুলার ভাসান নাট্যগীত উপস্থাপন করতে গিয়ে তিন প্রধান চরিত্রায়ণে অভিনয় তত্ত্ব ও প্রয়োগের দিকটি সযত্নে সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। গায়েন, বেহুলা ও সপ্তপুরুষ চরিত্র নির্মাণে সংস্কৃত নাট্যতত্ত্ব ভরত নাট্য শাস্ত্রের শক্তি ভেদে সাহায্য নেয়া হয়েছে- লিঙ্গ ভেদে- পুরুষ- তাণ্ডব (Animus _ Vigorus energy), নারী- লাস্য (Anima _ Soft energy).
বেহুলা চরিত্রায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে লাস্য অভিনয়ের। সঙ্গে রয়েছে স্তানিস্লাভস্কি অভিনয় তত্ত্বের চরিত্র নির্মাণ ও অভিনয় তত্ত্বের সূক্ষ্মতার দিকগুলো। অপরপক্ষে সপ্তপুরুষ চরিত্রায়নে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তাণ্ডব (Animus _ Vigorus energy) এর উপর। এর সঙ্গে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ব্রেখটীয় অভিনয় তত্ত্বের উপর। চরিত্রগুলো রূপায়ণে এমন কিছু নির্বাচিত সংকেত প্রযুক্ত যেন সহজে চরিত্রটিকে চিহ্নিতকরণ সম্ভব হয়। গায়েনের চরিত্রায়নে Anima এবং Animus (লাস্য এবং তাণ্ডব) দুই energy কেই মূখ্য অভিনয় উপাদানরূপে অনুশীলন করা হয়েছে। একই অঙ্গে বহুরূপ গায়েন যেন একই সঙ্গে একজন সজ্ঞান বিশ্লেষণকামী নারী ও বেহুলার প্রতিরূপ। একই দেহে দুইরূপ। ড. সেলিম আল দীন এর দেশজ নাট্যাঙ্গিক ও অভিনয় উপাদানের বর্ণনার সেই দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্পতত্ত্বের সফল প্রয়োগের চেষ্টা করেছি আমরা। গায়েন হিসেবে আমি নির্দেশকের সঙ্গে খুঁজতে চেষ্টা করেছি গায়েনের শিল্পশক্তির দিকটি। নাগরিক অভিনেতা হিসেবে দর্শকভীতি কম-বেশি বোধকরি প্রায় প্রত্যেক অভিনেতারই থাকে আলোকিত প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের সক্রিয় অংশগ্রহণে তাঁদের চোখে চোখ রেখে গল্প বলে যাওয়া আমার জন্য ছিল একই সঙ্গে প্রচণ্ড ভীতিপ্রদ এবং চ্যালেঞ্জর বিষয়। চারদিকে দর্শকথ নিজেকে লুকানোর এতটুকু জায়গা নেই। বারবার তাই খুঁজেছি গায়েনরা তাঁদের প্রদর্শনীতে কী করেন, কীভাবে দর্শকদের কাহিনীর মধ্যে সম্পৃক্ত করিয়ে নিয়ে চলেন। কৌশলগতভাবে গায়েন নিজের শরীর ও মনকে বর্ধিত (Dialation) করেন। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করে প্রচণ্ড ধর্মীয় বিশ্বাস ভক্তি ও কৃত্য-ভাব।
বাংলাদেশের লোকনাট্য মাঠ পর্যায়ে গবেষণা পর্যবেক্ষণ পর্যায়ে মনসা বিষয়ক ধর্মীয় উপাখ্যান কান্দে না বিষহরির গান আখ্যানের গায়েন শ্রী দেবেন্দ্রনাথ রায় অনুষ্ঠান পরবর্তী সাক্ষাতকারে আমাদের জানান যে তিনি পরিবেশনার দিন সকাল থেকেই উপবাস বা ব্রত পালন করেন। সামান্য চিড়া-মুড়ি ছাড়া কিছু আহার করেন না। মনসার পূজা এবং দেবী স্বরস্বতীর পূজা দেয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্বাস করেন যে স্বয়ং স্বরস্বতী তাঁর উপর ভর করেছেন এবং মনসা দেবী সহায় আছেন। আসরে তিনি নন, স্বরস্বতী দেবীই তাঁকে দিয়ে গান (পরিবেশন) করিয়ে নেন। এমনকি গায়েন আসর শুরুর আগে ও শুরুর সময়ে মন্ত্রে ও তন্ত্রের মাধ্যমে ‘আসর বন্ধ’ করেন যেন কিছুতেই তা ভণ্ডুল না হতে পারে। কিন্তু নগর গায়েন হিসেবে এই কৃত্য পদ্ধতি কিছুতেই তো খাঁটে না আমার সঙ্গে। আমাদের নাট্য আঙ্গিকের সঙ্গে। তাহলে উপায়! আমার আশ্রয় তবে কি মেডিটেশন ও ফোকাস গেমস? গায়েন হিসেবে মঞ্চে দাড়িয়ে আমি পুরো মিলনায়তনকে ধরে নিতাম এই হলো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, এর ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে আমি দাঁড়িয়ে আছি- আমি গায়েন, যা শুধু আমি নই, একজন গায়েন অথবা আমার এবং গায়েনের মাঝামাঝি অন্য আর কেউ- সেই অন্যটিকে, আমার দ্বিতীয় সত্তাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, লালন করেছিলাম মনের গহীনে সযতনে। এভাবেই একটু একটু করে অঙ্কুরিত ভ্রুণের মতোই আমরা (সমস্ত কলাকুশলী) লালন করেছি ভিন্ন এক সত্তাকে কিংবা কী জানি হয়তো নিজেরই অজানা প্রিয় সত্তাটিকে। এরকম অক্লান্ত ভালোলাগা পরিশ্রমের ফসল আমাদের পূর্ণাঙ্গ ভালোবাসার অবয়ব বেহুলার ভাসান। আর এভাবেই একটি প্রযোজনা অপ্রাতিষ্ঠানিকতার মুক্তাঙ্গন থেকে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তাত্ত্বিক নির্মিতির মাধ্যমে।
প্রযোজনার ভূয়সী প্রশংসার পাশাপাশি অনেক সমালোচনাও এসেছে বিদগ্ধ দর্শককূল থেকে। যেমন- অনেকেই বলেছেন- গ্রাম বাংলার সত্যিকারের লোকনাট্যে এত তত্ত্ব ধরাবাধা নিয়ম বা পূর্ব প্রস্তুতিমূলক কাঠামোর এত কড়াকড়ি নেই, এতো নীট এ্যান্ড ক্লীননেস’ও নেই। এতো সাজানো গোছানো এবং পূর্ব পরিকল্পিত পরিবেশনাকে ‘লোক’ বলা যায় কতটুকু? এই পশ্নে আমরাও থমকে দাঁড়িয়েছিলাম মুহূর্তকাল- তারপর আবারও প্রামাণ্য অনুসন্ধান, স্বপক্ষের যুক্তি বা যুক্তিসমূহ মিলিয়ে দেখি আমরা। বিভিন্ন এলাকার লোকনাট্যদল সম্পর্কে অনুসন্ধানে বের হলে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দা- দর্শকই বলে দেন যে মনসামঙ্গলের অমুকের দলটি ভালো বা কালীকাঁচ এ উনি ভালো অথবা কবির গানে বিখ্যাত গীতা রাণী সরকার। এর অর্থ কী? কেন তা অন্যান্য দলগুলো থেকে উৎকৃষ্টতর? কারণ এই দলগুলোর পরিবেশনায় গীত, সংলাপ, বাদ্য, পোষাক ও বৈচিত্র্যের বিশিষ্টতা। এই বিশিষ্টতা ব্যক্তির মেধা এবং প্রচেষ্টার ফসল। ব্যবহারিক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে তাত্ত্বিক নির্মিতি- অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন গায়েন বা কুশলী নিজের জীবনের বহুবছরের অভিজ্ঞতার আলোকে যা করেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন নাট্যকর্র্মী হিসেবে চর্চা ও নিরীক্ষণের মাধ্যমে সচেতনভাবে আমরা কি আরো নির্ভুলভাবে আরো সুচারুরূপে নিজেদের আখ্যান উপস্থাপন করার যোগ্যতা রাখি না? সবাই তাদের নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী উৎকর্ষের চরম শিখরে ওঠার আকাঙ্খা পোষণ করবে এটাই স্বাভাবিক, ইচ্ছাকৃত ভুল, অযত্নে বা বিন্যাসে অবহেলা শুধু অযোগ্যতার বাহকই নয়, হাস্যকরও বটে। আর এইসব কারণেই আমার কাছে মনে হয় গ্রাম-বাংলার বাস্তবতা আর শহরকেন্দ্রীক নগরজীবনের বাস্তবতা দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপট হলেও মৌলিক উপাদান ও আঙ্গিকের প্রয়োগে বেহুলার ভাসান নাটগীত সার্থক লোকনাট্যের নিঃসন্দেহে দাবীদার। আর তাই শুধু যাদুঘরে সংরক্ষিত আঙ্গিকরূপে নয়, লোকনাট্য আঙ্গিকের সঠিক ও সফল প্রয়োগ আজকের এই ব্যস্ততম নগরজীবনেরও গতিশীল প্রয়োগ প্রয়োজন। আর কত ভিক্ষাবৃত্তি, আর কত নকলনবীশতা- অন্যের পুচ্ছ আপন গাত্রে ধারণ?
ফরিদা আকতার লিমা : প্রাক্তন শিক্ষার্থী, নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।