Full premium theme for CMS
যা দেখেছি
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
ভারতবর্ষের অন্যান্য অংশে নাটক ও অভিনয়ের কী ধরনের প্রচেষ্টা চলেছে সে সম্পর্কে আমাদের ওয়াকিবহাল থাকা খুব দরকার। কীভাবে সেইসব রাজ্যের শিল্পীদের মন কাজ করছে, কীভাবে তাঁরা আধুনিক প্রচেষ্টার সঙ্গে ঐতিহ্যাশ্রিত নাট্যরূপের মিলন ঘটাচ্ছেন কিংবা আদৌ সে মিলন ঘটাতে চাচ্ছেন কি না, -এ সব খবরই আমাদের জানা দরকার। তেমনি দরকার ভারতবর্ষের নানান অংশের-যাকে বলা হয় লোকনাট্য, তারও নাট্যরূপের প্রকরণ জানবার। এইগুলো না জানলে সারা ভারতবর্ষে যে নাট্যকৃতির স্রোত চলেছে তার থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তখন কূপমণ্ডুকতার সংকীর্ণতা আমরা দূর করতে পারি না। তাছাড়া, খুব সহজ ভাষায় বলা যায় যে, একটা ভালো জিনিস দেখলে যে আনন্দ পাওয়া যায় তার সবটা তো আমাদেরই জমার খাতায় যোগ হবে, সে লাভটা ছাড়বো কেন?
বহুদিন আগে মারাঠী ‘তামাশা’ দেখেছিলাম। (এইরকম তামাশা ও অন্যপ্রদেশের যাত্রার কিছু উল্লেখ আছে আমাদের প্রায় একুশ বছর আগে-করা বিভাব নাটকের মধ্যে) আবার দেখলুম, বছর দেড়েক আগে বোধহয়। কী আশ্চর্য রূপারোপ। কতো সহজ কতো সাবলীল। আর কি অভিনয়। ঐ বৃদ্ধ অভিনেতা যদি বিলেতের বা জার্মানীর বা ঐরকম কোনো দেশের হতেন তাহলে তাঁর আশ্চর্য অভিনয়কৌশল সম্পর্কে অজস্র লেখা হোত, বই বেরুতো, এবং আমরা ... সেগুলো প'ড়ে কী করতুম?
একবার ‘নৌটাঙ্কি’ দেখেছিলুম। যতদূর মনে পড়ে হাথরাসের দল। অপূর্ব নাট্যরূপ। আর বিশেষ ক'রে একজন অভিনেত্রীর গান ও অভিনয় আমাকে মোহিত ক'রে দিয়েছিল। অভিনয়ের পরে ভিতরে গিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলুম। সাধারণত আবেগময় অভিনয়ের পর নটনটীরা যেমন ভীষণ সংযত ও নিস্তব্ধ হয়ে যায় তিনিও তখন তেমনি সুদূর হয়ে আছেন। আমি উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসা জ্ঞাপন ক'রে চ'লে এলুম। পরে শুনেছিলুম যে নির্দেশকের সঙ্গে তাঁর অনেক কলহ চলছিল এই প্রযোজনার শুরু থেকে, আর আমি দেখা করতে গিয়েছি সেই নির্দেশকেরই সঙ্গে, সেটাও একটা কারণ ছিল হয়তো তাঁর দূরত্বের। তাই বহুবার মনে হয়েছে, যদি অন্য সময়ে তাঁর সঙ্গে আর একবার আলাপ হোত তো ভালো লাগতো।
গান্ধীজীর হত্যা নিয়ে একটি নাটকাভিনয় দেখেছিলুম দিল্লীতে। একটি গুপ্ত গোষ্ঠী গান্ধীজীকে হত্যা করা হবে কি হবে না এই তর্কের মীমাংসা করবার জন্যে একটি বিচারের অনুষ্ঠান করে। গান্ধীজীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয় এবং একজন গান্ধীজীর পক্ষে তাঁর উক্তিগুলোকে উদ্ধৃত ক'রে তাঁকে সমর্থন করে। এ নাটকের মঞ্চরূপ এবং অভিনয় আমার খুবই ভালো লেগেছিল।
আমাদের এখানে শুনেছি বাঙ্গালি ছেলেরা সিনেমাঘরে গান্ধীজীর ছবি দেখলেই অশ্লীল চীৎকার করতো, তাঁর গ্রন্থাবলী যে-দোকানে বিক্রি হোত তার ওপরেও নাকি ‘বৈপ্লবিক’ আক্রমণ হয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত বুদ্ধিহীন ফ্যাশিস্টসুলভ আচরণ না ক'রে যদি এমনি একটা নাটকই তারা লিখতো সত্যবাদিতার সঙ্গে, তাহলে দেশের উপকার হোত। -যাই হোক, এই অভিনয় দেখেই দিল্লীর ‘অভিযান’ নাট্যগোষ্ঠীর সম্বন্ধে আমার শ্রদ্ধা হয়।
শ্রীমোহন রাকেশের আষাঢ় কা একদিন ভারতবর্ষে বহু জায়গায় অভিনীত হয়েছে। নাটকটাও আমার এক বন্ধু আমাকে প'ড়ে শোনান। যে-কোনো কারণেই হোক আমি যথেষ্ট মুগ্ধ হইনি। কিন্তু কলকাতায় শ্রীশ্যামানন্দ জালান যখন শ্রীমোহন রাকেশের লহরোঁ পে রাজহনস অভিনয় করলেন আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম। বিশেষ ক'রে শেষের দৃশ্যে শ্রীশ্যামানন্দের অভিনয় গভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ ও ব্যঞ্জনাময়। সচরাচর যে-সব অভিনয় দেখে আমরা প্রশংসা করি এ-অভিনয় সে-জাতেরই নয়। এ আলাদা, এ একটা বড়ো অভিনেতার স্তরের অভিনয়।
পরে শুনেছি ঐ শেষটুকু বদলে অভিনেয় ক'রে নেওয়ার জন্যে নির্দেশক ও লেখক শেষের কয়েকটি দিন অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। এবং সার্থক হয়েছিল সে পরিশ্রম। এই শেষের দৃশ্যের অভিনয় দেখেই আমার মনে হোল যে অভিনেতা শ্যামানন্দ এইবার বোধহয় তাক পেয়ে গেছেন।
শ্রীমোহন রাকেশ আধে অধুরে লেখার পর একদিন কয়েকজন বন্ধুকে আমন্ত্রণ ক'রে সবটা প'ড়ে শোনান। তাতে সাধারণ কথোপকথনের ভাষার মধ্যে যে-নাটকীয়তা তিনি এনেছেন তাতে আমি মুগ্ধ হই। এবং এরপরে দুটি একাঙ্ক নাটক তাঁর মুখে আর একদিন শুনে আরো মুগ্ধ হই। তাঁর পড়ার মধ্যে যে অভিনয়ধারা প্রকাশ পায় সেটা এতো সহজ ও এতো অর্থপূর্ণ যে অভিনেতাদের পক্ষে এটা অনুকরণীয়।- তাইতো হয়। যখন একজন দক্ষ নাটককার আসেন তখন তিনি একটা নতুন কথ্যভঙ্গী নিয়ে আসেন, এবং সেটা আমাদের শেখবার মতো। শ্রীমোহন রাকেশ নিঃসন্দেহে আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটককার।
হিন্দীতে এই যে নতুন একজন বলিষ্ঠ নাটককারের উদ্ভব হোল, এর পরিপ্রেক্ষিত কী? বহুদিন আগে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে, বোম্বাইয়ে শ্রীথ্বীরাজ কাপুর নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন। তার পূর্বে হিন্দীতে এ ধরনের অভিনয়গোষ্ঠী ছিল না। (‘এ ধরনের’ অর্থে আধুনিক বোঝাচ্ছি, committed বোঝাচ্ছি, পেশাদারী পরিচ্ছন্নতার কথাও বোঝাচ্ছি। সেই সময়ে দীওয়ার, পাঠান, গদদার প্রভৃতির অভিনয় আমাদের কলকাতার তৎকালীন ‘সাধারণ’ মঞ্চের নাট্যপ্রযোজনার চেয়ে ঢের বেশি আধুনিক ও উন্নতধরনের লাগতো।) অপরদিকে আর একরকম নাটক লেখা হোত যার অভিনয় মোটামুটি কলেজ ইউনিভার্সিটির মধ্যেই মাঝে মাঝে হোত। তার মধ্যে পূর্বের শ্রীজয়শঙ্কর প্রসাদ থেকে পরের শ্রীউপেন্দ্রনাথ আশক পর্যন্ত ছিলেন।
তারপর যে-কোনো কারণেই হোক পৃথ্বী থিয়েটার্সের জৌলুষের দিন কেটে যেতে লাগলো। তখন হিন্দী অঞ্চলে এমন অনেক লোকের দেখা পেয়েছি যাঁরা উপরোক্ত দুই ধারার কোনোটিকেই যথেষ্ট মনে করছেন না। আমরা যখন প্রথম জাতীয় নাট্যোৎসবে দিল্লীতে রক্তকরবী ও ছেঁড়াতার করতে যাই তখনো খুব একটা বলবার মতো নাট্যপ্রচেষ্টা সেখানে দানা বেঁধে ওঠেনি। কিন্তু কাজ শুরু হয়ে গেছে। পাঞ্জাব থেকে, শিমলা থেকে, এবং উত্তর প্রদেশ থেকে নানান্ নাট্যপ্রেমী লোক দিল্লীতে এসেছেন, আসছেন, ও ইতস্তত কাজ শুরু করেছেন। এবং ক্রমশ দিল্লী হিন্দী সংস্কৃতির কেন্দ্র হয় উঠলো। তার ফলে ভারতের নানন ভাষায় যে সমস্ত নাটক সুনাম পাচ্ছে তাদের হিন্দী অনুবাদ বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রীবাদল সরকারের নাটক যেমন অনুদিত হয়েছে, তেমনি হয়েছে শ্রীবিজয় তেন্ডুলকরের, তেমনি হয়েছে শ্রীগিরিশ কার্নাড’র। এই যে সর্বভারতীয় পরিপ্রেক্ষিত জানবার আগ্রহ, সবটাই পরখ ক'রে দেখবার আগ্রহ, এই মনোভাবেই শ্রীমোহন রাকেশের উদ্ভব এবং দিল্লীতে হিন্দী থিয়েটারের ভিত পত্তন হওয়া সম্ভব হোল। ‘অভিযান’-এর মতো একটি গোষ্ঠীকে সেখানে বাকি ইতিহাস করতে দেখেছি, শ্রীখানোলকের এক শূন্য বাজীরাও করতে দেখেছি, শ্রীবিজয় তেন্ডুলেকরের নাটক করতে দেখেছি, -এবং সব সময়ে বিভিন্ন ভাষার নতুন নাটকের অনুসন্ধান করতে দেখেছি। কেবল ভারতীয় ভাষার। পশ্চিমের নয়।
বোম্বাই শহরও এমন একটি জায়গা যেখানে বছরের প্রত্যেক দিন অভিনয় হয়। এবং ছুটির দিনে বা রবিবারে যে কতো অভিনয় হয় তার ইয়ত্তা নেই।
সেখানে মারাঠী নাট্য আছে, গুজরাতি নাট্য আছে, হিন্দী নাট্যও আছে। এর মধ্যে মারাঠী নাটমঞ্চেই বোধহয় বেশি উল্লেখযোগ্য নাটককার এসেছেন, সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য অভিনেতা এসছেন। বিগত শতাব্দীতে কলকাতায় যখন প্রথম মঞ্চনাট্যের প্রচেষ্টা হচ্ছিল তখন বোম্বাই শহরেও শুরু হয়েছে। মারাঠীদের এলাকা গিরগাঁওয়ে একটি মঞ্চ চালানো হয়েছিল।
যাই হোক, পুরানো ইতিবৃত্তের কথা থাক। কিন্তু কিছুদিন আগের শ্রীবালগন্ধর্ব স্ত্রীভূমিকায় যে অপূর্ব অভিনয় করতেন, এবং তাঁর গানের যে অপরিমেয় খ্যাতি ছিল একথা বোধহয় বাঙালি বহু নাট্যরসিকই আজ জানেন।
অভিনয়েও মারাঠী নাটমঞ্চের প্রচুর গৌরব। কিন্তু কলকাতায় যেমন স্থায়ী গৃহে পেশাদারী নাট্যসংস্থা সারা বছর অভিনয় ক'রে যায়, এ ঘটনা বোম্বাইয়ে নেই। তার কারণ, মহারাষ্ট্রে বোম্বাই যখন গ'ড়ে উঠছে তখনো পুণা, কোলহাপুর, শোলাপুর ইত্যাদি নানান পুরানো শহরের প্রতাপ মোটেই খর্ব হয়ে যায়নি। ফলে মারাঠী নাট্যসম্প্রদায়গুলো ভ্রাম্যমাণ ছিল, সারা বছর বোম্বাইয়ে ব'সে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওদিকে তখন সিনেমা কোম্পানীরা ঐসব প্রেক্ষাগৃহগুলো নিয়ে নিয়মিত বায়স্কোপ দেখানো শুরু ক'রে দেয়। ফলে নাট্যসংস্থাগুলো বোম্বাই শহরে যেন বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়লো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরেও অনেকদিন পর্যন্ত নাট্যভিনয়ের, বলতে গেলে, প্রায় একটি প্রেক্ষাগৃহই ছিল। প্যারেলে দামোদর হল।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম সম্মেলনের সময়েই দামোদর হলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন তার চেহারা দেখে মনে হয়েছিল কলকাতার মঞ্চেগুলো ঢের ভালো। সেটা ১৯৪৩ সাল।
এবং সেইখানেই আমি অনেকদিন পরে-তবে, আজ থেকে অনেকদিন আগে-বিখ্যাত শ্রীরাঙ্গনেকরের সংস্থার অভিনয় দেখি।
আর আজ কেউ একবার বোম্বাইয়ে গিয়ে দেখে আসুক সেখানকার আধুনিক প্রেক্ষাঘরগুলো- আমরা ইতরোমি করেছি, অন্য জায়গায় লোক কাজ করেছে।
শ্রীরাঙ্গনেকরদের সময় চলে গিয়ে এখন নতুন কাজ শুরু হয়ে গেছে। শ্রীপুল দেশপাণ্ডের দলে দু-একজনের-বিশেষ ক'রে একটি যুবকের অভিনয় দেখে আমি চমৎকৃত, মুগ্ধ, অভিভূত। একই নাটকে সে তিনটি ভিন্ন ধরনের ভূমিকা অভিনয় করলো। চিনতে পারা যায় না। যেন ব্যক্তিত্বই আলাদা।- অথচ রূপসজ্জার কোনো বাহুল্য নেই। খুবই সামান্য।
শ্রীঅরবিন্দ দেশপান্ডের নির্দেশে শান্ততা, ‘কোর্ট চালু আহে’র যে নাট্য তা দেখেও আমার খুব ভালো লেগেছিল। ঐ নাটকের বাংলা অনুবাদ (চোপ, আদালত চলছে) যখন করবার কথা হচ্ছে তখন আমি বারবার চেয়েছিলুম যে শ্রীঅরবিন্দ যেন কলকতায় এসে বাংলা অভিনয়ের নির্দেশ দিয়ে যায়। সেটা যে সম্ভব হোল না তার একটা কারণ হোল, শ্রীঅরবিন্দের চাকরি।
বোম্বাইয়ে এই যে নাটকের এতো চর্চা হচ্ছে, তার একটা কারণ এই যে সেখানে প্রেক্ষাগৃহ অনেকগুলি, এবং ভাড়া এখানকার চেয়ে ঢের সস্তা। সেখানে কোনো মঞ্চে স্থায়ী পেশাদারী সংস্থা না থাকায় ভাড়া পাওয়ার, এবং সস্তায় ভাড়া পাওয়ার সুযোগ বেশি। এবং মারাঠী নাট্য সম্প্রদায়গুলো নানান জায়গায় অভিনয় ক'রে আসতে পারে, এবং বিক্রির টাকা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে টাকা দিতে পারে। এবং যারা বিখ্যাত অভিনেতা তাঁরা তো কলকাতার শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের চাইতে অনেক বেশি টাকা পেয়েই থাকেন মাসে। এমন কি মঞ্চকর্মীরাও।
এটা সম্ভব হয় কারণ বেশি দামের টিকিট কেনবার মতো লোক সেখানে প্রচুর। সেটা আবার ঐ রাজ্যের আর্থনীতিক উন্নতির সঙ্গে যুক্ত। আর আমাদের অবস্থা? ....
বোম্বাই শহরে গুজরাতি অভিনয় প্রতি রবিবারে ও ছুটির দিনে অনেক ক'টি হয়। এবং একেবারে অপদার্থ না হলে অনেক আগেই সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়।
এইসবের ফল একদিকে যেমন ভালো করছে, অপরদিকে তেমনি সস্তা সেন্টিমেন্টাল (বা ঝলমসলার) থিয়েটার গ'ড়ে ওঠবার সাহায্য করছে। ফলে, যারা নতুন কাজ করবে, গভীর কাজ করবে, তাদের পন্থা দুর্গম হতে থাকছে।- তবু, মারাঠীতে নাট্যের কদর কতো তা বোঝা যায় তাদের শ্রেষ্ঠ নাটকের ছাপার ধরন দেখে, এবং মহারাষ্ট্রে রাজনৈতিক নেতারাও থিয়েটারের সম্পর্কে যতোটা শ্রদ্ধাশীল তাই দেখে। মহারাষ্ট্র সরকার অনেকদিন থেকেই তো নাট্যের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ ক'রে থাকে। তার ফলেই আধুনিক মারাঠী নাট্যভিনয়ের এতো উৎকর্ষ।
লেখাটা ক্রমশই বড়ো হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এরকম এলোমেলো বলতে বলতে অষ্টাদশ কাণ্ডে পৌঁছে যাবে। তবু শ্রীবালগন্ধর্বের নামটা যখন করেছি তখন গুজরাতের শ্রীজয়শঙ্কর সুন্দরীর নামটাও করা উচিত। তিনিও স্ত্রী ভূমিকায় অভিনয় করতেন। গুজরাতিতে। এবং তাঁকে দেখেও তখনকার মহিলারা শিখতেন যে কী ক'রে সাজতে হয়, কী ক'রে হাঁটতে হয় ইত্যাদি। অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর যে উপলব্ধি সেও খুব জানবার বস্তু। তিনি একবার কথায় কথায় বলেছিলেন,- ‘আমি মেয়েদের দিক থেকে নাটকে পুরুষদের দেখেছি। তাই পুরুষরা যে কেমন হয়- আমাদের অহঙ্কার, আমাদের ছেলেমানুষি,- সব খুব স্পষ্ট ক'রে বুঝতে শিখেছি।’- এ এক অমূল্য উক্তি।
যতোটুকু দেখেছি, যতোটুকু শুনেছি, তারও সবটুকু একসঙ্গে বলা যাবে না, গুছিয়ে বলতেও পারবো না আমি।
কিন্তু এইসব দেখেশুনে, বিশেষ ক'রে ভারতের নানা স্থানের, যাকে লোকনাট্য বলা হয় সেইগুলো দেখে আমার প্রচুর উপকার হয়েছে। বোধহয় ১৯৫০ সালে প্রথম আমাদের মনে খুব স্পষ্ট ক'রে এই কথাটার উদ্ভব হয় যে ভারতের একটা নিজস্ব নাট্যপদ্ধতি আছে, এবং সেইটা যে কী সেকথাটা বোঝবার জন্যে নিজেদেরই মনের মধ্যে হাতড়েছি। ছেঁড়াতার নাট্যের রূপারোপের মধ্যে তারই একটা সচেতন প্রচেষ্টা ছিল। তবু তখনো সম্পূর্ণ বুঝিনি। পরে রক্তকরবী করার সময়ে খুব যেন নিশ্চিত ক'রে মনে হোল বুঝে গেছি ব্যাপারটা। তাই তারপরেই ইবসেনের নাটক পুতুলখেলা শুরু করা হোল। মনে বিশ্বাস ছিল যে ভারতীয় পদ্ধতি যদি মনের মধ্যে ঠিক এসে থাকে তাহলে ইবসেনের নাটকের রূপারোপেও সেটা আপনা থেকে প্রকাশ পাবে। কোনোমতেই বিলিতি ইবসেন-নাট্যাভিনয়ের মতো হবে না। পুতুলখেলা জনপ্রিয় হোল খুব, কিন্তু লোকের কথা শুনে বুঝতে পারলুম না যে সেইরকম আন্দাজ ঠিক দিতে পেরেছি কিনা। যে কাজগুলো আমরা করেছিলুম ইবসেনকে আধুনিক ভারতীয় দৃষ্টিতে প্রকাশ করবার জন্যে সেটা পারলুম কিনা বুঝলুম না। তবে কিছু-একটা বোধকরি হয়েছিল, তাই মানুষের মনকে অতো ছুঁযে ছিল। আর তখন মনে হয়েছিল যে, ভারতীয়ত্বটা কেবল ওপরকার পোশাক নয়। এটার ভিত্তি বোধহয় অনেক গভীরে। চলনে, বলনে, আমাদের খুশির মুহূর্তে, ও জীবনে সঙ্কটের মুখোমুখি হওয়ার সময়ে-আমাদের, যাকে বলে world view তা-ই বোধহয় প্রকাশ হয়। অভিনয় যতো দীপ্ত হয় ততোই সে world view বেশি ক'রে প্রকাশ পায়।- এইরকমই মনে হয়েছিল।
এই সমস্ত চেষ্টার মধ্যে নৌটাঙ্কি বা তামাশা বা আরো অনেক দেশি নাট্যপ্রকার দেখে বারবার মনে হয়েছে যে কতো সহজে এরা নিজেদের রূপটা প্রকাশ করছে। সহজতা মানে কেবল যে গ্যাসলাইটের নিচে ভেলভেটের সাজ প'রে রাজা এসে অভিনয় আরম্ভ করলো সেই অপরিস্কৃত রুচির সহজতা নয়, এর মধ্যে ভামকলাপমের বা কথাকলির মতো জটিল রীতিবদ্ধতাও খুব সহজে প্রকাশ পায়। সীরিয়াস এবং সহজ-এই দুয়ের এক বিচিত্র সাম্য আছে। মুর্তিপূজার মতো। খড়মাটি দিয়ে প্রতিমা বানানো হোল, তখনো সে দেবী নয়; বিশেষণে চোখ আঁকা হোল, স্তরটা বদলে গেল; মন্ত্র প'ড়ে মূর্তির মধ্যে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হোল; তারপর তাকে সম্পূর্ণ দেবী ব'লে মেনে পুজো, উৎসর্গ, নাচাগাওয়া, সব হোল; তখন আর সে মোটেই দেবী নয়। সমস্ত ব্যাপারটাই খুব সহজ, অথচ খুব সীরিয়াস। মনের অনেক গভীর উপলব্ধি একে আশ্রয় করেই প্রকাশ পেয়েছে। এ এক আশ্চর্য sophistication, আশ্চর্য বৈদগ্ধ্য।
আজকাল আমাদের এইসব নাট্যরূপ নিয়ে মার্কিনী ফ্যাশান জোর হ'য়ে উঠছে। দশরথের অভিনেতা যদি ভেলভেটের সাজ পোশাকের ওপর সুতোজড়ানো একটা ভাঙা চশমা পরেই আসরে নামে তাহলে এই ফ্যাশানবিলাসীরা বাহা বাহা ক'রে ওঠেন। ‘কি সুন্দর alienation-এর প্রক্রিয়া, একেবারে আধুনিক,- ব্রেখটিয়!’
অবশ্য কিছু দিঙনাগাচার্য তো থাকবেই, যাদের স্থূল হস্তাবলেপে মনোযোগ-দিয়ে-কাজ-করার সময়ে বেশ একটু অসুবিধে হবেই। কিছু করার নেই। বরাত।
পুরানো যাত্রা যা ছিল; কথকতা, হরিকথার যে-রূপ এখনো দেখতে পাওয়া যায়; নৌটাঙ্কি, ভাওয়াই, তামাশা, যগান, ভামকলাপম,- এদের সবার মধ্যে একটা মিল আছে। সেই কেন্দ্র থেকেই এরা নিজেদের নিজেদের সময়কে প্রকাশ করেছে। আজ আমরা মূর্তিপুজা মানি না (অবশ্য চাঁদা ভয়েতেই অনেককে দিতে হয়, এবং জীবনতিক্তকারী ‘আনন্দোৎসব’ চুপ ক'রেই সইতে হয়) তবু অতো সহজে অতো গভীর অনুভবে যাবার রীতিপদ্ধতি কী হবে? কেমন ক'রে সেই নাট্য গ'ড়ে তুলবো যেটা খেলাও বটে, আবার পুজোও বটে। আমাদের গভীর উপলব্ধিগুলে যার মধ্যে উৎসারিত হ'তে পারবে, নেচে গেয়ে হেসে কেঁদে।
একটা জিনিষ আমরা গভীরভাবে অনুভব করেছি যে আমাদের এই বিশাল উপমহাদেশে দিকে দিকে প্রচুর শিল্পী আছেন, আর এর হাওয়াতে একটা গভীর বোধ আছে। তার সঙ্গে যদি আমরা যুক্ত হ'তে না পারি, সেই অনুভবের নিবিড়তার মধ্যে যদি ডুবে যেতে না পারি, তাহলে আমরাই বিনষ্ট হবো।- তা সে যতোই ইংরেজি বুকনি আওড়াই।
শম্ভু মিত্র : বাঙলানাট্যের প্রবাদ পুরুষ।
[প্রবন্ধটি শম্ভু মিত্রের প্রবন্ধ সংকলন ‘সন্মার্গ সপর্যা’ গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রণ করা হলো। অনেকের মন্তব্য, আমাদের সকল নাট্যকর্মীদের এই গ্রন্থটি অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। সেই অভিপ্রায়ে নাট্যকর্মীদের আগ্রহ তৈরির জন্যই থিয়েটারওয়ালার এই পুনর্মুদ্রণ। বইটি ঢাকার -আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ ও বেইলী রোডের বুকস্টলগুলোতে পাওয়া যায়- সম্পাদক]