Full premium theme for CMS
‘শেষের কবিতা’ : উপন্যাসভিত্তিক নাট্যনির্মাণে আধুনিকতা ও সাহসী শিল্পবোধের সযত্ন প্রয়োগ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপনে বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতে নানাবিধ উদ্যোগের যে সমারোহ দেখা গেছে, তা সত্যিই আমাদের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে থাকবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি তাদের নিজেদের নির্বাচন ও ভাবনা অনুযায়ী নানা কলেবরের গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। আরো যে কত রকমের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে তার তালিকা তৈরি করা বেশ আয়াস সাধ্য।
২০১১-র একেবারে শেষ প্রান্তে এসে ঢাকায় আয়োজিত রবীন্দ্র উৎসবে দেখলাম, সহস্র কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এমন সব জমকালো উদ্যোগের মধ্যে যা বিশেষ করে আমাকে আলোড়িত করেছে, তা হল, রবীন্দ্রনাটক ও কাহিনী ও তার জীবনকথা নিয়ে মঞ্চের কর্মীদের নিরলস কর্মোদ্যোগ। পুরোনো অনেকগুলো প্রযোজনা নতুন আবরণ ও আভরণে মঞ্চে এসেছে। সর্বসাম্প্রতিক যে প্রদর্শনী দেখলাম, এবং যেটাকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মবর্ষের প্রসঙ্গটা উল্লেখ করলাম, সেটা হল রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বহুলপঠিত এবং রচনার জন্মকথার দিক থেকে বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসের এক মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত ‘শেষের কবিতা’। এই উপন্যাসের আর একটি প্রযোজনা ঢাকার মঞ্চে নিয়মিত প্রদর্শিত হচ্ছে, নাটকের দল ‘প্রাঙ্গণে মোর’ সেটা মঞ্চে এনেছে। কিন্তু আমি যে ‘শেষের কবিতা’-র প্রদর্শনী দেখে বর্তমান এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশে প্ররোচিত বোধ করছি, সেটা প্রযোজনা করেছে থিয়েটার আর্ট ইউনিট।
এই তথ্যটা বেশ মনোযোগ দাবি করে এজন্যই যে, এই দলটির পূর্ববর্তী সব প্রযোজনার মধ্যে যে ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বক্তব্যের উত্তাপ দেখতে পেয়েছি, সেই দলটিই রবীন্দ্রনাথের এমন একটা কাহিনী নিয়ে নাট্যনির্মাণ করছে, যার মধ্যে প্রেমের সংজ্ঞা, দ্বন্দ্ব ও রোমান্টিকতা মুখ্য হয়ে ওঠে। সেদিক থেকে এই দলের জন্য ‘শেষের কবিতা’-র প্রযোজনা, শুধু ব্যতিক্রমধর্মী নয়, বেশ একটু দুঃসাহসীও বটে, প্রথমেই বলে নিই, এটা একটা ভালো ও ভাবনাপ্রসারী কাজ হয়েছে।
‘শেষের কবিতা’-র গল্পটা সবার জানা। তাই নাট্যরূপান্তরের পর দর্শক/পাঠকদের কোন কোন প্রিয় অনুষঙ্গ অক্ষত থাকলো অথবা তার উপস্থাপনা কতটা প্রত্যাশা পূরণ করলো, আর নাট্যপ্রযোজনার সীমিত সময়ের মধ্যে কীভাবে নতুন একটা সাব-টেকস্ট তৈরি হল, তাতে কনটেকস্ট-এর ওপর কোনো অনভিপ্রেত প্রভাব পড়লো কিনা, এসব জিজ্ঞাসা নিরন্তরভাবে মনের কোনায় উঁকি দিতেই থাকে। থিয়েটার আর্ট ইউনিট-এর দুই প্রধান কর্মী, প্রশান্ত হালদারের নাট্যরূপে এবং মোহাম্মদ বারীর নির্দেশনায় এই নাটকটি দেখার সময় উপন্যাসের অনুরক্ত পাঠককুল এমন সব প্রশ্নের বিষয়ে তাদের প্রার্থিত অথবা নাট্যনির্মাণ যুক্তিসাপেক্ষ উত্তর কতটা পেয়েছেন, তার সমীকরণ দর্শকভেদে ভিন্নমুখী হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রত্যাশা নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে প্রবেশ করিনি। উপন্যাস এমনকি নাট্যসাহিত্যের লিখিত টেকস্ট-কে উপস্থাপনার বেলায় নানারকম সম্পাদনার মুখোমুখি হতে হবে, সে বিষয়ে আমি সবসময়ই মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকি। নাটকপাঠে আমার নিজস্ব রসাস্বাদন যে নাট্যনির্মাণের আলাদা নরম-গরম মশলার মিশ্রণে আলাদা চরিত্র লাভ করতে পারে, এমন একটা উন্মুক্ত গ্রহণের অভ্যাসকে আয়ত্ত করেছি নানা দেশের নানা মুনির প্রযোজনা দেখে। তাই এই প্রযোজনাটি যখন আরম্ভ হলো, তখন দেখছি এক তরুণী, মুহূর্তেই যাকে উপন্যাসের সেই মধুরা নারী লাবণ্য বলে শনাক্ত করতে পারি, সে গলা সপ্তমে চড়িয়ে ক্রোধের প্রকাশ ঘটাচ্ছে, দেবী সরস্বতীর অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ পুস্তক-গ্রন্থাদি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, আর যে তরুণ এমন ক্রোধের উদ্দিষ্ট, সে যে শোভনলাল, সেটা বুঝতে কোনোই বেগ পেতে হয় না। এমন একটা ধমকানো আরম্ভের মধ্য দিয়ে নির্দেশক যে একটা চমক দেখানোর স্বেচ্ছানির্বাচিত চেষ্টা করেছেন তা বোঝা যায়।
আলো তখনো সবটা সেটের ওপর পড়ে না, অতএব স্থানিক সীমানার মধ্যেই আটকে থাকে আমাদের দৃষ্টি। যদিও সেটের আভাসটা বুঝতে পারেন যেকোনো জিজ্ঞাসু দর্শক। এই প্রাথমিক দৃশ্যের দৈর্ঘ্য মাত্র মিনিটখানেক, যেখানে শোভনলালের কোনো সংলাপ নেই। এই দৃশ্যপরিকল্পনায় আমার সমর্থন দিতে দ্বিধা হয়, কিন্তু এই অতি-সংক্ষিপ্ত পরিসর যে নাটকীয়তা সৃষ্টির জন্য করা হয়েছে, তার ফলটা হয়ত পাওয়া গেছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্চ ও সেট আমাদের কাছে বেশ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। তা থেকে শেষের কবিতা-র পরিপ্রেক্ষিতটা বোঝা যায়। অমিতকে দেখতে পাই তার আধুনিকতা-প্রেমী বান্ধববৃন্দের সান্নিধ্যে। সেটটা যেভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে কুশীলবদের স্থান পরিবর্তন ও চলন-বলনের একটা কাঠামো সহজেই তৈরি হয়ে যায়। সামনের দিকটার বেশিটাই উন্মুক্ত, উপবেশনের জন্য যে ব্যবস্থা আছে, তা সহজেই ভিন্ন দৃশ্যের অনুষঙ্গে মানিয়ে যায়। অমিত তার বিলেতি বিদ্যার প্রভাবজাত সুচয়িত শব্দসম্ভারে জীবন ও মানব-সম্পর্কের ব্যাখ্যা দেবার কাজটা স্বভাবতই প্রথম দিকেই শুরু করে। নাটকের শুরুতে সংলাপের গতি অনেক বেশি থাকলেও, মিনিট দশেক পর থেকে সংলাপ তার প্রার্থিত ছন্দ ফিরে পায়। কাব্যময়তা, নাটকীয়তা, চপলতা, তারুণ্যের অস্থিরতা, বন্ধুত্বের বিন্দু থেকে বৃত্ত ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক একটা ছন্দময়তা খুঁজে পায়। নাট্যরূপ ও নির্দেশনার কৌশলের মধ্যে একটা নান্দনিক যুগলবন্দী সৃষ্টি হয়।
নাটকের শেষে দলের প্রধান রোকেয়া রফিক বেবী জানালেন, এই প্রযোজনায় যারা অভিনয় করেছেন তাদের প্রায় সবাই নতুন। তাদের দেখেও তেমনটি মনে হচ্ছিল। কিন্তু নতুন হলেও এরা সবাই-ই অভিনয়ে প্রার্থিত পটুতা প্রকাশ করেছেন। বলা বাহুল্য, সেখানে নির্দেশকের বাহাদুরি আছে। শেষের কবিতা-র মত এমন সুপরিচিত একটা কাহিনী মঞ্চায়নে যেসব ঝুঁকি আছে, নির্দেশক সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন ছিলেন। নাটক ভালোবাসেন এবং নাটক বোঝেন, এমন অনেকেই এই কাহিনীর নাট্য রূপান্তরে সায় দিতে চাইবেন না। রবীন্দ্রনাথের বহু মঞ্চায়নযোগ্য নাটক আছে, শেষের কবিতা-র মত রোমান্টিক নিরীক্ষার নাট্যভাষ্য তার অন্তর্গত রসবোধকে বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারে, এমন একটা সন্দেহ থেকেই যায়। এমন সব উদ্বেগের একটা চমৎকার শিল্পশোভন উত্তর দিতে সমর্থ হয়েছেন নির্দেশক মোহাম্মদ বারী ও তার দলের অভিনয়শিল্পী ও নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন, তারা সবাই। সঙ্গত কারণেই এই নাট্যনির্মাণে নির্দেশক কাহিনীর বেড়াটার মধ্যে আটকে থাকতে চাননি। আবার কাহিনীর আবহ থেকে বেশ কিছুটা সরে গেলে দর্শক এটাকে নেবে না, এমন ভাবনাকে সামনে রেখেই মঞ্চ পরিকল্পনার মধ্যে একটা বাস্তব-পরাবাস্তবের মিশেল ঘটানো হয়েছে; আধো আঁধারিতে একটু-আধটু যে ওলট-পালট করা হয়েছে, তার সাংকেতিকতা যে বাড়তি বা ভিন্ন স্বাদের দৃশ্যায়নে দারুণ সহায়তা করেছে এমন মনে হয়নি আমার। তবে প্রকৃতির বহিঃস্থ উদারতা এবং প্রয়োজনে গৃহকোণের বদ্ধতার মধ্যে একটা সমঝোতা করা গেছে।
থিয়েটার আর্ট ইউনিট একটা দক্ষ ও সুসংবদ্ধ ইউনিট হিসেবে যা করতে সমর্থ হয়েছে তা হল তারা শেষের কবিতা-নামের এই উপন্যাসটিকে নাট্য উপস্থাপনায় বেশ সার্থক করে তুলেছে। একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হয়, রবীন্দ্রনাথকে কোনো puritanic কাঠামোর মধ্যে রেখেই যে তাঁকে ধারণ করতে হবে তা নয়, তাতে তিনি যতটা অক্ষয় হয়ে থাকবেন, তারও চেয়ে অনেক বেশি স্থায়িত্বের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে, তাঁকে নিয়ে, তাঁকে অবলম্বন করে নতুন সৃজনভাবনার বাস্তবায়নের মধ্যে। এই নাটকের প্রয়োগকৌশল ও মঞ্চায়নভাবনায় তার চমৎকার প্রতিফলন দেখা গেছে। আমি অন্তত তেমনটাই মনে করি। এই দল একটা নাটক করতে চেয়েছে, তার জন্য তারা রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিয়েছে, নাটকটা কী করলে আধুনিক এবং দর্শকভোগ্য করে তোলা যায়, আবার রবিঠাকুরকেও চিনতে সামান্য কষ্ট করতে না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশক যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন। সংলাপে রবীন্দ্ররচনাকে অনুধাবন করা যায়, শব্দব্যবহারের চাতুরির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক যে রসবোধ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনো ঘাটতি বাজেনি আমার কানে। ইংরেজি শিক্ষায় দীক্ষিত ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রতি দুর্বল যে শহুরে তরুণ দল উপন্যাসের চেনা চৌহদ্দি থেকে বারে বারে বেরিয়ে এসে বিনোদনের যোগান দেয় এই নাটকে, তার মধ্যে যে পরিমিতিবোধ ও নান্দনিক পরিবেশনা দেখতে পেয়েছি, সেজন্য নির্দেশকের ভাবনা ও দক্ষতাকে বাহবা দিতেই হয়। এই সমীক্ষণের পাঠকদের জানিয়ে দিই, নাটকে সম্মেলক গান ব্যবহার করা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি মেনে, আবার তার দৃশ্যমানতার মধ্যে এক ধরনের সচেতন উত্তর-আধুনিকতার বিস্তৃতি ঘটানো হয়েছে। এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলা বেশ কঠিন। নির্দেশক নাট্যপ্রয়াসের গতিকে বাড়িয়ে দেবার জন্যই সুচিন্তিতভাবে কোরিওগ্রাফি রচনা করেছেন। অতএব তাকে তখন একটা মানানসই পোশাক পরিকল্পনার সাহায্যও নিতে হয়েছে। আবার অমিতের দলবলের আচরণে একটা বাড়তি বাস্তবতা আরোপের জন্য বাংলা ছাড়াও ভিনদেশী (স্কটিশ) গান ব্যবহার করা হয়েছে। শিলং-এর আবহের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্থানীয় পোশাকের ব্যবহার আলাদা এক ধরনের দৃশ্যমানতা সৃষ্টি করেছে, যা এই নাটকে বাড়তি মাত্রা যোগ করে।
থিয়েটার আর্ট ইউনিটের এই প্রযোজনা কতটা মঞ্চসাফল্য পাবে, তা হলফ করে বলতে পারব না। যেসব জায়গায় রবীন্দ্র-অতিরিক্ত সংযোজন আছে এবং গানের ক্ষেত্রেই সেকথা বেশি প্রযোজ্য এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন নৃত্যভঙ্গি জড়িত, সেগুলির প্রয়োগ বেশ নাট্যগুণান্বিত হলেও আরো গভীর চিন্তার কিছুটা অবকাশ আছে বলে মনে করি। নতুন কুশীলবরা অভিনয়ের দাবি মিটিয়েছেন, কিন্তু স্বরপ্রক্ষেপণের সমস্যা দেখা গেছে বারবার। চমৎকার পোশাক পরিকল্পনা, কিন্তু লাবণ্যের জন্য শুধু একবর্ণা সুতি শাড়ি বেমানান না হলেও উৎকর্ষের মেজাজ আনে না। লাবণ্য রেশমী শাড়ি পরলে দৃশ্যায়নে বাড়তি সুফল পাওয়া যাবে। মাসীমা, যিনি আধুনিক, কিন্তু একাই থাকেন, তিনি যদি সেকালের অনুসরণে সরু পাড়ের আটপৌরে ঢঙে শাড়ি পরিধান করেন, তা অনেক স্বাভাবিক ঠেকবে। গান সংযোজনার ব্যাপারে আরেকটু বলতে চাই, নির্দেশক গান দিয়ে যে ইফেক্ট তৈরি করতে চান, তা বোধহয় আরো ভালো হয়, যদি গানগুলিতে সমাপনের দিকে বাণী ছাড়া শুধু সুরটা থাকে এবং যন্ত্রসঙ্গীতের একটা ধীর লয় তৈরি করা যায়। অমিতের ভূমিকায় প্রশান্ত প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটাতে ক’মিনিট সময় নিয়েছে, কিন্তু খুব দ্রুত সে চরিত্রের দাবি মিটিয়ে দেয়। লাবণ্যের চরিত্রে ফৌজিয়া করিম অনবদ্য। ওর মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে। কেতকী চরিত্রে একাও খুব ভালো করেছে, তবে বাক্ভঙ্গিমায় কিছু পরিবর্তন আনলে আরো স্বাভাবিক লাগবে। এই নাটকের এক বড় সম্পদ এর আলোক পরিকল্পনা- কুশলতার ছাপ স্পষ্ট, মুগ্ধকরও বটে। ছোটখাট যেটুকু খুঁতের বিষয় আমার চোখে ধরা পড়েছে, আশা করি এই দল তা দূর করে আরো নাটকীয় গতি সঞ্চার করতে পারবে।
সব মিলিয়ে আমার পরিতৃপ্তির ভাগটাই বেশি।
শফি আহমেদ : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। নাট্যসমালোচক