Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

নাজমা আনোয়ারের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য: আরণ্যকের রাজনৈতিক-দর্শনেরই প্রতিধ্বনি

Written by ড. বাবুল বিশ্বাস.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

প্রসঙ্গ বিবেচনা : পরিচয়

পারিবারিক-তথ্য

পারিবারিক নাম কাৎরাতুননেছা নাজমা হোসেন। পরিচিত নাম: নাজমা আনোয়ার। ডাক নাম: লাকী। ১৯৪১ সালে মুন্সিগঞ্জের টুঙ্গীবাড়ি থানার ধামারণ গ্রামের কাজী বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা কাজী আমির হোসেন ছিলেন মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজের আরবির শিক্ষক। মাতা শফিকুননেছা বাহরামান্দ বানু।

প্রগতিশীল এবং আধুনিক-মতাদর্শে বিশ্বাসী পরিবারেই বেড়ে ওঠা নাজমা আনোয়ারের। ছোটোবেলা থেকেই তাঁদের পরিবারে নাচ-গান-আবৃত্তির চর্চা ছিল। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া ছিল পরিবারের রেওয়াজ। নাজমা আনোয়ারের চাচা প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কাজী শাহজাহান হাফিজ, খালা কণ্ঠশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু, লুলু বিলকিস বানু এবং ফুফাতো ভাই বিখ্যাত গীতিকার নয়ীম গহর। নাজমা আনোয়ারের নানি ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের ভাগ্নি। দুই চাচা কাজী কামাল এবং কাজী হারুনুর রশীদ ছিলেন রাষ্ট্রদূত। তাঁর এবং তাঁদের পরিবারের উদার-সাংস্কৃতিকচর্চার পরিবেশ এবং অসাম্প্রদায়িক চিত্রটি ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখেছেন। ফুফাতো ভাই নয়ীম গহর এবং পিতা কাজী আমির হোসেন মুন্সিগঞ্জে ১৯৫৪ সালে ‘কপোত সংঘ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের হয়ে ১৯৫৪ সালে স্থানীয় জগধাত্রী মিলনায়তনে নাজমা আনোয়ার প্রথম মঞ্চে ওঠেন এবং নৃত্য পরিবেশন করেন।

বড়বোন আজমেরী জামান রেশমা ছিলেন গত শতকের ৬০ দশকের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র-অভিনেত্রী। তিনি নাটকের দল ‘ড্রামা সার্কেল’র সাথেও যুক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত অভিনেতা মাসুদ আলী খানের হাত ধরে রেশমার ড্রামা সার্কেলে যোগদান; এবং রেশমার হাত ধরে ড্রামা সার্কেলে যোগদানের মধ্য দিয়ে নাজমা আনোয়ারের মঞ্চসংযুক্তি তৈরি হয়। পরিবারের পরিবেশ-সম্পর্কে নাজমা আনোয়ার ডেইলি স্টারে একটি সাক্ষাৎকারে বলেন- `My family was culturally oriented. There were no restrictions such as using a `burka`. Nor were there fetters in the form of curbs on free movement.`

নাজমা আনোয়ারের পরিবারের সংস্কৃতিচর্চা এবং স্বাধীনচেতা-মনোভাবের কারণে মুন্সিগঞ্জে থাকাকালে পিতা আমির হোসেনের সাথে স্থানীয়-পর্যায়ে সাংঘর্ষিক-বিরোধ তৈরি হয়; যা এই পরিবারকে বাধ্য করে ঢাকায় মাইগ্রেট করতে। নাজমা আনোয়ার যখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী, ঠিক ঐসময়েই পিতা কলেজের শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ১৯৫৪ সালে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। বসতি করেন শান্তিনগরে। ওখানে তখন জাপানি দূতাবাস ছিল। পরবর্তীসময়ে ওই দূতাবাসেই আমির হোসেন চাকুরি নেন।

নাজমা আনোয়ারের প্রথম বিয়ে ভেঙে যায়, দ্বিতীয় বিয়ে করেন কবি মোস্তফা আনোয়ারকে। মোস্তফা আনোয়ার ছিলেন বাংলাদেশ বেতারের কর্মকর্তা। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। নাজমা আনোয়ারের প্রথম সংসারে তিন সন্তান: নাগিব, নাহিদ আর ইশরাত নিশাত এবং দ্বিতীয় পরিবারে দুই সন্তান: নাতাশা, নারিতা। অর্থাৎ চার কন্যা এক পুত্রসন্তান নিয়ে তাঁর সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংসার-জীবন ছিল। যদিও তা ছিল কষ্টকর আর সংগ্রামমুখর। কিন্তু বর্ণাঢ্য। ‘এ্যাডভিশন’ নামে তিনি একটি বিজ্ঞাপনী-সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; যদিও প্রতিষ্ঠানটির আয়ু বেশিদিন ছিল না।

সাংস্কৃতিক-তথ্য

নাজমা আনোয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বজলুল করিম ও মকসুদ-উস-সালেহীন প্রতিষ্ঠিত ‘ড্রামা সার্কেল’ (প্রতিষ্ঠা ১৯৫৬)-এ যোগ দেন। ড্রামা সার্কেলে নাজমা আনোয়ারের মঞ্চাভিনয় দান্তের মৃত্যু (মূল: Georg Buchner-এর Danton’s Death অবলম্বনে অনুবাদ: বজলুল করিম) নাটকের মাধ্যমে।২ ড্রামা সার্কেলের কার্যক্রম ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে আসে একসময়। নাজমা আনোয়ার ঠিক এসময়ে মামুনুর রশীদের আহ্বানে ১৯৮১ সালে আরণ্যক নাট্যদল (প্র. ১৯৭২)-এ যোগ দেন। ১৯৮২ সালে তিনি জার্মান কালচারাল সেন্টার প্রযোজিত ক্লাভিগো (রচনা:Johann Wolfgang von Goethe) নাটকে অভিনয় করেন। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন তাঁরই বড়বোন আজমেরী জামান রেশমা।৩ আরণ্যকে যোগ দেয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে দলের বাইরে এই একটি নাটকেই তিনি অভিনয় করেছেন। তারপর দীর্ঘ-সময় ধরে আরণ্যকই তাঁর ধারাবাহিক মঞ্চাভিনয়ের তীর্থভূমি ছিল। গত শতাব্দীর নব্বই-দশকের কোনো একসময়, আজানা কোনো বিষাদকে ধারণ করে তিনি আরণ্যক নাট্যদল ছেড়ে চলে যান। পরে ‘দেশ নাটক’ (প্র. ১৯৮৭) প্রযোজনা, মাসুম রেজার কাহিনির উপর ভিত্তি করে কন্যা ইশরাত নিশাতের নাট্যরূপ ও নির্দেশনায়  লোহা নাটকে (১৯৯৯) অভিনয় করেন। এটি ছিল তাঁর শেষ মঞ্চাভিনয়।

আরণ্যক নাট্যদলে নাজমা আনোয়ার যুক্ত হয়েছেন মামুনুর রশীদ রচিত ইবলিশ নাটককে কেন্দ্র করে। যদিও প্রথম প্রদর্শনী থেকে নয়, কয়েকটি প্রদশর্নী চলবার পর থেকে। আরণ্যকে নাজমা আনোয়ার অভিনীত নাটক- ওরা কদম আলী নাটকটির নিয়মিত মঞ্চায়নের শেষদিকে নাজমা আনোয়ার কিছু কলশো, কিছু নিয়মিত শোতে রাবেয়া চরিত্রে অভিনয় করেন। ইবলিশ নাটকেও তিনি পরে অভিনয় শুরু করেন এবং নাটকের অন্যতম চরিত্র আতশীর ভূমিকায় অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আরণ্যকের মঞ্চ প্রযোজনায় নিয়মিত হন। এরপর সাতপুরুষের ঋণ  নাটকে জয়মন, গিনিপিগ নাটকে পপির মা, অববাহিকা নাটকে সাজেদা, নানকার পালা নাটকে মতির মা, সমতট নাটকে মা এবং কোরিওলেনাস নাটকে ভলিউমনিয়া চরিত্রে অভিনয় করেন নাজমা আনোয়ার।

আরণ্যক নাট্যদলে তিনি সাংগঠনিক দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠার সাথে। দুই টার্মে তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

নাজমা আনোয়ার মঞ্চাভিনয়ের পাশাপাশি বেতার, টিভি এবং চলচ্চিত্রেও অভিনয় করতেন। শঙ্খনীল কারাগার, করিমন বেওয়া ইত্যাদি চলচ্চিত্র ছাড়াও সময় অসময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাত, সাতজন যাত্রী, হারাণের নাতজামাই এর মতো জনপ্রিয় টিভি নাটকে ছিল তাঁর অভিনয়-উপস্থিতি। বেঁচে থাকাকালীন একমাত্র বাচসাস পুরস্কার ছাড়া আর কোনো পুরস্কারে এই অভিনেত্রীকে ভূষিত করা হয় নি। মরনোত্তরও নয়। বিশেষ-করে আমাদের নাট্যাঙ্গনের বহু পুরস্কার-পদক-সম্মাননা আছে; তাও তাঁকে দেয়া হয় নি। তাঁর প্রয়াণ-পরবর্তী সময়ে রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ ত্রৈমাসিক-এর একটি সংখ্যা নাজমা আনোয়ারের প্রতি উৎসর্গীত হয়। হাসান শাহরিয়ার সম্পাদিত ‘থিয়েটারওয়ালা’ (সপ্তম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ ’০৫) ‘নাজমা আনোয়ার এবং অতঃপর ভাঙনের শব্দ শুনি’ প্রচ্ছদ-শিরোনামে একটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।

অসীমের পানে যাত্রা

শান্তিনগর চামেলিবাগের বাসায় গভীর রাতে হৃদযন্ত্র-ক্রিয়াজনিত অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ার পর কন্যা ইশরাত নিশাত রাত ২টায় তাঁকে নিয়ে রওনা হন সিদ্ধেশ্বরী মনোয়ারা হাসপাতালের উদ্দেশে। মাঝপথে গভীর রাতে তাঁর আজন্ম লালিত প্রিয়স্থান মহিলা সমিতি মিলনায়তন এবং গাইড হাউজ মিলনায়তনের সম্মুখভাগের রাস্তার মধ্যিখানে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল একটি রিকশা ভ্যানের ওপর। হাসপাতাল নেয়ার পর কর্তব্যরত ডাক্তার তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ তথ্য ইশরাত নিশাত আমাকে কথা প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, যিনি নিজেও পরবর্তীকালে কাউকে না জানিয়ে কোনো এক গভীর-রাতে অসীমের পানে চলে যান।

২০০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর এভাবেই ৭০/৮০ দশকের অভিনেত্রীদের মধ্যে অন্যতম প্রতিভাময়ী কিন্তু নিঃসঙ্গ, সংগ্রামী, অবহেলিত, অস্বীকৃত, উপেক্ষিত এই মঞ্চকন্যার মৃত্যু হয়। মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নাজমা আনোয়ারকে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুতে জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা শোক জানিয়েছিলেন।৪ অভিনেত্রী সারা যাকের নাজমা আনোয়ারের মৃত্যুর পর ডেইলি স্টার-এ একটি অসাধারণ কথা বলেছিলেন- 'Najma Apa's death was a classic example of the fate of an hapless actor.'

শ্রদ্ধা জ্ঞাপন

‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন’ ও ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ ১৮ ডিসেম্বর ২০০৪-এ মহিলা সমিতি মিলনায়তনে সামান্য-কিছু নাট্যকর্মীর উপস্থিতিতে এই মহিয়সী নারীর মহাপ্রয়াণে শোকসভার আয়োজন করে। শোকসভা উপলক্ষ্যে অধ্যাপক ড. আফসার আহমেদ ডেইলি স্টারে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেখান থেকে শোকসভায় আগত বক্তাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা তুলে ধরা হল:

রামেন্দু মজুমদারের প্রস্তাব- 'Publish a memorandum on Najma Anwar and introduce an award in her name.'৬ আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন...'we could neither use her talent properly, nor judge it.'৭ মামুনুর রশীদ...'we worked together more than a decade and she was among a few artistes of Bangladesh whose popularity crossed the boundaries of the country.'৮ গোলাম কুদ্দুছ...'Najma Anwar overcame all the meanness of the society and fundamentalism and we will not let her memories fade away.'৯ মান্নান হীরা...'She had the strange capability to transform herself into the character of a play. Being the General Secretary of Aranyak she was very strict about the rules and regulations.'১০

প্রসঙ্গ বিবেচনা : শিরোনামিক আলোচনায় ‘আরণ্যক নাট্যদল’র অভিনয়রীতি

আরণ্যকের রাজনৈতিক-দর্শনই আরণ্যকের অভিনয়রীতির প্রধানসূত্র

আরণ্যক নাট্যদলে নাট্যচর্চা, নাট্যরচনা এবং বোধের যে চর্চা হয়েছে, তা-ই মঞ্চে প্রতিফলিত হয়েছে দলীয়-ভাবাদর্শের ওপর ভিত্তি-করে। গণমানুষের অধিকার-আদায়-কেন্দ্রিক একটি নাট্যদল গঠনের মাধ্যমে আরণ্যক নাট্যদল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের আদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গি গবেষক-নাট্যসমালোচক-দর্শকের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। এপর্যায়ে দলটির নেতৃবৃন্দ তাঁদের দলীয়-স্লোগান ‘নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণি সংগ্রামের সুতীক্ষ্ণ হাতিয়ার’কেও গ্রহণীয় করে তোলে। দলের অভিনেতৃ, সংগঠক, নাট্যকার, নির্দেশকসহ সবাই দলীয়-আদর্শের চর্চা করতেন এবং ব্যক্তি-জীবনেও তা প্রয়োগ করতেন। নাটক-নির্বাচন, নির্দেশনারীতি এবং ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটির মর্মার্থ প্রত্যেক-সদস্য প্রত্যক্ষভাবেই মস্তিষ্কে ধারণ করতেন। নিয়মিত গ্রন্থচর্চা হতো আরণ্যকে।

মূলত, আরণ্যকের রাজনৈতিক-দর্শনই দলটির অভিনয়রীতি। সুতরাং আরণ্যকের কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রী সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে ‘আরণ্যক নাট্যদল’-সম্পর্কেই অগ্রভাগে জানতে হবে। তার-উপর ভর করেই আরণ্যকের অভিনেতৃর অভিনয়রীতি পর্যালোচনা করাই হবে সমীচীন।

সুতরাং নাজমা আনোয়ারের অভিনয়ে ‘সৃজন-স্বাতন্ত্র্য’ ব্যাখ্যায়ও তা জরুরি বলে মনে করি।

আরণ্যক নাট্যদলই বাংলাদেশে প্রথম নাট্যদল, যারা দল গঠন-পরবর্তী নাট্য-প্রযোজনায় ব্যক্তি-নির্দেশনায় কবর, গন্ধর্ব নগরী, ওরা আছে বলেই মঞ্চায়নের পর সমন্বিত-নির্দেশনার ভাবনাকে নাট্যজগতে উসকে দিয়েছিল। তাদের বেশ কিছু প্রযোজনায় নির্দেশকের নাম ছিল ‘আরণ্যক নির্দেশনা দল’। এই নির্দেশনা দল কর্তৃক নির্দেশিত নাটকগুলি হলো, ইবলিশ, সাতপুরুষের ঋণ, গিনিপিগ, অববাহিকা, নানকার পালা। এই নির্দেশনা দলে মামুনুর রশীদের সাথে যুক্ত ছিলেন আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, মান্নান হীরা, সালাহউদ্দীন লাভলু, শাহ আলম দুলাল এবং আজিজুল হাকিম।

আরণ্যকের নির্দেশনারীতি নিয়ে ‘আরণ্যক নির্দেশনা দলে’র সদস্যদের বক্তব্য

আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্য মামুনুর রশীদ বলেন- ‘নির্দেশনার ক্ষেত্রে আরণ্যকে আমরা আমাদের দলীয়চিন্তা, আমাদের রাজনৈতিক-দর্শনকেই প্রাধান্য দিতাম। ব্রেখট, স্তানিস্লাভস্কি, অগাস্টো বোয়াল, পিটার ব্রুক- তাঁদের নির্দেশনারীতি এবং রাজনৈতিক-দর্শন সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল; আমাদের মঞ্চ-প্রযোজনায় তাঁদের তাত্ত্বিকরীতির প্রয়োগ আমরা বিচ্ছিন্নভাবে ঘটিয়েছি, ধারাবাহিকভাবে নয়। আমারা আমাদের নিজস্ব-সৃজনশীলতাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। অবশ্য মুক্তনাটকের-ক্ষেত্রে অগাস্টো বোয়ালকে আমরা বেশ অনুসরণ করেছি।’১১

আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্য আব্দুল্লাহেল মাহমুদ বলেন- ‘আরণ্যকে আমরা আমাদের দলীয়চিন্তা এবং নিজস্ব-সৃজনশীল-পদ্ধতির মধ্যেই নির্দেশনার প্রয়োগ ঘটাতাম। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অভিনয়রীতি আমরা জানতাম, কিন্তু প্রয়োগের-ক্ষেত্রে আমরা আমাদের দেশীয়-রীতিকেই গুরুত্ব দিতাম। আমাদের নিজস্ব-সৃজনশীলতার মধ্যেই নির্দেশনা দিতাম। যা আমরা দেখেছি আমাদের প্রত্যক্ষ চোখের মাধ্যমে, তাই আমরা মঞ্চে প্রয়োগ করতাম।’১২

প্রসঙ্গ বিবেচনা : নাজমা আনোয়ারের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য

সৃজনশীলতা এবং আরণ্যকের রাজনৈতিক-দর্শনের প্রতিফলনই নাজমা আনোয়ারের অভিনয়রীতি

আগেই বলেছি, নাজমা আনোয়ার আরণ্যকে যুক্ত হন ১৯৮১ সালে। তাঁর অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নাট্যকারের চিন্তার প্রতিফলন তিনি দেখিয়েছেন এবং নির্দেশক, সমালোচক, দর্শক-কর্তৃক সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর আসনকে পোক্ত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, একজন অভিনেতৃর অভিনয়-সৌকর্যের সাথে নাট্যকার-নির্দেশকের দর্শনগত ছাপ কতখানি বিরাজমান। না কি কোনো অভিনেতৃ একক প্রচেষ্টাতেই তার সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছান। আবশ্যিকভাবেই বলতে হয়, অভিনেতৃর অভিনয় আর নাট্যকার-নির্দেশকের ছায়া সমান্তরালেই এগুবে। এই এগুনোয় আসবে নাট্যকারের নাটক-বিষয়ক প্রাসঙ্গিকচিন্তা, আরও আসবে নির্দেশকের রীতি-সম্বলিত প্রয়োগের ধারা। অর্থাৎ নাট্যকারের সামাজিক-দর্শন এবং নির্দেশকের নিজস্ব-প্রয়োগরীতি কোনো না কোনোভাবে অভিনেতৃকে প্রভাবিত করবেই।

আগেই উল্লেখ করেছি ইবলিশ, সাতপুরুষের ঋণ, গিনিপিগ, অববাহিকা, নানকার পালা নাটকগুলো আরণ্যক নির্দেশনা দলের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে। উল্লিখিত এই পাঁচটি নাটকেই নাজমা আনোয়ার অভিনয় করেছেন। সমতট নাটক থেকে আরণ্যক পুনরায় ব্যক্তি-নির্দেশনায় প্রযোজনায় ফিরে যায়। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে হয়, ‘আরণ্যক নির্দেশনা দল’ পরিচয়ে আরণ্যকের নাট্য-প্রযোজনার নির্দেশনা-বিষয়ক এই ভাবনার প্রধান ব্যক্তি ছিলেন মামুনুর রশীদ। মূলত তাঁর রাজনৈতিক-বিশ্বাসই ছিল নাট্যভাবনার প্রধানসূত্র। মঞ্চ-প্রযোজনায় তিনি প্রথাগত তত্ত্বনির্ভর প্রয়োগরীতিতে খুব বেশি নির্ভর করেন নি। তিনি তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা-ভাবনারই সৃজনশীল প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তাঁর নির্দেশনায় যারা অভিনয় করেছেন তাঁদের ওপর। আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্যগণও তাই অনুসরণ করেছেন। একক নির্দেশনায়ও তার ব্যত্যয় ঘটে নি। সেই স্থান থেকেই অতীব স্বার্থকভাবে নাজমা আনোয়ার নাট্যকারের নাট-বক্তব্য গ্রহণ করেছেন এবং প্রয়োগ করেছেন মঞ্চে। সাথে ছিল তাঁর নিজস্ব অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য। এখানে মোহাম্মদ জাকারিয়া’র একটি কথা উল্লেখ করছি- ‘সর্বাঙ্গসুন্দর শিল্পসম্মত অভিনয়রীতি আয়ত্ত করে যিনি পূর্ণাঙ্গ অভিনেতারূপে দর্শকচিত্তকে জয় করতে চান, তাঁকে কেবল উন্মাদনা, ভাবাবেগ বা উত্তেজনার বশে অভিনয় করে গেলেই চলবে না, অভিনয় করার আগে নাটকের বক্তব্য এবং চরিত্রের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে।’১৩

নাজমা আনোয়ারের অভিনয়-প্রয়োগরীতিতে মামুনুর রশীদের নাট্যিক-চিন্তা ছিল প্রবলভাবে সমার্থক-জীবনবাদী। তাঁর সেই অভিনয় ছিল তুমুলভাবে হৃদয়গ্রাহী, দর্শকস্পর্শী। মামুনুর রশীদ যথার্থই বলেছেন-‘ইবলিশ নাটকের আতশী চরিত্রে অভিনয় করতে এসে এত অবলীলায় যে একজন নিপীড়িত গ্রাম্য মহিলার আদলটির মধ্যে তিনি প্রবেশ করতে পারবেন তা আমরা ভাবি নি। এরপর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি- অববাহিকা, সাতপুরুষের ঋণ, নানকার পালায় গ্রামীণ চরিত্রে বিভিন্ন মাত্রা তিনি আরোপ করেছেন।’১৪

নাজমা আনোয়ারের অভিনয় প্রসঙ্গে আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্যদের বক্তব্য

আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্য সালাহউদ্দীন লাভলু বলেনÑ‘নাজমা আনোয়ার তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের মধ্যদিয়ে যা অর্জন করেছেন তাই তিনি মঞ্চে দিয়েছেন। তাঁর স্ট্রাগল ছিল দেখবার মতো। সংসার, বেঁচে থাকা এবং সংস্কৃতির চর্চার মধ্যে তিনি যেভাবে সমন্বয় করেছেন তা অন্য কোনো নাট্যাভিনেত্রীর বেলায় ঘটে নি। প্রত্যেকেরই কেউ না কেউ ছিল টেনে তোলার। নাজমা আনোয়ার ছিলেন একা, নিঃসঙ্গ। তাঁর জীবনের চলার পথের অভিজ্ঞাতই হলো তাঁর মঞ্চাভিনয়। সহজেই তিনি নাটকের চরিত্রে ডুবে যেতে পারতেন। সম্পূর্ণ নিজস্বরীতি এবং আরণ্যকের প্রধান ব্যক্তি মামুনুর রশীদের প্রায়োগিক চিন্তা তাঁর মধ্যে ছিল। আমরা আরণ্যকের দর্শন বুঝতাম, তা-ই অভিনেতাদের বোঝাতাম। আর নাজমা আনোয়ার খুব দ্রুত তা নিতে পারতেন।’১৫

আরণ্যক নির্দেশনা দলের সদস্য এবং সাবেক প্রধান সম্পাদক শাহ আলম দুলাল বলেন- ‘মামুনুর রশীদের নাট্যিক-কনসেপ্ট এবং নাজমা আনোয়ারের নিজস্ব অভিনয়রীতির যে প্রয়োগ আমরা মঞ্চে দেখেছি, তা আমাদের ৮০’র দশকের অন্যতম পাওয়া। ইবলিশের আতশী, গিনিপিগের সেক্রেটারির স্ত্রী এবং কোরিওলেনাসের মা চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে যেমন ভেঙেছেন তেমনি আমাদেরকেও তাঁর কারিশমা দেখিয়েছেন।’১৬

নাজমা আনোয়ারের অভিনয় : তুলনামূলক সূত্রানুসন্ধান

একজন অভিনেতৃর সফল মঞ্চ-প্রস্তুতিতে নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শকের ভূমিকা থাকে প্রত্যক্ষ। আর পরোক্ষভাবে অভিনেতৃর অবস্থান হয় প্রয়োগরীতির সমন্বয়ে মঞ্চে চরিত্র উপস্থাপনের বিশেষত্বে। যেখানে নাট্যকার এবং নির্দেশকের প্রভাব অপরিসীম। কৌশলগত দিক থেকে দলীয় রাজনৈতিক-দর্শনগত প্রভাবও থাকে যথেষ্ট, অবশ্য সেই দলটি নির্দিষ্ট কোনো দর্শনে যদি বিশ্বাসী হয়, তবেই। এক্ষেত্রে অভিনেতৃ যদি নিজস্ব-সৃজনশীলতার ওপরও নির্ভরশীল হন, তারপরেও তাঁর মস্তিষ্কে দলীয় দর্শনের প্রভাব থাকা অসমীচীন নয়। তবে শেষপর্যন্ত অভিনেতৃকেই তাঁর শেষটুকু দিতে হয়; তাহলেই দর্শক প্রভাবিত হবেন প্রথমে অভিনেতা-অভিনেত্রী দ্বারা, পরে নাটকের বিষয়বস্তু দ্বারা, আরও পরে নির্দেশকের প্রয়োগরীতি দিয়ে। এ প্রসঙ্গে ড. মো. মুস্তাফিজুর রহমানের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করছি- ‘মঞ্চে নাট্যভিনয়কে কেন্দ্র করে নির্দেশক, অভিনেতা ও দর্শকের মধ্যে পরস্পর ক্রিয়াশীল এক ত্রিমুখী সম্পর্ক গড়ে ওঠে।...নির্দেশক সৃজনশীল শিল্পী না ব্যাখ্যামূলক শিল্পী,Ñএ নিয়ে মতবিরোধ আছে। কিন্তু একথা প্রতিটি নির্দেশক জানেন যে, থিয়েটারের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল শক্তি হলো অভিনেতা।...বস্তুত নির্দেশক হলো অভিনেতার শিক্ষক, বন্ধু, পরিচালক ও সমালোচক।’১৭ ঠিক তাই, নাট্যকারের অস্তিত্ব, দলীয় রাজনৈতিক-দর্শনের অস্তিত্বের সমান্তরালেই অভিনেতৃর ভিত্তি থাকতে হবে; যার পরিশীলিতরূপের ব্যাখা-বিশ্লেষণ করবে নির্দেশক এবং অভিনেতৃ তাঁর নির্যাস নিয়ে নিজস্ব-সত্তার প্রয়োগ ঘটাবেন, তবেই হবে অভিনয়। গণনাট্য আন্দোলনের সময় নাট্য-প্রযোজনায় দলটির নাটক বাছাই-বিচারে-বিশ্লেষণে নাট্যকারের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করা হতো ব্যাপক-হারে। সেখানে দলীয় রাজনৈতিক-দর্শনও ছিল ‘বটগাছে’র আদলে। আরণ্যকেরও তাই। আরণ্যকে প্রতিটি নাটকের পাঠ-শেষে চরিত্রবণ্টন-পরবর্তী নির্দিষ্ট অভিনেতৃর দায়িত্ব থাকত তাঁর চরিত্র-বিশ্লেষণের এবং নির্দেশকের সাথে সেই চরিত্রের প্রয়োগরীতি বা অভিনেতৃর ধারণার সমষ্টিগত বার্তা-বিনিময়ের। বেশিরভাগ-ক্ষেত্রেই নির্দেশক অভিনেতৃর চিন্তাকেই প্রলুব্ধ করতেন। অভিনেতৃর সৃজনশীলতাকেই মুখবন্ধ করতেন।

নাজমা আনোয়ার উল্লিখিত বিচার-বোধের বিশ্লেষণে নাট্যকারের নাট-সংলাপ বিশ্লেষণ, দলীয়-দর্শন এবং নিজস্ব অভিনয়-স্বাতন্ত্র্যের ওপরই শেষপর্যন্ত নির্ভর করেছেন- আমৃত্যু। কারণ, ‘দর্শকের কাছে নাটকের মূলবাণী পৌঁছে দিতে হবে।’১৮

উল্লিখিত প্রসঙ্গের সূত্র-সারাংশ ধরেই বলছি, অস্বীকার করবার উপায় নেই, আমাদের দেশে অগ্রজ-নাট্যনির্দেশকের মতো বর্তমান নির্দেশকও এই তত্ত্বটি সবলভাবে ধারণ করেন যে, মঞ্চ-প্রযোজনায় নির্দেশকই সব। এখন প্রশ্ন হলো, নাটকে কার ভূমিকা কতটুকু? নাট্যকারের ভূমিকা কতটুকু আর নির্দেশকের ভূমিকা কতটুকু? অথবা অভিনেতৃর?

ব্রিটিশ নাট্যসমালোচক ও লেখক আইভর ব্রাউন তাঁর পার্টিস অব দ্য প্লে গ্রন্থে বলেছেন- ‘নির্দেশকের অবশ্যই সহজাত-অভিনয়-ক্ষমতা থাকতে হবে। মঞ্চে প্রায়োগিক-অসুবিধাগুলো তাঁকে যথার্থভাবে বুঝতে হবে। নির্দেশকের তারচেয়েও বড় কাজ হলো, নাট্যকার যে মূল-বক্তব্যটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান, তার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্র-দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নাটকটিকে বিচার করা।’১৯ তবে ভয়াবহ কথা বলেছেন হেরলড ক্লারম্যান- ‘যখন একজন নাট্যনির্দেশক নাটকের কোনো দৃশ্যের কার্যক্রম আবিষ্কার করেন, তখন তাঁর কাছে মানবিক-দ্বন্দ্বের প্রকাশটাই প্রাধান্য পাওয়া উচিত, শুধুমাত্র বিশুদ্ধ সংলাপ উচ্চারণ নয়। সেই কারণেই হয়ত বলা হয় যে বধির দর্শকই অভিনয়কলার প্রকৃত-বিচারক, কারণ তাঁর কাছে নাটকের সংলাপ গৌণ এবং দৃশ্যমান ঘটনাপ্রবাহ মুখ্য।’২০ এ প্রসঙ্গে আমি রুশ নির্দেশক মায়ারহোল্ডকেই সমর্থন করি। তিনি বলেছেন- ‘নির্দেশক, দর্শক ও অভিনেতৃর মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেন, যেখানে দর্শক শুধু উচ্চারিত শব্দমালাই শ্রবণ করেন না বরং অন্তর্নিহিত ভাবটিকেও হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।’২১ এখানে অন্তর্নিহিত ভাবই হলো নাট্যকারে দর্শন। আর একটু বাড়িয়ে স্যার জন গিলগুড বলেছেনÑ‘নির্দেশক অত্যন্ত বিতর্কিত একটি শব্দ। তাঁর মতে, থিয়েটারের ইতিহাসে কুশলী অভিনেতা-অভিনেত্রীরা নিজগুণেই বিখ্যাত হয়েছেন।...সহজাত-প্রবৃত্তিই হলো সু-অভিনয়ের সবচাইতে বড় গুণ এবং বৈদগ্ধ আরোপিত অভিনয়ের প্রচেষ্টা ভুল’।২২

নাজমা আনোয়ার মূলত মায়ারহোল্ড-গিলগুড-এর ধারণায় নিজেকে মেলে ধরেছেন অতীব সার্থকভাবে। তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন নিজস্ব-সৃজনশীলতার, অর্থাৎ তাঁর অভিনয়-স্বাতন্ত্র্যের ওপর ভর করে। নাট্যকারের সংলাপ-বিশ্লেষণে, আরণ্যকের রাজনৈতিক-দর্শনের ভেতর থেকে এবং নির্দেশকের নিদের্শনারীতির সাথে তাঁর প্রয়োগরীতির সহমিশ্রণে।

ওরা কদম আলী নাটক দিয়েই তাঁর মঞ্চ প্রতিশ্রুতির উদহারণ উপস্থাপন করছি। ওরা কদম আলী নাটকে, নাট্যকারের শ্রেণি-সংগ্রামের ভিতটুকু খুবই স্পষ্ট। একক নয়, যৌথপ্রতিবাদের অংশী হয়ে রাবেয়া (নাজমা আনোয়ার) এ নাটকে তাঁর মাতৃত্বকে যেমন ভুলে যান নি, তেমনি ভুলে যান নি তাঁর অবস্থানকে। তিনি তাঁর অবস্থান নিয়ে সজাগ। এ নাটকে অবহেলিত, নিগৃহীত, অপস্রিয়মান এক জীবন-সত্তাকে বয়ে নিয়ে চলেছে রাবেয়া। তার জীবনের পরিধি একটি কলস আর কিছু মানুষের লোলুপ-দৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখানে ‘তাজু’র মতো সজীব একটি প্রাণ বা বলা চলে একটি মিষ্টি হাওয়া এসে এই ছিন্নমূল-ভূমির সমগ্র-জীবনকে কীভাবে প্রতিরোধের আকার দিল, সকল লাঞ্ছিত-প্রাণ একত্রিত হয়ে প্রশাসনের ভ্রান্ত-আইন এবং পুঁজিতন্ত্রের একচেটিয়া আধিপত্যবাদকে চ্যালেঞ্জ করে বসল- তা ছিল দেখবার মতো। এখানে নাজমা আনোয়ারসহ অন্যান্য অভিনেতৃর চলমান অগ্রসরমানতায় ছিল একটি প্রতিবাদ, একটি প্রতিরোধ। মুখাবয়বে ছিল ধাবমানতার তীব্রতা, একরোখা-দৃষ্টি এবং ঐক্যবদ্ধের-স্পষ্টতা। অনেকটাই কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান ‘তাজু’কে হারানোর যন্ত্রণা এবং ইজারাদারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে ক্ষোভ উদ্গীরণ হয়েছে তাদের যৌথকণ্ঠে; সেখানে অধিকার-চেতনা যেমন প্রতিষ্ঠিত, তেমনি প্রতিষ্ঠিত নৃতাত্ত্বিক পরিচয়-উন্মোচনের এক প্রবল দুঃসাহস। সেখানে মায়ের সন্তান হারোনোর অসহায়ত্বও রাবেয়া সমভাবে প্রকাশ করেছে তার তীক্ষ্ণ অভিজ্ঞান এবং অনুচ্চারিত ক্রন্দনে।

আচ্ছা, এ ক্রন্দন কী এ নাট্য-প্রযোজনার মাত্র কিছুদিন আগে জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের সরব প্রতিবাদের করুণ চিৎকার! দূর কোনো গ্রামে কুপিবাতি জ্বালিয়ে অতীব নিবিড় বন্ধনে মৃত সন্তানকে আগলে রেখে কোনো এক পানকৌড়ির অবিরাম কান্না! নাজমা আনোয়ারের সন্তান হারানোর এ কান্নাকে আমার অনেকটা তাই মনে হয়েছে। যা মূক ‘কদম আলী’কেও স্পর্শ করেছে। কারণ, কদম আলীও ততদিনে পথহারা-ঘরহারা এই সন্তানকে ভালোবেসে ফেলেছে। এই মানবিক-স্পর্শই যৌথ-অধিকার-চেতনাকে প্রকম্পিত করেছে। প্রশাসনিক-নির্যাতনের রীতিকে উপেক্ষা করে, ঘাটের ইজারাদারের চোখ-রাঙানিকে অবজ্ঞা করে, একক চিৎকারকে সমবেত রূপে প্রকাশ করেছে নির্যাতিতরা- ‘আমি কদম আলী’, ‘আমরা কদম আলী’। সব পুরুষের মাঝে একজন নারীর এই যৌথ-চিৎকার বা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ বা তৎকালীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বা একচেটিয়া পুঁজিখোরদের বিরুদ্ধে নিবিড় অবস্থান দর্শককে রঞ্জিত করেছে। সবের মধ্যে থেকেও প্রতিরোধে রাবেয়ার দৃঢ় অবস্থান তাকে আলাদা করেছে, যেমন করেছে ইবলিশ-এর আতশীকে। মোহাম্মদ জাকারিয়া’র কথা- ‘ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অভিনেতা দলগত অভিনয়ের মধ্যেও নিজের ছন্দকে ঠিকই বজায় রেখে চলেন- সমষ্টিগত অভিনয়কে অক্ষত রেখেই। এই গতিছন্দ তাঁর নিজস্ব।’২৩ আমি নিশ্চিত এই প্রক্রিয়ায় নাজমা আনোয়ার নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক; তিন স্তরকেই সমানভাবে সামাল দিয়েছেন।

উল্লিখিত নাট্যাভিনয়ে আমরা একই সমান্তরালে পাই দলীয় আদর্শ-নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃকে। একক ক্রিয়ায় আরণ্যক বিশ্বাসী নয়। যৌথ-সৃজনশীলতায় আরণ্যকের যাত্রা আজও ব্যাপ্তিমান। এ বিষয়ে খ্যাতিমান অভিনেত্রী আল্লা নাজিমোভা (১৮৭৯-১৯৪৫) বহু বহু আগে একটু বাড়াবাড়িভাবেই হয়ত বলেছেন, যা আরণ্যকেরই নির্দেশনাগত চিন্তার বিশেষ প্রতিফলন- ‘পরিচালক অভিনেতৃকে কী করতে হবে না, শুধু সেইটুকু বলবে। সে যদি সংলাপ কীভাবে বলতে হবে, কী অঙ্গভঙ্গি করতে হবে, সেসব বলে বা দেখায়, তবে সে খুনি। সে দুভার্গ্যবশত মনে করে যে, অভিনেতৃ মস্তিষ্কহীন, কল্পনা শক্তিহীন। তাই তাকে তোতাপাখির মতো শেখাও।’২৪ এ বিষয়ে আমার জানার অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। মহড়ার শুরুতে নাট্যকারের উপস্থিতি খানিকটা টের পাওয়া যায় বটে; কিন্তু খানিকবাদেই খুব অল্পঅল্প করে নাটকে কোরিওগ্রাফির সমাবেশ ঘটিয়ে বর্তমানে নাটককে এমন একটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়; যেখান থেকে নাট্যকারের অস্তিত্ত্ব খুঁজে পাওয়া আজ বড্ড কঠিন। সব নয়, কিছু কিছু নির্দেশক কখনো কখনো বলছেন- ‘তুমি শুধু দুপায়ের ওপর দাঁড়াবে। আমি অভিনয় বের করে আনব।’ অর্থাৎ তিনি সংলাপ বা পরিবেশ বিশ্লেষণে না গিয়ে জোরজবরদস্তি ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। আরও একটা উদহারণ- ‘আমি নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করতে বেশি আগ্রহী। কারণ আমি জানি কীভাবে অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করতে হয়।’ উল্লিখিত দুটি মন্তব্যে বোঝা যায়, নির্দেশক জবরদস্তি করছেন। এখন প্রশ্ন হলো, অভিনয়ে প্রাণের সঞ্চার যখন ঘটে না, তখন বোঝা যায়, পরিকল্পনার ঘাটতি কোথায়। অভিনেতৃ সমাজকে বিশ্লেষণ না করে যখন মঞ্চে দাঁড়ায়; সংলাপের গুরুত্ব ততদিনে ম্লান থেকে ম্লান হতে শুরু করে। তবে কোরিওগ্রাফিতে ঠাঁসা নাটকের দর্শকও দারুণ তৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফেরে। কিন্তু তাদের মাথায় আর নাটকের মূলবিষয় থাকে না। সেখানে কোরিওগ্রাফিই মূল হয়ে দাঁড়ায়। নাটক সমাজের দর্পণ এ বিষয়টি এভাবেই আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়।

অভিনয় নিয়ে হাজারো মত আছে- পথ আছে। অভিনয় প্রসঙ্গে এখানে আল্লা নাজিমোভা’র আরও দুটি মতামত তুলে ধরছি- ‘যে মুহূর্তে চরিত্রের চিন্তা ও অনুভূতিগুলো তুমি জানতে পারবে, এমনকি নাট্যকারের চেয়েও বেশি জানতে পারবে, তুমি তখন প্রায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংলাপ বলতে পারবে।’২৫ একজন ভালো অভিনেতৃর অভিনয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন- ‘ভালো অভিনেতৃ দর্শককে অনুভব করানোর সামর্থ থাকা চাই। সেটাই তার কাজ। কিন্তু নিজেকে চরিত্রের মধ্যে হারিয়ে ফেললে হবে না। সবসময় নিজেকে সংযত ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আবেগ, উচ্ছ্বাস, অনুপ্রেরণা-  যাই হোক না কেন, অভিনয় করতে গেলে এসব আসবেই। কিন্তু এগুলো নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে, চরিত্রের ভাষ্য বা ইলিউশন সৃষ্টির দিকে বেশি নজর দিতে হবে।’২৬ আল্লা নাজিমোভা পক্ষান্তরে আঁতোয়ান এর রিয়ালিজম এবং স্তানিস্লাভস্কির (১৮৬৩-১৯৩৮) ন্যাচারালিজমকেই সমর্থন করেছেন।২৭

এ ধরনের অভিনয়ের একজন নিবেদিত চর্চাকারী ছিলেন নাজমা আনোয়ার। ওরা কদম আলী নাটকে তাজুর ফিরে যাওয়ার দৃশ্যটির তৎকালীন বাস্তবতা এবং তার পিতার সাথে ফিরে যাওয়া সন্তানের প্রতি রাবেয়ার মমত্ববোধের কাক্সিক্ষত ক্রন্দন ও প্রতিবাদী গণচরিত্রের যৌথবিকাশে নিজেকে সার্থকভাবে সম্পৃক্ত করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন নাট্যকারের নাট্য-চরিত্রের ভাষ্য এবং ইলিউশন। এ ছিল এক দুরূহ ব্যালেন্সড অ্যাক্টিং। এখানে নাজমা আনোয়ারের সমাজদর্শনের সমান্তরালে তাঁর অভিনীত চারিত্রিক-ভাষ্য এবং ইলিউশন দুটিই এক-স্রোতে মিশেছে। যেখানে দর্শকও সমানভাবে অংশী। অর্থাৎ নাজমা আনোয়ার দর্শককেও সমানভাবে মনোজাগতিকভাবে মঞ্চে ডেকে নিয়ে এসেছেন। ওরা কদম আলী নাটকের মূলকথা এটিই। নাটকে রাবেয়া চরিত্রে তিনি পৌঁছেছেন আবেগ দিয়ে নয়; মঞ্চ-রিয়ালিজমকে নির্ভর করে। নাজমা আনোয়ার স্তানিস্লাভস্কির পথই অনুসরণ করেছেন ওরা কদম আলী নাটকে। তবে জেনে-শুনে নয়, নিজস্ব ভিতকে অবলম্বন করে।

কোরিওলেনাস নাটকে নাজমা আনোয়ারের চারিত্রিক অবস্থান ভিন্ন, এ নাটকে তিনি স্থির ধীশক্তির অধিকারী; যেখানে মিশেল ঘটেছে সন্তানের প্রতি অপত্য-স্নেহ, অন্যদিকে রাজ-শৌর্যের প্রতি আনুগত্য। যখন কোরিওলেনাস সিদ্ধান্ত নেয় সে রোম আক্রমণ করবে, তখন মা চরিত্রের ভলিউমনিয়া অর্থাৎ নাজমা আনোয়ার এবং কোরিওলেনাসের পারস্পরিক সংলাপ প্রক্ষেপণে তিনি যে দৃঢ়তা ও নিজেকে সংযত করবার দক্ষতা মঞ্চে দেখান, তা সত্যিকার অর্থেই অভাবনীয়। আমি নিশ্চিত দর্শক এখানে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তারা বুঝতে পারছেন না, মা তার ছেলের নিশ্চিত অধঃপতনে শঙ্কিত না কি ছেলের জয়ী হয়ে ফেরার অপেক্ষায় মা, না কি রোমের অধঃপতনের আশঙ্কায় তিনি শৌর্য হারানোর বিহ্বলতায় হতবিহ্বল। তিনি একই সঙ্গে এখানে তিনটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। এও ছিল ন্যাচারালিজমের তাত্ত্বিক নির্ভরতার নির্ভেজাল রূপ। ওরা কদম আলী, ইবলিশ, সাত পুরুষের ঋণ, নানকার পালার সব চরিত্র ভেঙে তিনি এখানে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন আর একটি নব-উপমায়। মামুনুর রশীদের কথাÑ“শেক্সপীয়রেরও তুমি ‘মা’। কোরিওলেনাসেরও ‘মা’। আগের সব অভিনয়কে অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালে রোমান বীরমাতা হিসেবে। দীর্ঘ দীর্ঘ সংলাপকে তুমি আওড়ে গেলে অবলীলায়, নবতর দেহ ভঙ্গিমায় সৃষ্টি করলে এক মহান চরিত্র।’’২৮

নাজমা আনোয়ার স্তানিস্লাভস্কির থিওরি মাথায় রেখে অভিনয় করেছেন, এটি আমার বিশ্বাসে নেই। তাঁর অভিনয়ের সাথে কাকতালীয়ভাবে থিওরির সম্মিলন ঘটেছে এবং তা ছিল একান্তই তাঁর এবং সূত্রের আকস্মিক সম্মেলন। পরিকল্পনাগত নয়। এটি আরণ্যকের নাট্যভাবনার মূলদর্শন। যা উৎসারিত হয়েছে আরণ্যকের রাজনৈতিকদর্শন থেকে। নাজমা আনোয়ার সে পথেই হেঁটেছেন। শিমূল ইউসুফের কথা- ‘একজন শিল্পী হিসেবে আমি বলব, বাংলাদেশে তাঁর (নাজমা আনোয়ার) মতো এমন কারেক্টার ওয়াইজ পারফরমার আর আসবে কি না সন্দেহ।’২৯ মান্নান হীরার কথা- “ইবলিশর ‘আতশী’ থেকে শেক্সপীয়রের কোরিওলেনাস’র মা চরিত্রে তিনি ছিলেন সমান পারদর্শী। সাধারণ গ্রামীণ-চরিত্র থেকে যেকোনো অভিজাত-চরিত্র রূপায়ণে তাঁর ছিল অসাধারণ ক্ষমতা। চরিত্র নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে ও নাট্যকারের সঙ্গে দিনের পর দিন কথা বলা, মতবিনিময় ও প্রয়োজনে বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়া, সবই করতেন তিনি।...তাঁর নিজস্ব কিছু অভিনয়শৈলী তাঁকে নির্মিত-চরিত্রে অনন্য করে তুলত আর সেখানে নাজমা আনোয়ার হয়ে উঠতেন মহান শিল্পী।”৩০

গিনিপিগ নাটকেও নাজমা আনোয়ার চরিত্রগত সাযুজ্যতায় ছিলেন নিবিড়। এ নাটকে তিনি ছিলেন এক দুর্নীতিবাজ আমলার স্ত্রীর চরিত্রে। গিনিপিগ নাটকে মূলত আমলা এবং তার কন্যা পপিই মূলচরিত্র। উচ্চপদস্থ আমলার গরবিনী স্ত্রী, যার বংশের গৌরব এবং পিতৃকুলের অভিজাত্যে পপির মা রাজিয়া থাকেন সবসময় অহংকারের মিশেলে। নাটকে নাজমা আনোয়ারের উপস্থিতি ছিল অল্প; কিন্তু যতটুকু তাঁর উপস্থিতি ছিল, তাতেই তিনি ছিলেন সপ্রতিভ এবং জীবনঘেঁষা। অপূর্ব বাচনভঙ্গী এবং মুভমেন্টের মধ্য দিয়ে তিনি তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থার একটি প্রতীকিরূপকে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন সার্থক দ্যোতনায়।

স্তানিস্লাভস্কি বিশ্বাস করতেন অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রধান বোধ হলো অভিনেতা-অভিনেত্রীর দর্শনগত প্রস্তুতি। তিনি নিজে যেমন বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতিবাদ প্রতীকবাদ, মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদ এবং সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদ, তেমনি চাইতেনও অভিনেতৃও এই বিশ্লেষণে অভিনয় করুক। আরণ্যকের নির্দেশনা-প্যাটার্নও তাই। আরণ্যক একটি দর্শনকে ধারণ করেছে, নাজমা আনোয়ার তাই নিয়ে এগিয়েছেন। ইবলিশ নাটকে গ্রামের টাউট মেম্বার, ধর্মান্ধ মৌলবী, পুঁজিপতি জোতদারের পতন যখন অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন তারা প্রথমেই আঘাত হানে শ্রমিকদের ঐক্যের প্রতি। সেখানে যখন ব্যর্থ হয় তখন শেষ-অস্ত্র হিসেবে তারা বেছে নেয় নারীকে। সেই নারী হলো ‘আতশী’। নিঃস্ব, অসহায়, স্বামী-পরিত্যাক্তা, সন্তানহারা, অবহেলিত নিত্য-অপমানিত আতশী তথা নাজমা আনোয়ারের শাস্তি যখন গ্রাম্য টাউট মেম্বার দ্বারা নির্ধারিত হয়, মসজিদের ইমাম যখন মেম্বারের সহযাত্রী হয়, তখন নাজমা আনোয়ারের বেঁচে থাকার আকুতি আমাকে জ্যাঁ পল সাত্রের অস্তিত্ববাদের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এখানে তিনি ছিলেন অবিশ্বাস্যভাবে নিরুত্তাপ, কিন্তু বিচলিত। শাস্তি স্বরূপ যখন আতশীকে অগ্নিশলাকা দিয়ে নির্যাতন করা হয়, তখন সামন্তশ্রেণির দাপট অতিরিক্ত উত্তাপের সাথেই পরিলক্ষিত হয়। কো-অ্যাক্টরের এই উত্তাপটুকু ধারণ করতে হবে ভিক্টিম চরিত্রকে; তবেই সার্থক হবে চরিত্রের উত্তরণ। এ দৃশ্যে নাজমা আনোয়ার সাবলীলভাবেই মঞ্চে ছড়িয়ে দেন নির্যাতনকারী এবং নির্যাতনভোগীর সামন্বিক চিত্র। যা দর্শককে মুহূর্তেই আলোড়িত করে।

এ প্রসঙ্গে ডেইলি স্টারে নাজমা বলেন- `In my stage drama, Iblish, I have played the role of a struggling woman called Atoshi. I am still very fond of this character. Despite losing a child and being thrown out of the house by her tyrannical husband, sheper severes and ekes out a living as a domestic help.’৩১ সন্তান হারানো এবং স্বামীর নির্যাতনের মুখে গৃহত্যাগী আতশী জীবনের শেষদিন-পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে টিকে থাকার লড়াইয়ে। যেখানে তার সাথে ছিল গ্রামের অন্যসব প্রান্তিকজন। ওইটুকুই ছিল তার সম্বল। সাহস এবং অপ্রতিরোধ্য জীবিকাচার ছিল তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ইবলিশে উত্তাপটুকু জ¦লে ওঠে, যখন তালবেলেমের চিৎকারে বোধে ফিরে আসে গ্রামের মানুষ। তারা এখানে যে প্রতিরোধ করে তাতে মনস্তাত্ত্বিক-বাস্তববাদ এবং সমাজতান্ত্রিক-বাস্তববাদের সফল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই। এ হিসাবটুকু নাজমা আনোয়ারের গাণিতিক দর্পণে বিরাজিত। সার্থক অভিনয়ও তিনি করেছেন এই দৃশ্যে। এ প্রসঙ্গে নাজমা বলেনÑ‘ইবলিশ নাটকের আতশী চরিত্রটি আমাকে ভীষণভাবে টানে। এর একটি ডায়ালগও আমি ভুলিনি। মনের মধ্যে গেঁথে আছে। প্রথমত অসম্ভব সাফারড ও পরবর্তীসময়ে অসম্ভব রিভোলটিং কারেক্টার।’৩২ নাজমা আনোয়ার আরও বলেন-...`One of my greatest achievements is that I strongly empathise with my struggling characters.`৩৩

এক্ষেত্রে আমি আবশ্যিকভাবে বলব, অ্যালিয়েশন ইফেক্টের প্রবক্তা ব্রেটল্ট ব্রেখটের (১৮৯৮-১৯৫৬) অভিনয়-ভাবনার সাথে স্তানিস্লাভস্কির অভিনয়-ভাবনায় বেশ মিল আছে। দুজনের মেথডে আবেগের অবস্থান বেশ নিচে। ব্রেখট মার্কস-লেনিনের গভীর অনুসারী। নাট্যচর্চায়Dialectical তত্ত্বের সার্থক প্রয়োগকারী। dialectical তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুক্তির ওপর। সেখানে আবেগের কোনো স্থান নেই। নাজমা আনোয়ার তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়রীতিতে রিয়ালিজম, ন্যাচারালিজমের ধারায় এগিয়েছেন, তবে হয়ত জেনে শুনে নয়। এটি তাঁর সহজাত অভিনয়রীতি। আবেগ-সম্পর্কিত স্যার লরেন্স অলিভিয়ারের (১৯০৭-১৯৮৯) একটি মতামত, তিনি বলেছেন- ‘নিষ্ঠাভাবে, প্রচুর সময় নিয়ে, সঠিক পদ্ধতিতে নিজের ব্যক্তিত্বকে আবৃত করে, অন্য মানুষকে দেখানোর চেষ্টা করে যাওয়াÑযতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তোমাকে সেই মানুষটিই ভাবছে। সেই ইলিউশনকে বিশ্বাস করছে।’৩৪ অলিভিয়ারের কথায় একজন অভিনেতৃকে বুঝতে হবে যে, সামনে দর্শক আছে, সেই বিশ্বাসটুকু মাথায় নিয়েই অভিনয় করতে হবে। অলিভিয়ার তাঁর নিজের অভিনয় সম্পর্কে বলেছেন- ‘শরীরের চলনকে ও অঙ্গের ভঙ্গিমাকে অনেক গুরুত্ব দিই। সযত্নে সেসব সাজাই। আবেগকে ধীরে ধীরে উদ্দীপিত ও প্রশমিত করি।’৩৫ অর্থাৎ আবেগের প্রণোদনা থাকবে, তবে তা হবে নিয়ন্ত্রিত।

ড. ইউসুফ হাসান অর্ক তাঁর অভিনয়রীতি গ্রন্থে চমৎকারভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারণার সমন্বয় করেছেন অ্যারিস্টটলের পোয়েটিকস গ্রন্থের অনুসরণে। তিনি চমৎকারভাবে অ্যারিস্টটলিয় ধারণায় চারটি শব্দ নিজস্ব-ভাষায় উল্লেখ করেছেন, যা মূলত অ্যারিস্টটলের ভাবনাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি বলেছেন- ‘চরিত্রের অভিজ্ঞতা ও ঘটনার অনুকরণ’।৩৬ একজন অভিনেতৃর জন্য এই চারটি শব্দই প্রত্যক্ষভাবে তাঁর মঞ্চকলাকে উপজীব্য করে তোলে দর্শকের কাছে। এর প্রয়োগ কতখানি তিনি করবেন, সেই নির্দেশনাটুকু নির্দেশক ঠিক করে দেবেন, তবে প্রজ্ঞাটুকু তাঁকেই দেখাতে হবে অর্থাৎ যিনি অভিনয় করবেন তাঁকেই। সমতট নাটকই তার প্রকৃষ্ট উদহারণ। সমতট নাটকে দুটি অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে থেকে মনস্তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ছিল এ অংশের প্রধান প্রেক্ষিত; দ্বিতীয় অংশ ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক-বিশৃঙ্খলা এবং সামরিক শাসনের মধ্য দিয়ে স্থির সমাজকে অস্থির করবার প্রবণতা। নাট্যকার খুব সাধারণ সংলাপে অসাধারণভাবে সময়কে তুলে এনেছেন একটি ঘরে। যে ঘরে স্বামী সন্তান নিয়ে একটি পরিবারের আপাত সুখের-বসবাস। কিন্তু প্রবলভাবে সংবেদনশীলতার ঝড়ঝাপটাকে চিত্রিত করবার উচ্চমুখী প্রচেষ্টা। এ নাটকে অন্তর্গত সংবেদনশীলতার চরম নিয়ন্ত্রিত বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাই। বহিঃযন্ত্রণায় আক্রান্ত হয়ে সংসারের ভাঙন, সন্তানদের অনিশ্চিত গন্তব্য এবং পলয়ানপর মনোবৃত্তি, স্বামীর অস্থিরতায় দোটানা ভাবনা, কন্যাসন্তানের টিকে থাকার লড়াই এবং বেশ-পরে মৃত বড়ো সন্তানের ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সংসারের ভাঙন; পর্যায়ক্রমে সংগঠিত এসময়ে একমাত্র মা-ই ছিলেন নীলকণ্ঠী-নিঃশব্দযাত্রী।

একটি চরিত্রের নানামুখী অভিনয়ের যে সমন্বয়তা, চরিত্র থেকে চরিত্রে নিজেকে সমর্পণ, প্রতিটি অস্থিরতায় মায়ের পৌনঃপুনিক ভাঙন এবং ভাঙনের মধ্য থেকে পুনর্জাগরণÑতা নাজমা আনোয়ার দেখিয়েছেন অপরূপ ভঙ্গিমায়। দর্শকের সকল সমবেদনা কেন্দ্রীভূত হয়েছে নাজমা আনোয়ারের প্রতি। যা নাজমা আনোয়ারের অভিনয়গুণেই সম্পন্ন হয়েছে। একটি মঞ্চে, একটি ঘরে প্রবল ঝাপটার ভিন্ন ভিন্ন রূপ এবং সামাল দেয়ার প্রতিরূপায়ণে নাজমা আনোয়ারের দক্ষতা ছিল অবিশ্বাস্য। মামুনুর রশীদ এ নাটকের অভিনয়সূত্রে নাজমা আনোয়ারকে দিয়েছেন সুউচ্চ সম্মাননা- ‘নাট্যকারের সৃষ্টিকে বিস্তর ব্যাখ্যায় তুমি উদ্দীপ্ত করতে পেরেছ বারবার। সমতট নাটকে মায়ের চরিত্রটি কখনো ব্রেশটের মাদার মনে হয়। যেখানে একজন মা কতভাবে সন্তানদের রক্ষার জন্যে প্রাণপণ লড়াই করছেন। ব্যক্তিগত জীবনেও মনে হয়েছে তুমি যেন মাদার কারেজ।’৩৭ গিয়াসউদ্দীন সেলিমের কথা- ‘একজন সংবেদনশীল অভিনেত্রী কত সুনিপুণভাবে একটা চরিত্র নিজের ভেতর ধারণ করতে পারেন সেটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতা- অত্যন্ত তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা। প্রায় ১৫ বছর আগে সমতট নাটকের চরিত্র-চিত্রন এখনও আমি দেখতে পাই।’৩৮ এ নাটকে নাজমা আনোয়ারের মধ্যে ছিল প্রত্যয় এবং প্রভাব। যা তিনি সামলেছেন মধ্যবিত্ত নারী-চরিত্রের ভৌগলিক পরিবেশকে মস্তিষ্কে রেখে। অর্থাৎ তিনি এ ভূমির সকল কৃত্যকে সম্বোধনে রেখে তাকে পুনর্জাগরিত করেছেন সাবলীলভাবে। যা তাঁর নাটকীয় চরিত্রের সাথে বাঙালি মধ্যবিত্ত চরিত্রের টানাপোড়েনকে সার্থকভাবে মঞ্চে উপস্থাপিত করেছে। তাঁর সেই প্রজ্ঞা ছিল এবং পরিমিতিবোধ নিয়ে তিনি নিদের্শকের সাথেই তাঁর নিজস্বরীতির সমন্বয় করতেন। যা ছিল তাঁর অভিনয়রীতির প্রথম এবং শেষ দিশা। যেখানে ছিল নিয়ন্ত্রিত আবেগ। যদিও ইবলিশ নাটকের শেষ দৃশ্যে এ আবেগ নিয়ন্ত্রণে নাজমা আনোয়ার খানিকটা বেসামাল ছিলেন, তবে দর্শকের আনুকূল্য ছিল তাঁর প্রতি বিস্তর।

নাজমা আনোয়ার সবসময় মঞ্চে তাঁর অভিনয়ের মধ্যদিয়ে দর্শকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হতেন। তিনি সার্থকভাবে মঞ্চ-রিয়ালিজমের প্রয়োগ ঘটাতেন এবং যখন অভিনয় করতেন তখন মনে হতো না তিনি দর্শকের মনস্তাত্ত্বিক-রিয়ালিজমের অংশ, না কি দর্শক মঞ্চে তাঁর সাথে হাঁটছেন। নাজমা আনোয়ার নির্দেশনা শুনতেন গভীরভাবে, কিন্তু মানতেন নিজস্ব-রিয়ালিজমের মধ্য থেকে। এটি তাঁর স্বভাবজাত-প্রক্রিয়া বললেও ভুল হবে না। যদিও আমাদের নির্দেশকদের প্রায় শতভাগই অভিনেতৃকে এই মর্মে শিক্ষা দেন যে, ‘সামনে কোনো দর্শক নেই, তাই মাথায় রাখবে।’ ভাখতানগভ এ বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন- “প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিনেতা-অভিনেত্রী মঞ্চে এসে দর্শকের উপস্থিতির কথাটা জোর করে ভুলতে চায়। সে ভাবতে শুরু করে ‘আমি একা, আমার সামনে কেউ নেই, দর্শক নেই ইত্যাদি’। এটা ভুল পদ্ধতি।” চার্লি চ্যাপলিন বলতেন- ‘প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গি সবসময়ই শ্রেষ্ঠ। রীতিসর্বস্ব অভিনয় নিষ্প্রাণ।’৩৯ তবে চার্লি চ্যাপলিন স্তানিস্লাভস্কির ইনার ট্রুথের ওপরও বেশ জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেনÑ‘এ হলো, কোনো চরিত্রে অভিনয় না করে, সেই চরিত্রটি হয়ে ওঠা।’৪০ নাজমা আনোয়ার তাই হতেন; তবে হয়ত কোনো থিওরি পড়ে পড়ে না, অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য থেকেই।

নাজমা আনোয়ারের কণ্ঠস্বর ছিল ক্রিস্টাল ছাঁচের মতো। সেখানে কোনো ভাঙন ছিল না। যতক্ষণ-পর্যন্ত তিনি নিজে তা না ভাঙতেন। বরেণ্য অভিনেতা শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত বা খালেদ খান ছিলেন বাংলা নাট্যমঞ্চের অন্যতম কণ্ঠস্বরের অধিকারী। ড. ইনামুল হক নাজমা আনোয়ারের কণ্ঠ এবং উচ্চারণ সম্পর্কে বলেছেন- ‘তাঁর সবচেয়ে প্লাস পয়েন্ট তাঁর কণ্ঠ, শুদ্ধ উচ্চারণ, কোথায় থামতে হবে ও কীভাবে বলতে হবে।’৪১

নাজমা আনোয়ার এসব কিছুর সংমিশ্রণেই তাঁর অভিনয়কে কালজয়ী করে গেছেন। যেখানে তিনি কোনো ম্যাথডে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। প্রাসঙ্গিকভাবেই চার্লি চ্যাপলিনের আর একটি কথা উল্লেখ করছি। ‘শুধু প্রতিভা থাকাটিই যথেষ্ট নয়, প্রয়োগ-কৌশলে দক্ষ হওয়াটিও বিশেষ দরকারি।’৪২ খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। আমাদের ৭০/৮০ দশকের সকল প্রখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীই এই প্রয়োগ-কৌশলকে নিজস্ব অভিনয়-চেতনার প্রধান অবলম্বন করেছেন। নাজমা আনোয়ার চ্যাপলিনের সেই কৌশলেরই সার্থক অনুসারী।  

শেষ কথা : ১

বলা আবশ্যক যে, নাজমা আনোয়ারের অভিনয় বহুমাত্রিকতায় পৌঁছেছে আরণ্যক নাট্যদলের কারণেই। মামুনুর রশীদের নাটকের মধ্যদিয়ে প্রথমে, পরবর্তীসময়ে আব্দুল্লাহেল মাহমুদ এবং মান্নান হীরার নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে মামুনুর রশীদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদানই বেশি। তিনি মূলত এককে বিশ্বাসী নন; তিনি সমাজের বহুত্বে বিশ্বাসী। যা তাঁর রচিত নাটকে আমরা দেখি। একটি নিটোলগল্প থাকবে, যেখানে সমাজের সকল-স্তরের প্রতিনিধিকে তিনি মঞ্চে তুলে ধরেন তাঁর নাটকের মাধ্যমে। এই মাধ্যমের সাথে দর্শক যেমন পরিচিতি লাভ করে, তেমনি মঞ্চে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁরাও সমাজের এই বহুস্তরের চরিত্রের সাথে মিশে যান। সেই মিশে-যাওয়ার ক্ষেত্রে কার অভিনয়ের প্রাবল্য নির্দেশকের নির্দেশনার সহায়ক হবে তা নিশ্চিত করতে হবে শেষপর্যন্ত অভিনেতৃকেই। অভিনেতৃই নাট্যকারের নাটকে রক্তসঞ্চালনের দায়িত্ব নেবেন। নাট্যকার প্রাথমিকভাবে একটি ভূমি তৈরি করবেন। সেই ভূমিতে অভিনেতৃ হাঁটবেন নির্দেশকের নির্দেশনাকে অবলম্বন করে। তবে হাঁটতে গিয়ে কোথায় ইটের টুকরা আছে আর কোথায় কাঁটা আছে, তা পরখ করতে হবে অভিনেতৃকেই। সেই পরখ যার যত বেশি সূক্ষ্ম হবে সে ততবেশি মঞ্চের-মাধ্যমে দর্শকের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে, অভিনয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং দৃঢ়তা দিয়ে। নাজমা আনোয়ার পরখের ক্ষেত্রটিকে দারুণভাবে, নিবিড়ভাবে মানসচক্ষে দেখতে পেয়েছেন বলেই তিনি সতত আলাদা। মোস্তফা মনোয়ারের কথা- ‘...আরেক রকম অভিনয় আছে যেটা একেবারে সহজাত। হঠাৎ করে চলে আসে নিজের মধ্যে। সেই অভিনয়ের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। সেখানে চরিত্র, পরিবেশ ও ঘটনা-প্রবাহ এই তিনটির সমন্বয়ে নিজের মধ্যে একটা ছন্দ, একটা দেহভঙ্গি কী করে যেন এসে যায়। নাজমা আনোয়ার সেই দলের শিল্পী। শৈল্পিক-শিক্ষায় সেই মননশীলতা না থাকলে কেবল ওয়ার্কশপ-জাতীয় শিক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে শিল্পী তৈরি করা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে নান্দনিক-বোধটি থাকতে হবে। এই বোধটা বরাবরই নাজমার মধ্যে ছিল।৪৩

নাসির উদ্দীন ইউসুফের কথা- ‘নাজমা আনোয়ার আমাদের দেশের সেই বিরল-শিল্পীদের মধ্যে একজন যিনি তাঁর শিল্পবোধ ও মেধা দিয়ে একজন বহুমাত্রিক অভিনয়-শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।...তিনি সকল বর্ণ, ধর্ম, জাতি, মানুষের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-অধিকারে বিশ্বাসী একজন মানুষ।...নাজমা আনোয়ারের শিল্পসৃষ্টির জায়গাটা যদি বলি, তাঁর পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল।...এই যে তাঁর সৃষ্টিশীলতার ব্যাপ্তি, এই যে বহুমাত্রিকতা- তা বিরল। তিনি যেকোনো-শ্রেণির, যেকোনো-বয়সের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারতেন।... নাজমা আনোয়ারের যে বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতা ছিল, সেই অভিজ্ঞতা নিংড়ে তিনি যে চরিত্রটা নির্মাণ করতেন- সেই বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতার মানুষ কোথায়?’৪৪ নাজমা আনোয়ারও এ মাটির নির্যাস থেকে যা আহরণ করেছেন তাই দিয়ে সাজিয়েছেন তাঁর অভিনয়ের ডালি। সে অভিনয় সকল নাট্যকর্মী, নাট্যকার, অভিনেতৃ, নির্দেশক এবং দর্শক গ্রহণ করেছেন অশেষ-শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায়। অভিনয় প্রসঙ্গে একদিন মহিলা সমিতির সিঁড়ির আড্ডায় প্রখ্যাত অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদি বলেছিলেন- ‘অভিনয়ের জন্য যদি শিক্ষাই প্রধান হতো, তবে তো সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-ই খ্যাতিমান অভিনেতা হয়ে যেতেন।’

আমি প্রথাগত-তত্ত্বের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিতর্ক করছি না। আমি গত শতকের ৭০/৮০/৯০ দশকের অভিনয়রীতির প্রেক্ষিত তুলে ধরেছি- নাজমা আনোয়ারের অভিনয় প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে। আমার ধারণা আরণ্যকের ফজলুর রহমান বাবু এবং নাজমা আনোয়ার প্রমুখ কীর্তিমান অভিনেতৃগণ উল্লিখিত অভিনয়ধারার সার্থক অনুসারী।

শেষ কথা : ২

পূর্ণ বা আংশিক-তত্ত্বনির্ভর ভিন্নধারা অবলম্বেনেও বিংশ শতাব্দীর ৭০/৮০/৯০ দশকে খ্যাতি পেয়েছেন, আজও পাচ্ছেনÑবহু অভিনেতা-অভিনেত্রী; আজকেরকালে তত্ত্বনির্ভরতাই তো প্রধান, সাথে অসাধারণ সব কোরিওগ্রাফি! তবুও নাট্যচিন্তক ড. বিপ্লব বালার একটি কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। তাঁর কথা দিয়ে শেষ করছি- ‘...নাজমা আনোয়ার ছিলেন একাকী, দূর অরণ্যচারিণী, পথভুলে ঢাকা-মঞ্চে বুঝিবা- তাঁর উত্তর-স্বাধিকা হবার সাধ্য আপাতত বুঝি অসম্ভব এই নগর-বাজার বিশ্বে।’৪৫

তথ্যসূত্র
১.    Kavita Charanji, Najma Anwar : A grassroots actress getting under the skin of her characters, The Daily Star, July 02, 2004, Newspaper
২.    নাজমা আনোয়ার, বিক্রমপুরের গর্ব, সাপ্তাহিক বিক্রমপুর, ৩ জুন ২০১৯, সাপ্তাহিক  
৩.    আবুল হায়াত, ‘ঘুমিয়ে আছেন তিনি’, বরেণ্য নাট্যশিল্পী নাজমা আনোয়ার, মোমেনা চৌধুরী (সম্পাদক), সোনারং, ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৮, গ্রন্থ
৪.    Actress Nazma Anwar passes away, Staff Correspondent, The Daily Star, Dec 16 2004, Newspaper
৫.   Sara Zaker, Tribute : In memory of Najma Anwar, The Daily Star, Jan 8 2005, Newspaper
৬.  Afsar Ahmed, Theatre activists pay homage to Najma Anwar, The Daily Star, Dec 20 2004, Newspaper
৭.    প্রাগুক্ত
৮.    প্রাগুক্ত
৯.    প্রাগুক্ত
১০.    প্রাগুক্ত
১১.    মামুনুর রশীদ, নাট্যকার, নির্দেশক, সদস্য-আরণ্যক নির্দেশনা দল, আরণ্যক নাট্য দল, ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৩, টেলিফোন-সাক্ষাৎকার
১২.    আব্দুল্লাহেল মাহমুদ, নাট্যকার, পাদটীকা নং ১১, ২৩ জুন ২০২৩, ম্যাসেঞ্জার-সাক্ষাৎকার
১৩.    মোহাম্মদ জাকারিয়া, অভিনয়-ভাবনা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৩১, গ্রন্থ
১৪.    মামুনুর রশীদ, ‘মাদার কারেজ নাজমা আনোয়ার’, থিয়েটারওয়ালা, হাসান শাহরিয়ার (সম্পাদক), ঢাকা, ২০০৫, পৃ. ৯-১০, নাট্য পত্রিকা
১৫.    সালাহউদ্দীন লাভলু, পাদটীকা নং ১১, ২৩ জুন ২০২৩, টেলিফোন-সাক্ষাৎকার
১৬.    শাহ আলম দুলাল, নির্দেশক, সাবেক প্রধান সম্পাদক, পাদটীকা নং ১১, ২১ জুন ২০২৩, টেলিফোন-সাক্ষাৎকার
১৭.    মো. মুস্তাফিজুর রহমান (ড.), অভিনয়কলা, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ১৪৯, গ্রন্থ
১৮.    রাহমান চৌধুরী, চরিত্রসৃষ্টি এবং অভিনয়, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১১, পৃ. ২৩০, গ্রন্থ’
১৯.    আতাউর রহমান, নাট্য প্রযোজনায় নির্দেশকের ভূমিকা, নাটক করতে হলে, আতাউর রহমান (সম্পাদক),  বিদ্যা প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ. ১১২, গ্রন্থ
২০.    প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩, গ্রন্থ
২১.    প্রাগুক্ত
২২.    প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৩-১১৪, গ্রন্থ
২৩.    পাদটীকা নং ১৩, পৃ. ৩২, গ্রন্থ
২৪.    অন্জন দাশগুপ্ত, চার্লি চ্যাপলিন, অভিনয় চিন্তন, তৃতীয় খ-, গোপা দাশগুপ্ত, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৩, গ্রন্থ
২৫.    প্রাগুক্ত
২৬.    প্রাগুক্ত
২৭.    পাদটীকা নং ২৪, পৃ. ৬, গ্রন্থ
২৮.    পাদটীকা নং ১৪, পৃষ্ঠা ১০
২৯.    শিমূল ইউসুফ, ‘তাঁর প্রতি সহ¯্র শ্রদ্ধা’, পাদটীকা নং ৪
৩০.    মান্নান হীরা, ‘মঞ্চের ভালোবাসায় সিক্ত নাজমা আনোয়ার’, পাদটীকা নং ১৪, পৃ. ১৩-১৪
৩১.    পাদটীকা নং ১
৩২.    কাজী হাসান, ‘নাজমা আনোয়ারের সাথে কিছুক্ষণ’, পাদটীকা নং ৩
৩৩.    পাদটীকা নং ১
৩৪.    প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৫, গ্রন্থ
৩৫.    প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৪, গ্রন্থ
৩৬.    ইউসুফ হাসান অর্ক, চরিত্রাভিনয় এবং বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি, একটি তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ, অভিনয়রীতি, ভাষাচিত্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, ঢাকা, পৃ. ৫০, গ্রন্থ
৩৭.    পাদটীকা নং ১৪, ১০
৩৮.    গিয়াসউদ্দিন সেলিম, ‘হারানের নাতজামাই এবং প্রিয় নাজমা আনোয়ার’, পাদটীকা নং ৩
৩৯.    পাদটীকা নং ২৪, পৃ. ৩০, গ্রন্থ
৪০.    প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০, গ্রন্থ
৪১.    ইনামুল হক (ড.), ‘সন্ধিক্ষণে আমরা’, পাদটীকা নং ৩
৪২.    পাদটীকা নং ২৪, পৃ. ৩৮-৩৯, গ্রন্থ
৪৩.    মুস্তাফা মনোয়ার, ‘নাট্যশিল্পী নাজমা আনোয়ার’, পাদটীকা নং ৪
৪৪.    নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ‘প্রিয় নাজমা আনোয়ার’, প্রাগুক্ত
৪৫.    বিপ্লব বালা, ‘বঙ্গবালা নাজমা আনোয়ার : অয়ি পেশল সুষমাময়ী’, পাদটীকা নং ১৪, পৃ. ১১

ড. বাবুল বিশ্বাস ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, নাট্য-গবেষক