Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : নির্বাচিত ৫০ প্রযোজনা।। প্রসঙ্গ: মাতব্রিং

Written by অংশুমান ভৌমিক.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

নাটক: মাতব্রিং। রচনা: সাধনা আহমেদ। মঞ্চ-আবহসংগীতপরিকল্পনা ও নির্দেশনা: ইউসুফ হাসান অর্ক। আলোকপরিকল্পনা: শাহীন রহমান। পোশাকপরিকল্পনা: আইরিন পারভীন লোপা। পোস্টার ডিজাইন: ধ্রুব এষ। প্রথম মঞ্চায়ন-বর্ষ: ২০১৬। একটি ‘বিবর্তন যশোর’ প্রযোজনা

[যশোরের ‘বিবর্তন যশোর’ প্রযোজনা মাতব্রিং নাটকের এই নাট্যসমালোচনাটি অরণ্যের অধিকারের মুষল পর্ব- শিরোনামে আবুল হাসনাত সম্পাদিত কালি ও কলম (কলকাতা সংস্করণ) পত্রিকায় ছাপা হয় পৌষ ১৪২৩ সংখ্যায়। ‘থিয়েটারওয়ালা’র এবারের বিশেষ-সংখ্যায় নাট্যসমালোচনাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো]

বলতেই হচ্ছে যে অসাধ্য সাধন করেছে ‘বিবর্তন যশোর’। গেল পঁচিশ বছরে সামাজিক-অঙ্গীকারকে সামনে রেখে দিনবদলের স্বপ্নকে বুকে বেঁধে থিয়েটার করছেন তারা। জাতিক ও আন্তর্জাতিক স্তরের উৎসবে-আয়োজনে তাদের উদ্যোগ ও উদ্যমের পরিচয় মিলেছে। মাতব্রিং মঞ্চস্থ করে তারা বুঝিয়ে দিলেন কলজের জোর তো বটেই, কবজির জোরেও তারা কিছু কম যান না। সমবায়ী শিল্পের গরজ অনেকের থাকে। সেটিকে সাকার করার মুরোদ সবার থাকে না। যৌবনে প্লব এই দলটির তা আছে।

কেন? মাতব্রিং কী নিয়ে?

এক কথায় বলা যায় না।

একদিক থেকে দেখলে মাতব্রিং একটি প্রেমকথা। গারো পাহাড়ের আদিম উপত্যকায় অনাদিকালের ঘাম গন্ধ রক্ত রোমাঞ্চ বুকে নিয়ে কানু (জাহিদুল ইসলাম যাদু) আর মিত্তি (তানজিলা আক্তার জিনি) একদিন ‘আমি তোর হলাম আমি তোর হলাম’ এই অঙ্গীকারে বাঁধা পড়েছিল। মিত্তির মা রুগালার (সাবিকুন্নাহার কাকলী) মধ্যে দিয়ে বাদসাধলো নগরায়ন। বিয়ের পথে কাঁটা হলো ভূমি জমি পয়সার বিনিময়ে দাম্পত্যকে নির্ণয় করার নাগরিক-সমীকরণ। কানুকে যেতে হলো নগরে। মিত্তিকে বিয়ে করার টাকা রোজগার করতে। মিত্তি রইল প্রতীক্ষায়।

অন্যদিক থেকে দেখলে মাতব্রিং ইকোফেমিনিজমের সাজানো বাগান। কে না জানে যে কর্পোরেট ক্যাপিটাল মুনাফা ছাড়া কিস্যু বোঝে না। আবাসন নির্মাণের উসিলায় ছোট সাহেব (মানস বিশ্বাস) আর তার চামচা (কামাল হাসান রিপন) মিলে পল্লীকে গ্রাস করতে চায়, অরণ্যকে গ্রাস করতে চায়, ঝরনাকে গ্রাস করতে চায়, নারীকে গ্রাস করতে চায়। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে সরকারের কাছ থেকে বনের ইজারা নিয়ে গারো পাহাড়ের সানুদেশে সেই কোন মান্ধাতার আমল থেকে কৃষি আর পশুপালন করে জীবন উদ্যাপন করা মান্দি জনগোষ্ঠীকে ভূমিচ্যুত করতে চায়। ধরিত্রীকে নিঃস্ব করতে চায়, রিক্ত করতে চায়। কেউ রুখে দাঁড়ায়, কেউ বিকিয়ে যায়। ঢুকে পড়ে ফরেস্টারের (দেবদুলাল রায়) মতো ঘোড়েল দালাল। গোষ্ঠীপতি নকমাকে (নওরোজ আলম খান চপল) হাত করে ফেলে। লড়াই তবু থেমে থাকে না। উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের আদায়-কাঁচকলা সম্পর্ক গড়ে ওঠায় বাংলাদেশ এখন আলোড়িত। মাতব্রিং এই সংকটবিন্দুতে অবস্থান করে। অরণ্যের অধিকারকে নান্দনিক স্বীকৃতি দেয়।

আরেকদিক থেকে দেখলে এ লড়াই দুই সভ্যতার সংঘাত। একদিকে সহজ সরল কৌমজীবন, অন্যদিকে জটিল জান্তব নগরজীবন। মৃত্তিকালগ্ন সুর বনাম শূন্য কুম্ভের আস্ফালন। সালজং দেবতার সাথে সেটেলারদের অসম অলীক পাঞ্জা লড়াই। ‘জঙ্গল এখন গরমেন্টের’ কিনা! আধুনিক সভ্যতা নদী আর নারীকে ধ্বংস করে এগোতে চায়। স্তব্ধ করতে চায় সোমেশ্বরীর চলা, মিত্তির চলা। চাকমা, হাজং, মারমা এমন কত জনজাতি নাগরিক-স্বাচ্ছন্দ্যের কুহকটানে আপন সংস্কৃতির আখর ভুলতে চাইছে। মান্দিরা বাদ থাকে কেন? ঝাঁকের কই তো ঝাঁকেই মেশে। মাতব্রিং তবু প্রশ্ন তুলে যায়।

আরও একটি দৃষ্টিকোণ আছে। সেটির সঙ্গে বাংলাদেশের আধুনিক ইতিহাস ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্ন জড়িয়ে। আদিবাসী, মূলবাসী, জনজাতি, নৃগোষ্ঠী যে নামেই ডাকি না কেন, প্রান্তিক মানুষদের হাতে রাজদ- নেই। তাদের কোনো কোনো প্রতিনিধি এ নিয়ে সরব, সংসদ ভবনের অলিন্দেও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। টানাপোড়েন চলতেই থাকে। সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারাজীবন ঔপনিবেশিক ১৮শ শতকের বাংলার প্রান্তিক কৃষকদের প্রতিস্পর্ধাকে মর্যাদা দিয়েছে। মামুনুর রশীদের রাঢ়াঙ উত্তর-ঔপনিবেশিক-পর্বে সাঁওতালদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে কুর্নিশ করেছে। বছরখানেক আগে এই সমালোচক দেখেছিল কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির চিয়ারী। উত্তর-১৯৭১ বাংলাদেশে প্রান্তিক-জনজাতির নাগরিকত্বের দাবিকে সালাম ঠুকেছিল সেই প্রযোজনা। প্রযোজনার সামগ্রিক নৈপুণ্যে মাতব্রিং এই ধারায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন।

এটি যাঁর মানসকন্যা সেই সাধনা আহমেদ সমকালীন বঙ্গনাট্যে একটি স্বতন্ত্র স্বর। তাঁর লেখনীতে সহজাত এক কাব্যময়তা আছে যা মননের উষ্ণতা দাবি করে। তাঁর পদ্য ইন্দ্রিয়কে অবলম্বন করে অতীন্দ্রিয়ের ইশারা দেয়। তাঁর গদ্যসংলাপ কাব্যের হাত ধরাধরি করে চলে। তাঁর আরণ্যক উচ্চারণ জাদুবাস্তব আর পরাবাস্তবের আলপথ ধরে এগোয়। এরই পিঠোপিঠি তাঁর নাগরিক-উচ্চারণ এ জীবনের অন্তঃসারশূন্যতাকে উদোম করে। মাতব্রিং-এ প্রমিত বাংলাকেই বাহন করেছেন সাধনা। জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন ‘জুম’, ‘ফইট্যা’, ‘রাজামা’, ‘জাকছাপ’-এর মতো জনজাতিক সাংস্কৃতিক-অভিজ্ঞান। কলাবতী সাংমার (অদিতি সরকার রুমা) মতো এক প্রাচীনাকে নকশিকাঁথার সুইফোঁড়ে জুড়ে দিয়েছেন মাতব্রিং-এর দেহে। কানু যখন নগরে যাওয়া মনস্থ করে কলাবতী তখন হাহাকার করে ওঠেন- ‘ভূমিজাতক ভূমি ছেড়ে কোথায় যায়’। এই হাহাকার আমাদের এই উপমহাদেশের অন্তর্লীন বিষাদসিন্ধুতে জোয়ার আনে। ছিন্নমূল বাঙালির বেদনাকে গলার মধ্যে বিঁধিয়ে দেয়। বহুধা বিভায় আলোকিত হয় একটি বিশিষ্ট জীবনচর্যা যার শেকড় চারিয়ে আছে আমাদের নাগরিক-অস্তিত্বের সাধু-কঙ্কালে। রুগালা আর মিত্তির তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে মননশীল দর্শকের চেতনায় ডাক দিয়ে যায় রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য চ-ালিকা-য় প্রকৃতি আর মায়ের কথোপকথন। মাতব্রিং-এর শরীরে যতখানি রবীন্দ্রনাথ আছেন ততখানি আছেন তার সত্তায়। আর আছেন সেলিম আল দীন। ইশারায় ও আবডালে।

বর্ণনাত্মকরীতিতে গীতিনাট্য-নির্মাণে ইউসুফ হাসান অর্কের যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। কয়েক বছর আগে কবি¬ নির্মাণে এর একটি স্তরকে ছুঁয়েছিলেন তিনি। মাতব্রিং-এ তিনি পরের ধাপে চড়েছেন। সুরের সাথে তাঁর সহবাস এ প্রযোজনার অঙ্গরাগ। এ নাট্যের শরীরে অগণিত গান বুনেছেন অর্ক। সাধনার বর্ণনাত্মক গদ্যে সুর বসিয়েছেন অনর্গল। তাকে ছেনেছেন আদিম ছন্দে, বেঁধেছেন আনদ্ধ বাদ্যে, গড়েছেন লোকায়ত শারীরিক বিভঙ্গে। গায়েনের দল বায়েনের দল বসেছেন মঞ্চের পেছনে সার বেঁধে। এতে করে একটি সহজিয়া গতি পেয়েছে মাতব্রিং। বয়েছে আপন বেগে। এর দরুন মুশিকলও হয়েছে। কখনও কখনও খাজনার চেয়ে বাজনা হয়েছে বেশি। বিশেষ করে মাতব্রিং-এর প্রস্তাবনাপর্বে মান্দি জনজাতির কৌমজীবনের দুরন্ত উদ্যাপনের মধ্যে যে একটি অতলান্ত অতীত আছে তা লেখায় থাকলেও বলায় আসে নি। গভীর বাণীকে ঢেকে দিয়েছে উচ্চকিত মঞ্চআয়োজন। অগভীর সম্মেলক উচ্চারণে খেই হারিয়েছে সৃষ্টিরহস্য। সুর আর বাণীর এই মণিকাঞ্চন যোগটি না ঘটায় এক নিরালম্ব শূন্যতায় কেবল দৃশ্যভাবনায় ভর করে মাতব্রিং-এর সূচনা হয়েছে। কানু-মিত্তির প্রেমের পটভূমিতে তার বিস্তার ঘটেছে।

আবার কানু-মিত্তির বিচ্ছেদবিন্দুটিতে অর্কের সাংগীতিক-প্রয়োগ তুঙ্গবিন্দু স্পর্শ করেছে। সাধনা লিখেছেন-
ও আমার পরান পাখি শোন জোনাক জ¦লা রাতে
জোনাকির জাকলিন পরাব পরাব তোর হাতে।
যেয়ো না যেয়ো সখা মন মানে না তাতে
তুমি মোর সালজং দেবতা রহো আমারই কাছে।।
রব না রব না রব না দূরে আসব আবার ফিরে
জ্যোৎস্না হয়ে ঝরব তোর সোমেশ্বরী পায়ে।।

পয়ারের ছাঁদে খোদাই করা এই স্বপ্নচিত্রে জ্বলজ্বল করেছে ‘জোনাকির জাকলিন’-এর মতো অলৌকিক গহনা। মায়াবি সুরের মূর্ছনায়, একক ও সম্মেলক উচ্চারণের দোটানায় তাকে রসিক-দর্শকের বুকে পুরে দিয়েছেন অর্ক। আর তখন আলোকপরিকল্পক শাহীন রহমানের হাতযশে সাইক্লোরামা ধুয়ে গিয়েছে নীল আভায়। তার বুকে ভেসে উঠেছে পূর্ণিমা রাতের চাঁদ। প্রকৃতির এই পূর্ণতার প্রতিফলন ঘটেছে অদিতি সরকার রুমার নৃত্য-নির্মাণে।

৯৫ মিনিটের এই প্রযোজনাজুড়ে আছে এমন বেশ কয়েকটি স্মরণীয় দৃশ্য। নির্মাণ ও উপস্থাপনের বাহাদুরিতে সেগুলো চমৎকার। কানু-মিত্তির পুনর্মিলনের দৃশ্যটিও বিশেষভাবে উল্লেখ্য। উল্লেখযোগ্য শেষদৃশ্যটি যেখানে ‘রাতভর নগরের অলিগলি ধরে কানু হেঁকে যায় তাতারারাবুগা হিবাবো’। সে বিশ্বাস করে যে তার মিত্তি ‘নগরের কোনো খাঁচার ভেতর থেকে পাল্টা হেঁকে বলবে তাতারারাবুগা হিবাবো’। তখন তাতারারাবুগা-রূপী সানোয়ার আলম খান দুলু দুহাত তুলে এসে দাঁড়ান ডাউনস্টেজ সেন্টারে। আর কানু-মিত্তির অচরিতার্থ জীবনের অলৌকিক পূর্ণত্ব ঘটে সেন্টারস্টেজে রাখা কাঠের পাটাতনের ওপর। এই বিয়োগান্ত পরিণতি মাতব্রিং-এর প্রার্থিত-দর্শককে আরও নিবিড় অনুভবের পথে নিয়ে চলে।

মাতব্রিং-এর একদিকে যদি মান্দি জনজাতির নিজস্বতার উদ্যাপন ও সংকট থাকে, অন্যদিকে আছে নগরায়িত বাংলাদেশের কয়েকটি আত্মধ্বংসী প্রবণতা। আবাসন প্রকল্পের কেষ্টুবিষ্টুদের মুখ থেকে গারো পাহাড় গ্রাস করার নীল নকশা শোনানোর ছলে সমকালীন জীবনযাপনের বেশ কয়েকটি অসঙ্গতিকে কাঠগড়ায় চড়িয়েছে মাতব্রিং। বাণিজ্যবান্ধব পরিসরে রবীন্দ্রনাথের ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে যাওয়া নিয়ে যেমন বিষম কটাক্ষ ছুঁড়েছে, তেমনই পরিবেশবাদীদের সাথে আবাসন বঙ্গবাসীদের তলে তলে বোঝাপড়ার দিকেও আঙুল তুলেছে। এমনকি বঙ্গবাসীদের তালে তাল মিলিয়ে প্রতিবাদী জনজাতিকে গুলি করে পুড়িয়ে মেরে নিকেশ করার রাষ্ট্রীয় অতিসক্রিয়তাকেও ছেড়ে কথা কয় নি। তবে কারো হাতে মোবাইল ফোন না থাকায় কোনো নির্দিষ্ট কালখণ্ডে এটিকে নির্ধারণ করা উচিত হবে না। এই নান্দনিক বুদ্ধিমত্তা মাতব্রিং-কে একটি উদার জমিনে বিচরণ করতে দিয়েছে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে ‘বিবর্তন যশোরে’র কুশীলবরা নিজেদের উজাড় করে দিয়ে অভিনয় করেছে। তাদের ক্ষিপ্রতা, তাদের সংগীতবোধ আমাদের নজর কেড়েছে। যতদিন যাবে এই গভীর নাট্যশরীরের আনাচে-কানাচে তাদের আনাগোনা আরও স্বচ্ছ্বন্দ হবে। স্বল্প পরিসরে দাগ কেটেছেন কামরুল হাসান রিপন, কৌতুক অভিনয়ের ক্ষমতা তাঁর সহজাত। শুধু দর্শকের উচ্ছ্বাসকে অগ্রাহ্য করার তরিকা তাঁকে শিখে নিতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রায়ণ করেছেন দেবলাল রায়, নওরোজ আলম খান চপল। কানুর চরিত্রে জাহিদুল ইসলাম যাদুর শরীর যত একাত্ম হয়েছে, বুঝি অন্তর তত হয় নি। গলাটি তার বেশ। তবু সংলাপের ওজন বুঝে কথা তাঁকে বলতেই হবে। মিত্তির ভূমিকায় মিটমিট করে জ্বলেছেন তানজিলা আক্তার জিনি। সাধনার ভাষায় ‘ঘন কুয়াশার আসমানের নিচে নীল গারো, তার নিচে আরও নীল সোমেশ্বরীর জল, সে নদীর পাড় ধরে ঝুমঝুম মল বাজিয়ে দৌড়ে চলে যে কইন্যা, সেই তো মিত্তি’। জিনি এই প্রতিমাটিকে সর্বাঙ্গে ধারণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলতেই হবে মাতব্রিং-এর পরিচ্ছদপরিকল্পক আইরিন পারভীন লোপার কথা। জনজাতির বেশভূষায় আটপৌরে একটি আদল এনেছেন তিনি। সুতিবস্ত্রের হরেকরকম বুনোট আর বুননকে আপন করেছেন। গয়না পরিয়েছেন দরকার মাফিক। এতে করে গারো পাহাড়ের সাথে আরও অন্যান্য প্রান্তিক জনপদের বিনিসুতোয় মালা গাঁথতে পেরেছে মাতব্রিং।

মাতব্রিং-এর প্রোডাকশ ডিজাইনারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভিডিও প্রোজেকশন। প্রেক্ষাগৃহের প্রথমসারির ঠিক মাঝখান থেকে সাইক্লোরামার বুকে প্রোজেকশন হচ্ছে। একেবারে গোড়াতেই এ নাট্যের কথক তথা গারো কৌমপিতা তাতারারাবুগা (সানোয়ার আলম খান দুলু)-র আবির্ভাব ঘটেছে তারাম-লের ছত্রছায়ায়। ষাঁড়ের সঙ্গে কানুর প্রচণ্ড যুদ্ধকে ছাপিয়ে প্রবল আকার নিয়েছে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রের চলমান চিত্রমালা। আমাদের মনে হয়েছে দর্শকের কল্পনাশক্তির ওপর বুঝি নির্দেশকের আস্থা নেই। কানু নগরে আসার পর ‘মানুষের বিড়াল হাঁটার ঝলক ঝালক’-কে কীভাবে যেন দেখাতে চান নির্দেশক। বেজে ওঠে সিনথেটিক সুর। পরদায় ফুটে ওঠে সাইকেডেলিক আলোর তলায় উন্নতগ্রীব নারীর পদচারণ। চঞ্চল হয়ে ওঠে দর্শক। এই অতিরেক আমাদের ভাবনাকে নগরবিরূপ করে তোলো। এমনটি অভিপ্রেত ছিল না।

মান্দিদের খেরেস্টান হওয়াকে তাদের ‘দুখের শুরু’ বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন সাধনা। চার্চের আশ্রমে বেড়ে ওঠা ফ্যাশন শো কোরিওগ্রাফার অ্যান্টনির (শেখ জাহিদ) অস্তিত্বের সংকটকে ধর্মীয়-আগ্রাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝতে চেয়েছিলেন। অর্ক এই সরলীকরণকে এক ধাপ চড়িয়ে খ্রিস্টান মিশনারি আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের এক সাথে শূলে চড়িয়েছেন। ভিডিও প্রোজেকশনে দেখা গেছে ইউনিয়ন জ্যাক নিয়ে নিম্নবর্গীয় কৃষকদের পেড়ে ফেলেছে ঔপনিবেশিক শক্তি। ঠারেঠোরে বোঝানো হয়েছে যে খ্রিস্টার মিশনারিরা ঐ শক্তির তল্পিবাহক। ইতিহাসের এই তরল রাজনৈতিক ব্যাখ্যা মাতব্রিং-এর ভিতকে নড়বড়ে করেছে। এটি সংশোধনের দাবি রাখে।

আবার শেষদিকে যেখানে শাসক ও শোষিতের সম্পর্ককে বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে সব দেশের সব কালের মাত্রায় স্থাপন করতে চেয়েছিলেন নির্দেশক, সেখানেও ভিডিও প্রোজেকশন তাঁর সহায়ক হয়েছে। এই উপমহাদেশের সীমানাকে তুড়ি মেরে পেরিয়ে গিয়ে বিশ্বইতিহাসের পটপরিবর্তনের ধারায় মাতব্রিং-কে স্থাপন করতে পেরেছে। এই সমালোচকের মনে ভেসে উঠেছে ‘ঢাকা থিয়েটারে’র নিমজ্জন-এর দৃশ্যবৈভব।

বছর দেড়েক আগে একটি ব্যক্তিগত আলাপনে ‘ঢাকা থিয়েটারে’র যূথপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু গভীর বিষণ্নতা থেকে এই সমালোচককে বলেছিলেন, ‘সেলিম (সেলিম আল দীন) আর দু-তিন বছর বেঁচে থাকলে আমরা যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা একটা পাকাপোক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে যেত’। গেল কয়েক বছর ধরে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে সেলিম আল দীনের হাতে আধুনিক নাট্যভাষে উত্তীর্ণ হওয়া বাংলার এই ঘরের জিনিস। প্রসেনিয়ামের ঘেরাটোপকে মেনে বা না-মেনে প্লট-সিন-ডায়ালগের আঁটোসাঁটো বাঁধুনিকে পাশে সরিয়ে রেখে আখ্যানবিন্যাসের বাঙালি ঐতিহ্যকে লোকায়ত পরিসর থেকে ছেনে এনে তার নির্যাসকে পরিবেশন করছে নাগরিক-দরবারে। ষোলো আনা বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির ছাঁচে ঢালাই করা না হলেও সাধনা আহমেদের মাতব্রিং তাঁর (বাচ্চু) মতো মানুষকে আশ্বস্ত করবে। সেলিমের রচনায় যে মন্ময় লোকজীবন প্রবহমান সাধনা সেটিকে আত্মস্থ করেছেন। ভাবীকাল তাঁর উত্তরণের প্রতাশা করবে।

শুরুর-কথার জের টেনে শেষ-কথায় আসা যাক। মাতব্রিং-এর পূর্বসূরি হিসেবে যে প্রযোজনাটির কথা আমাদের এ সমালোচনায় এসেছে সেই রাঢ়াঙ-এর নামকরণে একটি সংযোজন ঘটিয়েছিলেন নাটককার তথা নাট্যকার মামুনুর রশীদ। মূল-নামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ‘দূরাগত মাদলের ধ্বনি’ শব্দবন্ধটি। এভাবে নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব উচ্চারণ আর নাগরিকমঞ্চায়নের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক-সেতুবন্ধন ঘটেছিল। সাধনা আহমেদ জানিয়েছেন, মাতব্রিং আঁচিক ভাষার একটি শব্দ যার অর্থ ‘গভীর অরণ্যচারী’। চমৎকার! এখন এই দুটি শব্দকে প্রযোজনার মূল-নামের পাশে বসিয়ে দিলেই পৃিথবীর পারাপারের জন্যে একটি সাঁকো অক্লেশে তৈরি হয়ে যায়। এই প্রযোজনার অন্তর্লীন আকাক্সক্ষাটির ভাব-সম্প্রসারণ ঘটিয়ে অভিপ্রেত একটি উদ্দীপনার জন্ম দেয়। মাতব্রিং-এর মাথারা ভেবে দেখতে পারেন।

আর একটি সবিনয় নিবেদন।

মাতব্রিং-এর পুস্তিকা দেখে মনে হলো এই প্রযোজনার সাপেক্ষে সাধনা আহমেদের অবস্থান নির্ণয়ে পুস্তিকা সম্পাদক কিঞ্চিৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মলাটে লেখা হয়েছে মাতব্রিং তাঁর রচনা। একটু পাতা ওলটালেই আমরা ‘নাটককারের কথা’ শিরোনামে সাধনার একটি বয়ান পাচ্ছি। খানিক বাদে কলাকুশলীদের পরিচয়পত্রীতে তিনি ‘নাট্যকার’। আশ্চর্য! আফসার আহমদের প্রশস্তিবচনেও তাই। বলাই বাহুল্য যে এই বিভ্রান্তি এই পুস্তিকা সম্পাদকের একার নয়, এক অর্থে বাংলা নাট্যজগতের। লোকনাট্যে ‘নাটককার’ আর ‘নাট্যকার’ অঙ্গাঙ্গী। কিন্তু নাগরিকনাট্য একটি তিলোত্তমাশিল্প। যত দিন যাচ্ছে নাটককার অর্থাৎ যিনি নাট্যের প্রাথমিক নাটলিপি রচনা করেন, তার সাথে নাট্যকার অর্থাৎ যিনি এই তিলোত্তমাশিল্পের সব কটি উপাদানের মধ্যে একটি সমন্বয় সম্পন্ন করে সেটিকে মঞ্চের উপযোগী করে তোলেন, তার দূরত্ব বাড়ছে। এই দূরত্ব নাট্যপ্রয়োগের খুঁটিনাটির। আধুনিক-নাট্যের প্রয়োগকলায় এত এত মাত্রা ইদানীং জুড়ে গেছে যে একে ‘ডিরেক্টরস থিয়েটার’ বলতে কারো আপত্তি হবার কথা নয়। আর তাই যদি হবে ‘থিয়েটার ডিরেক্টর’-এর বাংলা তরজমা ‘নাট্যনির্দেশক’ বা আরও ছোট করে ‘নাট্যকার’ বলাই শ্রেয়। আর ‘প্লেরাইট’-এর মাথায় উঠুক ‘নাটককার’ উষ্ণীষ। এতে করে দুটি বাড়তি সুবিধা মিলছে। প্রথমত, নাটককার আর নাট্যকারের স্বতন্ত্র পরিচয় স্বীকৃতি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইয়োরোপ-আমেরিকায় হালে চালু হওয়া ‘আর্স্টিস্টিক ডিরেক্টর’ তকমাটিকেও ‘নাট্যকার’-এর মতো বহুব্যঞ্জনাসম্পন্ন শব্দের পেটে পুরে নেওয়া যাচ্ছে।

অনেকদিন আগে শম্ভু মিত্র এই পৃথকীকরণের ডাক দিয়েছিলেন। সেটিকে বাংলা-সংস্কৃতির হরেক অঙ্গনে মেনে নেওয়া ও মনে নেওয়ার দরকার পড়েছে।
 
অংশুমান ভৌমিক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। ভারতের প্রথমসারির দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ আর বাংলা মাসিক ‘কৃত্তিবাস’ এর নাট্যসমালোচক