Full premium theme for CMS
গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : নানান রঙের থিয়েটার ও আমার কৈফিয়ত
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
প্রায় ২৫ বছর ধরে গ্রুপ থিয়েটার চর্চার অবিরত চেষ্টা চলছে আমার। সেই শুরু থেকে এখন অবধি জেলা পর্যায়ের (রাজধানীর দৃষ্টিতে যাকে মফস্বল বলে থাকি, সেই গ্রাম, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়) নাট্যচর্চা এবং রাজধানীর নাট্যচর্চার সাথে বিভিন্নভাবে যুক্ত থাকবার কম-বেশি অভিজ্ঞতা হয়েছে। একজন সাধারণ নাট্যকর্মী হিসেবে সাদা চোখে বেশ কিছু পরিবর্তন যেমন চোখে পড়েছে, তেমনি নানান সময়ে নানান প্রশ্নও মনে বাসা বেঁধেছে। পাশাপাশি অপর দুই বাংলা ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের নাট্য উৎসবগুলোতে নাট্যপ্রদর্শনী করবার সৌভাগ্য যেমন ঘটেছে, তেমনি এসব স্থানের নাট্যপ্রদর্শনী প্রত্যক্ষ করা এবং নাট্যজনদের সাথে নাট্যচর্চা বিষয়ে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কেরও সুযোগ ঘটেছে।
নানান সময় নাট্যবন্ধুদের সাথেও থিয়েটারচর্চা নিয়ে নানান ধরনের সু-কথা এবং অবশ্যই কু-কথারও চর্চা হয়; আমরা আনন্দের সাথেই ভালোলাগা থিয়েটারের পঞ্চমুখ প্রশংসার পাশাপাশি ভালো-না-লাগা প্রযোজনা সম্পর্কে সমান নিন্দায় ভাসিয়ে দিই। অগ্রজ নাট্যগুরু-নাট্যশিক্ষক-নাট্যজনদের নাট্যকর্মের দ্বারা হই অনুপ্রাণিত, কখনো তাদের অন্ধ অনুকরণ করি আবার কখনো অনুসরণ। আমার চর্চা এবং জানাশোনার সেই সময় থেকে এই সময়; থিয়েটারচর্চার সেসব অভিজ্ঞতা নিজের মতো করে বলবার একটা প্রয়াস যেহেতু পাওয়া গেল, তাই সেই সুযোগটি সানন্দে গ্রহণ করেছি।
পাঠক সকলকে এটুকু বলে নিতে চাই যে, এই লেখাটিতে প্রকাশিত সকল কথার দায়ভার সম্পূর্ণ আমার। ব্যক্তিগতভাবে থিয়েটারে আমার অভিজ্ঞতা, আমার পর্যবেক্ষণ, আমার মনে জমে থাকা প্রশ্ন এবং তার ব্যাখ্যা আমার মতো করেই এবং হয়তো কিছুটা অগোছালোভাবে প্রকাশ করছি এখানে। আমার এ ভাবনা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুলও হতে পারে, তবে কোনটি ভুল আর কোনটি সঠিক সেই বিচারও তো আপেক্ষিক; পরিবেশ পরিস্থিতি অবস্থা বিচারে পার্থক্য থেকেই যায়। আবার আমার না জানার পরিধিটার জন্যে অনেক তথ্য এখানে উপস্থাপিত নাও হতে পারে, অনেকের কথা উহ্যই থেকে যেতে পারে; এসকল বিষয় একান্ত আমারই অক্ষমতা এবং অজ্ঞানতার প্রকাশ বলেই অবিহিত হবে। তবে দেশের সকল স্থানের সকল নাট্যউদ্যোগের সাথে এবং প্রতিটি নাটকপাগল নাটক করিয়ে মানুষগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসা রয়েছে, রয়েছে সমর্থন।
শুরুর আগে আরো একটি কথা; আমার নাট্যচর্চাকালীন নানান রঙের থিয়েটারের কথাই বলার চেষ্টা করেছি, তবে কিছু কিছু জায়গায় সূত্র হিসেবে পূর্ব সময়ের থিয়েটারচর্চার কথাও চলে এসেছে অবধারিতভাবে।
গত ২০ বছরে নাগরিক নাট্যচর্চা
১৯৯৩ সালে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু করি কুষ্টিয়ায়, বাংলাদেশের ভালো থিয়েটার করিয়ে নাট্যদলগুলোর একটি ‘বোধন থিয়েটার’-এ যুক্ত হবার মাধ্যমে। সেসময় প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক বা সামাজিক গণমাধ্যমের এত বাড়াবাড়ি ছিল না। তবুও সেসময় সারা বাংলাদেশের নাট্যদল এবং তাদের ভালো মঞ্চ প্রযোজনার খোঁজ পাওয়া যেত। কুষ্টিয়া থেকেই রাজধানী ঢাকার নাট্যদলের পাশাপাশি পার্বতীপুর, রংপুর, সৈয়দপুর, বরিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেট, বাগেরহাটের নাট্যদলগুলোর নাটকের খবর পেয়ে যেতাম। পার্বতীপুরের ‘কিনু কাহারের থেটার’, সৈয়দপুরের ‘মানুষ’, বাগেরহাটের ‘ইনফরমার’, চট্টগ্রামের ‘মলকা বানু’ নাট্যপ্রযোজনাগুলো ছাড়াও আরো ভালো ভালো প্রযোজনার প্রশংসা শুনতাম অগ্রজদের কাছে।
তখন প্রায় প্রতিটি নাট্যসংগঠনেরই জমজমাট অবস্থা। জেলাশহরগুলোতে একটি নাট্যদল কোনো প্রদর্শনী করলে, তার পরপরই বেশ কিছু আগ্রহী মানুষ অভিনেতা হিসেবে দলে যোগদানের ইচ্ছায় যোগাযোগ শুরু করে দিত; আবার বন্ধু বা পরিচিতজন থিয়েটার করে দেখেও আগ্রহী হয়ে আসতো কেউ কেউ। আবার পুরনো নাট্যকর্মীর পরিবারেরও কেউ কেউ এসে যোগ দিত নতুন সদস্য হিসেবে। তবে রাজধানীর অবস্থা ছিল একেবারেই ভিন্ন। পরিচয় বা পারিবারিক সূত্র ধরে কিছু নাট্যকর্মী দলে প্রবেশ করতো বটে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নতুন কর্মী সংগ্রহের আহ্বানে সাড়া দিয়ে একঝাঁক তরুণ-তরুণী আবেদন করতো। প্রতিটি দলের আহ্বানেই পঞ্চাশ থেকে একশ’র মতো আবেদনকারী সাক্ষাৎকার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাছাই পর্ব পার করতো। তবে দলটি হয়তো বিশ-পঁচিশজনকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করতো নাট্যকর্মশালার জন্য, এরপর কর্মশালাতে টিকে যাওয়ারাই নবীন নাট্যকর্মী হিসেবে দলে ঠাঁই পেত। নতুন কর্মী দলে প্রবেশ করলে, আগে তাকে মঞ্চে অভিনয়ের উপযোগী করে গড়ে তুলবার প্রক্রিয়া শুরু হতো। প্রথমে একটা মানসিক আঘাত করা হতো; একে বলা হতো মধ্যবিত্তের মেরুদ-টা ভেঙে দেয়া। মহড়াকক্ষ ঝাড়ু দেয়া, মহড়ার সময় চা এনে পরিবেশন করা, নাটকের প্রদর্শনীর সময় মঞ্চসজ্জা-মিলনায়তন ব্যবস্থাপনা-টিকেট বিক্রিসহ নানান কর্মকাণ্ডে যুক্ত করবার মাধ্যমে এটা করা হতো। এ পরীক্ষায় যারা টিকে যেত, তারা তখন মহড়াতে মাঝে মাঝে অনুপস্থিত অভিনেতার বিকল্প হিসেবে দাঁড়াবার সুযোগ পেত। এভাবে ধীরে ধীরে উচ্চারণ অভিনয়সহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে জানা-বোঝার পর দর্শকের সম্মুখে মঞ্চের আলোয় দাঁড়াবার সুযোগ মিলতো।
নতুন কোনো নাটক মঞ্চে আনার উদ্যোগ নেয়া হলে শুরু হয়ে যেত সুস্থ প্রতিযোগিতা। কে কোন চরিত্র করবে, কে কোন দায়িত্ব পালন করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মহড়াতে থাকতো টান টান উত্তেজনা, কারণ, একটি চরিত্রে দাঁড়াবার জন্য তিন/চারজন আগ্রহী এবং সকলেই চেষ্টা করে চলেছে প্রাণপণ। মহড়াকক্ষ প্রতি সন্ধ্যাতেই থাকতো জমজমাট। নতুন কর্মীদের জন্য মহড়াকক্ষ হতো একটি থিয়েটার শেখার শ্রেণিকক্ষের মতো, আর পুরনো কর্মীরা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের ঝালিয়ে নিতো। দলের সেরা সদস্য হয়ে উঠবার একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা চলতো। এমন সুস্থ প্রতিযোগিতা একটি প্রযোজনার মান বাড়িয়ে দিত, একটি নাট্যদলকে এগিয়ে নিত সফল প্রযোজনার লক্ষ্যে। নিয়মিত মহড়াতো হতোই, পাশাপাশি থিয়েটার-আড্ডা চলতো মহড়াহীন দিনগুলোতে। থিয়েটারের অতীত-বর্তমান নিয়ে কথা, কীভাবে থিয়েটারকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে, সেখানে করণীয় কী- ইত্যাদি; এসব নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনাও একজন নাট্যকর্মীকে সমৃদ্ধ করে তুলতো। থিয়েটারবিষয়ক বই, পত্রিকা পড়া এবং পাঠচক্রেরও আয়োজন হতো। প্রতিটি প্রদর্শনীর পরই রিভিউ মিটিং ছিল অবধারিত। সংগঠন এবং প্রযোজনার উৎকর্ষতা অর্জনে প্রতিটি নাট্যদলই ছিল আন্তরিক এবং সচেষ্ট।
চোখের সামনেই এই অবস্থার পরিবর্তন দেখেছি। সারা দেশজুড়ে। স্বীকার করি বা নাই করি থিয়েটারের সেই রমরমা-জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। রাজধানীর বাইরে থিয়েটার দলই এখন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমার শহর কুষ্টিয়াতে কমপক্ষে দশ/বারোটি থিয়েটার দল ক্রিয়াশীল ছিল; সারাদেশেই প্রতিটি জেলাশহরে কম বেশি পাঁচ/ছয়টি করে নাট্যদল সক্রিয় ছিল তাদের নিয়মিত নাট্যকা-ের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ জেলা শহরগুলোতে একটি অথবা দুটি নাট্যদল টিকে রয়েছে। তরুণ নাট্যকর্মীদের ধরে রাখতে না পারা, বর্তমান প্রজন্মের উপযোগী স্বপ্ন দেখাতে না পারা এর অন্যতম কারণ।
একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, স্বাধীনতাউত্তরকালে যেসকল তরুণ যুবকেরা থিয়েটার দল গড়ে তুলেছিলেন, তারা সকলে এখন বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে। কিন্তু দলের দায়িত্বভার তারা বেশিরভাগই পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করেন নি। সময়ের প্রবাহে থিয়েটারচর্চায় যে পরিবর্তন ঘটেছে; সেই অনুযায়ীও থিয়েটারচর্চা তারা করেন নি বা করতে পারেন নি (একাধিক নাট্যদলের নবীন এবং প্রবীণের দ্বন্দ্ব আমি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি, এবং সেটা ‘কেমন নাটক করা উচিত আর কেমন করা উচিত না’ এসব নিয়ে)। ফলস্বরূপ এখন এসকল নাট্যদল হারিয়ে গেছে কিংবা কোনো রকমে ধুকে ধুকে চলছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রাম থিয়েটার, মুক্তনাটক আন্দোলন আর থিয়েটার ফেডারেশন মিলে যেভাবে রাজধানী-শহর-উপশহর-গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত থিয়েটার চর্চাটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিল; নতুন নতুন থিয়েটার দল গড়ে উঠেছিল, পূর্ণ উদ্যমে নানান রঙে-ঢঙে-ভঙ্গিমায় নাট্যকর্মশালা, নাট্যনির্মাণ, নাট্যপ্রদর্শনী, মিটিং, সেমিনার, উৎসব মিলে সারাদেশ জুড়ে যেন থিয়েটারের যজ্ঞ শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকেই এই ঘটনাগুলো ঘটা শুরু হয়ে তুঙ্গে উঠেছিল। এখনতো থিয়েটার চর্চাটা শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক, ফলে, সংকুচিত। আবার যতদিন না দেশের জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন স্তরে থিয়েটারটাকে পৌঁছানো যাচ্ছে, প্রসারিত করা যাচ্ছে, ততদিন ব্যর্থতা আর হতাশার পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে; এত হতাশার অর্থ কি এটাই দাঁড়ায় যে বাংলাদেশে এখন ভালো থিয়েটার হচ্ছে না? অবশ্যই হচ্ছে। শুধুমাত্র গত ২০ বছরের ঢাকার মঞ্চের থিয়েটার প্রযোজনাগুলোর দিকে যদি দৃষ্টি দিই, তাহলে দেখতে পাবো কতসব বৈচিত্র্যপূর্ণ নাট্য প্রযোজনা এসেছে দর্শকের সমুখে; এই সুযোগে উল্লেখযোগ্য কিছু নাট্য প্রযোজনার উল্লেখ করা যেতে পারে; নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের স্বপ্নবাজ, ওপেন কাপল, রক্তকরবী, ঘাসিরাম কতোয়াল; থিয়েটারের (নাটক সরণি) মুক্তি; আরণ্যক নাট্যদলের সংক্রান্তি, রাঢ়াঙ, ময়ূর সিংহাসন; ঢাকা থিয়েটারের বনপাংশুল, প্রাচ্য, নিমজ্জন, ধাবমান; লোকনাট্যদলের সোনাই মাধব, পদ্মানদীর মাঝি; নাট্যচক্রের সাইকেলওয়ালা, একা এক নারী; থিয়েটারের (আরামবাগ) নিখাই; থিয়েটার আর্ট ইউনিটের সময়ের প্রয়োজনে, আমিনা সুন্দরী, মর্ষকাম, অনুদ্ধারণীয়; নাট্যকেন্দ্রের প্রজাপতি, আরজ চরিতামৃত, এক যে ছিল দুই চোর; সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটারের অ্যাম্পিউটেশন, পীর চান, ভেলুয়া সুন্দরী, রাজা; প্রাচ্যনাটের সার্কাস সার্কাস, কইন্যা, কিনু কাহারের থেটার; ঢাকা পদাতিকের কথা’৭১; সময়-এর ভাগের মানুষ, শেষ সংলাপ; মহাকালের শিখণ্ডী কথা, শ্রাবণ ট্র্যাজেডি; সুবচন নাট্য সংসদের তীর্থঙ্কর, খনা, মহাজনের নাও; উদীচী’র চিলেকোঠার সেপাই, বৌবসন্তী; দৃশ্যপট-এর সক্রেটিসের জবানবন্দী; দেশ নাটক-এর লোহা, নিত্যপুরাণ; নাগরিক নাট্যাঙ্গনের গওহর বাদশা ও বানেছাপরী; বটতলা’র খনা, ক্রাচের কর্নেল, দ্য ট্রায়াল অব মাল্লাম ইলিয়া; পালাকারের ডাকঘর, রিকোয়েস্ট কনসার্ট, মানগুলা, বাংলার মাটি বাংলার জল; প্রাঙ্গণেমোরের আওরঙ্গজেব, আমি ও রবীন্দ্রনাথ; ইউনিভার্সেল থিয়েটারের মহাত্মা; অবয়ব-এর ফেরিওয়ালা; বাতিঘর-এর ঊর্ণাজাল; দৃষ্টিপাত-এর রাজা হিমাদ্রী; ধ্রুপদী এ্যাকটিং স্পেসের নভেরা; শূন্যন-এর লাল জমিন; থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস; শিল্পকলা একাডেমির পুত্র, এক ’শ বস্তা চাল, টার্গেট প্লাটুন, গাজী কালু চম্পাবতী, মুল্লুক, হ্যামলেট, বাঁধ; জন্মসূত্র-এর অহরকণ্ডল; বাঙলা থিয়েটারের চে’র সাইকেল; আগন্তুক-এর ধলেশ্বরী অপেরা; দশরূপক-এর বিসর্জন, যাত্রিক-এর অ্যান ইন্সপেক্টর কলস; আরশীনগর-এর রহু চণ্ডালের হাড়, নাটবাঙলা-এর রিজওয়ান, স্পর্ধা-এর জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা; ওপেন স্পেস-এর টুয়েলভ এ্যাংরি ম্যান; তাড়ুয়া-এর লেট মি আউট; বিবর্তন যশোর (ঢাকা শাখা)-এর ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের কমলারানীর সাগর দীঘি, বেহুলার ভাসান, সং ভং চং, ম্যাকবেথ, উরুভঙ্গম, মধ্যমব্যয়োগ, প্রথম পার্থ, পাঁজরে চন্দ্রবাণ, রসপুরাণ; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের কারবালার জারী; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যকলা বিভাগের জননী সাহসিকা। এ নাট্য প্রযোজনাগুলোর সবগুলোই মঞ্চে সফল কিংবা দর্শকনন্দিত হতে পেরেছে কিনা, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ; তবে নানানভাবে প্রযোজনাগুলো আলোচনায় এসেছে। বিষয়বৈচিত্র্যে দেশজ আঙ্গিক, রূপকথা, লোককথা, বিশ্বনাট্য, উপন্যাস-গল্পের নাট্যরূপ, অনুবাদ, রূপান্তর, ফিউশন; নানান রঙের এবং স্বাদের থিয়েটার দেখেছি আমরা ঢাকার মঞ্চে। ঢাকার বাইরেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক থিয়েটার হয়েছে। বিশ বছরের হিসাবে উল্লেখযোগ্য না বলে অবশ্য ‘হাতে গোণা’ শব্দটা ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত। তবে একথা সত্যি যে, এখন ভালো থিয়েটার প্রযোজনার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে; কিন্তু ভালো থিয়েটার প্রযোজনার সংখ্যা বাড়ছে মানে এই নয় যে থিয়েটারের অনুকূল পরিবেশ বর্তমান। রাষ্ট্রিকভাবে বাৎসরিক বাজেট বরাদ্দের দিকে তাকালে আমরা বুঝতে পারি রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দল এবং জনপ্রতিনিধিরা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের মূল্যায়ন করছেন কীভাবে, গুরুত্ব দিচ্ছেন কতটুকু। একটা দুইটা থিয়েটার হল নির্মাণ কিংবা বাৎসরিক সামান্য পরিমাণ থোক বরাদ্দ দিয়ে থিয়েটারের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। হাতে গোণা কিছু ভালো মঞ্চ প্রযোজনা তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু তার সবই হয় ব্যক্তি কিংবা সাংগঠনিক উদ্যোগে, এখানে রাষ্ট্রের কিংবা সরকারের কোনো সহযোগিতা নেই। জাতীয় নাট্যশালা কিংবা মহিলা সমিতিতে নাট্য প্রদর্শনীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা ভর্তূকি রয়েছে বটে, তবে এটাও মনে রাখা দরকার, যৎসামান্য অনুদান দিয়ে থিয়েটার চর্চা এগিয়ে নেয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজন সার্বিক সহযোগিতা।
থিয়েটার এবং তরুণ নাট্যকর্মী
একটা অভিযোগ রয়েছে তরুণ নাট্যকর্মীদের বিরুদ্ধে। এখনকার তরুণেরা থিয়েটারে আসতে চায় না, থিয়েটারে আসলেও ঠিকমত সময় দেয় না। থিয়েটারটাকে ঠিক ভালোবাসতে পারে না আজকের তরুণেরা। এখনকার তরুণদের মধ্যে আগের মতো সেই দায়বোধ নেই, কেউ থিয়েটারে আসলে এটাকে টিভি মিডিয়াতে যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে, ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাল্টা প্রশ্ন যদি করা হয়, তরুণেরা কেনো থিয়েটার করবে? বর্তমান প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া আর স্বপ্ন পূরণের মতো থিয়েটারচর্চা কি আমরা করতে পারছি? স্বাধীনতার সেরা ফসল থিয়েটার বলে বলে আমরা মুখে ফেনা তুলছি, কিন্তু সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে থিয়েটারটার কি পরিবর্তন ঘটাতে পেরেছি? মুখে আমরা বলছি যে, আমাদের বাংলাদেশের থিয়েটার এখন বিশ্বমানের! যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘কোন দিক দিয়ে বাংলাদেশের থিয়েটার বিশ্বমানের?’ সেটার উত্তর কী? আবেগ দিয়ে অনেক কিছুই তো বলা যায়, কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। আমরা ঢালাওভাবে বলে দিচ্ছি যে তরুণেরা থিয়েটার করছে না। থিয়েটার দলগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই, সেখানে তরুণ এবং প্রবীণদের অনুপাত যদি খেয়াল করি, তবে কী দেখবো? এখনও তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবীণেরাই থিয়েটারে যথাযথ সময়ও দিতে পারছেন না। সময় দিতে না পারাটার যৌক্তিক কারণ নিশ্চয়ই রয়েছে, কিন্তু সময়টা যে দিতে পারছেন না সেটা তো সত্যি। থিয়েটারগুলো টিকেই রয়েছে তরুণদের শক্তিতে ভর করে। সারাদেশ জুড়ে একের পর এক যখন থিয়েটার দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তখন মানিকগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, খুলনা, জামালপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়া, ভোলা, ঈশ্বরদী (পাবনা) সহ আরো জেলাশহরে তরুণ এবং নবীন নাট্যকর্মীরা হয় নতুন থিয়েটার দল তৈরি করে কিংবা বিলুপ্ত হতে যাওয়া দলের জোয়াল নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে নতুন উদ্যমে নাট্যকাণ্ড করে চলেছে।
রাজধানীর থিয়েটারচর্চার প্রসঙ্গই যদি ধরি, ১৯৭১ পরবর্তী যে দলগুলো গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু করেছিল, সে দলগুলোর বেশিরভাগের বর্তমান অবস্থা কী? পূর্বের সেই জৌলুশ ধরে রেখে কি তারা নাট্যচর্চা করতে পারছে? নাকি ছাড় দিয়ে দিয়ে (কম্প্রোমাইজ করে) টিকে থাকার লড়াই চলছে? গত শতকের নব্বই পরবর্তী সময়ে তরুণ নাট্যকর্মীরা নতুন নতুন নাট্যদল গড়ে তুলেছে। বর্তমান সময়ে তারুণ্যনির্ভর নাট্যদলগুলো (উদাহরণ: প্রাচ্যনাট, পালাকার, প্রাঙ্গণেমোর, বটতলা, স্বপ্নদল, জাগরণী থিয়েটার, বুনন থিয়েটার, সুবচন নাট্য সংসদ, জীবন সংকেত, মণিপুরি থিয়েটার, অপেরা, বাতিঘর ইত্যাদি) তাদের প্রযোজনা নিয়ে মঞ্চ মাতিয়ে রেখেছে। পুরনো দলগুলোও তরুণদের উপর ভর করেই এগোচ্ছে। থিয়েটার ফেডারেশনের রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে এবং বিকল্প নাট্যচর্চার অভিপ্রায়ে রেপাটরি নাট্যদল গড়ে তুলছে তরুণেরাই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক থিয়েটার দলগুলো (উদাহরণ: সমকাল, অনুশীলন, জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটার, থিয়েটার সাস্ট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটার ইত্যাদি) তরুণদেরই সৃষ্টি, সারা বাংলাদেশ জুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক থিয়েটার দলগুলো এখনও তাদের কার্যক্রমে নিজঃতেজে দীপ্যমান। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও থিয়েটার ক্লাব গঠিত হয়েছে, এসব সংগঠন তরুণেরাই পরিচালনা করছে। তবে একথা ঠিক, আগে ত্রিশজন তরুণ নাট্যকর্মী একটি দলে যুক্ত হলে পনেরো থেকে বিশজন শেষ পর্যন্ত সংগঠনে যুক্ত থাকতো। আর এখন, বিশজন তরুণ নাট্যকর্মী যুক্ত হবার তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে বারো থেকে পনেরোজনই ঝরে পড়ছে নানান কারণে। আগের মতো দলগুলোতে তরুণ নাট্যকর্মীদের জোয়ার আসে না বরং ভাটার টানটাই বেশি। এ দায় শুধু তরুণদের নয়, থিয়েটার সংশ্লিষ্ট সকলেরই।
রাস্তা নাচানো পথনাটক
গত শতকের আশির দশকে পথনাটক যেমন করে স্বৈরশাসককে অস্থির করে তুলেছিল, তেমন উদাহরণ কিন্তু তারপর আর লক্ষ করা যায় নি। এখন নাট্যদলগুলোর বেশিরভাগই নিয়ম রক্ষার মতো পথনাটক করে থাকে। ঢাকার বাইরে জেলাশহরগুলোতে পথনাটক প্রদর্শনীর স্থান নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা যায় না, কিন্তু রাজধানী ঢাকাতে সমস্যাটা প্রকট। এখানে দু-তিনটি নির্দিষ্ট স্থানে পথনাটক প্রদর্শনীর সুযোগ সীমিত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র রাজধানীতেই পথনাটক পরিবেশনের জন্য কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ টি স্থান উন্মুক্ত করা প্রয়োজন, এজন্য পথনাটক পরিষদের উদ্যোগী হওয়া উচিত। তা না হলে পথনাটকের চর্চা আরো সংকুচিত হতে থাকবে ভবিষ্যতে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাট্যচর্চা
গত শতকের আশির দশকে এবং কিছুটা হলেও নব্বইয়ের দশকেও স্কুলগুলোতে বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি নাটকও মঞ্চায়ন হতো। এতে স্কুলের শিক্ষার্থীরাই কুশীলব হিসেবে থাকতো। আর উচ্চতর শিক্ষায়তনের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব ২০০০ সাল পর্যন্ত কলেজগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচিতদের মধ্যে একজন করে নাট্য সম্পাদক থাকতেন। তার তত্ত্বাবধানেই প্রতিবছর বাৎসরিক নাটক অনুষ্ঠিত হতো। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, স্কুলে থাকাকালীন বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপর ক্লাশের ছাত্রদের অভিনীত নাটক দেখেই কিন্তু থিয়েটার করবার ইচ্ছাটা জাগে। কলেজে অধ্যয়নের সময় বাৎসরিক নাটক মঞ্চায়নের পূর্বে অভিনেতৃ বাছাইপর্বে দেখেছি হলভর্তি ছাত্রছাত্রী আগ্রহ নিয়ে এসেছে অভিনয় করবার সুযোগ পেতে। এই বাৎসরিক আয়োজনই অনেক কলেজে ‘কলেজ থিয়েটার’ গড়ে উঠতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। স্কুল এবং কলেজের এই বাৎসরিক নাট্যায়োজন এবং নাট্যচর্চা, নাট্যকর্মী হতে আগ্রহ তৈরি এবং রাজধানীসহ সারাদেশের নাট্যদলগুলোতে নাট্যকর্মী জোগান দিতে অনেকটা ভূমিকা রেখেছে।
স্কুলগুলোতে এখন হয়তো কোনোরকমে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটা হয়, কিন্তু নব্বইভাগ স্কুলেই মঞ্চনাটক আর হয় না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন স্থগিত হয়ে যাবার পর থেকে কলেজগুলোতেও বাৎসরিক মঞ্চনাটক একরকম বন্ধই হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একটি উদ্যোগের কথা আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে। চৌষট্টি জেলায় একটি করে কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে থিয়েটার দল গঠন করে পর পর দু’বছর ‘স্বাধীনতার নাট্য উৎসব’ এবং ‘স্বপ্ন ও দ্রোহের নাট্য উৎসব’ শিরোনামে থিয়েটার নির্মাণ এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নাট্য উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। সেসময় থিয়েটার অঙ্গনের অনেকেই এই উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, ‘এমন উদ্যোগের কোনো সফলতা নাই, বরং জেলা পর্যায়ের কোনো নাট্যদলকে প্রযোজনা নির্মাণের জন্য সহযোগিতা করলে সামগ্রীকভাবে থিয়েটার লাভবান হতো।’ কথাটা হয়তো একদিক দিয়ে সত্য, কিন্তু অন্যদিকে উদ্যোগটা থিয়েটারের জন্য বিনিয়োগ হিসেবে অবশ্যই সার্থক ছিল। সার্থকতা এখানেই, যখন আমরা দেখি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় কলেজগুলোতে থিয়েটার নির্মাণের কার্যক্রম চালানোর ফলে একাধিক জেলাতে ‘কলেজ থিয়েটার’ গঠিত হয়েছে। আবার একাধিক জেলাতে কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে শিক্ষাঙ্গনের বাইরে থিয়েটার গঠিত হয়েছে। আবার একাধিক জেলাতে স্থানীয় থিয়েটার দলে এক ঝাঁক কলেজ পড়ুয়া নাট্যকর্মী যোগ দিয়েছে। সুনামগঞ্জ, জামালপুর, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, নওগাঁ, বগুড়া, পটুয়াখালী, ভোলা, শরিয়তপুর, মাগুরা জেলাগুলোতে তো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছেই, এর বাইরেও অন্য আরো অনেক জেলাতেই নিশ্চয়ই এমনটাই ঘটে থাকবে বলে অনুমান করা যায়। শিল্পকলার এই কার্যক্রম পরবর্তী সময়ে আর চলমান থাকে নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে থিয়েটার নির্মাণ বা চর্চাকেন্দ্রিক এমন কার্যক্রম ক্রমাগত ১০/১৫ বছর অব্যাহত রাখতে পারলে এর সুফল স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আমাদের বিকল্প নাট্যচর্চা
বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার চর্চাটাকেই মূলধারার নাট্যচর্চা হিসেবে বিবেচিত করা হয়। তাই এর বাইরে চর্চিত হওয়া সব থিয়েটারচর্চাই বিকল্প নাট্যচর্চা বলে ধরে নেয়া যায়। বাংলাদেশে আমরা বিকল্প নাট্যচর্চা হিসেবে রেপাটরি নাট্যচর্চা, পরিবেশ থিয়েটার, প্রত্ননাটক এবং স্টুডিও থিয়েটার চর্চা দেখতে পাই।
১৯৮৭-৮৮ সালের কথা, জিয়া হায়দার চট্টগ্রামে মঞ্চায়িত করলেন ‘এলেবেলে’ (নাটক ও নির্দেশনা: জিয়া হায়দার)। এই প্রযোজনাটি ক্যাফে থিয়েটারের আদলে নির্মিত হয়েছিল। প্রদর্শনীতে দর্শক চা-কফি পান করতে করতে নাটকের মঞ্চ পরিবেশনা উপভোগ করেছেন। জিয়া হায়দারের ইচ্ছে ছিল, কোনো উন্নতমানের ক্যাফে নির্মাণ করে সেখানে নিয়মিত ক্যাফে থিয়েটার প্রদর্শন করা। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি।
থিয়েটারচর্চাতে পেশাদারিত্ব আনার জন্য পথিকৃৎ নাট্যজন মামুনুর রশীদ ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর যাত্রা শুরু করেছিলেন। মহিলা সমিতি-গাইড হাউজের মঞ্চের বাইরে অন্য কোনো স্পেসে ইনটিমেট থিয়েটার এবং একটানা প্রদর্শনীর আকাক্সক্ষা থেকেই এই নাট্যদল তৈরি করা হয়েছিল। জনপ্রিয় অভিনেতাদের সমন্বয়ে নির্মিত প্রযোজনাগুলোর প্রদর্শনীতে দর্শকের অভাব হয় নি কখনো। বাঙলা থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলো হলো ‘মানুষ’ (নাটক: মামুনুর রশীদ, নির্দেশনা: ফয়েজ জহির), ‘লেবেদেফ’ (নাটক ও নির্দেশনা: মামুনুর রশীদ), ‘চে’র সাইকেল’ (নাটক: মামুনুর রশীদ, নির্দেশনা: ফয়েজ জহির)। ‘বাঙলা থিয়েটার’-এর প্রদর্শনী শেষে প্রযোজনাসংশ্লিষ্ট সকলে পরিমাণে কম হলেও সম্মানী পেতেন। বাংলা থিয়েটারের প্রযোজনা নির্মাণ এবং প্রদর্শনী একেবারেই অনিয়মিত ছিল। তাই এই উদ্যোগের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় নি। তবে একটা পথ দেখতে পেয়েছে নাট্যকর্মীরা।
চট্টগ্রামে মুসলিম হলের পাশে ‘থিয়েটার স্টুডিও’ নামে একটা জায়গা তৈরি করেন চট্টগ্রামের নাট্যকর্মীরা। এখানে ইন্টিমেট থিয়েটার করা সম্ভব, তবে এই জায়গাটাকে মাথায় রেখে বিকল্প নাট্যচর্চা কিন্তু সেভাবে হয় নি।
স্টুডিও থিয়েটার চর্চার ক্ষেত্রে বরিশালে সৈয়দ দুলালের নেতৃত্বে ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’ বাংলাদেশের থিয়েটার অঙ্গনে নক্ষত্রের মতো। স্টুডিও থিয়েটার স্পেসকে মাথায় রেখেই শব্দাবলী তার নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ করে। প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত সেখানে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যপ্রদর্শনীও হয়। নিজস্ব জায়গা এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা শব্দাবলীর জন্য কাজটি অনেক সহজ করে দিয়েছে। জেলা কিংবা বিভাগীয় শহরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটারচর্চাকে মেলানোর মতো চমৎকার সব আয়োজন করে গেছে দলটি। দেশের এবং বাইরের নাট্যনির্মাতাদের নির্দেশনায় একের পর এক নাট্যপ্রযোজনা তৈরি এবং প্রদর্শন হচ্ছে বরিশালের শব্দাবলী থিয়েটারের স্টুডিওতে। শব্দাবলী থিয়েটারের স্টুডিও প্রযোজনাগুলোর মধ্যে উল্লেখ করবার মতো প্রযোজনা হলো ‘শিলারী’ (নাটক: গোলাম শফিক, নির্দেশনা: আমিনুর রহমান মুকুল), ‘এ নিউ টেস্টামেন্ট অব রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ (নাটক: সাইমন জাকারিয়া, নির্দেশনা: সাইদুর রহমান লিপন), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (নির্মাণ: প্রবীর গুহ), ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ (উপন্যাস: সেলিনা হোসেন, নাট্যরূপ: সুনন্দ বাশার, নির্দেশনা: সৈয়দ দুলাল), ‘বৈশাখিনী’ (নাটক: চন্দন সেন, নবনাট্যায়ন: মাহফুজা হিলালী, নির্দেশনা: সৈয়দ দুলাল), ‘ফনা’ (নাটক: শাহমান মৈশান, নির্দেশনা: সুদীপ চক্রবর্তী)।
রাজধানী ঢাকাতে ‘পালাকার’ নাট্যদলের নিজস্ব স্টুডিও থিয়েটার ছিল। দলপ্রধান আমিনুর রহমান মুকুলের সাথে যুক্ত ছিল এক ঝাঁক তরুণ নাট্যকর্মী। প্রথমে ইস্কাটনের দিলু রোড এবং পরবর্তী সময়ে বেইলি রোডে ছিল এই স্টুডিও থিয়েটারের ঠিকানা। স্টুডিওকে মাথায় রেখে ‘পালাকার’ নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছে এখানে। বিজ্ঞানের কল্পকাহিনি, ভৌতিক, লোক ধাঁধা, বিশ^সাহিত্য, ক্লাসিক, নানান ঢঙের আর স্বাদের থিয়েটার তৈরি হয়েছে এখানে। প্রতি সপ্তাহেই দু’টি সন্ধায় এখানে নাট্যপ্রদর্শনী হতো এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ চিন্তাভাবনা এবং উপস্থাপনা দিয়ে বাংলাদেশের নাট্যজগতে একটা আলোচনার জায়গা তৈরি করতে পেরেছিল ‘পালাকার’-এর স্টুডিও থিয়েটার। পালাকার তাদের স্টুডিও থিয়েটারচর্চা অব্যহত রাখতে পারে নি। কারণ, ভাড়া বাসায় স্টুডিও থিয়েটার স্থাপিত হওয়ার কারণে একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে এবং শেষে স্টুডিও থিয়েটার করবার মতো স্থানও খুঁজে পায় নি নাট্যদলটি। পালাকার-এর স্টুডিও প্রযোজনাগুলোর মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে যেসব প্রযোজনা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘ডাকঘর’ (নাটক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্দেশনা: শামীম সাগর), ‘রাইফেল’ (নাটক: ব্রের্টল্ড ব্রেখট, রূপান্তর: অমিত চন্দ, নির্দেশনা: আশিকুর রহমান), ‘দ্যা রিকোয়েস্ট কনসার্ট’ (নাটক: ফ্রাঞ্জ ইয়োভার ক্রোয়েটজ, নির্দেশনা: কামালউদ্দিন নিলু), ‘মৃত্তিকা কুমারী’ (নাটক ও নির্দেশনা: আমিনুর রহমান মুকুল), ‘ডেথ নকস’ (নাটক: উডি এ্যালান, রূপান্তর: মোস্তাইন বিল্লাহ, নির্দেশনা: আমিনুর রহমান মুকুল)। বর্তমানে দলটি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলের স্থানকে মাথায় রেখে আবার প্রযোজনা নির্মাণ শুরু করেছে। তবে নিজস্ব স্থান নাই বিধায় নিজেদের মতো করে চর্চা করা কিংবা প্রদর্শনী করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। জাতীয় নাট্যশালার স্টুডিও মিলনায়তনকে মাথায় রেখে যে প্রযোজনাগুলো নির্মাণ এবং প্রদর্শনী করছে দলটি সেগুলো হলো; ‘উজানে মৃত্যু’ (নাটক: সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নির্দেশনা: শামীম সাগর), ‘রং লেগেছে’ (নাটক: রয়েল বেঙ্গল থিয়েটার, নাট্যনবায়ন ও নির্দেশনা: আমিনুর রহমান মুকুল)।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা যাত্রা শুরু করে মূল মিলনায়তন এবং পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তন নিয়ে। বেশ কয়েকবছর পর বিকল্প এবং ইনটিমেট থিয়েটারচর্চার লক্ষ্যেই স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনটি আলাদা করে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু সমস্যা হলো নাট্যদলগুলো এই স্টুডিও হলটির উপযোগী করে মঞ্চ প্রযোজনা নির্মাণ করে না। স্টুডিও থিয়েটারের প্রকাশভঙ্গি আলাদা, তাই নাট্যদলগুলোর এই মিলনায়তনটিকে বিবেচনায় রেখে নাট্যনির্মাণ করা উচিত। সাধারণত দেখা যায়, নাট্যশালার মূল মিলনায়তন কিংবা পরীক্ষণ মিলনায়তনে যখন দর্শক কমে যায়, তখন সেই নাটকটি স্টুডিও থিয়েটারে মঞ্চায়িত হয়। যেহেতু বেশিরভাগ নাট্যপ্রযোজনা স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় না, সেহেতু সেই আবেদনটা দর্শকের কাছে পৌঁছায় না। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এই মিলনায়তনের যথাযথ ব্যবহারের জন্য দলগুলোকে উৎসাহিত ও আগ্রহী করে তুলতে পারে। এটা সম্ভব এইভাবে যে, যেসব দল স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনকে কেন্দ্র করে এবং বিবেচনায় রেখে নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ করবে, হল বরাদ্দের ক্ষেত্রে সেসব নাট্যদল অগ্রাধিকার পাবে।
বাংলাদেশের এক নিভৃত কোণে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ। সেখানে মণিপুরি সম্প্রদায়ের একদল নাটকপাগল নিজেরাই একটি নাটমণ্ডপ তৈরি করেছে তরুণ নাট্যসংগঠক শুভাশিস সিনহার নেতৃত্বে। নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলা ও বিশ্বনাট্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছে মণিপুরি থিয়েটার। সম্প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেদের নাট্যায়তনের উন্নয়ন ঘটিয়েছে তারা। বাংলাদেশে শুভাশিস সিনহা একটি উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মণিপুরি থিয়েটারের নাট্যচর্চার মাধ্যমে। মণিপুরি থিয়েটারের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলো হলো- ‘কহে বীরাঙ্গনা’ (নাটক: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা), ‘দেবতার গ্রাস’ (কবিতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নাটক ও নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা), ‘ইঙাল আঁধার পালা’ (নাটক ও নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা), ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ (নির্মাণ: শুভাশিস সিনহা), ‘হ্যাপি ডেজ’ (নাটক: স্যামুয়েল বেকেট, নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা), ‘লেইমা’ (নাটক: ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা, নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা)।
সাধারণত, একটা সুনির্দিষ্ট স্থান, এর পরিবেশ এবং প্রতিবেশকে বিবেচনায় নিয়েই ‘পরিবেশ থিয়েটার’ নির্মিত হয়ে থাকে। স্থানটির অতীত এবং ঐতিহাসিক ইতিহাস থেকে উপাদান নিয়ে যেমন থিয়েটার তৈরি হয়, আবার সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে স্থানটির উপযোগী নাট্যও নির্মিত হয়। বাংলাদেশে পরিবেশ থিয়েটারের চর্চা অনিয়মিত। ১৯৯১ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ‘পরিবেশ থিয়েটার’ হলো ঠাকুরগাঁওয়ে ‘ইটাবাড়ি’, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় টিএসসিতে ‘কারখানা’, চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকায় ‘মোহাম্মদ আমিন’, বাংলা একাডেমিতে ‘চন্দ্রবিন্দু’, জগন্নাথ হল গণকবর ‘ডেটলাইন জগন্নাথ হল’, মধুর ক্যান্টিনে ‘মৃত্তিকার কম্পাস’, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি মোটর গ্যারেজে ‘মবিল’, বিক্রমপুর ইদ্রাকপুর কেল্লায় ‘সেই সমতটে এই জনপদে’, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উন্মুক্ত স্থানে ‘সেই সব দিনগুলি’, ফরিদপুর স্টেডিয়ামে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-৭১’, মিরপুর, ঢাকায় ‘জল্লাদখানা’, রংপুর টাউন হলে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প-৭১’, মুজিবনগর আ¤্রকানন মেহেরপুরে ‘বৈদ্যনাথতলা থেকে মুজিবনগর’। কিছু নাট্যকর্মী বিচ্ছিন্নভাবে পরিবেশ থিয়েটার নির্মাণের কাজ করলেও বাংলাদেশে নিয়মিত চর্চা করেন আশীষ খন্দকার। সম্প্রতি আশীষ খন্দকার আঁলিয়াস ফ্রসেসের খোলা জায়গাকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেছেন ‘দুই আগন্তুক বনাম করবী ফুল’। অনিয়মিত চর্চার কারণে পরিবেশ থিয়েটার সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের নাট্যকর্মী এবং দর্শকদের মধ্যে তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয় নি বলে মনে হয়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কয়েক বছর ধরে চর্চা করছে প্রত্মনাটক। বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানের ইতিহাস ঐতিহ্যকে উপজীব্য করে নির্মিত হয় এই নাট্য। এখন পর্যন্ত নওগাঁর সোমপুর বিহারে ‘সোমপুর কথন’, নরসিংদীতে ‘উয়ারী বটেশ্বর’, বগুড়ার মহাস্থানগড়ে ‘মহাস্থান’ নির্মিত হয়েছে। পর্যটন এলাকাগুলোতে নিয়মিত প্রত্ননাটক প্রদর্শনীর সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এখন পর্যন্ত প্রত্ননাটক চর্চা বাংলাদেশে অনিয়মিত।
গ্রুপ থিয়েটার চর্চার বাইরে বর্তমানে উল্লেখ করবার মতো আরেকটি বিকল্প থিয়েটারচর্চা হলো রেপাটরি থিয়েটার চর্চা। প্রফেশনাল থিয়েটার করবার লক্ষ্য নিয়েই একাধিক রেপাটরি থিয়েটার দল গড়ে উঠেছে এবং নাট্যচর্চা করে যাচ্ছে। রেপাটরি থিয়েটারের লক্ষ্য থাকে একটানা অথবা স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশি প্রদর্শনী করা। সাধারণত দর্শক আগ্রহ সৃষ্টির জন্য মঞ্চ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জনপ্রিয় দক্ষ অভিনেতৃদের সমন্বয়ে প্রযোজনা তৈরি করা হয়। প্রতিদিন যে ধরনের থিয়েটার দর্শকেরা দেখে তার বাইরে গিয়ে কাহিনি-নির্দেশনা-ডিজাইন-উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের এবং চমকপূর্ণ প্রযোজনা নির্মাণ করা হয়। উদাহরণ হিসেবে ‘রিজওয়ান’ প্রযোজনাটির কথা উল্লেখ করা যায়, ‘নাটবাঙলা’ দশদিনব্যাপী একই নাটকের উৎসব করে জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় এই আয়োজনটি আলোড়ন সৃষ্টি করে। দশদিনে টানা ঊনিশটি প্রদর্শনী সফলভাবে সম্পন্ন করে ‘নাটবাঙলা’। ‘জন্মসূত্র’-এর ‘অহরকণ্ডল’ (নাটক: বদরুজ্জামান আলমগীর, নির্দেশনা: কামালউদ্দিন কবির) এবং ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র ‘শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’ও (নাটক: হাসান শাহরিয়ার, নির্দেশনা: আজাদ আবুল কালাম) বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর বাইরে যেসব রেপাটরি প্রযোজনা দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘আগন্তুক’ রেপাটরির ‘ধলেশ্বরী অপেরা’ (নাটক ও নির্দেশনা: পান্থ শাহরিয়ার), ‘শূন্যন’-এর ‘লাল জমিন’ (নাটক: মান্নান হীরা, নির্দেশনা: সুদীপ চক্রবর্তী), ‘নাট্যম রেপার্টরি’র ‘দমের মাদার’ (নাটক: সাধনা আহমেদ, নির্দেশনা: আইরিন পারভীন লোপা), ‘দশরূপক’-এর ‘বিসর্জন’ (নাটক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্দেশনা: নায়লা আজাদ নূপুর), ‘মেঠোপথ’-এর ‘অতঃপর মাধো’ (নাটক ও নির্দেশনা: অলোক বসু), ‘হৃৎমঞ্চ’-এর ‘রুধিররঙ্গিনী’ (নাটক ও নির্দেশনা: শুভাশিস সিনহা), ‘স্পর্ধা’-এর ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (উপন্যাস: শহীদুল জহির, নির্দেশনা: সৈয়দ জামিল আহমেদ)। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি বেশ কয়েক বছর ধরে, প্রায় প্রতি বছরই প্রযোজনাভিত্তিক রেপাটরি থিয়েটার দল গঠন করে নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ করে আসছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির রেপাটরি নাট্যপ্রযোজাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘এক’শ বস্তা চাল’ (নির্দেশক: গোলাম সরোয়ার), ‘টার্গেট প্লাটুন’ (নাটক ও নির্দেশনা: মামুনুর রশীদ), বাঁধ (উপন্যাস: শওকত ওসমান, নাটক ও নির্দেশনা: মোহাম্মদ বারী), হ্যামলেট (রূপান্তর: সৈয়দ শামসুল হক, নির্দেশনা: আতাউর রহমান), পুত্র (নাটক: সেলিম আল দীন, নির্দেশনা: মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন)।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে আদতেই রেপাটরি থিয়েটার চর্চাটা রেপাটরির মতো গড়ে ওঠে নি। একটি রেপাটরি থিয়েটার দলের জন্য একটানা একমাস, ছয়মাস কিংবা বছরব্যাপী মিলনায়তন বরাদ্দ প্রয়োজন। সেটা শিল্পকলা কিংবা মহিলা সমিতির মতো মিলনায়তনে সম্ভব না। দলগুলোকে পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে থিয়েটার নির্মাণ করতে হবে এবং নির্দিষ্ট মিলনায়তনে একটানা প্রদর্শনী করতে হবে। সব থেকে বড় বিষয় এখানে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। সময় কাটানোর সংগঠন করবার মতো করে থিয়েটার করলে কখনোই রেপাটরি থিয়েটার গড়ে উঠবে না। শুধুমাত্র নাম এবং আত্মতৃপ্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে এই উদ্যোগ।
গ্রুপ থিয়েটার চর্চার বাইরে আলাদা করে প্রফেশনাল থিয়েটারচর্চার ক্ষেত্রে দু’টি সংগঠনের নাম আলাদা করে উল্লেখ করাই যেতে পারে। একটি ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’ (সিএটি) এবং অন্যটি ‘সাধনা’। এই দু’টি সংগঠনের নাট্যপ্রযোজনাগুলো বিষয়-বৈচিত্র্য-ভাবনা-উপস্থাপনায় আলাদা মাত্রা যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে এবং দর্শকসৃষ্টির ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। সিএটি’র মুখ্য ব্যক্তি কামালউদ্দিন নীলু বিশ্বনাট্যের সাথে যোগসূত্র তৈরির ক্ষেত্রে চেষ্টা করে গেছেন এবং বিশ্বমানের থিয়েটার নির্মাণ করে গেছেন একের পর এক। গত ২০ বছরে সিএটি’র উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে অ্যাম্পিউটেশন (নির্দেশনা: কামালউদ্দিন নীলু), ব্র্যান্ড (নির্দেশনা: কামালউদ্দিন নীলু), মেটামরফোসিস (নির্দেশনা: কামালউদ্দিন নীলু) ইত্যাদি। ‘সাধনা’র প্রধান লুবনা মরিয়ম একটি গুরত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন। এর একটি প্রধানতম কাজই হচ্ছে বাংলার নিজস্ব নৃত্য ও নাট্যআঙ্গিকগুলোকে পুনরাবিষ্কার করা। তবে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান সকল সময়ই অবহেলা এবং অসহযোগিতার শিকার হয়েছেন। ‘সাধনা’র তাশের দেশ (নাটক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নির্দেশনা: ওয়ার্দ্দা রিহাব), সীতার অগ্নিপরীক্ষা (নাটক: সাইমন জাকারিয়া, নির্দেশনা: নাজনীন চুমকি), চম্পাবতী (কবি জসিমউদদীন এর বেদের মেয়ের নবনাট্যায়ন: সৈয়দ শামসুল হক, নির্দেশনা: শামিম হাসান ও শাব্বির আহমেদ খান বিজু ), মায়ার খেলা (নাটক: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবনাট্যায়ন: নির্ঝর চৌধুরী, নির্দেশনা: শাব্বির আহমেদ খান বিজু ও অমিত চৌধুরী)।
বিকল্প থিয়েটারচর্চার ক্ষেত্রে ‘প্রাচ্যনাট’, ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ এবং ‘পালাকার’-এর কিছু চমৎকার উদ্যোগের কথা আমরা জানি। ‘প্রাচ্যনাট’ স্বল্প আয়তনে থিয়েটার করবার একটা চর্চা করে থাকে, এই থিয়েটার পরিবেশনাগুলো গতানুগতিক থিয়েটার পরিবেশনার থেকে ভিন্ন; এই ভিন্নতা যেমন বিষয় বৈচিত্র্যে, তেমনি উপস্থাপনাতেও। প্রাচ্যনাট তাদের এই পরিবেশনাকে ‘ইনহাউজ থিয়েটার’ নামে নামাঙ্কিত করেছে। রীতিমত দর্শনীর বিনিময়ে এই প্রযোজনাগুলোর প্রদর্শনী হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া কোনো আলোচিত ঘটনা নিয়েও স্বল্প ব্যাপ্তির থিয়েটার নির্মাণ করে থাকে। এই চর্চাটা তারা নিয়মিতই করে থাকে। পথনাটকের সাথে এই ইস্যুভিত্তিক থিয়েটারগুলোর স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ তাদের ‘জবর আজব ভালোবাসা’ (নাটক: আন্তন চেকভ, রূপান্তর ও নির্দেশনা: সাইফ সুমন) প্রযোজনাটি কেন্দ্র করে একটি চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। পুরোপুরি বিনোদনধর্মী এই নাটকটি শুধুমাত্র মঞ্চে নয়, বিয়ে-জন্মদিনসহ বিভিন্ন সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানেও পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ‘পালাকার’ স্পষ্টতই কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই বিকল্প থিয়েটারচর্চা শুরু করেছিল প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। স্কুল পাঠ্যের থিয়েটার উপস্থাপনা নিয়ে ‘ক্লাস এ্যাক্ট’, পণ্যের প্রচারের জন্য ‘ব্র্যান্ড এ্যাক্ট’, মঞ্চ ও পথনাটকের বাইরে উন্মুক্ত স্থানের জন্য ‘ফ্রি এ্যাক্ট’ ছিল অন্যতম। এর প্রতিটিই ছিল অর্থের বিনিময়ে থিয়েটার। পালাকারে’র এই কার্যক্রম কিছুদিন স্থগিত থাকলেও বর্তমানে আবারও শুরুর প্রচেষ্টা চলছে।
অনুদান ও আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা প্রসঙ্গ
‘দৃশ্যপট’-এর ‘সক্রেটিসের জবানবন্দী’ নাটকটি মঞ্চে আসে ১৯৯৭ সালে (নাটক: শিশিরকুমার দাশ, নির্দেশনা: প্রযোজনা দল)। প্রযোজনাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শনীর জন্য আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। ‘শূন্যন’-এর ‘লাল জমিন’ (রচনা: মান্নান হীরা, নির্দেশনা: সুদীপ চক্রবর্তী) নাটকটি সারাদেশে শিল্পকলা একাডেমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উৎসবে প্রদর্শনের জন্য সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় আর্থিক সহযোগিতা অব্যহত রেখেছে। গত দুই বছর ধরে এই কার্যক্রম চলছে। এছাড়াও কিছু নাট্যদলের উৎসবে কিংবা নাটক নির্মাণের জন্য সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় অনুদান প্রদান করছে। এসকলই কিন্তু বিচ্ছিন্ন এবং অস্থায়ী সহযোগিতা। এভাবে সাময়িকভাবে কিছু নাট্যদল উপকৃত হলেও স্থায়ীভাবে থিয়েটার কখনোই লাভবান হয় নি, হওয়া সম্ভবও নয়। সামগ্রীকভাবে থিয়েটারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্থায়ী অথবা দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতা প্রয়োজন। এই সহযোগিতার মধ্যে প্রযোজনা নির্মাণ, নিয়মিত প্রদর্শনী, নাট্যকর্মশালা, নাট্যসংগঠনের নির্দেশক-নাট্যকার-অভিনেতাদের সম্মানী থাকাটাও জরুরি। নাট্যদলের কার্যক্রম এবং প্রযোজনার মানের উপর ভিত্তি করে এই সহযোগিতার পরিমাণ কম বেশিও হতে পারে।
বর্তমানে থিয়েটারের প্রায় সকলেই স্বীকার করছি যে, থিয়েটারের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সরকারি সহযোগিতার যেমন প্রয়োজন রয়েছে, পাশাপাশি বেসরকারি-করপোরেট প্রতিষ্ঠানেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এখন আমাদের মধ্যে এই বোধটা এসেছে, কারণ, আমরা থিয়েটার চর্চাটাকে এখন আর ভাবাবেগের জায়গা থেকে দেখছি না। সময় এবং বাস্তবতা পাল্টেছে, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবার চর্চাটাকে পাল্টে ফেলার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যে রাষ্ট্র এবং সমাজ বিনির্মাণের জন্য থিয়েটার নিঃস্বার্থভাবে এবং সমাজের বিবেক হয়ে তার জায়গা থেকেই কাজ করে গেছে, স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর থিয়েটারটা এখন রাষ্ট্র এবং সমাজের নিকট পৃষ্ঠপোষকতা দাবি করতেই পারে। একটি দেশের থিয়েটার দেখলে নাকি সেই দেশের সাংস্কৃতিক দিকটা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। থিয়েটারের আর দুয়োরানির সন্তানটি হয়ে নিজের দরিদ্রতা উপস্থাপন করাটা শোভন নয়। বর্তমানে এসব কথা বলছি বটে, কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে থিয়েটারচর্চার শুরুর দিকে এবং কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমরা একথাগুলো উচ্চারণই করতাম না, বরং বিরোধিতা করতাম। দুই/তিনটি উদাহরণ এক্ষেত্রে উল্লেখ করাই যেতে পারে।
সম্ভবত ১৯৮১-৮২ সালের দিকের ঘটনা। একটি দাতা সংস্থা থিয়েটারের জন্য একটি মিলনায়তন তৈরি করে দেবার প্রস্তাব করেছিল, শুধু মিলনায়তনই নয়, চারতলা বিশিষ্ট থিয়েটার কমপ্লেক্স। ‘থিয়েটার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিকতার প্রবেশ’, ‘থিয়েটারটাকে নষ্ট করবার ষড়যন্ত্র’, ‘স্বাধীনতার সোনালী ফসল থিয়েটারের মূল্যবোধটা এবার ধ্বংস হবে’- এমন নানান কথায় থিয়েটারের মানুষজনই ঐ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। ঐ উদ্যোগটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল।
২০০৮ সালে ঢাকা শহরের চারশত বৎসর পূর্তি উপলক্ষে এইচএসবিসি ব্যাংক একটা নাটকের আটদিনব্যাপী মঞ্চায়নের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করে। এজন্য ব্যাংকটি ‘পালাকার’ নাট্যদলকে বেছে নেয়, নাটকটি ছিল ‘বাহান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি’ (নাটক ও নির্দেশনা: আমিনুর রহমান মুকুল)। এই উদ্যোগ নিয়ে তখন বেশ নেতিবাচক আলোচনা হয়েছিল- ‘থিয়েটারকে করপোরেটওয়ালাদের কাছে বেঁচে দেয়া হলো’, ‘এভাবে থিয়েটারের ধ্বংস অনিবার্য হয়ে দাঁড়াবে’, ‘এ ধরনের নাট্যসংগঠন এবং থিয়েটার প্রযোজনাকে বয়কট করা উচিত’, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রযোজনাটি যেন কোনোভাবেই জাতীয় নাট্যশালায় প্রদর্শনের সুযোগ না পায় সেজন্য সব ধরনের অসহযোগিতা করা হয়েছিল। যদিও পরে মিলনায়তন বরাদ্দ দেয়া হয়। কীভাবে বরাদ্দ দেয়া হলো, সেটাও একটা গল্পের মতো। বিস্তারিত না-ই বললাম।
২০১৮ সালে আইডিএলসি নামক একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সাতদিনব্যাপী নাট্য উৎসবের আয়োজন করে। এই উৎসবের একটি লক্ষ্য ছিল যে, যেসকল তরুণের কখনো মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা হয় নি তাদেরকে সেই অভিজ্ঞতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইন রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে বিনামূল্যের টিকিট প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের কাক্ষিত দর্শককে মঞ্চমুখি করবার জন্য। এই ‘বিনামূল্যের টিকিটে’র বিষয়টি আলাদা একটি বিতর্ক। হয়তো এই বিতর্ক যুক্তিযুক্তও ছিল। কিন্তু এই বিতর্কের বাইরেও নানা বিতর্ক এবং সমালোচনা হয়েছিল এই উদ্যোগকে নিয়ে। ‘একটি করপোরেট আর্থিক প্রতিষ্ঠান কোন স্বার্থে একটি নাট্য উৎসব করছে’, ‘এই উৎসবে নাট্যকর্মী আর থিয়েটারের কী লাভ?’, ‘এমন লোকদেখানো উৎসব হবার চেয়ে না হওয়াটাই থিয়েটারের জন্য মঙ্গলজনক’ ইত্যাদি ইত্যাদি। থিয়েটারের করপোরেট সহযোগিতার পক্ষেও অবশ্য যুক্তি দিয়েছিল অনেকে। যুক্তিগুলো ছিল এমন যে, অনেক থিয়েটারকর্মীই তো করপোরেট হাউজে কাজ করেন, আবার করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় বিভিন্ন ইভেন্ট, সামাজিক অনুষ্ঠান, নাট্য উৎসবও তো হচ্ছে, সেসবে যদি কোনো সমস্যা না হয় তাহলে করপোরেট প্রতিষ্ঠান নাট্য উৎসবের আয়োজন করলে কেনো সমস্যা হবে- ইত্যাদি। উৎসবের সমাপনীদিনে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার অবশ্য বলেছিলেন যে, থিয়েটারের জন্য তাদের নানামুখি সহযোগিতা অব্যহত থাকবে। কিন্তু থিয়েটারের মানুষজন এই কথা সহজে বিশ্বস করতে চায় নি। অবশ্য উল্লেখ্য যে, পরবর্তী সময়ে আইডিএলসি ‘প্রাঙ্গণেমোর’র একটি উৎসবকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করে। সেটা নিয়ে অবশ্য সমালোচনা কিংবা প্রশংসা কোনোটাই শোনা যায় নি। আমি বলছি না যে, উল্লেখিত সব উদ্যোগই সমালোচনার ঊর্ধ্বে। কিন্তু কোনো একটি উদ্যোগ নেয়া হলে শুরুতেই সেটি বন্ধ করার জন্য হামলে না পড়ে, গঠনমূলক এবং সহযোগিতামূলক আলোচনা-সমালোচনা প্রয়োজন।
রাজধানীর বাইরের নাগরিক থিয়েটারচর্চা
বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যমগুলো শিল্পসংস্কৃতি বিষয়ক সংবাদ দায়িত্বশীলতার সাথে সংগ্রহ এবং প্রচার করে না- এই অভিযোগ অনেকদিনের। এর মধ্যে থিয়েটারবিষয়ক সংবাদের ক্ষেত্রে অবস্থাটা আরো ভয়াবহ। রাজধানীকেন্দ্রিক থিয়েটারচর্চার সংবাদ কিছুটা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করলেও রাজধানীর বাইরের থিয়েটারের সংবাদ প্রচারের বিষয়টি যেন চোখেই পড়ে না। কালেভদ্রে যেটুকু প্রকাশিত হয়, তা অনেকক্ষেত্রে ছোট করে গ্রামগঞ্জের খবর জাতীয় আকারে হয়। আর বছরশেষে পত্রিকাগুলোর থিয়েটারবিষয়ক সালতামামি দেখলে ধারণা জন্মাবে যে, বাংলাদেশে থিয়েটারটা শুধুমাত্র ঢাকাতেই হয়, ঢাকার বাইরে কোথাও কোনো থিয়েটারচর্চার অস্তিত্ব নেই। অথচ ঢাকার বাইরে এখনো অনেক ভালো থিয়েটারচর্চা হয়। উদাহরণ- হবিগঞ্জের ‘জীবন সংকেত’, মৌলভীবাজারের ‘মণিপুরি থিয়েটার’, বগুড়ার ‘বগুড়া থিয়েটার’, কুষ্টিয়ার ‘বোধন থিয়েটার’, চট্টগ্রামের ‘তির্যক’-‘সমীকরণ’-‘অরিন্দম’-‘উত্তরাধিকার’-‘নান্দিমুখ’-‘নান্দিকার’, বরিশালের ‘খেয়ালী’-‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’, চুয়াডাঙ্গার ‘অরিন্দম’, যশোরের ‘বিবর্তন যশোর’ ইত্যাদি। এই দলগুলোর একাধিক ভালো মঞ্চপ্রযোজনা ঢাকার মঞ্চেও প্রদর্শিত হয়েছে, নিজ জেলাতে তো হয়েছেই। কিন্তু এসব নাট্যদলের মঞ্চপ্রযোজনার সংবাদ আমরা সেভাবে সংবাদ মাধ্যমে পাই না। এটা খুবই দুঃখজনক।
অস্তিত্বের সংকট এবং অস্বীকার, এই দুইয়ে মিলে চলছে জেলাশহরের নাট্যচর্চা। রাজধানীর বাইরে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা করা নাট্যদলের সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত নাট্যদলের সংখ্যা ক্রমাগত কেনো কমে যাবে? এই দায় কি শুধুমাত্র ঝরে যাওয়া নাট্যদলগুলোর? অবশ্যই নয়। দলগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়ার পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। কারণগুলোর মধ্যে সাংগঠনিক দুর্বলতা, মৌলিক ভালো পাণ্ডুলিপির অভাব, নাট্যকার-নির্দেশকের অভাব, অভিনেতা সংকট, থিয়েটারের মানোন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, মহড়াকক্ষের অভাব, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, থিয়েটারের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধতার অভাব উল্লেখযোগ্য। এত অভাব নিয়ে একটি নাট্যদলের টিকে থাকা সত্যিই দুঃসাধ্য বিষয়।
১৯৯৩ সালের দিকে যখন প্রথম থিয়েটারের সাথে যুক্ত হলাম, সুযোগ ঘটে গেল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের বিভাগীয় নাট্যকর্মশালায় অংশগ্রহণের। একজন নতুন নাট্যকর্মীর জন্য খুবই উপযোগী ছিল সেই আয়োজনটি। পরপর তিন বছর ‘বোধন থিয়েটার’র উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নতুন নাট্যকর্মী এধরনের নাট্যকর্মশালাতে অংশগ্রহণ করেছিল। দু-তিন বছরে এক ঝাঁক নতুন নাট্যকর্মী পেয়ে গিয়েছিল ‘বোধন থিয়েটার’। এমন উদ্যোগ সারাদেশ জুড়েই ছিল। গত শতকের ৯৬/৯৭ সালের দিক থেকেই এই উদ্যোগে ভাটার টান দেখেছি। যা-ও হঠাৎ করে এক-দু বার হয়েছে, সেটাও ছিল দায়সারা গোছের। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনকে নতুন উদ্যমে আবার এগিয়ে যেতে হবে, সারাদেশের মৃত ও ঘুমন্ত নাট্যদলগুলোকে আবার জাগিয়ে তুলতে হবে। সারা বছর নাট্যদলগুলোকে সক্রিয় রাখতে নানান কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কেবল গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনই নয়, দেশ জুড়ে ৬৪ টি জেলা শিল্পকলা একাডেমি রয়েছে, জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে নির্বিঘ্নে এগিয়ে নিতে এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বও কম নয়। জেলার থিয়েটার দলগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান, আর্থিক সহযোগিতার বাইরেও সক্ষমতা ও প্রযোজনার মান বৃদ্ধি, মহড়ার স্থানের সুবিধা প্রদানসহ নানান বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান তারাও করতে পারে।
উন্নয়ন থিয়েটার ও উন্নয়ন সংস্থার থিয়েটার
বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তুলতে থিয়েটার একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যম। সারা পৃথিবী জুড়েই সচেতনা সৃষ্টি এবং বৃদ্ধির লক্ষ্যে থিয়েটার অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও উন্নয়ন থিয়েটারের প্রয়োগ উল্লেখযোগ্য। যথাসম্ভব ১৯৭৬ সাল হতে এদেশে উন্নয়ন নাটকের চর্চা হয়ে আসছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) নির্দিষ্ট ইস্যুতে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য উন্নয়ন থিয়েটারটাকে এখনও ব্যবহার করে চলেছে। সংস্থাগুলো যেমন নিজেরা নাট্যদল গঠন করে থিয়েটার প্রদর্শনী করছে, পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানীয় নাট্যদলকেও দায়িত্ব দেয় উন্নয়ন থিয়েটার তৈরি আর প্রদর্শনের জন্য। ইউনিসেফ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সাক্ষরতা অভিযানের নাম এক্ষেত্রে আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয়। তবে এখানেও যে বিষয়টি আশঙ্কার, সেটা হলো থিয়েটারের মান ক্ষুণ্ন হলেও ইস্যুর উপস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এ ধরনের থিয়েটারচর্চা যেসব থিয়েটার দল করেছে তাদের মূল ধারার থিয়েটারচর্চাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে ধীরে ধীরে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের থিয়েটার কার্যক্রম ছিল একটু ভিন্ন, সংস্থাটি দেশব্যাপী একটি চমৎকার কাজ করেছিল। থার্ড থিয়েটারের প্রবক্তা বাদল সরকারের তত্ত্বাবধানে নাট্যকর্মশালার আয়োজন এবং মাসুম রেজা ও প্রলয় চাকীর মতো প্রশিক্ষকদের সহায়তায় উন্নয়ন নাটক নির্মাণের কর্মশালার আয়োজন করে সংস্থাটি। এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত নাট্যকর্মীরা সাক্ষরতা বিষয়ে উন্নয়ন নাটক তৈরি এবং প্রদর্শন করতো।
কিছু থিয়েটার দল থিয়েটার চর্চার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে থিয়েটারকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বেসরকারি সামাজিক সংগঠন (এনজিও) এর ধারায় পথ চলেছে। এদের মধ্যে খুলনার ‘রূপান্তর’, চট্টগ্রামের ‘বিটা’ অন্যতম। উন্নয়ন থিয়েটারে পটগানকে জনপ্রিয় করে তুলেছে ‘রূপান্তর’ এবং ‘বিটা’ পাপেট থিয়েটারকে সমাজ উন্নয়নে ব্যবহার করেছে।
তবে শুধুমাত্র থিয়েটারের উন্নয়ন এবং দেশব্যাপী থিয়েটারের মান উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাওয়া তিনটি সংস্থার নাম আলাদা করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘গণ সাহায্য সংস্থা’ (জিএসএস), ‘প্রশিকা’ এবং ‘থিয়েটার সেন্টার ফর সোশাল ডেভেলপমেন্ট’ (টিসিএসডি)। জাতীয় একটি থিয়েটার দল গঠনের পাশাপাশি দেশব্যাপী তরুণ নাট্যকর্মীদের নিয়ে জেলা পর্যায়ে নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণের মতো চমৎকার একটা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে জিএসএস। বিপ্লব বালা’র নেতৃত্বে ‘হায় বাংলা হায় বেহুলা’, ‘কে জাগিবে আজ’-এর মতো দুর্দান্ত আর অভিনব সব প্রযোজনা নির্মাণ হয়েছিল গত শতকের নব্বই দশকের শেষ দিকে। জাতীয় পর্যায়ে গঠিত নাট্যদলে কচি খন্দকার, সরোয়ার ফারুকী, বাবু সরকারের মতো অভিজ্ঞ নাট্যকর্মীরা যুক্ত ছিলেন অভিনেতা হিসেবে। জেলা পর্যায়ের নাট্যকর্মীদের মানোন্নয়নে এই কার্যক্রম সহায়ক ছিল। তবে জিএসএস-এর তৃণমূল পর্যায়ের থিয়েটার কার্যক্রমে ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। সংস্থাটি তৃণমূল পর্যায়ে মূলত গণজাগরণমূলক গণনাটক নির্মাণ এবং প্রদর্শন করতো। এই নাট্যপ্রযোজনাগুলো বেশিরভাগ সময়ই নিম্ন মানের ছিল। এগুলোতে অযত্নের প্রকাশ পাওয়া যেত, কেন্দ্র থেকে ঠিক করে দেয়া ইস্যু এবং দিবসকে কেন্দ্র করে ছকে ফেলা থিয়েটার তৈরি হতো তাড়াহুড়োার মধ্য দিয়ে। মানের চেয়ে সংখ্যার দিকে গুরুত্ব ছিল তৃণমূলের গণনাটক চর্চায়।
সংস্কৃতি এবং সাথে সাথে থিয়েটার নিয়ে ‘প্রশিকা’ গুরুত্বপূর্ণ কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল। প্রথমত দেশব্যাপী প্রশিকার ৩৫০ টি গণ সংস্কৃতি দল ছিল। জেলা অফিসগুলোতে ১২-১৪ জনের একটি করে মানব উন্নয়ন বিষয়ক সাংস্কৃতিক দল ছিল যারা তৃণমূল পর্যায়ের দলগুলোকে পরিচর্যা করতো। তৃণমূলের দলগুলো মূলত ইম্প্রোভাইজেশনের মাধ্যমে পথনাটক তৈরি করতো এবং সেটা প্রদর্শন করতো। এই থিয়েটারগুলো সামাজিক উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে হতো না, মানুষের সামজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়েই মূলত তৈরি হতো। তবে শুরুর দিকে থিয়েটারগুলো বক্তৃতা ধরনের হয়ে যেত, কখনো প্রবন্ধের সরাসরি মঞ্চ উপস্থাপনাও হয়ে যেত। পরবর্তী সময়ে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক পুরো বিষয়টিতে সহযোগিতা করেন। এরপর দলগুলোর জন্য নতুন করে প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়, তৃণমূলের দলগুলোর থিয়েটারগুলোর শিল্পমান বাড়তে থাকে, রসকষহীন থিয়েটারে হাস্যরস-বিনোদন-গল্প যুক্ত হতে থাকে। তৃণমূলের পাশাপাশি মূলধারার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর উন্নয়নেও কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল নাট্যজন দেবাশীষ ঘোষের নেতৃত্বে। এই কার্যক্রমের আওতায় প্রতিটি জেলার সংগঠকদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করে সংস্থাটি, এই সেমিনারের মধ্য দিয়ে জেলার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সক্ষমত, দুর্বলতা, চাহিদা বের করে আনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা পর্যায়ে নাট্যকার ও নির্দেশক কর্মশালা, অভিনয় বিষয়ক প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। শুধু প্রশিক্ষণ করিয়েই ক্ষান্ত থাকে না সংস্থাটি, সম্ভাবনাময় সংগঠনগুলোর জন্য আলাদা করে জীবিকায়নের উদ্যোগও গ্রহণ করে। সংগঠনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের জন্য সহযোগিতাও শুরু হয়। এরই ফল স্বরূপ বরিশালের অন্যতম নাট্য সংগঠন শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার ‘শব্দাবলী প্রেস’ নামে একটি অফসেট প্রিন্টিং প্রেসের যাত্রা শুরু করে। এই প্রেসের ডেস্ক যবগুলোতে থিয়েটারকর্মীরাই সুযোগ পায়। এমনিভাবেই রাজশাহীর পুঠিয়া থিয়েটার ‘মৎস্য চাষ প্রকল্প’ গ্রহণ করে, সাতক্ষীরার প্রগতি সাংস্কৃতিক সংস্থা সংবাদ পত্র প্রকাশের কার্যক্রম গ্রহণ করে। প্রশিকার পরিকল্পনাতে আরো একটি চমৎকার উদ্যোগ ছিল, বিভাগীয় পর্যায়ে একটি করে আন্তর্জাতিক মানের কালচারাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা, যেখানে আন্তর্জাতিক মানের মঞ্চের পাশাপাশি মহড়াকক্ষ, প্রশিক্ষণকক্ষ, এমনকি আবাসনের বিষয়গুলোও যুক্ত ছিল। অনিবার্য কিছু কারণে উপরোক্ত সবগুলো কার্যক্রমই থমকে যায় মাঝপথে। প্রশিকা মানব উন্নয়ন সংস্থার কেন্দ্রীয় একটি নাট্যদলও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, সংস্থায় কাজ করা সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়েই দলটি গঠিত হয়। মূলত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ইতিহাস নির্ভর নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ করেছিল তারা। এর মধ্যে ‘আমিও যুদ্ধে যাবো’ (নাটক: কুমার প্রীতীশ বল, নির্দেশনা: দেবাশীষ ঘোষ), ‘পিয়ার চাঁদ’ (নাটক: কুমার প্রীতীশ বল, নির্দেশনা: দেবাশীষ ঘোষ) অন্যতম।
থিয়েটার সেন্টার ফর সোশাল ডেভেলপমেন্ট (টিসিএসডি)-এর থিয়েটার নিয়ে কার্যক্রম ছিল পাঁচটি জেলায় (ফরিদপুর, রাজবাড়ি, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা)। সার্বিকভাবে থিয়েটারে প্রশিক্ষিত নাট্যকার, নির্দেশক, পরিকল্পক (মঞ্চ, আলো), অভিনেতা তৈরি ছিল টিসিএসডি’র মূল উদ্দেশ্য। ধারাবাহিকভাবে নাটক রচনা, নির্দেশনা, মঞ্চ-আলো পরিকল্পনা, অভিনয়বিষয়ে একাধিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর পাঁচটি জেলায় নির্মিত নাট্যপ্রযোজনাগুলো নিয়ে ঢাকায় উৎসবের আয়োজন করে টিসিএসডি। এই কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিলেন শহিদুল আলম সাচ্চু এবং এই কার্যক্রমের সাথে প্রথমবার যুক্ত ছিলেন কামালউদ্দিন কবির, ইসরাফিল শাহীন এবং দ্বিতীয়বার মসলেম উদ্দীন শিকদার লিটন, আমিনুর রহমান মুকুলের মতো অভিজ্ঞজনেরা। পরপর দুই বছর এই কার্যক্রম চলবার পর এর ধারাবাহিকতা আর রক্ষা হয় নি। নির্দিষ্ট এলাকার থিয়েটার কার্যক্রমের সাথে যুক্ত নাট্যকর্মীদের নিয়ে এই ধরনের নিবিড় কার্যক্রম অন্তত পাঁচটি জেলার নাট্যাঙ্গনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। অগাস্ত বোয়ালের শিষ্য রাজকুমার পিটারবারির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশে ফোরাম থিয়েটারে প্রশিক্ষণের আয়োজন এবং ফোরাম থিয়েটার চর্চার মতো চমৎকার উদ্যোগও নিয়েছিল সংস্থাটি। ফোরাম থিয়েটার নির্মাণ এবং কর্ম এলাকার পাঁচটি জেলায় ফোরাম থিয়েটার প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশে ফোরাম থিয়েটারের প্রচলন ও চর্চা শুরু হয় টিসিএসডি’র উদ্যোগেই।
আরো কিছু উন্নয়ন নাটকের উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে এখানে। পারটিসিপেটরি অ্যাকশান রিসার্চ মেথডের সাথে ডেভেলপমেন্ট থিয়েটারের চমৎকার সমন্বয় করে কাজ করেছেন রাজীব পারভেজ। কবিগান, ইনভিজিবল থিয়েটার, ফোরাম থিয়েটারের মাধ্যমে লোকগবেষণামূলক কাজ করেছেন কুষ্টিয়া জেলায়। পুরো বিষয়টি ছিল কৃষক এবং কৃষিকেন্দ্রিক। এই চর্চা শুরু হলেও অব্যহত থাকে নি। মাঝ পথেই থেমে গেছে। চট্টগ্রামে মোস্তফা কামাল যাত্রার ইউনাইট থিয়েটার ফর সোশাল একশন (উৎস) নানামুখি কাজ করে যাচ্ছে এখনও। থেরাপিউটিক থিয়েটার একটি চমৎকার সংযোজন, উন্নয়ন নাটকের ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ ‘উৎস’কে আলাদা করে চিনিয়েছে।
উন্নয়ন নাটক কিংবা উন্নয়ন সংস্থার নাটকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এদের কাজ সমস্তটাই অনুদান নির্ভর হয়ে থাকে। অনুদান বন্ধ হয়ে গেলে কিংবা না থাকলে এই চর্চাটাও থেমে যায়। সারাদেশ জুড়ে বেশিরভাগ থিয়েটার দল অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতনতামূলক থিয়েটার পরিবেশনা করে থাকে। এই প্রদর্শনীগুলো একটি দলের আর্থিক কাঠামোকে একটু সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে গেলেও, সামগ্রিকভাবে ওই দলটির মূলধারার নাট্যচর্চায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
তবে ব্যতিক্রম উদাহরণও রয়েছে, রাজধানীর কিছু নাটকের দল থিয়েটারের মান বজায় রেখে অনুদানসহ বা অনুদান ছাড়াও বিভিন্ন ইস্যুতে উন্নয়ন নাটক চর্চা করে থাকে। এই নাট্যদলগুলো নাটকের শিল্পমান বজায় রেখেই উন্নয়ন নাটক নির্মাণ করে থাকে। এই নাট্যদলগুলোর মধ্যে ‘পালাকার’, ‘বটতলা’ অন্যতম। বিশেষভাবে এই দু’টি নাট্যদলের নাম উল্লেখ করবার কারণ হচ্ছে, আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও শুধুমাত্র সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একেবারে নিজেদের অর্থায়নেও বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে নাট্য নির্মাণ করে থাকে। আরো অনেক থিয়েটার দল নিশ্চয়ই রয়েছে যারা একইভাবে শিল্পমান বজায় রেখে উন্নয়ন থিয়েটার করছে।
জাতীয় নাট্য আঙ্গিক খুঁজে ফেরা
প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় আমরা নানান নিরীক্ষা, দেশি-বিদেশী, মৌলিক-যৌগিক-অনুবাদ-নাট্যরূপ-রূপান্তর, নানানরূপের থিয়েটার নির্মাণ করেছি। আমাদের বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চাতে নিজস্বতা বা বাঙালি পরিচয়কে প্রকাশ করতে নিজস্ব থিয়েটার আঙ্গিক নির্ধারণ করা অবশ্যই জরুরি একটি বিষয়। এই প্রশ্নটি সমুখে নিয়ে আসা এবং এর উত্তর খোঁজার প্রচেষ্টার পুরোধা হিসেবে সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফের অবদান অনস্বীকার্য। বর্ণনা, সংগীত আর সংলাপ মিলিয়ে সেলিম আল দীন নিজস্ব একটা নাট্য আঙ্গিক বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির লিখিতরূপ দিতে সফল হয়েছেন এবং সেই লিখিতরূপকে মঞ্চে সফলভাবে তুলে ধরেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ। ১৯৭১ পরবর্তী সময় নব উদ্যমে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরুর সময় থেকেই, বিশেষ করে ‘ঢাকা থিয়েটার’ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ জাতীয় নাট্য আঙ্গিক দাঁড় করবার চেষ্টা করে চলেছে। আমরা থিয়েটারের জাতীয় আঙ্গিক খোঁজার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি, নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। বেশ কিছু নাট্যদলও তাদের থিয়েটার প্রযোজনাগুলোতে দেশজ লোক-আঙ্গিকের ব্যবহার করে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক দাঁড় করবার চর্চায় যুক্ত করেছে নিজেদেরকে। তবে আমাদের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক কেমন হবে সেটা নিয়ে নানানরকম জিজ্ঞাসা রয়েছে।
নির্দিষ্ট একটি আঙ্গিক, বিশেষ করে বর্ণনাত্মক রীতিই কি জাতীয় নাট্য আঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হবে?
জাতীয় নাট্য আঙ্গিক কি প্রচলিত দেশজ নাট্য আঙ্গিকগুলোর মিশ্রণে প্রতিষ্ঠিত কোনো আঙ্গিক হবে? যদি হয় তবে সেটা কি উচিত হবে?
জাতীয় নাট্য আঙ্গিক বলতে কি আমরা এমন একটা নাট্যচর্চার কাল্পনিক আয়তন বুঝবো, যে আয়তনে আমাদের নিজস্ব দেশজ থিয়েটার আঙ্গিকগুলো অবস্থান করবে? কোনো থিয়েটার প্রযোজনাতে কোনো একটা দেশজ নাট্য আঙ্গিক এককভাবেই ব্যবহৃত হবে নাকি একাধিক আঙ্গিক মিলে একটি থিয়েটার প্রযোজনাকে সমৃদ্ধ করে তুলবে?
আমরা কোনো কোনো নাট্যজন/নাট্যগবেষককে একেবারে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছে যেতে দেখেছি যে, ‘বর্ণনাত্মক রীতি’ই আমাদের জাতীয় নাট্য আঙ্গিক।’ এক্ষেত্রেও একটা প্রশ্ন কিন্তু সামনে চলে আসে-
আমাদের আলকাপ, গম্ভীরা, গাজন, পুতুল নাচ, গাজীর গান, অষ্টকসহ সকল দেশজ নাট্য রীতিই কি বর্ণনাত্মক রীতির?
আবার আর একটি বিষয় ভাববার রয়েছে। বর্ণনাত্মক রীতি তো সারা পৃথিবী জুড়েই রয়েছে। সেক্ষেত্রে বর্ণনাত্মক রীতি আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবন বলাটা কি সঠিক হবে?
আমরা আমাদের থিয়েটারচর্চার অভিজ্ঞতায় যা দেখি, তা হলো, হাতে গোনা কিছু উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রযোজনা ছাড়া লোকজ আঙ্গিকের নাট্যপ্রযোজনাগুলো কিন্তু কোনো একটি নির্দিষ্ট লোকজ আঙ্গিককে আশ্রয় করে নির্মিত হয় নি। একটি থিয়েটারে একাধিক লোকজ আঙ্গিক এবং এর সাথে পাশ্চাত্য রীতির মিশ্রন ঘটিয়ে কিছু একটা তৈরি করে বলছি যে, দেশজ আঙ্গিকে একটি থিয়েটার করলাম। এসব প্রযোজনার অবস্থা না ঘরকা না ঘাটকা হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। এসব প্রযোজনাকে দেশজ নাট্য বলাটা কতটা সমীচীন সেটা কিন্তু ভাববার বিষয়।
দেশজ নাট্য আঙ্গিক নিয়ে আমাদের মনের মাঝে যেসব প্রশ্ন আর দ্বিধা জেঁকে বসে রয়েছে, যে ধোঁয়াশা রয়েছে, সেগুলোর একটা সমাধান প্রয়োজন। তবে এটা সত্য এবং সময়ের দাবি যে, এখন সময় এসেছে এমন থিয়েটার চর্চার, এমন থিয়েটার নির্মাণের, যে থিয়েটারকে বাংলাদেশের থিয়েটার হিসেবে আলাদা করে চেনা যাবে। আমরা বলতে পারবো যে, এটা বাংলাদেশেরই থিয়েটার।
সীমানা ছাড়িয়ে থিয়েটারের আদান-প্রদান
পশ্চিমবঙ্গের বাংলা নাটকসহ ভারতের অন্যান্য ভাষার উল্লেখযোগ্য সংখ্যার নাটক অনুদিত ও রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে। বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গে বা ভারতে বাংলাদেশের নাটক মঞ্চায়ন হয় না বললেই চলে। যদিও কালে-ভদ্রে একটি দু’টি দল ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে থিয়েটার নির্মাণ করেছে। তবে ইদানিং এই অবস্থা একটু হলেও পাল্টেছে। বাংলাদেশের নাটক কিংবা উপন্যাস নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে থিয়েটার নির্মাণ হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্দেশক পশ্চিমবঙ্গে নির্দেশনার কাজ করছে, আবার যৌথ নাট্যপ্রযোজনার কাজও চলছে। ‘একুশ শতক’ নাট্যদল সৈয়দ শামসুল হক এর ‘বুকঝিম এক ভালোবাসা’ মঞ্চে এনেছে। নদীয়ার ‘কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র’ মঞ্চে এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, জসীম উদদীনের ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’। বহরমপুরের ‘ঋত্বিক’ মঞ্চে এনেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘চম্পাবতী’। কলকাতার নাট্যদল ‘ভিন্নরূপ’ মঞ্চে এনেছে আমিনুর রহমান মুকুলের ‘জাতিস্মর’। মার্গন কলেজ স্ট্রিট কলকাতা মঞ্চে এনেছে শাহমান মৈশানের ‘নারী নসিমন’। উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙা রবীন্দ্র নাট্য সংস্থা মঞ্চে এনেছে মাহবুব আলমের ‘আমি’। ‘রঙ্গকর্মী’ মঞ্চে এনেছে সাধনা আহমেদের ‘সপ্তপর্ণী’। অশোকনগরের হেমাঙ্গ সাংস্কৃতিক সংস্থা মঞ্চে এনেছে মান্নান হীরার ‘শিকারী’, এটির নির্দেশনায় ছিলেন বাংলাদেশের জুলফিকার চঞ্চল। এই সংগঠন আরো একটি নাটক মঞ্চে আনার জন্য নির্মাণ কাজ করছে, শামীম সাগরের রচনা ও নির্দেশনায় ‘ভগবান আসবেন’। চাকদহ নাট্যজন মঞ্চে এনেছে সায়িক সিদ্দিকীর রচনা ও নির্দেশনায় ‘ভানু সুন্দরীর পালা’। বাংলাদেশের নাট্যদল ‘মেঠোপথ’ এবং পশ্চিমবঙ্গের নাট্যদল ‘সহজপাঠ’ যৌথভাবে মঞ্চে এনেছে ‘জলকুমারী’, এটির রচনা ও নির্দেশনায় দেবাশীষ ঘোষ। শান্তিপুর সাংস্কৃতিক মঞ্চে এনেছে সাধনা আহমেদের ‘অংশুপট উপাখ্যান’। এর বাইরে নিশ্চয়ই আরো কিছু নাট্যপ্রযোজনা পশ্চিমবঙ্গে নির্মিত হচ্ছে বা হয়েছে যেগুলোর নাট্যকার কিংবা নির্দেশক বাংলাদেশের। গত ২০ বছরের আমাদের থিয়েটারে এটা সকলের জন্যই সুখকর সংবাদ।
বাংলাদেশের বাইরে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরাতে নিয়মিত নাট্যচর্চা হয়ে থাকে। তিন বাংলা (বাংলাদেশ, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ) এর বাইরে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা নাটকের চর্চার সংবাদ আমরা পেয়ে থাকি। তিন বাংলার মধ্যে বিভিন্ন নাট্য উৎসবে বাংলা নাট্যপ্রযোজনা প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রিত হবার মাধ্যমে একধরনের আদান প্রদান হয়ে থাকে। এর মাধ্যমে তিন বাংলার নাট্যজন এবং দর্শকেরা তিন বাংলারই নাট্যচর্চা সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। তবে ইদানিং একাধিক বাংলাদেশি থিয়েটার দল পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে বিরূপ মন্তব্যের সম্মুখিন হয়েছেন। মন্তব্যগুলোকে এক করলে যা দাঁড়ায়, ‘আপনারা বাংলাদেশের থিয়েটারকর্মীরা দাবি করেন যে, বাংলাদেশের থিয়েটার কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারের থেকে এগিয়ে গেছে। কোন মুখ নিয়ে আপনারা এই কথা বলেন? আপনাদের যেসব থিয়েটার এদিকে আসে, সেসব তো আমরা দেখি; বাংলাদেশের নাটকের মান এখন কোন পর্যায়ে সেটাতো আমরা বুঝি। আপনারা মুখে অনেক তত্ত্বকথা বলেন, কিন্তু প্রয়োগে তো সেসবের ছিটেফোটাও দেখি না। হাতেগোনা কয়েকটি ভালো প্রযোজনা দিয়েই কি একটি দেশের থিয়েটারের সামগ্রিক মান বিচার সম্ভব?’ পশ্চিমবঙ্গে নাট্যপ্রদর্শনীর জন্য গিয়ে যদি স্থানীয় নাট্যকর্মী-সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়; তখন সহসা কোনো উত্তর কিন্তু মাথায় খেলে না। এরপর মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো যদি এসব সম্পূরক মন্তব্য শুনতে হয়, ‘দাদা, আপনাদের বাংলাদেশ থেকে যেসব নাটক এপারে আসে, তার বেশিরভাগই দেখা যায় না। কিছু মনে করবেন না, ওসব অখাদ্যের চেয়ে আমাদের গ্রামে-গঞ্জে ভালো নাটক হয় এখন’ তখন অবস্থাটা হয় বজ্রাহতের মতো। বিপরীতদিকে পশ্চিমবঙ্গের অনেক নাট্যদল বাংলাদেশে আসে যাদের ক্রমাগত মানহীন প্রদর্শনী দেখতে দেখতে একই প্রশ্ন আমাদের মনেও আসে। বাংলাদেশের একাধিক নাট্যকর্মী এবং নাট্যজনের সাথে পশ্চিমবঙ্গের নাট্যকর্মী, নাট্যজন, দর্শকের বাহাস হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নাটক সংশ্লিষ্টদের যেমন ধারণা জন্মেছে যে, বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের মান দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে; তেমনি বাংলাদেশের নাটক সংশ্লিষ্টদের মনেও একই ধারণা জন্মেছে যে, পশ্চিমবঙ্গের মঞ্চনাটকের মান ভালো নয়। তাদের মুখেই আক্ষেপ শোনা যায়, আরণ্যক, দেশ নাটক, নাগরিক, ঢাকা থিয়েটার, থিয়েটার-এর যেসব নাটক তারা একসময় কলকাতার মঞ্চে দেখেছেন, এখনকার নাটক তার ধারেকাছেও যায় না। তবে এসব দর্শকের কেউ কেউ যখন ‘ব্রাত্য আমি মন্ত্রহীন’ (বিবর্তন যশোর), ‘ক্রাচের কর্নেল’ (বটতলা), ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ (পালাকার), ‘অতঃপর মাধো’ (মেঠোপথ), ‘চন্দ্রাবতী কথা’ (বোধন থিয়েটার, কুষ্টিয়া), ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ (সাধনা), ‘অনুদ্ধারণীয়’ (থিয়েটার আর্ট ইউনিট), ‘মহাজনের নাও’ (সুবচন নাট্য সংসদ), ‘ভাগের মানুষ’ (সময়), ‘নিত্যপুরাণ’ (দেশ নাটক)-এর মতো নাট্যপ্রযোজনা দর্শন করেন, তখন তারা আক্ষেপ করে বলেন যে, এ ধরনের অন্য আর সব নাটক কেনো পশ্চিমবঙ্গে আসে না। আমরা বাংলাদেশি নাট্যকর্মীরাও তাদের মতো করেই আক্ষেপ করি এবং বলি, বাংলাদেশে ‘ঘসিরাম কতোয়াল’, ‘হৃদিপাশ’, ‘সিরাজদ্দৌলা’, ‘ম্যাকবেথ বাদ্য’, ‘গয়নার বাক্স’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’-এর মতো আর সব প্রযোজনাগুলো কেনো বাংলাদেশে আসে না। মানহীন নাট্যপ্রযোজনা আদান-প্রদানের কারণে ঢাকার মঞ্চে যেমন পশ্চিমবঙ্গের থিয়েটারের দর্শক হয় না, তেমনি কলকাতার মঞ্চেও বাংলাদেশের নাটকে দর্শকের উপস্থিতি তথৈবচ। এই যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানহীন থিয়েটার প্রযোজনার আদান-প্রদান চলছে দুই বাংলায়, এর কারণ কিন্তু থিয়েটার অঙ্গনের সকলেরই জানা। সবার মনে রাখা দরকার, দেশের সীমানার বাইরে যখন আমি পা রাখি তখন তো আর আমি ‘ব্যক্তি আমি’ থাকি না, আমি তখন আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করি, দেশের মানসম্মান আমার উপরও নির্ভর করে।
একটি থিয়েটার দল হিসেবে দেশের বাইরে নাট্যপ্রদর্শনীর জন্য যাওয়াটা অবশ্যই আনন্দের এবং সম্মানের। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে তখনই, যখন একটি নাট্যদল কোনো আমন্ত্রণ না পেয়েও নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে দেশের বাইরে প্রদর্শনী করার উদ্যোগ নেয়। ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিষয়টি নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। শুধু শুধু পিঠ চাপড়ানো প্রশংসা না করে, যথাযথ সমালোচনা আর উপদেশ প্রদান এবং গ্রহণও প্রয়োজন।
সবশেষে
রাজধানীর একটা নাট্যদল নারায়ণগঞ্জে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিল। নাট্যকর্মীরা মিলনায়তনে চেয়ারে বসে রয়েছে, এমন সময় নৃত্যশিল্পীদের একটি দল মিলনায়তনে প্রবেশ করে। এসময় উপস্থাপক মাইকে এই ঘোষণা দেন, ‘নাট্যকর্মীরা জায়গা ছেড়ে দেন, শিল্পীদের বসতে দেন।’ নাট্য সংশ্লিষ্টদের জন্য এই অসম্মান বেদনাদায়ক। নাট্যকর্মীরা এখনও সংস্কৃতিকর্মীদের কাছেই কামলার ঊর্ধ্বে উঠে শিল্পী হয়ে উঠতে পারে নি। তাহলে সমাজের চোখে তাদের অবস্থানটা তো বোঝাই যায়। কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাট্যশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, সংগীতশিল্পীদের এক পাল্লায় মাপা হয় না। মনে হয় নাট্যশিল্পীরা যেন অযাচিতের মতো উপস্থিত হয়েছে। এরজন্য থিয়েটার সংশ্লিষ্টরাও কিন্তু সমান দায়ী। দেশের ভিতরে এবং দেশের বাইরেও নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে নাট্যদলগুলো নাট্যপ্রদর্শনী করতে যায়। অনুষ্ঠান আয়োজকরা এখনও মনে করেন, থিয়েটার বিনা পয়সায় করা সম্ভব। আপনাদের কোনো সম্মানী দিতে পারবো না। এক বেলা খেতে দেব শুনলেই আমরা আনন্দে নেচে উঠি, দল বেঁধে দৌড় দিই। নিজেরাই গর্ব করে নিজেদের কর্মী বলতে বলতে কামলারও অধম করে রেখেছি। নাট্যকর্মীরা আজও শিল্পী হয়ে উঠতে পারলো না। আফসোস!
আমাদের থিয়েটারচর্চার পথ চলাটা কখনোই মসৃন ছিল না, এখনও নেই। ফরিদপুরে থিয়েটারকর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি, সিলেট এবং খুলনা অঞ্চলে নাট্যানুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাধা দেওয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক নাট্যানুষ্ঠান বন্ধের এবং ভবিষ্যতে নাটক মঞ্চায়নের পূর্বে জেলা প্রশাসন থেকে পা-ুলিপি পরীক্ষা করিয়ে নেয়ার নির্দেশ প্রদান; এমন ঘটনাগুলো থিয়েটারের জন্য অশনি সংকেত ও দুঃখজনক। এবং এসময়েও এমন ঘটনা ঘটার বিষয়টা সারাদেশে থিয়েটারের সাংগঠনিক দুর্বলতাই প্রকাশ করে।
তারপরও আমরা থিয়েটারটাকে আঁকড়ে শিল্পে বাঁচতে চাই। আমরা থিয়েটারটা নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা থিয়েটার সংশ্লিষ্টরা এখনও থিয়েটারটা নিয়ে সীমাহীন স্বপ্ন দেখি। কখনো কোনো কোনো স্বপ্ন ভঙ্গ হয়, আবার কখনো কখনো কোনো স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেয়। আমরা নানানভাবে নানানরঙের থিয়েটারচর্চা করেছি, করে চলেছি, ভবিষ্যতেও করবো। বৈচিত্র্য সমৃদ্ধির পরিচয়, এই বিষয়টা বিবেচনায় রেখে বৈচিত্র্যের আলোয় নিজেদের আলোকিত করে রাখবার প্রয়োজন রয়েছে।
জয় হোক থিয়েটারের।
তথ্য ঋণ: বাংলাদেশের থিয়েটার ও অন্যান্য: আরিফ হায়দার।। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা নাটকের অর্জন: আফসার আহমদ।। নাট্যচর্চায় বাংলাদেশ: আশিস গোস্বামী।। একবিংশ শতাব্দীতে আমাদের নাট্যচর্চা: ফারুক হোসেন শিহাব।। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার চর্চা: অভিজিৎ সেনগুপ্ত।। চট্টগ্রামে থিয়েটারের তিনটি মাইলফলক: মশিউর রহমান আদনান।। বাংলাদেশের পথনাটক: ইসরাফিল শাহীন।। প্রসঙ্গ: দেশজ নাট্য-এর জাতীয় স্বরূপ: মোস্তফা কামাল যাত্রা।। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাঙালির নাট্য সৃজনের মৌলিক ও স্বতন্ত্র প্রয়াস: হিতাংশু ভূষণ কর।। নাটকের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম: মাহমুদল হক জিহাদ।। পরিবেশ থিয়েটার: গোলাম শফিক।। ঢাকার বাইরে নাট্যচর্চায় সমস্যা ও সম্ভাবনা: নিরঞ্জন দে।। ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারসমূহ।। নাট্যজনদের ফেসবুক পেইজ পোস্ট।। বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গের একাধিক নাট্যদলের নাট্যজনদের সাথে মৌখিক সাক্ষাৎকার, আলাপ, আড্ডা।।
শামীম সাগর ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা-নির্দেশক। সদস্য- পালাকার।