Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কবির প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

সত্যি বলাই শ্রেয় যে, শামসুর রাহমান আমার প্রিয়কবিদের মধ্যকার কেউ নন। যে ধরনের তাড়না থেকে আমি কবিতা পড়ি, উলটিয়ে-পালটিয়ে আস্বাদনের জন্য একটি কবিতায় আমি যে ধরনের কাব্যবস্তুর সন্ধান করি, শামসুর রাহমানের কবিতা তার যোগান আমাকে খুব কমই দেয় বা দিতে পারে। এজন্যে কবিতাপাঠের অভিপ্রায়ে প্রায়শই আমার শামসুর রাহমানমুখী হওয়া হয় নি। এ স্বীকারোক্তি আমার জন্যে যেমন মোটেই গৌরবের নয়, তেমনি শামসুর রাহমানের জন্যও নয় অগৌরবের। কবি ও পাঠককুলে ‘কাব্যরুচি’ বলে একটা ক্লিশে কথার ব্যাপক প্রচলন আছে। ওই শব্দবন্ধাভ্যন্তরস্থ অর্থসম্পদই আমাদের মধ্যকার এই বিরহাকুল পটভূমিটি রচনা করে দিয়েছে। বিষয়টি কাজ করে একটি সেতুর মতো। সেতুটি স্থাপিত হলো তো নৈকট্যও স্থাপিত হলো, না হলে দূর-মহাদূর। অর্থাৎ বোঝাতে চাচ্ছি যে, শামসুর রাহমানের কাব্যরুচি আমাকে আকৃষ্ট করে না, কিংবা বলা যায় সাধারণভাবে আমার কাব্যরুচি শামসুর রাহমানের কবিতার প্রতি বিকৃষ্ট হয়।

লেখার সূচনাতেই এরকম নেতিগন্ধী কথা প’ড়ে মনে করবার কারণ নেই যে, কবি শামসুর রাহমানকে নিয়ে এই লেখকের সামগ্রিক মূল্যায়নটিও সমভাবে নেতিভারাক্রান্ত। বরং সেটা এরকম যে, শামসুর রাহমান সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে তাঁর সময়ের অতি প্রয়োজনীয় একজন জন ও রাষ্ট্রসংবেদী কবিব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কবিতা যেজন্য দেশ ও জাতির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পেরেছে, আক্ষরিকভাবেই যা আমাদের অনেকানেক জাতীয় প্রয়োজন মিটিয়েছে এবং মিটাবে। আমার কাছে এ বিবেচনায় তাঁকে এবং তাঁর কবিতাকে রীতিমতো অবিকল্প মনে হতো, এখনো মনে হয়, ভবিষ্যতেও এরকম মনে না হবার লক্ষণ আপাতত স্পষ্ট নয়। তাঁর আসাদের শাট’, তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়-সহ অজস্র কবিতা এদেশের মানুষ এত অসংখ্যবার পড়েছে এবং কাজে লাগিয়েছে ও লাগাবে যে, বলা যায়, এগুলো লিখিত না হলে স্ব স্ব ক্ষেত্রের প্রয়োজনটি এত যথাযথভাবে মিটাবার সুযোগই তৈরি হতো না।

‘কবি দায়বদ্ধ কবিতার কাছে’ (কবিতার দায়)- কবির দায়বদ্ধতার এরকম একটি নিজকৃত সংজ্ঞায়নের পরও জীবনের শেষদিকে শামসুর রাহমান যেসব কবিতা লিখছিলেন, সেসব নিয়ে নব্য কবিতাকর্মীদের মনে ক্রমাগত সংশয় জন্ম নিচ্ছিল। ‘যদি বাঁচি চার দশকের বেশি/লিখবো।/.../যদি বেঁচে যাই একদিন আরো/লিখবো।’ নিজবাসভূমে গ্রন্থধৃত তাঁর এই ‘ইচ্ছা’র, আমরা দেখেছি, পূর্ণ বাস্তবায়নই করে যেতে পেরেছেন তিনি, প্রতিদিন লিখে। সাধারণত তাঁর কবিতার রক্তমাংসসহ শারীরিক কাঠামোটি এত নরম-কোমল ও পেলব হতো যে, দেখে মনে হতো কবিতা লেখাটা আসলে কোনো ব্যাপারই না, যেকোনো সময়, শারীরিক-মানসিক যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো বিষয় নিয়ে অবলীলায় লিখে ফেলা যায় একেকটি কবিতা। তবে এরকম ক্ষেত্রে সামাজিক দায় মিটলেও, সত্যিকারার্থে কবিতার দায় ঠিকঠাক মেটে কি না, সেসব নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন জাগত আমাদের মনে। অনেকেই আমরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলাম ওই সমস্ত লেখার দিক থেকে। শাস্ত্রলাভের জন্য কবিদের ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা সূচিত হলেও শাস্ত্রটা মেলে শেষপর্যন্ত একস্থানেই; মঞ্জিল মূলত একটাই, কবিতামঞ্জিল, অরূপসাগর তীরে- আমরা জানতাম, তবু ওই অবলীলাবির্ভূত রচনামালার গুরুভাগকে সংশয়হীনভাবে গ্রহণ করা ও তার দিকে ফিরে ফিরেই তাকানো কিছুতেই আর হয়ে উঠত না আমাদের।  

কিন্তু আমরা যখন তাঁর পুরানো কবিতা থেকে পড়ি- ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়।’, (আসাদের শার্ট) তখন দু’টো দায়ই মিটে যায় বলে মনে হয়। যেজন্য আসাদের শার্টকে তখন আমাদের প্রাণের পতাকা করে নিতে বাধে না আর। এ জাতীয় কবিতাই, আমার ধারণা, শামসুর রাহমানকে বাংলার ‘প্রয়োজনীয় কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। শামসুর রাহমানের কবিতাভুবন এরকম বিস্তর উদাহরণে ঠাসা। জীবৎকালে সংঘটিত বাংলার-বাঙালির ছোটবড়ো প্রায় সকল আন্দোলন-সংগ্রামের কাব্যিক গ্রন্থনা শামসুর রাহমানের হাতেই সফলভাবে ঘটেছে। আরো পড়া যাক কিছু- ‘তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।’ (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা) ; কিংবা ‘আমরা ক’জন শ্বাসজীবী/ ঠায় বসে আছি/ সেই কবে থেকে। অকস্মাৎ কুকুরের/ শানিত চিৎকার/ কানে আসে, যাই জানালার কাছে, ছায়াপ্রায়। সেই/ পথের কুকুর দেখি বারংবার তেড়ে যাচ্ছে জলপাইরঙ/ একটি জিপের দিকে, জিপে/ সশস্ত্র সৈনিক কতিপয়। ভাবি, যদি/ অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর।’ (পথের কুকুর) ; কিংবা ‘দেখে সে/ উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায় ; মুক্তিযুদ্ধ/ হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।’ (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)। অথবা যদি পড়ি- ‘হে পরওয়ার দিগার, হে-বিশ্বপালক,/ আপনি আমাকে লহমায়/ একজন তুখোড় রাজাকার ক’রে দিন। তা’হলেই আমি/ দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়/ তেল ঢালতে পারবো অবিরল,/ গরিবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর/ মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে/ ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগি¦দিক আর সবার নাকের তলায়/ একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ/ কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অব-কাঠামো।’ (একটি মোনাজাতের খসড়া) ; বা ‘উদোম শরীরে নেমে আসে রাজপথে, বুকে-পিঠে/ রৌদ্রের অক্ষরে লেখা অনন্য স্লোগান,/ বীরের মুদ্রায় হাঁটে মিছিলের পুরোভাগে এবং হঠাৎ/ শহরে টহলদার ঝাঁক ঝাঁক বন্দুকের সীসা/ নূর হোসেনের বুক নয় বাংলাদেশের হৃদয়/ ফুটো করে দেয় ; বাংলাদেশ/ বনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে, তার/ বুক থেকে অবিরল রক্ত ঝরতে থাকে, ঝরতে থাকে।’ (বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)। উদাহরণদৃষ্টে মনে হয় যে, এসবের জুড়ি আমরা কোথাও হয়ত খুঁজে পাব না আর বাংলা কবিতায়?

ব্যক্তি ও সামাজিক মানুষ হিসেবে তিনি তুলনারহিত ছিলেন। ‘না’ বলতে জানতেনই না তিনি প্রায়। কিছু এলোমেলো শব্দের একটি স্তূপকে গ্রন্থের মোড়কে সাজিয়ে অথবা সাজাবার বাসনাটি অন্তত বগলদাবা করে তাঁর সামনে আর্জিটা পেশ করা গেলেই হলো, পাঠককে উদ্দেশ করে লেখাগুলো পড়ে দেখবার অনুরোধযুক্ত একটি ফ্ল্যাপ কিংবা ভূমিকা তিনি লিখে দিতেনই, তা আর্জিপেশকারী যেই হোক না কেন। এমনকি সম্পর্কের ফাঁসে জড়িয়ে অনেকে তাঁকে দিয়ে সাক্ষাৎকারের নামে নানা কিছু বলিয়ে নিতেও সক্ষম হতেন, এমনিতে যা হয়ত তিনি কখনোই বলতেন না। এই ভালোমানুষী সবসময় যে দেশ-জাতি, সাহিত্য-সংস্কৃতির জন্য মঙ্গলকর হতো না বলাই বাহুল্য। তবে কারো কারো প্রয়োজন তাতে অবশ্যই মিটত।

দেশের প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও মানবিক দর্শন তাঁকে সবসময় মিত্র হিসেবে পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকারের পক্ষে তিনি তাঁর গোটা জীবনই সরব ছিলেন। এই সরবতা সামাজিক মানুষ হিসেবে তাঁকে এমন প্রয়োজনীয় করে তুলেছিল যে জীবনের শেষ সময়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতাকেও অনেকে মার্জনীয় বলে গণ্য করতে চাইত না। যেজন্য শারীরিকভাবে অক্ষম হয়েও বাধ্য হয়ে তাঁকে ‘সভাপ্রধান’, ‘উদ্বোধক’, ‘প্রধান অতিথি’ ইত্যাদি চরিত্রে রূপদান করতে হতো। কবিতার দায় প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন, ‘একজন মর্যাদাসম্পন্ন কবি বিশেষ কোনোও দল, সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু তা’বলে সেই দল কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন না।’ ‘না’ উচ্চারণ করতে পারার তাঁর সহজাত অক্ষমতা এবং অন্তিম সময়ে শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলবার কারণে কখনো কখনো তাঁকে ওই পর্যায়েও যে অবনত হতে হয় নি তা নিশ্চিত করে বলা চলে না বস্তুত। অন্য সবার প্রয়োজনে লাগলেও, অনেকে জানেন, এসব ভার নিতে গিয়ে তাঁর শরীরের অনেক ক্ষতিও ডেকে আনা হয়েছিল।

একজন কবির দেশ-জাতি ও মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারা অনেক বড় ব্যাপার। কবি শামসুর রাহমান তাঁর মত্যুর বহু আগেই সে স্তরে উন্নীত হতে সক্ষম হয়েছিলেন। আমার ধারণা, দেশের প্রধান কবি হিসেবে জনসাধারণ্যে তাঁর স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে এটিও একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল। কবির এরকম প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারার লাভ অনেক, তবে তা কখনোই পুরোপুরি ক্ষতিহীন নয়।

২০-২১ অগাস্ট ২০০৬, ঢাকা  

দরজা-জানালা
শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ৩য় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯
শামসুর রাহমানের প্রবন্ধ, শ্রাবণ প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০০১

মুজিব মেহেদী : কবি