Full premium theme for CMS
শামসুর রাহমানের কবিতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
[বাঙলা নাট্যের অন্যতম প্রধান পুরুষ হিসেবে শম্ভু মিত্র যে-কোনো সময়েই শ্রদ্ধার সাথে স্বীকৃত। আর আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমান জীবিতকালেই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন, ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র সম্পাদক মীজানুর রহমান বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য সম্পাদক। মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’য় ১৯৯১ সালে ‘শামসুর রাহমান সংখ্যা’য় ছাপা হয়েছিল বাঙলা নাট্যের এই প্রধান পুরুষের নিবন্ধ শামসুর রাহমানের কবিতা। মীজানুর রহমান প্রয়াত হয়েছেন জুন’০৬ মাসে, গত ২২ অগাস্ট ছিল শম্ভু মিত্রের জন্মদিন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রধান এই তিন বাঙালিকে স্মরণ করতেই নিবন্ধটি ঈষৎ সংক্ষেপ করে থিয়েটারওয়ালার পাঠকদের জন্য পুনর্মুদ্রণ করা হলো।- সম্পাদক]
বর্তমান যুগের হতাশা, ক্লান্তি, অবসাদ এবং সব অতিক্রম করে আশার সুর শামসুর রাহমানের কবিতায় যেমনভাবে বেজেছে, উভয় বাংলার খুব কম কবির কাব্যকৃতিতে তেমনটি দেখা যায। তাঁর কবিতা একাধারে ব্যষ্টি ও সমষ্টি প্রেম, ফাঁপা সমাজ, সর্বসাধারণের দুঃখদুর্দশার ও চরম হতাশার মধ্যে চরম আশার এক প্রামাণিক দলিল। মানুষের হতাশা বেদনা আশা আকাঙ্খার নিখুঁত চিত্র তিনি যেমনটি এঁকেছেন, সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা এক আশ্চর্য সুন্দর অভিজ্ঞতা বলে বিবেচিত হবে। প্রশ্ন হতে পারে, শামসুরের সামনে বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের পটভূমি না থাকলে শামসুর রাহমান কি এতো ভালো লিখতে পারতেন? উত্তরে বলা চলে, সার্থক কবিতা তো প্রত্যক্ষ বেদনাসঞ্জাত অভিজ্ঞতারই স্বর্ণফসল। ভাষা আন্দোলন না এলে শামসুরের অবিস্মরণীয় লাইনগুলো ‘হে আমার আঁখিতারা ... তোমাকে উপড়ে নিলে বলো তবে, কী আমার থাকে? ’(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা) সৃষ্টি হত না। কিন্তু শুধু অভিজ্ঞতাই সব নয়, আপন প্রতিভার আশ্চর্য জারকরসে অভিজ্ঞতাকে জারিত করে যিনি স্বাদু রচনা উপহার দিতে পারেন তিনিই সার্থক লেখক। শামসুরের আছে সেই জাদু প্রতিভা। যখন অন্য কবিরা যান্ত্রিক সভ্যতার অবক্ষয়, বেদনা, দুঃখ ও আর্তিতে জর্জরিত, ঠিক তখনই তিনি প্রচণ্ড আশার ছবি এঁকেছেন। আর কোনো কারণে না হোক, অন্তত এই একটি গুণের জন্য আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। এ কথা বলছি না তিনি হতাশার ছবি আঁকেন নি। এঁকেছেন বৈকি। কিন্তু হতাশার পাশে পাশে ‘চোখ অন্ধ করা চৈতন্য ধাঁধানো উজ্জ্বলতা’-ও দেখেছেন। তিনি জীবনেরই ডাকে বাহিরকে ‘... ঘর, ঘরকে বাহির’ (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯) করতে জানেন। তাঁর কাছে ‘জীবন মানেই ... ফসলের গুচ্ছ বুকে নিবিড় জড়ানো, ... মুখ থেকে কারখানার কালি মুছে বাড়ি ফেরা একা শিশ দিয়ে ... টেপির মায়ের জন্য ... ডুরে শাড়ি কেনা ... সহপাঠিনীর চুলে অন্তরঙ্গ আলো তরঙ্গের খেলা দেখা ... অন্যায়ের প্রতিবাদে শূন্যে মুঠি তোলা ... প্রিয়ার খোঁপার ফুল গোঁজা ... হাসপাতালের বেডে শুয়ে একা আরোগ্য ভাবনা ... গলির মোড়ের কলে মুখ দিয়ে চুমুকে চুমুকে জলপান’ (ঐ) এবং আরো অনেক কিছু। তাইতো ‘দুর্মর দুর্জয় আশায় এখনো, ফুল ফোটে বাস্তবের বিশাল চত্বরে হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায় সেই ফুল আমাদেরই প্রাণ’ (ঐ) আর এই প্রাণের তাগিদে, আশার তাড়নায় কবি ‘চারদশকই বাঁচুন আর একদিন আরো বাঁচুন’ শুধু লিখতে চান।
নিরাশা থেকে কবির আশায় উত্তরণ যে সহজসাধ্য হয় নি তা সহজেই অনুমেয়। এলিয়টের ভঙ্গিতে মানুষের বহু যত্নে গড়া আদর্শ প্রতিমাগুলোকে কবির মনে হয়েছে- `a heap of broken images’ এই সমাজের মানুষ `Shape without form, shade without color, paralysed force, gesture without motion.’ ‘যিনি নম্বর ভালোবাসতেন’ তিনি মনে করছেন জীবন নোটের নম্বরে ছাওয়া, তাই টাকা ছড়িয়ে হাতের মুঠোয় সব কিছু পেলেও ( লো-কাট ব্লাউজ; পলিসি নম্বর ব্রিফকেস, চেকবই প্রসন্ন নোটের তাড়া, সবই ছিল তাঁর) আসলে তিনি ফাঁপা মানুষেরই মূর্ত প্রতীকতারই পরিণতি, বাগানের স্তব্ধতায পতনের শব্দ আর নিঃশব্দ ভীষণ বুকের একান্ত ঘড়ি, শূন্য হাত। ‘ফাপা সমাজের’ তিনজন বুড়ো প্রথমজন ‘খুঁটিনাটি ফ্যাসাদ মিটিয়ে ... জুতোর পাটির চেয়ে ঘন ঘন’ বউ বদলেছেন। ইনি প্রুফুকের কায়দায় না হলেও অন্যভাবে `have measured out ... life without coffee spoons.’ দ্বিতীয়জন গণঅভ্যুত্থানের গতি প্রকৃতি দেখে কৌতুক বোধ করেছেন। এরা ফাঁপা সমাজের মানুষ, তাই নিজের গল্প বলতে আগ্রহী হন, অন্যের কার্যপদ্ধতিতে মুর্খামির পরিচয় পেয়ে কৌতুকান্বিত হন, দেওয়ালের লিখন ফাঁপা মানুষরা পড়বে কী করে? শামসুর এখানেই থামেন নি, এলিয়টের ফাঁপা মানুষদের পোড়ো জমি ছাড়িয়ে নতুন বসতির দিকে এগিয়েছেন তৃতীয় বৃদ্ধের মাধ্যমে উপনিষদের দ্বিতীয় পাখির মত, যে দেখে শুধু দেখে গভীর একাকী।’ আশার জোলো কথা উচ্চারণ না করে কবি যে নিখুঁত আশার ছবি এঁকেছেন তা অবাক বিস্ময়ে দেখার মত। এই ধরনের আশাবাদ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতাতেও পাওয়া যায়, কিন্তু সে আশা বেশ কিছুটা রাবীন্দ্রিক ও এলিয়টীয় ভাবনায় ঈশ্বরনির্ভর (ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার ঐ ভাঙা দরজাটা মেলাবেন তিনি মেলাবেন’)। শামসুরের আশাবাদ-গণদেবতা-নির্ভর। এই গণদেবতা ‘সংখ্যাহীন’। তাঁর আশারূপী ‘লোক’ সর্বত্র, ‘আমাদের চোখের পাতায় লোক। ... পাঁজরের সিঁড়িতে লোক। ... ধুকধুকে বুকের স্কোয়ারে লোক’ (পুলিশ রিপোর্ট)। যখন ‘প্রেমিক শয্যায় তার কাতর মৃত্যুর প্রতীক্ষা’ রত, তখন ‘প্রেমিকা তার (ফাঁপা মানুষদের একজন) রেস্তরাঁয় তিনটি যুবার সাথে রাষ্ট্র করে হৃদয়ের গল্প’। এই সমাজেরই লোকেরা ‘শক্তির দোহাই পেড়ে সবাই মটকে পায়রার ঘাড় এবং প্রগতিশীল নাটকের কুশীলবের কমতি নেই, পার্ট জানা থাক অথবা না থাক সমস্বরে চেঁচালেই কেল্লা ফতে’ (আকাশের পেটে বোমা মারলেও)। আধুনিক সভ্যতা দিয়েছে দারিদ্র্য দুঃখ বঞ্চনা অভিশাপ। তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ তাঁর প্রিয় শহর ‘নগ্ন হাঁটে খোঁড়ায় ভীষণ, রেস খেলে, তাড়ি গেলে হাঁড়ি হাঁড়ি ... ছায়ার গহ্বরে আত্মার উকুন বাছে ... রাত্রি এলে সাত তাড়াতাড়ি যায় বেশ্যালয় ... সিফিলিসে ভোগে ... বুকে হাতে ঝোলায় তাবিজ তাগা, রাত্রি দিন করে রক্তবমি’ (এ শহর)। এখানে কবি এলিয়ট কথিত `shape without form’ সমাজকে মেনে নিয়েছেন। যেটা আধুনিক সভ্যতার দান, তাকে মেনে নেয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু হতাশায় তিনি কখনো ভেঙে পড়েন নি, তাই ‘সবুজ উদ্দাম বসন্ত’ (সমর সেন) আসবে কিনা সে সম্পর্কেও কোনো দ্বিধা নেই (এ শহর) ... ‘এলগ্রেকো ছবি হয়ে ছোঁয়া যেন উদার নীলিমা’ (ঐ), এ শহর মৃত্যুঞ্জয়ী, কেননা ‘এ শহর প্রত্যহ লড়াই করে বহুরূপী নেকড়ের সাথে’ (ঐ)। শামসুর `hooded hordes swarming over endless plains’ দেখে ভয় পান নি, তাদের সঙ্গে লড়াই করতে প্রতিমুহূর্তেই প্রস্তুত। সেই সংগ্রামের প্রস্তুতি হিসেবে কবি দেখেন ‘চতুর্দিকে তরঙ্গিত মাথা/ উত্তাল উদ্দাম’ (পুলিশ রিপোর্ট)। এই কারণেই বলা যায় শামসুর নিরাশার মধ্যেও আশার কথা নতুন করে বলিষ্ঠতার সঙ্গে দৃপ্তকণ্ঠে বার বার শুনিয়েছেন।
শামসুরের হৃদয় যন্ত্রণাজর্জর। তাই হতাশা ছাপিয়ে আশার কবিতা তিনি সব সময় শোনাতে পারেন নি, এ কথা সত্য। মৃত্যুভয়ও তাকে ঘিরে ধরেছে কখনো কখনো। ‘যেন মৃত্যু অকস্মাৎ এ শহরে সব কটি ঘরে দিয়েছে বাড়িয়ে হাত’, তাই শত ডাকা সত্বেও ‘দেয় না উত্তর কেউ’ (ডাকছি)। সুপ্রাচীন গ্রীকের মত ‘এ্যাম্ফিথিয়েটার থেকে’ ... পালা দেখে ‘ফিরে যেতে যেতে’ ‘কে যেন ডাকছে’ (ফিরে যাচ্ছি) মনে হলেও ‘এ আমার মতিভ্রম, কেউ ডাকছে না’। কিন্তু তা কি হয়? ‘কেউ ডাকবে না?’ প্রশ্ন মনষ্ক কবি উত্তর না পেয়ে কি তাই একাকীত্বে আশ্রয় পেতে চান? এই কারণেই কি তিনি ‘পুনরায় রৌদ্রহীন রৌদ্রে ... পথহীন পথে?’ (প্রত্যাবর্তন) তাহলে কেমন করে তিনি ‘বুকের একান্ত রৌদ্রে ... হু হু জনহীনতায়’ (টিকিট) স্বাধীনতার টিকিটাকে লালন করতে চান? আসলে বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতায় যন্ত্রণাজর্জর হয়ে ‘ঘাসের নিচের সেই বিষাক্ত সাপকে ভালবাসি, কেননা সে কপট বন্ধুর চেয়ে ক্রুর নয় বেশী রাগী বৃশ্চিকের দংশন আমার প্রিয় কেননা সে দংশনের জ্বালা অবিশ্বাসিনী প্রিয়ার লাল চুম্বনের চেয়ে অনেক মধুর’ (পক্ষপাত) কবি একাকীত্ব খোঁজেন, ‘কোকিল কুকুর হাঁস টিকটিকি’র সঙ্গ পেতে চান (প্রকারভেদ)। আর তখনই জীবনানন্দীয় ‘স্বপ্নের হাঁস আসে নেমে’ (ছেলেটা পাগল নাকি?) যদিও তা ক্ষণিকের জন্য। কবি বুঝতে পারেন যে তাঁর নিষ্ক্রিয়তা ও নীরবতার সুযোগ নিয়ে কারা যেন বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, অমনি বিদ্রোহী কবি সত্তা ‘গাছের পাতা, আকাশের নক্ষত্র, নদীর ঢেউ, প্রতিটি ফুল, চোখের মণি, হাত, গাছ’ সবাইকে বাকস্বাধীনতা দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠে। তাইতো গণ-সংগ্রামে শামিল হবার ডাক এলে প্রিয়ার সলজ্জ সান্নিধ্যে যাবার মন থাকে না; কেননা ‘আমাদের বুকে জ্বলে টকটকে ক্ষত/ অনেক নিহত আর বিষম আহত/ অনেকেরই প্রেমালাপ সাজে না’ (প্রতিশ্রুতি)। কবি ‘আজন্ম, যুদ্ধকে, ঘৃণা’ করেন, কেননা যুদ্ধ ‘মূল্যবোধ নামক বৃক্ষের প্রাচীন শিকড় ছিঁড়ে’ ফেলে ‘চতুর্দিকে’ ধ্বংসের ‘বাজায় দুন্দুভি।’ তবু তখন নিজের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে ওঠে তখন ‘যন্ত্রণাজর্জর’ ‘বাণীহীন বিমর্ষ কবি’ থেকে শুরু করে ‘সৈনিক ধর্ষিতা তরুণী’ এমনকি ‘শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন’ও বলবেন ‘যুদ্ধই উদ্ধার।’ তাইতো স্বাধীনতা-প্রাপ্তির উদ্দামতায় উন্মত্ত হয়ে ‘পাইকারী হত্যা ... রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন রক্তাক্ত দস্যুতা‘কে চিরতরে মুছে দিতে ইস্পাতদৃঢ় শপথে কবিকণ্ঠ দৃপ্ত তেজে ঘোষণা করে :
সুরম্য প্রাসাদের সব স্তম্ভ ফেলবো উপড়ে ...
... সুনিশ্চিত করবো লোপাট সৈন্য আর দাসদাসী অধ্যুষিত এই রাজ্যপট।
(স্যামসন)
শামসুরের কাছে জীবনের এক বিশেষ অর্থ আছে। তিনি জানেন সমাজের চারিদিকে শাসনের চোখ উঁকি-ঝুঁকি মারে, গুপ্তচরবৃত্তিতে দেশ ছেয়ে গেছে। শত্রুপক্ষ একটুখানি আদর ভালবাসার সুযোগও দেবে না (‘আমার চুমোর ওপর/ পড়ে দুর্ভিক্ষের ছায়া’- কী যুগে আমরা করি বাস)। অথচ বাঁচতেই হবে তাই নিজে অক্ষম হলেও ‘কর্মিষ্ঠ নকীব’ পাগল ছেলেটার দিকে আশার হাত বাড়ান, তারই চোখে কবি ‘কালের গতি, মার্কস আর লেলিনের প্রসিদ্ধ পাতায়’ লক্ষ্য করতে থাকেন (ছেলেটা পাগল নাকি?)। নাস্তিক কবি সত্তা ঈশ্বরকে ব্যঙ্গ করে সাম্রাজ্যবাদের মুখোস তুলে ধরেন-
সকল প্রশংসা তাঁর করুণা অপার
বুঝি তাই যুগে সোৎসাহে পাঠান
বিশ্বে জনসন আর সালাজার। (সকল প্রশংসা তাঁর)
সমাজবিমুখ স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিদের প্রতি তাঁর শ্লেষ সত্যই মর্মভেদী-
মেষ রে মেষ, তুই আছিস বেশ
... খড়বিচুলি পেলেই পোয়া বারো
জাবর কেটে দিন চলে যায় পশম বাড়–ক আরো। (মেষতন্ত্র)
রাজতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের মুখোস খুলে ধরতে বুঝি তার দোসর পাওয়া ভার- ‘ধন্য রাজা ধন্য দেশ জোড়া তার সৈন্য/ কেবল পোড়া মুখে পোরার দুমুঠো নেই অন্ন/ শোনো সবাই হুকুম নামা/ ধরতে হবে রাজার ধামা। বাঁ দিকে ভাই চলতে মানা/ সাজতে হবে বোবা কানা/ মস্ত রাজা হেলে দুলে/ যখন তখন চড়ান শূলে/ মুখটি খোলার জন্য ধন্য রাজা ধন্য’। (রাজকাহিনী)
কবি নাস্তিক হলেও সত্য সৌন্দর্য প্রেমের অস্তিত্বকে অস্বীকার করেন না। প্রেমের প্রতি তাঁর অটুট আস্থা ‘কেননা শিখিনি ঘৃণা বস্তুত ঘৃণায় নয় জানি/ প্রেমেই মানুষ বাঁচে’ (ঘৃণায় নয়)। এই প্রেমই (ব্যক্তিপ্রেম ও দেশপ্রেম) কবিকে দেখিয়ে দেয় কি করে গাঁয়ের জননী ও ‘সন্তানের রক্তমাখা জামার আহ্বানে ... পুত্রহীন হৃদয়ের দীপ্ত কান্না স্লোগানে স্লোগানে’ গলা মিলিয়ে মিছিলে শামিল হন (মা)। এই প্রেমই কবিকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করে সেই ‘হাতকে যে হাত অন্তরঙ্গতায়/ মোহন সুনীল হয়’; কবি চকিত বিস্ময়ে দেখেন সেই হাতকে ‘বাঁশি... ডাকে/ ডাকে সাত রঙ,/ শোনে সে আহ্বান পাথরের। ... সে হাতের মৃত্যু ভয় নেই (হাত)। তাইতো ভীষণ বুড়িয়ে’ যাওয়া সত্ত্বেও বেলা অবেলায় নিজেদের বেশ জবুথবু মনে হতেই সেই বালকই কবি-সত্তার কাম্য হয় যার ‘খোলা ... চোখে রাজসিক ... ছলনা’ ধরা পড়ে এক নিমিষেই। সে এলেই তাকে ‘বসিয়ে বিকল্প ঘরে হরিদ্রাভ বয়সের দিকে’ কবি যাত্রা করবেন। এ যুগে বাস করে tension কে এড়ানো যায় না। তাই স্বাভাবিকভাবেই শামসুরের tension আছে। কিন্তু সেই tension-এর মধ্যেই তিনি প্রচণ্ড আশাবাদী। তাই তিনি যেমন ‘পিতার শব ... সর্বদা’ বয়ে বেড়াতে রাজি নন ঠিক তেমনই সময় হলে ‘হরিদ্রাভ বয়সের দিকে এগুতে চান, আগন্তুকের জন্য ঘর ছেড়ে দিতে চান। এর মধ্যে এতটুকু বেদনাবোধ নেই তাঁর। সারা জীবন ধরে tension এর মধ্যে থেকে হরিদ্রাভ বয়সে tensionless হওয়াটা কম কথা নয়। tension থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা তাঁর কাব্য জীবনের প্রথম দিকেই লক্ষ্যণীয়। ‘শিখা’ ‘নির্জনদুর্গের গাথা’ ‘কোনো পরিচিতাকে’ ইত্যাদি কবিতায় সব ব্যথা ভুলিয়ে দেয় এমন প্রেমের সন্ধান পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন কবি। অর্থাৎ tension বিহীন হওয়ার অভিজ্ঞতা আজীবনই আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে কবির আশাবাদ যে ক্ষণিক মোহমুক্তির চিত্র নয়, কবির মানসিকতা যে প্রচণ্ডভাবে স্বর্ণময় ভবিষ্যতের ইংগিতবাহী এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে।
প্রত্যেক বিশিষ্ট কবিরই একটি প্রিয় রঙ থাকে। জীবনানন্দ, সমর সেন ইত্যাদির প্রিয় রঙ ধূসর, অমিয় চক্রবর্তীর গৈরিক। শামসুরের প্রিয় রঙ শাদা। অবশ্য ধূসর তাঁর জীবনে ও কাব্যকৃতিতে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে, তবু শাদা তাঁর আসল রং। উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে। ‘শাদা শার্ট’ (এক পাল জেব্রা), ‘রূপালি মাছ’ (হাত), শুভ্র দাঁত (দাঁত), ‘রূপালি শহর’ (দুঃস্বপ্নে একদিন), ‘বৃষ্টির ধবল দাঁত’ (হাত), ‘শ্বেত কাগজের শব্দমালা’ (বিকল্প ঘর). ‘দুধসাদা স্বপ্নের অচেনা গলি পথে’ (রৌদ্রে নিয়ে যাও), ‘মগজকে তুলে ধরি কাঁচা দুধেল জ্যোৎøায়’ (পার্ক থেকে যাওয়া যায়), শান্তির ... পায়রা’ (আকাশের পেটে বোমা মারলেও) ইত্যাদি তাঁর শাদা-প্রিয়তারই নির্ভুল সাক্ষ্য বহন করছে। শাদা রং সেই উজ্জ্বলতারই প্রতীক যে, ‘চোখ অন্ধ করা/ চৈতন্য ধাঁধানো/ উজ্জ্বলতা দেখেন নি মুসাও কখনো’ (পুলিশ রিপোর্ট)। যুগের প্রতীক ধূসর রং তাঁকে স্পর্শ করলেও তিনি এগিয়ে হৃদয়ের শুভ্রতাকেই খুঁজতে চেয়েছেন। কবি প্রথম জীবনের কাব্য সাধনায় নারীর খোলা চুলে ও বাহুতে আবদ্ধ হয়ে পরিতৃপ্ত হতে চাইতেন, তখন তাঁর রং ছিল ধূসর। তখন তিনি খণ্ডিত বেদনাময় প্রেমে পরিতৃপ্তি খুঁজতেন (ধূসর, শূন্যতা ও বেদনার প্রতীক) ধীরে ধীরে বাংলাদেশের স্বাধীকার অর্জনে লিপ্ত হয়ে কবি তাঁর হারানো ব্যক্তিপ্রেমকে মদনভস্মের মতো বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়ে পেলেন নূতনতর প্রেমের সন্ধান যার মূল সুর আশা, যার রং নির্ভুলভাবে শাদা। শাদা এমন একটি রং যাতে কোনো মালিন্য নেই, মলিনতা স্পর্শ করলেই শাদা ভীষণ নোংরা হয়ে যায়। এই শাদা রং কবির ঊষর জীবনে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
সুররিয়ালিস্ট কাব্য আন্দোলনের প্রভাব শামসুরের কবিতাতেও লক্ষ্য করা যায়। ‘একপাল জেব্রা’ (তুলনীয় জীবনানন্দের ‘হরিণ’ ও ‘ঘোড়া’) দুর্দমনীয় যৌবশক্তির প্রতীক। অত্যাচারির অত্যাচার অনাচার সহ্য করতে না পেরে মাঝে মাঝে তারা ‘তুমুল উদ্দামতায মেতে ওঠে।’ ‘ওরা ঘুরে মণিমুক্তো’রূপী বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ ‘ছড়িয়ে ছুটে যায়, ফিরে আসে না আর।’ কবির কবিতায় বিদ্রোহাগ্নির স্ফূলিঙ্গ জ্বালিয়ে অবদমিত যৌন বাসনারূপী এক পাল জেব্রা অবচেতন স্তরে মিলিয়ে যায় আর চেতনার স্তরে ভেসে ওঠে না। তখন ক্ষোভে কবির ‘নিজেরই হাত কামড়ে ধরতে ইচ্ছে হয়।’ ‘সবুজ ফ্ল্যাগ/ ওড়াতে ওড়াতে একটি কবিতার শাঁ শাঁ ট্রেনকে/ অন্তিম স্টেশনে পৌঁছে দিতে না দিতেই’ (অর্থাৎ আত্মকেন্দ্রিক সবুজ কবিতা লেখা শেষ না হতেই) ‘আবার একপাল জেব্রা/তুমুল ছুটোছুটি করে বাতাস চিরে রৌদ্র ফুঁড়ে আমার বুকে আফ্রিকায়’। অর্থাৎ জেব্রারূপী যৌন বিপ্লবী চেতনা বার বার চেতনার (প্রান্তর এখানে চেতনার প্রতীক) দরজায় ঘা দেয় জেগে উঠবার জন্য, অত্যাচার অবিচারকে নির্মূল করার জন্য। ‘বর্ণ নিয়ে’ ‘পুরোটাই দৈবাৎ ঘটনা বৈকি। [সুররিয়ালিস্ট ভাবধারা আকস্মিক ঘটনার (যা প্রায়ই কাল্পনিক) উপর ভিত্তি করেই তো রচিত হয়েছে।] শৈশবে-পড়া ‘অ’-কারের সেই অজগর হঠাৎ তেড়ে ফুঁড়ে এলো। তারপর এলো ‘আ’-কার ফুলবাবুটির মতো। তারপর ভীষণ কা-কা শব্দ করে এলো ‘ক’। এরপর এলো ‘ল’ ক্ষুধার্ত চোখ’ ‘ভিক্ষার পাত্র’ আর ‘ছায়ার মিছিল’ নিয়ে। শৈশবের বিদ্রোহী ও জেদী আজগরিক ভঙ্গী কবির চেতনার স্তরে ভেসে উঠে পুনরায় মগ্নচৈতন্যে লীন হল। যৌবনে কবির মন সবুজ প্রেমের বিলাসে ফুলবাবু হয়ে আজগরিক ভঙ্গী গেল ভুলে। সেই ফুলবাবুত্বের লালিমা মুছে গেল ‘ক’ অক্ষরের কা-কা শব্দের রূঢ়তায় অর্থাৎ দুঃখ দারিদ্র্য হতাশা-ভরা গদ্যময় বাস্তব জীবনে এসে হাজির হল তাই ফুলবাবুত্বের প্রশ্রয়ে আগেকার স্বপ্ন-রঙীন আত্মকেন্দ্রিক কবিতা লেখা সম্ভব নয়। ক্ষুৃধা -ভিক্ষা-মিছিল-কেন্দ্রিক কবিতা বিদ্রোহের রূপ নিয়ে অবচেতন মন থেকে কখনো সখনো চেতনার স্তরে উঁকি ঝুঁকি মারে। ‘তার আগে’ কবিতায় চেতনার স্তরে আকাশ, গাছপালা, গলির মোড়, আত্মীয়ের মৃত মুখ, মেথরাণীর নিতম্ব ইত্যাদি খেলা করে। অবচেতন স্তর থেকে অবদমিত যৌনশক্তি ভেসে ওঠে চেতনার স্তরে। বিপ্লবের পাখি অবচেতন মনকে ঠুকরে খায়, ঝাঁক ঝাঁক লাল পিঁপড়েরূপী বিদ্রোহের স্ফূলিঙ্গে সমস্ত মন অস্থির হয়ে ওঠে। দ্রুতগতি ট্রেন যেমন অকস্মাৎ মধ্যরাতে ঘুম ভাঙিয়ে চমকে দিয়ে চলে যায়, তেমনই এইসব অবদমিত বাসনা কামনার আবির্ভাব এরা হঠাৎ আসে হঠাৎ ডুব মারে। অবশ্য সুররিয়ালিস্ট কবিতায় চেতন স্তর ছাপিয়ে উঠতে হয়। শামসুরের কবিতায় চেতন স্তর সর্বদাই সক্রিয়, তাই আদর্শ সুররিয়ালিস্টিক কবিতা রচনা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।
এবার শামসুরের কবিতার চিত্রধর্মিতার কথা। এককথায় শামসুরের কবিতা ইমপ্রেশনিস্টদের আঁকা চিত্রের ইংগিতবাহী। ইমপ্রেশনিস্টদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল: যে দৃশ্য আঁকা হচ্ছে, তা যেন এক ঝলক দেখে নিয়ে যেমনটি দেখেছেন তেমনটি তাঁরা বসাতে চান। তাই এই ছবিগুলোর খণ্ডাংশের কোনো অর্থ হয় না। সব মিলিয়ে একটা টোটাল ইফেক্ট সৃষ্টি করাই এঁদের উদ্দেশ্য। শামসুরের কবিতার খণ্ডাংশেরও অর্থ হয় না। তাঁর কাব্যের সামগ্রিক আবেদনই বড় কথা। তবে ইমপ্রেশনিস্টদের ছবির কাছ থেকে কিছুই বোঝা যায না, দূরে গেলে তার আদ্যন্ত ধরা পড়ে। এদিক দিয়ে শামসুর ইমপ্রেশনিস্টদের সমগোত্রীয় নন, কেননা তাঁর কবিতা প্রায় ক্ষেত্রেই বুঝতে দূরে যেতে হয় না বা বেশি ভাবতে হয় না। ইমপ্রেশনিস্টদের মত কবির সৃষ্টির পটভূমি খোলা আকাশ, প্রান্তর। যে প্রকৃতি প্রতি মুহূর্তেই বদলাচ্ছে। কবি কত তাড়াতাড়ি তাদের রূপটি ধরেছেন ইমপ্রেশনিস্টদের দ্রুত সোজা টানের মত। ভাষার প্রকরণের সুক্ষ্ম কৌশলের দিকে দৃষ্টি না রেখেই। ইমপ্রেশনিস্টরা সাধারণ বলে কোনো বস্তুই অবহেলা করেন না। শামসুরও সামান্যতম বস্তুকে আদর করে কাব্যে স্থান দিয়েছেন। জুতো, বেঞ্চি, পার্ক, জাল, ট্যাক্সি, টিকিট, পুঁইশাক, পা-পোষ, কই, মহিষ ইত্যাদি শব্দ নির্দ্বিধায় তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে। আঙ্গিকে ধ্রুপদী শিল্পীদের সুস্পষ্ট ও সুশৃঙ্খল শেলীকে ইমপ্রেশনিস্টরা অনুসরণ করেন না। শামসুর প্রথাগত ছন্দবদ্ধ মানেন নি, অতি আধুনিক চলিত শব্দকে দুম করে তৎসম শব্দের পাশে বসিয়েছেন এবং আশ্চর্য, তা মোটেই বেমানান শোনায় নি।
শামসুরের এ্যালিউশান সত্যই সুন্দর। হিন্দু মুসলিম ও গ্রীক পুরাণ থেকে প্রচুর উদ্ধৃতি আছে তাঁর কাব্যে। নাচিকেত চৈতন্য, অতুন স্মৃতি, কুশীলব, বুররাখ, ফেরেস্তা, মোহম্মদ, মুসা, স্যামসন, ইত্যাদির প্রয়োগ অত্যন্ত সুন্দর। আধুনিক যুগের বিশিষ্ট প্রতিভার নাম তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন। এলগ্রেকো, রঁদা, কাণ্ডিনস্কি, পিকাসো, মাতিস, রাসেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিষ্ণু দে সকলেই বিশেষ সম্মানের স্থান পেয়েছেন। তাঁর চিত্রকল্প ও উপমা সত্যই অনবদ্য। যথা ‘গলিত কাঁচের মতো জল’ (বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা), ‘রাজপথ নিদাঘের বেশ্যালয়’ (হরতাল)। ‘স্তব্ধতা সঙ্গীন হয়ে বুকে/ গেঁথে যায়’ (ঐ), ক্লান্তির কফিন ঢাকা শরীর’ (ধানী), সৌরভের মদে চুর (কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম), করি পান আকণ্ঠ আরক শ্রাবণের’ (পার্ক থেকে পাওয়া), বিপুল স্তব্ধতার/ স্তন্য পান করে শব্দ বেড়ে ওঠে লীলায়িত স্বাস্থ্য’ (বিকল্প ঘর), একদা কবিতা তার স্তনের গোলাপ কুঁড়ি চেয়েছিল দিতে’ (কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি), ‘লুকানো গুহার দিকে যাত্রার কালে মোহাম্মদ যে স্তব্ধতা আস্তিনের ভাঁজ/ একদা নিয়েছিলেন ভরে’ (হরতাল), ‘চোখ অন্ধ করা/চৈতন্য ধাঁধানো/ উজ্জ্বলতা দেখেন নি মুসাও কখনো’ (পুলিশ রিপোর্ট) ইত্যাদি। কিছু বাক্য তো প্রবাদ প্রবচনে পরিণত হবার দাবী নিয়ে এসেছে।
`Every revolution in poetry is apt to be, and sometimes to announce itself as return to common speech’ (The Music of Poetry’ : T. S. Eliot)- এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝ যাবে আধুনিক কবিতায় চলিত ভাষার গুরুত্ব কতখানি। শামসুর কবিতায় চলিত ভাষা যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করেছেন এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তিনি সার্থক হয়েছেন। গদ্যাত্মক ভঙ্গিতে তাঁর কবিতা লেখার রীতি সুধীন্দ্রনাথের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাঁর চলিত ভাষার অপরূপ নমুনা, ‘কাগজের ঝাঁক যেন একতাড়া নোট ফুরফুরে’ (যিনি নম্বর ভালবাসতেন)। ‘ভীষণ কুঁড়িযে গেছি ... জবুথবু লাগে’ (একটি বালকের জন্য প্রার্থনা), ‘প্রকৃতির/ খোলামেলা দরবারে আয়ুর মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাকুল তদ্বির নিয়ে যাই’ (উক্তিটি সুধীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গদ্যভঙ্গির কথা মনে করিয়ে দেয়)। ‘ইনি কবি মনে/ করেন শব্দের ধনে প্রচুর পোদ্দারি’ (কোনো কোনো কবিতার শিরোনাম), ট্রাউজারে কানে দখিন হাওয়ার গুলতানি পুরে, পাখিদের গান/ শার্টের আস্তিনে গুঁজে’ (পার্ক থেকে যাওয়া যায়), ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাচ্ছি’ (দুঃস্বপ্নে একদিন), মালিশের ঝাঁ ঝাঁ গন্ধ এলো ভেসে ... উজিয়ে অনেক ঘর’ (মাতামহর মৃত্যু) ইত্যাদি।
পরিশেষে শামসুরের কিছু দুর্বলতার কথা। তাঁর কবিতার সব থেকে বড় দোষ প্রচারধর্মিতা। কোথাও কোথাও বড়s tatement-ধর্মী হয়ে পড়েছেন তিনি (ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯, ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা, হরতাল, অজস্র মাইক্রোফোন, পার্ক থেকে পার্কে যায় ইত্যাদি)। বিপ্লবাত্মক কবিতা বেশ কিছুটা statement-নির্ভর হয়, কিন্তু কবি নেপথ্যে না থেকে যদি সামনে এসে পড়েন, তবে ক্লাসিক কবিতার সৃষ্টি হয় না। ক্লাসিস্ট রূপেরই সাধনা করেন। রোম্যান্টিসিস্টের সাধনা তো প্রকাশের। শামসুরের কবিসত্তা অনেক সময় প্রচার বা বাণীর সাহায্যে পাঠকমন জয়ের একটা প্রয়াস তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এটা ত্যাগ করতে না পারলে তাঁর কবিতা নিছক document- হিসেবে গণ্য হবে, ধ্রুপদী সাহিত্য হিসেবে নয়। ছন্দের মিল বা শব্দ নির্বাচন কোথাও কোথাও দৃষ্টিকটু। জেদী ঘোড়া কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে ‘এই’ ও ‘নেই’র অন্ত্যমিল হাস্যকর। দাঁত কবিতায় ‘চামড়া’র সঙ্গে অন্ত্যমিল ঘটানোর জন্য ‘আমরা’ নেহাৎই বাহুল্যমাত্র। ‘রাষ্ট্র’ কথাটির সঙ্গে স্ট্র’ জোর করে মেলানো (হৃদয়ের গল্প)। ‘দঙ্গলে’র সঙ্গে ‘জঙ্গলে’র মিলও কষ্টার্জিত (ঐ)। কথ্যভাষা প্রয়োগের নিপুণ শিল্পী হলেও কোথাও কোথাও তাঁর শব্দ নির্বাচন সুপ্রযুক্ত নয়। নূতন শব্দ বসিয়ে চমকে দেবার ঝোঁক আছে তাঁর। নিদ্রার গহন থেকে পাতার টেরেসে’ (প্রকারভেদ) এই বাক্যটিতে ‘টেরেস’ কথাটি শুনলে ভাল লাগছে না (পংক্তিটি কি পাণ্ডিত্য-গন্ধী হয়ে যায় নি?)। ‘বাগ্মিতা নামের/ দজ্জাল মেয়ে’ (কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি) পংক্তিটির চিত্রকল্পটি অবশ্যই সুন্দর কিন্তু বাগ্মিতার সঙ্গে যেন দজ্জাল কথাটি খাপ খায় না। দুপুরের লাল এজলাসে দুলে জারুলের শাখা/ করেছিল জজিয়তি খুব (কতবার ভাবি)। কথ্যভাষায় এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে কোথাও কোথাও কবি বড় বেশি গদ্যগন্ধী করে ফেলেছেন। ‘আকাশের পেটে বোমা মারলেও ছাই এক বাচ্চা/ বিদ্যেবুদ্ধি বেরোবে না’, ‘ হাঁড়ি ঠেলে ঠেলে দ্রুত জননী হচ্ছেন ফৌত’, ‘আকাশের দিকে চেয়ে থাকি ফ্যালফ্যাল’ পংক্তি অবশ্যই কাব্যের উপযোগী নয়।
শম্ভু মিত্র : বাঙলার অন্যতম প্রধান নাট্যজন
[এই নিবন্ধটি বিষয়ে মীজানুর রহমানের প্রাপ্তি স্বীকার - এই নিবন্ধটির (বই পত্রিকা, ১১ বর্ষ/৯-১০ সংখ্যা, ১৩৮২) সংগ্রাহক স্নেহভাজন মুহম্মদ আরিফ। প্রথম প্রকাশ- উত্তরসুরী, ২২বর্ষ ১ম সংখ্যা, ১৩৮১ সংখ্যায়]