Full premium theme for CMS
নাটকের মানুষ : আমাদের অসিত কুমার সাহা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
ছোটোবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ-টার্মিনাল আমার কাছে অনেক প্রিয় জায়গা। বাবা-মার সাথে নানুবাড়ি যাওয়ার সময় নারায়ণগঞ্জ টার্মিনালে এসে প্রথমেই ইটের ফাঁক দিয়ে দেখে নিতাম টার্মিনালে বাঁধা লঞ্চগুলিকে। দেখার পর নিশ্চিত হতাম নানুবাড়ি যাচ্ছি।
অনেক বছর পর আবার নারায়ণগঞ্জের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠল অহরকণ্ডল নাটকের রিহার্সেলে এসে। অসিতদার সাথে নাটকের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতায় আপন হয়ে উঠলাম একে অপরের কাছে। অহরকণ্ডলের ঘোর লেগে গেল সবার চিন্তায়। সবাই মিলে ভারতের বহরমপুর শো করে এলাম। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাটমণ্ডল’-এ শো এর শেষে অসিতদা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আপনাকে যখন বেহালার মিউজিকটা দিয়েছি তখন কিছুটা উপরে ছিল কিন্তু আপনি অভিনয়ের সাথে এত সুন্দর করে মিলিয়ে নিয়েছেন।
আমার খুব ভালো লেগেছে। আমি খুবই খুশি হলাম। এমন করে, এত ভালোবাসা দিয়ে কেউ তো বলে না। আমিও অসিতদাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, আজ শো করে আমিও অনেক আনন্দ পেয়েছি।
আমরা তো আমাদের কাছের মানুষদের সম্মান করতে দেখি না। অসিতদার কাছে শিখেছি কীভাবে অন্যকে সম্মান করতে হয়। দেখেছি কত ভালোবাসা দিয়ে সুন্দর করে গুছিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে হয়।
নাটকের প্রতিটি শাখায় ছিল তার সরব উপস্থিতি। নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে শুরু করে নির্দেশনা, সেট, লাইট, সংগীত এমনকি সেট লাগানোর পর দুপুরে ছেলে-মেয়েরা কী খাবে না-খাবে, সেই বিষয়টিও আগে থেকেই ঠিক করে রাখতেন।
নবমী-রাতে মন্দিরে সারারাত আড্ডায়, গানে কাটিয়েছি অনেক সুন্দর সময়। ভোরবেলা শিউলি ফুল কুড়িয়ে ‘বোস কেবিন’-এ নাস্তা করে বাসায় ফিরেছি। অসিত কুমার সাহা আর ভবানী শংকর রায় এই দুই বন্ধুর মধ্যে মিষ্টি একটি বিতর্ক ছিল। পদবির দিক দিয়ে ‘সাহা’ বড়ো না কি ‘রায়’ বড়ো? তাদের বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথনে সমৃদ্ধ হয়েছি বহুবার।
অসিতদার বাসায় রাতের আড্ডায় একদিন ড্রপআউট নাটকের ভাবনাটি শেয়ার করি। আমাকে তার দলে অর্থাৎ ‘ঐকিক থিয়েটার’-এ নাটকটি নির্দেশনা দেয়ার অনুরোধ করেন। আমি দলের সাথে কাজ শুরু করি। অসিতদার সাথে কাজ করে নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছি বারবার।
ড্রপআউট নাটক করতে গিয়ে আমি যেমন প্রতিনিয়ত নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, আবার হারিয়েও ফেলেছি। তেমনি করে টের পেলাম অসিতদাও কী যেন খুঁজছেন। হয়তবা কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছেন। আমার অনুমান সত্য হোল। শো এর আগে দুইদিনের জন্য সোনারগাঁও-এ একটি এনজিও-র ডরমেটরিতে পুরো টিম আস্তানা গাড়লাম। যাওয়ার আগেরদিন অসিতদা আমাকে বললেন, আজ রাতে আপনি আমার সাথে থাকবেন। কাজ আছে। একটু হেসে বললেন, জানি দলের ছেলেদের সাথে থাকতে আপনার ভালো লাগবে। কিন্তু আজ আমার সাথে থাকবেন। কারণ জানতে চাইলাম। বললেন, আমি কিছুতেই সুরটা ধরতে পারছি না। আপনি পুরো স্ক্রিপ্টটা পাঠ করবেন, আমি রেকর্ড করব। অডিওটা পরে আমি শুনব। সারারাত কাজ করে সবাই মিলে সকালে চলে গেলাম সোনারগাঁও। এই দুইদিন অসিতদা উপোষ থাকলেন, শুধু ফল খেলেন। পরেরদিন বিকেলের দিকে অসিতদা আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে শোনালেন ড্রপআউট নাটকের মিউজিকের প্রথম অংশ।
আমি দেখেছি সংগীতের একজন গুণী মানুষ কীভাবে রাত-দিন একাকার করে দিচ্ছেন। মননে চিন্তায় শুধু একটাই ভাবনা, কীভাবে কাঙ্ক্ষিত সুরটি খুঁজে পাবেন। কাজ নিয়ে এমন মগ্নতা, এমন ভালোবাসা আমার চারপাশে আমি খুব একটা দেখি নি। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় শিহরিত হয়েছি বারবার।
অসিতদার হাত ধরেই নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছি। চিনেছি বোস কেবিন, চাষাড়া মোড়, শহীদ মিনার, চুনকা পাঠাগার, মাউরা হোটেল, সুগন্ধা বেকারি, কালির বাজার, প্রেসক্লাব-সহ আরও অনেক জায়গা।
নারায়ণগঞ্জের এইসব জায়গায় পদচারণার সময় আমার সবসময় মনে পড়বে অসিতদার কথা। অনেক কিছু শিখেছি অসিতদার কাছ থেকে। তার থেকে একটি বিষয় আমি সারাজীবন আঁকড়ে ধরতে চাই, সেটা হলো, নিমগ্ন হওয়া, ডুব দেওয়া। এই একটি গুণ আমার মধ্যে ধারণ করতে পারলেই আমি বিশ্বাস করি অসিতদার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে।
ভালো থাকুন নাটকের মানুষ অসিত কুমার সাহা। আপনাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
৩/০৯/২০২৩
আনোয়ারুল হক ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা। সংগঠক, উদীচী