Full premium theme for CMS
অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য : মোহাম্মদ জাকারিয়া-নাজমা আনোয়ার-হুমায়ূন ফরীদি-খালেদ খান
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বলা হয়, অভিনয় নাকি মানুষের সহজাত এক বৃত্তি। তাই কি কৈশোরে আমরা অভিনয়-অভিনয় খেলি? নিজে যা নই, হই নি, চারপাশে এমন যাদের দেখি তেমন-তেমন হয়ে খেলি- শিক্ষক, ডাক্তার, মা-বাবা। আমাদের জিন-কোডে নাকি বহু হবার এক প্রবণতা, বাসনা থাকে। জন্মের পর যেমন-যেমন পরিবেশ-পরিস্থিতির কনডিশনে পড়ি- সেইমতো হয়ে উঠি আমরা একেকরকম। তবে ভেতরে নাকি যা কিছু হই নি তেমন হবার বাসনা সুপ্ত থাকে। বড়ো হয়ে অভিনয়কলায়, সেই বহু হবার বৃত্তিরই প্রকাশ হয়, তাতেই নাকি আনন্দ- অভিনেতৃ, দর্শকের।
নানা চরিত্রে অভিনয় করে বা দেখেই নাকি নিজের নানান সত্তা-স্বভাব পাই। নিজেকে নানারূপে পাওয়া, হওয়া, আর তা প্রকাশের আনন্দ অভিনয়ে পাই। অথচ অভিনয় করতে গিয়ে তো বলা হয়- নিজেকে, নিজের স্বভাব ভুলে বিশেষ কোনো একটা চরিত্র হয়ে ওঠা চাই। কল্পনায় তেমন চেনা চরিত্রের অনুকরণে, অনুসরণে অভিনয় করে নাটকের চরিত্রটা প্রকাশ করতে হয়। তা না করতে পেরে, যদি নিজের স্বভাব মতো অভিনয় করি, তাইলে নিন্দা করে বলা হয়- অভিনয় না করে বিহেভিং করছে। নিজেকে ভুলে কল্পনায় নাটকের চরিত্র হয়ে ওঠাই চরিত্রানুগ অভিনয়- ক্যারেক্টর অ্যাকটিং। তবে আরেকরকম অভিনয়ের কথাও বলা হয়- ব্যক্তিসত্তানুগ অভিনয়ÑPersonality acting. এটা নাকি বড়ো অভিনেতৃর সাধ্য।
তবু যদি ভেবে দেখি- নিজেকে বাদ দিয়ে আর-কেউ কি হতে পারি আমরা? তেমন চরিত্রানুগ হয়ে বাইরে থেকে কারো মুদ্রা হয়ত অনুকরণ করতে পারি, যেমন আমরা বাস্তবে নানাজনকে নিয়ে করে থাকি। তবে সেটা করে কি সত্যিকার কোনো প্রকাশ হয়, যাতে অভিনেতৃ বা দর্শক কোনো শিল্পের আনন্দ পায়? শিল্প মানেই নাকি কোনো এক মাধ্যমে নিজেকেই প্রকাশ। তাতেই নাকি মেলে নান্দনিক আনন্দ।
আরেক কথা- বাস্তব জীবনে আমরা ছোটবেলা থেকেই তো অভিনয় করে চলি- নিজেকে লুকিয়ে অন্যের মন বা মত মতো চলা-বলা, যাকে আমরা অভিনয় বা মিথ্যা মনে করি, তা সত্য নয় বলে। আর তা কেউ করলেই আমরা বলে থাকি- নাটক করিস না, অভিনয় ছাড়, সত্যিটা বল। তাহলে জীবনের এই বাধ্যতার অভিনয়, যা আমরা সবাই করে থাকি, তা সত্যি নয় মিথ্যা মনে করেই করি- সেটা নাটকে মঞ্চে করলে কেন তবে আনন্দ পাই? নিজের বদলে অন্য চরিত্র হওয়াই তো অভিনয়, সেটাই তো করতে বলা হয়। তাহলে- জীবনের নিন্দিত-মিথ্যা মঞ্চে প্রশংসিত সত্য হয়ে ওঠে কী করে? বলা যায় হয়ত- জীবনে বাধ্য হয়ে যে মিথ্যা অভিনয়, আর মঞ্চে নিজের ইচ্ছায় যা করা হয় তা আর জীবনের অভিনয়ের মতো মিথ্যা থাকে না, সত্য হয়ে ওঠে, উঠতে পারে।
কী সেই শিল্পের জাদু তাহলে? তবে মঞ্চে কি নিজেকে পুরো ভুলে আর-কেউ হয়ে উঠতে সত্যিই পারি? নিজেকে বাদ দিয়ে? নাকি অজান্তে আমাদের ভেতরের বহু আমিরই একটা কোনো অপ্রকাশ্য রূপেরই প্রকাশ ঘটে, বিশেষ কোনো চরিত্র হয়ে উঠতে গিয়ে নিজেরই বিশেষ কোনো আরেক সত্তা বা চরিত্রই কেবল প্রকাশ পায়, পেতে পারে? তাই কি আমরা বড়ো অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ে অভিনেয় চরিত্রের মাধ্যমে অভিনেতৃর ব্যক্তিসত্তার প্রকাশও চিনতে পারি। তাতে করে সেই অভিনয়ে অভিনেতৃর ব্যক্তিত্ব চিনতে পাই- বড়ো অভিনেতৃকে সেভাবেই আমরা সনাক্ত করি, কেবল নাটকের চরিত্রকে নয়। অভিনয়ে এভাবে আমরা ব্যক্তি-অভিনেতৃর আত্মস্বরূপ চিনে নেই, তার তারিফ করি। বড়ো অভিনেতৃর বেলাই সেটা ঘটে, যখন তার অভিনয়ে নাটকের চরিত্রটা ছাপিয়ে সেই ব্যক্তিরও প্রকাশ দেখি। তার অভিনয় আর-সবার থেকে আলাদা হয় তার ব্যক্তিসত্তারই পরিচয়ে। এভাবেই তিনি নাম-পরিচয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এটা তার কেবল কতক মুদ্রাদোষ বা অভিনয়ের রীতিধরনের কারণেই ঘটে না, তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশগুণে সম্ভব হয়ে ওঠে। নাটকে কোনো বড়ো অভিনেতৃর ব্যক্তিসত্তার সম্প্রকাশ এভাবে ঘটে- এটাই হয়ে ওঠে তার অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য।
অভিনয় করে বা দেখে আমরা ঠিক কী পাই, কেমন কী হয়ে উঠি একবার যদি নিজের অভিজ্ঞতায় ভেবে দেখি।
মোহাম্মদ জাকারিয়া পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। ভারতবর্ষের প্রথম নাট্যদল ‘বহুরূপী’র প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। অভিনয়ে হাতেখড়ি তাঁর মহানট শম্ভু মিত্র’র কাছে। বলা হয়, নাগরিকমঞ্চে যিনি বাংলা ও রবীন্দ্রবাচনের প্রয়োগকার। বিচিত্রবীর্য লেখনে আবহমান বাংলাবাচনের এক নাগরিক-আবিষ্কর্তা তো রবীন্দ্রনাথ। যাতে করে বাংলা ভাষা ও বাকস্পন্দের একটা যোগসূত্র মেলে- গ্রামবাংলা ও নাগরিক বিভাজন পেরিয়ে। মহাকবির সেই তো মুখ্য কৃতিকর্ম- ভাষাসূত্রে স্বভাষা ও স্বজাতের মেলবন্ধন রচনা। সকল বড়ো কবির সেই তো মহাদায়, করণীয়।
বাংলামঞ্চে ছদ্ম ঐতিহাসিকতা ও মধ্যবিত্ত-নাগরিকের এক খর্ব, ছন্নছাড়া নাগরিক-বুলির মেলোড্রামা চলছিল। সেখানে ‘বহুরূপী’ আর শম্ভু মিত্র বাংলা বাচনের সুর ও ছন্দটা আয়ত্ত ও প্রয়োগ করেছেন। সেটা মধ্যবিত্ত-বুলি থেকে ভিন্ন- যে ভাষায় আমরা কথা কইতে পারি না, অথচ যা আমাদের অন্তরের গভীরতর ভাব-অনুভব প্রকাশ করতে চায়- রাবীন্দ্রিক সেই এষণা রপ্ত করা কোনো চলতি আধুনিক ফ্যাশনে তো লভ্য নয়, তার জন্য মনের সহজ, অনর্গল প্রকাশের দীর্ঘ অনুশীলন চাই। বহুরূপী তা অর্জন করে চার অধ্যায় থেকে রক্তকরবীতে উত্তীর্ণ হয়ে। সেটা নাগরিক দৈনন্দিন স্মার্ট ফ্যাশনদুরস্ত, পরস্পর প্রতিযোগিতার অমানবিক হাতিয়ার নয়; মানব স্বভাব ও সম্পর্কের এক যোগ-মিলনের সম্বন্ধবাচন, বাঙালি মানসের যৌথ অবচেতনে বাঙ্ময়।
মোহাম্মদ জাকারিয়া সেই বহুরূপী ও শম্ভু মিত্রকৃত রাবীন্দ্রিক শীলিত বাচনে সবার থেকে কেমন বিশিষ্ট মহিমায় উপস্থিত হতেন। সুবচন নির্বাসন নাটকে পিতা-চরিত্রটা তার প্রাচীন যাথার্থ্য অর্জন করত। সামাজিক পিতৃপুরুষের এক আর্কেটাইপ হয়ে উঠত। দর্শকের কাছে সেটাই হয়ত লাগত বাস্তবের অধিক বাস্তব। তার সঙ্গে অভিনেতা ও দর্শকের এক মানবসম্পর্ক গড়ে উঠত। বাংলা নাট্যের এক শিখরউত্তীর্ণ অভিনয়রীতি ও বাচন বাংলাদেশের নাগরিকমঞ্চে এক যোগসূত্রধারার সন্নিপাত ঘটায়। তার সঙ্গে যুক্ততায় এবং তা থেকে বিশিষ্ট আত্মবাচন অর্জন করতে হয়েছে পরবর্তী অভিনেতৃকুলকে- এটা বাংলাদেশের থিয়েটারের একটা বড়ো সম্ভাবনাভিত্তি তৈরি করেছে। অভিনয়ের বাইরেও তাঁর ব্যক্তিস্বভাব নাট্যমঞ্চের সঙ্গে সম্পর্কের এক মানবিক-পাটাতন তৈরি করে। নাগরিক ক্ষমতা-সম্পর্কের বিমানবিকতার বিপরীতে তা নান্দনিক, মানবিক হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ জাকারিয়াকে ‘দাদা’ বলেই সম্বোধন করত সর্বদলীয় নাট্যজন। খানিকটা বুঝি রাবীন্দ্রিক দাদাঠাকুরের মতো। সামাজিক মানবসম্পর্কের এক মুক্তি তাতে মিলত, উচ্চ-নিচ ভেদাভেদ উত্তীর্ণ হয়ে। টেলিভিশনে অভিনীত রক্তকরবী নাট্যে তাঁর নঙর্থক-চরিত্রাভিনয়ে- চতুর, ধর্মব্যবসায়ীর রূপারোপও একটা অর্কেটাইপ হয়ে ওঠে। এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন নাগরিক অভিনয়ধারায় প্রাচীন-নবীন-চিরকালীনের এক যোগসূত্রধর।
নাজমা আনোয়ার ষাটের দশকে ঢাকার প্রথম গ্রুপ ‘ড্রামা সার্কেল’-এ অভিনয় করতেন। পাকিস্তানের উপনিবেশে একজন নারীর পক্ষে সেটাই তো হয়ে ওঠে তাঁর ব্যক্তিসত্তার বিশিষ্ট পরিচয়। বাংলাদেশে ‘আরণ্যক নাট্যদল’-এ তাঁর অভিনয়ে গ্রামীণ নারীর দার্ঢ্য, তার পেশল সুষমা আলাদা করে চোখে পড়ে। নাগরিক সৌখিন-মধ্যবিত্ত নারী তো জড়তায় সাধারণত আড়ষ্ট থাকে, বাইরের সাজগোজ পোশাক-আশাক-মেকআপ-ফ্যাশনে যতই চৌকস হয়ে উঠতে চাক না কেন, স্বাভাবিক স্ফূর্তি ঠিক ঘটে না ব্যক্তিস্বরূপের। আর, তাকে যখন অচেনা-অজানা দূর গ্রামের কোনো সাধারণ, নিরক্ষর গরীব চরিত্রে অভিনয় করতে হয়, তখন তো এক ক্যারিকেচারই দেখতে পাই। প্রচলিত কিছু প্রথাগত শারীরভঙ্গির বা বুলির ঢঙঢাঙ মুদ্রায় বানানো, মিথ্যা এক অশ্রদ্ধেয় গ্রাম্যতার অনুকরণে কৌতুকরঙ্গ তৈরি হয়। তাতে আমাদের স্বচ্ছল, শিক্ষিতের শ্রেণিপরিচয় কেবল দগদগে হয়ে ওঠে। আমরা স্বশ্রেণির এই আরোপিত অভিনয় অভ্যস্ত সহানুভূতিতে মেনে নেই- আমাদের কল্পনায় গ্রাম্য নারীর একই পরিচয় যে।
নাজমা আনোয়ার মঞ্চে সেখানে আমাদের চেনাজানা টাইপ ভেঙে দেন- আবহমান গ্রামবাংলার কবেকার এক বঙ্গনারী তার সম্পূর্ণাঙ্গ স্বভাব-সত্তার দাপটে উঠে আসে। আমাদের কমদেখা, স্মৃতির অবচেতন থেকে বুঝিবা। নাগরিক সৌখিন, বিলাসী রুচি তাতে কখনো হয়ত আহত হয়, ঠিক নিতে পারি না সেই মুক্ত ক্রোধ আর সুস্থ ঘৃণা- প্রেম-অপ্রেমের রক্তমাংসময় জীবন্ত প্রকৃতিসত্তা।
তখন আমাদের নাজমা আনোয়ারের ব্যক্তি-স্বভাব ও তার পটভূমি মনে করতে হয়। তাঁর গড়ন ও বাচনে এক প্রাবল্য ছিল, যা ঠিক নাগরিক পরিচিত নারী-কোমলাঙ্গীর পেলব লবঙ্গলতিকা সদৃশ নয়। তাতেই মঞ্চে তাঁকে বিশিষ্ট লাগে, নারীপুরুষের অর্ধনারীশ্বর অন্তরঙ্গতায়। নাজুক, ল্যাকপেকে ন্যাকা নারীর পুরুষ-ধরা কামবিস্তারের বিপরীতে।
আরণ্যক-এর ইবলিশ নাটকে ‘আতসী’ হয়ে উঠতে যেন তাঁকে তেমন বেগ পেতে হতো না, অচেনা কোনো গ্রাম্যনারী সাজতে হতো না কতক মুদ্রাদোষের অভিনয়ে। জনসমাজ থেকে উঠে আসা সম্পর্কিত এক মানুষ ছিলেন যেন তিনি। তিনি আজন্ম নগরবাসী হয়েও স্বামীর সূত্রে কবি ও বামরাজনীতি-সংলগ্ন ভাবুকতায় অর্জেছিলেন গ্রাম-নগরের ভেদউত্তীর্ণ মানবস্বভাব এক। গ্রামসমাজ ও মানুষজন দূরের অপরিচিত কেউ ছিলেন না তাঁর। শিক্ষিত, শহুরে নারীসুলভ ভড়ংয়ে অভ্যস্ত হতে হয় নি তাঁকে। তাই বুঝি, ‘উড়নচণ্ডী’ মেয়ে নিশাতের বন্ধুদের সাথেও নির্বাধ মেলামেশায় বাধত না তাঁর। ব্যক্তিস্বভাব ও সম্পর্কের এই ধরনেই তাঁর অভিনয়ের রীতি-চরিত্র গড়ে ওঠে- সহজ অঙ্গাঙ্গিকতায়, তাতে দর্শকও জড়তা-আড়ষ্টতা থেকে মুক্তির আস্বাদ পেত- অভিনয়ের যা কি না চূড়ান্ত অন্বিষ্ট।
হুমায়ূন ফরীদিকে দর্শক প্রথম দেখে ‘ঢাকা থিয়েটার’-এর শকুন্তলা নাটকের একটা চরিত্রে। সেখানে সবাই তাঁর বিশিষ্টতা সনাক্ত করে। পুরাণকাহিনির নবরূপান্তরিত নাটকটার ভাষাও সাধারণ কথ্যবুলি নয়, আখ্যানের মেজাজ অনুযায়ী নবীন-বাচন। সেটাকে কথ্য বাকস্পন্দে প্রয়োগ করা সহজসাধ্য নয়, অভিনেতৃগণকে তা আয়ত্ত করতে নিশ্চয় কম মেহনত করতে হয় নি। এহেন বাচন হুমায়ূন ফরীদি রঙ্গব্যঙ্গাতুর মোক্ষম স্বরবাচনে পরিণত করেন শারীরভঙ্গির অঙ্গাঙ্গিকতায়। এতেই তাঁর সামর্থ্য তারিফ পায়। ফরীদির স্বভাবানুগ স্ফূর্তি তাঁর নানা চরিত্রাভিনয়ে অমোঘ হয়ে ওঠে। নাগরিক-অভিনয়কে স্বাধীনতা-পূর্ব অনিয়মিত অভিনয় কী পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটারের নবরূপায়ণেও, অভিনেতৃর ব্যক্তিসত্তা প্রকাশের যোগ্য হতে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও অনুশীলনসাধ্য হয়। অভিনয়ে চরিত্রানুগ হওয়ার বিভ্রান্তিতে ঘুরপাক থেকে সহজ কোনো সমাধানসূত্র অনায়ত্ত ছিল। নির্দেশকের প্রতিবাক্য ধরে দেখিয়ে দেয়া আর অভিনেতৃর অন্ধ অনুকরণ-রীতি তাতে বাদ সাধত।
অবশ্য ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসুর আন্তঃহল নাট্য-প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের নবনাট্য নির্মাণ ও অভিনয়ের মুক্তধারা খুলে দেয়। পেশাদার, প্রথাগত ধারায় নাট্যকার-নির্দেশকের বদলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীবৃন্দ প্রাচীন নিগড় থেকে একটা মুক্তির আহ্লাদ পায় স্বাধীনতার যথা-চেতাবনিতে। এই নাট্যোৎসবে আমরা টাটকা কতক নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃর উজ্জ্বল অভ্যুদয় দেখতে পাই। সেলিম আল দীন, হাবিবুল হাসান, আল-মনসুর নাট্যরচনায়; নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু নির্দেশনায় এবং আল-মনসুর অভিনেতা হিসেবে নাট্যের নবীন ধারাপাত করেন। তার আঁচ টেলিভিশনেও পড়ে- আল-মনসুর, মিতা চৌধুরী সেখানে অভিনয়ের নতুন ধারা নির্মাণ করেন। মঞ্চে ফেরদৌসী মজুমদার, আবদুল্লাহ আল-মামুন, আবুল হায়াত, আলী যাকের, আতাউর রহমান পূর্ববর্তী চরিত্রানুগ অভিনয়ের আড়ষ্টতা কাটিয়ে ব্যক্তিস্বভাবানুগ অভিনয় প্রবর্তন করেন। সেই প্রণোদনায় অভিনেতৃকুল বিচিত্র অভিনব স্ফূর্তি পায়।
গত শতকের ষাটের দশকে কিশোরবেলায় মাদারীপুরে থাকাকালীন প্রচলিত সৌখিন মঞ্চনাটকে ফরীদির অভিনয়ে হাতেখড়ি। তারপর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে দলবেঁধে গোটা দুই যাত্রাপালায়ও অভিনয় করেন। দেশের কিংকর্তব্যবিমূঢ় দশার বিদিশায় বছর পাঁচেক পড়াশুনায় বিরতির পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় অভিনয় করেন। বিচারকদের একজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু তাঁকে প্রস্তাব দেন ‘ঢাকা থিয়েটার’-এ আসতে, ভালো লাগলে যোগ দিতে। দলটা তখনই বিশিষ্ট নাট্যভাবনা-রীতি ও অভিনয়ে। রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আফজাল হোসেন, শিমূল ইউসুফ, সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে সেখানে শকুন্তলা নাটকের নবভাষ্যে স্বর্গীয় দূত ‘তক্ষক’ হয়ে দর্শকের চোখে পড়েন ফরীদি। শুরু হয় অভিনয়ে হুমায়ূন ফরীদির ব্যক্তিসত্তার সম্প্রকাশ যাত্রা। কোনো প্রথাগত, প্রচলিত মঞ্চাভিনয় মুদ্রায় নয়। অভিনয়ে ব্যক্তিই যে নাট্যচরিত্রে প্রতিফলিত হন- দর্শক সেটা অজান্তে ধরে ফেলে। ফরীদির স্বভাবস্ফূর্তি, ঢাকাইয়া নাগরিক-অভিনেতার অভ্যস্ত ছাঁচ ভেঙে ফেলে। তাঁর চরিত্রের নিজস্ব বাচনে যা লাগসই হয়ে ওঠে, নায়কোচিত শারীরিক তারকাসুলভ কোনো অভিব্যক্তি-মুদ্রার ধার না ধরে, ছদ্ম কোনো ঘেরাটোপে নিজেকে দক্ষ না করে তার বিচিত্র চরিত্রের অভিনয় নিজেরই ব্যক্তিস্বরূপের একেক রসায়নে। কিত্তনখোলা নাট্যে যাত্রাপালার উদাস প্রেমিক ‘ছায়ারঞ্জন’, নাগরিক-পরিচিত-ধরনের বাইরে ফরীদির স্বভাবের আনকোরা অভিনয়ে- নিজেরই চাপাপড়া, চাপাদেয়া প্রবল প্রেমিকটাকে, নিজেকেই কোথাও যেন ফিরে পাওয়া- বাঙালি-বাঙালের বা মফস্বলী-নাগরিক ভেদোত্তীর্ণ খুশিতে। কেরামতমঙ্গল নাটকে দিশাহারা পরিব্রাজক তরুণ-যুবাটি ফরীদির ব্যক্তিগত চরিত্রে মিলে গিয়ে আশির দশকের অস্থির তালগোল-পাকানো অষ্টাবক্র যুবজনের আর্কেটাইপ হয়ে উঠত। নাটকে কেরামতের দেশজোড়া বহু মানুষ-চরিত্র ও সমাজে ছটফট করে ফেরা- ‘কী যাতনায় মরিছে নিষ্ফল পাথরে মাথা ঠুকে’। নাট্য-অভিনয় তখন হয়ে ওঠে যেন দেশ-কাল-সমাজের প্রতীকনন্দন। হুমায়ূন ফরীদি এই অভিনয়ে হয়ে ওঠেন মঞ্চের বাংলাদেশি ট্র্যাজিক নায়ক-বিশেষ- ‘যৌবনরে, তোর শিয়রে দংশায় নিঠুর কাল ভূজঙ্গ রে’।
বাংলাদেশের চির অকালযাত্রায় মঞ্চের বালকবীর হয়ে ওঠেন যেন তিনি। স্বদেশের বাস্তবে তার পতন-বন্ধুর-অভ্যুদয়ে সিসিফাস-তুল্য এক কেরামত- যে জানে পাথরটা গড়িয়ে পড়বেই পাহাড়ের চূড়ায় তুলতে পারলেও- তবুও বুঝি দাবায়ে রাখতে পারবা না, চির বাঙাল এক রোখ তার।
একজন অভিনেতার স্থায়ী-পরিচয় জনমনে এভাবে মুদ্রিত হওয়া, মঞ্চ-টেলিভিশন ছাড়িয়ে যেন এক চিরসময়ের মানসপটে। অভিনেতার পক্ষে এ তো তার মাধ্যম-উত্তীর্ণ অর্জন- এভাবেই তিনি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশে। মৃত্যুর এতবছর পরেও তার যেন ক্ষয় নাই- প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্মৃতির শ্রুতিবাহিত হয়ে ফিরেছে যে পরিচয়। অভিনয়েও তাহলে হতে পারে এতখানি সময়োত্তীর্ণ নন্দন মহিমা- সে বড়ো বিস্ময়!
হুমায়ূন ফরীদির অভিনয়ে ব্যক্তিসত্তার সম্প্রকাশ গোটা-চারেক চরিত্রাভিনয়ে সনাক্ত করা যায়। শকুন্তলা নাটকে স্বর্গীয় চরিত্র তক্ষক হয়ে ওঠে মর্ত্যলোকের একালের চেনা এক কুশীলব। নাটকটাতেই সে অভিমুখ ছিল- স্বর্গীয়তা পার্থিবে রূপান্তর করা। তার ফলে চরিত্রটা ফরীদির ব্যক্তিগত চ্যাংড়ামি-পুংটামির শারীর-বাচনের স্বরমুদ্রায় যেমন স্বকালের হয়ে ওঠে, তেমনি তাতে ফরীদির স্বভাবের নাগরিক-প্রথাভাঙা স্ফূর্তি-মুদ্রা অমোঘ লাগে। এই অভিনয়েই ফরীদি পেয়ে যান যেন তাঁর স্বকীয় আত্মপ্রকাশরীতি। সত্তাস্বরূপে এই ভর তাঁকে পরবর্তী বিবিধ-বিচিত্র চরিত্রে লক্ষ্যভেদী করে তোলে। মুনতাসির তো তৎকালীন বাংলাদেশের, রফিক আজাদের ‘ভাত দে হারামজাদা/নইলে মানচিত্র খাবো’ প্রতিস্পর্ধার বিপরীত এক উলট-বাস্তব। তীব্র রঙ্গব্যঙ্গে যেখানে খেতে শুরু করে সে হাসপাতালের, দেশের তাবৎ খাদ্যাখাদ্য, যে বুভুক্ষায় স্বদেশ- খাদক হয়ে ওঠে সে ক্ষমতা-পুঙ্গব; যার লাগাতার ভক্ষণবিকার বুঝি চিরস্থায়ী এক বন্দোবস্ত হয়। এহেন কুৎসিত এক দানব ফরীদির তুরন্ত ঊনপঞ্চাশ বায়ুচড়া উন্মাদনে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নাগরিকদর্শক হয়ত তার আপাত বহিরঙ্গ রঙ্গমাতনে কেবল মজায় মজ্জমান হয়, অথচ ‘ঠাকুর ঘরে কে রে’-বৎ সন্ত্রস্ত্র হয়ে ওঠে কোনো কোনো দেশপ্রেমিক-বলয়ও- হয়ত পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে সেটা আর কোনো রাখ-ঢাক মানে না। সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন পরবর্তী মুনতাসিরও অনিবার্য হয়ে ওঠে দুষ্কালের কথকতা নাট্যে। এ অভিনয়ে ফরীদির ক্যারিকেচার রাজনৈতিক ক্ষুরধার তাৎপর্য পায়।
কিত্তনখোলা নাট্যের উদাস প্রেমিক নটটি বাঙালি যুবা-মানুষের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। নায়িকার প্রতি তার অভিমান, নাট্যকারের সহায়ক বাচনে, ফরীদির অভিনয়ে দেবদাসতুল্য আকুল হতাশ্বাস সঞ্চার করে দর্শকমনে। তারপর কেরামতমঙ্গল তো ফরীদির সত্তাস্বরূপের এক সামগ্রিক-পরিক্রমণ। দেশজোড়া টালমাটাল বাস্তবে প্রতিস্পর্ধী ট্র্যাজিক মহিমা অর্জন করে। ফরীদির আত্মপ্রকাশাভিনয় যথাবিস্তার পায়।
এভাবে হুমায়ূন ফরীদি নাগরিক-দর্শকমনে স্মৃতি-শ্রুতির কিংবদন্তি হতে পেরেছেন। টেলিভিশন নাট্যাবলিতেও আদলে-বাচনে প্রতিনায়ক ফরীদি সারাদেশের দর্শকসাধারণের মনে প্রকৃত নটনায়কের পরিচয়ে স্থায়ী এক মর্যাদা অর্জন করেছেন।
তবে, বাণিজ্য-চলচ্চিত্রে ফরীদি বাঁহাত দিয়ে হেলাফেলায় অভিনয়ের নামে কত যে বিকার-মদ্য যোগায়- উৎপল দত্তের মতোই জীবিকার নষ্টভ্রষ্ট বাস্তবে!
খালেদ খান, যুবরাজ, ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এর অভিনেতা, নির্দেশক। দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকে ‘মাখন’ চরিত্রে তৃতীয়-বিকল্প-অভিনেতা। বের্টল্ট ব্রেশটের রূপান্তরিত এ নাটকে মাখন এক ধনী জোতদারের গৃহস্থ কামলা, যার সাথে মনিবের নেশাকালীন সখ্য-বয়স্যের সম্পর্ক। নেশা কাটলে টিপিক্যাল মনিব-ভৃত্য। গুণী নট আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূর চরিত্রটিকে তৎকালীন বামরাজনীতির সাধারণ এক প্রলেতারিয়েতের কল্প-প্রটাগনিস্ট করে তোলেন। পশ্চিমবঙ্গীয় হায়াত ভাই-নূর ভাই ঢাকার মঞ্চের অভিনয়ে কথ্যবাচনের এক ভিত্তি তৈরি করেন, চরিত্রটির কথায় আঞ্চলিক বুলি থাকলেও। খালেদ খান মঞ্চেনির্মিত এই কথ্যমুদ্রা সক্ষমভাবে আয়ত্ত করেন, বলা যায় গুণী দুই বয়োজ্যেষ্ঠ নটের অনুসরণে, অনুগমনে। এই ভিত্তিভূমি থেকেই তিনি ব্যক্তিসত্তানুগ অভিনয়-বাচন নির্মাণ করেন। খালেদের এটাই তারিফযোগ্য সামর্থ্য, অগ্রজ নটের শিক্ষা আয়ত্ত করে নিজস্ব-বাচনে তা অর্জন করা। পশ্চিমবঙ্গীয় নাগরিক-বুলি সুরছন্দময় এক ভারসাম্যে বিন্যস্ত, মঞ্চাভিনয়ে তার রূপায়ণ শারীরভঙ্গি এক স্বাভাবিক সামঞ্জস্যে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে আঞ্চলিক নানা বুলি মানভাষার শীলিত বাচনের সঙ্গে এক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্কে অবতীর্ণ- একটা কোনো পারস্পরিক সুছন্দে গ্রথিত করা সহজসাধ্য নয়, এরই দ্বৈরথে মঞ্চে নানা অভিনয়রীতি গঠিত হয়। ঢাকায় নাগরিক-কথ্যবুলি মিশ্র এক বাগভঙ্গির জন্ম দিয়েছে, তাতে নানা আঞ্চলিক ভাষার বদলে ঢাকাই এক নাগরিকতা রূপ পেয়েছে, কলকাতা-অনুগামী মানভাষার অনুকরণের বিপরীতে। যাতে করে এক বাংলাদেশি নাগরিক-বাচন দাঁড়িয়ে গেছে, মঞ্চে তার প্রকাশ যদিও সচ্ছন্দ নয়, সেখানে শীলিত এক মানভাষার অধিক প্রচলন।
‘নাগরিক’-এর অচলায়তন নাটকে খালেদ খান প্রথম বিকল্প হিসেবে ‘পঞ্চক’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এই অভিনয় থেকেই খালেদের নিজস্ব এক অভিনয়রীতি গড়ে ওঠে। রবীন্দ্র-নাট্যের সঙ্গে এই প্রথম সেভাবে ঢাকার বা বাংলাদেশের মঞ্চ মুখোমুখি হয়, মোকাবেলা করতে হয় তাকে নাগরিক-অভ্যাসের ভিন্নতর এক সুর-ছন্দের বাচন, যাকে এতদিন কাব্যিক বলে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। কলকাতায় বহুরূপী ও শম্ভু মিত্র তা মঞ্চসম্ভব করে তোলেন, বলতে গেলে মঞ্চে রবীন্দ্র ও বাংলা-বাচন আবিষ্কার করেন, আবহমান বাংলা ভাব-ভাষার মৌল গড়নে ভর করে- মহাকবি যার সৃজনকর্তা- যে ভাষায় আমরা কথা কইতে পারি না অথচ যা আমাদের অন্তরের গভীর মর্মভাষ- নাগরিকজন তার তাবৎ দেশ-সমাজ-হীনতায় উপনিবেশিকভাবে বিচ্ছিন্ন। সামাজিক-মানবিক-সম্পর্কহীন ক্ষমতাসম্পর্কের বাস্তবতায় এক বাজার-কর্পোরেট চলতি অনুবাদ-ভাষা আয়ত্ত করে- যা ঠিক কারো মুখের বা মনের ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর মহাকাব্যিক পরাক্রমে সেই লুপ্ত, বিস্মৃত মানবভাষাটি অর্জন করেন গ্রামীণ বাকস্পন্দের এক সহজ-গভীর ভাবের-ভাষায়।
বাংলাদেশে আমরা মোহাম্মদ জাকারিয়ার মারফত তার এক ‘বহুরূপী’-ধরনের পরিচয় পাই; যা তাঁর অভিনয়ে প্রেক্ষাপট হারিয়ে চর্চিত, কৃত্রিম লাগে। প্রাচীন এক বাকভঙ্গি মাত্র ঠেকে। টেলিভিশনে বহুতর সৃজনকর্তা মোস্তফা মনোয়ার রক্তকরবী নাট্যসূত্রে বর্তমানকালের উপযোগী এক নাট্যবাচন নির্মাণ করেছিলেন। বাংলাদেশের নাগরিক-বাকস্পন্দে আয়ত্ত করতে পেরেছিল রবীন্দ্রবাচন।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় ও আলী যাকের প্রয়োগে অচলায়তন-এর এক নবরূপায়ণ করতে চেয়েছিলেনÑযাতে করে শোনপাংশু/দর্ভকজন আদিবাসী স্বরসুরভঙ্গিতে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
খালেদ খান, আবুল হায়াত-নূর ভাইয়ের নাগরিক কথ্যবাচনে শিক্ষানবিশীসূত্রে, নিজস্ব কথন ও শারীরভঙ্গির অন্তরঙ্গতায়, দূরবর্তী এক অচলায়তনের অনড় ঘেরাটোপে আটকে-পড়া পঞ্চককে জীবন্ত এক চরিত্রে ধরাছোঁয়ার মধ্যে আনেন- রবীন্দ্র সংলাপের তথাকথিত কাব্যিকতা আর তাতে বাদ সাধে না। বলতে গেলে খালেদ খানের ব্যক্তিসত্তার প্রথম স্বাক্ষর ও তার ভিত্তিভূমি রবীন্দ্রবাচনে আত্মপ্রকাশ-সামর্থ্যে গঠিত। দর্শক রবীন্দ্রচরিত্রের বাস্তবতা খালেদ খানের মারফতে জীবন্ত অভিনয়মুদ্রায় দেখতে পায়। রবীন্দ্রবাচন-দৌত্যে খালেদের এই আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের মঞ্চে স্মৃতি-শ্রুতির মর্যাদায় গৃহীত হয়।
হ্যামলেট নাটকের রূপান্তর দর্পণ নাট্যে খালেদ খান আঞ্চলিক ভাষায়, গ্রামীণ চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্র-বাচন আত্ম-বাচনে ধারণ, তাকে সুর-ছন্দের এক ভোকাবুলারিতে আয়ত্ত করায় দক্ষ খালেদকে আরেক বিপ্রতীপ চ্যালেঞ্জ জানায় এ নাটকে। সেটাও তিনি যথাযথ অর্জন করেন। বাচনের ও শারীরিকতার স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষিপ্রতায়। গ্রামীণ যুবাচরিত্র হ্যামলেটীয় সংকটাবর্তে বাস্তব হয়ে ওঠে, হয়ত খানিক নাগরিক-আরোপণে। খালেদ খানের ব্যক্তিগত স্বভাব-মুদ্রায় দর্শক অন্তরঙ্গ বোধ করেন- যেমন টেলিভিশনের জনপ্রিয় ভিলেনি চরিত্রের অভিনয়ে- ‘ছি ছি তুমি এত খারাপ?’! টিভিতে এসব নানা চরিত্রাভিনয়, বিহেভিং-চর্চায় যেন মঞ্চে বিশেষ কোনো চরিত্রের হয়ে ওঠার মহড়া বা রিহার্সেল। তবে নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে বীরনায়কের পার্শ্ববর্তী এক চরিত্র ‘দয়াশীল’ হয়ে ওঠে খালেদের পক্ষে ছোটো-চরিত্র অভিনয়ে বিশিষ্ট করে তোলার ক্ষমতা অর্জন- যখন কি না গোটা নাট্য আবর্তিত মহানায়কের বীরত্বব্যঞ্জক ঘটনাঘটনে। নাটকে হ্যামলেটীয় হোরেসিও বা বাস্তব ইতিহাসের বঙ্গবন্ধু-সহচর ‘তাজউদ্দীন’-চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের ঔজ্জ্বল্যের পাশেও ‘দয়ালশীল’ যে দর্শকের মনোযোগ পায়- সেটা কম কথা নয়। খালেদের পক্ষে আত্ম-অতিক্রমী সে প্রৌঢ়ভাবুকতা তারিফযোগ্য। গ্যালিলিও নাট্যে জিজ্ঞাসু, অনুগত শিক্ষার্থী চরিত্রে খালেদ খান আবার তাঁর আতীব্র চেনা সামাজিক-চরিত্র হয়ে ওঠেন, তৎকালীন রাজনৈতিক-যুবার সততার প্রতিভূ হয়ে উঠেন।
এভাবে খালেদ মঞ্চ বা দলীয় সংকীর্ণতার বাইরেও তরুণ- যুব নাট্যজনের অনুসরণীয় এক সুহৃদসখাÑহুমায়ূন ফরীদির পাশাপাশি, অথচ দুজনে স্বভাব-বিপ্রতীপ- পারস্পরিক দুটি অভিনয়ধারাই যেন বাংলাদেশের মঞ্চে বিবর্তিত। গুণী অভিনেতা এভাবে সামাজিক অন্তরঙ্গ চরিত্র হয়ে ওঠেন- নাট্যজন ও সাধারণ দর্শকের কাছে।
তবে খালেদ খান অভিনয়ে ব্যক্তিসত্তাস্বরূপ প্রকাশের পরিণত এক রূপায়ণ করেন, সৈয়দ শামসুল হকের অভিনব রচনা ঈর্ষা নাটকে। তিনটা চরিত্রের ৭টা সংলাপে নাট্যটি গঠিত। প্রবীণ এক শিক্ষক ‘প্রৌঢ়’ আর প্রেমিক-প্রেমিকা ‘যুবক’-যুবতী- তাঁর দুই ছাত্র-ছাত্রী। ছাত্রীটি শিক্ষকের মোহ-মায়ায় আকৃষ্ট হওয়ায় নাট্যক্রিয়া নানান ঘটনাঘটনে টানটান হয়ে ওঠে। এই নাটকে ছাত্র যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন খালেদ খান।
ঈর্ষা কাব্যনাট্যের কঠিন অভিনব বাচন খালেদ খানের অভিনয়ে শিল্পোত্তীর্ণ হয়ে ওঠে। কলকাতায় এ নাটকের অভিনয়ে দর্শকসাধারণ মহানট শম্ভু মিত্রের অনুগামী সাযুজ্য দেখতে পান। তরুণ নটের নিজস্ব এক সামর্থ্য-অর্জনসূত্রে জানা যায়, খালেদ শম্ভু মিত্রের কোনো মঞ্চনাট্য দেখেন নি, কেবল রেডিও আর রেকর্ড মারফত অভিনয় আর আবৃত্তি মাত্র শুনেছেন। সেই শিক্ষা ও অনুগমন মঞ্চে তার শারীরমুদ্রায়ও কী করে মহানটের আদল মনে পড়ায়- সে এক বিস্ময়! স্বভাবত সেটা থাকে না অনুকরণ অনুসরণের সহজ কোনো পন্থা যা নানাজন নানা সময়ে করেছেন। যদিও পরবর্তী গুণী নট অনেকে- রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, গৌতম হালদার, দেবশংকর-এর অভিনয়রীতির অন্তঃস্থলে ধরা যায়।
এঁদের সবার মধ্যে খালেদের কৃতি বিশিষ্ট লাগে। ঈর্ষা কাব্যনাট্যের গদ্য কবিতাও বাকস্পন্দে কথ্য দৈনন্দিন নাট্যসংলাপ হয়ে ওঠে। দর্শক তাতে নাট্যের মধ্যে নাটক ও কবিতার এই যুগলবন্দি, সমর্থ নটের নিজস্ব মুদ্রায়, বাচনে মঞ্চের কাব্য হয়ে ওঠা দেখতে পায়। ঢাকার মঞ্চে অভিনব এক অভিজ্ঞতার আস্বাদন করেন দর্শক-সাধারণ। স্বভাবত এ অভিনয় খালেদ ও বাংলাদেশে একালে অভিনয়ের এক কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। ঈর্ষা মানবিক সম্পর্কে দুই প্রজন্ম-ব্যবধায় মর্মান্তিক হয়ে ওঠে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সেখানে প্রতিস্পর্ধী একই নারীর সঙ্গে সম্পর্কের পারস্পরিকতায়। স্বাভাবিক-সম্পর্কনীতি টালমাটাল হয়ে ওঠে প্রেম ও কামের দ্বন্দ্বময়তায়। তিনটা চরিত্র তাতে উচ্চ-, উচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঈর্ষাতুর আধিপত্যের ক্ষমতাসম্পর্কে পর্যবসিত হয় নাটক। নাট্য ও কাব্য তাতে যুগপৎ উচ্ছ্রত হয়ে ওঠে। এহেন সংকটাবর্ত কাব্যনাট্যে একালের স্বদেশী বাস্তবতায় গঠিত হয় জটিল সে গূঢ়ৈষা। আধুনিক কবিতার ভাষা সাধারণত মঞ্চে কঠিনতম, কেবল পঠনসাধ্য লাগে। খালেদ খান এহেন ভাষ্য শারীর-বাচনে লক্ষ্যভেদী করে তোলেন। অভিনয়ের কাব্য তাতে স্ফটিকতুল্য হয়ে ওঠে। কবিতা ও চিত্রকলায় অদীক্ষিত সাধারণ দর্শকও যে তার ভোক্তা হয়ে উঠতে পারে- সে এক বিস্ময়! অভিনেতার ব্যক্তিসত্তাও তাতে অভিব্যক্ত হয়। তাই এমন তারিফযোগ্য সে অভিনয়।
খালেদের নাট্য-নির্দেশনায়ও তাঁর বিশিষ্ট অভিনয়মুদ্রা নাট্যে সঞ্চারিত হয়, একজন সমর্থ নট-কেই দর্শক দেখতে পায়।
মোহাম্মদ জাকারিয়া-প্রবীণ নটের আয়ত্ত দক্ষতা; নাজমা আনোয়ার- নারীর নাগরিকতা-উত্তীর্ণ আবহমান নারীর প্রতিস্পর্ধা; হুমায়ূন ফরীদি ও খালেদ খান নাগরিক দুই নটের বিপ্রতীপ ব্যক্তিসত্তা অভিনয়ে একেক ভিন্ন মুদ্রায় রূপায়িত হয়। তাতে মানবস্বভাবের বিচিত্র রূপারোপে দর্শকের স্মৃতি-শ্রুতিতে অভিনেয় চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে অভিনেতৃর বিবিধ ব্যক্তিসত্তা, অভিনয়ের কাব্যনন্দনে কিংবদন্তি তুল্য হয়ে ওঠে।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, নাট্যসমালোচক