Full premium theme for CMS
নাজমা আনোয়ার-হুমায়ূন ফরীদি-খালেদ খানের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য : স্মৃতির আঙ্গিনা থেকে
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাজমা আনোয়ার, হুমায়ূন ফরীদি, খালেদ খান- বাংলাদেশের নাট্যমঞ্চের শক্তিমান এই তিন শিল্পীর অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য নিয়ে দুকথা লেখার দুঃসাহস করছি ‘থিয়েটারওয়ালা’র অনুরুদ্ধ হয়ে। তিনজনই প্রয়াত হয়েছেন অকালে, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায়। দেশব্যাপী তাঁদের আকাশচুম্বি জনপ্রিয়তা ছিল মঞ্চ-টেলিভিশন-চলচ্চিত্রে অভিনয়ের কারণে। জনপ্রিয়তা শিল্পের মাপকাঠি নয়। কিন্তু এই তিন অভিনেতৃই ছিলেন শিল্পের নিপুণ কারিগর। জনপ্রিয়তার বিচারের বাইরেও, বাংলাদেশে তাঁরা বেঁচে থাকবেন শিল্পের বিচারে। সে বেঁচে থাকা মহত্তম। আমি তাঁদের ‘শক্তিমান শিল্পী’ হিসেবে উল্লেখ করেছি শুরুতেই। এই তিনজনই মূলত অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে ‘শিল্পী’তে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন বলেই আজ এবং ভবিষ্যতেও তাঁরা আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবেন।
এই তিন অভিনেতৃর মঞ্চের অভিনয় যাঁরা দেখেন নি, তাঁরা নিশ্চতভাবেই বড়ো কিছু থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল মঞ্চে তাঁদের অভিনয় দেখার। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটবার অব্যবহিত পরে গত শতকের আশির দশক ছিল থিয়েটার আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দশক। এই দশকে বিষয়-বৈচিত্র্যে ও নব নব আঙ্গিকে একের পর এক নতুন নতুন নাটক আসতে থাকে মঞ্চে, তৈরি হতে থাকে আমাদের থিয়েটারের দর্শক। এক ঝাঁক তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রী তখন মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করছেন। এই সময়ে, মঞ্চনাটকের প্রফুল্ল-জোয়ারকালের সামান্য আগেপরে এই তিন অভিনেতৃর মঞ্চে-আবির্ভাব। আশি ও নব্বই দশকজুড়ে দাপটের সাথে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন তিনজনই। আমার লেখায় ব্যক্তিগত চেনা-জানার অভিজ্ঞতা আর মঞ্চ এবং প্রাসঙ্গিকভাবে অন্যান্য মাধ্যমে তাঁদের অভিনয়ের স্মৃতি হাতড়িয়ে দুকথা বলবার চেষ্টা করব। অভিনয়ের শক্তিমত্তায় এই তিন অভিনেতৃর অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য খোঁজার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ‘আরণ্যক নাট্যদল’র ইবলিশ নাটকে আমি প্রথম দেখি নাজমা আনোয়ারের অভিনয়। সম্ভবত ১৯৮১ সালে। হুমায়ূন ফরীদির প্রথম মঞ্চাভিনয় দেখি গাইড হাউসে ‘ঢাকা থিয়েটার’র ধূর্ত উই নাটকে। আর খালেদ খানকে প্রথম মঞ্চে দেখার অভিজ্ঞতা ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’র দেওয়ান গাজীর কিস্সা না কি নূরলদীনের সারাজীবন নাটকে, মনে করতে পারছি না। তবে তিন অভিনেতৃর মধ্যে খালেদ খানকে সবচেয়ে বেশি মঞ্চে দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। ঈর্ষা, হিম্মতি মা, দর্পণ, রক্তকরবীর মতো নাটকে তাঁর অসাধারণ অভিনয় স্মৃতিতে অমলিন।
গত শতকের নব্বই দশকে আমি যখন ঢাকার মঞ্চে অভিনয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠছি, বিশেষত এস এম সোলায়মান নির্দেশিত কোর্ট মার্শাল নাটক নিয়ে, তখন নাটকটি নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। তখন একদিন নাটক দেখে খালেদ খান নিজে এসেই আমাকে অভিনন্দিত করে পরিচয় করে নিলেন। নাটকে আমার কণ্ঠের ব্যবহার নিয়ে প্রশংসা করলেন। নবীন অভিনেতা হিসেবে আমার বিস্ময়ের সীমা নাই! কারণ, তিনি তখন মঞ্চের দাপুটে বড়ো অভিনেতা, আর টেলিভিশনের সুপারস্টার। সেই পরিচয় থেকে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কত কত আড্ডা হয়েছে আমাদের; মহিলা সমিতির বারান্দায়, রিহার্সেল রুমে, তাঁর বাসায়। অনেক অনেক স্মৃতি তাঁর সাথে। সে তুলনায় দেশবরেণ্য অভিনেতা হুমায়ূন ফরীদির সাথে আমার পরিচয় ছিল সামান্যই। ফরীদি ভাই তখন টেলিভিশন-সিনেমা মিলে বাংলাদেশের মহাতারকা। সেই সময়ে কোনো কোনোদিন মহিলা সমিতি বা গাইড হাউসের বারান্দায় আড্ডা দিতে আসলে তাঁকে আমরা দেখতাম দূর থেকে। পরে আমার টেলিভিশনে অভিনয়েরসূত্রে ফরীদি ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বাড়ে। তিনি সোলায়মান ভাইয়ের বন্ধু ছিলেন বলে তাঁর সাথে দেখা হলে আমি আলাদা খাতির পেতাম। কারণ, তিনি জানতেন আমি সোলায়মান ভাইয়ের শিষ্য। তিনিও কোর্ট মার্শাল' দেখে ভুয়সী প্রশংসা করেছিলান। নানা আড্ডায় ও আলাপচারিতায় তাঁকে যতটুকু চিনেছি, জেনেছি; তা আমার কাছে অমূল্য সম্পদ। কিন্তু নাজমা আনোয়ার ছিলেন আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের একেবারেই বাইরে। আমি নব্বই দশকে যখন ঢাকায় মঞ্চে অভিনয় শুরু করেছি, তখন তিনি মঞ্চে কাজ করছেনই-না বলা যায়। তিনি তখন টেলিভিশনের তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী। এই সময়ে অর্থাৎ নব্বই দশকে নবীন দল হিসেবে ‘দেশ নাটক’র প্রযোজনা লোহায় তাঁকে অভিনয় করতে দেখেছি। তাঁর সুযোগ্য কন্যা অকালপ্রয়াত নাট্যজন ইশরাত নিশাত ছিলেন আমাদের সমবয়সী, কিন্তু থিয়েটারের আঙ্গিনায় আমার সিনিয়র। ইশরাত নিশাতের সাথে আমার পরিচয় এবং পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তৈরি হয় থিয়েটারকেন্দ্রিক নানা প্রতিবাদ আর আন্দোলনের সূত্রে। মা নাজমা আনোয়ারের সাথে ইশরাত নিশাতও আরণ্যক নাট্যদলে কাজ শুরু করেছিলেন কিশোর বয়সেই। কন্যা ইশরাত নিশাত নির্দেশিত লোহা নাটকে অভিনয় করেছিলেন মা নাজমা আনোয়ার, সম্ভবত এটাই ছিল মঞ্চে তাঁর শেষ-অভিনয়।
অভিনয়-দক্ষতার বিবেচনায় প্রায়ই একটা কথা শোনা যায় যে, ভালো অভিনেতৃ মূলত সহজাত প্রতিভাধর। অর্থাৎ ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রতিভা প্রাকৃতিক, জন্মগত। চেষ্টা বা প্রশিক্ষণে কিংবা লেখাপড়া করে অভিনয় প্রতিভার কার্যকারিতা ক্ষুরধার করা যায়, কিন্তু অভিনয়ের বড়ো ক্ষমতা ‘অর্জন’ করা যায় না। যুগে যুগে দেশে দেশে তাই সহজাত প্রতিভাধর অভিনেতৃই কালোত্তীর্ণ হয়েছেন। এই উপমহাদেশে নিকট অতীতে গিরিশ ঘোষ, বিনোদিনী, শিশির ভাদুড়ী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, অজিতেশ মুখোপাধ্যায়, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কেয়া চক্রবর্তী থেকে ফতেহ লোহানী, মোহাম্মদ জাকারিয়া, আনোয়ার হোসেন, অমলেন্দু বিশ্বাস, আলী যাকের, হুমায়ূন ফরীদি, ফেরদৌসী মজুমদার, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, রাইসুল ইসলাম আসাদের নাম নিত্য স্মরণীয়। এঁদের সহজাত অভিনয়-প্রতিভা তর্কাতীত, এঁরা জন্মগত অভিনেতৃ। অভিনেতৃ কি তবে কেবল প্রকৃতি-প্রদত্ত সহজাত প্রতিভার উপরই নির্ভর করে? তাঁর নিজস্ব কোনো সৃজনক্ষমতা নেই? তবে কি অভিনেতৃ শিল্পী নন?
কয়েকবছর আগে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটে এক দারুণ আড্ডায় বসেছিলাম আমরা তিনজন: প্রতিভাধর ও জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ওপার বাংলার নচিকেতা, বাংলাদেশের জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান আর আমি। পরে একসময় সে আড্ডায় যুক্ত হন জনপ্রিয় ব্যান্ডদল সোলসের কণ্ঠশিল্পী ও অভিনেতা পার্থ বড়ুয়া। গভীর রাত-অব্দি বেশ জমেছিল আড্ডাটা। নচিকেতার সাথে জাহিদের সম্পর্ক খুবই মধুর। আড্ডার একসময় নচিকেতা ঠাট্টাচ্ছলে জাহিদকে বলে বসলেন, ‘আরে অভিনেতা আবার শিল্পী নাকি! অভিনেতা হচ্ছে ডিরেক্টরের পুতুল। ডিরেক্টর যেমনি নাচায়, অভিনেতা তেমনি নাচবে...হা হা হা’। আমি আর জাহিদ হৈ হৈ করে উঠলাম। ঠাট্টাচ্ছলে বললেও নচিকেতার মন্তব্য নিয়ে আলোচনা করা যায়। বিশেষত আমাদের দেশে নির্দেশক ও অভিনেতৃর সম্পর্ক ও দায়িত্বের যে স্কুলটা ব্রিটিশ কলোনীয় দীর্ঘ উপনিবেশিকতার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছিল, তার ধারাবাহিকতা কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষেও প্রবাহিত হচ্ছিল। সে স্কুলের সূত্রে নচিকেতার মন্তব্যের সারবত্তা খোঁজা যায়। কিন্তু আদতে নাটক বা থিয়েটার হচ্ছে আদি শিল্প এবং সে শিল্পের মূল কুশীলব অভিনেতা-অভিনেত্রী। নাটক বা থিয়েটারের দীর্ঘ ইতিহাসের মাত্র গত দু-এক শতাব্দী আগে নাট্যাভিনয়ের শৃঙ্খলায় ডিরেক্টরের আবির্ভাব।
অভিনেতৃ নিঃসন্দেহে সৃজনশীল। আবার স্তানিস্লাভস্কি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করেছেন: সৃজনশীল, অনুকরণশীল, উৎকট। সুতরাং অভিনেতৃ মাত্রই সৃজনশীল নন। প্রশ্ন হলো নাটকের গুণগত মানে আপনি যে নাটকখানা দেখলেন, সে নাটকটা আপনাকে কতখানি শিল্পরসে আপ্লুত করল, সেটাকে আপনি আদৌ শিল্পের মর্যাদা দিচ্ছেন কি না এবং সে শিল্পে অভিনেতৃর ভূমিকা কী। অর্থাৎ নাট্যগুণ বিচারে সর্বোতভাবে নাটকটা শিল্পরসসমৃদ্ধ বা সৃজনশীল হওয়ার পর আসে সৃজনশীল অভিনেতা-অভিনেত্রীর প্রশ্ন। যে কারণে অনেক ভালো অভিনেতৃও ভালো নাটক না হলে দৃষ্টির আড়ালে চলে যান। নাটক বা থিয়েটার যেহেতু যৌথ শিল্প, তাই একজন অভিনেতৃর সৃজনশীলতা বা শিল্প (আর্ট) নির্ভর করে আরও অনেক কিছুর উপর। শিল্পের রস নিঃসন্দেহে ভোক্তার চিন্তা, রুচি, শিল্পবোধ ইত্যাদির বিবেচনায় সর্বদাই আপেক্ষিক। কিন্তু শিল্পীর ব্যখ্যা বোধকরি সুনির্দিষ্ট। তাই অভিনেতৃমাত্রই শিল্পী, এটা বলাও বেশ ঝুঁঁকিপূর্ণ।
আলোচ্য তিন অভিনেতা-অভিনেত্রীকেই আমি শিল্পীর অভিধা দিয়েছি রচনার শুরুতেই। কারণ, এই তিন অভিনেতৃই ছিলেন সৃজনশীল। তাঁরা অভিনীত চরিত্রকে ব্যাখ্যা করতে পারতেন তাঁদের সৃজনশীলতা দিয়ে। এবং তাঁরা সৌভাগ্যবান এ কারণে যে, তাঁদের অভিনীত অধিকাংশ নাটক ছিল শিল্প মহিমায় উজ্জ্বল। সেসব নাটকে অভিনয় করে তাঁরা তাঁদের সৃজন-প্রতিভার স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
নাজমা আনোয়ারের ইবলিশ' বা লোহার কথাই ধরা যাক। আশির দশকে ইবলিশ ছিল আরণ্যকের তুমুল জনপ্রিয় একটা নাটক। এ নাটকে গ্রামীণ জনপদের ক্ষমতা-কাঠামোর দৌরাত্ম্য এবং অশিক্ষা-কুসংস্কারের সুযোগ নিয়ে একটা লুটেরা-শ্রেণির শোষণ ও সাধারণ মানুষের বঞ্চনার ছবি চিত্রিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ নাটকের মূল শক্তি ছিল অভিনয়। সে নাটকে নাজমা আনোয়ারের আতশি চরিত্রে অভিনয় আমার মনে আজও জাগরূক। কী অসাধারণভাবে নাজমা আনোয়ার তাঁর শরীর, কণ্ঠ, সংলাপ দিয়ে আতশিকে এঁকেছিলেন! একেবারে গ্রামীণ একটা চরিত্রকে আত্মস্থ করার যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছিলেন, কঠোর পরিশ্রম ছাড়া তা আয়ত্বে আনা সম্ভব নয়। চরিত্রের মানসকাঠামো অনুযায়ী সংলাপ প্রক্ষেপণ আর অভিব্যক্তির সৃজনশীলতাই তাঁকে আমার স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখেছে। তেমনি লোহা নাটকে অতিবৃদ্ধার চরিত্রে তাঁর মনোনিবেশ দেখে আশ্চর্য হয়েছি। নীরবতার মধ্যে কেবল লাঠিতে ঠক ঠক করে ভাবলেশহীন দৃষ্টি দিয়ে কুকুর খেদানোর দৃশ্যে যে মুহূর্ত তৈরি হয়, তা নাটকটাতে বিরল দ্যোতনায় নতুন মাত্রা তৈরি করে। এই মাত্রা তৈরির সৃজনশীলতাই একজন শিল্পীর কাজ। নাজমা আনোয়ার স্বভাববাদী অভিনেত্রী ছিলেন। তাই তাঁর অভিনয়ে চরিত্রের স্বাভাবিক পরিস্ফুটন ঘটত। মনে হতো তিনি চরিত্রে প্রবেশ করেন নি, বরং চরিত্রই তাঁর মধ্যে প্রবেশ করেছে।
আমার কাছে নাজমা আনোয়ারকে একজন সহজাত প্রতিভাধর অভিনেত্রী মনে হয়। টেলিভিশনের অসংখ্য নাটকে তাঁর নানা ধরনের, নানা মাত্রার চরিত্রে স্বভাববাদী অভিনয় দেখে আমার এ প্রত্যয় জন্মেছে। যেকোনো চরিত্রে তিনি সাবলীল অভিনয় করতেন। সে অভিনয় ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং নির্মেদ। চরিত্র নির্মাণে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ততার ক্ষমতার কারণে আমি বিশ্বাস করি তিনি প্রকৃতিগতভাবেই একজন জাত অভিনেত্রী ছিলেন। বেঁচে থাকলে শিল্পী হিসেবে আরও অনেক বেশি কিছু তিনি অভিনয়শিল্পে দিয়ে যেতে পারতেন। তবে যতটুকু দিয়েছেন, তার মূল্যও কম নয়।
হুমায়ূন ফরীদির ক্ষেত্রেও বলতে পারি তিনি ছিলেন প্রকৃতিজাত অভিনেতা। তবে চরিত্র নির্মাণে হুমায়ূন ফরীদির তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল বিস্ময়কর। চরিত্রের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণের পাশাপাশি চরিত্রের সাবটেক্সট অনুসন্ধান করে চরিত্রনির্মাণে তাঁর দক্ষতাই অভিনেতা হিসেবে তাঁকে স্বতন্ত্র মহিমা দিয়েছে। তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তিকে তিনি ব্যবহার করতেন চরিত্র নির্মাণে। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় ছিল বহুমাত্রিক। ইমেজ ভেঙে এক চরিত্র থেকে আরেক চরিত্রে ট্রান্সফর্ম করার নিরন্তর সংগ্রামে তিনি শতভাগ সফল হয়েছিলেন। তাঁকে বলা যায় চরিত্রনির্মাণের কুশলী-কারিগর।
মঞ্চ দাপানো অভিনয় কাকে বলে, তা আমি দেখেছি ধূর্ত উই নাটকে। স্মৃতিতে এখনও এটুকু উজ্জ্বল হয়ে আছে যে তিনি মঞ্চের এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে সংলাপ ছুঁড়ছেন তীক্ষ্ণ বর্শার মতো। তাঁর শারীরিক অভিনয় ছিল যেমন পেটানো লোহার মতো এনার্জিটিক, তেমনি ছিল চরিত্রের মনোজগৎ নিয়ে খেলার বিপুল ক্ষমতা। অভিনয়ে তাঁর অভিব্যক্তি ছিল অন্তর্ভেদী। তিনি দর্শককে তাঁর অভিনীত চরিত্রের সাথে বয়ে নিয়ে যেতেন। তাঁর চরিত্রে তিনি যেমন সজীব থাকতেন, তেমনি অভিনয় দিয়ে তিনি উজ্জীবিত রাখতে পারতেন দর্শককুলকে। অভিনয়ে তিনি তাঁর শরীরকে এমনভাবে ব্যবহার করতেন যেন তাঁর মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত থাকত চরিত্রে নিমগ্ন। কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল আমার দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু রিভিউ লিটারেচারে ততদিনে আমরা জেনে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে এমন এক অভিনেতার আবির্ভাব ঘটেছে, যিনি দেশের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন হতে চলেছেন। পরবর্তীসময়ে টেলিভিশনে তিনি প্রায় একচেটিয়া দখল নেন। টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে একমাত্র তিনিই উদাহরণযোগ্য অভিনেতা যিনি ঝুঁকি নিয়ে তুমুল জনপ্রিয় প্রটাগনিস্ট বা নায়ক ইমেজ ভেঙে এন্টাগনিস্ট বা খল চরিত্রে সফল অভিনয় করেন। এখানেই তাঁর কৃতিত্ব। তিনি তারকাখ্যাতির বাইরে নিজেকে ‘অভিনেতা’ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং শেষে নিজেই প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন।
হুমায়ূন ফরীদির সাথে সহঅভিনেতা হিসেবে টেলিভিশনে অভিনয়কালে কিছু টুকরো ঘটনা এখানে বলবার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি বড়ো অভিনেতার দাপট নিয়ে কখনোই নিজেকে প্রকাশ করতেন না। আমার সাথে তাঁর প্রথম সরাসরি পরিচয় ঘটে টেলিভিশনের একটা নাটকের সেটে। শ্যুটিংয়ের অবসরে তিনি স্বভাবজাত মধ্যমনি হয়ে অন্যদের সাথে আড্ডায় বসেছেন। আমিও আড্ডায় আছি। তিনি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছেন আর নানা উইটিতে জমিয়ে রেখেছেন সবাইকে। ফরীদি ভাইয়ের রসবোধ সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তাঁর ধুমসে সিগারেট খাওয়া দেখে আমারও সিগারেটের নেশা পেল। সিগারেট ধরাবার অনুমতি চাইতেই তিনি আমাকে হতচকিত করে সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করলেন- তোমার বয়স কত? আমি ঘাবড়ে গেলাম। সিনিয়র আর্টিস্ট, বড়ো তারকা, সোলায়মান ভাইয়ের বন্ধু। মুহূর্তে মাথায় কত কী হামলে পড়ল। নিশ্চয়ই তিনি মাইন্ড করেছেন। আমি মিন মিন করে বললাম- এই তো ৪৪/৪৫ হবে। তিনি ততোধিক সিরিয়াসলি বললেন- ১৮ বছরের চেয়ে বেশি। রাষ্ট্র তোমাকে ভোট দেয়ার অধিকার দিছে, আর আমি সিগারেট খাওয়ার অনুমতি দিতে পারব না। নাও মিয়া ধরাও...বলেই তিনি হাতের লাইটার আমাকে দিলেন।- এরকমই হিউমারাস ছিলেন তিনি।
তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল আগে আরেক টেলিভিশন নাটকের শ্যুটিংয়ে মেক-আপরুমে আমরা বসে আছি। ফরীদি ভাই, আমি, আরেকজন সিনিয়র অভিনেতা। সিনিয়র অভিনেতা বিড়বিড় করে একই সংলাপ বারবার পড়ছেন, মুখস্থ করছেন। ফরীদি ভাই একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেই সিনিয়র অভিনেতাকে বললেন- সংলাপ এভাবে মুখস্থ করবেন না। তাহলে ‘অভিনয়’ হয়ে যাবে, ‘চরিত্র’ হবে না। সংলাপটা পড়েন, বোঝেন আর চরিত্রটা নিয়ে ভাবেন। সংলাপ এমনিতেই চলে আসবে।- তাঁর সেদিনের এই উক্তিতে নতুন করে উপলব্ধি করেছিলাম অভিনয়ের সেই চিরায়ত সংজ্ঞা: Acting means no acting.
হুমায়ূন ফরীদি অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছেছিলেন। আমার বিবেচনায় তাঁর শিল্পসত্তা পৌঁছেছিল ততোধিক চূড়ান্ত শিখরে। তাঁর অকালপ্রয়াণে যতটা ক্ষতি হয়েছে দেশের, তারচেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে বিশ্বের। কারণ তিনি ছিলেন বিশ্বমাপের একজন অভিনয়শিল্পী।
আলোচ্য তিনজনের মধ্যে খালেদ খানের সাথে আমার মঞ্চের সম্পর্ক সবচেয়ে দীর্ঘ। মঞ্চে তাঁর অভিনয় আমি দেখেছি সর্বাধিক। তাঁর সাথে আমার আলাপচারিতা ছিল, ছিল একরকম বন্ধুত্বও। আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল খুবই আন্তরিক। উল্লেখিত তিন অভিনেতার মধ্যে তিনি ছিলেন বয়সে সর্বকনিষ্ঠ- কিন্তু আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়ো। তিনি এত অকালে চলে গেলেন যে, এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
খালেদ খানকে আমি বলব একাগ্রতায়, নিষ্ঠায়, চর্চায় তৈরি হওয়া একজন বিরাট মাপের অভিনেতা। চরিত্রের মনোজগৎ বিশ্লেষণ করে অভিব্যক্তিতে আনার তাঁর যে সক্ষমতা, তা বোধকরি ঢাকার মঞ্চে খুব কম অভিনেতারই ছিল বা আছে। তিনি আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে খুব মাপা অভিনয় করতেন। ফলে তাঁর অভিনয় হয়ে উঠত একেবারেই নির্মেদ- আমরা অনেকেই যাকে বলি ‘আন্ডারটোন অ্যাক্টিং’, পরিমিত অভিনয়। চরিত্রের অন্তর্গতরূপ নিংড়ে নিয়ে তিনি তা অপরূপে বাঙ্ময় করে তুলতে পারতেন। তাঁর এই অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য তাঁকে অনন্য করে তুলেছিল ঢাকার-মঞ্চে। সত্যিকার অর্থেই অভিনেতার শিল্পসৃজনে তিনি আধুনিকতার উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। অভিনয়ে কণ্ঠস্বরের যুঁতসই ব্যবহারের যে কৌশল তিনি আয়ত্তে এনেছিলেন, তা বিস্ময়কর! কণ্ঠ ব্যবহারের তাঁর এই সক্ষমতাকে অনেকেই শম্ভু মিত্রের সাথে তুলনা করতেন।
ঈর্ষা বা রক্তকরবী নাটকে তাঁর অভিনয় অবিস্মরণীয়। থিয়েটারের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, নিষ্ঠা, কমিটমেন্ট ছিল নিখাঁদ, নিগূঢ়। তিনি যখন আমাদের অনুসরণীয় হয়ে উঠছিলেন, তখনই তিনি সকলকে কাঁদিয়ে পরপারে পাড়ি দিলেন। এ এক অবিশ্বাস্য চিরপ্রস্থান।
আলোচ্য তিন অভিনেতাই আমার নমস্য। তাঁরা সৃজনশীলতা দিয়েই তাঁদের শিল্পসত্তা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যে কারণে তাঁদের অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। অভিনয়শিল্পী হিসেবে তাঁরা ছিলেন জাতির সম্পদ। তাঁরা তিনজনই অকালে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁদের অকালপ্রয়াণে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। এই তিন মহান শিল্পীর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করছি।
ড. মোহাম্মদ বারী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক