Full premium theme for CMS
ক্ষণজন্মা খালেদ খানের অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘তুমি ও আমি দৃশ্য, শ্রাব্য, স্পর্শনীয় এই মুহূর্তে, এই দ্বারকায়। কিন্তু দ্যাখো, এই মুহূর্ত এইমাত্র অন্য এক মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, অন্য এক মুহূর্তে আবার। সঙ্গে নেয় তোমাকে আমাকে টেনে, টেনে নেয় দৃষ্টি, শ্রুতি, ঘ্রাণ, বৃক্ষ, জন্তু, নক্ষত্র, নিখিলবিশ্ব।- সংলাপগুলো বুদ্ধদেব বসুর নাটক কালসন্ধ্যা থেকে নেয়া। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ এর হয়ে আমি ‘ব্যাসদেব’ চরিত্রে এগুলো উচ্চারণ করতাম মঞ্চে। আজ থেকে প্রায় বিশ/একুশ বছর আগে।
যে মানুষটাকে নিয়ে লিখব, মূলত, যে মানুষটার অভিনয় নিয়ে কিছু লিখব বলে কলম হাতে নিলাম সেই মানুষটা এই নাটকের প্রাণ-পুরুষ ছিলেন। নির্দেশক-খালেদ খান। যার প্রত্যক্ষ-স্নেহে, শাসনে, ভালোবাসায় আমি প্রথম মঞ্চে উঠতে পেরেছিলাম।
থিয়েটারের সাথে আর থিয়েটারের মানুষগুলোর সাথে এই কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। থিয়েটারে সকলি হারিয়ে যায় কালেরগর্ভে। সময়ের অক্ষ বরাবর চলতে চলতে এই মুহূর্তে যা মঞ্চে হয়ে ওঠে বর্তমান, পর-মুহূর্তেই তা অতীত, পর-মুহূর্তে আবার। অভিনয়, আলো, সংগীত, সেট নিয়ে যে মুহূর্তটা তৈরি হলো এইমাত্র, তা পর-মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। আর কোনোদিন কোথাও দেখা যাবে না, সৃষ্ট হবে না সেই মুহূর্ত। এ এক নিদারুণ-করুণ সমাপ্তি। আর অভিনেতা? আমাদের নাট্যগুরু আলী যাকের ম্যাকবেথ নাটকের একটা সংলাপ আমাদের প্রায়ই শোনাতেন- ‘যাও, নিভে যাও, নিভু নিভু দীপ, জীবন নিতান্ত এক চলমান ছায়া, হতভাগ্য এক অভিনেতা রঙ্গমঞ্চে কিছুকাল লাফায় ঝাঁপায়, তারপর আর শোনা যায় না সংবাদ’। এই হতভাগ্য অভিনেতৃরা তাদের সকলকীর্তি, অনন্য সৃজন, আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে মিলিয়ে যায় কালেরগর্ভে। আসলেই কি হারিয়ে যায়? হারিয়েই যদি যাবে, তবে কেন এত আয়োজোন, এত দীর্ঘ পথ ছুটে চলা, এত লড়াই, করুণ বাস্তবতার সাথে এত বোঝাপড়া! থিয়েটার বা থিয়েটারের মানুষগুলো কি তবে এক চলমান অতীত?
‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের আহ্বানে ‘অভিনয়ে সৃজন-স্বাতন্ত্র্য’ বিষয়ে লিখতে গিয়ে এই কথাগুলো মনে আসছে বারবার। যে চারজন অভিনেতৃকে নিয়ে হাসান শাহরিয়ার লিখতে বললেন, তারা (মোহাম্মদ জাকারিয়া, নাজমা আনোয়ার, হুমায়ূন ফরীদি এবং খালেদ খান) নমস্য। তাঁরা অতীত হয়ে গেলেও চির-বর্তমান। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাংলাদেশের থিয়েটার-অভিনেতৃর সত্তায় ছিলেন, আছেন, থাকবেন তাঁরা। যে মুহূর্তে মঞ্চে আলো জ্বলে ওঠে, সে মুহূর্তে তারাও যেন জীবন্ত হয়ে উঠেন। আমি এঁদের সকলের অভিনয় দেখি নি বা স্নেহ-পরশও পাই নি। একমাত্র খালেদ খানকে আমি কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের কাছে যিনি ছিলেন ‘যুবদা’, বড়দের কাছে ‘যুব’- তিনি আমাদের দলের ‘যুবরাজ’। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে দীর্ঘকাল কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় আমি তাঁকে দেখেছি কীভাবে তিনি সৃজন-আনন্দে মেতে উঠতেন। নিজে মঞ্চে জন্ম দিতেন জাদুকরি মুহূর্তের। দলের আমরা যারা তাঁর অনুগামী ছিলাম, তাদের তৈরি করতেন নিরলসভাবে, নিংড়ে দিতেন যা যা তাঁর ভাণ্ডারে আছে। যতক্ষণ না আমরা তাঁর চাওয়া স্পর্শ করতাম, সেই সংগ্রাম চলতেই থাকত। আমি এই মানুষটার অসীম-ক্ষমতার সামান্য কিছু সৃষ্টি-ঝলক দেখেছিলাম বলেই তাঁকে নিয়ে লিখবার সাহস করছি। যুবদা বেঁচে থাকলে হয়ত শিষ্যের এই ভালোবাসাকে ভালোভাবেই নিতেন।
কথাগুলো শুনেছিলাম নির্দেশক আতাউর রহমানের কাছে। আতাউর রহমানের সাথে যুবদার এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাঁর নির্দেশনায় যুবদা অনেক কাজ করেছিলেন মঞ্চে। এর মধ্যে ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ঈর্ষা। এই নাটকটা তিনটা চরিত্রের। মোট সাতটা সংলাপ। একেকটা সংলাপের দৈর্ঘ্য কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিটের। যুবদার চরিত্র ছিল ‘যুবক’। একবার কলকাতায় ‘আকাদেমি মঞ্চে’ অভিনয় হয়েছিল নাগরিকের এই প্রযোজনা। দেখতে এসেছিলেন শম্ভু মিত্র।
নাটক দেখার পর যুবদাকে শম্ভু মিত্র বলেছিলেন- ‘যৌবনে আমি তোমার মতো অভিনয় করতাম’। কেন তিনি একথা বলেছিলেন আমরা জানি না, কারণ, আমরা তো আমরা, যুবদাও মঞ্চে শম্ভু মিত্রের অভিনয় দেখেন নি। তাহলে এই বলায় কী আসে যায়! কিন্তু মানুষটা যখন শম্ভু মিত্র, তখন তাঁর মন্তব্যের গুরুত্ব অনেক বেশি সংবেদনশীল এবং অতি-অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শম্ভু মিত্র ছিলেন তাঁর সময়ে মঞ্চের এক আলোকবর্তিকা। তাঁর এক স্বতন্ত্র অভিনয়রীতি ছিল, যা এখনও থিয়েটারের অভিনেতৃদের কাছে সাধনা আর চর্চার বিষয়। তিনি যখন তাঁর যৌবনকে খুঁজে পান এক টগবগে তরুণের অভিনয়ে, তখন তা আর সামান্য প্রশংসা হয়ে থাকে না। তাহলে যুবদা তাঁর অভিনয়ে নিশ্চয়ই এমন এক সৃজন-স্বাতন্ত্র্যের জন্ম দিয়েছিলেন, যা একজন কিংবদন্তিকে নিজের প্রদীপ্ত গৌরবময় যৌবনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেই সৃজন-স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান করব এই লেখায়।
আমরা জানি বা আমাদের থিয়েটার-জীবনে যে পাঠ আমাদের তৈরি হতে সাহায্য করে, তা হলো- দুইরকমের অভিনয়রীতি আছে মঞ্চে। এক. মেথড অ্যাক্টিং- যা স্তানিস্লাভস্কির দ্বারা অনুপ্রাণিত, আরেকটা হলো অ্যালিয়েনেশন বা বিযুক্তকরণরীতি- যা সবার কাছে ব্রেখটীয় বলে পরিচিত। এই দুটো ধারার মধ্যে যে মূল-পার্থক্য তা হলো, মেথড অভিনয়ে চরিত্রের ভেতর অভিনেতৃ প্রবেশ করেন এবং তার নিজস্ব-অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান দিয়ে চরিত্র নির্মাণ করেন। অভিনেতৃ যে মুহূর্তে চরিত্র হয়ে ওঠেন, তখন তিনি তাই করবেন, যা ঐ চরিত্র করতে পারেন। অর্থাৎ অভিনেতৃ আর চরিত্রের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকবে না, দুজনে তখন এক-সত্তা। আর ব্রেখ্ট বলছেন, চরিত্র আর অভিনেতৃ দুই ভিন্ন-সত্তা। তারা কখনো এক হবেন না, কী মঞ্চে, কী মঞ্চের বাইরে। তারা যুক্ত হতে হতে বিযুক্ত হয়ে যাবেন। মঞ্চে যা হবে তা অভিনয়, তা বাস্তব নয়। অভিনেতৃর কাজ হলো ঘটনা চিত্রণ করা চরিত্র আর দৃশ্যে, তাতে একীভূত হয়ে যাওয়া নয়। যুবদা এই দুই-ধারার কোনটাকে বেছে নিয়েছিলেন? অথবা, তিনি আদৌ কোনো ধারা অনুসরণ করেছিলেন কী? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেই দিতে পারতেন। আমরা শুধু তাঁর অভিনয়-ধারাকে বিশ্লেষণ করতে পারি। আমার ধারণা, যুবদা একজন আধুনিক-অভিনেতার মতো করেই এই দুই-ধারাকে একইসাথে ধারণ করেছিলেন।
কীভাবে?
তিনি যখন ঈর্ষা নাটকে যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন, চরিত্র আর যুবদার মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ে না। তিনি আবেগে কেঁপে ওঠেন, তাঁর চোখ জ্বলতে থাকে এক প্রতারিত প্রেমিকের মতো, তাঁর কণ্ঠস্বরে ভর করে তারুণ্যের যন্ত্রণা। তিনি যখন সংলাপের পর সংলাপে ধীরে ধীরে একের পর এক স্কেল ভেঙে উঠতে থাকেন আর গোটা হলভর্তি-দর্শক নীরব নিশ্চুপ হয়ে যায়, আচ্ছন্ন হয়ে যায় এক মোহন আবেশে, তখন আমরা দেখতে পাই এক মুক্তিযোদ্ধার স্পর্ধিত চেহারা আর হতাশা, যিনি স্বাধীনতার জনককে হত্যার ক্রোধে বিদীর্ণ করে দিতে চান আকাশ। একজন অভিনেতা তখন আর অভিনেতা থাকেন না, জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেন। আমরা মঞ্চে খালেদ খানকে দেখি না, আমরা দেখি একজন শিল্পী, প্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং দেখি সেদিনের ক্রমশ আঁধারে ঢেকে যাওয়া স্বদেশের এক তরুণের দ্রোহ। এসব কি তবে মেথড অ্যাক্টিং? হয়তবা তাই, হয়তবা নয়, হয়তবা এটাই খালেদ খানের নিজস্ব-সৃজন।
যুবদা যখন অভিনয়-শিক্ষক আর আমরা তাঁর ছাত্র, তখন তিনি অভিনয় কী এ নিয়ে অনেক রকম ব্যাখ্যা দিতেন। একটা কথা প্রায়ই বলতেন, অভিনয় হচ্ছে ‘রিয়ালিটি প্লাস’। অর্থাৎ যা কিছু বাস্তব তাই প্রকাশ করা বা সেরকম হুবহু চরিত্র মঞ্চে উপস্থাপন করাই অভিনয় নয়। অভিনেতৃর কাজ হলো তার সাথে কিছু প্লাস করা, মানে যোগ করা, যা এই চরিত্রের যে বাস্তব বিশ্বসমাজে আছে, তার মধ্যে নেই, অথবা থাকলেও তা প্রকাশিত হয় নি। যাকে আমরা জীবনানন্দের ভাষায় বলতে পারি ‘এক বিপন্ন বিস্ময়, যা আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে’। অভিনেতৃ প্রতিটি মানুষের ভেতরে বাস করা এই বিপন্ন বিস্ময়ের খোঁজ করবে এবং চরিত্র-নির্মাণে তার প্রয়োগ ঘটাবে।
যুবদা বলতেন, প্রতিটা মানুষের ভেতরে অনেকগুলো দ্বান্দ্বিক-সত্তা থাকে, যা তাকে ঘটনা এবং পরিস্থিতি-অনুযায়ী ভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশে সাহায্য করে। এই সত্তাগুলোর সবগুলোই মঞ্চে প্রকাশযোগ্য নয়। কিন্তু কোনটা প্রকাশযোগ্য আর কোনটা নয়, তা অভিনেতৃ বুঝবে কীকরে? এইখানে প্রয়োজন নাটকটাকে বোঝা, নাট্যকারকে বোঝা। দরকার বোঝা নাটকে এই চরিত্রটা ঠিক কী প্রয়োজনে এসেছে। তার আগমনের উদ্দেশ্য কী, আর, নাটকে কোন কোন ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ায় সে অংশ নেয় এবং কেন নেয়। এরকম অনেকগুলো প্রশ্ন অভিনেতেৃকে (নিজেকে) করতে হবে এবং এই প্রশ্নগুলোর উত্তর তাকেই বের করতে হবে। পাণ্ডুলিপি তাকে সাহায্য করবে আর সাহায্য করবে নির্দেশক। যুবদা যখন নিজে অভিনেতা, তখন চরিত্রসৃজনে, চরিত্র-নির্মাণে, এই প্রশ্নগুলো নিজেকে করতেন। আর যখন তিনি নির্দেশক, তখন তাঁর অভিনেতৃদের মধ্যে এই প্রশ্নগুলো করার তাড়না সঞ্চার করতেন এবং উত্তর দিতেন। এখানে তাঁর এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য।
এই যে চরিত্র-নির্মাণে রিয়ালিটি এবং নিজস্ব-সৃজনের সহাবস্থান বা সংযোগ, এটা করতে গেলে একজন অভিনেতৃর কী কী গুণ থাকা দরকার বা কী কী থাকলে তাকে সৃজন বলা যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর যুবদার অভিনয়রীতি এবং তাঁর শিক্ষণ-প্রক্রিয়ার ভেতরেই আছে। তাঁর এই শিক্ষণ-প্রক্রিয়াই একজন অভিনেতৃকে নির্মাণ করে, তাকে অনন্য সৃজন-শিল্পীতে পরিণত করে।
কী সেই নির্মাণ প্রক্রিয়া?
একজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে একটা স্কুলিং-এর ভেতর দিয়ে অবশ্যই যেতে হয়। এই স্কুলিং তাকে অভিনয়ের ব্যাকরণগত-দিক জানতে সাহায্য করে এবং সাধনার পথ বাতলে দেয়। আরেকটা দিক হলো মনোজাগতিক, যা তাকে অন্তর্দৃষ্টি দান করে, যার মাধ্যমে সে ভিন্ন এক মননের সন্ধান পায়। যুবদার স্কুলিং এই দুইয়ের এক অভাবনীয় মেলবন্ধন।
খালেদ খান মঞ্চে অভিনয়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। এই প্রস্তুতি অন্য অভিনেতা থেকে তাকে পৃথক করেছে। তিনি একজন অসাধারণ রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ছিলেন। রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিক-শিক্ষায় শিক্ষিত একজন শিল্পী। ‘ছায়ানট’-এ স্বয়ং ওয়াহিদুল হকের ছাত্র। একবার যুবদাকে বলতে শুনেছিলাম, ‘আমার বোধহয় গানটা নিয়েই থাকা উচিত ছিল’। অর্থাৎ গানের জন্য যে ব্যাকুলতা, তা তাঁর সারাজীবন ছিল। এই গান নিয়ে থাকলে কী হতো জানি না, তবে এই সংগীত-সাধনা তাঁর অভিনয়-জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। সংগীতের মূলে যে স্বর-সাধনা এবং সুর-সাধনা, তা তাঁকে মঞ্চে অভিনয়ের যে বেসিক, যাকে বলে কণ্ঠ-অভিনয় (vocal acting), সেটাতে অনন্য-উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর সময়ে এরকম কণ্ঠের-খেলা, এরকম মড্যুলেশন, এমন নানান স্কেলে স্বরগ্রামকে নিয়ে মঞ্চে এক মোহন-জাদুবাস্তবতা তৈরি করা কণ্ঠের মাধ্যমে, তা কেবল তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। এই কণ্ঠ-সাধনার সাথে যোগ হয়েছিল শুদ্ধ প্রমিত-উচ্চারণ। সেই ছায়ানট, সেই মানুষগুলোর সাহচার্য তাঁকে কেবল সুর-সাধনার পথে নিয়ে গেল না, শুদ্ধ প্রমিত বাংলা উচ্চারণের পথেও নিয়ে গেল। তাতে করে যেটা হলো, মঞ্চে একইসাথে শুদ্ধ বাংলা, স্কেলসমৃদ্ধ-কণ্ঠের ওঠানামা, অর্থপূর্ণ সংলাপ-প্রক্ষেপণক্ষম একজন অনন্য বাচিক-অভিনেতার জন্ম দিল। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ক্লাসিক নাটকগুলো তাঁর বাচিক-অভিনয়ের গুণে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। অচলায়তন, মুক্তধারা, দর্পণ, ঈর্ষা, রক্তকরবী নাটকের অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠল খালেদ খানের বাচিক-অভিনয়, তার সাথে তাঁর শ্রুতিমধুর গান। তাঁর সমসাময়িককালে আর কোনো অভিনেতৃ দর্শককে এভাবে অসাধারণ মোহাবিষ্ট করতে পেরেছিল কি?
শুধু বাচিক দিয়ে তো আর মঞ্চ-অভিনয় হয় না। তার সাথে থাকতে হয় অভিনেতৃর শরীর, তাঁর চলন। তাঁর হাত-পা, পুরো দেহ যখন কণ্ঠের সাথে মিলন-মোহনা তৈরি করে, তখনই একটা সম্পূর্ণ-চরিত্র মঞ্চে জীবন্ত হয়ে ওঠে। অচলায়তনর পঞ্চক, রক্তকরবীর বিশু, দর্পণর দর্পণ, ঈর্ষার যুবকÑসেরকম জীবন্ত মানুষ। এই মানুষগুলোর ভেতর শুধু রিয়ালিটি নেই, আছে আরও-কিছু। এই আরও-কিছুই খালেদ খানের সৃষ্টি, তাঁর অনন্য-সৃজন।
এ তো গেল ব্যাকরণগত-দিক। কিন্তু অন্তর্জগৎ! সেটা ছাড়া সবই তো অর্থহীন, অসম্পূর্ণ। চরিত্র-নির্মাণ তো কেবল ব্যাকরণ দিয়ে হয় না, তাকে রক্ত-মাংস দিতে গেলে হতে হয় সেই মননের-অধিকারী, যে মনন আধুনিক, বৈজ্ঞানিক, মুক্ত এবং মানবিক। এই মনন একদিনে তৈরি হয় না। পুরো-জীবন লেগে যায় এই অন্তর্ভেদী মনোজগত নির্মাণে। এই নির্মাণে অংশ নেয় ব্যক্তি স্বয়ং। তাকে প্রভাবিত করে পরিবার, তার চারপাশ, সমাজ-রাষ্ট্র। খালেদ খান যে পরিবার থেকে উঠে এসেছেন সেখানে সবাই সাংস্কৃতিক-বলয়ের মানুষ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় ছাত্র রাজনীতির সাথেও যুক্ত হয়েছিলেন। ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়ায় তাঁর মধ্যে রাজনীতি-সচেতন-মননের জন্ম হলো, জন্ম হলো বৈজ্ঞানিক-যুক্তিবাদ। তখনকার ছাত্র রাজনীতি, বিশেষকরে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি ছিল আধুনিক মার্ক্সীয় চিন্তাধারার অনুসারীদের পীঠস্থান। সেই আলোক তাঁকেও স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তাঁর হৃদয় আর মস্তিস্ক-জুড়ে ছিল শিল্প-সৃষ্টির তাড়না। রাজনীতির জটিল সমীকরণ ছেড়ে তাই সে পুরোপুরি আত্মনিবেদিত হলেন শিল্পের-জগতে। নাটক নয়, সংগীতে। বৃহত্তর ‘ছায়ানট পরিবারে’। ডুব দিলেন রবীন্দ্রনাথের অতল সাগরে। মিশে গেলেন সংগীতের শুদ্ধতম-চর্চার সাথে। ওয়াহিদুল হক, সানজিদা খাতুনÑএসব সাধকের সংস্পর্শে এসে তাঁর ভেতরে এক মুক্ত-মানুষের জন্ম হলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অন্তর্চক্ষু দান করলেন। বন্ধু হিসেবে পেলেন সংগীতের এক মহাগুণী শিল্পী মিতা হককে। যে বন্ধুত্ব জীবনের শেষদিন-পর্যন্ত থাকল। যে বন্ধুত্ব একটা ঘর পেল, সংসার পেল। দুই শিল্পী দুজন দুজনকে জল দিল, হাওয়া দিল। দুজন দুজনকে এক নবতর জীবন দান করল। আমরা পেলাম দুজন অনন্য-সৃজন-কারিগর। মিতা হক এবং খালেদ খান।
যুবদার জন্মদিন ছিল সেদিন। আমরা সবাই রিহার্সেল শেষে গোল হয়ে বসেছি যুবদাকে শুভেচ্ছা জানাবো বলে। উপস্থিত হলেন আলী যাকের। প্রত্যেকের কথা বলা শেষে যুবদা যখন বলতে লাগলেন, তখন আমরা তঁকে ভীষণ আবেগতাড়িত হয়ে উঠতে দেখলাম। তিনি বললেন আলী যাকেরের উদ্দেশে- ‘ছটলুভাই (আলী যাকের) আমাকে নির্মাণ করেছেন’। দেখি দুজনের চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে এক অভাবনীয় দৃশ্য! আমরা নির্বাক! রিহার্সেল রুমে পিনপতন নীরবতা। কেন যুবদা এটা বললেন? বললেন কারণ, আলী যাকেরের মতো মুক্ত-মন, বিশাল-হৃদয়, অনন্য-প্রতিভা, ক্ষণজন্মা মানুষের স্নেহ-ভালোবাসা, অগাধ-পাণ্ডিত্যের সংস্পর্শে এসে খালেদ খান শিল্পী হতে পেরেছিলেন। শুধু আলী যাকের কেন, আতাউর রহমানও তাঁর বিশালতা-দিয়ে যুবদাকে ছায়া দিয়ে গেছেন শেষদিন-পর্যন্ত। এই কথাগুলো এখানে বলা আবশ্যক, কারণ, একজন মানুষের শিল্পী হয়ে ওঠবার জন্য দরকার সেইরকম মানুষের সান্নিধ্য, দরকার সেইরকম একটা সংগঠন- যেখানে শিল্প আর শিল্পীর জন্ম হবে। আমি বিশ্বাস করি, একটা দলে একজন ভালো অভিনেতৃর জন্ম হবে তখনই, যখন সেখানে একাধিক ভালো অভিনেতৃ থাকবে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় শুধু ভালো অভিনেতৃর মিলন-মোহনা ছিল না, স্বাধীনতার পর থেকে সবচেয়ে প্রগতিশীল, মুক্ত-চিন্তার ধারক শিল্পী এবং বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চায় আত্মনিয়োগ করেছে, এরকম একদল মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল এই নাট্যদলে। তরুণ খালেদ খান ১৯৭৮ সালে যখন নাগরিকে যোগ দেন, তখন এই মানুষগুলোর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে তৈরি হয়েছিল তাঁর মনোজগৎ। এই মনোজগৎ তাঁকে করে তুলেছিল শিল্পী, তিনি অনন্য-সৃজন-স্বাতন্ত্র্যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিলেন। আজকাল থিয়েটারগুলোয় সেরকম মানুষের সমাবেশ নেই। নেই সেই বুদ্ধিবৃত্তিকচর্চা। আর সে কারণে শিল্পী হয়ে ওঠা হয় না কারো। এমনকি ভালো অভিনেতৃও খুঁজে পাওয়া ‘সোনার পাথরবাটি’র মতো আজকাল।
একটা বিষয় অভিনেতৃর ক্ষেত্রে খুব আলোচিত হতে দেখা যায়- স্টালাইজেশন এবং নেচারাল অ্যাক্টিং। আমরা সকল অভিনেতৃকেই এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলি, এবং যার যার মতো করে সমালোচনা করতে থাকি। এক্ষেত্রে যুক্তির ধারে কাছে না গিয়ে নিজের ভালোলাগা, মন্দলাগা অভিনেতৃর উপর অযাচিতভাবে প্রয়োগ করি। খালেদ খানের অভিনয়-স্বাতন্ত্র্যকে বিশ্লেষণ করতে গেলে এই বিষয়টা এসে যাবে বিধায় তা অবতারণা করলাম।
খালেদ খান স্টালাইজড-অভিনেতা ছিলেন, নাকি নেচারাল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা এই দুই ধারা নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে পারি। আচ্ছা, উৎপল দত্ত কেমন অভিনয় করতেন? একবার কল্পনা করুন। মঞ্চে তাঁর একটাই নাটক ভিডিও পাওয়া যায়- ব্যারিকেড। আর টিনের তলোয়ার পাওয়া যায় অডিওতে। এছাড়া মঞ্চে তাঁকে বুঝবার আর কোনো পথ অন্তত বক্ষমাণ-নিবন্ধকের প্রজন্মের কারো নেই। যা আছে তা হলো অসংখ্য বাণিজ্যিক-চলচ্চিত্রে এবং সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষ এঁদের পরিচালনায় কিছু চলচ্চিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয় দেখার অভিজ্ঞতা।
বাণিজ্যিক-ধারাগুলোকে তর্কের-খাতিরে বাদ দিয়ে, উপরে স্মরণ-করা পরিচালকদের ছবিতে তাঁর অভিনয় নিয়ে একটু ভাবি। ‘হীরক রাজা’ কি নেচারাল অভিনয়? ভুবন সোম? হোসেন আলী? বাদ দেন। শেষ ছবি-আগন্তুক-এ? যেখানে সম্পূর্ণ নেচারাল গল্প, সেখানে কি তিনি তাঁর স্টাইলের বাইরে এলেন? এই যে এলেন না, তাতে করে কি কোথাও আমাদের মনে হচ্ছে এটা গ্রহণযোগ্য না, চরিত্রগুলো এভাবে কথা বলবে না? না, মনে হয় নি। বরং তিনি তাঁর অভিনয়-ক্ষমতা দিয়ে তাঁর স্টাইলকেই আমাদের কাছে চরিত্রের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করে ছাড়লেন। আর এটাই হলো স্টালাইজড অভিনেতৃদের দক্ষতা। তাঁরা চরিত্র এমনভাবে নির্মাণ করবেন যে, মনে হবে এটাই নেচারাল অ্যাক্টিং। তবে স্টাইলের বাড়াবাড়ি চরিত্রকে হত্যা করে অনেক সময়- সেই পরিমিতিবোধ একজন অভিনেতৃকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে।
যাঁরা স্টালাইজড-অভিনয় করতে পছন্দ করেন, তাঁদের মধ্যে ব্রেখটীয় অভিনয়রীতির অনুসরণ করতে দেখা যায়। সম্ভবত এই ধারায় অভিনেতৃকে একটা স্বাধীনতা দেয় চরিত্রটাকে চরিত্রের ভেতরে না গিয়ে বাইরে থেকে দেখার। স্টালাইজড-অভিনেতৃ নিজের স্টাইলের মধ্যে থেকে চরিত্রের ভেতরে প্রবেশ করেন এবং নিজেই তাকে নিয়ে খেলতে থাকেন। এই খেলাটাই একটা সময় চরিত্রে পূর্ণতা পায়। বিষয়টা খুব জটিল। নেচারাল অভিনেতৃ এই জটিলতার ভেতর দিয়ে যান না। তাঁরা চরিত্রের প্রতি পূর্ণবিশ্বস্ত থেকে একটা বাস্তব-প্রতিবিম্ব দাঁড় করাতে চান। এটাকে অনেকে undertone বা underacting বলে থাকেন। এই মাটির কাছাকাছি অভিনয় দর্শকের মনে দাগ কাটে সহজে এবং এটা খুবই কঠিন। স্টালাইজড-অভিনয় অতি-অভিনয়ের দোষে দুষ্ট হয়ে যেতে পারে। আবার একই ধরনের (পৌনঃপুনিক) অভিনয় মনে হতে পারে । অনেকেই ভাবতে পারেন এই অভিনেতৃর অভিনয় একবার দেখলেই হয়, বারবার দেখার দরকার নেই। এটা মনে হওয়া অমূলক নয়, যদি না বিষয়টাকে সূক্ষ্ম জায়গা থেকে দেখি। নেচারাল-অভিনয় আপনাকে বাস্তবকে আপনার সামনে সেরকম করেই প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু নতুন কিছু দেখাতে পারবে না। দিতে পারবে না চরিত্র বা নাটকের ভিন্ন কোনো চেহারা বা ব্যাখ্যা। স্টালিজড-অভিনেতৃর হাতে সে সুযোগ অবারিত। সে ভাঙবে, গড়বে, দর্শককে বলে দেবে- আমি একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী। আমি যে চরিত্রটা করছি সেটা এই, তাকে যেরকম আপনি দেখেন, সে আপনার দেখার চাইতে ভিন্নতর কিছু।
স্টালাইজড-অভিনেতৃর একটা ‘সিগনেচার মার্ক’ থাকে। হতে পারে সেটা সংলাপ-বলার-ভঙ্গি, হতে পারে শারীরিক-প্রকাশভঙ্গি। অর্থাৎ, একটা ম্যানারিজম সে আয়ত্ব করে। উদাহরণ, পশ্চিমবঙ্গের অভিনেতা গৌতম হালদার। তাঁর অভিনয় এতটাই স্বতন্ত্র যে, তাঁর ম্যানারিজমগুলো নিয়মিত-দর্শক আগেই বলে দিতে পারবেন। সেটাকে তাঁর দুর্বলতা বলতে পারেন কেউ। কিন্তু আপনি যদি তাঁর কয়েকটা নাটক দেখেন, কয়েকটা ভিন্ন-চরিত্রে তাঁর অভিনয় দেখেন, লক্ষ্য করবেন, তিনি চেনা-পথ ধরে আপনাকে নিয়ে ভ্রমণ করবে, কিন্তু শেষে ভেড়াবেন কোনো এক অচেনা-বন্দরে। মেঘনাদ বধ কাব্যে একক-অভিনয়ে বর্ণনারীতির পাশেপাশে যখন নানা চরিত্র আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়, আমরা তাদের পুরোটাই দেখতে পাই, আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, অথবা তিনি তাঁর বৈচিত্র্যময়-প্রতিভার (কণ্ঠ, সংগীত, সংলাপ, শরীর) দ্বারা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন। স্টালাইজড অভিনেতা-অভিনেত্রী তাই, আপনাকে বাধ্য করবে বিশ্বাস করতে। তাঁরা দর্শককে নিয়ন্ত্রণ করেন, নিয়ন্ত্রিত হন না। এবার যদি প্রশ্ন করি, এই মেঘনাদ কাব্য কি নেচারাল স্কুলিং-এ অভিনয় করা সম্ভব? করতে গেলে তার আয়োজন কতটা ব্যাপক হতে হবে- একবার ভাবুন তো। অথচ, একজনমাত্র অভিনেতা সংগীতদলের সাহায্য নিয়ে কী অবলীলায় আমাদের মোহিত করে ফেলেন। এটাই এঁদের ক্ষমতা! এই ক্ষমতাকে ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। তঁর অভিনীত অন্য-চরিত্রগুলো যদি দেখেন, তবে লক্ষ করবেন, তাতে হয়ত অভিনেতা হিসেবে গৌতম হালদারকে আমরা দেখি, কিন্তু শেষমেষ তা সকলি ভিন্নভিন্ন মানুষ। যদি খুব খেয়াল করে দেখেন, তবে দেখবেন, নেচারাল-অভিনেতৃ যাঁদের আমরা বলি, তাঁদেরও একটা স্টাইল আছে। স্টাইল ছাড়া অভিনয় হয় না।
বিষয়টা নিয়ে একটা ডায়লগ বা আলোচনা করার সুযোগ হতে পারে। অবশ্য, এখন মঞ্চে পড়াশোনা করে অভিনয় করার দরকার হয়ত নেই। ‘ফেসবুক’ এর মতো একটা ‘দানব’ তো আছেই। এখানে আমড়া কাঠ আর সেগুন কাঠ একই দরে বিক্রি করা যায়। তথাকথিত ‘বন্ধু’ আর ‘লাইক’ আপনাকে বিশাল কিছু বানিয়ে দেবে এক লহমায়। শুধু একটু যোগাযোগÑব্যাস, কম্মো সাবাড়! কে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে, দেখে, শিখে মঞ্চে দাঁড়াতে যায়!!! যেখানে শ’খানেক ‘লাইক’ আপনাকে যুগ-শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বা অভিনেত্রী কিংবা নির্দেশক বানিয়ে দিতে প্রস্তুত, তার বাইরে আর কোনো অধ্যাবসায়ের কী প্রয়োজন আছে!
এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই। খালেদ খানের অভিনয়কে আমরা স্টালাইজড-অভিনয় বলব কি না। একান্তই আমার মতে, তিনি একজন ক্লাসিক স্টালাইজড-অভিনেতা। তিনি চরিত্রকে প্রথমে কণ্ঠে ধারণ করতেন, তারপর তাঁর বাচিক-অনন্যতায়, তারপর শরীরে এবং তারপর মঞ্চের অনুষঙ্গে। ঈর্ষা নাটকে ‘যুবক’ চরিত্র যখন সংলাপের একেবারে পিকে অবস্থান করছেন, তখন বোঝা যায়, এটা খালেদ খানের স্টাইলের পথ বেয়ে চরিত্রের মূর্ত-বাস্তবতায় এসে পৌঁছল। সে এক মুহূর্ত! সে এক জাদুবাস্তবতা! এখানে স্টাইল আছে, আছে এক বাস্তব-তরুণের অবাস্তব-প্রতিবিম্ব। সবচেয়ে বেশি আছেন খালেদ খান স্বয়ং, নিজের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে।
খালেদ খান যে স্টালাইজড অভিনেতা ছিলেন সেটা মঞ্চে তাঁর আরেকটা ভূমিকা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। নির্দেশকের ভূমিকায় খালেদ খান। একজন নির্দেশক সাধারণত দৃশ্য-নির্মাণে এবং নাটকনির্মাণে তাঁর নিজ-বিশ্বাস এবং দর্শনের প্রয়োগ ঘটাতে চান। আর যদি সেই নির্দেশক একজন নিজস্ব-সৃজনধর্মী অভিনেতা হয়ে থাকেন, তবে তিনি অবশ্যই চাইবেন তাঁর অভিনেতৃরাও তাঁর অভিনয়রীতি অনুসরণ করুক। খালেদ খানও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমি তাঁর নির্দেশিত কালসন্ধ্যা নাটকে প্রথমে ‘ব্যসদেব’ চরিত্রে, পরে মূল-চরিত্র ‘কৃষ্ণ’ হয়ে মঞ্চে উঠেছিলাম ২০০৫ সালে। এর আগে এবং পরে তাঁর পরোক্ষ-নির্দেশনায় অভিনয় করেছি। রক্তকরবী, নাট্যত্রয়ী (রবীন্দ্রনাথের তিনটা কবিতার অভিনয়) নাটকে নির্দেশক আতাউর রহমানের পাশে পাশে আমাদের চরিত্র-নির্মাণের মূল-কাজটা করেছিলেন খালেদ খান। আমি সেই অভিজ্ঞতার আলোকে দেখব, একজন অভিনেতা-নির্দেশক খালেদ খান কেমন ছিলেন।
কালসন্ধ্যা নাটকের রচয়িতা বুদ্ধদেব বসু। গল্পটা মহাভারতের চরিত্রদের নিয়ে। দ্বাপর যুগের অবসানে যখন চারিদিকে অন্যায়, অরাজকতা নেমে এল, অর্জুনের গাণ্ডিব ব্যর্থ হলো, তিনি পরাজিত হলেন। কৃষ্ণ অসহায়ের মতো দেখতে লাগলেন যদু বংশ আর দ্বারকা নগরীর পতন। তখনকার এক নিয়তির অবশ্যম্ভাবিতার গল্প আমাদের বলেন বুদ্ধদেব বসু। যখন কৃষ্ণ বলেন- যা আছে তা চিরকাল ধ্বংসের অতীত, যা নেই তা কোনোকালে ছিল না। তখন আমাদের সামনে সেই এপিক ধরা দেয়, যা আমাদের বলে একমাত্র সময় সত্য, বাকি আর সব সময়ের গর্ভে বিলীন চিরকালীন অনস্তিত্ব। নাটকটা কাব্য ভাষায় লেখা। মহাভারতের সংস্কৃত শ্লোকের ছন্দ মিশ্রিত এক দুরূহ বাক্য-বিন্যাসে লেখা। মূল চারটা চরিত্রের সাথে রয়েছে অসংখ্য নগরবাসী। রয়েছেন মহাভারতের স্রষ্টা ব্যসদেব। যুবদার এই দুরূহ নাটকটা বেছে নেয়া প্রমাণ করে তাঁর মনন এবং দর্শন। যে খালেদ খান ক্লাসিকের মধ্যে বড় হয়েছেন, তিনি বেছে নিলেন মহাভারতের প্লট-নির্ভর এক চিরকালীন এপিক। এর আগে তিনি নাগরিকে রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা, নাসরিন জাহানের স্বপ্নবাজ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন। নাগরিকের বাইরে ইবসেনের মাস্টার বিল্ডার, ডলস হাউস (পুতুল খেলা), রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ ক্ষুধিত পাষাণ, নাসরিন জাহানের রূপবতী নির্দেশনা দিয়ে ফেলেছেন। মানে সবগুলোই ক্লাসিক। কিন্তু এবার তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেলেন। ভেঙে দিলেন দৃশ্যের স্থবিরতাকে। বাচিক-অভিনয়ের সাথে এবার শরীর আর ক্লাসিক কোরিওগ্রাফের মাধ্যমে মঞ্চে মূর্ত হলো দ্বারকার ধ্বংসলীলা, মানুষের অবক্ষয়, সত্য আর ন্যায়ের পরাজয়। অর্জুন আর কৃষ্ণ অসাধারণ দার্শনিক-সংলাপের ভেতর দিয়ে আমাদের বলে চলেন জীবনের লক্ষ্য আর তার চূড়ান্ত পতনের কাহিনি। বলেন এসবই তো হবার কথা ছিল। যা ঘটছে তাই সত্য। আমি, তুমি, এই দ্বারকাবাসী- সব মিথ্যে। আমরা নড়ে চড়ে বসি। একদল তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীর সামনে তিনি চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। এই চ্যালেঞ্জ এক তীক্ষ্ম, দুর্বোধ্য কাব্য-সংলাপ-উচ্চারণে, সুকঠিন অর্থপূর্ণ শরীরী-অভিনয়ে। আমরা পরিচিত হই এক অভিনব-দর্শনের সাথে। আগেই বলেছিলাম, অভিনয় কেবল ব্যাকরণগত বা জন্মগত কিংবা চর্চিত-প্রতিভা নয়, অভিনেতৃকে হতে হয় এক সুতীক্ষ্ম আধুনিক বন্ধনহীন মনোজগতের অধিকারী। যার তা নেই, সে অসম্পূর্ণ, সে পুত্তলিকা মাত্র, এর বেশি কিছু নয়। যুবদা এবং নাগরিক তার সেই সময়ের মানুষদের একটা সম্পূর্ণ অভিনেতৃ করতে চেয়েছিলেন, অনেকে তা হতেও পেরেছেন।
যুবদা যখন রিহার্সেল করাতেন, তখন প্রথমেই জোর দিতেন সংলাপ-প্রক্ষেপণে। সে এক মহাসংগ্রাম। তিনি নিজে যেহেতু বাচিক-অভিনয়ের এক মূর্তিমান-প্রতিভু, তাই যতক্ষণ আমাদের সংলাপ তাঁর চাওয়ার অন্তত কাছাকাছি না যেত, ততক্ষণ সেই সংগ্রাম চলতেই থাকত। তবে আনন্দের বিষয় হচ্ছে, সেই সংগ্রাম কোথাও ক্লান্তি নিয়ে আসত না, নিয়ে আসত বাচিক-অভিনয়ের এক অচেনা বন্দরের নিশানা, তাকে ছুঁতে চাওয়ার তৃষ্ণা। তাকে পেয়ে গেলে অনির্বচনীয় আনন্দ, শান্তি! আজ এত বছর পর সেকথা লিখতে গিয়ে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। কারণ, সেই সংগ্রাম কিছু ব্যতিক্রম উদাহরণ ছাড়া, আজ আর কোথাও নেই। নেই তৃষ্ণা জাগানোর মতো কেউ, নেই শিল্পের সেই চিরশান্তি, চিরসুখের ক্ষণ। আছে কেবল পিঠ চাপড়ানো, অশুদ্ধ উচ্চারণে, অর্থহীন সংলাপ-প্রক্ষেপণে মঞ্চে দাপাদাপি।
যুবদা তিনটা ধাপে চরিত্র-নির্মাণে আমাদের এগিয়ে নিতেন। প্রথম ধাপে চরিত্রকে কণ্ঠে এবং বাচিকে ধারণ। তবে কণ্ঠে বলতে স্বরযন্ত্রের প্রকৃত ব্যবহার। এটা আমরা শিখেছিলাম যুবদার কাছ থেকে। আমরা প্রায় সকলে জানতাম যে, কণ্ঠ থেকেই সব সংলাপ বলতে হবে। যুবদা দেখালেন কীভাবে বাতাসের ব্যবহার করে স্বরযন্ত্রের প্রতিটা অঙ্গ থেকে কণ্ঠে শব্দ ধারণ করে তা প্রক্ষেপণ করা যায়। কীভাবে মঞ্চে সংলাপ বললে, তা গলার উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলবে না, যেন গলা বসে যেতে না পারে। কীভাবে সংলাপ বললে তা মিলনায়তনের শেষপ্রান্তে বসা দর্শকের কাছে পৌঁছবে, অথচ তা কোনোভাবেই চীৎকার মনে হবে না। অনেকে আমরা মহিলা সমিতির আদিকালের সাউন্ড সিস্টেমের কারণে চীৎকার করে সংলাপ বলতাম। যুবদা আমাদের রিহার্সেলে সবাইকে শ্বাসযন্ত্রের ব্যায়াম শেখালেন। আমরা জানলাম মঞ্চে এই যে সহজভাবে একের পর এক সংলাপ সাবলীল-ভঙ্গীমায় বলে যাওয়ার পেছনে দক্ষ-অভিনেতৃর কতটা পরিশ্রম কাজ করে। তিনি যেহেতু সংগীতের ছাত্র ছিলেন, তাই আমাদের সারগাম করার কৌশলগুলো শেখাতেন। এই সারগাম একজন অভিনেতৃকে স্বরগ্রামের নানা স্কেলে সংলাপ ওঠানামা করতে সাহায্য করে।
দ্বিতীয় ধাপে চরিত্রটাকে শরীরে বা বডি ল্যংগুয়েজে ধারণ করা। মানুষটা কীভাবে চলবে, শরীরের কোন অঙ্গগুলো চালনা করতে হবে, কীভাবে সংলাপ এবং শরীরের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপিত হবে- এসব নিয়ে কাজ হতো অনেকদিন। অনেকে সংলাপ বলেন, কিন্তু তার শরীর কথা বলে না। মঞ্চে শরীর কথা না বললে তা বিশ্বাসযোগ্য হয় না, কারণ দর্শক একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষকে দেখে। আর প্রত্যকেটা চরিত্রের শরীরী-ভাষা অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন।
তৃতীয় ধাপে আগের দুই ধাপের চরিত্র-নির্মাণকে এবার গল্পের সাথে, দৃশ্যকল্পের সাথে, নাটকের গতি এবং তার অন্তিম-লক্ষ্যের সাথে মালা-গাঁথার-পালা। এখানে এসেই আসলে তিনি মূল-কাজটা করতেন। আমাদের চরিত্রের শাখা-প্রশাখা মেলতে শুরু করত। প্রতিদিন নতুন নতুন দিক উন্মোচিত হতো। এমনও হয়েছে, আগেরদিন যেভাবে সংলাপের ডেলিভারি দিয়েছিলাম, তা-ও অনেক সংগ্রামের পর, পরেরদিন সেই ডেলিভারি আর গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। নতুন করে আবার, পরেরদিন আবার। এতে করে যেটা হতো, মঞ্চে গিয়েও আমরা নানানভাবে ডেলিভারি দিতে পারতাম।
যুবদাকে দেখেছি, অনেক সময়েই, একদিনের শো-এর সাথে আরেকদিনের শো-এর অভিনয় মিলছে না। অনেক জায়গায় অন্যরকম ডেলিভারি। আজ বুঝতে পারি, যুবদা একেকদিন একেকভাবে আমাদের দিয়ে সংলাপ বলিয়ে আমাদের মধ্যেও এরকম বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতেন। আমরা আমাদের সাধ্যমতো সেটা অনুসরণ করতাম। কখনও সফল হতাম, কখনও হতাম না। আজও মঞ্চে দাঁড়ালে সেটা অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
খালেদ খান আসলে নিজেকেও এই তিনটা ধাপে প্রস্তুত করতেন। তিনি অনেক বেশি ক্যাল্কুলেটিভ-অভিনেতা ছিলেন। স্টালাইজেশনকে তিনি ব্রেখট এবং সনাতন-পদ্ধতির মিশেলের মাধ্যমে নিজস্ব উপায়ে নিজস্ব-সৃজনে, অনন্য করে তুলেছিলেন। তাঁর অভিনয় স্টালাইজেশনের মধ্যে থাকলেও আপনি আগে থেকে বলতে পারবেন না আজকের নাটকে বা আজকের প্রদর্শনীতে আমরা কোন খালেদ খানকে দেখব, আজ অভিনয়ে নতুন কোন সংযুক্তি ঘটবে। এখানেই অভিনেতা খালেদ খানের সার্থকতা। এখানেই তাঁর অভিনয়-স্বাতন্ত্র্য।
খালেদ খানের অভিনয়-সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলব না। শুধু একটা মজার কথা দিয়ে শেষ করব। রক্তকরবী নাটকে যুবদা ‘বিশু’ চরিত্রে অভিনয় করতেন। নাটকে তাঁকে সবাই বলত বিশু পাগল। প্রথম এবং দ্বিতীয় প্রদর্শনী পরপর দুদিন ছিল। আমি এক বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে বসে চা খাচ্ছি। এক ছাত্র যে আগের দিন শো দেখেছে , সে তার বন্ধুর সাথে রক্তকরবী নিয়ে কথা বলছে। তার কথাটা ছিল এরকম- ‘কাইল রক্তকরবী দেখলাম। খালেদ খান করল বিশু পাগল। কিন্তু তার অভিনয়ে তো পাগলের মতন কিছু দেখলাম না। ভালো মানুষ। গান গায় আর ডায়লগ দেয়’। পরদিন রিহার্সেলে যুবদাকে বললাম সে কথা। যুবদা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন- ‘কস কী! তাইলে এক কাজ করি, পরের শোতে ছালা পিন্দা নামি’। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। যুবদার সেন্স অব হিউমার অনেক সূক্ষ্ম ছিল। আমরা প্রায়শই তাঁর কাছে নানান মজার কথা, ঘটনা শুনতাম। আর যখন আতাভাই এবং যুবদার একসাথে আড্ডা শুরু হতো রিহার্সেল শেষে, তা হয়ে উঠত এক অসাধারণ মুহূর্ত। আমরা সেন্স অব হিউমারের চূড়ান্তরূপ দেখতাম এ দুজনের বাক্যবানে। কোথায় গেল সেসব দিন!!!
যুবদা অসুস্থ হবার পর আমাকে রক্তকরবীতে তাঁর চরিত্র করতে বলা হয়। যুবদাই করতে বলেন। তিনি মঞ্চে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। তাই দর্শকের সাথে অসততা করতে চান নি। আমি তাঁর অভিনীত চুয়াত্তরটা শো এবং দীর্ঘ রিহার্সেল তাঁকে কাছ থেকে দেখে সাহস করে মঞ্চে দাঁড়াই। তেত্রিশটা শো করি। যারা দেখেছেন তারা নানান মন্তব্য করেছেন। আমি সব মাথা পেতে নিয়েছি। প্রশংসা, কটুবাক্য, তির্যকবাণী- সব। কিন্তু যুবদার প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার সাধ্যমতো করে গেছি। দর্শকের সাথে, নাটকের সাথে, দলের সাথে, নির্দেশকের সাথে কোনো-ধরনের প্রতারণা করি নি। একজন বলেছিলেন- ‘যুবদার মতো হচ্ছে না’। আমি তাকে বলেছিলাম, প্রতিটা মানুষ যেমন স্বতন্ত্র, প্রতিটা অভিনেতা-অভিনেত্রীও স্বতন্ত্র। আমি খালেদ খান নই। খালেদ খান হতেও পারব না। কারণ, খালেদ খান হওয়া যায় না। খালেদ খান জন্মায়।
আমি বিশ্বাস করি, শিল্পী ক্ষণজন্মা। শিল্পী গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না। প্রতিভার জন্ম হয়। তারসাথে চর্চা এবং পরিবেশ তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, পূর্ণমাত্রায় বিকশিত করে। একজন খালেদ খান জন্মেছিলেন। আবার কোনোদিন কেউ হয়ত জন্মাবেন অথবা জন্মেছেন। যাঁকে দেখে আমরা বা ভাবীকালের দর্শক বলবেন, মঞ্চে আরেকজন খালেদ খান এলেন।
ক্ষমা করবেন যুবদা। আপনাকে নিয়ে, আপনার অভিনয় নিয়ে আমি কথা বলার স্পর্ধা দেখালাম। এই স্পর্ধা আপনার কাছ থেকেই শেখা। আপনিই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন, সেই শেখানোকে সম্বল করে আজও মঞ্চে উঠি। যতদিন তা পারব, ততদিন আপনি আমার এবং আমার মতো অনেকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।
কিংবদন্তি-প্রতিভাধর অভিনেতা-অভিনেত্রী এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বেঁচে থাকে।
রাজীব দে (
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
): মঞ্চশিল্পী