Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

পরিশীলিত অভিনয় : প্রসঙ্গ মোহাম্মদ জাকারিয়া

Written by রামেন্দু মজুমদার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

মোহাম্মদ জাকারিয়া। তাঁর বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার সূচনাকালের সাথে জড়িত থাকার। মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বিজন ভট্টাচার্য, গঙ্গাপদ বসু, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কলিম শরাফী প্রমুখ যখন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র রাজনৈতিক বেড়াজালের বাইরে এসে নাটকের দল ‘বহুরূপী’ প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন কলিম শরাফী দলে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর তরুণ সহকর্মী মোহাম্মদ জাকারিয়াকে। প্রথম থেকেই মোহাম্মদ জাকারিয়া ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়লেন বহুরূপীতে। দলের প্রথম কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছিলেন তিনি।

১৯৪৮ সালে বহুরূপীর প্রথম নাটক নবান্ন-এ অভিনয় করেছেন মোহাম্মদ জাকারিয়া। তারপর থেকে তাঁর কেবলই ছুটে চলার পালা। বহুরূপীর পথিক, উলুখাগড়া, ছেঁড়াতার, দশচক্র, এই তো দুনিয়া, ধর্মঘট, রক্তকরবী, সেদিন বঙ্গলক্ষ্মী ব্যাঙ্কে, অংশীদার, ডাকঘর- এসব নাটকে অভিনয় করে তিনি দর্শকনন্দিত হয়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় নাট্যোৎসবে রক্তকরবী নাটকে ফাগুলাল চরিত্রে অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন।

১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) এর ‘থিয়েটার সেন্টার’-এ পেশাদারভিত্তিতে চারটি নাটকে অভিনয় করেন।

১৯৬৪ সালে মোহাম্মদ জাকারিয়া এদেশে এসে জহির রায়হানের সাথে চলচ্চিত্রে যুক্ত হন। বাহানা, বেগানা, বেহুলা প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ তে স্থায়ীভাবে থাকার জন্যে এদেশে চলে আসেন। কলিম শরাফী তখন ঢাকা টেলিভিশনের অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ। তাঁরই আগ্রহে জাকারিয়া সাহেব টেলিভিশনের চাকুরিতে যোগ দেন।

১৯৭২ সালে যখন আমরা নাট্যদল ‘থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করলাম, তখন আবদুল্লাহ আল-মামুনের আহ্বানে তিনি থিয়েটারে যোগ দেন। অভিনয় ছাড়াও দীর্ঘদিন থিয়েটারের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।

থিয়েটার-এর প্রথম প্রযোজনা কবর থেকে শুরু করে দশটি নাটকে তিনি অভিনয় করেছিলেন। পরের নাটকগুলো হচ্ছে- সুবচন নির্বাসনে, চারদিকে যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দুই বোন, সেনাপতি, ওথেলো, এখানে এখন, ম্যাকবেথ আর এখনও ক্রীতদাস।

কর্মস্থলে তাঁকে সবাই দাদা ডাকত। আমাদের থিয়েটারে এসেও তিনি হয়ে গেলেন সবার ‘দাদা’। তবে তাঁকে আমরা শ্রদ্ধা করতাম পিতার মতোই। বহুরূপীর আদর্শ তিনি জীবনভর অনুসরণ করেছেন। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার উপর বেশি জোর দিতেন তিনি। বাচিক-অভিনয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন। কারও বিন্দুমাত্র উচ্চারণত্রুটি তিনি সহ্য করতে পারতেন না।

১৯৭৪ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমিতে থিয়েটার-এর প্রথম প্রযোজনা মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে ইন্সপেক্টর হাফিজের চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেন। চরিত্রটির নানা বাঁক তিনি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলেন। আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে নাটকে আদর্শবাদী একজন স্কুল শিক্ষকের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় এখনও চোখে ভাসে। সংলাপের প্রত্যেকটি শব্দ উচ্চারণ করতেন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে। জীবনে যেসব আদর্শকে সত্য বলে মেনেছেন, তা তাঁর ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে যেতে দেখে তাঁর ভেঙে পড়ার দৃশ্যে দর্শকহৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠত।

চারদিকে যুদ্ধ নাটকে তিনি এক ক্ষমতাবান বস্-এর চরিত্রে অত্যন্ত পরিশীলিত অভিনয় করেন। বাচিক-অভিনয়ের সাথে তাঁর চলাফেরায় ছিল একজন উচ্চবিত্তের মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়-এ পীর সাহেবের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় ছিল মঞ্চনাটকে একটি মাইলফলক। আমাদের ধারণা ছিল আঞ্চলিক সংলাপে অনভ্যস্ত তাঁর পক্ষে চরিত্রটির সংলাপ বলতে হয়ত অসুবিধা হবে। কিন্তু কী অপূর্ব দক্ষতার সাথে তিনি সেসব সংলাপ বলে চরিত্রটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলেন। এখনও কানে বাজে তাঁর পুথি পড়ার সুর।

রবীন্দ্রনাথের দুইবোন নাটকে তিনি মথুরদা চরিত্রে অভিনয় করেন। সহ-শিল্পী হিসেবে ফেরদৌসী মজুমদারের সাথে তাঁর একটি চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। মঞ্চনাটকে ফেরদৌসীর বাবা এবং দাদা- দুটো ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন সাবলীল। মথুরদা চরিত্র রূপায়ণেও সেটি ফুটে উঠেছিল।

সেনাপতি নাটকে তিনি অভিনয় করতেন সখের প্রদীপ আহরণকারীর ভূমিকায়। নাটকের শুরুর দৃশ্যে নাটকটির একটি পটভূমি নির্মাণ করে এই চরিত্রটি। একটি হ্যারিকেন হাতে নিয়ে পর্দার সামনে খুবই স্বাভাবিক অভিনয় করতেন তিনি। নাটকের শেষেও তাঁর একটি সংলাপ ছিল।

ওথেলো নাটকেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। এখানে এখন-এ তিনি করতেন সাদা বেশধারী কোরাসের ভূমিকায়। তাঁর কণ্ঠস্বর আলাদা করে চিহ্নিত করা যেত। পরের দিকে শরীর খারাপের কারণে বড় চরিত্রের বোঝা তাঁর পক্ষে আর টানা সম্ভব ছিল না। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ ও ‘থিয়েটার’-এর যৌথ প্রযোজনা ম্যাকবেথ-এ তিনি করতেন চিকিৎসকের একটি ছোট ভূমিকায়। কিন্তু তাতেই জানান দিতেন তিনি কত বড় অভিনেতা। তাঁর অভিনীত শেষ-নাটক এখনও ক্রীতদাস-এ করতেন প্রোডাকশান ম্যানেজার তালেব মিয়ার চরিত্র। একটিই দৃশ্য। এক কথায় অসাধারণ! তিনি অসুস্থ হয়ে যাবার পর আমি সে চরিত্রতে অভিনয় করতাম।

আমাদের সৌভাগ্য, এমন বড়-মাপের অভিনেতার সাহচর্য আমরা পেয়েছিলাম। ‘ভালো অভিনেতা হতে হলে ভালো মানুষ হতে হয়- এ কথাটা প্রায়ই তিনি আমাদের বলতেন।

রামেন্দু মজুমদার ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ) : নাট্যব্যক্তিত্ব