Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

মোহাম্মদ জাকারিয়া : নাট্যক্রিয়ায় যিনি জেগে আছেন

Written by মামুনুর রশীদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

মোহাম্মদ জাকারিয়া তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে এসেছিলেন গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। কলকাতায় থাকাকালীন তিনি প্রখ্যাত নাট্যবোদ্ধা শম্ভু মিত্রের ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে কাজ করতেন। শম্ভু মিত্রের নেতৃত্বে ‘বহুরূপী’র প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যও ছিলেন তিনি। সেই সময়ে তিনি দার্শনিক-অভিনেতা মহর্ষি মনোরঞ্জনের সাহচার্যে আসতে পেরেছিলেন। তার সহকর্মীরা ছিলেন তৃপ্তি মিত্র, মোহাম্মদ ইস্রাফিল, কুমার রায়, কলিম শরাফী, সুবিতাবৃত্ত দত্ত এবং আরো অনেকে।

শম্ভু মিত্র ‘ভারতীয় গণনাট্য’ ত্যাগ করে বহুরূপী প্রতিষ্ঠা করেন এবং তুলসি লাহিড়ীর অসাধারণ কিছু নাটক যেমন ছেঁড়াতার, বাগড়া এসবে অভিনয় করে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন। এই সময়ে বহুরূপী-র একটা বড় ঘটনা রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী প্রযোজনা। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় ঐ নাটকে ফাগুলাল চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেন মোহাম্মদ জাকারিয়া।

শম্ভু মিত্র স্তানিস্লাভস্কি মেথড অ্যাক্টিং-এর ভীষণভাবে বিশ্বাস করতেন। এবং সেভাবেই তার দলের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের মানসপট গড়ে তুলেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, অভিনয়ে কণ্ঠস্বর এবং সংলাপ প্রক্ষেপণই প্রধান। যার একটা প্রবল প্রভাব পড়েছিল মোহাম্মদ জাকারিয়ার উপর। ষাটের দশকে যখন তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় এলেন, তখন দেখতে পেলেন এদেশে নিয়মিত মঞ্চনাট্যাভিনয় হয় না, তাই অভিনয়ের ক্ষেত্র হিসেবে তাকে বাধ্য হয়েই বেছে নিতে হলো চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন। চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার ডাক পড়ল জহির রায়হানের কাছ থেকে। জহির রায়হানের বেহুলা চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেন এবং সেইসাথে জহির রায়হানের উর্দু চলচ্চিত্রেও তিনি কাজ করার সুযোগ পান। কিন্তু চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তার দিগন্ত খুব একটা উন্মোচিত হলো না। ঐসময়ে তখনকার টেলিভিশনে, প্রযোজক হিসেবে তিনি চাকরি পান। টেলিভিশন প্রযোজনা তখন একটা দুরূহ কাজ। ঢাকা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) ভবনের (বর্তমানের রাজউক ভবন) দুটি কক্ষের স্টুডিওতে নাটক হতো দুটি ক্যামেরায় এবং সরাসরি সম্প্রচার। রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা তখনও শুরু হয় নি। সেই সময়ে প্রযোজনা কাজের ক্ষেত্রে টেলিভিশনে অভিনয় করতেও শুরু করেন। অভিনয়ের বাইরেও তিনি তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘ত্রিরত্ন’র প্রযোজনা করতেন। বেশ কটা ‘ত্রিরত্ন’র পাণ্ডুলিপি আমিও রচনা করেছিলাম।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি নাট্যপ্রযোজনাতেই (টিভিতে) অধিকতর আগ্রহী হয়ে পড়েন। কিন্তু ওই সময়ে বাংলাদেশে নিয়মিত মঞ্চনাট্যচর্চাও শুরু হয়। এবং, সেসূত্রে তার মঞ্চাভিনয় আবার শুরু হয়। তিনি যোগ দেন নাটকের দল ‘থিয়েটার’-এ। তখন থিয়েটারে নাট্যকার ও নির্দেশক ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার রচিত নাটকগুলোয় অভিনয় করে মোহাম্মদ জাকারিয়া যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেন। মূলত, ঐ সময় থেকেই আমরা তার মঞ্চাভিনয় দেখার সুযোগ পাই। সুস্পষ্ট উচ্চারণ, সংলাপ নিয়ে খেলা করা, এবং মেথড অ্যাকটিংয়ের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাই তার অভিনয়ে। তার অভিনয়ের একটা বড় উদাহরণ সৈয়দ শামসুল হকের নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। যদিও তিনি এই বাংলার আঞ্চলিক উচ্চারণে তেমন দক্ষ ছিলেন না, তবুও চরিত্রটাকে তার মতো করে আঞ্চলিক ও প্রমিত উচ্চারণ মিলিয়ে একটা চরিত্র নির্মাণ করেছিলেন।

তার অভিনয়ে সব সময়ই একটা গভীর মনোযোগের লক্ষণ ছিল। যে বিষয়টা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো সেটা হচ্ছে, তার ব্যক্তিগত শৃঙ্খলা এবং অভিনয়ে সম্পূর্ণভাবে মনোসংযোগ করা। যে কারণে ঢাকায় যারা তখন মঞ্চনাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন, তাদের উপরও একটা প্রভাববিস্তার তিনি করতে পেরেছিলেন। টেলিভিশন নাটকেও তিনি স্তানিস্লাভস্কির রীতি মেনে চলতেন। এই রীতি মেনে চলাতে কখনো কখনো ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার প্রকাশভঙ্গিমায় এক ধরনের বাধার সৃষ্টি হতো। সেখানে মঞ্চাভিনয়ের বিষয়টাও লক্ষ করা যায়। শম্ভু মিত্র এক সময় চলচ্চিত্রে অভিনয় করা শুরু করেছিলেন, একই কারণে তিনিও খুব একটা সফল হতে পারেন নি। চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনে দেহ ভঙ্গিমায় একটা নতুন ভাষা তৈরি হয়। যা চলচ্চিত্রের ভাষার জন্য খবুই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু সংলাপ দিয়ে নয়, দেহের ভঙ্গিমা দিয়ে যে ভাষা তৈরি করা হয় তা দর্শকের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়। চার্লি চ্যাপলিন তার একটা বড়ো উদাহরণ। কিন্তু ‘বহুরূপী’ স্কুলের ছাত্ররা সারাজীবন শম্ভু মিত্রের অভিনয় ভাবনাকে মেনে চলেছেন। কিছুটা ব্যতিক্রম ছিলেন তৃপ্তি মিত্র।

মোহাম্মদ জাকারিয়া সব সময়ই ছিলেন অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, নিয়মানুবর্তী এবং নীতি বা জীবনাচরণের জন্যে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। কোনো ধরনের চারিত্রিক-দুর্বলতা বা উচ্ছৃঙ্খলা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। সৎ জীবন যাপন করতে গিয়ে, তার জীবনের বৃত্তটা ছোট হয়ে গিয়েছিল। তাতে তার খুব একটা আফসোসও ছিল না। এক সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) এর চাকরি থেকে অবসর নেন এবং একটা সময় তিনি হৃদরোগেও আক্রান্ত হন। এই সময়ে তার অভিনয়ের জগৎটা ছোট হয়ে আসতে থাকে। তার মধ্যেও তিনি চেষ্টা করেছেন মঞ্চ ও টেলিভিশনে সীমিতভাবে অভিনয় করার।

তিনি স্তানিস্লাভস্কির উপর একটা বইও রচনা করেছেন। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে এই বইটা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইটা এখন পাওয়া যায় কি না জানি না। আমার বেশ কিছু টেলিভিশন নাটকের প্রযোজনা করে আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন এবং তার সঙ্গে অভিনয় করেও আমি খুবই লাভবান হয়েছি। সেই দিক দিয়ে তার কাছে আমি ভীষণভাবে ঋণী। আজকের দিনে নাট্যাভিনয়ের পাশাপাশি নাট্যরীতি, আলোচনা ও তাত্ত্বিক নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়ের ভাবুক-মানুষ খুব কমে গেছে। সমাজে অভিনয় করে সম্মানজনক একটা জায়গায় তিনি পৌঁছাতে পেরেছেন। এটা একজন মানুষের জীবনে কম পাওয়া নয়।

বাংলা নাটকে চল্লিশের দশকে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি উপমহাদেশের গ্রুপ থিয়েটার (শম্ভু মিত্র বলতেন সংঘ নাট্য) আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। যে আন্দোলন আজ দুই বাংলায়ই বহাল আছে। বহুদিন হয় তিনি গত হয়েছেন কিন্তু আজও মনে হয় তিনি বিগত হন নি এবং কখনো হবেনও না।  

আমাদের নাট্যক্রিয়ায় তিনি জেগে আছেন।

মামুনুর রশীদ ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব