Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

মঞ্চনিপুণ অভিনয়শিল্পী মোহাম্মদ জাকারিয়া

Written by অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ড. অজিতকুমার ঘোষ ‘বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন- নাট্যকারের হাতে নাটকের একটি-মাত্র রূপ, কিন্তু প্রয়োগকর্তা ও অভিনেতার বিভিন্নতা অনুযায়ী সেই একটি-মাত্র রূপ নানা বিচিত্ররূপে দেখা যায়, নাট্যকারের সৃষ্টি নবনবতর সৃষ্টি হয়ে ওঠে মঞ্চে। অভিনেতার আকৃতি, প্রকৃতি ও প্রবণতা অনুযায়ী একই চরিত্র নতুন নতুন তাৎপর্য, সম্ভাবনা ও ভাবরসে মূর্ত হয়ে ওঠে।

সমকালের নাট্যবিদগণ অভিনেতার আকৃতির যোগ্যতাটিকে গৌণবিবেচনা করে অভিনেতার পর্যবেক্ষণ, অধ্যয়ন, সাধনা ও দক্ষতাকে তার অভিনয়ের শিল্পমূল্য বিচারের মাপকাঠি ধরেছেন। সে মাপকাঠি দিয়ে বিচার করে অভিনয়শিল্পীকে মূল্যায়ন করার এই আধুনিক-প্রবণতা বর্তমানে স্বীকৃত। প্রস্থিত শতাব্দীর সত্তুর ও আশির দশকের বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের অসামান্য গুণি অভিনয়শিল্পী মোহাম্মদ জাকারিয়াকে মূল্যায়ন করতে গেলে ড. অজিত ঘোষ ও সমকালের নাট্যবিদ, সকলের বিচারকাঠিকে সঙ্গী করেই করতে হবে।

মোহাম্মদ জাকারিয়ার (২২ ফেব্রুয়ারি ১৯২৩-৪ এপ্রিল ১৯৯৩) জন্ম পশ্চিমবাংলার বীরভূম জেলার সেকেড্ডা গ্রামে। ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত গ্রামের মাদ্রাসায় পড়েছেন। তার পিতা চেয়েছিলেন তিনি কোরআনে হাফেজ হবেন। কিন্তু মায়ের ইচ্ছায় ইংরেজি-মাধ্যম-স্কুল সিনিয়র বেণী মাধব ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে মেট্রিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পড়েন হেতেমপুর কলেজে। এরপর কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। তিনি রেজিস্টার, জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে যোগদান করেন। কর্মসূত্রে এখানে পরিচয় হয় অশোক মজুমদার ও অমর গাঙ্গুলীর সঙ্গে। তাদের দুজনের সূত্রে পরিচয় হয় নাট্যজন শম্ভু মিত্রের সঙ্গে। ঐ সময় বিজন ভট্টাচার্য মঞ্চস্থ করছেন নবান্ন। শম্ভু মিত্রের সহযোগিতায় নবান্ন নাটকে অভিনয়ের সুযোগ হয়। সে নাটকে আহামরি কোনো অভিনয় করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন নি। কিন্তু নাট্যসংগঠক হওয়ার সম্ভবনা দেখাতে পেরেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, নাটকের দল ‘বহুরূপী’ গঠন ও দল-পরিচালনায় মোহাম্মদ জাকারিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

মোহাম্মদ জাকারিয়া বহুরূপীর উদ্যোগে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন কর্মযজ্ঞে গভীরভাবে যুক্ত হন। সেসময় দলের ভিতরে সহকর্মীদের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। যার কারণে তিনি ঐ বছরই ‘থিয়েটার সেন্টার’-এ যুক্ত হন এবং চাকরির পাশাপাশি নাট্যাভিনয়ে সক্রিয় হন। চার বছর এ দলে তিনি অভিনয় করেন।

এ সময়, ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে একটি মর্মান্তিক ও কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে।

জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে রটে যায় যে, কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থিত হজরতবাল মসজিদে রক্ষিত হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাথার চুল হিন্দুরা চুরি করে নিয়ে গেছে। এ সংবাদ শুনে প্রথমে খুলনায়, তারপর গোটা পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু-নিধন শুরু হয়। হাজার হাজার হিন্দুর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা ধ্বংস করে। আক্রান্ত হিন্দুদের একটি অংশ পশ্চিমবাংলায় চলে যায়। এরই প্রভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। সে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত মোহাম্মদ জাকারিয়া কলকাতা ছেড়ে সপরিবারে ঢাকায় এসে বসতি গড়েন। উল্লেখ্য, পরে জানা গিয়েছিল, চুল চুরির তথ্যটি সঠিক নয়। পূর্বপাকিস্তানে আইয়ূব-বিরোধী বাঙালির তীব্র আন্দোলনকে প্রতিরোধ করার কৌশল হিসেবে ‘চুল চুরির’ গুজব ছড়ানো হয়েছিল।

ঢাকায় এসে মোহাম্মদ জাকারিয়া পরিচিত হন চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে। মোহাম্মদ জাকারিয়া জহির রায়হানের সঙ্গে থেকে সিনেমায় কাজ শুরু করেন। দুবছর কাজ করার পর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রে প্রযোজক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি টেলিভিশনে ১৫ বছর চাকরি করে ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন।

এর মধ্যে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, তবিবুল ইসলাম বাবু, ইকবাল বাহার চৌধুরী, আহমদ জাহান চৌধুরী প্রমুখ প্রতিষ্ঠা করেন ‘থিয়েটার’ নাট্যদল। মোহাম্মদ জাকারিয়াও থিয়েটারে যুক্ত হন। আমৃত্যু (১৯৯৩ খ্রি.) তিনি থিয়েটারে সম্পৃক্ত থেকে বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেছেন। স্মর্তব্য, মোহাম্মদ জাকারিয়া শুধু মঞ্চে নয়, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

মোহাম্মদ জাকারিয়া অভিনীত মঞ্চনাটক হলো- নবান্ন, অঘটন আজও ঘটে, রক্ত করবী, সুবচন নির্বাসনে, চারদিকে যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, দুই বোন, সেনাপতি, ওথেলো, এখানে এখন, ম্যাকবেথ আর এখনও ক্রীতদাস।

উল্লেখ্য, বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে মোহাম্মদ জাকারিয়া অভিনীতি মঞ্চনাটকের মধ্যে যেগুলো নিবন্ধকার দর্শক হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন সেগুলোর আলোকে তার অভিনয়শৈলীর সাধারণ মূল্যায়ন করা হবে। পাশাপাশি মোহাম্মদ জাকারিয়া, নাট্যকার-নির্দেশক আবদুল্লাহ আল-মামুন, অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার ও রামেন্দু মজুমদারের সঙ্গে অনির্ধারিত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাবলির আলোকেও মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয়দক্ষতা সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করা হলো। তবে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয়শৈলী সম্পর্কে প্রদত্ত মতামত একান্তই নিবন্ধকারের নিজস্ব।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের রচনা ও নির্দেশনায় থিয়েটার ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মঞ্চে আনে নাটক সুবচন নির্বাসনে। মঞ্চসফল ও জনপ্রিয় এ নাটকে মোহাম্মদ জাকারিয়া অভিনয় করেন ‘বাবা’ চরিত্রে। কন্যা ‘রানু’ চরিত্রে অভিনয় করেন ফেরদৌসী মজুমদার। নাটকে তিন ভাইবোন খোকন, তপু ও রানু বাস্তবতার তিক্ত-অভিজ্ঞতা থেকে ‘সততাই মহৎ গুণ’, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সেই’, এবং ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’- এই তিন সুবচনকে মিথ্যা প্রমাণ করে আদর্শবান বাবাকে অভিযুক্ত করে।

‘বাবা’ মোহাম্মদ জাকারিয়া সারাজীবন আদর্শ জীবন-যাপন করেছেন। কখনো আদর্শবিচ্যুত হন নি। সন্তানদেরকেও আদর্শ জীবন-যাপনে অনুপ্রাণিত করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-বাস্তবতা হলো, আদর্শলগ্ন থেকে জীবনে কিছু করা যায় না। তাই, তার সন্তানরা অভিযুক্ত করে বাবাকে। আর নাটকের শেষপ্রান্তে বাবা মোহাম্মদ জাকারিয়া ছেলেমেয়েদের অভিযোগের জবাবে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারককে বলেনÑআমাকে শাস্তি দিন। প্রমাণ করুন, সত্য অচল হয়ে গেছে, জ্বলছে শুধু মিথ্যার হুতাশন। আমি অপরাধী, দয়া করে আমাকে শাস্তি দিন।

সুবচন নির্বাসনে বাবা চরিত্রে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয় ছিল প্রশংসনীয়। দর্শকনন্দিত এই অভিনেতার উচ্চারণ ছিল সুস্পষ্ট ও শুদ্ধ। কোনোরকম আঞ্চলিকতা বা উচ্চারণ-বিকৃতি তার ছিল না। এ নাটকে অনেকটাই মেলোড্রামার ধাঁচে সংলাপ ছিল। মোহাম্মদ জাকারিয়া সেসব সংলাপ কেবল আবেগ দিয়ে প্রক্ষেপণ করতেন না। তার অভিনয়ে বাচিক ও আঙ্গিকের যুগলবদ্ধতা নিপুণ ছিল। অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ সংলাপের ভাবের সঙ্গে চঞ্চল হয়ে উঠত। মোহাম্মদ জাকারিয়ার সংলাপ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকের বিচারশক্তি ও কল্পনাশক্তি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠত। শিহরিত দর্শকবৃন্দ অভিনেতার গমনাগমনের সঙ্গে সঙ্গে নিজ চোখ ও মনকে একাত্ম রাখত।

সুবচন নির্বাসনে নাটকে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয় সম্পর্কে সহশিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার বলেন- আর কী তাঁর প্রক্ষেপণ! সংলাপ যত সুন্দর, দাদার আত্মসমর্পণ-ভঙ্গিটা এবং জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার বেদনাদায়ক অভিব্যক্তিটি ছিল তার চেয়েও বেশি বক্ষবিদীর্ণ করা। আমার মনে আছে, এ সংলাপ উচ্চারণ করার প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত হলভর্তি লোক টানটান হয়ে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে থিয়েটারকে অনুধাবন করতেন। দর্শকসারিতে একটা পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। কারণ, এইরকম স্পষ্ট করে কথা বলে দর্শক-শ্রোতার মন টলিয়ে সম্মোহিত করে দিতে পারতেন জাকারিয়া দাদাই। এখানেই আমরা বুঝতে পারতাম শিল্পীর সঙ্গে দর্শক একাত্ম হয়ে যাওয়ার মানে কী?

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল রায়ের কাহিনি অবলম্বনে আবদুল্লাহ আল-মামুন রচনা করেন চারদিকে যুদ্ধ। নাটকটির নির্দেশনাও তিনি দেন। এ নাটকে অসামান্য অভিনয় করেন ফেরদৌসী মজুমদার, আরিফুল হক এবং মোহাম্মদ জাকারিয়া। নাট্যকাহিনিতে দেখা যায়, ফেরদৌসী মজুমদার সংসারের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে প্রমোদবালায় পরিণত হয়। আর মোহাম্মদ জাকারিয়া অভিনয় করেন ধনী ব্যবসায়ী নারী-সঙ্গলিপ্সু পুরুষ হিসেবে। তার অভিনয় দর্শকের কাছে দারুণ প্রশংসিত হয়। মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয় সম্পর্কে সহশিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার বলেনÑচারদিকে যুদ্ধ নাটকে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয় যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বলতে পারবেন দাদার অভিনয়ের উচ্চতা কতটা ছিল। কী তাঁর সংলাপ প্রক্ষেপণ, কী বিশুদ্ধ উচ্চারণ! চোখে-মুখে কী অপূর্ব অভিব্যক্তি! কী অসাধারণ বিরল ব্যক্তিত্ব! বিরাট বড়লোক, বড় অফিসার, নারী-সঙ্গ-উন্মুখ- এই কঠিন চরিত্রে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অসম্ভব সংযত, শীতল অথচ দৃপ্ত, দৃঢ় ও আভিজাত্যপূর্ণ অভিনয় ভোলার নয়। দাদার বিকল্প নেই।

প্রকৃত অর্থেই সে সময়ে ঢাকার মঞ্চে মোহাম্মদ জাকারিয়ার বিকল্প ছিল না। মহিলা সমিতির টিনের চালের হলঘরভর্তি দর্শক চারিদিকে যুদ্ধ নাটকে মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধতায় উপভোগ করতেন। তার দৃপ্ত পায়ে চলা, মাথা বাঁ দিকে বাঁকিয়ে সংলাপ বলা এবং ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপ মিশিয়ে হাসি দেয়ার স্মৃতি অদ্যাবধি নিবন্ধকার ভুলতে পারে নি।

সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আবদুল্লাহ আল-মামুন নির্দেশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসামান্য কাব্যনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। এ নাটকে পির চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন মোহাম্মদ জাকারিয়া। মোহাম্মদ জাকারিয়ার উচ্চারণশৈলী, সংলাপ প্রক্ষেপণ ও দেহভঙ্গি পির চরিত্রটিকে অন্যস্তরে নিয়ে যায়। এ নাটকে তার হাঁটার ভঙ্গি ও অঙ্গ সঞ্চালন তার অভিনয়-দক্ষতা ও স্বাতন্ত্র্যকে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।

মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয়-দক্ষতার স্বাক্ষর আছে- আবদুল্লাহ আল-মামুন রচিত ও নির্দেশিত সেনাপতি নাটকে শখের প্রদীপ আহরণকারী চরিত্রাভিনয়ে, এখনও ক্রীতদাস নাটকে তালেব মিয়া চরিত্রাভিনয়ে এবং এখানে এখন নাটকে সাদাবেশধারী কোরাস চরিত্রের অভিনয়ে। অতি-অভিনয়-মুক্ত, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে এবং শুদ্ধ-প্রমিত উচ্চারণে সংলাপ প্রক্ষেপণের বিরল যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি এ তিনটি নাটকের অভিনয়ে। তার সহশিল্পী রামেন্দু মজুমদার বলেন- ‘বহুরূপী’তে যে শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন, তার যথার্থ প্রয়োগ করেছেন অভিনয়ে। কৃত্রিমতা-বর্জিত এমন বাস্তব শিল্পসম্মত অভিনয়শিল্পী ঢাকার মঞ্চে খুব কমই ছিল।

উল্লেখ্য, পুরনো সংলাপনির্ভর অভিনয়রীতির প্রাথমিক ভাঙন দেখা দেয় বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন নাটকের মাধ্যমে। পরে শম্ভু মিত্র বহুরূপীর মাধ্যমে সে ভাঙনকে সম্পন্ন করে বাংলা মঞ্চনাটককে নতুন স্তরে উপনীত করেন। তার সময় থেকে অভিনয় হয়ে ওঠে প্রয়োগনির্ভর। প্রয়োগকর্তা নিয়ন্ত্রিত নানা প্রয়োগকৌশলের সঙ্গে অভিনয় যুক্ত। বর্তমানে নাট্যকার সৃজিত শব্দ, ভাষা, বাক্য, ধ্বনি কেবল অভিনয়ের জন্য নয়। এর সঙ্গে অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে আলো, আবহ, সংগীত, মঞ্চসজ্জা, রূপসজ্জা, সামগ্রী ইত্যাদি অনেক কিছু। এর ফলে অভিনেতার একক অভিনয়-কৃতিত্বের প্রাধান্য কমে গেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আধুনিককালে অনেক অভিনয়শিল্পী আছেন যারা এখনও ব্যক্তি অভিনয়-নৈপুণ্যে সকলের মধ্যে একক হয়ে ওঠেন। মোহাম্মদ জাকারিয়া নবান্ন ও বহুরূপীর অভিনয়রীতি ভাঙার সারথি ছিলেন বলে তার অভিনয়রীতি গড়ে উঠেছিল প্রয়োগরীতিধর্মী। আর তার অভিনয়রীতি প্রয়োগরীতিধর্মিতার ভিতর দিয়ে সাধনায়, সততায় ও নিষ্ঠায় এক নতুন অবয়ব পেয়েছিল। যার সুস্পষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন ‘থিয়েটার’ প্রযোজিত তার অভিনীত নাটকগুলোয়। এখানে আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, মোহাম্মদ জাকারিয়া একটি নাটক থেকে যখন আরেকটি নাটকে গিয়েছেন তখন পরিবর্তিত চরিত্রের আলোকে নিজেকে নির্মাণ করেছেন। ‘বাবা’ থেকে যখন ‘পির’ হন তখন প্রকৃতই তিনি পির হয়ে ওঠেন। তার দেহভাষা, কথনকলা, ভাব-ভঙ্গি ও হাঁটাচলা পিরের মতোই হয়ে যায়। আবার যখন তিনি ধনী নারী-সঙ্গলিপ্সু পুরুষ তখন ঠিক তার মতোই হয়ে ওঠেন। মোহাম্মদ জাকারিয়ার চরিত্র থেকে চরিত্রে গমনের নিখুঁত যাত্রাকে সশ্রদ্ধচিত্তে বারবার স্বীকার করেছেন নাট্যকার-নির্দেশক আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিনি মোহাম্মদ জাকারিয়ার অভিনয়নৈপুণ্যের প্রশংসা করে নিবন্ধকারের কাছে বলেছেন- মোহাম্মদ জাকারিয়া জাত অভিনেতা। বিজন ভট্টাচার্য ও শম্ভু মিত্রের কাছে হাতেখড়ি বলেই তিনি এমন দক্ষ ও প্রাজ্ঞ অভিনেতা হয়েছেন।

মোহাম্মদ জাকারিয়া নিবন্ধকারের কাছে বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র এবং আবদুল্লাহ আল-মামুনের কাছ থেকে পাওয়া তার নাট্যশিক্ষার ঋণের কথা বলেছেন। তিনি ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়নৈপুণ্য দেখেও নিজেকে নির্মাণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।

থিয়েটার’ জন্মলগ্ন থেকে সম্মিলিত অভিনয়ের নাটক করেছে। তারা সুপরিকল্পিত, সুশৃঙ্খল ও রীতিবদ্ধ কম্পোজিশন করে অনেক চরিত্রকে একসঙ্গে মঞ্চে এনেছেন। এই রকমের কম্পোজিশন ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, ব্লকিং, সংলাপ, ধ্বনি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এখানে এলোমেলো হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আলো ও আবহ কখনো অভিনয়শিল্পীর সহগামী নাও থাকতে পারে। এ রকমের দুর্ঘটনা মঞ্চে বহুবার ঘটেছে। কিন্তু মোহাম্মদ জাকারিয়ার ক্ষেত্রে কখনো ঘটে নি। সূক্ষ্ম শিল্পজ্ঞানসম্পন্ন মোহাম্মদ জাকারিয়া মঞ্চাভিনয়ে যেমন নিজে সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতেন, পাশাপাশি সহশিল্পীরা যাতে কোনো ভুল করে নাট্যপ্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে সেদিকেও তিনি সর্বক্ষণ মনোযোগ রাখতেন। মোহাম্মদ জাকারিয়ার সহঅভিনয়শিল্পীরা একথা বলেছেন। থিয়েটার সমবায়ভিত্তিক দলগত সমন্বিত-শিল্প-প্রয়াস। এখানে যারা কাজ করেন তাদেরকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয় থিয়েটারকে। মোহাম্মদ জাকারিয়া তাই দিয়েছিলেন।

জানা যায়, তিনি যখন বহুরূপীতে অভিনয় করেন, তখন একদিন প্রদর্শনীর-পূর্বে সংবাদ পেলেন, তার পিতার মৃত্যু হয়েছে। দর্শকবৃন্দ টিকিট কেটে হলে প্রবেশ করেছেন। এটি দেখে মোহাম্মদ জাকারিয়া পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনেও মঞ্চে অভিনয় করেছেন। অভিনয় শেষে গিয়েছেন পিতার শেষকৃত্যে। তার এই মহান আত্মত্যাগ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছে। বস্তুত, আমৃত্যু তিনি এমন আত্মনিবেদিত অভিনেতা হিসেবেই থেকেছেন।

বস্তুত, মোহাম্মদ জাকারিয়া ছিলেন শম্ভু মিত্রের উত্তরসাধক। ঠিক তারই মতো মঞ্চনিপুণ অভিনয়শিল্পী। শম্ভু মিত্রের নাট্যসাহচর্য তাকে তার মুগ্ধ-অনুগামী করেছিল। মোহাম্মদ জাকারিয়া ছিলেন কণ্ঠপ্রধান অভিনেতা, কিন্তু আবৃত্তিধর্মী ছিলেন না। ভাবের অভিব্যক্তির দিকে তার মনোযোগ ছিল বেশি। অঙ্গসঞ্চালন ও দেহভঙ্গির মাধ্যমে ভাবপ্রকাশে তিনি অধিক আগ্রহী ছিলেন। তবে তার ছিল অসম্ভব পরিমিতি বোধ। তিনি সংলাপ উচ্চারণের সময় Pause বা বিরতি দিয়ে সংলাপটিকে দর্শক-শ্রোতার বোধগম্য করে তুলতেন। তবে ‘সুবচন নির্বাসনে’ বাবা চরিত্রের- সংলাপে মাত্রাতিরিক্ত চধঁংব কখনো কখনো নাটকটির গতি শ্লথ করে দর্শকের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। আবার চারদিকে যুদ্ধ নাটকে তার ধনী ব্যবসায়ী-চরিত্রের সংলাপ উচ্চারণকে মাঝেমাঝে বক্তৃতাধর্মীতায় দুষ্ট মনে হয়েছে। অন্যদিকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় নাটকে পির চরিত্রের সংলাপ-উচ্চারণে শব্দ ও বাক্যের স্বতন্ত্র গুরুত্বের দিকে মনোযোগ দিয়ে মোহাম্মদ জাকারিয়া পির চরিত্রটিকে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছিলেন।

মঞ্চনিপুণ মোহাম্মদ জাকারিয়ার বর্ণময় ভাবসম্ভার-সমৃদ্ধ-অভিনয় বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি চরিত্রের স্বভাবের বাস্তবতা ও মঞ্চের বাস্তবতার সমন্বয়ে এক নবতর বাস্তবতাকে মূর্ত করে তুলতেন তার মঞ্চাভিনয়ে। কণ্ঠস্বরের বিস্তার, আবেগের প্রাবল্য, হাঁটাচলা ইত্যাদির মাধ্যমে মোহাম্মদ জাকারিয়া তার অভিনয়ের যে শিল্পসম্মত বিকাশ ঘটিয়ে গেছেন তা পরম্পরায় আজও কোনো কোনো অভিনেতার আদর্শ হয়ে আছে।

আর এখানেই মোহাম্মদ জাকারিয়া-শিল্পীর সার্থকতা।

অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, লেখক