Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

অভিনেতা খালেদ খান : মঞ্চের যুবরাজ

Written by শামীম সাগর.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..


স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক-অর্জনগুলোর মধ্যে একটি হলো গ্রুপ থিয়েটারের চর্চা। স্বাধীনতার আগে, বিচ্ছিন্ন এবং অনিয়মিত মঞ্চনাট্যচর্চা বিদ্যমান ছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর, বাংলাদেশের থিয়েটার নতুন উদ্দীপনার সাথে, বিশেষ-করে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার মাধ্যমে একটি নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। থিয়েটারচর্চার এই নতুন পথের পথপ্রদর্শক একদল সংস্কৃতিমনা মানুষ, যারা যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং দেশের থিয়েটার-ল্যান্ডস্কেপটাকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে ব্রত নিয়েছিলেন।

তাদের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, নতুন নতুন থিয়েটার-সংগঠনের আবির্ভাব ঘটে, যা নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃদের একটি সৃজনশীল-প্লাটফর্মে যুক্ত হতে আকর্ষণ করে এবং নবব্যাখ্যা আর নিরীক্ষায় সকলের সম্মিলিত অংশগ্রহণে নতুন এক থিয়েটার-অভিজ্ঞতা পায় সকলে। দর্শকও আগ্রহের সাথে এই নতুন অভিযাত্রায় অংশ নেয় এবং সমর্থন দিয়ে যেতে থাকে। যদিও প্রাক-স্বাধীনতা থিয়েটারচর্চা প্রায়ই বিক্ষিপ্ত এবং খণ্ডিত ছিল; স্বাধীনতা-পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটারচর্চা আরও সুসংহত এবং গতিশীল থিয়েটার-ল্যান্ডস্কেপ তৈরি করে দিয়েছিল।

বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারচর্চা শুধু নাট্যের শৈল্পিক-সাফল্যই নিয়ে আসে নি, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকেও ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। নাট্যগোষ্ঠীগুলো তাদের নির্মিত-নাটকে সামাজিক-অবিচার, রাজনৈতিক-দুর্নীতি এবং সাংস্কৃতিক-পরিচয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করেছে। এই অর্থে, গ্রুপ থিয়েটার সামাজিক-ভাষ্য এবং রাজনৈতিক-সমালোচনার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। তাই এটি বাংলাদেশি-সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাণবন্ত দিক হিসেবে দর্শককে আকর্ষণ করেছিল এবং নতুন প্রজন্মের সংগঠক, পরিকল্পক আর অভিনয়শিল্পীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। গত শতকের নব্বই-দশক পর্যন্ত, থিয়েটারে লাইভ পারফরম্যান্স ছিল বাংলাদেশের, বিশেষ-করে ঢাকার দর্শকের কাছে বিনোদনের একটি অন্যতম মাধ্যম। সেই সময়ে, নাট্যনির্দেশকের ফোকাস ছিল মূলত অভিনেতৃর উপর, যারা যেকোনো নাট্যপ্রযোজনার সাফল্যের মূল-চাবিকাঠি ছিল। যাইহোক, সাম্প্রতিক-বছরগুলোতে, মঞ্চে ভালো অভিনেতৃর অভাব দেখা দিয়েছে, কৌশলী-নাট্যনির্দেশকেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভিনয়ের খামতি বা ত্রুটি কাটিয়ে ওঠার জন্য কোরিওগ্রাফিসহ অন্যান্য কারিগরি দিকগুলোতে বেশি জোর দিয়ে চলেছেন।

তবে এটা তো সত্য, একটা সময় মঞ্চে সুঅভিনেতা-অভিনেত্রীর আধিপত্য ছিল, এবং তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যিনি সত্যিকারের জাদুকরী অভিনয়-ক্ষমতার অধিকারী, তিনি খালেদ খান যুবরাজ। তিনি মঞ্চের যুবরাজ বা রাজপুত্র হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। কারণ, নিজের অভিনয়ের আলোয় পুরোমঞ্চকে আলোকিত করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি অভিনয়ের জাদুতে দর্শককে মোহিত করে তাদের একটি ভিন্ন জগতে নিয়ে যেতে পারতেন। খালেদ খান যুবরাজ ছিলেন এমন একজন অভিনেতা, যিনি সত্যিকার-অর্থে অভিনয়-শিল্পটাকে বুঝতেন। তিনি অভিনয়-নৈপুণ্যের একজন সত্যিকারের মাস্টার-পর্যায়ের ছিলেন এবং তাঁর মঞ্চাভিনয়গুলো বাংলাদেশের থিয়েটার-অঙ্গনের অভিনয়ের সেরা উদাহরণ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।


খালেদ খান ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’-এ ১৯৭৫ সালে নাট্যকর্মী হিসেবে যুক্ত হন; ১৯৭৮ সালে নাগরিকের দেওয়ান গাজীর কিস্সা নাটকে কাজ করার মাধ্যমে তাঁর অভিনয়-জীবনের শুরু। এরপর প্রায় ২৮ বছর নিয়মিত মঞ্চে কাজ করে গেছেন অভিনেতা হিসেবে, নির্দেশক হিসেবে। অভিনেতা হিসেবে গ্যালিলিও নাটকে গ্যালিলিওর শিষ্য আন্দ্রিয়া, দর্পণ নাটকের দর্পণ, ঈর্ষা নাটকের যুবক, রক্তকরবী নাটকের বিশু-সহ প্রায় ৩০টি মঞ্চনাটকে দুর্দান্ত-দাপটে নিজের উপস্থিতি জানিয়েছেন তিনি। মঞ্চাভিনেতা হিসেবে খালেদ খানের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয়-প্রতিভা। তাঁর মঞ্চাভিনয়ের অভিজ্ঞতার দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, তিনি ক্লাসিক, কনটেম্পোরারি, কমেডি, সাহিত্যনির্ভর সবধরনের নাটকেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারদর্শী ছিলেন।

অভিনেতা খালেদ খান যুবরাজকে বুঝতে তাঁরই নাট্যদলের জ্যেষ্ঠ সদস্য আতাউর রহমানের স্মৃতিচারণ উল্লেখযোগ্য; তিনি বলছেন- খালেদ খানের দক্ষ-অভিনয়ের পরিচয় আমি পাই নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আলী যাকের নির্দেশিত প্রযোজনা  অচলায়তন নাটকে। অমন নেচে-গেয়ে কিশোর ‘পঞ্চক’-কে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না বলে আমি মনে করি। অচলায়তন নাটকে যুবরাজ মঞ্চকে জয় করে নাট্যমঞ্চের ‘যুবরাজ’ হয়ে উঠল। সৈয়দ শামসুল হক রচিত আমার নির্দেশিত দুরূহ কাব্যনাটক ঈর্ষা নাটকে অভিনয় করে দেশে-বিদেশে খালেদ খান সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এমন নিবিষ্ট এবং শুদ্ধাচারী অভিনেতার সাক্ষাৎ সহজে মিলে না। সৈয়দ শামসুল হক রচিত এই কাব্যনাট্য দীর্ঘ ৭টি সংলাপে সমাপ্ত। নাটকটিতে খালেদ অভিনয় করত তরুণ চিত্রশিল্পীর ভূমিকায়। চরিত্রের নাম ‘যুবক’। মনে আছে বাংলা থিয়েটারের কিংবদন্তি পুরুষ শ্রী শম্ভু মিত্র নাটকটি অখ--মনোযোগে দেখেছিলেন এবং খালেদের অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। কলকাতার ‘একাডেমি অব ফাইন আর্টস’ প্রাঙ্গণে পরেরদিন নাট্য-উৎসবে অন্য একটি নাটক দেখতে গিয়ে শুনতে পাই যে, কয়েকজন দর্শক নিজেদের মধ্যে খালেদকে দেখিয়ে বলাবলি করছে, যৌবনে শম্ভু মিত্র বাংলাদেশের ঐ ছেলেটির মতো অভিনয় করত। এই উক্তি আমাকে বিস্ময়ে হতবাক করেছিল।

আতাউর রহমান আরও উল্লেখ করেন- খালেদকে নির্দেশনা দেয়া খুব সহজ ছিল। নির্দেশক কী চায়, সামান্য কথার ভেতর দিয়ে খালেদ তা বুঝে নিত। এভাবে খালেদ মনোগ্রাহী অভিনয় করেছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দর্পণ নাটকে। দর্পণ ছিল আলী যাকের-কৃত শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকের রূপান্তর এবং নাটকটির নির্দেশনাও দিয়েছিলেন আলী যাকের। আমার নির্দেশিত নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের গ্যালিলিও নাটকে খালেদ খান ‘গ্যালিলিও’র ছাত্র আন্দ্রিয়ার ভূমিকায় হৃদয়গ্রাহী অভিনয় করত। নাটকটি বের্টল্ট ব্রেশটের দ্য লাইফ অব গ্যালিলিও গ্যালিলাই; যার বাংলা অনুবাদ করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। এছাড়াও খালেদ নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের আরও কয়েকটি নাটকে ছোটো-বড়ো ভূমিকায় অভিনয় করেছে, তবে সে যে ভূমিকায়ই অভিনয় করত, তা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত ওর মোহনীয় অভিনয় ক্ষমতার গুণে।

আতাউর রহমানের উপরোক্ত বিশ্লেষণের ভেতর দিয়েই খালেদ খানের অভিনয়-ক্ষমতার চমৎকার মূল্যায়ন বের হয়ে আসে।


‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা দর্পণ। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অমর ক্লাসিক হ্যামলেট এর অসাধারণ এক স্থানিক রূপান্তর করেন আলী যাকের, নির্দেশকও ছিলেন তিনি। এই নাটকে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন খালেদ খান। দর্পণ নাটকে অভিনেতা এবং চরিত্রের বয়স ছিল কাছাকাছি, খালেদ খানের জন্য এই চরিত্রে মিশে যাওয়াটা সহজতর ছিল বলা চলে। তবে আলী যাকের যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অচলায়তন এর নির্দেশনা দিলেন, সেখানে খালেদ খান ৮ বছর বয়সী ‘পঞ্চক’ চরিত্রে অভিনয় করেন, যেসময় তাঁর বয়স ছিল ২২। আতাউর রহমান নির্দেশিত গ্যালিলিও নাটকে ‘গ্যালিলিও’র ছাত্র আন্দ্রিয়া চরিত্রে অভিনয় করেন, এই চরিত্রটিও তাঁর বয়সের তুলনায় কম-বয়সী ছিল। এই পঞ্চক আর আন্দ্রিয়া চরিত্র দুটির চরিত্রায়ন আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার বিষয়টি সহজ ছিল না একেবারেই। কিন্তু এই দুটি চরিত্রকেই তিনি অসাধারণ দক্ষতায় বালক পঞ্চক এবং কিশোর আন্দ্রিয়ার বয়স-অনুযায়ী আবেগ-অনুভূতি-আচরণ ফুটিয়ে তুলেছেন, দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন। বিশেষ-করে পঞ্চকের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় সকলকে চমকে দিয়েছিল। সমসাময়িক-সময়ের অন্যান্য মঞ্চাভিনেতার চাইতে খালেদ খান একজন ব্যতিক্রমী এবং দক্ষ অভিনেতা ছিলেন নিঃসন্দেহে।

আমরা সাধারণত কোন অভিনেতৃকে ভালো অভিনেতৃ বলি, কিংবা কোন বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে একজনকে ভালো অভিনেতৃ বলা যাবে? প্রশ্নের উত্তরে যেসব গুণ আর বৈশিষ্ট্যের কথা উঠে আসবে, সেগুলোর বিচারে যদি অভিনেতা খালেদ খান যুবরাজের বিচার করি, তাহলে যে বিষয়গুলো উঠে আসবে:

এক. অভিনীত চরিত্রের আবেগের জটিল-বিষয়গুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে ফুটিয়ে তোলবার একটি সহজাত-সক্ষমতা ছিল তাঁর। এই দক্ষতাটি যেকোনো অভিনেতৃর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, এটির যথাযথ প্রয়োগই দর্শকের উপর প্রভাব তৈরি করতে সহায়তা করে।

দুই. খালেদ খান শারীরিক-অভিব্যক্তিতেও দক্ষ ছিলেন। তিনি তাঁর শারীরিক-ভাষার পরিমিত কিন্তু দুর্দান্ত প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর অভিনয়ে গভীরতার একটি অতিরিক্ত স্তর যুক্ত করতেন। উপরন্তু, তিনি ছিলেন বাচিক-শিল্পী। তাঁর কণ্ঠের একটি চিত্তাকর্ষক-আবেদন ছিল, যা তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলত।

তিন. খালেদ খান যুবরাজের সৃজনশীলতা ছিল অনন্য। তাঁর মৌলিকতা এবং সৃজনশীলতা কেবল তাঁর অভিনয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। নির্দেশনায়ও তা ছিল স্পষ্ট। তিনি একটি চরিত্রকে অনন্য এবং অসাধারণ উপায়ে ব্যাখ্যা করতে পারতেন। তিনি অভিনেতা-অভিনেত্রীকে চরিত্র-বিশ্লেষণ করার সময় তাঁর নিজস্ব-ব্যক্তিগত স্পর্শ আনতে পারতেন।

চার. তিনি যেকোনো প্রযোজনা, চরিত্র এবং পরিস্থিতিতে অনায়াসে অভিযোজিত হতে পারতেন, তা সে একজন নতুন পরিচালক, সহ-অভিনেতা, অভিনয়ের-ধরন, যাই হোক না কেন। মানিয়ে নেয়ার এই ক্ষমতা তাঁকে দারুণ উপভোগ্য-পারফরম্যান্স তৈরি করতে সহায়তা করত।

পাঁচ. যুবরাজ মানসিক-বুদ্ধিমত্তা, শারীরিক-অভিব্যক্তি, সমাজের একটি ভালো আদেশ এবং অভিযোজন-ক্ষমতা-সম্পন্ন একজন ব্যতিক্রমী অভিনেতা ছিলেন। তাঁর সৃজনশীলতা এবং চরিত্রগুলোর অনন্য-ব্যাখ্যা তাঁকে তাঁর প্রজন্মের প্রধান-অভিনেতৃদের একজন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।


খালেদ খান টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন। জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা অর্জন করার সাথে সাথে একজন দক্ষ এবং নিপুণ অভিনয়শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁর অভিনীত টিভি নাটকের বেশ কিছু সংলাপের নিপুণ ডেলিভারি ছিল সমানভাবে স্মরণীয়, যেগুলো ব্যাপক প্রশংসা লাভ করে এবং দর্শকের মুখে মুখে ফিরেছিল সেসব সংলাপ।

বাংলাদেশের থিয়েটার-ইতিহাসে বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি অভিনেতৃর আগমণ ঘটেছে। তাঁদের মধ্যে খালেদ খান মঞ্চের রাজপুত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরকালের জন্য খোদাই করে রেখেছেন। যদিও তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তবুও তাঁর অভিনয়শৈলীর জন্য পরবর্তী-প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয়, অনুসরণীয় হয়ে আছেন।

শামীম সাগর ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক