Full premium theme for CMS
বাংলাদেশের মঞ্চের যুবরাজ
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
সৈয়দ শামসুল হকের ঈর্ষা নাটকের তিনটি চরিত্র। প্রৌঢ়, যুবতী আর যুবক। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের এই নাটকটিতে মাত্র সাতটি সংলাপ। নাটকের ব্যাপ্তি ২ ঘণ্টার অধিক। মাত্র তিনজন চরিত্র বলবেন সাতটি বিশাল সংলাপ। প্রৌঢ় চরিত্রে জামালউদ্দিন হোসেন, যুবতী চরিত্রে সারা যাকের আর যুবক চরিত্রে খালেদ খান। আহা! কী অসাধারণ কেমিস্ট্রি দেখেছিলাম তিনজনের সংলাপে!
এই নাটকটি আরও দুইবার দেখি। কারণ, খালেদ খান এর এন্ট্রির পর পুরো নাটক এক ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। উনি সংলাপ বলা শুরু করেন। মন্ত্রমুগ্ধতা কাজ করে। দর্শক হিসেবে মনে হতে থাকে, ওনার সংলাপ বলা যেন শেষ না হয়। চলুক। পুরো নাটকে উনিই সংলাপ দিক। দেহভঙ্গিমা, বাচনভঙ্গি, মাঝেমাঝে দীর্ঘ বিরাম, কিন্তু এই বিরাম-এ আমাদের মনোঃসংযোগ আরও বেড়ে যায়। এই অভিনয় দেখার সাধ হয় জনম জনম। মঞ্চের যুবরাজ আমাদের সেই অভিনয়ের উৎকর্ষতা ছড়ায়। তাঁর অভিনয় দেখি আর আন্দোলিত হই। কখনো কখনো উনি সংলাপ বলেন তারায় কিন্তু শব্দ বুঝতে একদম কষ্ট হয় না। খালেদ খান তথা যুবদার সমস্ত সংলাপের প্রত্যেকটি শব্দ, বাক্য যত কঠিনই হোক, উনি যখন বলেন তখন স্বচ্ছ পানির মতো পরিষ্কার শোনা যায়, বোঝা যায়, রসাস্বাদন করা যায় সহজেই। এই জাদু মঞ্চে খুব কমই দেখা আমার অভিজ্ঞতায়। এরপর থেকে পাগলের মত তাঁর মঞ্চাভিনয় দেখি। এর আগে-পরে অচলায়তন, গ্যালিলিও, খাট্টা তামাসা, রক্তকরবী আরও কতসব নাটকে কত-রকমের চরিত্র-নির্মাণ আমাদের মুগ্ধ থেকে মুগ্ধতর করতে থাকে। এরকম ধারাবাহিক উন্নত-চরিত্র-নির্মাণের ইতিহাস বাংলাদেশের মঞ্চে খুব কম দেখা যায়। চরিত্রের প্রতি শতভাগ সৎ থেকে একটির পর একটি নাটকে অভিনয়ের নতুন মাত্রা নির্মাণ করে যেতেন আমাদের মঞ্চের যুবরাজÑখালেদ খান।
আমরা তরুণ থিয়েটারকর্মীরা তাঁকে অনুসরণ শুরু করি। তাঁর বলন, চলন, এক্সপ্রেশন- সব। কিন্তু তা আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কারণ, যুবদা ছিলেন সারাদিনের শিল্পী। তাঁর চর্চা সারাদিনের। তিনি চাকুরি করতেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মুখাবয়ব ও ভাবনায় সারাক্ষণ অভিনয়ের চিন্তা খেলা করত। তা তাঁর সাথে কথা বললেই বোঝা যেত।
তাঁর নির্দেশনায় দুটো নাটকে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল- ক্ষুধিত পাষাণ আর রূপবতী। চরিত্রের যে লেয়ার তিনি আমাকে দেখাতেন তা ছিল আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। উনি যখন সংলাপ মাঝেমাঝে বলে দিতেন, হা হয়ে শুনতাম। মনে হতো, আহা! উনি যদি অভিনয়টি করতেন! আমাদের সংলাপ-প্রক্ষেপণে তাঁর হতাশ হবার কথা, অথচ উনি হতেন না। কোনো অভিনেতা-অভিনেত্রীকে রাগ করে কিছু বলা আমাদের থিয়েটার-নির্দেশকদের খুব স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। কিন্তু যুবদা একেবারেই তার ব্যতিক্রম ছিলেন। কী অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে হাসিমুখে তিনি চালিয়েই যেতেন স্তানিস্লাভস্কির অ্যাক্টিং মেথড- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতি বিরক্ত হয়ে যেতাম একারণে যে, কেন তাঁর দেখানো পথে শতকরা একভাগও হাঁটতে পারছি না! কিন্তু উনি উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়েই যেতেন। তাঁর ধৈর্য দিয়ে, খুব সাধারণ একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে তিনি কোন স্তরে নিয়ে যেতেন, তা দেখে দেখে আমরা অবাক হতাম। নিজে যেমন শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন, তেমনি তিনি অভিনেতৃ নির্মাণও করতে চাইতেন শ্রেষ্ঠতর। কিন্তু আমাদের সীমাবদ্ধতায় আমরা ব্যর্থ হতাম। খুব ধীর, স্থির অথচ আড্ডাবাজ একজন মানুষ আমাদের অভিনয়ের মায়ায় বাঁধতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের উড়ু-উড়ু মন তা হতে দেয় নি হয়ত। কিন্তু এখনও অভিনয়ের সময় যুবদা মাথার উপরে থাকেন, গাইড করেন। উনি সফল হন, আমরা ব্যর্থ হই!
গত শতকের নব্বইর দশকে আমরা মেথড অ্যাক্টিং বলতে ‘স্তানিস্লাভস্কি’র অভিনয়রীতিই অনুসরণ করতাম। যুবদার অভিনয়ে আমরা এই পদ্ধতির প্রতি শতভাগ মনোনিবেশ দেখতাম। উনি বলতেন ‘অভিনয় এমন এক কেমিস্ট্রি, সংলাপটা ঠিকমতো বুঝে বললে, দেহে তা অনায়াসে চলে আসে।’ আমাদের অভিনয় দেহে আসে সংলাপে আসে না। সংলাপ বলি মনে হয় অন্য কারো কথা বলছি। সংলাপ হয় না। আমাদের আর্টিকুুলেশনে অনেক ঝামেলা। কিন্তু উনি আর্টিকুলেশনের ছিলেন এক অনুপম-কারিগর। আমার আফসোস হয়, তাঁর অভিনয়-পদ্ধতিটি আমরা কোনো লিখিত বা ভিডিও আকারে যদি ধারণ করতে পারতাম, তাহলে অভিনয়ের এক নতুন নাট্যভাষা হয়ত আমরা বানিয়ে ফেলতে পারতাম।
সেটার গবেষণা হওয়া জরুরি মনে হয় এখন।
মোহাম্মদ আলী হায়দার ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা ও নির্দেশক