Full premium theme for CMS
সমকালীন নাট্যচর্চা : রীতি ও প্রবণতা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
নাট্যকলা চলমান এক শিল্পমাধ্যম। দীর্ঘদিনের বাহিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও চেতনারভিত্তিতে তার গতি-প্রকৃতি আবর্তমান। হুটকরেই তার রূপ-রেখা বদলায় না। শিল্পাদর্শ ও দর্শকের রসভস্বাদনের সঙ্গে দ্বান্দ্বিক-প্রক্রিয়ায় নাট্যচর্চার রীতি-প্রকৃতি ও প্রবণতা তৈরি হয়। বাঙালির নাট্য-সংস্কৃতি হাজার বছরের নানা চড়াই-উৎরাই, আন্দোলন-প্রতিঘাত, দেশজ-বিদেশি নানা জ্ঞান-তর্কের মাধ্যমে আজকের দিনের এ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহী নাট্যচর্চা সমকালীন বিশ্বনান্দনিকতায় বিকাশের পথ সৃষ্টি করেছে।
কোনো অঞ্চলের সাম্প্রতিক-নাট্যচর্চার রীতি-প্রবণতা, প্রকৃতি নির্ণয় করতে গেলে তার ভূতাত্ত্বিক প্রকৃতি, বুদ্ধিভিত্তিক রূপরেখা, অবকাঠামো, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি-সক্ষমতা, তুলনামূলক পর্যবেক্ষণ, ধরন-ধারণ, স্থান-কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে ন্যূনতম একযুগ সময়কে গবেষণার পরিসীমা হিসেবে ধরে নিতে হয়। কিন্তু এ প্রবন্ধের পরিধির বিবেচনায় আমাদের সে সুুযোগ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা-মহামারি নাট্যচর্চায় ছেদ সৃষ্টি করে। করোনার বদ্ধজীবন এক ধরনের মানসিক পরিবর্তনে দোলা তৈরি করে। তাই ‘সাম্প্রতিক’ বা ‘সমকাল’ অর্থে এ আলোচনায় করোনা-পরবর্তী সময়ে মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মধ্যে নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বশীল প্রযোজনাগুলোর আলেখ্যে রূপ-রীতি, প্রবণতা চিহ্নিত করতে সচেষ্ট থাকব। এসব প্রযোজনারভিত্তিতে নাট্যচেতনার নানা পরতে এ সময়ের ধ্বনি, এ সময়ের সুর, এ সময়ের তাল-লয়-সুর-ছন্দ, বোধ-বিশ্বাস, প্রায়োগিক ভাবনা ও সময়ের বিভা অনুসন্ধানে ব্যাপ্ত থাকব। এতে অতীতের প্রবহমান প্রবণতা যেমন উপলব্ধ হবে, তেমনি অতি সাম্প্রতিক-সময়ের নাট্যচর্চার রীতি-প্রকৃতি, প্রবণতার স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
আমরা এ আলোচনাটি শুরু করব করোনা লকডাউন সমাপ্তির শুরুতেই আলোচিত হয়ে ওঠা একটি নাটককে কেন্দ্র করে। একটি লৌকিক কিংবা অলৌকিক স্টিমার- আনন জামানের রচনায়, শহীদুজ্জামান সেলিমের নির্দেশনায় ‘ঢাকা থিয়েটার’ ৪৯তম প্রযোজনা হিসেবে নাটকটি মঞ্চে নিয়ে আসে। নাটকের বিষয়বস্তু এক অজানা ব্যাধি। নাটকের কাহিনি শুরু হয় এক ডকইয়ার্ডকে কেন্দ্র করে। যেখানে ধীরে ধীরে লোকজন জমায়েত হচ্ছে। কারণ, ওই শহরের প্রত্যেক মানুষই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে। ব্যাধিটি ছোঁয়াচে। শহরের সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ, এমনকি মন্ত্রীরাও আতঙ্কিত। একসময় সবাই শুনতে পায় পাশের নদীতে এক জাহাজ আসবে। যারা এ রোগে আক্রান্ত হয় নি এবং বাঁচতে চায়, তাদের সে জাহাজ নিয়ে যাবে দূরান্তের নীরোগ কোনো স্থানে। সবার বিশ্বাস, আসবেই সে স্টিমার উদ্ধার করতে। কিন্তু সেটি সত্যি স্টিমার কি না বা আসবে কি না কিংবা নিতান্ত কল্পনাপ্রসূত কি না, কেউ জানে না। নাটকটি সমসময়কে ধারণ করলেও নাট্যকার এটি অনেক আগেই রচনা করেছেন। হয়ত নাট্যকার তার অবচেতন মনেই এমন ভবিষ্যতের শঙ্কা দেখছিলেন। নাটকটি কোনো একক কাহিনি নির্দেশ করে না; কোনো এক জনপদের সামগ্রিকতাকে নির্দেশ করে। ঐতিহ্যবাহী বর্ণনাত্মক নাট্যরীতিতে প্রসেনিয়াম মঞ্চে উপস্থাপিত। মঞ্চে জাহাজ ঘাটের সাজেস্টিভ সেট। চরিত্র ও তার পোশাক বাস্তববাদী। এ নাটকে নানামাত্রায় সমকালকে ধরবার একটি প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। এ নাটকে যেন সমকাল আর ঐতিহ্য একই সূত্রে গ্রন্থিত হয়েছে।
‘পালাকার’র শামীম সাগর নির্দেশিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত উজানে মৃত্যু নাটকটি বিমূর্তবাদী শিল্পবৈশিষ্ট্যে অনবদ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সৃষ্ট এ ধাঁচের নাটকগুলোয় ঘটনার উদ্ভটতা, স্থানকালের অযৌক্তিকতা ও সংলাপের অর্থহীনতাসহ নানা অসঙ্গতি শৃঙ্খলাহীনতায় ক্লান্তিকর দর্শনের অভিজ্ঞতাই সাধারণত বেশি হয়। কিন্তু পালাকার-প্রযোজিত এ নাটক অরূপজাত চিন্তাকে যেন রূপের কল্পনায় দৃশ্যরূপে ধরেছে। তিনটি প্রতীকী চরিত্রের অস্তিত্বহীন অনিশ্চিত গন্তব্যের পরিক্রমায় মানবজীবনের প্রকৃত-সত্যকে সন্ধান করেছে। জাহাজের সাজেশনের মঞ্চ-বিন্যাসে অনবদ্য তার উপস্থাপন। এ নাটক ইউরোপীয় প্রসেনিয়াম মঞ্চরীতিকে ভেঙে তিনদিকের দর্শকবেষ্টিত রীতিতে উপস্থাপিত হয়েছে। এ নাটকের ডিজাইনের সমস্তটাই সাজেস্টিভ ঘরানার।
‘নাট্যম রেপার্টরি’ মঞ্চে নিয়ে আসে কোথায় জলে মরাল চলে নাটক। মোহন রাকেশের রচনায় অংশুমান ভৌমিকের অনুবাদে নির্দেশনায় ছিলেন আইরিন পারভীন লোপা। গৌতম বুদ্ধ যখন নির্বাণ শেষে কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে ফিরে একে একে সবাইকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করছিল, তখন তারই জ্ঞাতি ভাই নন্দের স্ত্রী সুন্দরী ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পক্ষে দাঁড়ায়। সুন্দরী বৈরাগ্যের বিপরীতে ভোগ-লালসা, আনন্দ-সৌন্দর্যকেই বড়ো করে দেখছিল। আয়োজন করেছিল কামোৎসবের। ধীরে ধীরে কীভাবে মোহগ্রস্ত অপরূপ নারী সুন্দরী সেই সমস্ত ইন্দ্রিয়গম্য সুখ পরিহার করে বৌদ্ধীয় ধ্যানকেই জীবনের সঙ্গী করে নেয়; মুক্তির সাধনায় ব্যাপ্ত হয়Ñএমনই আখ্যানের মঞ্চ-উপস্থাপন নানা সংবেদনশীলতায় উপস্থাপিত।
নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্র। নন্দ- বুদ্ধের বৈমাত্রেয় ভাই ও রাজকুমার, সুন্দরীÑনন্দের মহিষী এবং গৌতম বুদ্ধ। যদিও গৌতম বুদ্ধকে শুধু শেষদৃশ্যে সংলাপহীন দেখা যায়। কিন্তু নাটকের সর্বত্র নানা রূপকে তার উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে। প্রসেনিয়াম মঞ্চে চরিত্রাভিনয় ধারায় নাটকের উপস্থাপন। হৃদয়স্পর্শী বিষয়, রাজপ্রাসাদীয় সাজেস্টিভ নান্দনিক মঞ্চবিন্যাস, জৌলুসপূর্ণ বাহারি পোশাক, মানবীয় আবেগঘন পরিমিতমাত্রার অভিনয়ে থিয়েটারটি হয়ে উঠেছে অনবদ্য শিল্প। কামনার সঙ্গে মুক্তির দ্বন্দ্বে মানবমুক্তিই জয়ী হয়। প্রসেনিয়াম-উপস্থাপনরীতিকে আশ্রয় করে জীবন-জিজ্ঞাসার একটি বিশেষ দিককে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছেন নির্দেশক।
এরইমধ্যে মঞ্চে আলোচিত হয়ে ওঠে মাংকি ট্রায়াল নাটক। ‘বাতিঘর’র প্রযোজনায় সঞ্জয় সরকার মুক্তনীল যেখানে উচ্চারণ করলেন অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তার মঞ্চসংলাপ। খ্রিষ্টান মৌলবাদের বিরুদ্ধে মানবতার জয়গান। ঘটনায় আমেরিকার এক প্রদেশের স্কুলের এক শিক্ষককে ক্লাসে বিবর্তনবাদ পড়ানোর অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় হতে হয়েছিল। বিচারের নামে ধর্মীয় প্রহসনে প্রবর্তিত বাটলার অ্যাক্ট অনুযায়ী তাকে কারাদদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। খ্রিষ্টান গোঁড়া ধর্মযাজকরা মধ্যযুগে যেমন ইউরোপীয় মানবজীবনকে করেছিল নারকীয়; তেমনি আধুনিক যুগে এসেও মানুষের মুক্তচিন্তা ও বিকাশকে করেছে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যেন এ নাটকের দৃশ্যের পরতে পরতে। প্রসেনিয়াম-মঞ্চের বিন্যাসে অনবদ্যভাবে তার উপস্থাপন। যুক্তিবাদী দর্শনমুখী চিন্তনধারার এ নাটকের আলোচনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই ঢাকার অদূরে বাস্তবে ঘটে সেরকমই এক ঘটনা। এ নাটকে প্রগতিচেতনা নতুন আরেক সংশ্লেষ তৈরি করে। নির্মাণে বিশেষ কোনো ভাবনা কিংবা নিরীক্ষার বিপরীতে নির্দেশকের মনস্তত্বে ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধ-কণ্ঠস্বরই প্রধান।
২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগ ‘যাত্রা-আঙ্গি’কে মঞ্চে নিয়ে আসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটক। তরুণ নির্দেশক তানভীর নাহিদ খান ধর্মীয় উগ্রবাদের বিপরীতে অহিংস মানবতাবাদী রূপকে দেখাতে চেয়েছেন। নিজ সন্তানের রক্ত দেখে পুরোহিত রঘুপতির মধ্যে মানবতাবোধ জেগে ওঠে। চিৎকার করে ওঠেন- দেবী নাই, কোথাও নাই। এ মানবতাবাদ এ নাটকটির মূল। ঐতিহ্যবাহী যাত্রা-আঙ্গিকের সঙ্গে সমকালীন প্রসেনিয়াম-জ্ঞানের প্রভাবজাত ঢঙের প্রযোজনা এটি। প্রচলিত যাত্রার সাজেস্টিভ রীতির পরিবর্তে স্তানিস্লাভস্কীয় অতিমাত্রার চরিত্রাভিনয়, অতিবাস্তববাদী পোশাক, যাত্রার মিউজিক ভিন্ন মাত্রার এক আবহ তৈরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ শিক্ষায়তনিক নাট্যচর্চার রূপ-রীতির ক্ষেত্রে ইউজিসির সিলেবাসই প্রধান ভূমিকা পালন করে। ফলে বিদ্যায়তন ভিন্ন হলেও তাদের প্রবণতা প্রায় একই থাকে। এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের চর্চায়।
মোমেনশাহী গীতিকা অবলম্বনে মাধব-মালঞ্চী নাট্য-প্রযোজনায় ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ নাট্যজগতে বড়োসড় আলোড়ন তৈরি করে। ‘পালা-রীতি’ বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতি। আবহমানকাল ধরেই বাঙালির সমাজে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম এ পালারীতি। নির্দেশক রোকেয়া রফিক বেবী মাধব-মালঞ্চী নাটকটি ঐতিহ্যবাহী পালারীতিকে অক্ষুণ্ন রেখে আধুনিক প্রসেনিয়াম-মঞ্চজ্ঞানে উপস্থাপন করেছেন। একক পরিবেশনের রীতি ভেঙে বর্ণনা, বন্দনা, নৃত্য-গীত, অভিনয় ও দৃশ্যসজ্জার সংযোজনে অদ্বৈত উপস্থাপন করেছেন। এর কাহিনি রাজ-রাজড়া হলেও এ যেন প্রাত্যহিক গ্রামীণ জীবনের মানবিক-সমস্যাগুলোই চিহ্নিত করে। চরিত্র, সংলাপ, হাবভাব, চলনবিন্যাস ও আচরণ আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকেই নির্দেশ করে। সংগীত-নির্ভর কমেডি ও স্যাটায়ারের দ্রবণ বিদ্যমান। ঐতিহ্যবাহী চেতনায় আধুনিক রীতি ও আধুনিকতার অন্বেষণের প্রবণতাই যেন নাটকে অন্বিষ্ট।
‘বটতলা’ মঞ্চে নিয়ে আসে রাইজ অ্যান্ড শাইন। নির্দেশক ম সাঈদ ঢাকার কর্মজীবী নারীরূপকে পুরুষশাসিত সমাজ যেভাবে নারীর শৃঙ্খল পরিয়েছে তা দেখাতে চেয়েছেন। নারী বন্দি স্বামীর অনুশাসনের কাছে, সংসারের ঘানির কাছে ও বুর্জোয়া চালিত সমাজের প্রতিটি স্তরেই নারী চরমভাবে অসহায়। একজন পোশাকশ্রমিক নারীর জীবনের আধাবেলার কাহিনির মধ্য দিয়ে এমনই নারী জীবনের যন্ত্রণাগুলো ফুটে উঠেছে এ নাটকে। রাইজ অ্যান্ড শাইন নাটকটি ইতালির নাট্যকার দারিও ফো ও তার স্ত্রী ফ্র্যাঙ্কা রামের নাটক অবলম্বনে রূপান্তর করেছেন আবদুস সেলিম। একক চরিত্রের অভিনেয় নাটক এটি। রুশো প্রভাবিত সিমোন দ্য বোভেয়ার বা হুমায়ুন আজাদ নারী বলতে সামাজিক নারীকে যেমন বুঝাতে চেয়েছেন, তেমনি এ নাটকেও সমাজের সৃষ্ট শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারীসত্তাকেই দেখাতে চেয়েছেন। প্রসেনিয়াম-পরিবেশনারীতিতে মার্ক্সবাদী মানস এ নাটকে উপস্থিত।
জল পলকের গান নাটকে নিয়ে এলো আবহমান বাংলার পালাকারের প্রেমগাথা। সৈয়দ শামসুল হকের বুকঝিম এক ভালোবাসা অবলম্বনে নির্মিত এ নাটকের নাম জল পলকের গান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রযোজিত এ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। মনসুর বয়াতি মধ্যযুগের অত্যন্ত জনপ্রিয় পালাকার। মনসুর বয়াতির জীবনের একাকীত্ব, বিরহ-বেদনাই এ নাটকের প্রধান-অঙ্গী। শিল্পের হৃদয়ে কারো হৃদয় এসে পৌঁছালেই কি জীবনের সব প্রাপ্তির খতিয়ান করা যায়। যে কণ্ঠ দিয়ে মানুষের হৃদয়ে তান দিয়ে চলে মনসুর, সে কণ্ঠ বাজেয়াপ্ত করে দিলেই কি ভালোবাসার প্রাণভোমরাকে রুদ্ধ করা যায়। বয়াতির জীবনের এমন করুণ গাথা নৃত্য-গীত, অভিনয় ও চলনে উপস্থাপন হতে হতে কল্পনা-ইতিহাস থেকে উপস্থিত হয় চাঁদ সুলতানা, আবুল, হায়দার, মাতব্বর জং, নূরজাহান কিংবা ফিরোজ শাহ। আবহমান বাংলার শিল্পী ও শিল্পজীবন যেন নাটকের পরতে। পালারীতির নাটক হলেও পালাকার চরিত্রপ্রধান এটিই এ সময়ের একমাত্র নাটক।
এদিকে জয়পুরহাটের ‘শান্তিনগর থিয়েটার’ এইচআর অনিকের নির্দেশনায় মঞ্চে নিয়ে আসে বিশ্বখ্যাত চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির জীবনী নিয়ে নাটক। ভিঞ্চির জীবনকে আটটি দৃশ্যে বিভক্ত করে মঞ্চে উপস্থাপন করেন। এ সময় ‘বগুড়া থিয়েটার’ মঞ্চে নিয়ে আসে তৌফিক হাসান ময়নার নির্দেশনায় নাটক মজনু শাহ। ব্রিটিশদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে জেগে-ওঠা ফকির-সন্ন্যাস বিদ্রোহের অন্যতম নেতা মজনু শাহর জীবনী ও সংগ্রামকে আশ্রয় করে এ নাটক। ঐতিহ্যবাহী বাংলা-নাট্যরীতির আলেখ্যে অনবদ্যভাবে ফুটে ওঠে উপনিবেশের বিরুদ্ধে জীবনসংগ্রাম। মঞ্চ ডিজাইনে বাহুল্য না রেখেও ঐতিহ্যের পরম্পরা এখানে অনবদ্যভাবে ফুটে উঠেছে।
‘দেশনাটক’ ফাহিম মালেক ইভানের নির্দেশনায় মঞ্চে নিয়ে আসে পারাপার। এ যেন শিল্পের আড়ালে লুকানো শকুনদের চেহারা। শিল্পের ভেতরে যে অশুভ প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায় তা সবার চোখে পড়ে না। অসংখ্য শকুন শিল্পীর মোড়ক পরে থাকে। নানা প্রশ্নের উত্থাপন করে এ নাটক। শিল্পের আড়ালে কি সত্যি নারী ব্যবসার মতো জঘন্য প্রবণতা বিদ্যমান? কীভাবে শিল্পের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মুখোশ পরে থাকে শকুনরা? ব্যবসায়ীই কি শিল্পী সাজে! অথবা, একজন শিল্পীর জীবিকা-অর্জনের উপায়ই-বা কী! নাটকের শেষে নাট্যকার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন- শিল্পী কি শিল্পকে ভালোবাসবে? নাকি ভালোবাসবে তার প্রেমিকাকে? তাহলে বাঁচার জন্য কী করবে? ঐতিহ্যবাহী বাংলা-নাট্য-উপস্থাপনরীতির নন্দনে নাটকটি দর্শকের ভাবনার নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়। দেশ, সমাজ ও দেশজ-শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতার মানসিকতা এ নাটকে স্পষ্ট। এ নাটকে নৃত্য-গীত-সংলাপ-অভিনয়ে গল্পের গাঁথুনির গীতল ঢঙে নাটকীয় দ্বন্দ্বটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। নির্দেশক অনেকটা নিরাভরণভাবেই দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়েছেন। বাঙালির শিল্পচর্চার প্রেক্ষিতকে কেন্দ্র করে মানবীয় রক্তক্ষরণের গতিময় দৃশ্যরূপ মাঞ্জেলা কিংবা জোসনার রক্তক্ষরণের ধারায় দর্শককেও দগ্ধ করে। এ নাটকে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান।
‘আরণ্যক নাট্যদল’র রাজনেত্র নাটকে সমকালীন রাজনীতিকেই ব্যঙ্গ করতে দেখা যায়। অভিনয় নিয়ে কত রকমের কারিশমা করা যায় তা বেশি দেখা যায় আরণ্যকের নাটকে। এ নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। সাত্ত্বিক অভিনয়ের রকমফের, সংলাপের কত স্বর-বৈচিত্র্য, শারীরিক-ভঙ্গির কত হেরফের এবং গল্পের কত নৈপুণ্য এসবই দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করে। বিদ্রুপাত্মক ধারায় রাজক্ষমতার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণের মধ্যদিয়েই সমকালীন সমাজ-রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্যাটায়ার করেছে। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা হারুন রশীদ। রাজনীতির রাজা মাত্রেই বিত্ত বৈভব ভোগ বিলাসের কাছে বন্দি। জনগণ ও রাজার মধ্যকার দেয়াল পারিষদবৃন্দ। প্রতিটি দৃশ্যনির্মাণ অনবদ্য। নৃত্য-গীত-হাসি-কান্না-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সব মিলে একাকার এখানে। রাজ আদেশের নামে চলে কত শোষণ, পীড়ন ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ। রাজা তা জানেই না। এ নাটক থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নাটকে সমকালকে দেখবার, সমকালকে বুঝবার প্রবণতা থাকা প্রয়োজন। থিয়েটার শুধুই বিনোদন নয়, থিয়েটারও রাজনীতির হাতিয়ার। এ রাজনীতি মানুষের মুক্তির রাজনীতি। মঞ্চবিন্যাস, পোশাক কিংবা সংগীতের প্রাধান্যের চেয়ে মানুষের মুক্তির অন্বেষণই এখানে প্রধান।
‘থিয়েটার’-প্রযোজনা পোহালে শর্বরী নাটকে নারীর অধিকারকে প্রশ্ন করতে দেখা যায়। নারী কি শুধুই সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। নাকি সেও একজন মানবসত্তা। পুরুষের অধিকারের মতো তারও সবধরনের অধিকার-ইচ্ছা থাকবার কথা। তাহলে এর প্রতিবন্ধক কে? ইতিহাস থেকে ঘটনা নিয়ে সমকালীন জীবন-মানবিকতায় চলে তার উত্তর খোঁজা। ত্রপা মজুমদার নির্দেশিত এ নাটকটি প্রসেনিয়াম-মঞ্চে সংলাপাত্মক ধারায় আবেগিক ভাষায় যেন খুঁজে চলেছে নারীত্বের উত্তর। হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক সুরেন্দ্র বর্মার রচনা থেকে নাটকটি অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক।
বনপাংশুল নাটকে ফুটে ওঠে বিপন্ন মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শিল্পভাষ্য। সুকির আর্তচিৎকারে মান্দি জাতিগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা ও অস্তিত্বহীনতার যন্ত্রণা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছিল স্টুডিও থিয়েটারের মঞ্চজুড়ে। নৃগোষ্ঠী জনপদ বিলুপ্তির শঙ্কায় দর্শক যেন নড়েচড়ে বসছিল। ‘অন্তর্যাত্রা’ নাট্য-বান্যারে সেলিম আল দীন রচিত এ নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন খন্দকার রাকিবুল হক। এ নাটকের আখ্যান গড়ে উঠেছে মধুপুর গড়ের বনাঞ্চলে বসবাসরত নৃগোষ্ঠী গারো-মান্দির জীবন সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। আদিকাল থেকে যে বনভূমিতে বাস করছিল হঠাৎ সে বন ধ্বংসে তারা হয়ে উঠেছিল অসহায়। ভূমি দখল- শোষণ, মহাজনিপ্রথা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠনে- সুকি, গুণীন, রাজেন্দ্র, মঙ্গলি, সোনামুখী, নৃপেন যেন মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছিল। ঐতিহ্যবাহী-নাট্যরীতিতে নৃত্য-গীত-অভিনয়-দ্বন্দ্ব অনবদ্যতায় অদ্বৈতসুরে উপস্থাপিত। আবহমানরীতির চারদিকে দর্শক-বেষ্টিত মঞ্চরীতিত্ইে চরিত্র ও ঘটনার নানা আবেগ, নানা ম্যাটাফোরে উপস্থাপিত। ধূপ-ধোঁয়া, লাইভ মিউজিকের তারুণ্যে অনবদ্য।
অপরদিকে হাত বাড়িয়ে দাও নাটকে ফুটে উঠেছে মাতৃসত্তা। নারীর মাতৃত্ব যে কী আবেগপূর্ণ তা নতুন করে উপলব্ধি হলো এ নাটকে। ‘অপেরা’ থিয়েটারের এ প্রযোজনার নাট্যবস্তুটি গ্রহণ করেছেন ওরিয়ানা ফাল্লাচির লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন গল্প থেকে। অনুবাদ করেছেন আনু মুহাম্মদ। নির্দেশক সাজ্জাদ সাব্বির কী চমৎকারভাবে আলো, মিউজিক ও অভিনয়ে নাট্যমুহূর্তের বুনন তৈরি করেছেন। নাটকটি শুরু হয় সাদা কাপড়ে ঢাকা গর্ভের সাজেশনের প্রতীকে। যেখানে শিশুগুলো নড়াচড়া করছে। পৃথিবীতে যার আগমনের অপেক্ষা। শিশুর পৃথিবীযাত্রা অনিশ্চয়তা সত্যি ব্যথিত করে। কিন্তু ইউরোপে গর্ভধারণ-সমকামিতাকে কিছু মনে না করলেও আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি তা সায় দেয় না। ধর্মের শাশ্বত নৈতিকতাবোধের সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক। বাস্তববাদীরীতিতে মার্ক্সবাদী বস্তুবাদই এখানে অন্বিষ্ট।
পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা যুগ যুগ ধরে অসহায়। নারীসত্তার প্রকৃত প্রার্থনা কী তা যেন নতুন করে খোঁজ করছে ‘সাধনা আর্টস অ্যান্ড থিয়েটার’। নাটকটির নির্দেশনায় আইরিন পারভীন লোপা। সাধনা আহমেদ রচিত এ নাটকে দেখা যায় অধিবাস্তবিক ধারায় প্রার্থিনী সত্তার জাগরণের মধ্য দিয়ে নারীর মনস্তত্ত্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৌঠান ‘কাদম্বরী’ চরিত্রকে কেন্দ্র করে নারীবাদী চিন্তার আবর্তন। কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যার পূর্বমুহূর্তে আফিমজল পান করতে গিয়ে সাজটেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। কাদম্বরীর ভেতর থেকে বের হয়ে আসে আরেক সত্তা। দুই-সত্তার দ্বান্দ্বিক ঘূর্ণাবর্তে উন্মোচিত হতে থাকে নারীর বঞ্চনা, চাওয়া-পাওয়া, অস্তিত্বহীনতা, চিরায়ত নারীসত্তাসহ সেসময়ের ইতিহাস।
অ্যাক্টোম্যানিয়ার হ্যামলেট মেশিন নাট্যপ্রযোজনায় যেন কল্পনার বাঁধ ভেঙে দেয়। জার্মান নাট্যকার হাইনার ম্যুলারের রচিত, কবীর চৌধুরীর অনুবাদে নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন নওরীন সাজ্জাদ। নাটকটির প্রদর্শনী শুরু হয় হ্যামলেটের সংলাপের মধ্যদিয়ে- ‘আমি হ্যামলেট নই, আমাকে বলবার মতো আমার সংলাপের আর কিছু নেই। আমার চিন্তা চিত্রকল্পগুলি থেকে রক্ত শুষে নেয়। আমার নাটক আর ঘটে না।’ কাহিনিটি বহুস্তরীয়-বহুমাত্রিক। প্রথাগত থিয়েটার ভেঙে এটি পোস্টমডার্ন পরিবেশনা। এতে সার্বিক-বিশেষের কোনো পার্থক্য নেই। নির্দেশক স্থান-কালের গণ্ডি রাখেন নি। সুনির্দিষ্ট ঘটনা-চরিত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে বিধ্বস্ত মানবিক অভিব্যক্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা, চরিত্রের অর্ন্তদহন, বাণিজ্যিক সভ্যতা, মানুষের স্খলন-অধঃপতন, নৈরাজ্যবাদ ও স্বপ্ন-বাস্তবতাকে প্রতীকাবলির সংমিশ্রণে দেখাতে চেয়েছেন। বাস্তববাদী মঞ্চরীতিতে বাস্তবিক কথনই যেন নাটকে স্থান পায়।
দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নাট্যশিক্ষকের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল। মেছো জাতি হিসেবে বাঙালির আবহমান পরিচয় থাকলেও মৎস্যশিকার নিয়ে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য কোনো সাহিত্যকর্ম নেই। বাঙালিদর্শনে সাধনায় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি বলে কিছু নেই। কিংবদন্তির সোনারঙা বোয়াল যেন অধরাই থেকে যায় চিরকাল। নিকারিদের এমনই জীবন-প্রবাহ ফুটে ওঠে প্রযোজনা দুটোর দৃশ্যের পর দৃশ্যে। ‘থিয়েট্রেক্স’ প্রযোজিত সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত নাটকে প্রধান চরিত্র মাছ- স্বর্ণবোয়াল। এ নাটকে সাঁঝমালা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী। সাঁঝমালা ও স্বর্ণবোয়াল এক সুতোয় বাঁধা। তিরমন যেন তারই সাধনায় লীন। বোয়ালটিকে যেন কূলের তিরতিরে জলে টেনে আনলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চারদিক। এ প্রযোজনায় একজন শিল্পীর শিল্পজীবনের চরম আকাক্সক্ষাকেই খুঁজে ফিরতে চেয়েছেন। অপরদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রযোজিত ইউসুফ হাসান অর্ক নির্দেশিত নাটকে মানুষই প্রধান। যে মানুষগুলো স্বর্ণবোয়াল ধরবার খোয়াবে বিভোর। জাতিপরম্পরায় তিরমনের মনেও বুনে দিয়েছে সেই স্বর্ণবোয়ালের নেশা। তিরমন উপলব্ধি করে জীবনের অপ্রাপ্তি ও প্রাপ্তির হিসাব কতটা তুচ্ছ। অনুভব করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চিরন্তন গণিতে মানবসভ্যতার বয়ে চলা বোধিসত্ত। রূপক উপমার মানবসত্তার সীমানা পেরিয়ে স্বর্ণবোয়াল একটি চিরন্তনী রহস্য। দুটো প্রযোজনাই আবহমান-বাংলা-নাট্যরীতির আলেখ্যে। ঐতিহ্যবাহী বাংলাঅঞ্চলের নাটকে নৃত্য-গীত-অভিনয়-গল্প নানা কিছু এক ঐক্যতানিক বন্ধনে একীভূত থাকে। দ্বান্দ্বিক বিন্যাসের চেয়ে জীবনের প্রাণই গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে। বাংলানাট্যরীতির নিরীক্ষাই এ দুটো প্রযোজনায় প্রধান হয়ে ওঠে। আর গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে বাঙালির দর্শনের অনুসন্ধান।
নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের ‘আলী যাকের নাট্য প্রণোদনা’য় নতুন কয়েকটি নাটক মঞ্চে আসে। তারমধ্যে অন্যতম ‘হৃৎমঞ্চ’-প্রযোজনা রিমান্ড। বাংলাদেশের বর্ষিয়ান অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর দীর্ঘ সময় পর এ মঞ্চে অভিনয় করেছেন। নাটকটির রচয়িতা ও নির্দেশক শুভাশিস সিনহা। নাটকের মূলে আছে একজন নৈরাজ্যবাদী লেখকের সত্তা। তরুণদের বিধ্বংসী নানা প্রবণতা উসকে দেবার অপরাধে তাকে গোয়েন্দার জেরার সম্মুখীন হতে হয়। নাটকটির দৃশ্য নির্মাণের অতটা কারিশমা নেই; যতটা কারিশমা আছে চিন্তার ভাব-প্রকাশে। কারিশমা আছে সংলাপের দ্বান্দ্বিক খেলায়। নাট্যকার লেখকের মনস্তত্ত্বকে আশ্রয় করে নৈরাশ্যবাদী বিধ্বংসী প্রবণতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। বিপরীতমুখী দুটি চরিত্রকে দিয়ে নৈরাজ্যচেতনা, সমাজের ক্ষত, জীবনের নানা অনুষঙ্গ, টানপোড়েনগুলো তুলে ধরেছেন। খুব বড়োধরনের কোনো মঞ্চসজ্জা নেই। প্রচলিত রিমান্ডের মতো দুটো চেয়ার ও একটি টেবিল। প্রসেনিয়াম-মঞ্চবিন্যাসের ইউরোপীয় দ্বন্দ্ব-নির্ভররীতিতে বাস্তববাদী ধারায় নাটকটি উপস্থাপিত।
আলী যাকের নাট্য প্রণোদনার আরেকটি নাটক প্রাচ্যনাট-প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অচলায়তন নাটকটি এ সময়ে বিশেষ মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। নির্দেশক আজাদ আবুল কালাম এ নাটকে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক নারী-শিক্ষার অচলায়তনকে চিহ্নিত করেছেন। মানবমুক্তি বা গতিতে ভিন্ন আরেক মাত্রা যোগ করেছেন। প্রসেনিয়াম-আর্চেই নৃত্য-গীত-অভিনয়ে অনবদ্য হয়ে ওঠে নাট্যবাস্তবতা। থিয়েটার যে অনবদ্য মঞ্চমায়া তৈরি করবে এ নাটকে যেন সে প্রবণতাই বিদ্যমান। প্রথা, ধর্ম ও সমাজের অচলায়ন ভেঙে মানুষের মুক্তিই এর মূলসুর।
এ সময়ের আরেক প্রযোজনা সখী রঙ্গমালা। জনপ্রিয় উপন্যাস নিয়ে মঞ্চনাটক নির্মাণ করতে গেলে নানা ঝামেলায় পড়তে হয় তা অনেকেই জানে। কিন্তু নাটকের দল ‘বটতলা’ বরাবরই সেসব ঝামেলা উপড়ে গেছেন। শাহীন আখতার রচিত সখী রঙ্গমালা উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি নৃত্য-গীত-অভিনয়ে অনবদ্য নাটক। নির্দেশনায় মোহাম্মদ আলী হায়দার। এর কাহিনি দুশ বছর আগের এক কিংবদন্তি ঘিরে আবর্তিত। নারীর দৃষ্টিকোণে পুরুষের ভোগবাদী-মানসিকতা, ক্ষমতার লড়াই ও মানবীয় দ্বন্দ্ব উপস্থাপিত হয়েছে। এ নাটকে রঙ্গমালা ও রাই বিপরীত সত্তার প্রতীক হলেও যেন একই রূপের আধার। আর সমাজের চৌধুরী যেন ভোগলিপ্সার প্রতীক। বাংলা-নাট্য-আঙ্গিকের ধারায় বর্ণনাত্মকরীতিতে প্রসেনিয়ামমঞ্চে নৃত্য-গীত-অভিনয়ের ঐক্যতানিক সূরে গাঁথা। ঐতিহ্যবাহীরীতির সঙ্গে আধুনিক-নাট্যরীতির সংশ্লেষ বিদ্যমান। বর্ণনার সঙ্গে চরিত্রাভিনয় নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে।
‘তাড়ুয়া’ প্রযোজিত বাকার বকুলের আদম সুরত নাটকটি গভীর বাস্তবতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সমষ্টি, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবুল। এ নাটকে হিসাবুল অপেক্ষা করে মাটির তলদেশে মুনকার-নকীবের তিন সওয়ালের। একে একে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। আত্মজিজ্ঞাসাই সামাজিক-জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিক দোলাচল ও রাজনৈতিক-নিষ্পেষণের বিকলাঙ্গ এক রূপরেখায় যেন বিধ্বস্ত মানবতা। অশিক্ষা-কুশিক্ষা মগজে যেন যাপিত-জীবনের যন্ত্রণারই লীলাক্ষেত্র, আবার মুক্তি-অন্বেষী মানুষও নিস্পৃহ কিংবা আক্রমণের শিকার- এমনই এক জনপদের ক্ষয়িষ্ণু প্রতিচ্ছবি এ নাটক। এ সময়ে নাট্যচর্চার পরিপ্রেক্ষিতে এর উপস্থাপনরীতি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে প্রত্যুজ্জ্বল। প্রচলিত মঞ্চবিন্যাসকে ভেঙে তিন দিকে দর্শক বসার স্থান দেয়া হয়েছে। এ ধরনের মঞ্চবিন্যাসে সাধারণত কোনো সেট ব্যবহার করতে দেখা যায় না। কিন্তু এ নাটকে সেট ব্যবহার হয়েছে। মঞ্চের মধ্যে একটি কবরের সাজেশন। তিন দিকে দরজার সাজেশন। দরজার নিচেই কসাইয়ের দোকানের প্রতীকীরূপ নির্মাণ করেছেন। অভিনেতৃর মঞ্চে প্রবেশের পথও বৈচিত্র্যময়। কোরিওগ্রাফি ও প্রপসের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারের নানা মুহূর্ত অনবদ্য। কখনও কোরিওগ্রাফি, কখনও ভাষা, কখনও চরিত্রের সঙ্গে আলো-সংগীতের মায়াজালের দৃশ্যকল্প তৈরি। এ প্রযোজনাটিও আলী যাকের নাট্য প্রণোদনায় মঞ্চে আসে।
‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’ একসময় প্রযুক্তিসভ্যতার আগ্রাসনে মানবজীবনের অসহায়ত্ব নিয়ে রচিত শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস নাট্যপ্রযোজনা দিয়ে দর্শককে যেমন বিমোহিত করেছে, জবর আজব ভালোবাসা দিয়ে আনন্দে ভাসিয়েছে, তেমনি শাহাদুজ্জামান রচিত ও সাইফ সুমন নির্দেশিত নাজুক মানুষের গল্প নাটকে সমকালীন দার্শনিক-বাস্তবতা দিয়ে দর্শককে আপন করে তুলেছে। এক অন্বেষী ও এক প্রজ্ঞাবান দার্শনিকের কথোপকথনের ধারায় জীবন ও জগতের সত্যগুলো উন্মোচনের পথ খোঁজে। বিমূর্তবাদী সেট ও সংলাপের চমৎকারিত্বে অনবদ্য। যেন এ যুগের সক্রেটিস ও তার শিষ্য। যুক্তির খোঁজে যাদের যাত্রা। নাটকটি দেখতে দেখতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কেন এমন চিন্তাশীল মানুষের জন্ম হয় না? ‘থিয়েটারওয়ালা’ তাদের প্রতিটি প্রযোজনায় আধুনিক ও বুদ্ধিভিত্তিক নতুন থিয়েটারের অন্বেষণ করেছে।
আমি বীরাঙ্গনা বলছি প্রযোজনায় সৈয়দ জামিল আহমেদ মঞ্চে সৃষ্টি করেছেন মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা নারীসত্তার মানবিক-অভিঘাত। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে অনেকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাবে অভূতপূর্ব সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু নারী মুক্তিযোদ্ধারা কী পেয়েছে? ধর্ষিতার গ্লানি ছাড়া তাদের ভাগ্যে আর কী জুটেছে? জুটেছে বঞ্চিত লাঞ্ছিত জীবন। ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিও তাদেরকে চিড়িয়াখানার জন্তুতে পরিণত করেছে। নাটকটির কাহিনি গ্রহণ করেছেন নীলিমা ইব্রাহিম রচিত বীরাঙ্গনা নারীর আত্মজীবনীমূলক গল্পগ্রন্থ থেকে। এতে মুক্তিযুদ্ধে ৭জন বীরাঙ্গনার বীভৎস্য অভিজ্ঞতা থেকে ২জনের আত্মকাহিনি উপস্থাপন করেছেন। এ উপস্থাপনের মধ্যদিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন নারীর প্রতি নির্যাতন, সহিংসতাসহ যুদ্ধোত্তর সময়ে নিগৃহীতের মর্মপীড়া অনবদ্য শিল্প-আলেখ্যে নান্দনিক কুশলে উপস্থাপিত হয়েছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ বরাবরই মঞ্চে ইঙ্গিতময় বাস্তবতা নির্মাণ করেন। এ নাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। আলোর নানা অর্থ যেমন আবেগের গভীরতাকে উসকে দেয় তেমনি মিউজিকের অনবদ্যতা হৃদয়ের অতলকে নাড়া দিয়ে যায়। গল্পকথনের সুরে দৃশ্যনির্মাণের অলংকরণে ভালোলাগা ছুঁয়ে যায়। সংলাপ প্রক্ষেপণ, বিশ্বাসযোগ্য চলন, শারীরিকভঙ্গি, অভিনয়ের যুগপৎ সম্মিলনে অনবদ্য। আসলে বীরাঙ্গনা যে বারাঙ্গনা নয় সেটিই এ নাটক বুঝিয়ে দিতে চেয়েছে।
নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় অন্তরে বাহিরে চিত্রাঙ্গদা নাটকে দেখাতে চাইলেন নারীর আত্ম-অন্বেষণ। সৌন্দর্য নারীর অহংকার। কিন্তু একমাত্র সৌন্দর্যই কী নারীসত্তার মাপকাঠি! নির্দেশক প্রখ্যাত অভিনেত্রী সারা যাকের এ নাটকে নারীবাদী নতুন দৃষ্টিকোণে চিত্রাঙ্গদা-অর্জুনের সম্পর্কের মনস্তত্ত্বকে ভিত্তি করে নারীর আবেগ, সৌন্দর্যসত্তা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে নৃত্য-সংগীত-অভিনয়ের অদ্বৈত নান্দনিক ভাষ্যে তুলে ধরেছেন। দেহছন্দ, চলন, নৃত্য ও ভাবপ্রকাশের নিপুণতায় দুজনের সম্পর্ক ও সম্পর্কের মনস্তত্ত্ব অনবদ্য জীবন্ত।
নাট্যকেন্দ্রের প্রযোজনা তীর্থযাত্রী নানা কারণে গুরুত্ববহ। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন তৌকীর আহমেদ। নাটক ঠুনকো বিনোদন না হয়েও সমাজ-মানুষ-সভ্যতার স্বরূপ উপলব্ধি ও দায়বোধ যে নাটকে থাকা উচিত এ নাটক তাই প্রমাণ করে। তিন পরিব্রাজকের বিশ্বপরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে অ্যাপিসটোমোলজিক্যাল ধারায় জীবন-জগৎ, সমাজ-সভ্যতা, ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের দার্শনিক-দৃষ্টিভঙ্গিতে অনবদ্য। ইতিহাস-সমাজ বিবর্তনের ধারায় নিজস্ব দার্শনিক উপলব্ধি। দীর্ঘ সময়যাত্রা আর জনপদ, জনযাত্রা, ভাবধারা পরিক্রমণ-পরিবর্তন নৃত্য-গীত, অভিনয়, রং-রূপ দৃশ্যকল্পের মাধুর্যের ধারায় অনবদ্যভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে মঞ্চে। এতবড়ো ক্যানভাসের বিষয় হয়েও, এত জটিল দার্শনিক চিন্তা হয়েও, গল্পকথনের ঘনঘটা না হয়েও এত সরল-বুদ্ধিদীপ্ত ও নান্দনিক নাট্যপরিবেশ নির্মাণ সাধারণত দেখা যায় না।
এরমধ্যেই ‘আরশিনগর’ প্রযোজিত সিদ্ধার্থ নাটকটিতে দর্শক উপচে পড়ে। হেরমেন হেসে রচিত সিদ্ধার্থ উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি নির্মাণ করেছেন রেজা আরিফ। হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ উপন্যাসটি মূলত গৌতম বুদ্ধের নির্বাণ সাধনপথের উল্টো পথ। দুঃখ, কামনা-বাসনা, জরা-ব্যাধি, জন্মান্তর নির্বাপণ বা নির্বাণের পথে মানবমুক্তির সাধনায় গৌতম বুদ্ধ কৃচ্ছ্র অবলম্বন করেছেন। অধিক ভোজন করা যাবে না, নারীসঙ্গ গ্রহণ করা যাবে না, জ্ঞান-সংঘে সমর্পণ, ভিক্ষু ও ভিক্ষাবৃত্তিকে অবলম্বন করে ধ্যানসাধনার পথে মুক্তির অনুসন্ধান করতে হবে। কিন্তু ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতি চিরকালই আবহমান এ বাংলা খণ্ডের নানা রূপ-রীতিকে পঁচিয়েছে। হেসে কিছুদিন ভারতে বৌদ্ধদর্শন ও সাধনপদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধার্থ উপন্যাস রচনা করেছেন। এ উপন্যাসের নায়ক সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ নয়। এটি গৌতম বুদ্ধের সময়কালে সিদ্ধার্থ নামের এক যুবকের আধ্যাত্মিক সাধনার অভিযাত্রা। এ সাধকের মধ্যদিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে বুদ্ধের দর্শনের অনেক কিছুর অসারতা প্রমাণ করে নতুন আরেক বুদ্ধ তৈরি করেছেন। যে জ্ঞানতত্ত্ব নির্মাণ করেছেন কান্ট, হেগেল, ডেকার্ত প্রমুখের দার্শনিকবোধকে আশ্রয় করে। ডেকার্ত ‘ডিসকোর্স অন মেথড’-এ উল্লেখ করেছেন একসময় তিনি শিক্ষক, গুরু কিংবা জ্ঞানের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে প্রকৃতি-পাঠশালায় নিজেকে খুঁজে ফিরেছেন। এ উপন্যাসেও তাই। বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সিদ্ধার্থ ছিলেন বৈরাগ্যবাদী ঈশ্বরচিন্তাহীন কর্মনির্ভর মানবমুক্তিকামী। এখানে সিদ্ধার্থ ভোগী ও সর্বভূতে ঈশ্বরবাদী। নাটকে কী চমৎকারভাবে সাধনার ক্রম-পর্যায়-পরিণতি-উপলব্ধিগুলো তুলে ধরেছেন। অভিনয়, শারীরিকচলন, সংগীত ও আলোর মায়ায় কী অপূর্ব দৃশ্যের পর দৃশ্য নির্মাণ করেছেন। অ্যাপিসটোমোলজিক্যাল চিন্তাগুলোর দৃশ্য নির্মাণে অত্যন্ত নান্দনিক শিল্পমার্গ হয়েছে। নাটকে দার্শনিক স্ট্যান্ড পয়েন্টগুলোও খুব সুন্দর। ‘আমি মেডিটেশন করতে পারি, ধৈর্য ধরতে পারি, উপোস করতে পারি।’ সিদ্ধার্থ হাঁটলেন বণিকগিরির পথে, নারীসঙ্গের পথে। শেষে সিদ্ধার্থের মুক্তি ঘটে নদী-প্রকৃতি-জীবন ও মৃত্যু উপলব্ধির মধ্যদিয়ে।
আবু সাঈদ তুলু ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যসমালোচক, লেখক