Full premium theme for CMS
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’-এর অস্তিত্ব থাকা না-থাকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার বয়স কম করে হলেও দুই-যুগ। দুই-যুগ ধরেও (প্রকৃত-বিবেচনায় চার দশকের বেশি সময়) নানান যুক্তিতর্ককে ‘থোড়াই-জ্ঞান’ করে যে ফেডারেশান টিকে আছে, তাকে এক ফুৎকারে নিভিয়ে দেয়া সহজ-ব্যাপার না। যথাযথ যুক্তি-প্রমাণ হাজির না করে, তাকে অবলুপ্ত করার বাসনা-প্রকাশও যৌক্তিক বলে মনে করছি না।
কিন্তু সর্বশেষ একটি সংবাদ প্রায় সবাইকে বেশ নড়েচড়ে বসতে তাড়িত করেছে। আর্থিক-দুর্নীতির ‘অজুহাত’ দেখিয়ে (অজুহাত বলছি এ কারণে যে, তদন্ত-কমিটি গঠন করে এর সত্যতা প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা-পর্যন্ত ফেডারেশান এখনও নেয় নি) নির্বাহী পরিষদের দুজন সদস্যকে পদচ্যুত করা হয়েছে। অথচ সেই দুজন স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে, তারা অশালীন-অন্যায়ের স্বীকার, যা তাদের থিয়েটার-জীবন তো বটেই, স্বাভাবিক পারিবারিক ও সামাজিকজীবনকেও অসম্মানজনক-পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। এবং, এই ভিকটিমরাই চাচ্ছে স্বচ্ছ-তদন্ত। একবার দু-বার না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার তারা এর স্বচ্ছ-তদন্ত চেয়ে চলেছে। অথচ, এ ব্যাপারে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না। এক্ষণে মনে হলো, বাংলাদেশে থিয়েটারচর্চার শুরু থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটারচর্চা ও ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’-এর সৃষ্টি ও অনেক ব্যর্থতা থাকা সত্ত্বেও এর অস্তিত্ব টিকে থাকার বিষয়টিতে আদ্যোপান্ত-ভ্রমণ করা দরকার। আর তা থেকে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনে দিন’ কেমন হতে-পারে তার একটি হদিস মেলানোর চেষ্টা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। সে লক্ষ্যেই এই লেখার অবতারণা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বিজয়ের-পর, অর্থাৎ, স্বাধীন-সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র পাওয়ার পর, এখানে নিয়মিত এবং দর্শনীর-বিনিময়ে মঞ্চনাট্যচর্চা বা গ্রুপ থিয়েটার চর্চা শুরু হয়।
উপরের কথাটি বহুলপ্রচলিত একটি ইতিহাস-সত্য কথা। কিন্তু কথাটির মধ্যে যে ‘নিয়মিত’ আর ‘দর্শনীর বিনিময়ে’ শব্দগুলো আছে, সেগুলোকে আমরা অনেকেই আমলে না নিয়ে ধরে নিই যে, আমাদের এখানে মঞ্চনাট্যচর্চা বুঝি শুরুই হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে। আরো একটু এগিয়ে এ-ও মনন-মগজে ঢুকিয়ে ফেলেছি যে, স্বাধীনতা-সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা কলকাতায় অবস্থান করছিল এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে জড়িত ছিল, তারা ওখানকার মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে পরবর্তীসময়ে সেই অভিজ্ঞতার আলোকে স্বাধীন দেশে মঞ্চনাটক করায় উৎসাহিত হয়। সবই সত্য, তবে মনে রাখতে হবে ‘নিয়মিত’ ও ‘দর্শনীর বিনিময়ে’ শব্দগুলো। অর্থাৎ স্বাধীনতার আগেও আমাদের এখানে মঞ্চনাটক হয়েছে, তবে তা অনিয়মিত এবং স্বাধীনতার আগেও আমাদের এখানে মঞ্চনাটক হয়েছে, তবে তা দর্শনীর বিনিময়ে নয়। অর্থাৎ এক্কেবারে সৌখিনমঞ্চনাট্যচর্চা (যেহেতু ‘সৌখিন’, তাই এটিকে ‘চর্চা’ বলা যাবে কিনা, এই বিতর্কে গেলে মূলকথা হারিয়ে অহেতুক-তর্কেই সময় চলে যাবে। তাই মেনে নেয়া যাক, ‘সৌখিন’ হলেও ওটি ছিল আমাদের ‘নাট্যচর্চা’)।
আমাদের দেশে অনেককাল থেকেই মঞ্চনাটক মঞ্চায়নের চলন আছে। তবে তা, আগেই বলেছি, আপাদমস্তক সৌখিন। মঞ্চনাটক হচ্ছে শহুরে-নাট্যচর্চা। এটিকে এককথায় বলা যায় ‘থিয়েটারচর্চা’। এই ‘চর্চা’র সাথে জড়িত হয় মূলত শহুরেমধ্যবিত্তশ্রেণি। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বড় বড় শহরে তো বটেই, বিভিন্ন জেলাশহরে, এমনকি তৎকালীন মহকুমাশহরে আর থানা-শহরেও নাটক মঞ্চায়নের প্রচলন ছিল। এখানে একটি কথা বলে নেয়া ভালো, বোঝার সুবিধার জন্য এই লেখায় মঞ্চনাট্যচর্চাকে আমরা ‘থিয়েটারচর্চা’ও বলব। মানে, যখন যেটি বললে শুনতে-পড়তে ভালো লাগে, সেটিই বলব। যদিও ‘থিয়েটার’ বলতে যদি ধরা হয় ত্রি-মাত্রিক স্পেস থাকবে, থাকবে অভিনেতৃ আর থাকবে দর্শক, যাদের সামনে সচেতনভাবে অভিনেতৃ কিছু-একটা উপস্থাপন করবে, তাহলে অনেককিছুকেই আমরা থিয়েটার বলতে পারি। মঞ্চে দর্শকের সামনে গান গাওয়াও থিয়েটার, নৃত্য করাও থিয়েটার। মঞ্চে দর্শককে যাদু দেখানোও থিয়েটার।
এসবকে যদি থিয়েটার বলি, তাহলে প্রত্যেক দেশ বা জাতিতে যেসব দেশজপারফরমেন্স বা দেশজনাট্য আছে সেগুলোও অতি-অবশ্যই থিয়েটার। বিশ্ব নিয়ে আলাপে না গিয়ে কেবল বাংলাদেশ বা ধরা যাক, আমাদের এই অঞ্চলটিকে নিয়েই কথা বলি। আমাদের বহু দেশজনাট্য আছে। কিছু নাম বলা যাক, পুঁথি বা পুঁথিপাঠ, কীর্তন, গম্ভীরা, সাঁওতাল নৃত্য, রামায়ণ গান, ব্রতচারী, বেদের গীত, বিচার গান, বিয়ের গীত, পদ্মাপুরাণ ও ভাসান, গাজীর গীত, বারসী, অষ্টক গান, রয়ানী, জারীগান, কবিগান, সঙযাত্রা, যাত্রা (বা যাত্রাপালা), এগুলোও আসলে ‘থিয়েটার’। কিন্তু এসব দেশজনাট্যের বিশেষ-উৎকর্ষ হলো, এদের নিজস্ব আলাদা আলাদা নাম আছে, এরা কম-বেশি পেশাদারিভিত্তিতে চর্চিত হয়, গ্রামীণ-জনগোষ্ঠীর মধ্যে চর্চিত হয় এবং অবশ্যই অঞ্চলভিত্তিক-লোকসমাজ তথা দর্শকের সামনে প্রদর্শিত হয়। এদের বয়স কম-বেশি হাজার বছর। সমগ্রতার বিচারে এসব নাট্য আমাদের গর্ব, আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু স্বতন্ত্রভাবে এরা প্রত্যেকেই অঞ্চলভিত্তিক-পরিবেশনা। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, গম্ভীরা যারা করে বা দেখে, তারা হয়ত কোনোদিনও সঙযাত্রা দেখে নি (ভাইস ভার্সা)। আবার যারা সাঁওতাল নৃত্য করে বা দেখে, তারা হয়ত কোনোদিনও বেদের গীতের সাথে পরিচিত না। বলে রাখা ভালো, এখানে নির্দিষ্ট পরিবেশনের সাথে-জড়িত শিল্পী-কলাকুশলী-দর্শকের পরিচয়-অপরিচয়ের কথা বলছি। যদিও, নানান-গবেষক ‘গবেষণার খাতিরে’ এধরনের সব-নাট্যরীতির সাথেই বেশ পরিচিত।
এই লেখাটিকে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ নাম দিয়েছি এবং সেটি হচ্ছে, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান থাকা না-থাকার পরও আমাদের মঞ্চনাট্যচর্চা কীভাবে এগিয়ে গেলে আরো সমৃদ্ধরূপ নেবে বলে মনে করি, তা নিয়ে কথা বলা। যার-কারণে আমাদের দেশজ-নাট্যঐতিহ্য ও তার চর্চাকে আমাদের শহুরেনাট্যচর্চার সাথে মিলিয়ে-মিশিয়ে জগাখিচুড়ি করব না। সেকারণেই নিজস্বভূমি-থেকে-সৃষ্ট হাজার বছরের নাট্যচর্চা যারা করে, তাদের কাজের সাথে শহুরে-নাট্যচর্চাকে একাকার না-করার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছি। আর তাই, আমাদের শহুরেমঞ্চনাট্যচর্চাকেই এখানে ‘থিয়েটারচর্চা’ বলতে চাচ্ছি আর দেশজনাট্য-ঐতিহ্যকে দেশজনাট্য (অথবা যার যার নাম ধরে, ধরা যাক, গম্ভীরা হলে গম্ভীরা, সাঁওতাল নৃত্য হলে সাঁওতাল নৃত্য কিংবা কবিগান হলে কবিগান) উল্লেখ করার বাসনা নিয়েছি। বলে রাখা ভালো, এই মঞ্চনাট্যচর্চায় বা থিয়েটারচর্চায় উপরে উল্লিখিত দেশজনাট্যরীতির গবেষকের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। কারণ, তারা জানান দিয়েছে যে, থিয়েটারচর্চা শহুরেনাট্যচর্চা হলেও এর বিষয়বস্তু ও প্রযোজনা-অভিনয়রীতিতে আমাদের নিজস্বনাট্যরীতির (এমনকি নাটক-রচনাশৈলীরও) সন্নিবেশ ঘটালে এই শিল্পমাধ্যম আরো অধিকতর শিল্পীত ও সমৃদ্ধ হবে, আরো বেশি ‘আমাদের’ হয়ে উঠবে। এবং আমরা লক্ষ করি যে, বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের রচনা-উপস্থাপনায় বর্তমানে প্রচুর দেশজ বা নিজস্বনাট্যচিন্তা-পরিবেশনার মিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু স্পষ্ট হওয়া দরকার, এসব মিশ্রণের ফলে যে শিল্প মঞ্চে দাঁড়ায়, সেটি এতক্ষণ ব্যাখ্যা-করা ‘থিয়েটার’ বা ‘মঞ্চনাট্য’ই দাঁড়ায়, দেশজনাট্য দাঁড়ায় না। এবং যারা এই শহুরেনাট্যচর্চায় জড়িত, তারা সচেতনভাবেই এই শহুরে-থিয়েটারচর্চাই করে, দেশজ বা নিজস্বনাট্যচর্চা নয়। তাই, উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, ‘ঢাকা থিয়েটারে’র কেরামতমঙ্গল কোনো মঙ্গলযাত্রা না, ‘ঢাকা পদাতিকে’র এই দেশে এই বেশে কোনো গম্ভীরা না, ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র সঙক্রান্তি কোনো সঙযাত্রা না, ‘ঢাকা থিয়েটারে’র প্রাচ্য কোনো পাঁচালী/ভাসানযাত্রা না, বনপাংশুল কোনো আদিবাসী-কৃত্য না। এ সবগুলোই আধুনিক-থিয়েটার তথা শহুরেমঞ্চনাট্য, অর্থাৎ, ‘থিয়েটারচর্চা’। থিয়েটারচর্চাকে ‘আধুনিক’ বলছি একারণে যে, এর রচনা-উপস্থাপনায় থাকে বস্তুবাদীচিন্তা, আধ্যাত্মিকতার স্থান এখানে অপাঙ্ক্তেয়।
এবার এগিয়ে যাই মূললক্ষ্যে, মূলকথায়। অর্থাৎ আমাদের থিয়েটারচর্চায় কী কী পরিবর্তন আনলে আমরা বর্তমান বা আগের চেয়ে নিয়মিত ও সমৃদ্ধ-থিয়েটারচর্চা করতে পারব।
স্বাধীনতার আগে আমাদের থিয়েটারচর্চা কেমন ছিল, সেখান থেকে শুরু করি। বলে রাখা ভালো, আমরা থিয়েটারচর্চার ইতিহাস জানাতে যাচ্ছি না, মূলকথা বলবার জন্য যতটুকু ইতিহাস আমাদের দরকার, ততটুকুই ব্যবহার করছি। তাই, এই লেখাটিকে ঐতিহাসিক না-মনে-করে, ইতিহাস-আশ্রয়ী বলে ধরে নিলে, আগ্রহী-চিন্তক-ভাবুকগণ পরের-কথাগুলোর সাথে খুব সহজেই মিশে যেতে পারবে।
স্বাধীনতার আগে ‘ঢাকায়’ কোন-ধরনের থিয়েটারচর্চা হতো, সেটি দেখলেই আমরা বুঝে যাব, পুরোদেশের থিয়েটারচর্চার স্বরূপ কী ছিল। জানা যায়, মীর মকসুদ-উস-সালেহীন, বজলুল করিম প্রমুখ-মিলে ১৯৫৬ সালে নাটকের দল ‘ড্রামা সার্কেল’ গঠন করে। মহড়া করত পল্টনে। অনেকের ধারণা, এই বাংলায় এই দুজন আধুনিক থিয়েটারের প্রচলন করে। ঢাকা প্রেস ক্লাবের উল্টোদিকের ভবনটি তখন ছিল ‘আমেরিকান কালচারাল সেন্টার’। সেখানে ড্রামা সার্কেলের প্রযোজনাগুলো মঞ্চস্থ হতো। প্রশ্ন আসতে পারে, এই ‘আধুনিক থিয়েটারে’র ধারণা তারা কোথায় পেল। উত্তরে ধারণা করা হয় যে, তারা যেহেতু পড়াশোনা-জানাশোনা আর বুদ্ধিবৃত্তিকচিন্তা-চর্চায় অগ্রসর ছিল, তাই হয়ত, পশ্চিমা-দুনিয়ার সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল। এছাড়াও জানা যায়, কলকাতার সাথেও তাদের যোগাযোগ ছিল। এবং এ-ও জানা যায়, কলকাতায় রাজা ইডিপাস মঞ্চায়ন করে ড্রামা সার্কেল। এ উপলব্ধিও জানতে পাই যে, ড্রামা সার্কেলের নাটকগুলোকে খুব প্রফেশনাল মনে হতো। মানে, একটি কাজের পরিশীলিতরূপ কেমন হওয়া উচিত, সেটি তাদের কাজ দেখলেই বোঝা যেত। অর্থাৎ, ঠিক সময়ে নাটক শুরু হওয়া, নাটকে লাইটের সুন্দর ব্যবহার, সাউন্ড ইফেক্ট, মানে সব কিছুতেই পরিশীলিতভাব প্রত্যক্ষ করা গেছে ড্রামা সার্কেলের প্রযোজনায়।
আরো কিছু তথ্য আমাদের কাছে আছে, সেটি হলো, মুনীর চৌধুরীও থিয়েটারচর্চার সাথে যুক্ত ছিল। রিহার্সেল হতো তার বাসায়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে মুনীর চৌধুরীর রক্তাক্ত প্রান্তর তারই পরিকল্পনায় (নির্দেশনায়) অভিনীত হয়েছিল। আরো জানা যায়, তখন ভালো নাটকের খুব একটা চর্চা না হওয়ার কারণে, বাংলা একাডেমি উদ্যোগ নিয়ে কিছু নাটক প্রকাশ করত এবং ‘ড্রামা সিজন’ বা ‘নাট্যমৌসুম’ নাম দিয়ে দু-তিনটি নাটকের, ধরা যাক, উৎসবের মতো, মঞ্চায়নের আয়োজন করত। প্রতিটি নাটকের দু-চারটি প্রদর্শনী হতো। কখনো ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে, আবার কখনো বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের তেতলায়। ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি)’। কেন্দ্রটি তখন কার্জন হলের দোতলার একটি রুমে ছিল। তখন ‘ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নাট্যগোষ্ঠীর শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিল অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
আসকার ইবনে শাইখও থিয়েটারচর্চায় নিবেদিতপ্রাণ ছিল। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রায় সবাই বলে, আসকার ইবনে শাইখ ছিল সাংঘাতিক নাটক-পাগল লোক। যেকোনো হলে নাটক হলে, সে স্টেজে বা ব্যাক-স্টেজে কাজ করবার জন্য ‘খামাখাই ঘুরে-বেড়ানো’ শিক্ষার্থীকে নিয়ে যেত। ওইসব শিক্ষার্থীও তার নির্দেশ মাথা পেতে নিত। জানতে পারি, আসকার ইবনে শাইখের এসব নির্দেশ পালন করার জন্য অনেকেই তাদেরকে ‘আসকার স্যারের চামুণ্ডা’ বা ‘চামচা’ বলে সম্বোধন (!) করত (এই ‘প্রথা’ বর্তমান সময়েও প্রচলিত আছে বলে ধারণা করি)। শোনা যায়, এই তথাকথিত ‘চামচা’দের সে বলত, নাটক করবা তো সিরিয়াসলি করবা। যদি বাপের ওষুধ নিতে হয়, তবে ওষুধ উইংসের পাশে রাইখা নাটক করবা, পরে ওষুধ নিয়া বাড়ি যাবা’ (এমন নিবেদনের কথা শুনে শুনে আমরাও থিয়েটারচর্চা শুরু করেছি, এখনও অনেকে শুরু করছে। এবং যারা এমন নিবেদনের প্রতি নিবেদিত, ইতিহাস বলে থিয়েটারচর্চা তাদের জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, এবং হচ্ছে)। তো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর প্রথম প্রযোজনা ছিল শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি-র রামেন্দু মজুমদার-কৃত নাট্যরূপ। কার্জন হলে এই নাটক মঞ্চস্থ হয়। মনে করিয়ে দিই, তখন টিকিটের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু দর্শক হৈচৈ করতে পারে ভেবে, বিনা-পয়সায় কার্ড সংগ্রহ করে নাটক দেখার অনুরোধ করা হয়েছিল, যেন শৃঙ্খলা বজায় থাকে।
ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর ব্যানারে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে মাইকেলের কৃষ্ণকুমারী মঞ্চস্থ হয়, আগে উল্লেখ-করা বাংলা একাডেমির নাট্যমৌসুমে। এরপর, এখন যেটি ‘নাটমণ্ডল’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত, সেখানে মুনীর চৌধুরীর দণ্ড ও দণ্ডধর-এর মঞ্চায়ন হয়েছিল। জানা যায়, তখন এই ‘নাটমণ্ডল’ ছিল পরিত্যক্ত। লাইব্রেরির জায়গা ছিল এটি। সবাই মিলে পরিষ্কার করে, বাইরে থেকে চেয়ার এনে দর্শকের-আসন বানিয়ে প্রদর্শিত হয়েছিল এই দুটি নাটকের চারটি প্রদর্শনী (এর সাথে স্বাধীনতার পর নিয়মিত নাট্যচর্চায় মহিলা সমিতির পরিত্যক্ত-মঞ্চকে মঞ্চায়ন-উপযোগী করার উদ্দীপনাকেও মিলিয়ে দেখা যেতে পারে)। একই বছর বাংলা একাডেমি শেক্সপিয়রের ৪র্থ জন্ম-শতবার্ষিকী পালন করেছিল। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠী কমেডি অব এরর্স অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসাগরের ভ্রান্তিবিলাস-কে রামেন্দু মজুমদারের নাট্যরূপে মঞ্চে আনে। এছাড়াও বাংলা একাডেমিতে সাঈদ আহমদের মাইলপোস্ট নাটকের মঞ্চায়নের খবরও পাওয়া যায়। প্রযোজনাটি ছিল ‘সাতরং’-এর। আরো জানা যায়, সেখানে আবদুল্লাহ আল-মামুনের শপথ নাটকটিও মঞ্চস্থ হয়েছিল। এ ছাড়াও নাটকের দল ‘পারাপার’ ১৯৭০ সালে পোস্টার প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে বাংলা একাডেমির বটতলায়, কবির আনোয়ারের নির্দেশনায়।
এক্ষণে একটি কথা বলে নিই, এসব তথ্য-উপাত্ত কোনো নাট্যইতিহাসের বই থেকে নেয়া হয় নি। এসব কাজের সাথে যারা জড়িত ছিল এবং স্বাধীনতার পর আমাদের নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চা যারা শুরু করেছিল, তাদের সাথে আলাপচারিতায় যা জানতে পেরেছি, তাই উল্লেখ করছি। মূললক্ষ্যের দিকে যাওয়ার জন্য এ নিয়ে আর কথা না বাড়াই।
এরমধ্যেই আমরা জানতে পারি, নীলিমা ইব্রাহিম নাটক করার ব্যাপারে খুব ডেডিকেটেড ছিল। সে সময়ে নাটকের ব্যাপারে এতটা ডেডিকেশন সংস্কৃতিচর্চার সাথে জড়িত অন্যান্য মহিলার মধ্যে দেখা যায় নি। সে বুলবুল ললিত কলা একাডেমিতে (বাফা) নাটকের বিভাগ খুলেছিল। এখনও আমাদের থিয়েটারচর্চার সাথে জড়িত আছে, এমন অগ্রজের মধ্যে কেউ কেউ ঐ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল।
তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ডাকসু’র উদ্যোগে হলে হলে নাটক হতো। তখন ডাকসুতে কর্তাব্যক্তি ছিল নাজমুল হুদা বাচ্চু, আহসান আলী সিডনীসহ আরো অনেকে। নাট্যকার ও নির্দেশনায় প্রতিনিধিত্ব করত মূলত নূরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ ও মুনীর চৌধুরী। নাটকে প্রম্পটারের সাহায্য নেয়া হতো। জানা যায়, তখন প্রম্পটারের ভূমিকা ছিল বিরাট, অনেকটা নির্দেশকের পরপরই ছিল তার অবস্থান। একটি মজার গল্প শুনেছি। প্রম্পট করতে করতে আবদুল্লাহ আল-মামুনের একসময় মনে হলো, স্টেজের উপরের মানুষগুলোকে তো দর্শক দেখে, তাকে (আবদুল্লাহ আল-মামুনকে) তো কেউ দেখে না। তাই তার বাসনা জাগল অভিনয় করার। নাজমুল হুদা বাচ্চুকে সে তখন শ্রেফ জানিয়ে দিল তাকে অভিনয় করতে দিতে হবে। এবং সেবারই মঞ্চনাটকে প্রথম অভিনয় করল সে, নাটকের নাম অনেক তারার হাতছানি। বিষয়টি তুলে ধরলাম এই জন্য যে, আজও, প্রায় সব নাট্যকর্মী থিয়েটারচর্চায় যুক্ত হতে চায় মূলত অভিনয় করার জন্য। আর এই ইচ্ছাটিকে দলের অগ্রজ-নাট্যব্যক্তিরা তিরস্কারের দৃষ্টিতে দেখে থাকে। তারা ভুলে যায় যে, অপেশাদার ও সৌখিন এই শিল্পমাধ্যমটিতে দর্শকের সামনে (অথবা, ধরা যাক, প্রিয়জনদের সামনে) নিজের ‘অভিনয়প্রতিভা’ দেখানোর ইচ্ছা বা আগ্রহ থাকা খুবই স্বাভাবিক। সুযোগ যখন চাচ্ছে, দিয়ে দেখাই যাক না। ব্যর্থ হলে, সে নিজেই সরে যাবে, চলে যাবে নেপথ্যকর্মে কিংবা ত্যাগ করবে থিয়েটারপাড়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় তখন মহড়া প্রায় প্রতিদিনই হতো। মহড়া মানে, যদি কাজ না থাকত তখন আড্ডা হতো। কেউ কেউ বলে, তখন থেকেই, যদিও, তখনও জানত না ‘গ্রুপ থিয়েটার’ কী, পরে তাদের মনে হয়েছে, ওসব কাজগুলো গ্রুপ থিয়েটারের মতোই ছিল, অর্থাৎ, যারা যারা একই মানসিকতার, তারা তারা একসাথে কাজ করে, নিয়মিত মহড়া কক্ষে যায় ইত্যাদি। কথাটির সত্যতা পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় সহজেই টের পাওয়া যায়।
স্বাধীনতার আগের থিয়েটারচর্চার ইতিহাসে যেটুকু ঘুরে এলাম, তা দিয়েই সামনে এগুতে পারব বলে আশা করি।
আমরা দেখলাম, দেশের অনেক অগ্রসরচিন্তক লেখক-শিক্ষক-ছাত্র-পেশাজীবী থিয়েটারচর্চার সাথে জড়িত ছিল। কয়েকটি নাট্যদলের সৃষ্টিও তখন হয়ে গেছে, যাদের কাজের ধরন, একটু আগেই জানতে পেরেছি, বর্তমানের ‘গ্রুপ থিয়েটারে’র মতোই ছিল। নাট্যদলের মধ্যে ‘ড্রামা সার্কেল’, ‘সাতরং’, ‘পারাপার’ ইত্যাদি নাম আছে। আরো একটি নাম আছে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’, যেটি জিয়া হায়দারকে সভাপতি করে ১৯৬৮ সালে নাট্যদল হিসেবে গঠিত হলেও স্বাধীনতার আগে কোনো নাটক মঞ্চস্থ করে নি, বেতার-মাধ্যমে তাদের কাজ সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর, এই-পর্বের লেখায় আমরা দেখতে পাব, নিয়মিত ও দর্শনীর-বিনিময়ে-থিয়েটারচর্চায় দলটি মুখ্যভূমিকা পালন করেছিল।
স্বাধীনতার-পর কীভাবে নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার সূচনা হলো, তা জানতে কারো কারো ভাবনাচিন্তার-ভ্রমণ এখন হাজির করা যাক।
কেউ কেউ বলছে, স্বাধীনতার পর মঞ্চনাটক যে এরকম একটি জায়গায় আসবে, সেটি ভাবতে পারে নি তারা। এখন আমরা মঞ্চনাটকের নেতৃস্থানীয় (প্রথমপ্রজন্ম) হিসেবে যাদের সাক্ষাৎ পাই, তাদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে (যদিও কেউ কেউ সে সময়ে যুদ্ধের সম্মুখসমরেও ছিল) অবস্থান নিয়েছিল, এটি আসলে এসেছে তাদের হাত ধরে। সেখানে, অর্থাৎ কলকাতায়, তারা মঞ্চনাটক দেখে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হলে (বিজয়-লাভ করলে) এদেশেও সেরকম ধারায় মঞ্চনাটক শুরু করা যায় কিনা, সেটি নিয়ে ভাবছিল। এটি অনেকেরবেলায় হয়ত সত্য, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম-ভাবনাও পাওয়া যায়। অনেকে মনে করে, মুনীর চৌধুরী-আসকার ইবনে শাইখ-নূরুল মোমেন প্রমুখের সাথে কাজ করতে করতে, মঞ্চনাটকের প্রতি একটি ঘোর তৈরি হয়েছিল স্বাধীনতার আগে থেকেই। আবার কেউ কেউ বলে, তখন যেহেতু কলকাতার সাথে একমাত্র যোগাযোগ ছিল রেডিও-র মাধ্যমে, সেখানে শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র-উৎপল দত্ত-নীলিম দাসের অভিনয় শুনে এবং যেহেতু এ-ও জেনে গেছে যে, তারা মূলত মঞ্চ-অভিনেতৃ, তা থেকেই হয়ত একটি মানস-গঠন-প্রক্রিয়া চলছিল নিয়মিত মঞ্চনাটক করার ব্যাপারে। এবং আমরা যখন জানতে পারি যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে জড়িত শিল্পীরা কেবল যে কলকাতার মঞ্চনাটক দেখেছে তাই নয়, তারা সেখানে মামুনুর রশীদ রচিত পশ্চিমের সিঁড়ি- মঞ্চস্থ করার জন্য মহড়াও শুরু করেছিল। তখন টের পাই, মঞ্চনাটককে অনেকেই ততদিনে নিজেদের ‘কেবলা’ বানিয়ে ফেলেছিল।
এই ভাবনা থেকেই হয়তবা ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ‘আরণ্যক নাট্যদলে’র সৃষ্টি হয় এবং ২০ ফেব্রুয়ারি দলটি মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকটি মঞ্চস্থও করে। এরপর মঞ্চে আনে স্বাধীনতার-সময় কলকাতায় অসমাপ্ত প্রযোজনা পশ্চিমের সিঁড়ি। কিন্তু অনিয়মিত নাট্যচর্চার বিষয়টি থেকেই যায়, কেননা, এরপর আরণ্যক নাট্যদল দ্বিতীয় প্রযোজনা মঞ্চে এনেছিল ১৯৭৬ সালে। এরপর ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ মঞ্চে আনে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। ‘বহুবচন’ মঞ্চে আনে প্রজাপতির লীলা লাস্য। কিন্তু তখনও নিয়মিত নাট্যচর্চার কোনো আভাস পাওয়া যায় না। এসব তথ্য বিবেচনায় রেখে অনেকের মতামত হচ্ছে, আমাদের এখনকার নাট্যচর্চার বর্তমান ধরন-ধারণের সূত্রপাত হয় মূলত ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতা’ থেকে। যেখানে ৭টি হল তাদের ব্যানারে ৭টি নাটক মঞ্চে এনেছিল।
তাহলে জানা যাক ঐ নাট্যপ্রতিযোগিতা কেমন ছিল?
অনেকেই বলে, তখন ছিল নতুন নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা-তর্ক-বিতর্কের এক উত্তাল-সময়। স্বাধীনতারই যেন এক নান্দনিক-উৎসারণ ছিল সেদিনের নাটক। সবসেরা (অগ্রসর-সমাজভাবনা যাদের মধ্যে ছিল) শিক্ষার্থী যুক্ত হতো নাটকে। রাজনীতি-শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে চুলচেরা আলোচনা, সমালোচনা হতো তখন। নাটক কেন করা, উদ্দেশ্য কী তার, দেশ-সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক কী নাটকের? কী কাজে লাগে নাটক (মনে রাখা দরকার, যখনই ‘নাটক’ বলছি, তা ‘মঞ্চনাটক’ বা ‘থিয়েটার’কেই বলছি)? নাটক কেবল কি একটি শহুরে-সৌখিন-বিলাস মাত্র? ঢাকায় বসে নাটক করে কী হয়, কারা দেখে এসব নাটক? দেশ-বিশ্বের তাবৎ ভাবনা-চিন্তা, সংকট-যন্ত্রণা, আতীব্র তার প্রকাশ-বিষয় ও রূপরীতির কত কত সর্ব-মথিত সেই নাট্যদিন ছিল। আনন্দে-উল্লাসে-বিস্ময়ে-মুগ্ধতায় নজরুলের প্রথম প্রেমের ‘থরথর-কম্পন’ হয়তবা ছিল সেটি। নাটক দিয়েই যেন জয় করা যায় বিশ্ব, বাংলাদেশের বাতাসে ফিরছিল এমনই ফিসফাস। একেক সময়ে একেক দেশে একেক বিষয় নিয়ে এমনই সব কাণ্ড ঘটেছে, ইতিহাস তা-ই বলে।
ঐ নাট্যপ্রতিযোগিতার আগেই ডাকসু নিজস্ব একটি নাট্যদল তৈরি করে, ‘নাট্যচক্র’। নাট্যচক্রের ব্যানারে মঞ্চস্থ হয় সেলিম আল দীনের এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা আর আল মনসুরের রেভ্যুলিউশন এবং খৃষ্টাব্দ সন্ধান। এই ‘নাট্যচক্র’ যাদের হাতে সৃষ্ট, তারাই পরবর্তীসময়ে গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় ‘নাট্যচক্র’ নামেই কাজ করতে থাকে।
উল্লেখ্য, ‘আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতা’র প্রধানশর্ত ছিল, প্রতিটি নাটক হতে হবে ‘নতুন নাটক’ এবং শিক্ষার্থী-দ্বারা রচিত। অর্থাৎ বুঝতে অসুবিধা হয় না, ডাকসু আয়োজিত ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আন্তঃহল নাট্যপ্রতিযোগিতা’ সত্যিই একটি ‘ঘটনা’ ছিল, এবং, পরবর্তীসময়ের ‘নিয়মিত-থিয়েটারচর্চার’ ক্ষেত্র-প্রস্তুত করে দিয়েছিল তা।
এরপর থেকেই সম্ভবত নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা করার ধারাটির সূচনা হয়।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই কবির আনোয়ার বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাটক করল, জনে জনে জনতা। ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে। পরপর চারটি প্রদর্শনী হয়েছিল। খুব সম্ভবত এর ধারাবাহিকতা না থাকায় (নিয়মিত না হওয়ায়) বর্তমানে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা বাকি ইতিহাস (১৯৭৩)-কেই নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটারচর্চার পথিকৃৎ হিসেবে ধরা হয়। এই মঞ্চায়ন নিয়ে অনেকের উচ্ছ্বাস অনেকটা এরকম, রোববার সকালবেলা, প্রচুর দর্শক। বিস্ময়-জাগানিয়া দৃশ্য। দর্শনীর বিনিময়ে এর আগে কবির আনোয়ারও প্রদর্শনী করেছে, কিন্তু এত অর্গানাইজড-ওয়েতে না। ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ বিজ্ঞাপন দিয়েছে, কাউন্টারে লাইন দিয়ে টিকিট কাটতে হয়েছে এবং টানা ৮টি সকাল তারা প্রদর্শনী করেছিল বাকি ইতিহাস নাটকের। এরপর যখন ব্রিটিশ কাউন্সিল বলল, তাদের নিজস্ব-কাজের জন্য ওখানে আর প্রদর্শনী করা যাবে না, তখন তারা ভিন্ন মঞ্চ খোঁজা শুরু করল এবং মহিলা সমিতির পরিত্যক্ত-মঞ্চটিকে কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করে ঝেড়ে-মুছে, বিজ্ঞাপন দিয়ে দর্শনীর বিনিময়ে বাকি ইতিহাস-এর পরপর আরো ৬টি প্রদর্শনী করল।
অনেকের মন্তব্য, মূলত এই প্রযোজনার সাফল্যই এরপর দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চার ভিত গড়ে দেয়।
তার আগে-পরে ‘থিয়েটার’, ‘ঢাকা থিয়েটার’সহ আরো অনেক নাট্যদল গড়ে ওঠে এবং তারা নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটারচর্চা শুরু করে। বলে রাখা ভালো, ততদিনে ঢাকার বাইরেও এই চর্চার হাওয়া লেগেছে এবং ঢাকার নাট্যদলের বাইরে যাওয়া ও বাইরের দলের ঢাকায় আসার চর্চা শুরু হয়ে গেছে।
এভাবে নিয়মিত ও দর্শনীর বিনিময়ে থিয়েটারচর্চা শুরু হলেও এর বিপরীতে সরকারিভাবে অনেক বাধাও আসতে শুরু করে। এবং তাকে সামাল দিতেই অর্থাৎ বাধার মুখোমুখি হওয়ার জন্যই পরবর্তীসময়ে গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’। আমরা এখন ঢুকে যাব, ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিনে’র মূল-বিষয়ে।
তখন থিয়েটারচর্চার সাথে যারা জড়িত ছিল, অনেকের মতে মঞ্চনাটকের শক্তিকে সব-সরকারপক্ষ সবসময়ই ভয় পেয়ে এসেছে। পথনাটক মঞ্চায়নের একটি ঘটনার কথা বলা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-চত্বরে নাটক চলছিল, তখন ঢাকা থিয়েটারের কয়েকজনকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ১৯৭৭ সাল, তখন সামরিক শাসন চলছি। কারণ হিসেবে বলা হলো, তারা নাকি লোক জমায়েত করছিল। যখন বোঝানোর চেষ্টা হলো যে, ওখানে আসলে পথনাটক হচ্ছিল। তখন পুলিশ ওয়ারলেসে ঊর্ধ্বতন অফিসারকে স্ক্রিপ্ট পড়ে শোনাতে শুরু করল। ওপাশ থেকে বলা হচ্ছে, নাটকে যে প্রাণিটি মারা গেল, সেটি শেখ মুজিবকে বোঝানো হয়েছে কিনা, ইত্যাদি।
১৯৭৪ সালে কথা, মহিলা সমিতি মঞ্চে চলছে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের প্রযোজনা বহিপীর। বিরতির সময় গ্রিনরুমে খবর এল, কোর্ট থেকে ম্যাজিস্ট্রেট এসেছে, সে নাটক বন্ধ করে দেবে। কারণ হলো, নাটকের প্রমোদকর দেয়া হয় নি, আর নাটকটির কোনো সেন্সরশিপ সার্টিফিকেট নেয়া হয় নি। এরপর পানি অনেকদূর গড়াল। পরদিন কোর্টে যাওয়া হলো, কোর্ট পাঠাল থানায়, দরখাস্তের উপর দশ-বারটি সিল পড়ল। বিনিময়ে বহুকষ্টে ৮টি প্রদর্শনী করার ছাড়পত্র পাওয়া গিয়েছিল।
এভাবে মঞ্চনাটক করা মুশকিলই হয়ে পড়ল। যদিও এটির একটি সাময়িক সমাধান মিলেছিল। জানা যায়, আবদুল্লাহ আল-মামুন তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে কর্মরত ছিল। একদিন বঙ্গবন্ধু রামপুরা টেলিভিশন ভবন পরিদর্শনে গেলে, আবদুল্লাহ আল-মামুনকে বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞাসা করে, তোমাদের নাটক কেমন চলতাছে? উত্তর এল, স্যার আপনার রাজ্যে তো নাটক করা যাবে না। কেন কী হইছে? তারপর মহিলা সমিতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনা ইত্যাদি খুলে বলা হলো। সব শুনে বঙ্গবন্ধু একটি অধ্যাদেশ জারি করল যে, মঞ্চনাটক করার জন্য দলগুলোকে কোনো প্রমোদকর দিতে হবে না। এবং পুলিশ ও প্রশাসনের হাত থেকে ‘সেন্সরশিপ’ চলে এল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অধীনে।
তারপরও আমরা জানি, সেন্সরশিপ ঢাকা শহরে বলবৎ না থাকলেও, ঢাকার বাইরের জেলা-শহরগুলোর জন্য প্রযোজ্য ছিল। এই নিয়ে আরেকটি ঘটনা বলা যাক। ১৯৭৫ সালের অব্যবহিত পর কুমিল্লার কোনো একটি নাট্যদল আবদুল্লাহ আল-মামুনের এখন দুঃসময় নাটকটি মঞ্চে আনার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মঞ্চায়নে বাধ-সাধে তখনকার জেলা প্রশাসক অর্থাৎ একটি জেলার সবচেয়ে ‘ক্ষমতাধর’ সরকারি কর্মকর্তা। ডিসির একটিই কথা, এখন (স্মরণ করিয়ে দিই, পঁচাত্তরের পরপর) দেশটি ‘দুঃসময়ের’ মধ্যে নেই। এখন কেবলই ‘সুসময়’। সুতরাং ‘এখন দুঃসময়’ নাম দিয়ে কোনো নাটক মঞ্চস্থ করা যাবে না। এরপর কী হয়েছিল বা হয় নি, তা নিয়ে আর কথা না-বাড়াই।
তো, থিয়েটারচর্চার ব্যাপারে এসব নানান প্রতিকূলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেই হয়তবা দেশের সব-নাট্যদলগুলোকে নিয়ে একটি ফেডারেশান গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়।
তখন বোধকরি এটি সময়ের দাবি ছিল, কারণ কেউ কেউ বলে, নাট্যচর্চা যখন বিস্তৃত হচ্ছিল তখন তারা অনেকে মিলে ভাবছিল, একটি আমব্রেলা তৈরি করা যায় কিনা। তারা আরো বলে, এই ভাবনার কিছু কারণও ছিল। নাটক করতে গিয়ে কিছু সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছিল (উপরে উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতা-ছাড়াও), যেমন, মহিলা সমিতির সংস্কার করা, নাটকের নতুন জায়গা তৈরি করা, অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিল করা, ইত্যাদি। তাদের মতামত হচ্ছে, এসব ব্যাপার একা মোকাবিলা করা যায় না। তাই ভাবনায় এল, কোনো ফেডারেল বডি তৈরি করা যায় কিনা।
কারো কারো মতে, ১৯৮০-র আগেই অনেকের মনে হচ্ছিল, একটি ফেডারেশান করা যায় কিনা। কিন্তু অনেকেই আবার সন্দেহ করছিল যে, গণ্ডগোল হবে, মনোমালিন্য হবে, তাই কেউ আর এগোয় নি। আমরা জানতে পারি, এরমধ্যেই অনেকদল মিলে ‘ঢাকা নাট্যোৎসব’ করল এবং সেটি বেশ সফলও হয়েছিল। এরপরই মূলত ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ তৈরির কাজ শুরু হলো। অগ্রজদের ভাষ্যমতে, অনেকের মধ্যেই যখন ফেডারেশান করার ভাবনা দেখা গেল, কিন্তু কেউ কোনো উদ্যোগ নিচ্ছিল না, তখন ‘থিয়েটার’ পত্রিকার পক্ষ থেকে ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সবাইকে এক মতবিনিময় সভায় আহ্বান করা হলো। ব্যাপারটি এমন যে, আলোচনা করে দেখা যাক, ফেডারেশান তৈরি করা উচিত কি উচিত না। সেদিন সভায় ঢাকার ২১টি দলের প্রতিনিধি এবং জেলা-শহরের ১৫টি দলের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। তো, ঐ সভায় নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে, ফেডারেশান গঠন করা হবে। পরে আরেকটি সভায় ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ গঠন করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথম সম্মেলন হয়েছিল ২৩ আগস্ট ১৯৮১।
এরপর অতিঅবশ্যই ফেডারেশানের একটি গঠনতন্ত্র তৈরি হয়েছিল। কীভাবে এবং কোন কোন দল এই ফেডারেশানের সদস্য হতে পারবে, ফেডারেশান আদতে কী কী কাজ করতে চায়, এসবই গঠনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ ছিল। এরপর ঐ গঠনতন্ত্রের অনেক সংশোধন হয়েছে, পরিবর্তন-পরিবর্ধন-পরিমার্জন হয়েছে। সর্বশেষ যে গঠনতন্ত্রটি আমাদের হাতে আছে, তার আলোকেই পরবর্তী-আলোচনা এগিয়ে নেয়া যাক।
‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র গঠনতন্ত্রে ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমরা দেখতে পাই:
১. গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা।
২. নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা।
৫. নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা।
৬. নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা।
৭. বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা
৮. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা।
৯. দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।
১০. মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
১১. পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।
যারা মনে করে গত ৪০/৪১ বছরে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সফলতা আকাশচুম্বী, গ্রুপ থিয়েটার চর্চায় ফেডারেশানের উপস্থিতি অনিবার্য ছিল, আছে, এবং থাকবেই। ফেডারেশান গঠিত না হলে এতদিনে থিয়েটারচর্চা হয়ত বন্ধ হয়ে যেত, এমনকি নাট্যচর্চায় বিকল্প কোনোকিছু ভাবা প্রায় সংবিধান লঙ্ঘনের মতো ‘দণ্ডনীয় অপরাধ’, তাদের জন্য কোনো কথা বলতে চাই না। কিন্তু যারা মনে করে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’-এর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার, এ রচনা কেবল তাদের জন্য। অর্থাৎ, যারা ফেডারেশান-গঠনের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি এর উৎকর্ষের-মানসে তার কর্মকাণ্ডকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে থাকে, অর্থাৎ, ‘ভালোকে’ ভালো আর ‘মন্দকে’ মন্দ বলতে দ্বিধা করে না, এ আলোচনা তাদের জন্যই বলে ঠিক করেছি।
অনেকেই মনে করে, গঠিত হওয়ার পরপরই, গত শতাব্দীর আশির-দশকে ফেডারেশান বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। তারপর থেকে ক্রমশই সে তার কাজের জৌলুস হারাতে শুরু করে। এই বিবেচনাকে একটু খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
লক্ষ করে থাকব, এর জন্মের দেড় বছরের মাথায় বাংলাদেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে, যা দ্রুতই ‘স্বৈরশাসন’ বলে চিহ্নিত হয়। তখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-গোষ্ঠীগুলো সবাই ঐ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তখন থিয়েটারচর্চার পাশাপাশি পথনাটকচর্চারও ব্যাপক-প্রসারতা লক্ষ করা গেছে। পথনাটকের প্রায় সবগুলো এবং মঞ্চনাটকেরও একটি বড় অংশ তখন দখল করে নেয় সমসাময়িক স্বৈরশাসন অবসানের নিমিত্তে অনেকটা ‘পোস্টার থিয়েটার’ ঘরানায়। ফেডারেশানের কর্মকর্তারা তখন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলে তা সফল করতে তেমন কোনো সৃজনশীলচিন্তা বা মেহনতের প্রয়োজন হয় নি। তখন সবাইকে খুব সহজেই বোঝানো গেছে যে, ফেডারেশানের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ আমরা পার করছি। এবং সব-নাট্যকর্মী প্রায় একই উপলব্ধিই করেছি। অর্থাৎ স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা স্বাধীনদেশে ‘অনন্য’ এক থিয়েটারচর্চা করতে পারব এবং আমাদের সৃজনশীলতার সর্বোচ্চ-প্রকাশ ঘটাতে পারব বলে ধরে নিয়েছি। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে, গত শতাব্দীর আশির দশকের ‘থিয়েটার-উন্মাদনা’র সাথে ফেডারেশানের কার্য-কারিশমার তেমন কোনো যুক্ততা আছে বলে মনে হয় না। সার কথা, আশিতে যদি ফেডারেশান নাও গঠন করা হতো, তাহলেও স্বৈরাচার-পতনের লক্ষ্যে, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ইস্যু বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ‘আপৎকালীন সাংস্কৃতিক-মোর্চা’ এমনিতেই তৈরি হতো। এবং তা একই রোখ নিয়ে স্বৈরাচারপতনে অবদান রাখত। সুতরাং তখনকার থিয়েটারচর্চার তুমুল-আগ্রহকে যারা তখনকার বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃত্বের সৃজনশীল-ফসল বলে বাহ্বা দিতে চায়, তারা আত্মতৃপ্তি পেতে গিয়ে কোথাও কোনো-একটি ভুল করছে বলে মনে করি।
উপরের কথাগুলোর সত্যতা টের পাওয়া যায় গত শতাব্দীর নব্বই-এর দশক থেকে।
তাহলে দেখে নেয়া যাক, নব্বই দশকের প্রথমভাগ-পর্যন্ত, অর্থাৎ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের জন্মের ১২/১৫ বছরের বেশি সময়-ধরে তার ‘প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে’র কতটা বাস্তবায়ন ঘটল। ‘প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’ বলছি এ কারণে যে, যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নাট্যদলগুলোর একক-প্রচেষ্টায় অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে ধরে নেয়া হয়েছিল, সেসব-লক্ষ্যগুলো-বাস্তবায়নের বৃহৎ-উদ্দেশ্যেই আমরা ‘ফেডারেশান’ গঠন করেছিলাম। কিন্তু ফেডারেশানের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের গুটিকয়েক-ছাড়া বাকিগুলো যেকোনো একক-নাট্যদল বা এমনকি, দু-একজন নাট্যকর্মীর আন্তরিকতা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমেও বাস্তবায়ন সম্ভব। এবং আমরা এক সময় লক্ষ করব, ঠিক এই লক্ষ্যগুলো একক-নাট্যদল কিংবা দু-একজন নাট্যকর্মীর মাধ্যমেই অনেকটা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই বিবেচনায়, ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ‘প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’গুলোর বাস্তবায়নে প্রথম ১২/১৫ বছরে (যদিও আলোচনার সময়ে কখনো কখনো পরের-কাল, এমনকি, বর্তমান সময়-পর্যন্ত চলে আসব) ফেডারেশানের অর্জনগুলো আমারা জেনে নিতে পারি।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৩: সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা:
গঠনতন্ত্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে এটি অন্যতম, যার বাস্তবায়ন এককভাবে কোনো নাট্যদলের পক্ষে সম্ভব না। অথচ এই উদ্দেশ্য-বাস্তবায়নে কোনো ধরনের কর্মসূচি ঐ সময়কালে নেয়া হয় নি।
বরং, বিপরীতে, ব্যক্তিগত-প্রচেষ্টায় স্থানীয় মেয়রের সহযোগিতা নিয়ে নিজস্ব-মঞ্চ ‘থিয়েটার ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম’ তৈরি হয়েছে, ঢাকায় ‘পালাকার’, বরিশালে ‘শব্দাবলী’, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে ‘মণিপুরি থিয়েটার’ নিজস্ব-স্টুডিও থিয়েটারে নিয়মিত নাট্যমঞ্চায়ন করেছে বা করছে। এসবের পিছনে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’-এর কোনো প্রত্যক্ষ অবদান ছিল না।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৯: দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা:
এই লক্ষ্য-অর্জনও এককভাবে কোনো নাট্যদলের পক্ষে সম্ভব না। অথচ এর বাস্তবায়নেও তেমন কোনো উদ্যোগ ফেডারেশান নেয় নি।
বি.দ্র: একটি দেশে ‘থিয়েটার ইনস্টিটিউট’ গড়ে-তোলার অর্থের (বোধগম্য হওয়া) যে ব্যাপকতা, সেই ব্যাপকতা উদ্যোক্তরা অনুধাবন করতে পেরেছিল কিনা তাই নিয়েই সন্দেহ করা যেতে পারে।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১১: পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা:
পেশাদারি থিয়েটারচর্চার জন্য যে পরিমাণ মানসম্মত-নাট্যমঞ্চ দরকার, সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দরকার এবং সর্বোপরি শিক্ষিত-নাট্যকর্মী প্রয়োজন, আমাদের থিয়েটার তখন (এমনকি এখনও) এর ধারে-কাছেও যেতে পারে নি। তবে অনেকে ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি)-সহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠান থেকে নাট্যবিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও এ-সবই হয়েছে, হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে, নয়ত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কোনো ভূমিকা সেখানে ছিল বলে প্রতিয়মান হয় না।
এছাড়াও গত-শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরু থেকে ‘রেপাটরি থিয়েটার’ চর্চার (‘রেপাটরি থিয়েটার’কে আন্তর্জাতিকভাবে কী সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেছে, সে তর্কে আপাতত না গিয়ে, দলগুলোকে ‘রেপাটরি থিয়েটার’ বা ‘পেশাদারি থিয়েটারচর্চায়’ আগ্রহী হিসেবে ধরে নিই) হাত ধরে পেশাদারি থিয়েটারচর্চার যে প্রচলন হয়েছে, এবং এখনও সেই চর্চা চলছে, তার ধারে-কাছেও ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ কোনো-ধরনের অগ্রসর-চিন্তা করে নি। এ সবই হয়েছে এবং হচ্ছে ব্যক্তিগত বা গুটিকয়েক নাট্যজনের ‘থিয়েটারচর্চায় নিবেদিত থাকার’ রোখ থেকে।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১০: মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া:
ফেডারেশান গঠনের পর আলোচ্যসময়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিষয়ে যে অনার্স-মাস্টার্স কিংবা সাবসিডিয়ারি কোর্স চালু হয়, সেগুলো স্ব স্ব অনুষদ ও উদ্যোগী-কিছু শিক্ষকের প্রচেষ্টায় হয়েছ। সেখানে ফেডারেশানের কোনো প্রত্যক্ষ-ভূমিকা ছিল না। এমনকি ঐ সময়ে, এবং, ঐ সময়ের পরেও (আগেই বলেছি, ফেডারেশানের ব্যর্থতার-কাল বোঝাতে অনেক পরের কর্মতৎপরতাও হাজির করব) কয়েকটি নাট্যদলের নিজস্ব-প্রচেষ্টায় ‘নাট্যবিষয়ক স্কুল’ তৈরি হয়েছে, যার পেছনেও ফেডারেশানের কোনো প্রত্যক্ষ-ভূমিকা ছিল না।
অর্থাৎ উপরের ‘সাক্ষী-সাবুদে’ দেখা যায়, ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ গঠনের ১২/১৫ বছর-পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঢেউয়ের অনকূলে পাল-তুলে থিয়েটারচর্চা এগিয়ে গেছে, লক্ষ্য-অর্জনে ফেডারেশানের তেমন কোনো অগ্রসরচিন্তার উপস্থিতি ছিল না।
তবে ফেডারেশান-গঠনের কয়েকবছর পর থেকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যে কার্যকরী পদক্ষেপটি নেয় তা হলো মহিলা সমিতি ও গাইড হাউসের হলবরাদ্দের দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের সাথে সমন্বয় করে নিজের হাতে তুলে নেয়া। এর ফলে নাট্যদলগুলো নিয়মিত হলবরাদ্দ পাওয়ার জন্য আর কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হতে হলো না। ফেডারেশান নিজ-দায়িত্বে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের সব নাট্যদলের নাট্য-মঞ্চায়ন নিশ্চিত করা শুরু করে (যদিও কোন দল কতদিন হলবরাদ্দ পাবে, ছুটির দিনে পাবে কিনা, ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সমালোচনা করা যায়, তবে আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য এহেন-বিতর্ক থেকে একটু দূরেই থাকা যাক)। শুধু তাই নয়, ভেপসা-গরম আবহাওয়া থেকে মহিলা সমিতি মঞ্চকে উদ্ধারের জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়, সেটির মূল-কৃতিত্বও ফেডারেশানের (যদিও মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ এর সুফল-ভোগের বিপরীতে নাট্যমঞ্চায়নে দলগুলোকে আর্থিক-ছাড় দিয়েছে কিনা, সে প্রশ্নটি থেকেই যায়)। এবং এরপর আমরা লক্ষ করি, এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীসময়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির (ঢাকা) জাতীয় নাট্যশালার হলবরাদ্দের মূল-অধিকারটিও ফেডারেশানের হাতেই থাকে (যে নামে ডাকা হয়, সে নামই উল্লেখ করছি। আদৌ এটিকে ‘জাতীয় নাট্যশালা’ বলা যাবে কিনা সেই তর্কে যাচ্ছি না)। তো, জাতীয় নাট্যশালার হলবরাদ্দের অধিকারটি ফেডারেশান না নিতে পারলে, নাট্যদলগুলোর নিয়মিত হলবরাদ্দ পেতে আমলাতান্ত্রিক অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হতো, যার ফলে থিয়েটারচর্চা ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যেত। শুধু তাই নয়, শিল্পকলার হলগুলোয় মঞ্চায়নের জন্য যে বিরাট-অর্থের ভর্তুকি প্রতিটি দল ভোগ করে, এর পিছনে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ মূল-ভূমিকা পালন না করলে, অত খরচ করে বাংলাদেশে থিয়েটারচর্চা করা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।
এক্ষণে, আবারও একটু সমালোচনার দিকেই যাই। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নির্বাহী পরিষদের কার্যক্রম ও ‘নাটকীয় ঢং’ (attitude)-এর দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাব, যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ফেডারেশান গঠিত হয়েছিল, তার ‘প্রধান-উদ্দেশ্য’গুলো থেকে দূরে সরে গিয়ে, কেবল যা যা করলে পুরোদেশের নাট্যদলগুলোর উপর কর্তৃত্ব করা যায়, সেসব কাজে তারা বেশি মনোযোগী ছিল। যেমন, (লক্ষ্য-উদ্দেশ্য) ৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ৯. দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, ১০. মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ১১. পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা, ইত্যাদির প্রতি চরম-অবহেলা দেখিয়ে নিজেদের কেবল ‘হলবরাদ্দের মালিক’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি ভাবনা-চিন্তা-অর্থহীন প্রতারণামূলক-স্লোগান ‘আমাদের মঞ্চ আমরা গড়ব’ বলে যে ‘হাস্যকর নাটক’ কয়েকবছর করেছে, এখন তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে।
যেহেতু ফেডারেশানের কর্তাব্যক্তি হলে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোনো কাজ করতে হয় না, বিপরীতে সারাদেশে ‘নেতা’ হিসেবে একটি পরিচিতি পাওয়া যায়, সেজন্য তখন থেকে শুরু হলো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কর্তা-ব্যক্তি-হওয়ার ‘নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’। আগে যে ফেডারেশানের নির্বাহী পরিষদ ছিল ‘মনোনীত’ (তা-ও অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে রাজি করাতে হতো), তা চোখের নিমিষে ‘নির্বাচিত’-রূপ নিয়ে হাজির হলো (আমি ‘নেতা’ হতে চাই, আমাকে ভোট দাও, তাহলে ‘হলবরাদ্দ পাবা’, এই টাইপের)। যদিও, এরমধ্যেও, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আরো দুটি অর্জন হলো ১৮৭৬ সালের ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাতিল ও কিছু কিছু নাট্যদলকে নতুন প্রযোজনা মঞ্চে আনার ব্যাপারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আর্থিক-সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া। যদিও জেলাশহরের প্রশাসনিক-কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের-প্রজ্ঞাপন’ এখনও পৌঁছেছে কিনা, তা নিয়ে মাঝেমাঝেই সন্দেহ হয়। আর, নাট্যদলগুলোর মধ্যে কারা কারা যোগ্যতা-ব্যতিরিকেই মন্ত্রণালয়ের আর্থিক-সহযোগিতা পেয়ে যাচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। তবে এটুকু স্বীকার করা উচিত বলে মনে করি, ফেডারেশানের সদস্য না, কিন্তু সক্রিয়ভাবে থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে, এমন দলও এই আর্থিক-সহযোগিতা পেয়ে আসছে নিয়মিত। সুতরাং নাট্যদলের সরকারি-আর্থিক-সহযোগিতা পাওয়ার ব্যাপারে ফেডারেশানের সদস্য হওয়া বা না-হওয়া অতটা জরুরি বিষয় নয়, সেটুকু মান্যতা (সৃজনশীল-মানসিকতার বিচারে) ফেডারেশান পেতেই পারে। তার মানে দাঁড়ায় এই, কোনো নাট্যদল ইচ্ছা করলে নিজের সৃজনশীল-ক্ষমতায় ফেডারেশানের বাইরে থেকেও ফেডারেশান-কর্তৃক-অর্জিত অনেক সুফল ভোগ করতে পারবে বা পারছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সেইসব দলের কর্মকাণ্ড-পরিচালনায় এবং সরকারি-আর্থিকসুবিধাভোগে নীতিগতভাবে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি বা আশা করা যায় বাধা হয়ে দাঁড়াবে না (বলে রাখা ভালো, বাধা হয়ে না-দাঁড়ানোটি তাদের সদিচ্ছার উপর নির্ভর করে না, বরং সেটি তাদের এখতিয়ার-বহির্ভূত বলে বিবেচনা করা যেতে পারে)।
এবার আমরা দেখে নিতে পারি অন্যান্য লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সফলতা কতটুকু হয়েছে।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ২: নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা:
আগেই উল্লেখ করেছি, ফেডারেশান গঠিত হওয়ার পরপরই স্বৈরশাসন তথা ‘এরশাদবিরোধী আন্দোলন’ শুরু হয়। এবং সেখানে নাট্যদলগুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণের পিছনে ফেডারেশানের সাফল্যের চেয়ে তখনকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-আন্দোলন-বাস্তবতা বেশি অবদান রেখেছে (অনেক পরে দেখা গেছে, আন্দোলনের-ক্ষেত্র প্রস্তুত-থাকা সত্ত্বেও, ‘রাজনৈতিক দাসখতচর্চার’ কারণে, নাট্যদলগুলোকে প্রতিবাদ করা থেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে)।
থিয়েটারচর্চার জন্য সর্বপ্রথম মৌলিক-চাহিদা হচ্ছে মহড়াকক্ষ। মহড়াকক্ষের জন্য প্রায় প্রতিটি নাট্যদলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ধর্ণা দিতে দেখেছি, চারুকলার ফাঁকা ফ্লোর-উঠোন-ছাদে সৃষ্টিসুখেরউল্লাসে মেতে থাকতে দেখেছি। আবার এ-ও বিস্ময় নিয়ে দেখেছি, বিভিন্ন স্কুল-কিন্ডারগার্ডেনের কোনো কক্ষ ভাড়া-করে একবেলা মহড়া চালাতে। আবার হাতেগোনা কয়েকটি দল প্রায়-পরিত্যক্ত বাড়ি নিয়ে হয়ত থিয়েটারচর্চা চালিয়েছে কিন্তু যেদিন কিনা ডেভালপারের চোখ ঐ সমস্ত বাড়ির উপর পড়েছে, সেদিনই দলটিকে পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। এসব বৈরি-থিয়েটারচর্চা হয়েছে (বা হচ্ছে) নাট্যদলগুলোর নিজস্বপ্রচেষ্টায়। কিন্তু এসব দায়িত্ব নেয়া উচিত ছিল ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র। কেননা ফেডারেশান গঠনের বাস্তব-পরিস্থিতি ছিল, যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য একক নাট্যদলের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব না, সেসব সমস্যা সমাধানে ফেডারেশান বলিষ্ঠ ভূমিকা নিবে। অথচ আমরা লক্ষ করি, নাট্যচর্চার স্বার্থে মহড়াকক্ষের ব্যবস্থা তো করেই নি, উল্টো ৫/৬টি নাট্যদল ও ‘থিয়েটার স্কুল’ নিজেদের ঐকান্তিক-প্রচেষ্টায় ইস্কাটন গার্ডেনের যে স্কুলটিতে মহড়া ও অন্যান্য কার্যক্রম চালাত, এক ‘মাঝারি-গোছের আমলা’র আপত্তির কারণে যখন সেখানে থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল, তার নিরসনে ফেডারেশান দলগুলোর-পাশে-পর্যন্ত দাঁড়ায় নি।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৪: নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা:
সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার মানে যদি হয়, বন্যা-খরা বা অন্য কোনো দুর্যোগের সময় বিপদগ্রস্ত-সাধারণমানুষের পাশে দাঁড়ানো কিংবা করোনাকালীন সময়ে কম-আয়ের নাট্যকর্মীকে আর্থিক-সহযোগিতা দেয়া, তাহলে স্বীকার করতে হয়, এ ব্যাপারে ফেডারেশান কিছুটা সফলতা দেখিয়েছে। যদিও দু-বছর ধরে চলা করোনাকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য কম-আয়ের নাট্যকর্মীর যতটা আর্থিক-সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল, তার তুলনায় তারা কতটা পেয়েছে আর বিপরীতে এ নিয়ে প্রচার-প্রপাগাণ্ডা কতটা ব্যাপক হয়েছে, সে প্রশ্ন তোলাই যায়। কেননা, কোনো কোনো নাট্যদলের একক আহ্বানে ও কিছু নাট্যকর্মীর যৌথ-প্রয়াসে ‘সংস্কৃতিকর্মীবৃন্দ’ আর ‘থিয়েটার স্বজন’-এর মাধ্যমেও অনেক সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়েছে, যে সহযোগিতার আর্থিক-পরিমাণ মোটেও ফেডারেশানের আর্থিক-সহযোগিতার চেয়ে কম ছিল না।
যা বলতে চাচ্ছি তা হলো, দুর্যোগকালীন সময়ে নাট্যকর্মীকে বা দেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতির হাত প্রসারিত করার জন্য যুগের পর যুগ ধরে একটি ফেডারেল বডি তৈরি করে রাখার কোনো মানে হয় না। দুর্যোগ এলে, নাটকের মানুষজন এমনিতেই যুথবদ্ধ হয়ে যায়।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৫: নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা:
এ নিয়ে মতামতের প্রয়োজন আছে কিনা সন্দেহ করি। নিয়মিত-অনিয়মিত অন্তত শ’খানেক নাট্যবিষয়ক-প্রকাশনা বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চায় ছিল এবং আছে। তার একটিও ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ কর্তৃক প্রকাশিত নয়। সবই ব্যক্তিগতভাবে কাঠখোর পুড়িয়ে চালিয়ে/এগিয়ে নেয়ার সংগ্রাম। সবগুলোর নাম উল্লেখ না করে, কেবল নাট্যবিষয়ক-প্রকাশনার পুরোধা হিসেবে নাট্যচর্চাকে সমৃদ্ধ করে যাওয়া রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকার কথা উল্লেখ করে বলতে চাই, পত্রিকাটি এ বছর ৫০ বছরপূর্তী-সংখ্যা বের করেছে, যা তার ৮৭তম-সংখ্যা। এতগুলো-সংখ্যায় কতশত নাট্যচিন্তা ছাপার-অক্ষরে টিকে আছে তা অকল্পনীয়। এ ছাড়াও ৫/৬ থেকে ৩০-অধিক সংখ্যা প্রকাশ-করা প্রকাশনার হিসাব এক-লহমায় স্মৃতিতে আনা প্রায় অসম্ভব। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অর্জনে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ কতটা সফল কিংবা থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নিতে এ ধরনের প্রকাশনা বের করার গুরুত্ব ফেডারেশান আদৌ অনুভব করে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৬: নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা:
এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হাসিলে ফেডারেশানের কোনো সংগ্রহশালা তো নাই-ই, ন্যূনতম কোনো কর্ম-উদ্যোগের কথাও কারো জানা থাকলে তা প্রকাশ করার অনুরোধ জানাই।
বরং, কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগ এ বিষয়ে অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। নাট্যবিষয়ক-সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠায় নাট্যজন বাবুল বিশ্বাস যেটুকু সফলতা দেখিয়েছে তা উল্লেখ-দাবি করে। বিভিন্ন-নাট্যদলের নানান-প্রযোজনার পোস্টার-লিফলেটসহ অন্যান্য ঈর্ষণীয়-সংগ্রহ, Art of Bangladesh-প্রকাশনা-দিয়ে সেই সংগ্রহশালার অংশ-বিশেষ ধরে রাখা ও অধুনা-প্রতিষ্ঠিত Bangladesh Theater Archives এর মাধ্যমে যে ভার্চুয়াল-সংগ্রহশালার সাক্ষাৎ পাই, এবং, খোরশেদুল আলমের চট্টগ্রামের ‘৩ দশকের নাটক’ প্রকাশনা-দিয়ে চট্টগ্রামের মঞ্চনাট্যের যে সংগ্রহশালা পাই, তা-ই প্রমাণ করে ‘অনেক-বড়-কাজ’ করার জন্য ‘মেদবহুল ফেডারেশানের’ প্রয়োজন হয় না। বরং একক-ব্যক্তির নিবিষ্ট-চিত্তই সেই লক্ষ্য-অর্জনে যথেষ্ট।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৭: বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা:
বিভিন্ন সময়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা বা মতবিনিময়ের আয়োজন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান করেছে বটে, তবে নানান নাট্যদল এককভাবে, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউটের (আইটিআই) আয়োজনে এ বিষয়ে যত কাজ হয়েছে, তার তুলনায় ফেডারেশানের কাজ উল্লেখের খুব একটা দাবি রাখে বলে মনে হয় না।
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৮: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা:
গত ৪০/৪১ বছরে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বেশ কিছু ‘আড়ম্বরপূর্ণ’ নাট্যোৎসব আয়োজন করেছে, যেগুলোকে ‘জাতীয় নাট্যোৎসব’ বলা যেতে পারে। আবার যেসব নাট্যোৎসবে বিদেশের নাট্যদল অংশ নিয়েছে, সেগুলোকেই সাধারণভাবে ‘আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব’ বলা হয়ে থাকে, সে আয়োজনও ফেডারেশান কয়েকটি করেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, নাট্যদলগুলোর একক উদ্যোগেও এ ধরনের অনেক (ক্ষেত্রবিশেষে তুলনামূলক পরিসরে-বড় ও জমকালো) নাট্যোৎসবের আয়োজন হয়েছে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, বিদেশের কোনো নাট্যোৎসবে দেশের কোনো নাট্যদলের অংশগ্রহণ কিন্তু ফেডারেশানের মাধ্যমে হয় নি। এ ক্ষেত্রে নাট্যদলগুলো নিজ-উদ্যোগ ও যোগাযোগের মাধ্যমে বিদেশের মঞ্চে নাট্যমঞ্চায়ন করেছে। এমনকি ভারতের ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামায় (এনএসডি) প্রতিবছর যে নাট্যোৎসব হয়, সেখানে বাংলাদেশের যেসব দল অংশ নেয়, তা তাদের নিজস্ব-প্রচেষ্টার ফসল। এসব ক্ষেত্রে ফেডারেশান ন্যূনতম কোনো সহযোগিতা-পর্যন্ত করে না।
‘ন্যূনতম সহযোগিতা’ বলতে আসলে কী বোঝাচ্ছি?
আমরা জানি, দেশের বাইরের নাট্যদলগুলোকে যখন আনা হয়, তখন তাদের রাষ্ট্রীয়-নিরাপত্তামূলক কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে। আবার দেশের নাট্যদল যখন বাইরে যায়, তখনও এসব আনুষ্ঠানিকতা মোকাবিলা করেই যেতে হয়। এর মধ্যে আছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগ (এনএসআই), স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) অনাপত্তিপত্র, ভিসার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। আমলাতান্ত্রিক-জটিলতার কারণে নাট্যদলের একার পক্ষে এসব আনুষ্ঠানিকতা মেটাতে বেশ বেগ পেতে হয়। ফেডারেশান যেহেতু নাট্যদলগুলোর ‘ফেডারেল বডি’, সেহেতু এ কাজগুলো করার জন্য তার একটি শাখা বা দপ্তর (উইং) থাকতেই পারত। আমরা লক্ষ করে থাকব, এমন একটি উইং নির্বাহী পরিষদে আছেও। যেমন, নির্বাহী পরিষদের ‘সম্পাদক (আন্তর্জাতিক)’-এর কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে-বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের নাটকের প্রচার ও প্রসার, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন নাট্য সংগঠন ও ফেডারেশানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক নাট্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। তাহলে প্রশ্ন তোলাই যায়, এই উইং গত ৪০/৪১ বছরে নাট্যদলগুলোকে আদতে কী সহযোগিতা করেছে?
পূর্বালোচনায়, আমরা ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ১০টির সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো বাস্তবায়নের ‘ফলাফল’ও প্রত্যক্ষ করেছি। ১ নম্বরটি নিয়ে কিছু বলা হয় নি। এতে বলা আছে, ‘গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা’।
এ দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়েছে! গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ বলতে কী বোঝায়?
কিছু কিছু নাট্যদল আছে যাদের নাট্যচর্চার মূল-উদ্দেশ্য দেখলে আন্দাজ করা যায়, তারা কোন ধরনের নাটক মঞ্চায়নে আগ্রহী, অথবা থিয়েটারচর্চায়ই-বা তারা কেন আগ্রহী? কিন্তু এসব উদ্দেশ্য তো একেক দলের একেকরকম। ‘গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র গঠনতন্ত্রের ধারা ১১ (ক)-এ বলা আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি-সংস্কৃতি এবং গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শে বিশ্বাসী বাংলাদেশের যেকোনো নাট্যদল এর সাধারণ সদস্য পদের জন্য আবেদন করতে পারবে। এর মানে কি এই যে, আমাদের দেশের অভ্যন্তরের আদিজনগোষ্ঠী দ্বারা তৈরি কোনো নাট্যদল ফেডারেশানের সদস্য হতে পারবে না? আর যদি সদস্য হতে হয়, একজন অবাঙালিকেও ‘বাঙালি’-হয়ে নাট্যচর্চা করতে হবে? সংস্কৃতিকর্মীর এমত চিন্তা তো মারাত্মক! এসব কারণে গঠনতন্ত্রের ১ নম্বর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যটি বোধগম্য হয় নি বলে, তার সফলতা-ব্যর্থতা নিয়েও কিছু বলা গেল না।
আবার ধারা ১৩-এ বলা আছে, বছরে কমপক্ষে ৩টি প্রদর্শনী না করলে দলটি সদস্যপদ হারাবে। যতটুকু তথ্য আছে, ৩৩৬টি নাট্যদল এখন ফেডারেশানের সদস্য। এই ৩৩৬টি দলই কি বছরে ন্যূনতম ৩টি প্রদর্শনী করছে? যদি না করে থাকে, তাহলে তার/তাদের সদস্যপদ বহাল থাকে কী করে?
যাক, গঠনতন্ত্রের ধারাগুলো নিয়ে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। কেননা, সেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে কীভাবে ‘নির্বাহী পরিষদ’ গঠিত হবে তার বর্ণনা আছে, কিন্তু ‘লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’ অর্জন করতে না পারলে ঐ পরিষদের ভবিষ্যৎ-পরিণতি কী হবে তা নিয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। এখন প্রশ্ন থাকতে পারে, ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল অর্থাৎ যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এককভাবে নাট্যদলের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব না, এর জন্য প্রয়োজন ‘ফেডারেল বডি’ গঠন করা, যে বডি সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনায় গিয়ে এসব অর্জন করবে, গত চারদশকের বেশিসময়ে সেসব অর্জনে ব্যর্থ হওয়ার পরও, সেই ফেডারেশানকে টিকিয়ে রাখার আর প্রয়োজন আছে কিনা।
এ প্রশ্ন যে এখন শুরু হয়েছে তা নয়। একদম শুরুতে বলেছি, এ প্রশ্নের জন্ম প্রায় দুইযুগ আগে থেকেই। এটি তখন সাধারণ-নাট্যকর্মীর মনের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু যাদের হাতে ফেডারেশান তৈরি হয়েছিল তাদের ভিতরেও, আজ থেকে ১৫/১৬ বছর আগে থেকেই এই প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে। তাদের কারো কারো মন্তব্য হচ্ছে, এখন ফেডারেশান আগের ইমেজ ধরে রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। এখন এটি অনেক পলিটিসাইজড হয়ে গেছে। আগে ফেডারেশানের কর্মকর্তারা সিলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচিত হতো, এখন সরাসরি ব্যালট পেপারের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়। ফলে মূল-কাজ বাদ দিয়ে ভোটের রাজনীতি ঢুকে গেছে। আবার, অনেকের মত এমত, আগে ফেডারেশানের কাজ খুবই সীমিত ছিল, এবং আবারও কিছুটা সীমিত করে ফেলা উচিত বলেই মনে করে তারা। তাদের মত হচ্ছে, ফেডারেশান শুধু দেখবে নাট্যদলগুলোর কী কী অসুবিধা আছে। দিবস উদ্যাপন করা, টেলিভিশনে নাটক করানো ইত্যাদি তার মূল-কাজ না। আর অর্থের ব্যাপারে সব কাজের জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশানের উপর নির্ভর করতে হবে কেন? নিজের টাকায় চলতে শিখতে হবে। তা না হলে ফেডারেশানের সংগ্রামী-চরিত্রটি নষ্ট হয়ে যাবে। উন্নতমানের নাটকগুলো যেন বেশি অভিনয়ের সুযোগ পায়, তার চেষ্টা করা উচিত ফেডারেশানের। কেবল সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে লাভ নেই, মানটাই বিচার্য হওয়া উচিত।
মনে রাখতে হবে এগুলো এখন থেকে ১৫/১৬ বছর আগের মন্তব্য এবং মন্তব্যগুলো স্বয়ং ফেডারেশান-প্রতিষ্ঠাতাদের। তবে ফেডারেশানে মূল-লক্ষ্য-উদ্দেশ্য (৩, ৯, ১০, ১১) এত ব্যাপক হওয়ার পরও শুরুর দিকে ‘ফেডারেশানের কাজ খুবই সীমিত ছিল’ বলা হলো কেন, তা বোধগম্য নয় (তাহলে কি এগুলো পরে সংযোজন করা হয়েছে?)। যাক সে কথা। ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী-চরিত্র নষ্ট’ হওয়ার যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তা অমূলক নয়। সংগ্রামী-চরিত্রের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পর্বটির সূচনা হয় যখন একই ব্যক্তি ফেডারেশানের সভাপতি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদটিতে বসে যায়। কেননা, তখন থেকেই ‘নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা’র (লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ২) বিষয়টি অকার্যকর হয়ে যায়। দুই পদে একই ব্যক্তি থাকার মানে যে ‘সাংঘর্ষিক-বিষয়’, এটি জেনেও এতদিন ধরে বাঘা বাঘা থিয়েটারওয়ালারা তা মেনে নিল (এবং নিচ্ছে) কীভাবে তা ভাবতেই অবাক লাগে। তার উপর ইদানিং সামাজিক-যোগাযোগমাধ্যমে ‘ক্ষমতাধর’ অনেক নাট্যকর্মী আশাবাদ ব্যক্ত করছে যে, দুই-উচ্চপদে-পদস্থ নাট্যজন যেহেতু রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দল-প্রধানের ‘পরীক্ষিতজন’, তাই তার বিজয় অনিবার্য (দুদকের তোলা কোটি-কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ মন্তব্য)। মানে কী দাঁড়াল! মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্পীত-সংগ্রামী-থিয়েটারচর্চা করার স্বার্থে, নানান সরকারি-বেসরকারি বাধা-নিষেধ মোকাবিলা করার লক্ষ্যে যে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ তৈরি হয়েছে, তার নির্বাহী পরিষদকে হতে হবে ক্ষমতাসীন দলের ‘পরীক্ষিত নাট্যজন’ (অথচ বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নির্বাহী পরিষদের উচিত ছিল সংগঠনের সভাপতিকে তার পদ-থেকে অব্যাহতি দিয়ে দুদকের মামলা মোকাবিলা করে ফিরে-আসার সতর্কবানী দেয়া। তারা সেটি করে নি)! বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভয়াবহ!
এসব কার্যকলাপ ও নির্বাহী পরিষদ থেকে সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুই নাট্যজনের ঘটনাক্রম এবং আরো বহু কারণেই অনেকের অনুভূতি এমত যে, এই ফেডারেশানকে টিকিয়ে রাখার আর কোনো মানে হয় কিনা।
এর বিপরীতে এটি বলা যায় কিনা, ফেডারেশানটি টিকে আছে তার ৩৩৬টি নাট্যদলের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে। সুতরাং, তার আর টিকে থাকার অধিকার নেই, এমত বলা প্রায় গণতান্ত্রিক-ভাবনাচিন্তাকে বিসর্জন দেয়া। বরং দেখা যেতে পারে এভাবে যে, যেহেতু সৃষ্টির ৪০/৪১ বছরেও ফেডারেল বডি হিসেবে এটি থিয়েটারচর্চার উন্নতি ঘটাতে পারছে না, সেহেতু স্বয়ং-নিজে (নাট্যদলটি) ওই ফেডারেশান থেকে বের হয়ে আসতে পারে কিনা। অর্থাৎ, যেসব নাট্যদল মনে করবে ফেডারেশান আসলে কার্যকর কিছু না, সেহেতু ফেডারেশান থেকে নিজের সদস্যপদ প্রত্যাহার করে নিলাম। কেননা, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে, ফেডারেশান গত কয়েকমাসে যে বিভাগীয় সম্মেলন করেছে, সেখানেও প্রায় সব নাট্যদলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। তাহলে এই ফেডারেশানকে অস্বীকার করি কীভাবে? আর ‘নিন্দুকেরা’ (যারা মূলত পরিবর্তন চায়) যদি মনে করে, অনেক নাট্যদলেরই ওসব সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছিল না, তাহলে সেসব নাট্যদল ফেডারেশান থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে না কেন? যা বলতে চাচ্ছি তার সারমর্ম এই যে, ফেডারেশানের মূল-কার্যক্ষমতার-সীমাবদ্ধতাকে উপলব্ধি না করে যদি এমনটি ভাবা হয় যে, অন্যকেউ নির্বাহী পরিষদে নির্বাচিত হলে, ধরা যাক, দেশে ‘স্থায়ী-নাট্যমঞ্চ’, ‘থিয়েটার ইনস্টিটিউট’, ‘পেশাদারি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা’ ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারবে, তাহলে তারা বড় ভুল করছে। বরং ফেডারেশান-কাঠামোর বর্তমান কর্মতৎপরতা যাদের কাছে অকার্যকর বলে মনে হচ্ছে, তারা ফেডারেশান থেকে বের হয়ে নিজের মতো থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাওয়াই আপাতত কাজের-কাজ বা ‘সঠিক-সিদ্ধান্ত’ বলে মনে করছি।
এর প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশান তাদের [ফেডারেশান থেকে বেরিয়ে যাওয়া নাট্যদল(গুলো)র কথা বলছি] থিয়েটারচর্চায় কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছি না। কারণ, প্রথমত, যারা এখনও ফেডারেশানের সদস্য না, এবং সদস্য হতে চায়ও না কিন্তু নিয়মিত নাট্যচর্চা করার কথা ভাবে ও করে, তাদের চর্চায় বাধা দেয়ার অধিকার ফেডারেশানের নেই। এটি ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রেও নেই। আমরা বরং যেকোনো নাট্যদলের (হোক সেটি সদস্য বা সদস্য না) চর্চার পক্ষে সবসময় ফেডারেশানের ইতিবাচক-অবস্থান প্রত্যক্ষ করেছি। ফেডারেশানের সদস্য না কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার চর্চা বা রেপাটরি থিয়েটার চর্চা (অথবা এই ধরনের কিছু) করে, তারাও কিন্তু নাটক মঞ্চায়নের জন্য হলবরাদ্দ (এমনকি সরকারি আর্থিক-অনুদানও) পাচ্ছে। তার মানে, যারা মনে করবে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ অকার্যকর, ফলে তার কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া দরকার, তারা বরং ফেডারেশান থেকে তাদের সদস্যপদ সরিয়ে নিলেই ভালো হয়। এতে তাদের থিয়েটারচর্চার কোনো ক্ষতি হবে না, বিনিময়ে, ফেডারেশানের ব্যর্থতার দায়ভার থেকে তারা মুক্তি পাবে।
তাহলে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ এখন কী ভাবতে পারে?
এতক্ষণের আলোচনায় আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সর্বশেষ গঠনতন্ত্রে ১১টি লক্ষ্য উদ্দেশ্য আছে। আবারও একবার সেগুলোকে দেখে নেয়া যাক:
১. গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা।
২. নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা।
৫. নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা।
৬. নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা।
৭. বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা
৮. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা।
৯. দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।
১০. মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
১১. পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।
এরমধ্যে ৩, ৫, ৬, ৯, ১০, ১১ বাস্তবায়নের ধারেকাছেও গত ৪০/৪১ বছরে ফেডারেশান যেতে পারে নি। সুতরাং বলাই যায়, ওগুলো তার কম্ম নয়। ৪, ৭, ৮ এর যতটুকু ফেডারেশান বাস্তবায়ন করেছে, তারচেয়ে চোখেপড়ার মতো বাস্তবায়িত হয়েছে একক নাট্যদলের দ্বারা বা ব্যক্তিগত-উদ্যোগে। আর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ২ এ, নাট্যচর্চার স্বার্থে বিষয়ভিত্তিক যে আন্দোলন গড়ে তোলার কথাটি আছে, সেটির মৃত্যু হয়েছে একই ব্যক্তি যখন ফেডারেশান ও সরকারি-নির্বাহী-সংস্থার পদটিতে বসেছে, সেদিন থেকেই। তার মানে, ‘হারাধনের’ আর একটি ছেলে বেঁচে আছে, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১। যেটি পড়তে ভালো লাগে, কিন্তু এর কোনো অর্থ বের করা যায় না।
তাহলে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ টিকে থাকবে কী নিয়ে?
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে তার পরিধেয় জামাটি তার সাইজে বানিয়ে পরতে হবে। ৪ ফুট সাইজের ব্যক্তি যদি ১০ ফুট সাইজের ‘জমিদারী’ জামা গায়ে চাপায়, তাহলে জামাটির একটি সৌন্দর্য হয়ত বেরিয়ে আসে, কিন্তু জামাটি যে পরেছে, তাকে স্রেফ ক্লাউন বা জোকার মনে হবে। সুতরাং তাকে মানানসই-দেখাতে হলে, পরতে হবে তার-মাপের জামা-কাপড়। অর্থাৎ, টিকে থাকার জন্য, প্রথমেই ফেডারেশানকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ছোট করে ফেলতে হবে। সে বিবেচনায়, ফেডারেশানকে দেখতে হবে, কোন কোন কাজ নাট্যদলগুলো এককভাবে পেরে ওঠে না, শুধুমাত্র সেসব কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করা। থিয়েটারচর্চায় সৃজনশীলতা-টিকিয়ে-রাখা এবং এগিয়ে নেবার কাজটি করবে নাট্যদল(গুলো), ফেডারেশান কেবল ওই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়াবে।
সহযোগিতা ১:
থিয়েটারচর্চার জন্য সবার আগে প্রয়োজন মহড়াকক্ষের। জাতীয় নাট্যশালায় মহড়াকক্ষ বাড়াবার ব্যাপারে সে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে পারে। আবার রাজধানীর বিভিন্ন জায়গার স্কুল-কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতায় এসে ক্লাসকক্ষগুলোতে মহড়ার ব্যবস্থা করতে পারে (যেমনটি ইস্কাটন গার্ডেনের স্কুলটিতে নাট্যদলগুলো নিজের উদ্যোগেই করতে পেরেছিল, যদিও বিপদের সময় ফেডারেশান উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছিল। তারপরও সুযোগ দিয়ে দেখা যাক, ফেডারেশান ‘থিয়েটারচর্চা-বান্ধব’ হয়ে উঠতে পারে কিনা)। তবে এসব সুযোগ ভোগ করতে হলে নাট্যদল(গুলো)কে অবশ্যই সহনীয়-অর্থ খরচ করতে হবে, এ ব্যাপারটি নাট্যদলগুলোর বিবেচনায় থাকবে নিশ্চয়ই।
তারপরই প্রয়োজন হয় প্রযোজনার ‘সেট রক্ষণাবেক্ষণের’ সমস্যা-নিরসন। এ ব্যাপারে জাতীয় নাট্যশালার গাড়ি-পার্কিং জোনে অনেক জায়গা (স্পেস) বের করা সম্ভব, যেখানে অর্থের বিনিময়ে নাট্যদলগুলোকে সেট রাখার অনুমতি নিয়ে দিতে পারে ফেডারেশান। এর বাইরেও জাতীয় নাট্যশালার ক্যাম্পাসে (ধরা যাক, নাট্যশালার মূল-হল ও পশ্চিমদিকের ক্যাফে হাউজের মাঝখানে) একটি বহুতল ফাঁকা স্পেস-ভবন নির্মাণে কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে পারে, যেখানে বিভিন্ন ফ্লোরের প্রয়োজনীয় জায়গা (স্পেস) একেকটি নাট্যদল সহনীয়-ভাড়ার বিনিময়ে ব্যবহার করতে পারে।
সহযোগিতা ২:
আরেকটি কাজ ফেডারেশানের করতে পারে (করা উচিত)। আগেই উল্লেখ করেছি, অনেক নাট্যদল দেশে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব করে এবং নাট্যোৎসবে যোগ দিতে দেশের বাইরে যায়। প্রত্যেকটি নাট্যদল নিজের উদ্যোগেই এসব কার্যক্রম করে। ফেডারেশানের এখানে কোনো ভূমিকা গত চারদশকে দেখা যায় নি (দলগুলো সেই প্রত্যাশা এখন আর করেও না)। ফেডারেশান একটি জায়গায় ভূমিকা রাখতে পারে। সেটি হলো, এই যে বাইরের দলকে দেশে আনা এবং নিজেরা বাইরে যাওয়া, এ সময় কিছু আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয় যেগুলো খুবই জটিল ও সময়-সাপেক্ষে। এগুলো এককভাবে কোনো নাট্যদলের পক্ষে করতে হলে শিল্পচর্চায় ব্যঘাত ঘটে। সুতরাং এসব আনুষ্ঠানিকতা (পূর্বেই উল্লেখ করেছি, এগুলো হলো, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-এনএসআই-এসবির সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় অনাপত্তিপত্র বের করা ও দূতাবাস থেকে নাট্যকর্মীর ভিসা সংগ্রহ-করা) পূরণ করে নাট্যদলগুলোকে সহযোগিতা করার জন্য ফেডারেশান একটি উইং তৈরি করতে পারে।
সহযোগিতা ৩:
ফেডারেশান আরেকটি কাজ করতে পারে (এখনও যেটি করছে), তা হলো, নাট্যদলগুলোর সরকারি আর্থিক-অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করা এবং এই আর্থিক-অনুদানের পরিমাণ বৃদ্ধিতে সরকারের সাথে বোঝাপড়া করা। আমরা জানি, জাতীয় নাট্যশালার তিনটি মঞ্চেই নাট্যমঞ্চায়নের ব্যাপারে সরকার বিরাট-অংকের ভর্তুকি দিয়ে থাকে, এবং সেটি ফেডারেশানের কর্মতৎপরতার কারণেই হয়েছে। আবার মহিলা সমিতি মঞ্চেও নাট্যমঞ্চায়নের ব্যাপারে ফেডারেশান সরকারি-ভর্তুকির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এমনিভাবে নাট্যদলগুলো যদি নিজ-উদ্যোগে অন্যকোনো সরকারি-বেসরকারি-মঞ্চেও তাদের কার্যক্রম চালাতে চায় (ধরা যাক, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মঞ্চ, আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা ইনস্টিটিউট মঞ্চ, ইত্যাদি) সেখানেও এধরনের ভর্তুকির ব্যবস্থা করার জন্য সরকার ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে সমঝোতা করে দিবে ফেডারেশান।
সর্বশেষ-সহযোগিতা ৪:
নাট্যদলগুলোর সৃষ্টি-ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে যোগ্যতা-অনুসারে মঞ্চগুলোয় হলবরাদ্দ দেয়ার কাজটি ফেডারেশান করতে পারে।
অর্থাৎ, আবারও বলছি, নাট্যদলগুলোর থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নেয়ার জন্য হাতেগোনা যে কয়টি সহযোগিতা প্রয়োজন, ফেডারেশান কেবল সেগুলোই করবে। গঠনতন্ত্রে বড়ো বড়ো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সন্নিবেশ করে নাট্যদলগুলোর সাথে কোনো ধরনের প্রতারণার জায়গায় যাবে না।
এবার ফেডারেশানের কাঠামো-পরিবর্তন নিয়ে কিছু বলা যাক।
একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবো, ফেডারেশানের কাজকে যেভাবে গুটিয়ে এনে কেবল তাকে নাট্যদলগুলোর থিয়েটারচর্চা-বান্ধব হতে বলছি, তা অনেকটা ঢাকার থিয়েটারচর্চার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একদম ঠিক কথা। এসব কাজ করার জন্য ‘বাংলাদেশ’ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নাম দিয়ে বিভাগে বিভাগে সম্মেলন করার কোনো প্রয়োজন নেই। মশা মারতে কামান দাগানো মাথা-ভারী নির্বাহী পরিষদ গঠনের কোনো অর্থই হয় না। এ সবই ক্ষমতা-দেখানোর ‘আমলাতন্ত্র’ তৈরি করা ছাড়া আর কিছু না। কারণ, থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নেয়ার জন্য যদি কোনো ধরনের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রয়োজন হয়, সেটি বাংলাদেশব্যাপী তো নয়ই, এমনকি বিভাগ-পর্যায়েও নয়, এসব কাজ জেলায় জেলায় আলাদাভাবেই করলেই যথেষ্ট। পুরো দেশের নাট্যদল নিয়ে কোনো ফেডারেশান তৈরি না করে, আঞ্চলিকভাবেই এমন ফেডারেশান স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে। এবং কেউ কারো উপর নির্ভরশীল থাকার কোনো প্রয়োজনই নেই। এবং ‘গঠনতন্ত্র’ও হবে আলাদা আলাদা, নিজেদের প্রয়োজন-মাফিক। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, সংগঠন বা ফেডারেল বডির নাম ‘বাংলাদেশ’ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান না হয়ে ‘গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, ঢাকা’ কিংবা রাজশাহী অথবা চট্টগ্রাম বা ধরা যাক সিলেট, কুষ্টিয়া, রাঙ্গামাটি, পাবনা, রংপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ ইত্যাদি ইত্যাদি হতে পারে। এমনকি যদি কোনো জেলার নাট্যদলগুলো মনে করে, তাদের থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নেয়ার জন্য কোনো ধরনের ফেডারেল বডির প্রয়োজন নেই, তারা কোনো ফেডারেশান না-ও গঠন করতে পারে। অর্থাৎ, দেশের ৬৪ জেলায়ই যে নাট্যদলগুলোর ফেডারেল বডি থাকতে হবে তাও না, কিন্তু যদি থাকেও, তাদের কার্যক্রম স্বতন্ত্রভাবে চলবে (এবং আবারও উল্লেখ করছি, তাদের থাকবে নিজ নিজ ‘গঠনতন্ত্র’), কোনো কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধরের অধীনে থাকবে না কেউ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, থিয়েটারচর্চার ব্যাপারে পুরো দেশের প্রত্যেকটি নাট্যদলেরই সমান অধিকার আছে। যে দল মনে করবে, পুরো দেশে ভ্রমণ করে নিজের প্রযোজনা দেখানোর মতো তার ক্ষমতা আছে, সে পুরো দেশ ভ্রমণ করবে। প্রত্যেক ফেডারেশানের হলবরাদ্দ-কমিটি তাদেরকে হল-বরাদ্দ দিয়ে সহযোগিতা করবে (আর যেসব জেলায় ফেডারেল বডি থাকবে না, সেখানে স্থানীয় নাট্যদল যেভাবে হল-বরাদ্দ পায়, অন্য-অঞ্চলের নাট্যদলও সেইভাবেই হল-বরাদ্দ পাবে)। কারণ, মূলত আমরা সবাই থিয়েটারচর্চা এগিয়ে নেয়ার জন্যই কাজ করছি, সেটি ভুলে গেলে চলবে না।
এবার দেখা যাক কীভাবে থিয়েটারচর্চায় কাজের-কাজ করা যেতে পারে, তার কিছু সম্ভাবনার দিক। যা-ই মূলত ‘থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এখানে ঢাকার থিয়েটারচর্চা নিয়ে কথা বলতে চাই, যা মূলত পুরো দেশের নিজ নিজ অঞ্চলের (বিভাগ/জেলা/উপজেলা) থিয়েটারচর্চারই দিক-নির্দেশনা দিবে বলে মনে করি।
হলবরাদ্দের ব্যাপারে বর্তমান অবস্থাকে ঢেলে সাজানোর কথা দিয়েই শুরু করি।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, ঢাকা (প্রস্তাবিত নাম হিসেবে ব্যবহার করছি) জাতীয় নাট্যশালার তিনটি হলের বরাদ্দের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে ঠিক করবে প্রতিমাসে নাট্যদলগুলো কদিন মঞ্চগুলো ব্যবহার করতে পারবে। আমাদের দাবি হবে অবশ্যই প্রত্যেকদিন। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, হুটহাট করেই সরকারি-কার্যক্রম কিংবা কোনো দূতাবাসের অনুষ্ঠানের জন্য হলবরাদ্দ দেয়া হয়। বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানকে (দূতাবাসসহ) হলবরাদ্দ তো দেয়া যাবেই না, এমনকি সরকারি-কার্যক্রমও জাতীয় নাট্যশালায় সীমিত করতে হবে। সরকারি-কার্যক্রম উপস্থাপনার জন্য বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনসহ আরো অনেক মঞ্চ আছে। নাটকের মঞ্চকে ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন সরকারের আছে বলে মনে করি না। সরকারকেও মনে রাখতে হবে থিয়েটারচর্চা একটি রাষ্ট্রের জনগণের মনন-বিকাশের মাধ্যম। এ চর্চাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা কোনোভাবেই উচিত না।
আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য ধরে নিই, বছরের ৩৬৫ দিনই জাতীয় নাট্যশালা থিয়েটারচর্চার জন্যই বরাদ্দ থাকছে। মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করেও ঠিক এমনিভাবে মাসে কদিন নাট্যমঞ্চায়নের জন্য হলের বরাদ্দ থাকবে সেটি ঠিক করতে হবে।
মঞ্চ তো পাওয়া গেল, এবার আসি নাট্যদলগুলো কীভাবে এর বরাদ্দ পাবে সেই কথায়।
প্রচলিত বা বর্তমান পদ্ধতি হচ্ছে প্রতি-মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে আবেদন করতে হবে পরের মাসের কোন-এক বা একাধিক তারিখে নাট্যদলটি হলবরাদ্দ পেতে আগ্রহী। বর্তমান-অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, এ বিবেচনা পর্যালোচনা করে বরাদ্দ কমিটি মাসে কোনো নাট্যদলকে একদিনের বেশি (এমনকি কোনো কোনো মাসে একদিনও না) হলবরাদ্দ দিচ্ছে না বা দিতে অপারগ হচ্ছে। কিন্তু কোনো কোনো নাট্যদল তো প্রতিমাসে একাধিক দিনের বরাদ্দ চাচ্ছে। সেক্ষেত্রে কী হবে? এক্ষণে তাহলে নাট্যদলগুলোর থিয়েটারচর্চার আর-কিছু বিষয়ে একটু ভ্রমণ করে আসা যাক।
আপাতত এমনটি বলা যায় কিনা, যারা ভালো (শিল্পের নানান-অর্থে) থিয়েটারচর্চা করে, তাদের বেশি বেশি হলবরাদ্দ পাওয়া দরকার। তর্ক বাড়াতে চাইলে শুরুতেই বলা যায়, শিল্পে ভালো-মন্দ বিচার করার ভার কে নেবে? এ নিয়ে যতটুকু পারা যায় ‘তর্কের খাতিরে তর্ক’ না করাই ভালো। গত পঞ্চাশ বছর (এরও অধিক-সময়) ধরে থিয়েটারচর্চা চলছে, আর ভালো-খারাপ প্রযোজনা বা নাট্যদল চিহ্নিত করতে পারব না, তা হয় না, হতে পারে না।
এর পরের কথা হচ্ছে, কারা মূলত ভালো থিয়েটারচর্চায় সক্ষম?
স্বাধীনতার পর থেকে যারা নাটক করছে, তাদের প্রত্যেকের দলেই ক্রমে ক্রমে মেধাবী নাট্যজন তৈরি হয়েছে, কী নাট্যরচনায়, কী নির্দেশনায় অথবা অভিনয় কিংবা বিভিন্ন ডিজাইনে। এবং ব্যক্তিগত কারিশমায় যতটা না, তারচেয়ে দলীয়-যৌথ সৃজনশীলতায় তারা খুব কম সময়ের মধ্যে বিপুল-দর্শক তৈরি করেছিল। অর্থাৎ গ্রুপ থিয়েটার চর্চা সামনে ক্রমশই এগিয়ে যাবে এমন বাস্তব-লক্ষণ দলগুলো আমাদের সামনে আনতে পেরেছিল। সেই পথ ধরে গত প্রায় চার দশক ধরে এমন অনেক নাট্যদল তৈরি হয়েছে, যাদের মেধা ও মননে সৃষ্টি হয়ে চলেছে একের পর এক নাটক। এর মধ্যে ভালো-থিয়েটারচর্চা যারা করছে, সেই দলগুলোর একটি প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে নিয়মিত নতুন নাট্যনির্মাণ, এবং তারচেয়েও, নিয়মিত নাট্যমঞ্চায়নে সক্রিয় থাকা। ফলে কয়েকটি নাট্যদলের নির্দিষ্ট দর্শকও ক্ষেত্রবিশেষে তৈরি হয়ে গেছে এবং হচ্ছে। সেই দলগুলোর ব্যানারে যে প্রযোজনাই মঞ্চে আসুক না কেন, তা দেখার জন্য দর্শক উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। এবার তাহলে এটি স্বীকার করে নেয়া যায় কিনা, ‘ভালো-নাট্য বা প্রযোজনা’ করার জন্য চাই ভালো নাট্যদল? যদি মেনে নিই, তাহলে ভালো নাট্যদল বাছাই করার কাজটিও সহজ হয়।
নিয়মিত নাট্যনির্মাণ ও নাট্যপ্রদর্শনীর জন্য দরকার সাংগঠনিকভাবে দক্ষ ও সৃজনশীলতায় উন্নত নাট্যদল। নিয়মিত নাটক মঞ্চায়নে দরকার অবিরাম মহড়া। নিয়মিত নতুন নাট্যপ্রযোজনায় দরকার বেশি বেশি পড়াশোনা-বোঝাপড়া-কর্মশালা আর শিল্পকলা নিয়ে নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ায় লিপ্ত হওয়া। এসব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করার জন্য চাই নিজস্ব কোনো জায়গা। যাকে আমরা বলতে পারি ‘নিজস্ব-মহড়াকক্ষ’। আমাদের সামনে বেশ কয়েকটি নাট্যদলের উদাহরণ আছে, যারা ভাড়ার বিনিময়ে নিজস্ব-মহড়াকক্ষ ব্যবহার করে। সেখানে তারা মহড়া তো করেই, তার উপর কোনো কোনো দল নাট্যবিষয়ক স্কুল পরিচালনা করে, বিভিন্ন বিষয়ের উপর কর্মশালার আয়োজন করে, মূল-প্রযোজনার বাইরেও পরীক্ষামূলক নাট্যনির্মাণ করে দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনী করে (যাকে ইন-হাউজ প্রোডাকশন বলা যেতে পারে), নিয়মিত পাঠচক্রের আয়োজন করে, নিজ দলের প্রয়োজনে প্রতিবছর নতুন নতুন নাট্যশিল্পী তৈরি করে (কর্মশালার মাধ্যমে), পড়াশোনার জন্য লাইব্রেরি গড়ে তুলেছেÑইত্যাদি। ভালো নাট্যদল হয়ে ওঠার জন্য এই যে এত এত চর্চার মধ্যদিয়ে চলা, এর জন্য প্রতিমাসে প্রতিটি দলের ভাড়া বাবদ কম-বেশি ৩০-৩৫ হাজার টাকা গুণতে হয়। আর এই টাকা কোনো অনুদান থেকে আসে না, সরকারি কোনো বরাদ্দ থেকেও আসে না। দলের প্রতিটি সদস্যের পকেট হাতড়ে তবে বের হয় এই অর্থ।
সাংগঠনিকভাবে শক্ত-পোক্ত এই দলগুলো কমপক্ষে ৩/৪ থেকে ৭/৮টি প্রযোজনা নিয়মিত-মঞ্চায়ন করে থাকে। ৭/৮টি নাটকের সেটগুলোকে বছরের-পর-বছর ‘সুস্থ-সবল’ রাখার জন্যও আলাদা জায়গার দরকার হয় এবং সেখানেও অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। সুতরাং, আমরা আপাতত এটি মেনে নিতে পারি কিনা, যেসব নাট্যদলের ৩/৪/৫/৬/৭/৮টি নাটক নিয়মিত মঞ্চায়ন হয়, সেগুলোর দর্শকগ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই মঞ্চায়িত হয়? যদি মেনে নিই, তাহলে আমরা চাইব কিনা যে, দর্শককে বেশি বেশি হলমুখী করার জন্য এই নাটকগুলোর আরো ঘন-ঘন প্রদর্শনী হোক? আশা করি উত্তরটি ‘সমর্থনসূচক’।
কিন্তু খানিক-আগেই আমরা দেখেছি, ‘আন্তরিক-ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও’ ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ জেলায় জেলায় বা বিভাগে বিভাগে তো নয়ই, এমনকি জাতীয়ভাবেও একটি নিজস্ব-নাট্যমঞ্চ তৈরি করতে পারে নি। তাই বর্তমান আলোচনাপর্বটি ঢাকার জাতীয় নাট্যশালা ও মহিলা সমিতির মঞ্চবণ্টনেই সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের ৪টি মঞ্চে কীভাবে ভালো-থিয়েটারচর্চা-করা দলগুলোকে বেশি বেশি হলবরাদ্দ দেয়া যায়, এবং অন্যান্য নাট্যদলগুলোও যেন থিয়েটারচর্চা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম হলবরাদ্দ পেতে পারে, তার একটি উপায় বের করার চেষ্টা করা যাক। এ-ও লক্ষ রাখতে হবে, এই ৪টি হলে নাট্য-প্রদর্শনী করার অধিকার দেশের সব নাট্যদলেরই আছে (ঢাকার বাইরের মঞ্চগুলোও এর ব্যতিক্রম না। কিন্তু আলোচনা এগিয়ে নেয়ার জন্য শুধু ঢাকা নিয়ে কথা বলছি, যা আগেই উল্লেখ করেছি)। ৪টি হলে বরাদ্দের জন্য প্রতিমাসে আবেদন-নিবেদন করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে মিলিয়ে ধরা যাক ১০০/১১০টি নাট্যদল। অর্থাৎ প্রত্যেক নাট্যদলকে ১ রজনির বেশি বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু উপরের আলোচনায় যাদেরকে ‘ভালো দল’ বলে মেনে নিয়েছি এবং ঐ দলগুলোর ৩ থেকে ৮টি চলমান প্রযোজনা নিয়মিত মঞ্চায়ন প্রয়োজন বলছি, সেই নাটকগুলোর প্রদর্শন তাহলে কীভাবে সম্ভব? আর তা যদি সম্ভব না হয়, তৈরি হওয়া দর্শককে হলমুখী করার আদৌ কোনো উপায় থাকবে কি?
তাহলে দেখে নেয়া যাক, কী করা যায়!
হলবরাদ্দের নিয়মটি ৩ ভাবে করা যায় কিনা।
এক:
কোনো নাট্যদল চাইলে প্রতিমাসে হলবরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারবে (যেভাবে এখন চলছে)।
দুই:
কোনো দল চাইলে ৬ মাস পরে টানা ৭ দিন (ন্যূনতম) হলবরাদ্দের আবেদন করতে পারবে।
তিন:
কোনো দল চাইলে ১ বছরে যেকোনো মাসে টানা ১৫ দিন (ন্যূনতম) হল বরাদ্দ চাইতে পারবে।
তবে যেসব দল ৬ মাস পর হলবরাদ্দ চাইবে, সেসব দল ৬ মাস পূর্বেই আবেদনটি করে রাখবে। ঠিক তেমনি, ১ বছর আগে আবেদন করে, ১ বছর পরের কাঙ্ক্ষিত তারিখগুলো চাইতে হবে।
এটি কেন বলছি?
আমাদের শ্রদ্ধেয় এক নাট্যচিন্তক-গবেষক-নির্দেশক নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেছে, ঢাকায় নাট্যদর্শক আছে কম-বেশি মাত্র ৫ হাজার। অর্থাৎ জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিমেন্টাল হলটিতে (ধরা যাক ৩ শ’ আসন) যদি কোনো দল হল-ভর্তি-দর্শক নিয়ে কোনো প্রযোজনা দর্শকের সামনে আনে, তাহলে ঢাকার সব দর্শককে প্রযোজনাটি দেখাতে ১৬/১৭টি প্রদর্শনীই যথেষ্ট। আর যদি ধরে নিই, অনেক দর্শকই প্রযোজনাটি দ্বিতীয়বার দেখতে আগ্রহী (কেননা, ভালো-প্রযোজনা হলে দর্শক একাধিকবার দেখতে আগ্রহী হতেই পারে), তাহলে এক বছর পর কাঙ্ক্ষিত মাসে প্রযোজনা নিয়ে টানা ১৬/১৭টি প্রদর্শনী করতে পারে (প্রয়োজনে তখন পুরনো প্রযোজনাও প্রদর্শিত হতে পারে)। অর্থাৎ একটি ভালো-প্রযোজনা ঢাকার সব নাট্যদর্শককে ২ বার দেখাতে নাট্যদলটির সময় লাগছে দুই মাস (আসলে ১ মাস)। অথচ, প্রতিমাসে যদি ওই নাটকটির প্রদর্শনী করা হয়, এবং সব প্রদর্শনী হলভর্তি দর্শকের সামনে করা হয়, তাহলেও দলের-সবাইকে সময় দিতে হবে প্রায় ৩ বছর। নিকট অতীতে আমাদের এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, টানা প্রতিদিন প্রদর্শনী করলে, আর দর্শক যদি আগাম জানতে পারে যে, এক বছরের আগে আর প্রযোজনাটি দেখার সুযোগ থাকবে না, তখন প্রায় প্রতিটি প্রদর্শনীতে হল-ভর্তি দর্শক উপস্থিত থাকে।
অর্থাৎ, বলতে চাচ্ছি, যারা গতানুগতিক নাট্যদল থেকে আলাদাভাবে থিয়েটারচর্চা করে থাকে, এবং এর জন্য মেধা-শ্রম-অর্থ সবই অন্যদের চেয়ে বেশি খরচ করে, তাদের প্রয়োজন একটি বাৎসরিক কর্মপরিকল্পনা সদস্যদেরকে জানিয়ে দেয়া (কোনো কোনো নাট্যদল হয়ত ইতোমধ্যেই এভাবে চালিত হচ্ছে)। নাট্যকর্মীর জন্য থিয়েটারচর্চা যেহেতু আর্থিক-আয়ের উল্টানুপাতিক, অর্থাৎ থিয়েটাচর্চায় যে যত বেশি নিবেদিত হবে, যে যত বেশি থিয়েটারচর্চা করবে, সে তত বেশি বেশি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই তাদের আয়-সংস্থানের জায়গাটিকে নিরাপদ রাখার সুযোগ দিতে হবে। আমাদের নাট্যকর্মীদের আয়ের উৎস হলো, চাকরি, ব্যবসা আর মিডিয়ায় কাজ করা। তো, তারা যদি নাট্যদল থেকে ১ বছরের কর্মপরিকল্পনা পেয়ে যায়, তাহলে থিয়েটারচর্চাকে তাদের পেশার সাথে (সেটি যাই হোক না কেন) সমন্বয় করে নিতে পারবে।
ভালো ভালো প্রযোজনা কেবল ঢাকার দর্শক দেখলেই তো চলবে না। সারাদেশের নাট্যদর্শকের কাছেও নিয়ে যেতে হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা আছে, বিভাগীয় বা জেলাশহরের কোনো নাট্যদলের আমন্ত্রণে ঢাকার দলগুলো বাইরে যায়। কিন্তু সে সংখ্যাও ইদানিং বেশ কমে গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার কোনো কোনো দল নিজ উদ্যোগে ঢাকার বাইরে নিজেদের প্রযোজনা (এক বা একাধিক) দিয়ে নাট্যোৎসব করেছে। ঢাকার বাইরের দলও একই কাজ করেছে ঢাকার মঞ্চে। নিয়মিত থিয়েটারচর্চার জন্য এগুলো ভালো উদাহরণ। কিন্তু এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। এ ধরনের চর্চা আরো ব্যাপক হওয়া দরকার। বেশি বেশি নাট্যদল, বেশি বেশি শহরে এ ধরনের উৎসবের আয়োজনের কর্মপরিকল্পনা বছরের শুরুতেই করে ফেলতে পারে। বছরে ন্যূনতম একবার এমন কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে। আর ঢাকার বাইরের দলগুলোর কেবল ঢাকামুখী হওয়ার প্রবণতাও কমানো দরকার। তাদেরও কর্মপরিকল্পনা থাকতে হবে অন্যান্য জেলা ও বিভাগীয় শহরে নাট্য-মঞ্চায়নের। আরেকটি বিষয় লক্ষ করা গেছে। আমাদের প্রায় সব-নাট্যদলেরই একটি প্রবণতা আছে, প্রযোজনা নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার (বিশেষকরে পশ্চিমবঙ্গে বা ত্রিপুরায়)। এ পরিকল্পনা-বাস্তবায়নে যে আর্থিক ও কায়িক খরচা হয়, তা দিয়ে অনেকগুণ বেশি-সংখ্যক স্বদেশী দর্শককেই নাট্য-রসাস্বাদন দেয়া যেতে পারে। ঢাকার বাইরের নাট্যদলগুলোরও প্রধান প্রবণতা থাকে, প্রযোজনা নিয়ে ঢাকার মঞ্চে আসা। এর চেয়ে অনেক সাশ্রয় হওয়ার কথা যদি তারা আশ-পাশের সব জেলাগুলোয় ভ্রমণ করে। এবং যদি সম্ভব হয় সারাদেশ ভ্রমণ করে। ঢাকার দর্শক প্রযোজনা দেখে ‘সাবাস’ দিলে যেমন ঢাকার বাইরের দলগুলো তৃপ্তিতে গদগদ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি দেশের বাইরের দর্শকের ‘অভিনন্দন’ পাওয়ার জন্য ঢাকার দলগুলো নিরন্তর প্রত্যাশায় ছোটে। এ মানসিকতা দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
অনেক আগে থেকেই কিছু কিছু নাট্যদল (যারা ভাড়ার বিনিময়ে নিজস্ব-মহড়াকক্ষ পোষে) সংক্ষিপ্ত কলেবরে কিছু প্রযোজনা তৈরি করে, সেগুলো মহড়াকক্ষেই দর্শনীর বিনিময়ে প্রদর্শনের আয়োজন করে আসছে। কিন্তু বেশি নাট্যদল এ ধরনের আয়োজনে আগ্রহ দেখায় নি। ইদানিং আরো দু-তিনটি দলকে এমন আয়োজনে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে দেখছি। এটি নিয়মিত ও বেশি-সংখ্যক নাট্যদলের মধ্যে চালু রাখার প্রয়োজন বলে মনে করি। এর-দ্বারা দর্শকের ভিন্ন-রুচিতে আগ্রহী করে তোলার এবং নিজ দলের নাট্যকর্মীকে প্রশিক্ষিত করে তোলার কাজটি সচল থাকবে।
আরেকটি কাজ হয়ত হতে পারে। সক্ষমদলগুলো তাদের নাট্যদলের ব্যানারে শিশু-কিশোর-কিশোরী অভিনেতৃ দিয়ে নিয়মিত নাট্যনির্মাণ করতে পারে। এতে করে নতুন প্রজন্মকে আগে থেকেই মঞ্চনাট্যচর্চার দিকে আকর্ষণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছি। নিজ নাট্যদলের প্রাপ্ত হলবরাদ্দ থেকে বছরে ১/২টি বরাদ্দ ওসব প্রযোজনা প্রদর্শনের জন্য বিবেচনা করতে পারে, আবার প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক বা ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চমাধ্যমিক স্কুল-কলেজগুলোয়ও এসব প্রযোজনা প্রদর্শন করা যেতে পারে।
আর কথা না-বাড়াই।
উপরোক্ত নাট্যকর্ম ও চর্চা চালিয়ে যেতে পারলে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র ‘নেতাগিরি থাবা’ থেকে মুক্ত হয়ে ‘থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’গুলো ভালোভাবে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখি।
পুনশ্চ: লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এখানে কেবল ঢাকার থিয়েটারচর্চা নিয়ে কথা হয় নি। এখানে পুরো বাংলাদেশের ‘থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’-এর দিকেই [অর্থাৎ. যদি প্রয়োজন হয় (গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান-চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কিংবা পাবনা, রংপুর, ফরিদপুর, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ-ইত্যাদি)] মনোযোগ দেয়া হয়েছে। আবার চাইলে যেকোনো নাট্যদল ফেডারেশানভুক্ত না হয়েও দেশের যেকোনো জায়গায় থিয়েটারচর্চার সামনের দিনগুলোতে সরব থাকতে পারে।
১৮ চৈত্র ১৪২৮। ১ এপ্রিল ২০২২।
হাসান শাহরিয়ার (
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
): সম্পাদক-‘থিয়েটারওয়ালা’