Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কিংস্নেক ও অদ্ভুত ভূত : নিষিদ্ধ-সংস্কৃতিচর্চার নাম গ্রুপ থিয়েটার!

Written by বাকার বকুল.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

এই রাষ্ট্রে এখনও একধরনের নিষিদ্ধ-সংস্কৃতিচর্চার নাম গ্রুপ থিয়েটার। কথাটায় একমত হবার বাধ্য-বাধকতা নেই। দ্বিমত হলেই বরং ভালো, থিয়েটারবিষয়ক বোঝাপড়াটা ঝালাইয়ের সুযোগ ঘটে। গ্রুপ থিয়েটারে আসা অধিকাংশ ছেলে-মেয়ে আসলে পরিবারের অগোচরে থিয়েটারকর্মটি করেন। অল্পসংখ্যক, যাদের লুকিয়ে করতে হয় না, তাদের ভাগ্যবান মনে করি। ভাগ্যহীনের মধ্যে মেয়েটির প্রতিবন্ধকতার-সীমা চূড়ান্তে। সমাজের-দৃষ্টিতে পথভ্রষ্ট-নষ্ট আদব-লাজহীন না হলে কোনো মেয়ে আসলে নাট্যচর্চা করে না। ব্যতিক্রম দু-একটি পরিবার থাকলেও সমাজ পরিবারটিকে মর্যাদা দূরে থাক, গ্লানিতে ম্লান করে দেয়। বাড়িয়ে বলা কথা মনে হতে পারে এবং প্রশ্নও করা যেতে পারে, এখন কি আর আগের মতো সেই দিন আছে? নিজদলের মেয়েটি কিংবা ছেলেটির সঙ্গে একটু কথা বলে দেখুন না, পরিবারকে মানিয়ে কীভাবে সে গ্রুপে আসে, ইতিবাচক দৃষ্টিতে কয়টি পরিবার দ্যাখে অথবা একটি পরিবার দেখান, যে পরিবার বলেছে, যা থিয়েটারটাই মন দিয়ে কর! দুর্লভ!

যাহোক, এভাবে যদি থিয়েটার সংগঠিত হয়ও কিন্তু মহড়াকক্ষ! ঢাকায় কী হয় আপাতত সেটিই যদি দেখি, দ্বারে দ্বারে ঘুরেও একটি মহড়াকক্ষ জোগাড় করা যায় না। যে সকল নাট্য-সংগঠনের আর্থিক-সামর্থ্য আছে, তারাও ব্যর্থ হয়। কারো দয়া-দাক্ষিণ্যে যদি একটি মহড়াকক্ষ পাওয়াও যায়, সেখানে টিকে থাকা কতটা কঠিন সেটি যারা এই কর্মযজ্ঞটি পরিচালনা করেন শুধু তারাই জানেন, হোক সে ভাড়ায় কিংবা অন্য উপায়ে। অতীতে নাকি সরকারি স্কুল-কক্ষগুলো মহড়ার জন্য ভাড়া কিংবা বরাদ্দ পাওয়া যেত, সে-ও এখন স্বর্ণ-মৃগ। শোনা যায়, একটি নাট্যদলকে মহড়ার জন্য কক্ষ বরাদ্দ দেয়ায় স্কুল-কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক সচিব মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। ব্যস, স্কুলের কক্ষ-বরাদ্দ বন্ধ (ব্যতিক্রম উদাহরণ না হোক)। থাকে শুধু শিল্পকলা একাডেমির মহড়াকক্ষগুলো! দুষ্প্রাপ্য, অন্তরিক্ষের চাঁদ! যে কোনো নাট্যদলের একটি প্রযোজনা প্রস্তুত করতে কতদিন লাগে? ধরা যাক, কমপক্ষে তিন মাস। টানা তিন মাস শিল্পকলার মহড়াকক্ষ পাওয়া! অলীক-কল্পনা। এক সপ্তাহের আবেদন করলে পাবেন দুইদিন কী তিনদিন, যদি হলবরাদ্দ কমিটির সাথে আপনার সুসম্পর্ক বজায় থাকে তবেই। ওটুকু পেতেও আরো কিছু চর্চার অভ্যাস আপনাকে করতে হবে। যেমন, কমিটির নেতাদের বড় করে সালাম দিলেন, মাঝেমধ্যে ফোনে হাই-হ্যালো করলেন, অন্য নেতাদের ভীড়ে উনি যে একটু ভিন্ন এবং খাঁটি-নেতা (যতই পাতি-ই হোক) সেটিও দু-একবার জানান দিলেন, আবেদনের পর ফোনে একটু মনে করিয়ে দিলেন, এইসব আরকি! সে আপনার দল যতই দুর্দান্ত কাজ করে থাকুক, সৃজনশীল-মানসম্পন্ন কিংবা আধুনিক, ওগুলোয় কিছুই যায় আসে না! ওগুলো ওনারা দেখবেন না! এখন বলতে পারেন, কেন, ওমুক তো অনেকদিন ধরেই টানা মহড়া করছে! সর্বনাশ! তাহলেই আপনার থিয়েটারের স্বপ্ন শিকেয় উঠে গেল। ওনারা অভিজাত, বাকিরা নিম্নজাত। অভিজাতদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজেদের নিম্ন-শ্রেণির ভাবুন, না হলে আপনাকে দিয়ে আর যাইহোক, নাট্যচর্চা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। আর যদি সরকারি-অনুষ্ঠান, শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব-অনুষ্ঠান (ইদানিং বছর ধরেই দেখা যায়) থাকে, ওমুখো না হওয়াই উত্তম, কর্তৃপক্ষ ভীষণ গোস্যা করবেন।

মঞ্চায়নের কথায় আসা যাক। পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তুর উপর সরকারি-সেন্সরশিপ (অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন) উঠে গেছে সেই কবে। কিন্তু এখনও সেন্সরশিপের ভূত বহাল তবিয়তেই ঘুরে ফিরে বেড়ান। যেমন ধরা যাক, একটি নাটকে প্রাপ্তবয়স্ক-দৃশ্য রয়েছে, নির্দেশক হিসেবে শুরুতেই আপনি কেটে ফেলে দিন, একান্তই যদি রাখতে চান উইংসের বাইরে রাখুন, দর্শকের দৃষ্টির আড়ালে, ইশারা-ইংগিত কিংবা দুই-গোলাপের টোকা-টুকিতে বুঝিয়ে দিন দৃশ্যটি প্রাপ্তবয়স্ক। নাবালকের থিয়েটার-শিল্প (!) সাবালকগিরি দেখাতে গেলেই সর্বনাশ। হলের সামনে টাঙানো নাটকের ব্যানারটি কর্তৃপক্ষ টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলতে পারে। পরবর্তীসময়ে হলবরাদ্দ চাইলে নাটকটি সেন্সর করার মুচলেকা দিতে হতে পারে, হলবরাদ্দ কমিটিতে যতই থিয়েটার-বোদ্ধা থাকুক না কেন। মনে রাখতে হয়, ভূত যেহেতু অদৃশ্য সেহেতু যে কাউকেই আছর করতে পারে। প্রমাণ দেব? দেই। এইতো সেদিন রাত ভরে বৃষ্টি নাটকটি নিয়ে ‘আপস্টেজ’ নাটকের দলটিকে অশালীনতার দায়ে বিব্রত করা হলো। তার আগে সে রাতে পূর্ণিমা ছিল নাটকটি নিয়ে ‘আরশিনগর’ নাট্যদলটি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের শীর্ষস্থানীয় দু-একজন নেতার মুখে ছিঃ ছিঃ শুনেছি। তারও বহু আগে ‘প্রাচ্যনাটে’র কইন্যা নাটকটির কথিত অশালীনতা হজম করতে দীর্ঘ সময় লেগেছে অনেকের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল উল্লেখিত নাটকগুলো গুণে-মানে-ডিজাইনে অসম্ভব ভালো নাটক।

রাজনৈতিক থিয়েটার! সে তো আরো বেশি জটিল। সৈয়দ জামিল আহমেদ ‘স্পর্ধা’র ব্যানারে নিয়ে আসলেন নাটক, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা সৈয়দ জামিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-বিকৃতির-দায়ে অশোভনভাবে অভিযুক্ত হলেন। যারা অভিযোগ তুললেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা, কেউ কেউ আওয়ামী সরকারের সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ডের উপদেষ্টা এবং সর্বোপরি থিয়েটারের মানুষ। ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’-প্রযোজনা ও কামালউদ্দিন নীলু নির্দেশিত স্তালিন নাটকেও একই ঘটনা ঘটল। ইতিহাস-বিকৃতির প্রতিবাদে সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিতরা জাতীয় নাট্যশালায় মিছিল করলেন। আরো আগে ফরিদপুরের ঘটনাটি আমাদের নিশ্চয়ই মনে থেকে থাকবে। ধর্মীয়-অনুভূতিতে আঘাতের ‘অজুহাতে’ কথা কৃষ্ণকলি নাটককে অভিযুক্ত করা হলো। বিএনপি-জামাতের কর্মীরা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করলেন এবং ফরিদপুরের গতিশীল-থিয়েটার-কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থবির করে দেয়া হলো। স্বাধীনতা-পরবর্তী সারাদেশের চলমান থিয়েটার-কার্যক্রমে এ ধরনের ঘটনা অসংখ্য। উদাহরণ হিসেবে দু-একটিই শুধু উল্লেখ করা হলো মাত্র। তার মানে কী দাঁড়ায়? ধরা যাক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) রাষ্ট্র-পরিচালনা করছে। জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বায়োগ্রাফিক্যাল একটি থিয়েটার বানাতে চান। সৈনিক থেকে মেজর জেনারেল-মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার-সাবেক রাষ্ট্রপতি, সবই ঠিকঠাক থাকল, কিন্তু যখনই আপনি উল্লেখ করবেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে নেপথ্যে যারা ছিলেন, তাদের অন্যতম একজন জিয়াউর রহমান কিংবা সাজানো ট্রাইব্যুনালে কর্নেল তাহেরের হত্যাকারী তিনি। তা ইতিহাস যতই সত্য হোক, আপনি রাষ্ট্রদ্রোহীতা ও ইতিহাস-বিকৃতির দায়ে দুষ্ট হবেনই। ধরা যাক, ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েম হলো এই দেশে। মাওলানা নিজামীরা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধীতা করে যে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ-খুন-ধর্ষণ চালিয়েছে, সেই সব কথা দূরে থাক, নাটক করবেন ভাবনাটিও মগজের ভেতরে সুইসাইড করবে। তালেবানীয় শাসন-ব্যবস্থায় আফগানিয়দের দশা দেখলেই তা অনুমান করা যায়। সমাজতান্ত্রিকদের কথা যদি বলি, লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লবের পর ট্রটস্কি-স্তালিনদ্বন্দ্ব, ট্রটস্কিকে অস্ত্রের মুখে নির্বাসনে পাঠানো, স্তালিনের দীর্ঘ-শাসনামলে নিজদলের ভেতরে মতবিরোধীদের হত্যাকাণ্ড, ইউক্রেনে পুতিনীয় আগ্রাসন, কিংবা এইদেশের সমাজতান্ত্রিক-নেতাদের ক্ষমতার লোভে বিভিন্ন সময়ের পল্টিবাজি ইত্যাদি সমাজতান্ত্রিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে এগুলো থিয়েটারে তুলে আনা অসম্ভব হবে তা প্রমাণিত। কেননা, ক্ষমতায় না থেকেও স্তালিন নাটকটি বন্ধ করার জন্য নাট্যশালায় জোটবদ্ধ হয়ে উত্তেজিত মিছিল করেন তারা। এরপরও যদি কেউ এমন নাটক করার আগ্রহ দেখান, তা ইতিহাস যতই সত্য হোক, খেতাব পাবেন ‘পুঁজিবাদীদের পেইড প্রপাগান্ডিস্ট’, ট্রটস্কির মতো নির্বাসিত অথবা গুম হবেন। আওয়ামী লীগ শাসন আমলেও এর ব্যত্যয় ঘটে নি, ঘটছে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী দীর্ঘ-রাজনৈতিক-জীবন তুলে ধরলে কথা নেই, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বজ্রকণ্ঠ, একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জীবনের অধিকাংশ সময় কারাবাস, সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন, তার রাজনৈতিক-আদর্শ, সবই ঠিক থাকবে। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাজউদ্দীনসহ চার বুদ্ধিদীপ্ত নেতা এবং সিরাজুল আলম খানদের দূরে ঠেলে দেয়া, খন্দকার মুশতাকদের কাছে টেনে নেয়া, সিরাজ সিকদারকে স্বাধীন দেশের প্রথম ক্রসফায়ারে হত্যা করা, কিংবা, বর্তমানের গুম-খুন-ধর্ষণ আর বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশাসন ও বিচার-ব্যবস্থাকে দায়ী করে একটি থিয়েটার বানানো সম্ভব নয়। আপনার কাছের লোকটিই গোয়েন্দা পুলিশ কিংবা র‌্যাব ডেকে নিয়ে আসবে। ছোট্ট এক জীবনে আপনার হেনস্তার শেষ থাকবে না। আর একান্তই যদি সত্য কথাটি থিয়েটারে বলার জন্য আপনি অন্তর-তাড়িত হন, তবে সরল-নান্দনিকতার কোনো উপায় নেই, রূপক-সাংকেতিকতার প্রলেপ দিতে দিতে ততটাই দুর্বোধ্য ও অস্পষ্ট করে তুলবেন যতক্ষণ না দর্শককে ‘নির্বোধ’ প্রমাণ করা যায়। উপরোক্ত বিষয়াদি পর্যালোচনা-সাপেক্ষে যদি বলা হয়, এই রাষ্ট্রে একধরনের ‘নিষিদ্ধ-সংস্কৃতিচর্চার নাম গ্রুপ থিয়েটার, সেটি অত্যুক্তি হবে না বলে মনে করি।

সঙ্গতভাবে প্রশ্ন এসেই যায় তাহলে কেন থিয়েটার করি, কেন করে, কারা করে? উত্তরগুলোও অজানা নয়। একজন প্রকৃত-শিল্পী অসৎ হতে পারেন না, নিজের ক্ষেত্রে আরো বেশি রূঢ় এবং দৃঢ় থাকেন, এটি তার স্বভাবজাত মানবিক-বৈশিষ্ট্য, যে অধ্যাবসায় তিনি যুগের পর যুগ ধরে করে থাকেন বা করে এসেছেন। সমাজ-রাষ্ট্র-ব্যক্তি-ইতিহাসের অসঙ্গতি-মিথ্যাচার তাকে বিক্ষত করে বলেই তিনি শিল্পের ভেতরে এগুলোকে আশ্রয় করেন। যে কোনো উপায়েই হোক, কথা তাকে বলতেই হয়। তাই তিনি অস্থির-নিঃসঙ্গ-গোঁয়ার ও সমাজের সবচেয়ে অসুখী মানুষ।

গ্রুপ থিয়েটারের ক্ষেত্রেও প্রশ্নগুলো সাজানো যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে থিয়েটারচর্চা কীভাবে হলো, কতটুকু হলো, এখনও কীভাবে চলমান, কালোত্তীর্ণ নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতৃ-সংগঠক তৈরি হয়েছে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন তুললে, এক্ষেত্রেও উত্তরগুলো স্পষ্ট, হাতেগোনা কিছু কাজ হয়েছে সত্য, আর সেগুলো হয়েছে ব্যক্তিগত গোয়ার্তুমিতে, বিক্ষত শিল্পীসত্তার অস্থিরতা থেকে। বাকি অধিকাংশ স্তূপে পরিণত হওয়া শিল্পের-আবর্জনা, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কৌশলে নিজেদের প্রশংসায় পিঠ চাপড়া-চাপড়ি, নিচু-দরের ব্যক্তি-স্বার্থ-সিদ্ধির লোভনীয় রাষ্ট্রীয় পদ-পথ-পদক খুঁজে নেয়ার ধান্ধাবাজি। ওগুলো শিল্প-সম্পর্কহীন। একটি স্বাধীন দেশে শিল্পী এবং শিল্পের জন্য যে উদারনৈতিক বিস্তীর্ণ-ক্ষেত্র প্রয়োজন ছিল, তা কখনোই সৃষ্টি হয় নি। ব্যক্তি-উদ্যোগে কিছু কিছু ক্ষেত্র তৈরি হতে হতেও মরে গেছে, কখনো কখনো মানসিক-চাপে, দৈন্যে-বিভ্রান্তিতে উদ্যোক্তারাই মেরে ফেলেছেন। এ সকল কারণেই নাট্যচর্চায় নিবেদিত হতে চাওয়া নতুন ছেলে-মেয়ে অল্প কিছুদিনেই থিয়েটারবিমুখ হতে বাধ্য হন। আবার অন্যদিকে দীর্ঘকাল থিয়েটারে কাটিয়ে দেয়া পিতা-মাতাকে দেখি সন্তানদের থিয়েটারমুখী হতে নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই দেশে কোনো এক সময় কিছু মানুষ নাট্যচর্চার মতো সৃজনশীল-গঠনমূলক একটি কাজ বেছে নিয়েছিল, দেশব্যাপী ছোট ছোট গ্রুপ করে উন্নতস্তরের সমাজ-গড়ার স্বপ্ন বুনেছিল, যে কোনো অতিকায় অশুভ-শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গ্রুপগুলো সংঘবদ্ধ হয়ে ফেডারেশান গঠন করেছিল। হ্যাঁ, ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র কথাই বলছি। একজন স্বাধীনচেতা সৃজনশীল-নাট্যশিল্পীর জন্য মুক্ত-বিকাশময়-উদারনৈতিক একখণ্ড নাটক-বান্ধব-জমিন তৈরি করা, সংগঠনটির ক্ষমতার মধ্যেই ছিল। কিন্তু আমরা প্রতারিত হই বারবার, খেত পাহারা দিতে যে বেড়া নির্মাণ করি, বেড়ায়ই খেয়ে ফেলে আমাদের সাধের সেই খেত!

‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকার সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। শিরোনাম, ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’। একটি স্বাধীন দেশে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার শুরু, চলমানপ্রক্রিয়া-অর্জন-ব্যর্থতা, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠন, ভূমিকা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফলতা-বিফলতা ও সামনের দিনে করণীয় প্রভৃতি বিষয়াদি সম্বলিত নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। এক শিরোনামে বিষয়গুলোকে আটকেছেন লেখক, যা সহজে চোখ বোলানোর প্রশান্তি যেমন দেয়, সাথে সাথে একজন প্রকৃত থিয়েটার-প্রাণ মানুষের মনকষ্টও সমপরিমাণে জানান দেয়। নানা আলোচনার ভিড়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রসঙ্গও তুলেছেন তিনি। ধন্যবাদ তাকে এই জন্য যে, অন্য অনেকের মতো বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে যান নি। যদিও শাহরিয়ার হালকা-চালে মূলবিষয়টি উল্লেখ করেছেন কিন্তু এর তল খুঁজে দেখা থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট সকলেরই দায়িত্ব। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ফেডারেশানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-২ এর কথাটি হচ্ছে ‘নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা’। সেক্ষেত্রে ফেডারেশানের নির্বাচিত সভাপতি যদি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হন অর্থাৎ দুই পদে একই ব্যক্তি থাকেন, তাহলে ফেডারেশানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা, ফেডারেশানের সংগ্রামী-চরিত্র নষ্ট হয় কিনা। ব্যক্তি দ্বান্দ্বিকতার জায়গা থেকে নয়, বাস্তবতার-নিরিখে পর্যালোচনা সুবোধের কাজ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (তাও আবার থিয়েটারচর্চার ভালো-মন্দ দেখার সরকারি প্রতিষ্ঠান), সরকারের পছন্দের মানুষটিই মহাপরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন এটাই প্রত্যাশিত। এখন ফেডারেশানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-২ অনুযায়ী নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক-আন্দোলন যদি গড়ে তুলতে হয়, সেটি কার বিরুদ্ধে হবে? আমাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? এ যাবৎকালে নাট্যচর্চায় সবচেয়ে বড় বাঁধাদানকারি প্রতিষ্ঠান কোনটি? এক কথায় বলে দেয়া যাবে, বিভিন্ন সময়ের ‘সরকার’ এবং তার প্রশাসন-বাহিনী। এর বড় প্রমাণ ১৮৭৬ সাল থেকে একশ বছরের অধিক সময় ধরে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন’ বলবৎ থাকার চেয়ে আর কী হতে পারে। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন উঠে যাবার পরও যে সকল আঘাত বিভিন্ন সময়ে থিয়েটারওয়ালাদের উপর হয়েছে, সেগুলো অনুসন্ধান করলেও দেখা যায়, ওই সময়কার সরকারই ছিল প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ-ইন্ধনদাতা। এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনের কথাই ধরা যাক। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল কাজ বোধকরি তখনই কিছুটা করেছে। মঞ্চ থেকে শুরু করে পথে-ঘাটে বিভিন্ন ধরনের স্বৈরাচার-বিরোধী নাট্যায়োজনের মধ্যদিয়ে দেশব্যাপী নাট্যদলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে সাংস্কৃতিক-আন্দোলনে রূপ দিতে পেরেছিল। এখন প্রশ্ন হলো, স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের সময় যদি ফেডারেশানের সভাপতি ও শিল্পকলার মহাপরিচালক একই ব্যক্তি হতেন, তবে তার নেতৃত্বে কি একটি সাংস্কৃতিক-আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হতো?  হয় গ্রুপ থিয়েটারগুলোর চাপে তাকে রাষ্ট্রীয় পদ ছেড়ে সংগ্রামে-মিছিলে-মঞ্চে দাঁড়াতে হতো অথবা রাষ্ট্রের চাপে ফেডারেশানের সভাপতিত্ব ছেড়ে সরকারের সেমি-আমলা সেজে সাংস্কৃতিককর্মীদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে গালিগালাজ ও পিণ্ডিচটকানোয় পারদর্শী হতে হতো।

ফেডারেশানের অন্তর্ভুক্ত তিনশ’রও বেশি নাট্যদল। বেশিরভাগ নাট্যদলকেই এখন ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় শিল্পকলা একাডেমির নানাবিধ কার্যক্রমে। শিল্পকলার বছরব্যাপী অগণিত উৎসব-অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যস্ততায় নাট্যদলগুলোর নিজস্ব কার্যক্রম দিনে দিনে স্থবির হয়ে যাচ্ছে। মানসম্মত নাট্যপ্রযোজনা আর দলগুলো থেকে আসছে না। তবে অন্যকারণে নামকাওয়াস্তে কিছু প্রযোজনা আসে। কারণগুলো হলো, নাটক না থাকলে কর্মী থাকে না, কর্মী না থাকলে দল থাকে না, দল না থাকলে ফেডারেশানের সদস্যপদ থাকে না, সদস্যপদ না থাকলে নেতাগিরি থাকে না, আর নেতাগিরি না থাকলে সুবিধাভোগীর ধান্দা থাকে না। এসব দুষ্টচক্রের খপ্পরের মধ্যদিয়ে প্রযোজনা উৎপাদিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় আর যাই হোক শিল্পী এবং শিল্পের বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু অনেক দলেরই অতীত ইতিহাস বলে, নিজস্ব-স্বকীয়তার মধ্যে থেকেই দুর্দান্তসব প্রযোজনা তারা নাট্যামোদী-দর্শককে উপহার দিয়েছেন। শিল্পকলা একাডেমি যেহেতু জাতীয় প্রতিষ্ঠান, সেহেতু বিভিন্ন দলের মেধাবী শিল্পী প্রতিষ্ঠানটির মধ্যদিয়ে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাবেন, জাতীয়-আন্তর্জাতিকমানের প্রযোজনা তৈরি করবেন, যা ভবিষ্যৎ-শিল্পীদের জন্য অনুকরণীয়-অনুসরণীয় হবে, এগুলো তো আশার কথা। কিন্তু সে আশার ‘গুঁড়ে’ সব সময় আমরা ‘বালি’ই দেখতে পাচ্ছি। যে সকল মাইলফলক-নাট্যপ্রযোজনা এ যাবৎ ব্যক্তিগত নাট্যসংগঠনগুলোর উদ্যোগে হতে দেখেছি, সেই তুলনায় শিল্পকলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি-হওয়া প্রযোজনাগুলোর মান এবং স্থায়ীত্ব হতাশার কোঠায়। যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন এসে যায়, শিল্পকলা একাডেমি তো আগের তুলনায় অনেক বেশি চাঙ্গা, সরগরম, বছরব্যাপী দেশজুড়ে উৎসব-অনুষ্ঠান আয়োজনে ব্যস্ত এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয়ও সেখানে করছে, তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা নেই। একটি রাষ্ট্র সংস্কৃতি-বান্ধব হবে, সারাদেশে উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সংস্কৃতিকর্মীরা উজ্জ্বীবিত থাকবেন, খুবই ভালো কথা। কিন্তু ভালোটাই কাল হয়ে দাঁড়ায়, যখন উদ্দেশ্যটিই হয় ‘উদ্দেশ্যমূলক’। একটি রাষ্ট্রীয়-প্রতিষ্ঠান যখন কোনো অনুষ্ঠান অথবা উৎসব আয়োজন করে, মূলত সেই প্রতিষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই করে থাকেন। একজন শিল্পী কিংবা সামাজিক-উদ্যোগে গড়ে-ওঠা শিল্পসংগঠন সেই উদ্দেশ্যমূলক-এজেন্ডা বাস্তবায়নকে প্রয়োজনীয় নাও মনে করতে পারে, আবার করতেও পারে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে কোনো শিল্পী কিংবা শিল্পসংগঠন যদি এ ধরনের কাজকেই নিজের বা সংগঠনের মূলকাজ ধরে নেয়, তাহলে ঐ শিল্পী এবং সংগঠনের কাছ থেকে অন্যের এজেন্ডাভিত্তিক কিছু প্রজেক্ট ব্যতীত মৌলিক, কালোত্তীর্ণ, সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্পকর্ম প্রত্যাশা করা অপরিণামদর্শীতা ছাড়া আর কিছু নয়। মনে রাখা দরকার, এসকল প্রাতিষ্ঠানিক-এজেন্ডাগুলো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের সূক্ষ্ম হিসাব-নিকাশ দ্বারা সুচিন্তিতভাবে উৎপন্ন ও বাস্তবায়ন-প্রসূত হয়। নাটক কথাবলা শিল্প। সমাজনীতি-রাজনীতির অসঙ্গতিগুলো নিয়ে জবাবদিহিতামূলক কথাবলাটাই তার কাজ। মুক্তচিন্তা ও বাক্স্বাধীনতার উন্মুক্ত-সহনশীল-পরিবেশে এই জবাবদিহিতাকেই প্রতিষ্ঠা করে চলে নাটক। যে জবাবদিহিতাই একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অগ্রগামীতার পথে মূল-প্রাণশক্তি। কিন্তু উল্লেখিত প্রাতিষ্ঠানিক-এজেন্ডাগুলো ব্যবহৃত হয়ই মূলত এই সকল জবাবদিহিতাকে আড়াল করার প্রয়োজনে। কেননা, জবাবদিহিতা মানেই ‘প্রশ্ন’ আর ‘প্রশ্ন’। আর এদেশে প্রশ্ন মানেই কেঁচো খুঁড়তে সাপ। একটি অঞ্চলে সামাজিক-উদ্যোগে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে নাট্যসংগঠনটি গড়ে ওঠে, সে এমনিতেই গড়ে ওঠে না, ঐ অঞ্চলের কৃষ্টি-কালচারকে জীবিত রাখার পাশাপাশি মানবিক-মূল্যবোধ-সম্পন্ন শিক্ষিত-সচেতন প্রজন্ম তৈরি হয় সেখানে, যে প্রজন্ম নীতি-নৈতিকতাহীন যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সামাজিক-প্রতিরোধ ও সাংস্কৃতিক-আন্দোলন গড়ে তোলে। হোক সে উগ্রমৌলবাদিতা কিংবা রাষ্ট্রীয়-প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতা। জাতির মেরুদণ্ডটি সেখানেই ছিল বোধকরি। মেরুদণ্ডটিকে শক্ত-সামর্থ্য রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যা যা করার সেই ক্ষেত্র-বিস্তারে মূল-ভূমিকাটিই ছিল ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলে, ফেডারেশান তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। অর্থকেলেঙ্কারি, সিন্ডিকেটাইজেশানসহ অনভিপ্রেত অসংখ্য ঘটনাই উন্মোচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সামাজিক-উদ্যোগে গড়ে-ওঠা নাট্যসংগঠনগুলোর প্রতি ফেডারেশানের যে দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা, তা শুধু কাজির গরুর মতোই, কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। কেতাবে (গঠনতন্ত্রে) থাকা বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো একবার দেখে নিলে আলোচনার বিষয়বস্তু অনুধাবনে সুবিধা হবে বলে মনে করি।

‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
১.    গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা।
২.    নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩.    সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪.    নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা।
৫.    নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা।
৬.    নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা।
৭.    বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা
৮.    জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা।
৯.    দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা।
১০.   মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
১১.   পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।

বোধকরি ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র নির্বাহী-পরিষদ গঠনতন্ত্র খুলে দেখার প্রয়োজনই মনে করেন নি কখনো। যদি করতেন এবং লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ন্যূনতম পদক্ষেপ নিতেন নিশ্চয়ই আমরা আঁচ করতে পারতাম। যেমনটা আগে থেকেই আঁচ করা যায় ফেডারেশানের ভোটের আবহাওয়া, কে কে সেক্রেটারি জেনারেল পদে আগ্রহী, কোথায় কোথায় লবিং করছেন, কে কাকে ল্যাং মারার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, কে কাকে হাতে রেখেছেন ইত্যাদি গার্বেজ-বিষয়াদি। জনগণের উদ্যোগে গড়ে-ওঠা নাট্যসংগঠনগুলোর সমন্বিত-শক্তি ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ বর্তমানে সরাসরি রাষ্ট্রকর্তৃক পরিচালিত সংগঠন শিল্পকলা একাডেমির সাথে গাটছঁড়া বেঁধে গেছে বা বলা যেতে পারে সুকৌশলে গাটছঁড়া বেঁধেছে। এতেও কোনো সমস্যা হতো না যদি ফেডারেশানের নির্বাহী-পরিষদ বুঝতে পারতেন স্বতন্ত্র-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কটা কতটা ‘গলাগলির’ আর কতটা ‘বোঝাপড়ার’। কিন্তু দুর্ভাগ্য এদের বোধ-বুদ্ধি, চোখ-নাক-মুখ, সব বন্ধ। ফেডারেশান-একাডেমি মিলেমিশে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাবার কারণে, ফেডারেশান যদি কোনো কার্যক্রম হাতে নেয়ও, বোঝার উপায় থাকে না যে, কার্যক্রমটি শিল্পকলার, নাকি ফেডারেশানের। বিষয়টা ভয়াবহ!

আসলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে গিলে ফেলেছে। আর গ্রুপ থিয়েটারের যেইসব দলপ্রধান, ফেডারেশান-একাডেমি ভাই-ভাই বলে হৈহৈ করছেন, তারা গিলে ফেলেছেন নিজেদের হাতে-গড়া নাট্যদলটিকেই। এখনও যারা ‘গলাগলি’ থেকে বেরিয়ে ‘গেলাগিলি’ থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছেন, তাদের কাছ থেকেই মূলত কিছু অর্থপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-মানের নাট্যপ্রযোজনা দেখা যাচ্ছে। বাকি অধিকাংশই ইলবাবা-ইলবাবা হুজুরশাহ্-হুজুরশাহ্ জিকির তুলে শিল্প-সংস্কৃতির ছাপ দেয়া খালিঠোঙ্গা হাতে তবারকের আশায় পির-মুর্শিদের দরবারে আস্তানা গাঁড়তে ব্যস্ত।
 
‘গেলাগিলি’ নিয়ে একটা গল্প বলে শেষ করি।

আসলে গল্প না, ঘটনাটি সত্যিই ঘটেছিল।

আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া অঙ্গরাজ্যে সাপের একটা অভয়ারণ্য আছে। অন্যান্য প্রজাতির অনেক সাপের মধ্যে সেখানে বাস করে একটি ‘কিংস্নেক’ (বিষধর প্রজাতির সাপ)। পোকামাকর-ব্যাং-পাখি এবং অন্যান্য শিকার করা যায়, এমন প্রাণিই খাদ্য হিসেবে তার পছন্দ। কিন্তু হঠাৎ শোনা গেল, সে নাকি অন্যপ্রজাতির আস্ত-আস্ত সব সাপকেও গিলে ফেলছে। কী করে সম্ভব! হোক-না অন্যপ্রজাতির, কিন্তু সাপ তো! একটি সাপ অন্য আরেকটি সাপকে আস্ত গিলে ফেলবে! ভাবা যায়! আরো শোনা গেল, র‌্যাটল এবং কপারহেড এর মতো বিষাক্ত-সাপকেও অনায়াসে গিলে ফেলে হজম করতে পারে কিংস্নেক।

কিন্তু আমি আরো বিস্ময়কর একটি বিষয় বলতে গল্পটি শুরু করেছিলাম। গেলাটা কিংস্নেকের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, তাই কোনো-এক-সন্ধ্যায় নিজের লেজ থেকে নিজেকেই গেলা শুরু করল। লেজটি ছিল সরু, তাই দ্রুত গিলতে সময় লাগল না। এরপর গেলার গতি কিছুটা কম হলে মনে হচ্ছিল আর বোধহয় গিলতে পারবে না। কিন্তু আচমকা রাবারের মতো চোয়ালটিকে ফুলিয়ে নিজের পেট-পর্যন্ত গিলে ফেলল।

বিষয়টি প্রথম দ্যাখে জেসি রোথাকার। জেসি রোথাকার পেশায় সর্প-বিশেষজ্ঞ। সাপ নিয়েই জীবনভর কাজ করেও এমন দৃশ্য জীবনে দ্যাখেন নাই। চিন্তায় পড়ে গেলেন রোথাকার।

যে বিষয়টি নিয়ে রোথাকার সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হলেন, সেটি আমারও চিন্তার বিষয়। আগ্রহী হলে পাঠকও চিন্তা করে দেখতে পারেন। বিষয়টি কিছুটা ধাঁধার মতো। কিংস্নেক সমস্ত শরীরটা না হয় গিলে ফেলল, কিন্তু শেষমেষ কী ঘটবে? যখন সে তার মাথার কাছে চলে আসবে?

উপরোক্ত ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে গুগল কিংবা ইউটিউব খুঁজে দেখতে পারেন।

বাকার বকুল ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক