Full premium theme for CMS
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন : আমার ভাবনা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বেশ একটা দোটানার মধ্যে পড়ে গেলাম। থিয়েটার-বন্ধু সাইফ সুমন আর থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’র সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার একটা বৈঠকে যেতে ডাক দিলেন। যে বৈঠকের বিষয় ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’। আমি তো স্বনামধন্য কেউ নই, থিয়েটারের মতো এত বিশাল কর্মযজ্ঞে আমি নিতান্তই এক তুচ্ছ-পথিক। নিজের যোগ্যতা সম্বন্ধে আমি নিঃসংশয়। আর আগামী তো কেবল সময় নামের এক কাল্পনিক অক্ষ বরাবর এগিয়ে যাওয়া, যার শুরু নেই, শেষও নেই। তবু কেবলি বন্ধুত্বের আহ্বানে আর অন্যদের কথা শুনতেই আমার এই আয়োজনে অংশ নেয়া এবং তারই ধারাবাহিকতায় আদেশক্রমে এই লেখার অবতারণা। কারণ, থিয়েটার আমাদের প্রথম যা শেখায় তা হলো বাধ্যতা, নির্দেশকের এবং দলীয় নেতৃত্বের।
বাঙালি মানেই রাজনীতি-প্রিয়। ব্রিটিশদের তাড়াতে বাঙালির মতো এত মারমুখো অন্যকোনো ভারতবর্ষীয় ছিল না। তাই তো যত নেতা এই বঙ্গ থেকে উদ্ভূত হয়েছে সারা ভারতবর্ষ মিলিয়েও তা হয় নি। আমরা তিনজন একত্রিত হলেই দুটো দল হয়ে যাই এবং একে অপরকে সন্দেহ করতে থাকি। এই বিপুল সন্দেহ-প্রবণ এবং রাজনীতি-প্রিয় মানুষগুলোই একটা গোটা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছিল। কারণ, তারা প্রথমবারের মতো এক হয়েছিল (বেশিরভাগ বলাটাই শ্রেয়)। তার আগে অথবা পরে, বাঙালির আর একত্রিত হইবার ইতিহাস খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তো সেই বহুধা-বিভক্ত এবং অগণিত নেতার রাজ্যে থিয়েটার নামক এক সংগঠন, যার পেছনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ নামের এক মহাকাব্য আর রয়েছে কিছু ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ইউটোপিয় মানুষের ঘাড়-ত্যাড়া জীবন, তারা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ফেডারেশান করবেন। অর্থাৎ এক হবেন, মিলিত হবেন। মিলিত হবেন সংগ্রামের আদর্শে, মিলিত হবেন শিল্পের আশ্রয়ে। সেই মিলনেরও আজ বেলা বেলা বয়ে অনেকটা পথ। এতটা পথে রয়েছে অনেক সফলতা, রয়েছে নানান-সময়ে রাষ্ট্রীয় এবং বিরুদ্ধশক্তির বাধা অতিক্রম করে অসাধারণ সব নাটক মানুষকে উপহার দেয়ার গৌরব। জন্ম হয়েছে কত নাটককার-নির্দেশক-অভিনেতৃ-পরিকল্পকের। সকলে মিলে হয়েছিলেন এক। স্বৈরাচারের, মৌলবাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সদর্পে ঘোষণা করেছেন নিজের অস্তিত্ব। কিন্তু এ বিপ্লব প্রথম দিককার। প্রতিষ্ঠার প্রথম দুই দশক যে উন্মাদনা লক্ষ করা গিয়েছিল, তা যেন কোথায় হারিয়ে গেল সহসা। অনেকে বলেন, এ হলো তাগিদের অভাব। অনেকে বলেন, আপোষ। যদি আপোষ হয়, তবে কার সাথে আপোষ? কেনই-বা আপোষের কথা উঠছে? কিন্তু নাটক তো হচ্ছে। জীবনমুখী নাটক হচ্ছে, দ্রোহের নাটক হচ্ছে, হচ্ছে অনিন্দ্য-সুন্দর শিল্পীত-নাটক। সাহিত্য-নির্ভর নাটক, লোকজ পালাধর্মী নাটক, সবই তো হচ্ছে। তাহলে কোথায় অতৃপ্তি? কেন অনেকে বলেন ঘোর অমানিশা?
কেন এই মনে করা যে, এ তো রাত্রি? এ ঘোর সংকট? প্রতিদিনই তো নাটকের শো হচ্ছে। একে একে চারটা মঞ্চ। মহিলা সমিতির সেই ভাঙাচোরা দমবন্ধ-হয়ে-যাওয়া মঞ্চ তো নয়ই, রীতিমতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ঢাকা শহরে অন্য কোথাও বিদ্যুৎ চলে গেলেও শিল্পকলা একাডেমি আলো-ঝলমলে। সরকার রীতিমতো ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে দেশে শিল্পের অগ্রযাত্রা (!) চালু রাখতে। তাহলে কেন এই বিষাদ, কেন এই গেল গেল রব? এ কি তবে শিল্পীর অন্তর্গত-দুঃখবিলাস, চিরকালীন-অতৃপ্তি? নাকি এ সত্য, কঠিন এবং নির্মম-সত্য যে, বাংলাদেশে থিয়েটার বলে যা ছিল, তা হারিয়ে গেছে, অসীম ব্ল্যাকহোলে যেমন সকলি যায় হারায়ে। এই হারিয়ে যাওয়াও কি সময়ের দাবি?
হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধ-মারফত জানতে পারলাম, ফেডারেশানের বয়স ৪১ বছর পার হয়ে গেছে। আরো জানতে পারলাম ফেডারেশান-গঠনের ইতিহাস। জানতে পারলাম তার প্রথম এবং প্রধান-লক্ষ্য গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা। তো কী সেই আদর্শ যা সমুন্নত রাখার জন্য রীতিমতো সংগ্রাম করতে হবে! থিয়েটার তো শিল্পমাধ্যম এবং সবচাইতে বলিষ্ঠ শিল্পমাধ্যম, যার সাথে মানুষের সরাসরি সম্পর্ক। সেখানে লক্ষ্য হওয়ার কথা শিল্পের উৎকর্ষ-সাধন, শিল্পের নানারকম গবেষণা। কিন্তু তা তো নেই। আছে সংগ্রাম সমুন্নত রাখার কথা। কী সেই সংগ্রাম? আমার তো প্রায় ২২ বছর দেখা হলো এই অঙ্গন, আমাকে কেউ কোনোদিন বলে নি তো থিয়েটারের-আদর্শ ব্যাপারটা কী। আমার দলে যেসব কর্মশালা হয়েছে তাতে অনেকটা জেনেছি বটে, কিন্তু সে তো আমার দলীয় জায়গা থেকে বলা। যেহেতু ফেডারেশান একটা সমন্বিত-আদর্শের কথা বলে, তারা কি কোনোদিন এদেশের নাট্যকর্মীকে কখনো এটা বলার তাগিদ অনুভব করেছে যে তারা কোন সংগ্রামের কথা বলছে? সে সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে? রাষ্ট্র, সরকার, প্রাতিষ্ঠানিকতা, মৌলবাদ, স্বৈরতন্ত্র, গোষ্ঠীতন্ত্র? নাকি এসব মিলেমিশে একরকম কিছু? কিন্তু এসব করতে গিয়ে যে শিল্পের ক্ষতি হবে, তার বেলা? শিল্প তো কেবল শিল্পেরই দাবি করে। সে দাবি মেটাবে কে? থিয়েটার করতে এসে আমি কি কেবল প্রতিবাদীই হবো? মানুষ হিসেবে সুন্দরের প্রতি আমার যে দায়বদ্ধতা, আমার থিয়েটার বা আমাদের ফেডারেশান কি সেই দায়বদ্ধতা মেটাচ্ছে বা মেটানোর কথা ভেবেছে কয়েকজন আপাত-বিচ্ছিন্ন মানুষ ছাড়া?
থিয়েটার নিজেই একটা আন্দোলন। আমরা যেহেতু পেশাদার থিয়েটার করি না, তাই আমাদের জন্য পুরো ব্যাপারটাই শুধুমাত্র ভালোলাগা এবং কিঞ্চিৎ-পরিমাণ আদর্শ দিয়ে গড়া একটা কিছু। যেহেতু আদর্শ ব্যাপারটা খুব গোলমেলে তাই কখনো কখনো সেটা সংগ্রামের নামে আসলে এক স্বার্থচক্রের জন্ম দেয়। এই চক্র কিছু নেতা এবং সংগঠনের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। তাদের নাম-অর্থ-যশ ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধাভোগী হয়। যদি শাসককুল তাদের নিকটজন হয়, তারা নেগোশিয়েটর হয়, সরকারি-আনুকূল্যে পদক পেয়ে যায়। তাই তাদের লক্ষ্য বদলে যেতে পারে। আর যাদের শ্রম, মেধা, সময়ের বিনিময়ে এই অর্জন, তাদের লক্ষ্য বদলায় না, তাই তারা হারিয়ে যায়, মুছে যায়।
এর কারণ, থিয়েটার যে শেষপর্যন্ত শিল্প, তা ভুলে যাওয়া। কিছুদিন আগে সৈয়দ জামিল আহমেদের নির্দেশনায় নাটকের দল ‘স্পর্ধা’-প্রযোজনা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখলাম। কী অসাধারণভাবে মানুষের কথা, রাজনীতি আর মুক্তির কথা বলা হলো? আর কতই-না অনিন্দ্য-সুন্দর-শিল্পের আবহে। আমরা কি কখনো এভাবে ভেবে দেখেছি যে, এভাবেও বলা যায়, এটাও আদর্শের জন্য সংগ্রাম? নাকি এর জন্য দরকার সেই বোধ যা স্লোগান-সর্বস্ব নয়, স্টান্টবাজি নয়, স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সত্যিকারের আদর্শ, সংগ্রাম? নিজের পেট-ভরার লক্ষ্যে তথাকথিত আদর্শের-বুলি কপচানো নয়।
থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের পেছনে যে মানুষগুলো ছিলেন তাদের অনেকেই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, অনেকে আবার পরোক্ষভাবে। তারা একটা বিপ্লবী-ধারণা থেকে এবং অনেকটা কলকাতার থিয়েটারচর্চা দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথমে গ্রুপ থিয়েটারচর্চা শুরু করেছিলেন এবং পরে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ গঠন করেছিলেন। সেই গঠন নিশ্চয়ই সময়ের দাবি ছিল এবং থিয়েটারের রাজনৈতিক-আদর্শের পরিপূরক ছিল। কিন্তু এর পরিসর ও ভাবনার বিকাশ-ঘটানোর জন্য যে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করা ছিল তাদের প্রাথমিক দায়িত্ব, সেটায় তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।
একজন সাধারণ নাট্যজন হিসেবে আমি যখন বর্তমান তরুণ-নেতৃত্বের দিকে তাকাই, তখন ভীষণ হতাশ হই। কারণ, এদের বেশিরভাগই কোনো যোগ্যতা রাখে না থিয়েটার ফেডারেশানের মতো একটা ক্রিয়েটিভ সংগঠনের নেতৃত্ব দেবার। এদের অনেকেই ঠিক কেন থিয়েটার করে এটাই আমাকে ভাবিয়ে তোলে। এদের অনেকের কোনো ক্রিয়েটিভ কাজ নেই মঞ্চে বা মঞ্চের বাইরে। এরা না কোনো যোগ্য অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক, না কোনো যোগ্য আলো-শব্দ-সেটপরিকল্পক, এমনকি না কোনো ভালো সংগঠক। যে মানুষগুলো এক সময় ফেডারেশান গঠন করেছিলেন, তাদের সাথে এই বর্তমান এবং কিছুকাল আগের নেতৃত্বের মানে ও মননে বিশাল পার্থক্য আমাদের থিয়েটারের দীনতাকেই প্রকাশ করে। অবশ্য এটা সর্বোতভাবে পুরো বাংলাদেশের সব কিছুর বেলায়ই প্রযোজ্য। গত শতাব্দীর সত্তর-আশি-নব্বই দশকের রাজনৈতিক এবং সামাজিক-নেতৃত্বের সাথে বর্তমান নেতৃত্বের যে পার্থক্য, সেই একই-চিত্র বহন করছে আমাদের থিয়েটার। কারণ, থিয়েটার বাংলাদেশ ও সমাজের বাইরের কিছু না। একসময় সবচেয়ে সৎ, সবচেয়ে মেধাবী মানুষটা রাজনীতি করত, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিত। এখন অসৎ, মেধাহীন, কপট, ধান্দাবাজ, গুন্ডামি-বদমায়েশি করা লোকটা রাজনীতিতে আসে (ব্যতিক্রমও আছে, তবে ব্যতিক্রম তো আর উদাহরণ হতে পারে না)।
ভাবছিলাম থিয়েটারের আদর্শ কী তা নিয়ে। থিয়েটার যেহেতু নিজেই একটা রাজনীতি, কাজেই তার ভাবনা ও প্রকাশ অবশ্যই রাজনৈতিক। কিন্তু সেই রাজনীতির সংজ্ঞাটা আসলে কী? সেটা কি প্রচলিত রাজনীতির মতোই, নাকি তার ভাষা ভিন্ন, প্রকাশ ভিন্ন? যা কিছু মানুষের পক্ষে, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শিল্পীত-প্রকাশের দুরন্ত সাহসই তো থিয়েটার। কিন্তু কেউ যদি মনে করে তা প্রকাশে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিপক্ষে যাওয়া হয়ে যায় এবং তা তার জন্য সমীচীন নয়, তবে তার কি আর নৈতিকভাবে থিয়েটার করা মানায়? অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, সামাজিক-অবক্ষয় অনেক বেশি মাত্রায় সক্রিয়। এগুলোর পেছনে যে শুধু সরকার দায়ী কেবল তা নয়। এসবের পেছনে একটা সামাজিক-দুষ্টচক্র ক্রিয়াশীল, ক্রিয়াশীল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি। কিন্তু এসব রুখে দেয়ার জন্য যে সাংস্কৃতিক-আন্দোলন গড়ে উঠবার কথা ছিল, তা কেন হয় নি? কোথায় আমাদের ব্যর্থতা? আমরা কি ধরেই নিয়েছি যে, এসবের প্রতিবাদ করা শেষপর্যন্ত সরকার-বিরোধীতায় গিয়ে ঠেকবে? কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রযন্ত্রের কেউ তো নিকট-অতীতে থিয়েটারের বিরুদ্ধে এমন কোনো অবস্থান নেয় নি, যাতে মনে হয়েছে তারা চান না মঞ্চে এই প্রতিবাদের ধ্বনি উচ্চারিত হোক। তাহলে বাধা কোথায়? কেন বাঘা বাঘা নাটককার, নির্দেশকের কাছ থেকে আসছে না সেই রকম নাটক, যা তারা গত আশির দশকে, নব্বইয়ের দশকে করেছিলেন। অথচ অমন নাটকের প্রতি সময়ের দাবি এখন সবচেয়ে বেশি। এটা কি কোনো মহলকে খুশি করার জন্য ‘সেলফ সেন্সরশিপ’, নাকি শুকিয়ে গেছে সব সৃষ্টিশীলতা? কিন্তু আবার কেউ কেউ তো করছে। যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ, তাদের অনেকেই স্পর্ধিত-উচ্চারণে মঞ্চে ঝড় তুলছে। তারা অনেক বিদেশি নাটকের অনুবাদ-রূপান্তর মঞ্চে আনছে যা দেখলে মনে হয়, এই তো আমার দেশের এই সময়ের প্রতিচ্ছবি। তারা এই সময়ের সন্তান। ফেডারেশান তো এদের বাধা দিচ্ছে না, বরং সাধুবাদ জানাচ্ছে। বিদ্বজ্জনেরাও বাহ্বা দিচ্ছে। কিন্তু নিজেরা ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছেন খোলসে, মুখোশের আড়ালে। কেন?
অনেকে জবাবদিহিতার কথাও বলেন। অবশ্যই জবাবদিহিতা একটা সভ্য-সমাজের পরিচয়। কিন্তু যেখানে গত পঞ্চাশ বছরে এদেশে জবাবদিহিতার-সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি কোথাও, তাই থিয়েটার তথা সাংস্কৃতিক-অঙ্গনে সেটা আশা করাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। আমরা এসবের বাইরে নই। তাছাড়া জবাবদিহিতা কার কাছে? আমরা চাই অন্যেরা জবাবদিহি করবে, আমি ছাড়া। কারণ, একমাত্র আমিই সৎ। আমরা প্রত্যেকেই এই জবাবদিহি-বিহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মাতা এবং সুবিধাভোগী। এখানে রহিম দুর্নীতি করলে যদি ভাগ পায় করিম, তবে তার পক্ষে দাঁড়ায়। আবার করিম অসৎ কিছু করলে রহিম তার পক্ষ নেয় সুবিধা পেলে। আবার এই দুজনই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে যায় যদি কোথাও হালুয়া-রুটির হিসাবে গড়মিল দেখা দেয়। এখানে ঠগ বাছতে গা উজাড় হয়ে যাবে। কাজেই জবাবদিহিতা নেই এবং হবে না ধরেই আমি পরে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেবো।
এবার ‘সামনের দিন’ নিয়ে একটু ভাবনা শেয়ার করি। বলা হয় আগামীকে সবার আগে অনুভব করতে পারে সৃজনশীল মানুষ, শিল্পী। একজন শিল্পী যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়। মানুষকে দেখাতে পারে কী হতে যাচ্ছে সামনে। কোথায় মুক্তির মন্ত্র। আমি সৃষ্টিশীল মানুষ নই। কিন্তু থিয়েটারের একজন অবজারভার হিসেবেও আমি চাই আমাদের থিয়েটার আগামীকে দেখতে পাক, দেখাক তার শিল্পকর্মে। কিন্তু সবচেয়ে জীবন্ত শিল্প-মাধ্যম থিয়েটার কি অনুভব করতে পারছে আগামীর বাংলাদেশের ছবি? চারিদিকে মৌলবাদীদের উল্লম্ফন, সাম্প্রদায়িকতার ভয়াবহ উত্থান, নষ্ট মানুষের অধিকারে সব চলে যাওয়ার অশনি সংকেত কি থিয়েটার স্পষ্ট-উচ্চারণে প্রকাশ করছে এখন, এই মুহূর্তে? যদি না করে থাকে তবে আর কখন করবে? সব শেষ হয়ে গেলে? তখন তো আর থিয়েটার না-ও থাকতে পারে। আমরা কি সেই চূড়ান্ত সময়ের অপেক্ষায় আছি তাহলে? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সারা বাংলাদেশে যেভাবে সংস্কৃতিচর্চা ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে, তারই ধারাবাহিকতায় থিয়েটারও থাকবে না। এখনই ঢাকা শহরে এক শিল্পকলা একাডেমিকে ঘিরে কয়েকটা দল আর চট্টগ্রাম ও অন্যান্য জেলায় অল্পকিছু মানুষ ছাড়া কেউ থিয়েটার করছে না। ঢাকায় মাত্র পাঁচ হাজার দর্শক একটা নাটক দুই-তিন বছরে দেখে। জেলাশহরে তো আরো কম। জেলাশহরে হঠাৎ কালেভদ্রে কিছু নাছোড়বান্দা ‘পাগল’ নাটক করে থাকে।
এর পেছনে শুধুই সাংগঠনিক-দুর্বলতাই দায়ী নয়। আসল সত্যটা হচ্ছে এদেশে ক্রমাগত মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার উর্বর-ভূমি হয়ে যাচ্ছে। এখানে গান, নৃত্য থেকে শুরু করে শিল্পের সব শাখা, সামান্যকিছু শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত ছাড়া বাকিদের কাছে চরম ধর্মবিরোধী বলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ঘরে ঘরে এই বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে যে, এসব করলে পরকাল বলে কিছু থাকবে না। আগে মফস্বলশহরের বা গ্রামে যেভাবে শিশু-কিশোরকে সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে দেখা যেত, এখন তার এক শতাংশও নেই। এসব (শিল্প-সংস্কৃতিচর্চা) করা খারাপ, এই কথা বলা হচ্ছে খোদ পরিবার থেকে এবং স্কুল থেকে। এই কিশোররা দিনদিন অপরাধে জড়াচ্ছে এবং এদের মগজ দখল করে নিচ্ছে মৌলবাদীচিন্তা। বিপরীতে সরকার উদাসীন! কারণ, একটা বুর্জোয়া সমাজ-ব্যবস্থায় এবং পুঁজিবাদী-রাষ্ট্রে সমাজ বদলের নয় বরং বদলে যাওয়া সমাজের সাথে মিল রেখে নিজের দর্শন এবং লক্ষ্য বদলে নেয়ার রাজনীতি শেখানো হয়। কাজেই যখন একটা রাজনৈতিক দল দেখবে যে, দেশে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাই ভবিষ্যৎ, তখন তার যদি প্রগতিশীল-অসাম্প্রদায়িক-রাজনীতির ইতিহাস থেকেও থাকে, সে টিকে থাকার স্বার্থেই নিজেকে বদলে নেবে। এটাই দেখছি আমরা প্রতিদিন। থিয়েটার বা সাংস্কৃতিক-নেতৃত্ব সরকারকে বোঝাতে পারে নি যে, এই অন্ধত্ব চলতে থাকলে, যদি সাংস্কৃতিকচর্চা না থাকে, তবে দেশ হয়ত থাকবে, তবে তা পাকিস্তানের মতো, যেখানেও কিনা থিয়েটারচর্চা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের নেতৃত্ব সরকারকে এসব বোঝাবার ঝুঁকিতেই যায় নি, কেননা, তাতে যদি কারো ‘পাওয়ায়’ কিছুটা কম পড়ে।
এদিকে আবার শোনা যাচ্ছে সর্ষের ভেতরেই নাকি ভূত লুকিয়ে আছে। যারা থিয়েটারের নেতা বনে বসে আছেন, তারা অনেকেই অর্থ-লোপাটের দায়ে তদন্তের মুখোমুখি। অবশ্য অনেকে এতে অবাক হলেও, কষ্ট পেলেও, আমি অবাক হই নি, কষ্টও পাই নি। কারণ, এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। এরা এই বর্তমান বাংলাদেশেরই মানুষ। চারিদিকে লুটপাটের যে মহোৎসব চলছে, তাতে তারাই-বা বাদ থাকবেন কেন? বরং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলাই তো আধুনিক মানুষের লক্ষণ। তাই তারা পিছিয়ে পড়তে রাজি নন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমি অবাক হবো না। বরং তাদের বাহ্বা দেবো এই জন্য যে, তারা সুযোগের হাতছাড়া করেন নি।
যাক, এবার তাহলে শেষ-কথায় আসি।
কেমন হবে আমাদের আগামীর থিয়েটার? আমি গৌড়চন্দ্রিকা আর বাড়াব না। উপরের আলোচনাকে প্রেক্ষিত ধরে আমার ভাবনা এবং দাবি এরকম:
১. আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বলিষ্ঠ হতে হবে, ‘আদর্শ’ সমুন্নত রাখার আন্দোলন। এখানে আদর্শ হবে একটাই, আর তা হলো কেবল মানুষ আর তার জাগরণ। এখানে যেকোনো আপোষ ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রশ্নবিদ্ধ করে দেবে।
২. সারাদেশে যেভাবে সাংস্কৃতিক-কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে জায়গা পেয়ে যাচ্ছে মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা, তাকে রুখে দেবার জন্য ছড়িয়ে দিতে হবে থিয়েটার। জেলাশহরে প্রতি বছর থিয়েটার-কর্মশালা, থিয়েটার-উৎসব করতে হবে। আগামী কয়েকবছর ঢাকায় কোনো উৎসব হবে না। সবগুলো হবে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে।
৩. স্কুল এবং কলেজভিত্তিক নাট্যনির্মাণ-প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। প্রত্যেকটা জেলার এই প্রতিযোগিতাশেষে প্রথম দশটা নাটক নিয়ে উৎসব হবে ঢাকায়। তাদের জাতীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হবে।
৪. সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কিংবা শিল্পকলা একাডেমিতে নিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট কোনো কমিটি বা জোটের নেতৃত্বে আসতে পারবে না।
৫. প্রতি বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে নতুন নাটককার আর নির্দেশক তৈরি করার জন্য উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে হবে। এখানে সারাদেশ থেকে বাছাই-করা দশটা মৌলিক-নাটক নিয়ে তরুণ ও প্রতিশ্রুতিশীল নির্দেশককে দিয়ে সেগুলো মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তাদের পুরস্কৃত করতে হবে।
৬. বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মূলহল (তথাকথিত জাতীয় নাট্যশালার কথা বলছি) শুধুমাত্র নতুন নাটকের জন্য বরাদ্দ দেয়া হবে এবং তা হবে টানা দশ দিনের জন্য। সেই নাটক সে বছর আর মূলহল বরাদ্দ পাবে না। বছরের বাকি সময়ে অন্য হলগুলো (এক্সপেরিমেন্টাল, স্টুডিও, মহিলা সমিতি) এবং ঢাকা শহরের নানা জায়গায় এবং সমগ্র বাংলাদেশে সেই নাটকের মঞ্চায়ন করবে। জেলাশহরে মঞ্চায়নের সময় জেলা শিল্পকলা একাডেমি সার্বিক সহযোগিতা করবে।
৭. ঢাকার মেয়রদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন মঞ্চের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটি ও ক্লাবের সাথে কথা বলে তাদের ওখানে গিয়ে ঐ মঞ্চোপযোগী নাটক দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সময় এবং যানজটের কারণে তারা অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শিল্পকলা একাডেমি বা মহিলা সমিতির মঞ্চে নাটক দেখতে পারেন না।
৮. প্রতি বছর মৌলিক-নাটকের সংকলন প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। বই মেলায় তা প্রকাশের উদ্যোগ নিতে হবে।
৯. পেশাদারি থিয়েটারের অলীক-স্বপ্ন না দেখে (বাংলাদেশে পেশাদারি থিয়েটার সম্ভব নয়), নাটকের দলগুলোকে আর্থিক-সহযোগিতার পরিমাণ বাড়াতে হবে। এটাতে অগ্রাধিকার দেয়া হবে তাদের, যারা গত বছর সবচেয়ে শিল্পমান-সম্পন্ন নাটক করেছে এবং তার বহুল-প্রদর্শনী করে মঞ্চে দর্শক আনতে পেরেছে।
১০. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে থিয়েটারবিষয়ক সংলাপের (ডায়লগ) ব্যবস্থা করবে। সেখানে থিয়েটারকর্মীরা তাদের ভাবনার প্রকাশ ঘটাবে এবং তা কীভাবে তাদের সৃষ্টিশীলতায় প্রয়োগ করা যায়, তা নিয়ে পারস্পরিক মতবিনিময় করবে।
সবশেষে এই মুহূর্তের একটা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতে চাই।
যেহেতু বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃত্বের বিষয়ে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে, তাই আগামী কয়েকবছর কোনো নির্বাচন না করে, বর্তমান ফেডারেশানকে ভেঙে দিতে হবে।
কারণ, এই তথাকথিত নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া ফেডারেশান সুযোগ করে দিয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর হালুয়া-রুটির ভাগ নিয়ে কামড়া-কামড়ির। আরো সুযোগ করে দিয়েছে, তাদের নেতাগিরি আর দাদাগিরি করার, যাদের অনেকের থিয়েটার করারই কোনো যোগ্যতা নেই। থিয়েটারে যারা সৃষ্টিশীল অগ্রজ-নাট্যজন তাদের নিয়ে ১০/১৫ সদস্য-বিশিষ্ট কমিটি করা হবে। তারাই হবে ফেডারেশান। তাদের কাজ হবে সরকার এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করে সারাদেশে কীভাবে থিয়েটার ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও লজিস্টিক সাপোর্টের ব্যবস্থা করা যায় তার পদক্ষেপ নেয়া।
উপরে উল্লেখিত দশটা দাবি তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা হবে।
আমি আগেই বলেছি, একজন সামান্য মানুষ হিসেবে আমার উপলব্ধি প্রকাশ করা এবং বন্ধুত্বের দাবি মেটাতেই এই লেখা। প্রত্যেকের প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং সম্মান আছে এবং থাকবে। শুধু একটাই আকাঙ্ক্ষা থেকে কথাগুলো বলা, ‘যদি বদলাতে চাই চারপাশ, সবার আগে চলো নিজেরাই বদলাই’। অবশ্য কোনদিকে বদলাবেন, সেটা আপনার স্বাধীনতা।
ধন্যবাদ সবাইকে।
রাজীব দে ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): মঞ্চশিল্পী