Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন : একটি প্রবন্ধ পর্যালোচনা ও ব্যক্তিগত অভিমত

Written by সাইদুর রহমান লিপন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

সার-সংক্ষেপ

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন: একটি প্রবন্ধ পর্যালোচনা ও ব্যক্তিগত অভিমত শিরোনামে বক্ষ্যমাণ রচনায় সমাদৃত নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’র সম্পাদক এবং থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র অধিকারী হাসান শাহরিয়ারের ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ শীর্ষক প্রবন্ধের পর্যালোচনা এবং তৎপরবর্তী কিছু মতামত তুলে ধরার প্রয়াস রয়েছে। প্রক্রিয়া অনুসারে, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন শিরোনামে শাহরিয়ারের প্রস্তাবিত প্রবন্ধের (এটি থিয়েটারওয়ালা পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশিত) পাঠ ও পর্যালোচনামূলক একটি অনুষ্ঠানে কিছু নাট্য-বন্ধুদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে প্রবন্ধটির পাঠ ও পর্যালোচনায় যা কিছু মত-দ্বিমত প্রদান করা হয়, এই রচনাটি তার ভিত্তিতেই বিন্যাস করা হয়েছে।

রচনাটির প্রসঙ্গ এবং প্রাসঙ্গিকতা অনুসরণ করার সুবিধার্থে শাহরিয়ারের প্রবন্ধটিকে নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয়-বৈচিত্র্যে পর্যালোচনা করা হয়েছে। যেমন: ১. প্রবন্ধের প্রেক্ষিত-নির্ধারণ এবং দেশজনাট্য ও শহুরেনাট্যচর্চার মীমাংসা, ২. ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক-নাট্যচর্চার নানা প্রসঙ্গ এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের প্রাসঙ্গিকতা, ৩. সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ানে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ, ৪. গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী চরিত্রে’র ধ্বংস প্রসঙ্গ, ৫. গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভবিষৎ ভাবনা এবং টিকে থাকার লড়াই ও ‘সামনের দিনে’ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য পথ-নির্ধারণে ৪টি দাওয়াই’য়ের প্রস্তাবনা। পরিশেষে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বর্তমান প্রেক্ষিত-বিবেচনায় কতিপয় অভিমত ব্যক্ত করা হয়।

একনজরে দেখা শাহরিয়ারের প্রবন্ধ:
‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ শিরোনামে হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধ রচনার প্রেক্ষাপট সুনির্দিষ্ট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে সৃষ্ট বর্তমান-সংকট শীর্ষক প্রকাশিত একটি ‘সংবাদ’ (যদিও প্রবন্ধে সংবাদটির উৎস উল্লেখ করা হয় নি)। প্রবন্ধে সংবাদটি উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে: “[কিন্তু] সর্বশেষ একটি সংবাদ প্রায় সবাইকে বেশ নড়েচড়ে বসতে তাড়িত করেছে। আর্থিক-দুর্নীতির ‘অজুহাত’ দেখিয়ে (অজুহাত বলছি এ কারণে যে তদন্ত-কমিটি গঠন করে এর সত্যতা প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা-পর্যন্ত ফেডারেশান এখনও নেয় নি) নির্বাহী পরিষদের দুজন সদস্যকে পদচ্যুত করা হয়েছে।” ঢাকাসহ সারাদেশের নাট্যাঙ্গনে তোলপাড় করা এই সংবাদ এবং সংগঠনের অভ্যন্তরে সৃষ্ট সংকটের কারণ অনুসন্ধান এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায় বা করণীয়-পদক্ষেপ অন্বেষণে ব্রতী হয়ে শাহরিয়ার রচনা করেন এই প্রবন্ধ।
 
প্রবন্ধটির সূচনাতে লেখক বুঝে নিতে চেয়েছেন, গ্রুপ থিয়েটারচর্চা এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কের আদ্যোপান্ত, এদের অতীত, আর পরবর্তীসময়ে টিকে থাকার লড়াই। এজন্য লেখক মূলপ্রসঙ্গ আলোচনার পূর্বে বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চা, সৌখিন নাট্যচর্চা, জেলা/মহাকুমা-শহরের মঞ্চনাট্যচর্চা, ঢাকা শহরের মঞ্চনাট্যচর্চা, দেশজ বা লোকনাট্যচর্চা, আধুনিক নাট্যচর্চা প্রভৃতি নাট্যচর্চার সংজ্ঞা, সম্পর্ক, বৈশিষ্ট্য আলোচনার মাধ্যমে এদের পারস্পরিক মিল-অমিল, সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের মীমাংসা করে নিতে সচেষ্ট হন। আর মীমাংসায় এসে তিনি মোদ্দাকথা এটিই বলতে চাইলেন যে, সকল ভিন্নতা ও বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও “এ সবগুলোই আধুনিক-থিয়েটার তথা শহুরে-মঞ্চনাট্য, অর্থাৎ, ‘থিয়েটারচর্চা’।”     
 
আলোচনায় এরপর তিনি মূলপ্রসঙ্গের অবতারণা করেন এবং এর ভূমিকা হিসেবে বাংলাদেশের নাট্যচর্চার, বিশেষত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার ইতিহাস, ধারাবাহিকতা, ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। স্বাধীনতার আগে ও পরের নাট্যচর্চা, গ্রুপ থিয়েটারচর্চার নানাবিধ তথ্য ও ঘটনাবহুল উদ্যোগ, চর্চা, পদক্ষেপ তুলে এনে শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার ইতিহাস এবং এর ধারাবাহিকতার এক দীর্ঘ আলোচনার আবতারণা করেন এই অংশে। সময়ের ব্যাপ্তিতে যা তিনি ১৯৫৬ সালে মীর মকসুদ-উস-সালেহীন এবং বজলুল করিমের প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ‘ড্রামা সার্কেল’ থেকে শুরু করে ১৯৮১ সালের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের আগ-পর্যন্ত শহরকেন্দ্রিক নাটক ও নাট্যের উল্লেখযোগ্য প্রায় সকল একক এবং দলগত উদ্যোগ এবং চর্চাগুলো হাজির করেন।

গ্রুপ থিয়েটারে সাংগঠনিক-কাঠামোর বিস্তার ও চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে লেখক শাহরিয়ার অতঃপর গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের যুক্তি ও প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে গঠনতন্ত্রে নির্ধারিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য (নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে) পর্যালোচনা করেন। এই অংশের আলোচনায় তিনি ১১টি লক্ষ্য উদ্দেশ্য’র প্রতিটি এককের গুরুত্ব ও তাৎপর্য-বিবেচনায় ফেডারেশান কর্তৃক গৃহীত নানাবিধ উদ্যোগ, পদক্ষেপ এবং কর্মসূচী বাস্তবায়নের সফলতা ও ব্যর্থতার এক লম্বা খতিয়ান তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য:
১. গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা, ২. নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্ন সময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা, ৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ৪. নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা, ৫. নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা, ৬. নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা, ৭. বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা, ৮. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা, ৯. দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, ১০. মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, এবং ১১. পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।

মূলত এটিই সম্পাদক শাহারিয়ারের প্রবন্ধ আলোচনার কেন্দ্রীয় অংশ। এই অংশের আলোচনায় সংগঠনটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং সামর্থ্য ও সক্ষমতার নিরিখে তিনি দেখাতে চাইলেন যে, সংগঠনটি তার গঠনকাল থেকে এ-পর্যন্ত যা কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কিছু কিছু ক্ষেত্র ব্যতীত অধিকাংশই নির্ধারিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে হয়েছে ব্যর্থ। তিনি বলতে চাইলেন সংগঠনটি ক্রমান্বয়ে থিয়েটারের উন্নয়ন ও বিকাশের সহযোগী শক্তি থেকে সরে গিয়ে ব্যক্তি-পর্যায়ে ক্ষমতাচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি স্পষ্ট মন্তব্য করেন, “যেহেতু ফেডারেশানের কর্তাব্যক্তি হলে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কোনো কাজ করতে হয় না, বিপরীতে সারাদেশে ‘নেতা’ হিসেবে একটি পরিচিতি পাওয়া যায়, সেজন্য তখন থেকে শুরু হলো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কর্তা-ব্যক্তি-হওয়ার ‘নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’।” নেতৃত্ব গ্রহণের ‘নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’ এবং গ্রুপ থিয়েটারের উন্নয়নে কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণে ধারাবাহিক ব্যর্থতার অনিবার্য ফলস্বরূপ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তার ‘সংগ্রামী চরিত্র’ হারিয়ে ফেলে। তবে সংগঠনটির ‘সংগ্রামী-চরিত্র নষ্ট’ হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একটি সিদ্ধান্তকে, এক ব্যক্তির ফেডারেশানের সভাপতি এবং শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদে অধিষ্ঠিত হওয়াকে মূল এবং গুরুতর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
 
গৃহীত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ‘আগামী দিনে’র জন্য কী কী করণীয় হতে পারে এমন ভাবনায় তিনি ‘সহযোগিতা’-মূলক চারটি (৪) লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বা পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেছেন। এবং এর ব্যাখ্যা প্রদানের মধ্যদিয়ে লেখক তার দীর্ঘ প্রবন্ধ আলোচনার শেষপর্যায়ে চলে আসেন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র বর্তমান-সক্ষমতা এবং সামর্থ্য-বিবেচনায় গৃহীত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসে ন্যূনতম চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার বর্তমান সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে শাহরিয়ার তার দীর্ঘ আলোচনার প্রায়-উপসংহার রচনা করেন।  

পর্যালোচনা

প্রবন্ধের প্রেক্ষিত-নির্ধারণ এবং দেশজনাট্য ও শহুরেনাট্যচর্চার মীমাংসা:
প্রবন্ধকারের বক্ষ্যমাণ রচনার প্রেক্ষিত স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট, ফেডারেশানের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং দুজন সাংগঠনিক কর্তাব্যক্তির পদচ্যুত হওয়া। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য হলো-
আর্থিক-দুর্নীতির ‘অজুহাত’ দেখিয়ে (অজুহাত বলছি এ কারণে যে, তদন্ত-কমিটি গঠন করে এর সত্যতা প্রমাণ করার কোনো চেষ্টা-পর্যন্ত ফেডারেশান এখনও নেয় নি) নির্বাহী পরিষদের দুজন সদস্যকে পদচ্যুত করা হয়েছে। অথচ সেই দুজন স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে, তারা অশালীন-অন্যায়ের স্বীকার, যা তাদের থিয়েটার-জীবন তো বটেই, স্বাভাবিক পারিবারিক ও সামাজিক-জীবনকেও অসম্মানজনক-পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এবং, এই ভিকটিমরাই চাচ্ছে স্বচ্ছ-তদন্ত। একবার দু-বার না, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বারবার তারা এর স্বচ্ছ-তদন্ত চেয়ে চলেছে। অথচ, এ ব্যাপারে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে না।

প্রবন্ধ-রচনার যুক্তি ও প্রেক্ষিত-নির্ধারণে উপরের উদ্ধৃতিটি প্রবন্ধকারের অবস্থান স্পষ্ট করে ঠিক কিন্তু তা পক্ষপাতমূলক, যা এই রচনার উদ্দেশ্য এবং এর ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ‘অজুহাত’ শব্দটির ব্যবহার এবং এর ব্যাখ্যায় যেমনটি বলা হয়েছে (উদ্ধৃতি দেখুন) তা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় লেখকের দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানকে একতরফা এবং পক্ষ-অবলম্বনের দায়ে দোষী করে তুলতে পারে। কারণ, বিদ্যমান-সমস্যা বা সংকট চিহ্নিত করতে ‘অপর পক্ষ’ অর্থাৎ ‘যারা’ নির্বাহী পরিষদের দুজন সদস্যকে পদচ্যুত করেছে, তাদের যুক্তি হাজির করা হয় নি। তাই এই প্রবন্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং এর যৌক্তিকতা সর্ব-গ্রহণযোগ্য হতে হলে অপর পক্ষ, যারা ‘আর্থিক-দুর্নীতি’র কথা বলছেন তাদের বক্তব্যও (উক্তি/উদ্ধৃতি) হাজির করা প্রয়োজন। তাই গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের চলমান-সংকটের সমাধানে বুদ্ধিবৃত্তিক-তৎপরতা এগিয়ে নিতে হলে প্রবন্ধকারের নিরপেক্ষ, নির্লিপ্ত এবং আস্থাযোগ্য-অবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করি।
 
প্রবন্ধের সূচনা-কথায় তিনি তার রচনার লক্ষ্য স্থির করে বললেন, “বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ কেমন হতে-পারে তার একটি হদিস মেলানোর চেষ্টা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।” আর এ লক্ষ্যে তিনি গ্রুপ থিয়েটারচর্চা, দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা, নিয়মিত নাট্যচর্চা প্রভৃতি প্রাসঙ্গিক-আলোচনার অবতারণা করেন। তবে সম্পাদক এই প্রসঙ্গ আলোচনার শুরুতেই থিয়েটার, মঞ্চনাট্যচর্চা, দেশজনাট্য, লোকনাট্যচর্চা, আধুনিক নাট্যচর্চা প্রভৃতি নাট্যচর্চার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান সংকট-মোকাবিলায় এই আলোচনা কতটা প্রাসঙ্গিক বা আদৌ প্রাসঙ্গিক কিনা অথবা থিয়েটারচর্চায় আগামীর দিশা অন্বেষণের ক্ষেত্রে এই আলোচনা কীভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে সে বিষয়ে তিনি কোনো সুস্পষ্ট মন্তব্য করেন নি। সে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে মূলবিষয়ের সাথে এই প্রসঙ্গটির প্রত্যক্ষ এবং যৌক্তিক সম্পর্ক নির্দেশ না করা গেলে প্রস্তাবিত আলোচনা থেকে এই অংশটিকে বাদ দেয়া যেতে পারে।
 
ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক-নাট্যচর্চার নানা প্রসঙ্গ এবং গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের প্রাসঙ্গিকতা:
আলোচনার ধারাবাহিকতায় শাহরিয়ার এ পর্যায়ে তার পাঠককে শহরকেন্দ্রিক আধুনিক-নাট্যচর্চার ইতিহাসে ভ্রমণ করিয়েছেন। তিনি এই দীর্ঘ পরিভ্রমণে শহরকেন্দ্রিক-থিয়েটারের ধারাবাহিকচর্চা ও বিকাশের নানাবিধ প্রসঙ্গ এবং তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। ১৯৫৬ সালে গঠিত ‘ড্রামা সার্কেল’ থেকে শুরু করে সৌখিন-নাট্যচর্চা, বিশ্ববিদ্যালয়-কেন্দ্রিক নাট্যচর্চা এবং নাট্যোৎসব, একাত্তর-পরবর্তী গ্রুপ থিয়েটারচর্চার সূচনা, দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যপ্রদর্শনী, গ্রুপ থিয়েটারচর্চার সাংগঠনিক-চ্যালেঞ্জ প্রভৃতি প্রসঙ্গ তুলে আনেন। ইতিহাসনির্ভর এই আলোচনায় স্বাধীনতা-পূর্ব এবং পরবর্তীসময়ের, বিশেষকরে ১৯৮১ সালে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠন-পূর্ব নাট্যচর্চা, এই দুটি পর্বে বিন্যস্ত করে কার্যত তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনের প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী শহরায়তনিক-নাটচর্চায় সৃষ্ট বেশকিছু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক-প্রতিবন্ধকতা এবং বিধি-বিধানগত জটিলতা উল্লেখ করে লেখক এ অংশের আলোচনার উপসংহার টানলেন এই বলে যে, ‘থিয়েটারচর্চার ব্যাপারে এসব নানান প্রতিকূলতা থেকে মুক্তি পাওয়ার লক্ষ্যেই হয়তবা দেশের সব-নাট্যদলগুলোকে নিয়ে একটি ফেডারেশান গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়।’
 
শাহরিয়ারের এই অংশের আলোচনা থেকে ফেডারেশান গঠন-প্রাক্কালের কিছু প্রতিকূল পরিস্থিতি জানা গেল বটে, তবে এর পেছনে আদর্শিক এবং সাংগঠনিক-চিন্তার সংশ্লিষ্টতা কিরূপ ছিল তা জানা যায় না। তাছাড়া এই আলোচনা অংশে ‘হয়তবা’ শব্দের ব্যবহার ফেডারেশান গঠনের প্রাথমিক ও মৌলচিন্তাকে অনেকটাই ধারণা-প্রসূত করে তোলে। এবং এর সাংগঠনিক-প্রাসঙ্গিকতাকেও দুর্বল করে দেয়। এই ক্ষেত্রে ফেডারেশানের গঠন-প্রাক্কালে সক্রিয় এবং সংশ্লিষ্ট নাট্যব্যক্তিদের কথা ও উদ্ধৃতি অথবা মুদ্রিত রেফারেন্স উল্লেখ করে ফেডারেশান গঠনকালের মৌলিক ও আদর্শিক চিন্তাগুলো হাজির করে এই আলোচনাকে আরো তথ্যবহুল, একই সাথে যৌক্তিক-কাঠামোকে আরো মজবুতভিত্তির উপর দাঁড় করানো প্রয়োজন বলে মনে করি। তবে শাহরিয়ার এই পর্বের আলোচনার মাধ্যমে নাট্যচর্চার ইতিহাসকে আরেকটি প্রাসঙ্গিক-দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন, আর সেটি হলো, এই দীর্ঘ চার দশকের শহরকেন্দ্রিক-নাট্যচর্চা কোনো প্রকার ফেডারেটিভ বডি বা সংগঠন গঠনের আকাঙ্ক্ষা বা প্রয়োজনীয়তা ছাড়াই বিদ্যমান সমাজ-সংস্কৃতির প্রয়োজনে সংকটে-সংগ্রামে-গুরুত্বে-গৌরবে সাড়া দিয়েছিল, বিকশিত হওয়ার নিজ নিজ উপায় খুঁজে নিয়েছিল।  

সফলতা-ব্যর্থতার খতিয়ানে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন প্রসঙ্গ:
আলোচনার ধারাবাহিকতায় এই পর্যায়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত এবং সর্বশেষ সংশোধিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে গৃহীত পদক্ষেপ, কর্মসূচি এবং কার্যক্রমসমূহ পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রবন্ধে ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিচার করে ফেডারেশান-কর্তৃক বাস্তবায়নযোগ্য ‘প্রধান লক্ষ্য-উদ্দেশ্য’ এবং ‘একক নাট্যদল বা ব্যক্তি-কর্তৃক বাস্তবায়ন-যোগ্য’ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, এই দুটি স্তরে আলোচনার বিস্তার করা হয়। এই আলোচনায় সম্পাদক শাহরিয়ার এটিই স্পষ্ট করে বোঝাতে চাইলেন যে, দু-একটি দৃষ্টান্ত ব্যতীত গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তার গঠনকাল থেকে অদ্যাবধি থিয়েটারচর্চার বিস্তার ও বিকাশে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো কর্মসূচি/উদ্যোগ/কার্যক্রম গ্রহণে সক্ষম হয় নি। ফলে গঠনতন্ত্রে গৃহীত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে ধারাবাহিকভাবে হয়েছে ব্যর্থ। এই প্রসঙ্গে লেখকের নিম্নোক্ত মন্তব্যে ফেডারেশানের গৃহীত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের যে চিত্র ফুটে ওঠে তা নিঃসন্দেহে হতাশাজনক-    
গত শতাব্দীর নব্বই দশকে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নির্বাহী পরিষদের কার্যক্রম ও ‘নাটকীয় ঢং (attitude)-এর দিকে খেয়াল করলে দেখতে পাব, যেসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে ফেডারেশান গঠিত হয়েছিল, তার ‘প্রধান-উদ্দেশ্য’গুলো থেকে দূরে সরে গিয়ে, কেবল যা যা করলে পুরোদেশের নাট্য-দলগুলোর উপর কর্তৃত্ব করা যায়, সে সব কাজে তারা বেশি মনোযোগী ছিল। যেমন, (লক্ষ্য-উদ্দেশ্য) ৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, ৯. দেশে একটি থিয়েটার ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা, ১০. মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, ১১. পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা ইত্যাদির প্রতি চরম-অবহেলা দেখিয়ে নিজেদের কেবল ‘হলবরাদ্দের মালিক’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। যদিও ভাবনা-চিন্তা-অর্থহীন প্রতারণামূলক-স্লোগান ‘আমাদের মঞ্চ আমরা গড়ব’ বলে যে ‘হাস্যকর নাটক’ কয়েক বছর করেছে, এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
 
লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-৩ (সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা) প্রসঙ্গে বলা হলো যে, ‘কোনো ধরনের কর্মসূচি ঐ সময়কালে নেয়া হয় নি।’ আবার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-১০ (মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া) বাস্তবায়নে যা কিছু সাফল্য এসেছে তা ‘উদ্যোগী কিছু শিক্ষক’ এবং কয়েকটি ‘নাট্যদলের নিজস্ব প্রচেষ্টায়’ যথাক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে নাট্যশিক্ষা এবং নাট্যবিষয়ক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সাফল্যের পেছনেও ফেডারেশানের কোনো প্রত্যক্ষ-ভূমিকা ছিল না বলেও সোজাসাপটা বলে দিলেন।

ব্যর্থতার দীর্ঘ-খতিয়ান সত্ত্বেও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র সুদীর্ঘ-সাংগঠনিক-কার্যক্রমে কিছু অর্জন তো রয়েছেই, বিশেষকরে সামরিক শাসন ও শোষণের বিরূদ্ধে শহরকেন্দ্রিক-নাট্যচর্চার দৃঢ় অবস্থান বাংলাদেশের নাট্যইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত। এর ফলে সামাজিক-জীবনে নাট্যকলারচর্চা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতে সক্ষম হয়। তবে এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ারের স্পষ্ট অবস্থান হলো, “বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ গঠনের ১২/১৫ বছর-পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঢেউয়ের অনকূলে পাল-তুলে থিয়েটারচর্চা এগিয়ে গেছে, লক্ষ্য-অর্জনে ফেডারেশানের তেমন কোনো অগ্রসর-চিন্তার উপস্থিতি ছিল না।” তিনি এই সর্বাত্মক-ব্যর্থতার মূলে ‘নেতা হওয়ার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’য় লিপ্ত হওয়ার দুর্বল সাংগঠনিক-কাঠামো আর সামর্থ্যহীনতাকেই দায়ী করেন।
 
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সমকালীন কার্যক্রম-নিরিখে উদ্ধৃত মন্তব্য ও মতামতগুলোকে অস্বীকার করার বিশেষ কোনো কারণ নেই। তবে মত ও মন্তব্য-প্রদানের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া-বিবেচনা করলে শাহরিয়ারের এই সকল বক্তব্য নিতান্তই ব্যক্তিগত ভাব-আবেগ দ্বারা তাড়িত, বিচারমূলক, বহুপক্ষীয় যুক্তি ও প্রামাণিক তথ্য দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। কেননা, ‘এ যাবৎ কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করে নি’, ’অগ্রসরচিন্তার উপস্থিতি ছিল না’, ’নেতা হওয়ার নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’, এ জাতীয় ক্ষুরধার মন্তব্যের সমর্থনে যে বহুমুখী ও প্রামাণিক তথ্য থাকা প্রয়োজন তা এই প্রবন্ধে অনুপস্থিত। আমার ধারণামতে (যেহেতু আমি ফেডারেশানে’র কোনো-পর্যায়ের কমিটির সদস্য নই) ফেডারেশানে’র প্রতিটি সম্মেলনে আগত কাউন্সিলরদের সম্মুখে বিগত বছরের সম্পাদিত যাবতীয় কর্মসূচী/উদ্যোগ/পদক্ষেপ/পরিকল্পনা ইত্যাদির সফলতা-ব্যর্থতাসম্বলিত একটি বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করা হয় বা করার কথা। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র এ যাবৎ যতগুলো সম্মেলন-প্রতিবেদন প্রকাশিত/উপস্থাপিত হয়েছে, সেখানে গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে কী কী ভাবে কর্মসূচী আকারে গ্রহণ করা হয়েছে বা হয় নি, অথবা এই ১১টির বাইরেও যে সকল উদ্যোগ/কর্মসূচির সফলতা বা ব্যর্থতার কথা নানাজনে নানাভাবে লিপিবদ্ধ করেছে, পেপার-পত্রিকা, জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে সে সব দৃষ্টান্ত তুলে এনে এবং সংশ্লিষ্ট-ব্যক্তিদের (বিভিন্ন সময়ের নির্বাচিত কমিটির সদস্য) বক্তব্য হাজির করে উল্লেখিত মন্তব্যগুলোকে বহুমাত্রিক তথ্যসূত্রে প্রমাণ করা প্রয়োজন।
 
শাহরিয়ারের প্রবন্ধে উল্লেখ রয়েছে এরকম আরো বেশকিছু মত ও মন্তব্যের প্রায় অধিকাংশের সাথেই আমি ব্যক্তিগত ভাবে একমত। তবে, যেহেতু গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বিদ্যমান-সংকট-চিহ্নিতকরণ এবং সমাধানের উপায় অন্বেষণের এটি একটি আনুষ্ঠানিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগ, তাই ব্যক্তিগত মত ও মন্তব্য-প্রকাশে বহুপক্ষীয় যুক্তি ও দৃষ্টান্তের দোহাই দিয়েই কেবল এই ধরনের ক্ষুরধার মন্তব্য গ্রহণযোগ্য এবং গঠনমূলক হতে পারে বলে মনে করি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই ধরনের একটি আনুষ্ঠানিক তথা বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় অতিমাত্রায় একপাক্ষিক এবং আবেগতাড়িত-মন্তব্য এই উদ্যোগের পক্ষ-বিপক্ষের বিদ্যমান-বিভাজনকে আরো উসকে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ খুঁজে পেতে যে সকল প্রস্তাবনা এই প্রবন্ধে পেশ করা হয়েছে, সেগুলোও নানাবিধ সন্দেহের চোখে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আমার অভিমত হচ্ছে এই যে, প্রবন্ধ-পাঠ ও পর্যালোচনাবিষয়ক এই আড্ডার উদ্দেশ্য যদি হয় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র বর্তমান-সংকটের গ্রহণযোগ্য এবং কার্যকর-সমাধান খুঁজে পাওয়াÑতবে এই প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের যুক্তিতর্ক হাজির করে একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণমূলক-অবস্থান নিশ্চিত করা-ই এ উদ্যোগের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। যেকোনো পর্যায়ের উত্তেজিত, আবেগতাড়িত-বাক্যের ব্যবহার বা মন্তব্য-প্রদান এই উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী চরিত্রে’র ধ্বংসাত্মক পর্ব-নিরূপণ:
শাহরিয়ারের প্রবন্ধ-আলোচনার এই অংশটি একই সাথে গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল। এই আলোচনায় তিনি গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানে’র ‘সংগ্রামী চরিত্র’ ধ্বংসের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। তিনি দেখালেন যে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের এই নুয়েপড়া নতজানু চেহারাটি আজ থেকে আরো ১৫/১৬ বছর আগে থেকেই প্রকাশ্য হয়েছে। এই প্রসঙ্গে তার বক্তব্য  হলো-
[এ] প্রশ্ন যে এখন শুরু হয়েছে তা নয়। একদম শুরুতে বলেছি, এ প্রশ্নের জন্ম প্রায় দুই যুগ আগে থেকেই। এটি তখন সাধারণ-নাট্যকর্মীর মনের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আজ থেকে ১৫/১৬ বছর আগে, যাদের হাতে ফেডারেশান তৈরি হয়েছিল তাদের ভিতরেও এই প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছিল। তাদের কারো কারো মন্তব্য হচ্ছেÑএখন ফেডারেশান আগের ইমেজ ধরে রাখতে পারছে বলে মনে হয় না। এখন এটি অনেক পলিটিসাইজড হয়ে গেছে।

অতঃপর সংগ্রামী চরিত্র ধ্বংস হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি একটি নির্দিষ্ট ও বিশেষ-ঘটনাকে অনুঘটক হিসেবে চিহ্নিত করে একে একটি ‘পর্ব’ বা অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করলেন। এই প্রসঙ্গে তার দৃঢ় অবস্থান-
সংগ্রামী-চরিত্রের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক পর্বটির সূচনা হয় যখন একই ব্যক্তি ফেডারেশানের সভাপতি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদটিতে বসে যায়। কেননা, তখন থেকেই ‘নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্ন সময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা’র (লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ২) বিষয়টি অকার্যকর হয়ে যায়। দুই পদে একই ব্যক্তি থাকার মানে যে ‘সাংঘর্ষিক-বিষয়’, এটি জেনেও এতদিন ধরে বাঘা বাঘা থিয়েটারওয়ালারা তা মেনে নিল (এবং নিচ্ছে) কীভাবে তা ভাবতেই অবাক লাগে।
 
উপরে উদ্ধৃত দুটি উক্তি প্রাবন্ধিকের সাংঘর্ষিক-অবস্থান প্রকাশ করে। কারণ, ‘দুই পদে এক ব্যক্তির থাকার’ ঘটনাটিকে ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী-চরিত্র’ ধ্বংস হওয়ার ‘সূচনা-পর্ব’ বা কাল হিসেবে মেনে নিলে ১৫/১৬ বছর আগে থেকে সংগঠনটির ‘ইমেজ’ নষ্ট-হওয়া বা ‘পলিটিসাইজড’ হয়ে যাওয়ার যুক্তিটি গ্রহণযোগ্যতা হারায়। বিপরীতক্রমে, ফেডারেশানের পলিটিসাইজড হওয়ার বিষয়টি যদি ১৫/১৬ আগে থেকেই শুরু হয়ে থাকে, তবে ‘সূচনা-পর্ব’ হিসেবে ‘এক ব্যক্তির দুই পদে থাকা’র’ ঘটনাটি বিশেষ-অর্থ তৈরি করে না। বিষয়টিকে অতিমাত্রায় সরল-দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা হয়েছে। কেননা, একজন ব্যক্তির দুই-উচ্চপদে-পদস্থ হওয়ায় ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী-চরিত্র’ ধ্বংস হয়েছে, এই যুক্তির স্বপক্ষে আলোচ্য প্রবন্ধ জোরাল যুক্তি প্রমাণ হাজির করে না। বরং বিষয়-উপস্থাপনের ধরন-দৃষ্টে এটি ব্যক্তিগত অভিযোগে পরিণত হয়েছে। আবার যুক্তির তর্ক-বিতর্কে এমনটিও প্রমাণ করা গেল না যে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান বরাবরই তার ‘সংগ্রামী-চরিত্র’কে প্রশ্নাতীতভাবেই অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল, কেবল এই ঘটনার কারণেই তা ক্ষুণ্ন হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদশীল এই জন্য যে, ‘বাঘা বাঘা থিয়েটারওয়ালাদের’ মধ্যে অনেকেই আছেন যারা প্রবন্ধকারের উল্লেখিত ‘১৫/১৬’ বছর আগে থেকেই রাষ্ট্র/সরকারের নানা-পর্যায়ের লাভজনক বা অলাভজনক সাংগঠনিক-কাঠামো অথবা পরামর্শক-কমিটির সাথে যুক্ত থেকেছেন এবং এখনও যুক্ত হচ্ছেন। প্রবন্ধকার এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলেন না, দেখালেন না যে, এদের কারণে গ্রুপ থিয়েটারের ‘সংগ্রামী-চরিত্রে’ কী কী ক্ষতি হয়েছে অথবা আদৌ কোনো ক্ষতি হয় নি, বরং প্রতিবাদ-আন্দোলন-সংগ্রামে তারা সর্বদাই সক্রিয়-ভূমিকা পালন করেছেন।
 
আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রবন্ধকারের এই মৌলচিন্তার সাথে সম্পূর্ণ একমত। ক্ষমতার-সান্নিধ্যে থেকে, ক্ষমতার-আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে লাভজনক বা অলাভজনক নানাবিধ সুবিধা ভোগ করে, ঐ ক্ষমতার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদী-সংগ্রামী হওয়ার চিন্তা করা শুধু হাস্যকর-ই নয়, নাটকীয় paradox-ও বটে। সুতরাং, আমার দ্বি-মত প্রবন্ধকারের মৌলচিন্তার বিরুদ্ধে নয়, বরং তিনি যে পদ্ধতিতে এবং দৃষ্টিভঙ্গীতে এই সমস্যাকে চিহ্নিত করতে চাইলেন, দ্বি-মত সেখানে। কেননা, প্রবন্ধকার এই সমস্যার মূল অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটিমাত্র ঘটনার উপর দৃষ্টি আবদ্ধ করলেন। দেখানোর চেষ্টা করলেন সমস্যার শুরু ওখান থেকেই। অথচ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ‘পলিটিসাইজড’ হয়ে যাওয়া বা মধ্যপন্থায় আপোষকামী হওয়ার মূলে রাজনৈতিক-সংস্কৃতির একটি দীর্ঘ এবং সামষ্টিক-প্রেক্ষাপট রয়েছে, যা তিনি নিজেও নানাযুক্তিতে, দৃষ্টান্তে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। অথচ সমস্যা-চিহ্নায়নে এই বিষয়ে গুরুত্বারোপ না-করে কেবল একটি ঘটনাকে মূলকারণ (পর্ব) হিসেবে দেখার ফলে সমস্যার বৃহত্তর ও সামষ্টিক-প্রেক্ষিত গৌণ হয়ে দুজন সাংগঠনিক কর্তাব্যক্তির ক্ষমতাকেন্দ্রিক-লড়াইয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে। সুতরাং, আমি মনে করি না যে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ‘সংগ্রামী-চরিত্র’ ধ্বংস হওয়ার কারণ-অন্বেষণে শাহরিয়ারের এই বিশেষ-দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যার গভীর ও বিস্তৃত রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক-প্রেক্ষাপটকে নির্দেশ করতে সক্ষম হবে। বরং উল্টোভাবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি-পর্যায়ে সিদ্ধান্তের ঠিক-বেঠিক, সফলতা-ব্যর্থতার নানাবিধ সংকীর্ণ-বিতর্ককে উসকে দিয়ে সমস্যার মূল-থেকে বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে এবং সাংগঠনিক-বিতর্ক-বিভাজনকে আরো ত্বরান্বিত করবে, যেমনটি এখনও করছে।

গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভবিষৎ-ভাবনা এবং টিকে থাকার লড়াই ও ‘সামনের দিনে’ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য পথ নির্ণয়ে প্রস্তাবিত ৪টি দাওয়াই:
হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধের পাঠ ও পর্যালোচনার এটি চুড়ান্ত এবং শেষপর্ব। তিনি এই অংশের উপসংহারে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নির্ধারিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে সংগঠনটির শক্তি-সামর্থ্য ও দক্ষতা পুনর্মূল্যায়নেরভিত্তিতে ‘সামনের দিনে’ এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্য করণীয়-নির্ধারণে ৪টি পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো-
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে তার পরিধেয় জামাটি তার সাইজে বানিয়ে পরতে হবে। ৪ ফুট সাইজের ব্যক্তি যদি ১০ ফুট সাইজের ‘জমিদারী’ জামা গায়ে চাপায়, তাহলে জামাটির একটি সৌন্দর্য হয়ত বেরিয়ে আসে, কিন্তু জামাটি যে পরেছে, তাকে স্রেফ ক্লাউন বা জোকার মনে হবে। সুতরাং তাকে মানানসই দেখাতে হলে, পরতে হবে তার-মাপের জামা-কাপড়। অর্থাৎ, টিকে থাকার জন্য, প্রথমেই ফেডারেশানকে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে ছোট করে ফেলতে হবে। সে বিবেচনায়, ফেডারেশানকে দেখতে হবে, কোন কোন কাজ নাট্যদলগুলো এককভাবে পেরে ওঠে না, শুধুমাত্র সে সব কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করা। থিয়েটারচর্চায় সৃজনশীলতা-টিকিয়ে-রাখা এবং এগিয়ে নেবার কাজটি করবে নাট্যদল (গুলো), ফেডারেশান কেবল ওই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়াবে।

অর্থাৎ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বর্তমান সাংগঠনিক-শক্তি এবং সক্ষমতা-বিবেচনায় বাস্তবায়ন-যোগ্য নয় এমন বিষয়গুলো নির্ধারিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে বাদ দিয়ে ছোট পরিসরে চারটি সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ বা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের প্রস্তাব করেন। চারটি সহযোগিতামূলক-প্রস্তাবনার মূল বা সারকথা নিম্নরূপ-
সহযোগিতা-১: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নাট্যদলগুলোর জন্য মহড়াকক্ষের ব্যবস্থা করা এবং প্রযোজনা’র সেট রক্ষণাবেক্ষণের সু-বন্দোবস্ত করতে সহযোগিতা করা।
 
সহযোগিতা-২: নাট্যদল-কর্তৃক-আয়োজিত আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবের শিল্পীর গমন-আগমন-সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয়-প্রশাসনিক ও দাপ্তরিক-প্রক্রিয়া সম্পাদনে সহায়তা করা।
 
সহযোগিতা-৩: নাট্যদলগুলোর জন্য সরকারি অনুদান-প্রাপ্তি ও তার পরিমাণ বৃদ্ধিতে এবং নির্ধারিত হল (মঞ্চ) ছাড়াও অন্য কোনো প্রেক্ষাগৃহে নাটক করতে চাইলে ভর্তুকি-মূল্যে তার ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করা।

সহযোগিতা-৪: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নাট্যদলগুলোর সৃষ্টি-ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে যোগ্যতা-অনুসারে মঞ্চ/প্রেক্ষাগৃহ বরাদ্দ দেয়ার কাজ তদারকি করা।

শুরুতেই একটি প্রাসঙ্গিক-গল্প দিয়ে ‘ছোট করে ফেলা’ (চারটি) লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মূল্যায়ন করা যায়। গল্পটি এরকম, দূর-গন্তব্যে পৌঁছানোর সুতীব্র-বাসনা নিয়ে এক মাঝি রাতভর নির্ঘুম-পরিশ্রমে তার নৌকা বেয়ে চলল। কিন্তু সকালের আশ্চর্য-চোখে দেখতে পেল নৌকাটি ঘাটেই রয়েছে বাঁধা। যে ক্ষমতা’র জোরে সাংগঠনিক-কর্তাব্যক্তিরা ‘নির্লজ্জ প্রতিযোগিতায়’ মত্ত হয়ে ‘নেতা’ (সংগঠক) নির্বাচিত হয়ে নাট্যদলগুলোর ওপর খবরদারি করতে ব্যতিব্যস্ত হন বলে শাহরিয়ার ক্ষুরধার সমালোচনা করলেন, আশ্চর্যজনকভাবে সেই ক্ষমতা-কাঠামোতেই তিনি আস্থা রাখলেন এবং এর পুনর্মূল্যায়নের দাওয়াই দিলেন। বিষয়টি ঠিক গল্পের সেই মাঝি’র মতো, নতুন পথের সন্ধানে দীর্ঘপথ পরিভ্রমণ করে শাহরিয়ার সমাধানের তরীটি নোঙর করালেন সেই প্রচলিত ক্ষমতা-বন্দরেই। শাহরিয়ারের সহযোগিতা-১, ৩ এবং ৪ অনুসারে যে নির্দিষ্ট-দায়িত্ব পালনের কথা হয়েছে, নামে-বেনামে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে এতকাল ধরে এই দায়িত্বগুলোই তো কম-বেশি পালন করে আসছে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। উপরন্তু, ‘নাট্যদলগুলোর সৃষ্টি-ক্ষমতাকে মূল্যায়ন করে যোগ্যতা-অনুসারে হলবরাদ্দ দেয়ার’ যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রচলিত হল/মঞ্চবরাদ্দ প্রক্রিয়াকে আরো জটিল এবং ক্ষমতায়নের আর এক নয়া-স্তরে উন্নীত করবে। কেননা, কোন মানদণ্ডেরভিত্তিতে দলগুলো মূল্যায়িত হবে বা হতে পারে এ ব্যাপারে তিনি স্পষ্ট কোনো রূপরেখা দেন নি।  তদুপরি এই প্রক্রিয়া-বাস্তবায়নে বেশকিছু প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া জরুরি হয়। যেমন, ‘সৃষ্টি-ক্ষমতা’ মূল্যায়নের মাপকাঠি কি নাটকের নির্মাণ ও প্রদর্শন সংখ্যাধিক্যেরভিত্তিতে হবে নাকি নাটকের গুণ-মান ও দর্শকপ্রিয়তারভিত্তিতে হবে? নতুন নাটক পুরাতন নাটক, এরকম বিবেচনায় হবে, নাকি দলের প্রতিষ্ঠা-বছর-বিবেচনায় নতুন দল ও পুরান দল (অভিজ্ঞ-অনভিজ্ঞ) এই ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? দলের সৃষ্টি-সক্ষমতার মানদণ্ডগুলো কি সাংগঠনিক নাকি নান্দনিক-গুণ, দক্ষতা, চর্চা, বৈশিষ্ট্য দ্বারা নির্ধারিত হবে?  কে করবে এই মূল্যায়ন, ফেডারেশানের কর্তাব্যক্তিরা, নাকি ভিন্ন কোনো সাংগঠনিক-কমিটি? মূল্যায়নের কর্তাব্যক্তিরা কি বর্তমান পদ্ধতি অনুসারে প্রত্যক্ষ ও গোপন ভোটে নির্বাচিত হবেন নাকি বাছাইকরণ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হবে? এই প্রক্রিয়ায় দলগুলোর প্রত্যক্ষ-অংশগ্রহণ থাকবে নাকি থাকবে না? আলোচ্য প্রবন্ধ এসকল গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর দেয় না। ফলে এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হলবরাদ্দের দায়িত্ব পুনর্মূল্যায়নের এই চিন্তা কার্যত কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের সুযোগ ও সম্ভাবনাকেই বাড়িয়ে দিবে। যদিও সহযোগিতা-২ এর ভাবনায় খানিকটা নতুন কিছু বলা হলো, তবে এই ভাবনা যেকোনো যুক্ত-সংগঠনের (ফেডারেটিভ বডি) বৃহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক এবং মর্যাদাহানিকর। কেননা এই প্রস্তাব নাট্যচর্চার বৃহত্তর স্বার্থ সুরক্ষা এবং সার্বিক-উন্নয়ন ও বিকাশের ক্ষেত্র নিশ্চিত করার বিপরীতে নাট্যদলের চাহিদা ও কর্মসূচি মোতাবেক এজেন্ট, সংস্থা অথবা কেয়ারটেকার হিসেবে খেদমত (সহযোগিতা) করার কথা বলে। এই ভাবনা ফেডারেশানের বৃহত্তর লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। আমি মনে করি কোনো ফেডারেটিভ বডি বা সংগঠনেরই দায় এটি হওয়া উচিত নয় যে, সে সকল দলের নিজ নিজ কর্মসূচি বাস্তবায়ন তদারকি করবে। বরং কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে নাট্যচর্চার এমন একটি সামষ্টিক-ক্ষেত্র নিশ্চিত করবে যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৃহত্তর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট এবং সকল নাট্যদলের নিরাপদ ও স্বাভাবিকচর্চাকে প্রণোদিত করে সার্বিক-উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।  

কতিপয় ব্যক্তিগত ভাবনা:
দীর্ঘ পর্যালোচনা শেষে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাফল্য ও ব্যর্থতার যে চিত্রটি পাওয়া গেল, তাতে এমনটিই বোঝা গেল যে, মোটামুটিভাবে বিগত শতকের শেষ-থেকেই নাট্যচর্চার সামগ্রিক-উন্নয়নের জিম্মিদার হিসেবে ফেডারেশান তার সহায়কের ভূমিকাটি হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। এই সময় থেকে নাট্যদলগুলোর নিয়মিত এবং স্বাভাবিকচর্চা, প্রদর্শন-প্রক্রিয়ায় সংগঠনের ভূমিকাও ক্রমান্বয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে। তবে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ ওঠে সংগঠনটির নৈতিক এবং আদর্শিক-অবস্থানের বিরুদ্ধে। কারণ, রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সাথে সাথে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান তার রাজনৈতিক আদর্শিক এবং প্রতিবাদী অবস্থান থেকে সরে গিয়ে একটি কৃত্রিম প্রতিবাদী এবং নতজানু-অবস্থান গ্রহণ করে। ফলে ব্যক্তি ও দলগতপর্যায়ে ফেডারেশানের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক ও দোদুল্যমান হয়ে পড়ে। সুতরাং, এমন একটি সামগ্রিক-ব্যর্থতার-প্রতিবেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’কে এগিয়ে নেয়ার বিশেষ-কোনো তাৎপর্য আছে বলে আমি মনে করি না। থিয়েটার তার নিজ শক্তি-গুণেই প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে জানে, জানে টিকে থাকার লড়াই করতে। যেমনটি শাহরিয়ার তার রচনায় দেখিয়েছেন, বিগত শতকের পঞ্চাশ থেকে আশির দশক পর্যন্ত শহারায়তনিক নাট্যচর্চায় ফেডারেশান বা এ জাতীয় সংস্থার অস্তিত্ব ছাড়াই থিয়েটার তার আপন-ভাষা খুঁজে নিয়েছে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে, বিনোদনে আপন-আলোয় উদ্ভাসিত থেকেছে। সুতরাং, আমার অভিমত, সমাজ ও সংস্কৃতিতে অভিঘাতসৃষ্টিতে-অক্ষম এমন একটি সাংগঠনিক-শক্তিকে টিকিয়ে রাখার বিশেষ-কোনো প্রয়োজন নেই।
 
তবে, শহরায়তনিক আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিকপ্রেক্ষিত বিবেচনায়, বিশেষত ঢাকা শহরে নাট্যচর্চার যে বহুমুখী প্রতিকূল প্রতিবেশ বিরাজমান, এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় যদি একটি সমন্বিত-শক্তি হিসেবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের নেতৃত্ব প্রয়োজন বলে মনে করা হয়, যেমনটি শাহরিয়ার মনে করেন, তাহলে সাংগঠনিক চিন্তা ও কর্মে-সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মনে করি। এই প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত ভাবনাগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:
সকল প্রকার হল/মঞ্চবরাদ্দের দায়িত্ব থেকে ফেডারেশানকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাখা। এ দায়িত্ব স্ব স্ব প্রেক্ষাগৃহ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করবে। তবে ভর্তুকির বিনিময়ে প্রেক্ষাগৃহ ব্যবহারের সুবিধা-প্রাপ্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রেক্ষাগৃহ-বরাদ্দের প্রচলিত পদ্ধতি বাতিল করে নতুন এবং সমন্বিত-পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে। এই পদ্ধতির অধীনে শুধুমাত্র নতুন নাটকের ক্ষেত্রে দলের চাহিদা-অনুযায়ী হলবরাদ্দ (অনধিক ১৫ দিন) নিশ্চিত করা যেতে পারে। এবং পুরাতন নাটক-মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দের বর্তমান পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে।

ঢাকা শহরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং অবকাঠামোগত পরিবর্তনের এই প্রতিকূল প্রতিবেশে কমপক্ষে ১০টি নতুন প্রেক্ষাগৃহ প্রয়োজন-বিবেচনায় একটি সমন্বিত আন্দোলন সংগঠিত করা যেতে পারে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত সিটি কর্পোরেশানের অধীনে থাকা ‘কমিউনিটি সেন্টার’গুলোকে ‘মাল্টিপার্পাস কালচারাল সেন্টার’-এ রূপান্তরের প্রস্তাব রেখে এই আন্দোলন সংঘটিত করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানভুক্ত ও বহির্ভুত সকল নাট্যসংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ের নাট্যকলা বিভাগ ও সংগঠন, কলেজ-পর্যায়ের নাট্যবিভাগ ও সংগঠন এবং এলাকাভিত্তিক নাট্যদল বা সংগঠনের সমন্বয়ে বৃহত্তর পরিসরে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে দাবি আদায়ের এই আন্দোলন সংগঠিত করা।

সারাদেশে নাট্যচর্চার বিস্তার এবং এর সাংগঠনিক সামর্থ্য-বৃদ্ধির লক্ষ্যে গ্রুপ থিয়েটারচর্চার বাইরের সংশ্লিষ্ট সকল প্রকার নাট্যসংগঠন/প্রতিষ্ঠান/রেপাটরি/দলসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করে সংগঠনটির কলেবর বা পরিধি বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’ নাম ও গঠনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিকরণের এই কাজটি সম্পাদিত হতে পারে এবং একে অপরের সুযোগ-সুবিধা ও সম্ভাবনার বিনিময় এবং সহযোগিতার মাধ্যমে নাট্যচর্চার সমন্বিত-শক্তি ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।  

বর্তমান বিশ্বে কালচারাল ও ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রির ব্যাপক প্রসার এবং নিও-লিবারাল সামাজিক ও অর্থনৈতিক-প্রতিবেশে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে অতিশীঘ্র পেশাদারিত্বের থিয়েটারচর্চাকে উৎসাহিত করা এবং এই ধরনের থিয়েটারচর্চার প্রবর্তনে উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে ফেডারেশান জাতীয় নাট্যশালা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত-পরিকল্পনার মাধ্যমে দুবছর মেয়াদি স্থায়ী প্রকল্পের অধীনে একটি রেপাটরি নাট্যদল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার দাবি জানাতে পারে। এই রেপাটরিতে-সংশ্লিষ্ট যোগ্য-নাট্যশিল্পী একটি বাছাইকরণ প্রক্রিয়ার-মাধ্যমে মাসিক বেতনে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। প্রকল্পটি স্থায়ী বিধায় প্রতি দুবছর পর পর নাটকের ধরন ও বৈশিষ্ট্য-অনুসারে নাট্যশিল্পী পরিবর্তন, বাছাই ও নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। এছাড়াও পেশাদারিত্বের নাট্যচর্চার-বিকাশে ফেডারেশান একটি সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগে স্কুল, কলেজ এবং বিসিএস-পর্যায়ে নাট্যশিক্ষা-কার্যক্রমের অধীনে নাট্য-শিক্ষক নিয়োগের আন্দোলন পরিচালনা করতে পারে।
 
প্রতিযোগিতামূলকনাট্যচর্চার বিকাশ এবং নাটকের গুণ, মান ও অভিজ্ঞতার-বিনিময় ত্বরান্বিত করতে ফেডারেশান, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা সিটি কর্পোরেশান এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগে এবং একটি স্থায়ী-প্রকল্পের অধীনে দ্বি-বার্ষিক আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এই প্রকল্পের অধীনে বিশেষ অর্থ-প্রণোদনারভিত্তিতে বাছাইকৃত নির্দিষ্ট সংখ্যক নাট্যদলের (ঢাকা ও ঢাকার বাইরের) নতুন নাটকের উৎসব ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ড. সাইদুর রহমান (লিপন) ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): শিক্ষক, নির্দেশক, অভিনেতা ও গবেষক