Full premium theme for CMS
ওয়েটিং ফর গডো...
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
থিয়েটার-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কোনো কথা হলে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান মাঝেমাঝেই আলোচনায় উঠে আসে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে সম্প্রতি দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণ দেখিয়ে ফেডারেশানের নির্বাহী পরিষদের দুজন ব্যক্তিকে বহিষ্কারের ঘটনাটা থিয়েটার পাড়ার মৌচাকে যেন ঢিল ছুঁড়ে দেয়! সবার বা অধিকাংশের শরীরে যেন হুল ফুটতে শুরু করে! সবাই মৃদু নড়েচড়ে বসে। অনেক ‘জানা/বোঝা বিষয়’ প্রকাশ্যে আসায় কেউ কেউ বেশ খুশি হয়, কেউ কেউ তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়, কেউ কেউ লজ্জা পায়।
এসব সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি মূলত ফেসবুকের কল্যাণে। ফেডারেশান-কর্তৃক অভিযুক্ত দুই ব্যক্তির দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নেয় কেউ কেউ, আবার অন্যদিকে এটাকে স্রেফ প্রতিহিংসা বলেও উল্লেখ করে এক পক্ষ। দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, স্লোগান। মূলত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দেয়ালকেই উল্লেখ করছি। আমাদের সমস্ত ভাবনা, আন্দোলন এখন ঐ ফেসবুককেন্দ্রিক কিনা! তো, দৃশ্যত দুই পক্ষ বেশ কণ্ঠ ছাড়ল। মাঝে দাঁড়িয়ে গেলেন কোনো কোনো অগ্রজ নাট্যজন। তাঁরা প্রশ্ন তুললেন ফেডারেশানের কর্মকাণ্ড বা প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। সেখানেও নানা মতের সমাহার।
কাছাকাছি সময়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠল। দুর্নীতি দমন কমিশনে তাঁকে ডাকা হলো। এমন চলমান অবস্থায় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বহিষ্কার-সংক্রান্ত এই হুলস্থুল কাণ্ড নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা হতে থাকল চায়ের টেবিলে, মহড়াকক্ষে। ফেডারেশান থেকে বহিষ্কৃত সেক্রেটারি বহিষ্কার স্বীকার করলেন না। তিনি ফেডারেশানে বহাল আছেন প্রমাণ করতে ফেসবুকে দু-একটা লেখাও দিলেন, ফেডারেশানের অফিসিয়াল প্যাড ব্যবহার করে। এই রকমের বিষয় ধারাবাহিকভাবে যখন চলছে তখন থিয়েটারকর্মীর মধ্যে হতাশা আর ক্ষুব্ধতা তৈরি হচ্ছে। দুপক্ষই তা প্রকাশ করছে এবং এক সময় বাংলাদেশের দীর্ঘ বছরের পরম্পরায় ভর করে মানুষ সে আলোচনা থেকেও নিজের চোখ সরিয়ে নিল। এদেশে কোনো আন্দোলন, আলোচনা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এদেশের শুরুটাই কেবল হয়েছিল দীর্ঘ একটা আন্দোলন এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং আশির দশকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। ঐ শেষ। এদেশে টেবিল টেনিস খেলাটা যে কেন জাতীয় খেলা হলো না! বল একবার এপাশে তো আরেকবার ওপাশে। তো, সেই পিংপং বলের ছাইয়ে বাতাসটা দিলো ‘থিয়েটারওয়ালা’। ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ শিরোনামে একটা লেখা লিখে ফেললেন থিয়েটারওয়ালার সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার। ২১ পাতার সেই ডকুমেন্টস যখন হাতে পৌঁছাল এবং পড়া শেষ করলাম, তখন প্রথম কথাটাই মনে এল, যেকোনো থিয়েটার-শিক্ষার্থী বা থিয়েটারের সাথে সম্পৃক্ত মানুষের জন্য এটা একটা প্রয়োজনীয় দলিল। বাংলাদেশের থিয়েটারের দীর্ঘ পথচলার পায়ের ছাপ এতে সুস্পষ্ট। এক বসায় আপনি বাংলাদেশের থিয়েটারকে জেনে ফেলছেন বা এটা জানার জন্য আরো পিছিয়ে গিয়ে স্বাধীনতাপূর্ব পূর্ববাংলার থিয়েটারকে জানছেন, সে একটা বড় পাওয়া। অন্য আলোচনায় যাওয়ার আগে এটার জন্য একটা ধন্যবাদ দিতে চাই থিয়েটারওয়ালাকে বা এই প্রবন্ধের লেখক হাসান শাহরিয়ারসহ এর সাথে যুক্ত সকলকে।
আমি যখন নাট্যকলার শিক্ষার্থী, তখন এক মৌখিক পরীক্ষায় আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল শেক্সপিয়রের জন্ম তারিখ কত? আমি ভুলে গিয়েছিলাম। যথারীতি উত্তর দিতে পারি নি। তো সেই ব্যর্থতা ঢাকতে বন্ধুদের বলেছিলাম, ‘পৃথিবীর সবকিছু জানার দায় তো আমার নয়’। একজন নিয়মিত নাট্যকর্মী হিসেবে একই রকম একটা ব্যর্থতা ছিল হয়ত আমার ফেডারেশানের বিষয়েও, মানে ঐসব জানা না-জানার বিষয়ে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের গঠনতন্ত্রের ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আমার জানা ছিল না। হাসান শাহরিয়ারের এই লেখা পাঠের মধ্য দিয়ে সেটাও জানা গেল। আমার ধারণা থিয়েটারের সাথে যুক্ত এমন অনেকেই আছেন যারা আমার মতোই বলবেন এখন, ‘পৃথিবীর সবকিছু জানার দায় তো আমার নয়’।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কিন্তু নিঃসন্দেহে দারুণ। যে সময়ে এই ফেডারেশান তৈরি হয়েছিল সে সময়ে নিশ্চয়ই এসব লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেসব বিবর্ণ হয়েছে। আলোচনার বা সকলের বোঝার সুবিধার জন্য ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এখানে আগে লিখে সামনে আগানো উচিত বলে মনে করছি।
১. গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা।
২. নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
৩. সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৪. নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা।
৫. নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা।
৬. নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা।
৭. বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা
৮. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা।
৯. দেশে একটি থিয়েটার ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা।
১০. মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।
১১. পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা।
এখন কথা হলো আমি যে থিয়েটার দলে কাজ করি ‘বটতলা’, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সদস্য নয়। কিন্তু সদস্য না হলেও নিয়মিত নাট্যচর্চার সাথে আমরা যুক্ত আছি, তাই থিয়েটারের খোঁজ তো আমাদের রাখতেই হয়। যারা ফেডারেশানের সদস্য তারাও থিয়েটারের বা ফেডারেশানের খোঁজ খবর রাখেন বা পান। তো এই খোঁজ রাখা বা পাওয়ার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বেশ বোঝা যায়, উপরের ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান হেঁটে চলছে অন্য দিকে। ঠিক কবে থেকে একটা বাঘ বেড়াল হয়ে গেল তা জানি না।
উপরে উল্লেখিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা বা দুটা ছাড়া বাকিগুলোর কোনো খবর আমার অন্তত জানা নেই। আপনারা জানেন কি? আমার ধারণা অধিকাংশই আমার মতো। আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখতে পায় বলে একটা প্রবাদ আছে। সেটা মনে পড়ল। আকাশে চাঁদ ওঠে নি বলেই দেখি না।
এই ১১টা লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সবার সামনে হাজির করে থিয়েটারওয়ালা-সম্পাদক যে লেখার অবতারণা করেছেন, তার একাংশের সাথে একমত আমিও। অর্থাৎ তিনি যে প্রতিটা পয়েন্টকে বিশদ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং কোন কোন কাজ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান এ যাবৎ করেছে বা করে নি বা করতে পারে নি বা তাদের অর্জন বা ব্যর্থতা, আমি সে বিষয়ে তার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। তার এ লেখাকে কেন্দ্র করে মতামত বিনিময়ও হয়েছে কয়েকজন নাট্যকর্মীকে নিয়ে। সেখানে আমি তার লেখার পক্ষে-বিপক্ষে যে যুক্তি তুলে ধরেছিলাম, এখনও সে মতে নিবিষ্ট আছি। ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণে ফেডারেশান ব্যর্থ হয়েছে বলে, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কলেবর ছোট করে এটা কেবল সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে ভালো হবে বলে তিনি যে মতামত বা পরামর্শ দিয়েছেন আমি সেখানে দ্বিমত পোষণ করি। মাথা ব্যথা হয় বলে মাথাটা কেটে ফেলতে হবে, আমি সেটা বিশ্বাস করি না। এজন্য বরং ডাক্তার দেখানোই শ্রেয়। আর ঐ ডাক্তারকে অবশ্যই যোগ্য এবং পরীক্ষিত হতে হবে।
গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যে সময়ের প্রেক্ষাপটে তৈরি বা শুরুতে যে ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত, সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুতে যেভাবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান অন্যায়ের প্রতিবাদে সামিল হতো সেসব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যদিও হাসান শাহরিয়ারের মতে ‘[...] লক্ষ করে থাকব, এর জন্মের দেড় বছরের মাথায় বাংলাদেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়ে যা দ্রুতই ‘স্বৈরশাসন’ বলে চিহ্নিত হয়। তখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীগুলো সবাই ঐ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় [...] ফেডারেশানের কর্মকর্তারা তখন বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করলে তা সফল করতে তেমন কোনো সৃজনশীল চিন্তা বা মেহনতের প্রয়োজন হয়নি, তবু আমি বলব ‘সৃজনশীল চিন্তা’ বা ‘মেহনত’ না করে হলেও তো তখন যুথবদ্ধ হতে পেরেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষ। এখন তো সেই যুথবদ্ধতাও নেই। এখন তো অধিকাংশ থিয়েটার দলকে রাজনৈতিক বা সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে দেখা যায় না, কোনো কর্মসূচী গ্রহণ করতে দেখা যায় না। হাতেগোনা ২/৩টা থিয়েটার দল শুধু নেমে আসে রাস্তায়, সেখানেও নানা সন্দেহের দৃষ্টি থাকে অনেক ‘গুরুজনের’। যেসব ইস্যু সমাজে গুঞ্জন সৃষ্টি করে সেসব ইস্যু নিয়ে কোনো পথনাটক, সাংস্কৃতিক প্রতিবাদী সমাবেশ বা হাতে হাত ধরে দাঁড়ালে ‘ওরা বাম’, ‘ওরা জামাত’ এমন সব মন্তব্য ছুঁড়তে শুনেছি নানা বয়সের থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট মানুষকে। খুব দূরের অতীত নয় সেগুলো। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, এট তো পথভ্রষ্ট হওয়া-ই
‘থিয়েটার ফর ডেভেলপমেন্ট’ বা ‘উন্নয়নের জন্য নাট্য’ আমার অতি প্রিয় একটা বিষয়। তা বলে এ বলছি না যে এটা অন্যদেরও প্রিয় হতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ হচ্ছে উন্নয়নের জন্য নাট্যচর্চার সবচেয়ে বড় একটা ক্ষেত্র। অথচ ‘উন্নয়নের জন্য নাট্য’ বিষয়টা এদেশের থিয়েটারের মানুষ কেমন ছুঁড়ে ফেলে দিলো বা অন্যভাবে বলা যায়, তারা এর মর্মার্থই বুঝল না, কিন্তু এনজিওগুলো এটাকে ঠিকই কুক্ষিগত করে নিল তাদের নানা ইস্যু প্রচারে (যদিও তারা অধিকাংশই যেভাবে এর প্রয়োগ করছে সেটা নিয়ে নানা প্রশ্ন, আলোচনা, সমালোচনা দাবি রাখে)। অবশ্য এ আশা করাও তো ভুল, কারণ, এই নাট্যদর্শন তখনই মানুষ গ্রহণ করবে যখন সে আসলে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। বাংলাদেশের থিয়েটার তো ঐ চার দেয়ালেই আটকে আছে। অনেকটা রাজা, রানি সুখে শান্তিতে বসবাস করার মত। এখানে কোনো প্রজা নেই, প্রজার দুঃখ নেই, বঞ্চনা নেই, হতাশা নেই।
আবার অন্যভাবে বললে, উন্নয়নের জন্য নাট্য কনসেপ্টকে গ্রহণ না করেও তো সাংস্কৃতিক-আন্দোলন সম্ভব ছিল, সেটাও কি হতে দেখছি আমরা এখন? আমরা কি আদৌ ঐ ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ দেখি? দেখি না। তবু আমি বলব গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রয়োজন আছে। হাসান শাহরিয়ার যেমন প্রস্তাব দিয়েছেন যে ফেডারেশান কেবল সহযোগীর ভূমিকায় থাকবে, আমি সেটার সাথে অনেকাংশে দ্বিমত পোষণ করি।
তার প্রস্তাবের সহযোগিতা নম্বর ৩ এ তিনি উল্লেখ করেছেন, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নাট্যদলগুলোর সরকারি আর্থিক-অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারে। বর্তমানে সরকার যে অনুদান দেয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মাধ্যমে, সেটা বিশ্লেষণ করলেও তো আমরা দেখতে পাই যে, সেখানে এক শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে বর্তমানেও। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাথে যুক্ত এবং তিনি দলগুলোর এই অনুদান প্রদানেও যুক্ত। এ বিষয়টাই তো গোলমেলে। নাম উল্লেখ করে বলতে চাই না, যারা অনুদানের তালিকা দেখে থাকেন নিয়মিত, তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, নিয়মিত নাট্যচর্চা করছে এবং দর্শকমহলে যাদের সুনাম আছে সেসব দল কতটাকা অনুদান পায়, উল্টোদিকে অনেকক্ষেত্রে যেসব দলের নামও অনেকে জানে না সেসব দল কতটাকা অনুদান পায়। তো হাসান শাহরিয়ারের সহযোগিতা ৩ নম্বরের এই অংশটাও যে এই ফেডারেশান দিয়ে খুব সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হবে সেটা বলা যায় না। বিশ্বাসও হয় না।
ঐ লেখার সহযোগিতা ৪ এ তিনি যে সারাদেশে সবগুলো জেলায় আলাদা আলাদা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান হতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন সেটাও যুক্তিযুক্ত মনে হয় নি। কারণ তাতেও আসলে কিছু যাবে আসবে না। বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে আসলে ঢাকা শহর। সব সুযোগ-সুবিধা, সব রথী-মহারথী এখানেই থাকে। সুতরাং সিদ্ধান্তও যা নেবার নেয়া হয় এখান থেকে। তখন দেখা যাবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ঢাকা বা চট্টগ্রাম বা খুলনা বেশি সুবিধা পাচ্ছে। অন্যরা সেই পিছিয়ে আছে এখনকার মতোই। আদতে এখন যেমন বড়ো মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলছে, তখনও তেমনই হবে। প্রবন্ধকার এই ৪ নম্বরে এও উল্লেখ করেছেন যে, হলবরাদ্দের ব্যাপারে স্থানীয় ফেডারেশানগুলোই দায়িত্ব প্রাপ্ত হবে। সে তো এখনও আছে। তাতে কী লাভ হচ্ছে মুষ্টিমেয় কয়েকটা দল ছাড়া? তখনও কি হলবরাদ্দে স্বজনপ্রীতি হবে না? ফেডারেশানে যতদিন ‘মানুষ’ থাকবে বা ‘এই মানুষরা’ই থাকবে ততদিন এমনই হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারি।
সহযোগিতা ২ এ তিনি বলেছেন যে, বিদেশে শো করতে গেলে দলগুলোকে সাহায্য করবে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান (ভিসা ও সরকারের অনাপত্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে)। আমার মনে হয়েছে এটা আরো বেশি জটিলতা তৈরি করবে। ঈর্ষাকাতর হয়ে কেউ কেউ কিন্তু ইচ্ছে করেই ভুলভাল কাগজপত্র জমা দিতে পারে, ফলে দেখা গেল দলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরই ভিসা হলো না। একথা কেউ বলতে আসবেন না যে, ‘এমনটা হবে না’। এদেশের জল-হাওয়ায় আমার বেড়ে ওঠা। আমি খুব ভালো করে চিনি আমার স্বজনদের, পড়শিদের।
সহযোগিতা ১ নিয়ে কিছু বলার নেই। অধিকাংশ দল এখন যেভাবে তাদের সেট রাখার জায়গা ম্যানেজ করে সে এক যুদ্ধ। ঐটুকু সহযোগিতা করা গেলে সেটা খারাপ হয় না।
তাই বলে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কর্মপরিধি কমিয়ে তাকে কেবল সহযোগীর ভূমিকায় দেখতে আগ্রহী নই। ফেডারেশানের নেতৃত্বে পরিবর্তন দরকার। ফেডারেশানে এমন নাট্যকর্মীরই আসলে নির্বাচন করা উচিত যারা এই ১১টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান সব মাখামাখি করে ফেললে তো হবে না। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যখন এমন একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকেন, যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামের উপর ভিত্তি করে, সেই সংগঠন তখন একদম লেজেগোবরে পাকিয়ে ফেলবেই। এখন যেমন অবস্থা আর কি!
মোদ্দাকথা, সরকারি আঁচলের ছায়া থেকে বের হতে হবে। পৃথিবীতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় সর্বদা সরকার-কর্তৃক। তো আপনি মানবতার কথা আপনার নাটকের মাধ্যমে বলতে চাইলে আপনাকে তো সরকারের বিপক্ষেই দাঁড়াতে হবে। জুজুর ভয় করলে তো চলবে না। কিন্তু আপনি সব সুবিধা চাইবেন, সরকারের সুনজরেও থাকতে চাইবেন, আবার গ্রুপ থিয়েটারের সাথেও যুক্ত থাকতে চাইবেন, সে তো হবে না বাপু। এমন নাট্যকর্মীদের ফেডারেশানে নির্বাচিত করা উচিত, যারা সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারে, জুজুর ভয় নেই যাদের। ফেডারেশানের যে কয়টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আছে সেগুলো বাংলাদেশের থিয়েটারকে একটা ‘উন্নত’ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার জন্য যথেষ্ট। এখন সেই নেতৃত্বে কারা যাবেন, কোন প্রক্রিয়ায় যাবেন, সেটাই হোক আলোচনার বিষয়। আজ অব্দি শুনলাম না, সকল থিয়েটারকর্মীর অংশগ্রহণে কোনো আলোচনা হয়েছে, কোনো মতামত চাওয়া হয়েছে থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে। হয়েছে কি? আমি অন্তত শুনি নি।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানকে ঢেলে সাজাতে হবে। কথাটা কেমন বায়বীয় কথার মতো লাগল নিজের কাছেই। কিন্তু কিছু করার নেই, এটাই আমি বিশ্বাস করি। আবারও বলছি, ঢেলে-সাজানোর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আশা করছি ‘থিয়েটারওয়ালা’র মতোই কোনো সংগঠন সে কাজটা করবে খুব শীঘ্রই।
আমি খুব সহজ-সরলভাবে বুঝি বাংলাদেশের থিয়েটারের মান আরো উন্নত করতে চাইলে যা যা বেশি প্রয়োজন সেগুলো হলো:
১. ঢাকার বাইরে এবং ঢাকায় প্রচুর কর্মশালা করা। ঢাকার বাইরের দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ আছে সেটা কথা বলে জেনেছি। মৌলবাদীতার বিপক্ষে কথা বলি আমরা, কিন্তু ঢাকা শহরের বাইরে যে বাংলাদেশ, সে বাংলাদেশকে মৌলবাদীতার হাত থেকে বাঁচাতে তরুণ-প্রজন্মকে শিল্প-সংস্কৃতির সাথে, থিয়েটারের সাথে যুক্ত করতে হবে।
২. থিয়েটার করেই থিয়েটারকর্মীর অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করা। এক্ষেত্রেও স্বজনপ্রীতি পরিহার করতে হবে।
৩. ঢাকা শহরে বেশ কয়েকটা জায়গায় থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠা করা। এট করা গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের জন্য খুব বিশাল কোনো ব্যাপার না, সেটা জেনেই বলছি। দরকার কেবল ফেডারেশানে এই তাগিদ-পূরণে সমর্থ-নেতৃত্ব।
৪. ঢাকার বাইরের দলগুলোকে নতুন নাটক ও নাট্যোৎসব করতে সাহায্য করা। যেসব জায়গায় থিয়েটার হল নেই, সেসব জায়গায় থিয়েটার হল নির্মাণ করা। ঢাকাকেই সারা বাংলাদেশ জ্ঞান করলে এদেশের থিয়েটার কোনোদিনই কোনো ‘উন্নত’ জায়গায় পৌঁছাবে না।
৫. মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে থিয়েটারবিষয়কে যুক্ত করা এবং তা চর্চায় সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা। আমার ছোটবেলায় প্রথম থিয়েটার দেখা আমার শহরের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই। এখন কি হয় সেসব?
সর্বোপরি নির্বাচন, ক্ষমতা, সু-নজরে থাকা, স্বজনপ্রীতি এইসব পরিহার করে ‘নেতা’দের নজর দেয়া উচিত থিয়েটারের উন্নয়ন, থিয়েটার দল এবং থিয়েটারকর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোয়।
সবশেষে ধন্যবাদ দিতে চাই ‘থিয়েটারওয়ালা’কে, থিয়েটারবিষয়ক এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাকে কথা বলার বা লেখার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। এই কথাগুলো আমার মতামত, কারো ভালো লাগতেও পারে, নাও পারে। যা সত্য বলে মনে হয়েছে তাই লিখেছি। এই লেখার সবটুকু দায় আমার। এদেশের থিয়েটার বিশ্বে কবে স্থান করে নেবে জানি না, কিন্তু আমাদের মতো করেই ‘মানসম্মত’ থিয়েটার হোক, এটাই চাই। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান যেসব ‘দোষে দুষ্ট’ বলে প্রচার পায়, সেখান থেকে মুক্ত হোক।
জুজুর ভয় থেকে বেরিয়ে আসুক সবাই।
কাজী রোকসানা রুমা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): থিয়েটারকর্মী। বটতলা