Full premium theme for CMS
পথের দিশা : থিয়েটারচর্চার সুলুক সন্ধান
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
তির্যক প্রশ্ন ও পথের সুলুক
পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ! ইচ্ছায় অনিচ্ছায়!! সে সুলুক সন্ধান করবে কে? এমনিতেই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে তাড়াতে তিনকুল গেছে, বাকি সময়ে থিয়েটারের কাজ করব না থিয়েটারের মোষ কীভাবে কে তাড়াবে তার সুলুক সন্ধান করব! অন্যদিকে রয়েছে জীবন-জীবিকার টানাপোড়েন। সেই সালতামামির কথা না হয় বাদই দেয়া যাক। আমরা জানি, গুটি কয়জন ছাড়া অসংখ্য নাট্যকর্মী কীভাবে এই বহুবিধ টানাপোড়েনের মধ্যেই দিনযাপন করেন।
এইত বেশ কয়েক মাস আগের কথা। যতদূর মনে পড়ে জানুয়ারি ২০২২ এর শেষ সপ্তাহের কোনো এক সকালবেলা বেশ খুশি মনে ঘর থেকে বের হয়ে, আমার দিন কাটাবার বসবার-স্থানের দরজা খুলতেই প্রশ্নের মুখোমুখি হই, ভাই তোমরাও!? আমার ছোট ভাইয়ের সেই তির্যক বিস্ময়সূচক প্রশ্ন আমাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করে। আশেপাশে চেয়ে দেখি আরো কিছু তির্যক চোখ আমার দিকে তাকিয়ে। প্রত্যেকেই আমার প্রিয়জন এবং ঘনিষ্ঠ। বুঝতে অসুবিধা হলো না কী এর হেতু। বেশ কিছুদিন হচ্ছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রসঙ্গে যে তথ্য ও সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, প্রশ্নের কেন্দ্রবিন্দু সেখানে বিদ্যমান। সেদিন আমার মাথা নত হয়েছিল। পা পা করে এগিয়ে চেয়ার টেনে বসে উত্তর একটা দিয়েছিলাম তা মনে আছে, কিন্তু বিষয়টা উত্তর দিয়ে পার পাওয়া যায় তেমন কি! বা উত্তর দেয়ার বিষয়টাও প্রাসঙ্গিক নয়, প্রসঙ্গ আরো গভীরে, কেন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো?
এমন একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ভাবি নি। এই না ভাবাটাও এক ধরনের বোকামি। কারণ, তথ্য ও সংবাদ প্রবাহের এই ডিজিটাল সময়ে কোনো কিছুই লুকানো যাচ্ছে না। আর তাই সমাজের অলিতে গলিতে মানুষের চিন্তায় সংবাদগুলো যুক্ত হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সমাজে কিছু মানুষ তো আছেন যারা এখনও নাট্যচর্চার (থিয়েটার) সাথে যুক্ত মানুষজন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। নয়ত এই প্রশ্ন তাদের মনে জাগত না। রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বস্তরে যে অনৈতিকতার চর্চা বিদ্যমান, তার সাথে এই বিষয়টা এক করে দেখে বলতেন, জানতাম এমনটাই হবে, এবং মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতেন। কিন্তু তারা তা করেন নি। কারণ, থিয়েটারচর্চাকে তারা ভিন্ন চোখে দেখেন। সেই চোখ যে বদলে যাবে না কে বলতে পারে। এবং বদলে যাবার দায় কে বহন করবে? সুতরাং আগামীদিনের থিয়েটারচর্চার বিষয়টা শুধুমাত্র নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় না হয়ে, হয়ে ওঠে সমাজের বিষয়, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী
সত্য-মিথ্যার হিসাব-নিকাশ করে তা প্রমাণ করা না-করায় কিছু যায় আসে না। কারণ, আমি-আমরা চিহ্নিত হচ্ছি, এই লজ্জা ঝেড়ে ফেলে পুনর্জন্ম নেবার সুযোগ কি আছে! এ তো অভিনেতৃদের অভিনয়-রজনি নয় যে, অভিনীত নাটকের অভিনয় শেষে স্বমহিমায় স্বচরিত্রে ফিরে যাব। এই বঙ্গে প্রচলিত প্রবাদ আছে, নাটক ফাটক করে কী হবে বা বলা যায় যাত্রা করে ফাতরা লোকে। এই প্রচলিত প্রবাদের পেছনে একটাই কারণ রয়েছে, সমাজ-সংসারে অকর্মার ঢেঁকি, বাউণ্ডুলেরাই এর সাথে যুক্ত হয় এবং তা সম্মানজনক নয়। এদেশে নারীদের থিয়েটারে অংশগ্রহণের চিত্র খুব সহজ ছিল না, একথা সর্বজনবিদিত। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারীদের অভিনয় জীবন বেছে নিতে গিয়ে পরিবার-সমাজের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যে লড়াই করতে হয় এবং তা আজও বিদ্যমান তা কে না জানে।
এই যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য থেকে থিয়েটারকে একটা সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাওয়ার ও এই চর্চা বেগবান করার চেষ্টা, সেখানে অগ্রজদের দীর্ঘদিনের একাগ্রতা-সততা-নিষ্ঠা-নৈতিকতা ইত্যাকার বহুমাত্রিক গুণাবলি কাজ করেছে একথা যেমন সত্য, আবার তার উল্টোপিঠেও কিছু কথা বলার থাকে। হয়ত সেখানেই উপ্ত হয় আজকের বীজ। তাতে করে যে কূপ তৈরি হয়, সমাজ-সংসারের দৃষ্টিতে থিয়েটারে যুক্ত সকল মানুষ সেখানে নিক্ষিপ্ত হয়। যে সন্তান পরিবারের গোচরে বা অগোচরে থিয়েটারচর্চায় যুক্ত থেকে তার সৃজনশীল মেধা বিকাশে উন্মুখ, আজ তার জন্য কোন স্থান নির্ধারিত হলো? যেখানে এই পশ্চাৎপদ (বহিরাবরণে আধুনিক!) সমাজে একজন তরুণকে পথচলায় রাশ টেনে ধরা হয়, সেখানে একজন তরুণী বা কিশোরীর থিয়েটারচর্চার পথ কি আরো রুদ্ধ করে দেয়া হয় না? বর্তমান চিত্র আরো ভয়াবহ! নারীরা কী পোশাক পরবেন, টিপ পরতে পারবেন কিনা ইত্যাকার প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করতে খড়গহস্ত হয় সমাজের একশ্রেণির নারী ও পুরুষ। শিক্ষায় বিজ্ঞানমনস্কতা থাকবে কী থাকবে না, তা-ও ঠিক করে দিচ্ছে তারা। উগ্র-ধর্মান্ধ মৌলবাদী-শ্রেণি সাধারণের কাঁধে সেই জোয়ালটা তুলে দিয়ে বেশ নিরাপদে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। রাষ্ট্রে শিক্ষানীতি নির্ধারণে তাদের আধিপত্য, পাঠ্যপুস্তকে বিষয় বদলে দিয়ে ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাসকে শিক্ষার বিষয় করে তোলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চিত্রাঙ্কন ও অভিনয় বিষয়টা বাদ দেয়ার মধ্যদিয়ে আমরা কী বার্তা পাচ্ছি? আমার কি দেখতে পাচ্ছি, অনুধাবন করতে পারছি তাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য?
সেখানে সংস্কৃতিবান্ধব শাসকশ্রেণির ভূমিকা কোথায়! শূন্যের কোঠায়। যেখানে একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে কিছু অর্বাচীনের কথায় গ্রেপ্তার করা হয়, সেখানে তো তা শূন্যেরও নিচে বলতে হয়। এই দমন-পীড়ন সময়ের সত্যকে থিয়েটার লালন করে, সেখানেই ভয়।
সম্পাদকের বয়ান ও প্রাসঙ্গিকতা আর থিয়েটারচর্চার মানসগঠন
সৌখিন থিয়েটারচর্চার মানসগঠন ও জগৎ তৈরির কারিগর ও স্বাধীনতা পূর্ব-উত্তর পথচলার সালতামামি রয়েছে হাসান শাহরিয়ারের লেখায়। তারপর মূললক্ষ্য বা মূলকথায় যা অবতারণা করেন তা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। আমার লেখায় এর পুনরাবৃত্তি তাই অপ্রয়োজনীয়। এক্ষণে এ কথা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যে, এ কাজটায় তিনি অতীতের নথি, অগ্রজদের বিচ্ছিন্ন-ভাষ্যের গ্রন্থিত অগ্রন্থিত তথ্য আমাদের অবগত করেন। এবং তার ধারাবাহিকতা তৈরি করেন। আমরা চোখ বন্ধ করে সব দেখতে পাই বা কৌতূহলী হলে আরো এগিয়ে সামনে দেখার পথ তৈরি হয়।
মানুষের থিয়েটারচর্চার এই মানস-জগৎ একদিনে তৈরি হয় নি। থিয়েটারওয়ালার সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার তার বয়ানে এই বঙ্গে থিয়েটারের বিস্তার (লোকনাট্য বা মিলনায়তনকেন্দ্রিক শহুরেনাট্য) আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছেন।
এদিকে সম্পাদকের লেখা পাঠ করতে করতে অতীতের স্মৃতিতে মন ভারাক্রান্ত হয়। মানুষের শৈশব-জগৎ কি তবে আপন-জগৎ গড়ে নেয়ার ভিত তৈরি করে! হয়ত করে। নয়ত এক্ষণে সেই ছোট্ট থানা শহরের (আজকের শহর বলতে যা বোঝায়, তার সুযোগ-সুবিধাহীন স্থান) কথা মনে পড়বে কেন! সিলেটের বড়লেখা, পাহাড়ের ঢালে বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে আমাদের বাসা। একদিন সন্ধ্যাবাতি জ্বালাবার পূর্বমুহূর্তে বাবা মাকে জানালেন আমাদের ভাইবোন সকলকে নিয়ে বেড়াতে যাবার পোশাক পরে নিতে, দূর্গা পূজা দেখতে যাব। শীতের সন্ধ্যা। সেদিন কোনো বাহন ছিল না, আমাদের বেশ অনেকটা পথ হেঁটেই যেতে হয়েছিল। যখন পূজামণ্ডপে পৌঁছলাম সে এক বিস্ময়! ধূপ-ধুনার মধ্যে হ্যাজাক (পেট্রম্যাক্স) বাতির আলোতে পূজামণ্ডপ যেন রহস্যঘেরা এক জগৎ। ঢাকের শব্দ, মানুষের মুখ-নিসৃত ধ্বনি, আলো-আঁধারী তার সাথে ধূপ হাতে নৃত্যরত মানুষ। আলো, ধূপের ধোঁয়া আর মানুষের দেহ-ভঙ্গিমা সব মিলিয়ে যে আবহ তৈরি করে তা এই সময়ের যেকোনো উল্লেখযোগ্য নাটকের নাট্যমুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সাথে বাড়তি পাওয়া ফলাহার ও মিষ্টান্ন। এখানেই শেষ নয়। কিছুক্ষণ পর উদ্যোক্তারা জানালেন, পালাগান হবে, মহিষাসুর বধ পালা। আমাদের দেখেই যেতে হবে। রাত বেড়ে চলেছে, ঘরে ফেরার তাড়া আছে, তবুও বাবা আমাদের নিয়ে পালাগান দেখতে বসে রইলেন। পালা কী? এমন ধারা শব্দের সাথে প্রথম পরিচয়। বাবা জানালেন, অভিনয় হবে। অভিনয় শব্দটার সাথেও সেইদিন পরিচয়। অপার বিস্ময়ে দেখেছিলাম পালা। সংলাপ-গানে-বাদ্যে মানুষের চলনে-বলনে একের পর এক দৃশ্য বললে যাচ্ছে, গল্প এগিয়ে যাচ্ছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে শৈশবমনে গল্পের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করতে হয়ত খেই হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্টতই বুঝতে পারা গিয়েছিল, দশভূজা নারী মানবকুলকে রক্ষায় এক রূপকথার দৈত্যকে কীভাবে প্রতিহিত করে। সেদিনের স্মৃতির উজ্জ্বলতা এতটুকু ম্লান হয় নি। এবং শৈশবের সেই অপার কৌতূহলই হয়ত একজন শিশুর মানসপটে আগামীদিনে পথচলার পথ তৈরি করে। এভাবেই হয়ত আজকে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো করে স্বার্থহীন ত্যাগী থিয়েটারের মানুষ তৈরি হয়েছে। এবং আমরা পাই নাটকের উজ্জ্বল কিছু প্রযোজনা। তার ব্যতিক্রমও রয়েছে, রয়েছে বলেই থিয়েটারের মানুষদের নিয়ে এত কথা!
ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা ও আমাদের বাতচিৎ
ঐ যে শুরুতে তির্যক-চাহনির প্রসঙ্গ টেনেছিলাম, সে নিয়ে তো বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের ভেতর-বাহিরে দীর্ঘদিন ধরে টানাপোড়েন চলছে। কিন্তু তাতে কি থিয়েটারে কোনো খামতি হয়েছে! হয় নি। তবুও ঘুরে ঘুরে এই প্রসঙ্গ থিয়েটারি আড্ডায় আর থিয়েটারের বাইরে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেরও অনেক সময় কেড়ে নেয়। এটাই সমস্যা। থিয়েটারওয়ালা’র সম্পাদকও তাই স্থির থাকতে পারেন নি। এদিকে আবার জানা যায়, থিয়েটারকর্মীরাও (সকলকে এক কাতারে ফেলার জন্য দুঃখিত। বিশেষ বিশেষণে ভূষিত না করে সকলের ইতিবাচক-ভূমিকার জন্যই ‘কর্মী’ উল্লেখ করলাম। আবার আমরা এও জানি কেউ কেউ আছেন, যাদেরকে বিশেষ বিশেষণে ভূষিত না করলে ওনাদের মনে গোস্বা হয়) বসে নেই। চলমান ঘটনার গুরুত্ব ও এর দায় এবং সামনের পথ চলার দিকনির্দেশনা নিয়ে সকলেই কমবেশি চিন্তিত। যদিও আমাদের অনেকেই ফেডারেশানের অতীত কর্মকাণ্ডের জন্যে ফেডারেশানের প্রতি আস্থাশীল নন। এবং ফেডারেশানের ভূমিকা ছাড়াই নিরবচ্ছিন্নভাবে থিয়েটারচর্চা করে যাচ্ছেন। তবু তারা কথা বলছেন, ভাঙতে চাচ্ছেন অচলায়তনের চক্রব্যূহ। এটা আশার কথা। কারণ, যে আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে ফেডারেশানের গঠন, তাতে ঘুণপোকা বাসা বেঁধেছে। সংগঠনের আদর্শ-উদ্দেশ্যের চাইতে ব্যক্তি-ইচ্ছে চরিতার্থের প্রবণতাই কি এর মূল! তাই আমাদের কারো কারো মনে এই জাতীয় সংগঠনের নেতৃত্বের প্রশ্নে তাদের (ব্যক্তির) মানসগঠন ও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের প্রবণতা ও সৃজনশীলতা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন বিদ্ধ হয়।
গত জুন ০৯ জুন, ২০২২ তারিখে নজরে এল আমাদের শ্রদ্ধাভাজন নাসির উদ্দীন ইউসুফের একটা চিঠি। চিঠিটা তিনি পাঠিয়েছিলেন ফেডারেশানের সভাপতি বরাবর। কবে পাঠিয়েছিলেন তার তারিখ পাওয়া যায় নি। কিন্তু ফেসবুক পোস্টের প্রারম্ভে তিনি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছেন দুইমাস পূর্বে চিঠিটা ফেডারেশানের সভাপতি মহোদয়ের নিকট পাঠিয়েছিলেন। সেই চিঠির কোনো প্রতিউত্তর তিনি আজও পান নি। হয়ত তিনি চিঠির উত্তর পাবার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেন নি বা চিঠির বিষয়বস্তু ফেডারেশানের বর্তমান সাংগঠনিক কমিটির কাছে কোনো গুরুত্বই বহন করে না। আমরা আরো দেখতে পাই প্রাসঙ্গিক কারণে শ্রদ্ধাভাজন রামেন্দু মজুমদার একটা খোলা চিঠি (২৩-০১-২০২২) লিখেছেন।
আমরা জানি, ফেডারেশানের চলমান সংকট আর নেতৃত্বে থাকা পরিষদের পরস্পর পরস্পরকে নৈতিকতা ও আর্থিক-লেনদেনের সচ্ছতার অভিযোগের প্রেক্ষিতেই অগ্রজদের কলম সচল হয়েছিল। চলমান উক্ত চিঠি নিয়ে নাট্যকর্মে যুক্ত আমাদের সহযোদ্ধাদের মধ্যে বেশ ইতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। কিন্তু তারও কোনো প্রভাব কোথাও দেখা যায় নি, যাচ্ছে না। কারণ, আমাদের চোখ তো ক্ষমতার কেন্দ্রে। সেখানে যতদিন অধিষ্ঠিত থাকা যায় তারই চেষ্টায় নিরন্তর সচেষ্ট আমরা। সুতরাং কে কোথায় কী বলল না বলল, কে চিঠি লিখল না লিখল, তাতে মাথা না ঘামিয়ে আপনাকর্মে থাকি মশগুল। তাতে যদি দু-চারটা নিন্দাবাক্য উচ্চারিত হয় হউক, না শোনার না দেখার ভান রপ্ত করে যেমন চলছি তেমন চলব। যদি কেউ স্বেচ্ছাচারী বলে বলুক না, তাতে কী আসে যায়।
ফেডারেশানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বনাম বর্তমান হালচাল
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান প্রতিষ্ঠার কার্যকরণ ও পরবর্তীকালে তার কাজের ধারাবাহিকতার বিশদ বিবরণের মধ্যদিয়ে সম্পাদক আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, ফেডারেশান কীভাবে তার কর্মপরিধি পরিবর্তন করেছে এবং ফেডারেশানকে একটা চোখ-কান-মুখহীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দেয়া হয়েছে। প্রতিবাদ-আন্দোলন-সৃজনের নান্দনিক-কর্মে তার কোনো অংশগ্রহণ থাকে না।
আমাদের ‘জাতীয় নাট্যশালা’ রয়েছে এই ভেবে আমরা বেশ তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। অথচ জানি না তার রূপরেখা-নীতিমালা কেমন হবে। জাতীয় নাট্যশালার রূপরেখা-নীতিমালা কেমন হওয়া উচিত তা তৈরি করা এবং এ নিয়ে রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে বোঝাপড়া করার কোনো উদ্যোগ নিতে ফেডারেশানকে কখনো দেখা যায় নি। কারণ, তাতে সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের হাতের বাইরে চলে যায় ‘জাতীয় নাট্যশালা’। যখন-তখন যে কোনো অনুষ্ঠানের নামে এই প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের এখতিয়ার হারাতে হয়। আর আমরা তো ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে কিছু খুদকুড়ো পেতে চাই, আজ্ঞাবহ দাস হওয়াই যেন আমাদের মূললক্ষ্য। তাই, কোনোভাবেই এই সব দেনদরবার নিয়ে সরকারের বা রাষ্ট্রের কোনো মন্ত্রণালয়ের কাছে যাওয়া চলে না। তাতে যে বিরাগভাজন হবার সম্ভাবনা প্রকট।
অন্যদিকে, কার কাছে কে যাবে! ফেডারেশান তার দাবি বা ইচ্ছে-অনিচ্ছের কথা নিয়ে কার দ্বারস্থ হবেন, সেখানেও তো একই ব্যক্তি। তাহলে একুল ওকুল দুইকুলই রক্ষা হউক, সরকারের তল্পিবাহক নেতৃত্বের এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
‘আমাদের মঞ্চ আমরাই গড়ব’ এই স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান দীর্ঘদিন বিভিন্নস্থানে দর্শকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। যতদূর জানা যায়, এজন্যে ব্যাংক একাউন্টও খোলা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীসময়ে সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তন হলে সেই স্লোগান আর শোনা যায় নি। দর্শকের কাছ থেকে আর অর্থও সংগ্রহ করা হয় নি। বরং সেই ব্যাংক একাউন্টের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না, সব তামাদি হয়ে যায়। কিন্তু আমরা কেউ জানতেও চাই নি, কেন এমনটা হলো, কার সময়ে (নেতৃত্বে) হলো। এভাবেই শুরু হয় অস্থিরতা এবং তারই ধারাবাহিকতায় এই অচলবস্থা।
আমরা যদি দৃষ্টি ফেরাই থিয়েটার সংগঠনগুলোর দীর্ঘদিনের সাংগঠনিকচর্চার দিকে, তাহলে দেখতে পাব সেখানেও রয়েছে একধরনের এককেন্দ্রিকতা-স্বেচ্ছাচরিতা। রয়েছে বৈষম্য। দলের ত্যাগী কর্মীর প্রতি কেমন ধারা রীতি-নীতি প্রয়োগ হচ্ছে সেখানে? কে প্রিয়ভাজন, কে চাটুকার-তোষামোদকারী, কে সংগঠন প্রধানের প্রয়োজন মেটাতে পারঙ্গম, সেটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তার না থাকুক সৃজন-মনন ক্ষমতা, না থাকুক জ্ঞানের পরিধি, না থাকুক নৈতিকতা। এই চিত্রও তো বর্তমান। সুতরাং আমরা যারা পর্যায়ক্রমিক ফেডারেশানের নেতৃত্বে এসেছি, তারা কি নিজ নিজ ভূমিকা একটু পর্যলোচনা করব? কারণ হঠাৎ করেই তো ফেডারেশানের এই অবস্থা তৈরি হয় নি। কারো কোনো একটা পদক্ষেপ এই বীজ রোপন করেছিল। এভাবেই একের পর এক পদক্ষেপই ফেডারেশানকে অথর্ব সংগঠনে পরিণত করেছে। ফেডারেশানের পথচলায় দীর্ঘকাল পর দেখা যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি চর্চিত হচ্ছে। তাছাড়া রয়েছে প্রভাব-বলয় তৈরির চেষ্টা, তাতে করে স্বেচ্ছাচারিতার পথ সুগম হয়। প্রভাব-বলয়ের ক্ষেত্র বিস্তৃত করার জন্য কোন সংগঠনকে সদস্য করা হবে, কোন সংগঠনকে সদস্য করা হবে না তা বিচার্য হয় এবং তা নিয়ন্ত্রিত হয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির ইচ্ছের উপর। কারণ, ভোটের রাজনীতিতে যে এর বড়ো প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়াও চর্চিত। আমাদের রাষ্ট্রিক রাজনৈতিক দলগুলোতে যে গণতান্ত্রিক (?) প্রক্রিয়া প্রচলিত, সেই প্রক্রিয়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। এ ছাড়া কে কতটা এবং কোন সাংস্কৃতিক-সংগঠন কতটা ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তিতে যুক্ত হতে পারে তার প্রতিযোগিতাও বেশ কৌতুককর। এভাবেই ফেডারেশান এ দেশের চলমান রাজনৈতিক দলগুলোর চরিত্রের আদল লাভ করে।
কিন্তু তবু কিছু মানুষ রয়েছে যারা প্রচলিত স্রোত-ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে যুক্ত হন কর্মে, থিয়েটারে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও নিজের দিকেই থুথু ছুঁড়ে দেয়া
সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমাকে ফেডারেশানের ‘প্রশিক্ষক সম্পাদকে’র দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। সে সময়ের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি, ব্যক্তির নাম অনুল্লেখ রেখে। ‘স্বল্প ব্যয়ে নতুন স্থানে নতুন নাটক’ শিরোনামে ফেডারেশান থেকে বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। একটা বিভাগীয় শহরে কর্মশালা শেষে যে আর্থিক খতিয়ান পাওয়া যায় তার জন্য ততধিক খাতে ততধিক পরিমান অর্থ বরাদ্দ ছিল না। যে খাতগুলি স্থানীয়ভাবে সমাধান করার কথা ছিল, স্থানীয় উদ্যোক্তা সে সকল খাতও যুক্ত করেছেন, যুক্ত করেছেন অনির্ধারিত খাতও। এমনকি প্রশিক্ষকের থাকার বিল হিসেবে যে হোটেলে তিনি অবস্থান করেছেন তার চেয়ে বেশি কক্ষভাড়া সম্পন্ন হোটেলের বিল পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ ভাড়া বেশি ধরা হয়েছে। তখন এ-ও বুঝতে বাকি রইল না, অন্যান্য যে সকল খাত দেখানো হয়েছে তাতেও হিসাবের বেশ অনেকটা গরমিল রয়েছে। সেই ব্যক্তি বেশ ক’বার বিলটা পরিশোধ করতে বলেছিলেন কিন্তু আমি পরিশোধ করতে পারি নি। কারণ, বিলে সাধারণ সম্পাদক মহোদয়কে স্বাক্ষর দিতে বলেছিলাম, তিনি এর দায় নিতে চান নি। সেই বিলটা পরবর্তী নতুন কমিটির কাছে সকল তথ্যসহ হস্তান্তর করি। এই একটা ক্ষুদ্র বিষয় থেকে বোঝা যায় আমাদের কিছু মানুষের মধ্যে কতটা নৈতিক-স্খলন ঘটেছে। এই ধারা ক্রমাগত কি প্রশস্ত হয়েছে! আমরা বুঝতে পারি না কেন অর্থ সম্পাদকরা ফেডারেশানের সম্মেলনে তাদের হিসাব দাখিল করতে ব্যর্থ হন। কেন আমাদের প্রিয় মানুষদের কাছে লজ্জায় তাকাতে পারি না, মস্তক অবনত করতে হয়। কিন্তু যাদের দিকে তর্জনি নির্দেশ করা আছে, অন্যায়ের দায়ভার নেবার কথা যাদের, তাদের তো অবনত মস্তকে চলতে দেখি না! দেখি সেই সকল মানুষরা দন্তবিকশিত হাসিতে ফেসবুক জুড়ে নিত্যদিন বিরাজমান!
পরিমিতবোধহীনতা ও ডুগডুগি বাজানেওয়ালার দল
পরিমিতিবোধহীনতার প্রসঙ্গে ফিরে আসতে বাধ্য হই। কারণ, আমরা বধির ও অন্ধ হতে পারি না। আমরা দেখতে ও শুনতে পাই। আজকাল তো একটা কথার বেশ চল হয়েছে, নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হবে। ফেসবুক খুললে তা আকছার দেখা যাচ্ছে। এবং আমরা দেখতে পাই, যখন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হতে শুরু করে, তখন কিছু মানুষ সুবিধাভোগীর তালিকায় যুক্ত হবার জন্যে কী প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফেসবুক জুড়ে নিত্যদিন ব্যক্তি-পূজার গুণপনা, মিথ্যাকে সত্য আর সত্যকে মিথ্যার মোড়কে মোড়াবার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারীরাও পিছিয়ে নেই। রয়েছে স্ববিরোধীতা। প্রশ্ন তাদের কাছে, এই দায় কেন! কারণ বোধহয় অস্তিত্বের সংকট। আত্মপরিচয়ে বাড়তি কিছু যুক্ত করার বাসনা। তাই নিজের পরিমিতিবোধের তোয়াক্কা না করে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পরেন।
নিজের মুখটা নিজেই চিনে নাও
প্রতিদিন যে আয়নায় নিজেকে দেখি তা আসলে নিজেকে দেখি কি? না দেখি না। নিজেকে দেখার সেই চোখ কোথা! বা সময়ইবা কোথা সেই চোখ অর্জনের। প্রতিদিন সকাল হলেই আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাই না, তার ভাষা বুঝতে পারি না বা বুঝতে চাই না। কারণ, নিজের প্রতিবিম্বে নিজেই মুগ্ধ। অন্যের কাছে আপন মহিমা তুলে ধরতে নিজের ঢাক নিজেই হাতে তুলে নিয়েছি। গড়ে তুলেছি একটা পোষ্য-স্তাবকশ্রেণি বা হয়ে উঠেছি তেমনি। থিয়েটারে বিষয়-প্রযোজনা-নান্দনিকতায় কতটা কালকে অতিক্রম করার মননশীল প্রচেষ্টা রয়েছে তা মুখ্য নয়। জীবনাচারেও তাই। নিজের মুখ নিজেই চিনে নেবার, জেনে নেবার চোখের সুলুক কবে পাব?
সুলুক সন্ধানের সুলুক
এ এক ধাঁধার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল সম্পাদক। বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন! থিয়েটার কি থেমে আছে! ফেডারেশান কি আপনার থিয়েটারচর্চার প্রাণশক্তি! প্রাণশক্তি হউক বা না-হউক কিন্তু মিলনায়তন-মহড়াকক্ষ বরাদ্দ না দিয়ে তো আপনার থিয়েটারচর্চার পথ সংকুচিত করতে পারে। কিন্তু বিকল্পও রয়েছে। তাই এক্ষণে একটা কথাই সর্ব-অর্থে সত্য বলে বোধ হয়। থিয়েটার করতে হবে, সে থিয়েটার হতে হবে মানুষের জন্য, জীবনের জন্য এবং শিল্পের সকল শাখার আধার হয়ে বহুমাত্রিকতায়। থিয়েটারের পথ রুদ্ধ করা সহজ নয়, কারণ থিয়েটারের নিজস্ব শক্তি রয়েছে। আমরা, এই মানুষরাই তো থিয়েটারের সত্যিকারের চালিকাশক্তি। প্রয়োজনে থিয়েটারের মানুষদের সম্মিলিত অংশগ্রহণে হবে প্রতিবাদ-দাবি-আন্দোলন। সেটাই একমাত্র পথ। এবং এই প্রয়োজন যার বোধ-চেতনায় জাগ্রত হবে সে-ই হয়ে উঠবে এর অংশ।
কিন্তু এ জন্য নতুন কোনো সংগঠন কাম্য নয়। কারণ, কে বলতে পারে যে ঐ সংগঠন হয়ে উঠবে না আরো একটা ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’!
ফয়েজ জহির ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): প্রশিক্ষক-ডিজাইনার-নির্দেশক