Full premium theme for CMS
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন : কিছু ভাবনা
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
‘থিয়েটারওয়ালা’ সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ শীর্ষক নিবন্ধটি বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চার বর্তমান বাস্তবতা বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ। চার দশকেরও বেশি সময়ের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সংবেদনশীল সংগঠনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, দায়িত্ব এবং অর্জন-ব্যর্থতার বিশ্লেষণ রয়েছে এ নিবন্ধে। সেই সাথে আগামী দিনে ফেডারেশান কীভাবে আরো সক্রিয় হতে পারে বা থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট-কর্মকাণ্ডে ফেডারেশান কীভাবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, তার দিক-নির্দেশনাও বলা হয়েছে। নিবন্ধটি প্রত্যেক থিয়েটারকর্মীর জন্য অবশ্য-চিন্তার খোরাক হবে বলে আমার বিশ্বাস।
নিবন্ধের শুরুতেই ফেডারেশান-সম্পর্কিত আলোচনা-সমালোচনা এবং সম্প্রতি আর্থিক-দুর্নীতির কারণে ফেডারেশানের দুজন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাহীকে বহিষ্কার-প্রসঙ্গের অবতারণা করে হাসান ভূমিকায় বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর রচনার মূল-উদ্দেশ্যের সাথে কার্যকারণ হিসেবে এই গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অবতারণা অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ মনে হয়েছে। তবে, সারা বাংলাদেশের থিয়েটারকর্মীদের আশা ও আশ্রয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের ‘সংস্কার’ বিষয়ে কথা তোলার গুরুত্ব বোঝতেই হয়ত নিবন্ধকার বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার-প্রাসঙ্গিক দীর্ঘ এই ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করেছেন।
এই নিবন্ধের প্রথম লাইনে যা বলা হয়েছে সেটিই এই নিবন্ধ রচনার প্রেক্ষিত হিসেবে মোদ্দাকথা। ঢাকা পদাতিকের জ্যেষ্ঠ অভিনেতা মাসুম আজিজ সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে লাইভ ভিডিওতে গ্রুপ থিয়েটার প্রতিষ্ঠাকালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সামনে পশ্চিম-বাংলার প্রখ্যাত নাট্যজন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের সাথে আলাপচারিতার স্মৃতি টেনে এনে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন বলে জানিয়েছেন। তারমানে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এর প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে সংশয়-সমালোচনা ছিল। তারপরও প্রতিষ্ঠার পর অন্তত নির্বাচনকেন্দ্রিক ফেডারেশানের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পূর্ব-পর্যন্ত ফেডারেশানের কার্যক্রমে একধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট-পরিস্থিতিতে ফেডারেশানের যে সংগ্রামী ও স্বেচ্ছাসেবী ভূমিকা তা নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফেডারেশানের প্রগতিশীল এই ভূমিকা শ্রদ্ধেয় ও স্মরণ-যোগ্য। যদিও হাসান তার নিবন্ধে ফেডারেশানের সংগ্রামী ভূমিকা সেভাবে স্বীকার করতে চান নি। তিনি বলেছেন: ‘৮০-র দশকের স্বৈরশাসনবিরোধী যে আন্দোলন, সে আন্দোলনে নাট্যদলগুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণের পেছনে ফেডারেশানের সাফল্যের চেয়ে তখনকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক-আন্দোলন-বাস্তবতাই বেশি অবদান রেখেছে’। আমার বিবেচনায় সাংস্কৃতিক-আন্দোলনের সেই বাস্তবতার প্রেক্ষিত রচনায় ফেডারেশানের মাধ্যমে নাট্যকর্মীদের যূথবদ্ধতার শক্তির যে উন্মেষ, তা নিশ্চয়ই সে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা তৈরি করেছিল। রাজপথে সাংস্কৃতিক-আন্দোলনের অগ্রসৈনিক ছিল নাট্যকর্মীরা, আর তা সংগঠিত করেছে ফেডারেশান। একই বাক্যে ব্র্র্যাকেটবন্দি করে হাসান লিখেছেন: “অনেক পরে দেখা গেছে, আন্দোলনের-ক্ষেত্র প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও, ‘রাজনৈতিক দাসখতচর্চা’র কারণে, নাট্যদলগুলোকে প্রতিবাদ করা থেকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে”। তার এই ব্র্র্যাকেটবন্দি বাক্যটি অতীব গুরুত্ববহ। গত দুদশকে ফেডারেশানের স্ট্যাব্লিশমেন্ট-বিরোধী সংগ্রামী তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়ে না। বর্তমান এবং বিগত দুই মেয়াদ ফেডারেশানের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক একই ব্যক্তি (যদিও তিনি সৃজনশীল-ব্যক্তিত্ব হিসেবে যোগ্য ও শ্রদ্ধেয়) হওয়ায় নাট্যদলগুলোর সমস্যাদি নিয়ে ফেডারেশানের সাথে সরকারের দর-কষাকষির সুযোগ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। হাসানের নিবন্ধেও তার উল্লেখ আছে। ফলে ফেডারেশানের ‘তথাকথিত’ নির্বাচনকেন্দ্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা সৃজনশীল সুনেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথটি হারিয়ে ফেলেছি, একইসাথে হারিয়ে ফেলেছি ফেডারেশানের সংগ্রামী চেতনাটিও। ফেডারেশানের নেতৃত্ব নির্বাচনের এই গণতান্ত্রিক পন্থাটিকে আমার ‘তথাকথিত’ বলার কারণ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
নাট্যকর্ম যদি শিল্প (Art) হয়, তবে নিঃসন্দেহে এখানে সৃজনশীলতাই মুখ্য। একটি নাট্যদলের প্রায়োগিক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মূল-সমস্যাগুলো মর্মে মর্মে অনুভব করেন দলের সৃজনশীল ব্যক্তি (যেমন: নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, আলোক-পরিকল্পক, মঞ্চ-পরিকল্পক ইত্যাদি)। তারা যদি বেশি বেশি ফেডারেশানের নেতৃত্বে থাকেন, তবে উত্তম। গত দুদশকে ফেডারেশানের কর্মকাণ্ডে সৃজনশীলতার অভাব প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। তারমানে ভোট দিয়ে নাট্যদলগুলো যে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছে, এই দায় সেই নেতৃত্বেরই নিতে হয়। হাসানের নিবন্ধ-ভাষ্যে ফেডারেশানের এই অন্তঃস্বারশূন্য নেতৃত্বের কথাই বেরিয়ে এসেছে।
ফেডারেশানে দলের ‘প্রতিনিধি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ফেডারেশানের ফোরামে ভোট বা মত প্রকাশের একমাত্র অধিকার থাকে এই প্রতিনিধির। তিনি যদি সৃজনশীল ব্যক্তি না হন, তবে তার ভূমিকা ফেডারেশানকে দুর্বল করতে বাধ্য। এই ‘প্রতিনিধি’ই ফেডারেশানে একটি নাট্যদলের সর্বময় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আমরা লক্ষ করছি , ফেডারেশানের নেতৃত্ব-নির্বাচনে দলের প্রতিনিধি সৃজনশীল হোন বা না হোন, তার ভোট কিন্তু একটিই। যদি মামুনুর রশীদ ফেডারেশানে তার দলের প্রতিনিধি হন, তার যেমন একটি ভোট, তেমনি যেকোনো নাট্যদলের সাধারণ একজন কর্মী যদি প্রতিনিধি হোন তারও ভোট একটি। কিন্তু দুজনের দায়িত্বশীলতা, বুদ্ধি-বিবেচনা, সৃজনশীলতা কি এক? একটি শিল্প-সংক্রান্ত ফেডারেল বডির প্রতিনিধির (যিনি নেতাও নির্বাচিত হতে পারেন) যোগ্যতার এই গড়পড়তা হিসাব যে কতখানি বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী, তা আজকের বাস্তবতায় প্রমাণিত। ফেডারেশানের গত কয়েকদফা নির্বাচনকালে দেখা যাচ্ছে নেতা হতে আগ্রহী প্রার্থীগণ সারাদেশে বিভিন্ন নাট্যদলের ঐ একজন প্রতিনিধির সাথে মরিয়া হয়ে যোগাযোগ করছেন ভোটের প্রত্যাশায়। ভোটাভুটির এই চর্চায় নাট্যদলের চেয়ে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রার্থীর কাছে। ফলে নির্বাচনপ্রার্থী-নেতার পুরো নাট্যদলের সমস্যা জানার সুযোগ হচ্ছে কম। শুধু তাই নয়, ঐ একজন প্রতিনিধিকে যেকোনো প্রকারে (অনৈতিকভাবে হলেও) নিজের পক্ষে টানার চেষ্টা প্রবল হয়ে উঠছে। নাট্যজন মাসুম আজিজ তার লাইভ ভিডিওতে এই একব্যক্তির (প্রতিনিধি) মত যে পুরো দলের মত নয়, তা স্পষ্ট করেছিলেন। ফেডারেশানে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিকচর্চার একটি ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় ফেডারেশানের নেতা (দলের প্রতিনিধি) বা নেতা না হলেও যিনি প্রতিনিধি, ফেডারেশান প্রসঙ্গে তিনি যা বলেন, দলের সাধারণ নাট্যকর্মী তা বলেন না। বিভিন্ন আড্ডায় বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখেছি, ফেডারেশানের কোনো নেতার বা প্রতিনিধির বিপক্ষে মত প্রকাশ করছেন ওই দলেরই নাট্যকর্মী। নিবন্ধে হাসান উল্লেখ করেছেন: ‘ফেডারেশান টিকে আছে ৩৩৬টি দলের প্রতিনিধি হিসেবে। সুতরাং তার টিকে থাকার অধিকার নেই, এমত বলা প্রায় গণতান্ত্রিক-ভাবনাচিন্তাকে বিসর্জন দেয়া। [...] ফেডারেশান গত কয়েকমাসে যে বিভাগীয় সম্মেলন করেছে, সেখানেও প্রায় সব নাট্যদলের অংশগ্রহণ ছিল।’ এ-ই যদি সত্য হয়, তবে নাট্যদলগুলোর প্রতিনিধিরা ফেডারেশানের গুরুত্ব ও মহিমা দলের সাধারণ নাট্যকর্মীদের বোঝাতে ব্যর্থ হচ্ছেন। নতুবা সাধারণ নাট্যকর্মীদের মধ্যে ফেডারেশান নিয়ে এত অসন্তোষ অভিযোগ থাকবে কেন? ২০২১ সালের ১৭, ১৮ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে ‘তির্যক’ আহুত বাংলাদেশের সৃজনশীল নাট্যজনদের এক সম্মিলনে প্রবীণ নাট্যজন শিশির দত্তসহ অনেকেই বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বর্তমান অবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন। ফেডারেশানের কর্মকা-, বর্তমান অবস্থা নিয়ে দেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যে যে চাপা ক্ষোভ, হতাশা ও অসন্তোষ আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ‘গণতান্ত্রিক ভাবনা-চিন্তা’কে বিসর্জন নয়, বরং তার দুর্বলতা থেকে উত্তরণ নিয়ে কথা বলা জরুরি।
হাসান শাহরিয়ার মূলত ফেডারেশানের গঠনতান্ত্রিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গত ৩০/৪০ বছরে ফেডারেশানের যে ব্যর্থতা তা পরিষ্কার করেছেন। ফেডারেশানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে তিনি বাস্তবতা-বিবেচনায় সীমিত ও অর্জনযোগ্য করার সুপারিশ করেছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে আরো বলেছেন: ‘থিয়েটারচর্চায় সৃজনশীলতা-টিকিয়ে-রাখা এবং এগিয়ে নেয়ার কাজটি করবে নাট্যদল(গুলো), ফেডারেশান কেবল ওই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়াবে।’ তার এই মতের সাথে আমি একমত। সহযোগিতার উদাহরণস্বরূপ তিনি বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট চমৎকার প্রস্তাবনা দিয়েছেন। তারপর তিনি যে প্রস্তাবটি দিয়েছেন, তা সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতার নিরিখে তিনি বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান-এর কাঠামো সংস্কারের যে প্রস্তাব করেছেন, তা কৌতূহল উদ্দীপক এবং সমর্থনযোগ্য। শ্রদ্ধেয় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার সাম্প্রতিক-প্রেক্ষাপটে ফেডারেশানের বর্তমান কমিটি ভেঙে দিয়ে এডহক কমিটি করে সংকট নিরসন করা যেতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তার মতকে বাংলাদেশের বিদগ্ধ বহু নাট্যজন প্রকাশ্যে সমর্থন করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফেডারেশানের বর্তমান কমিটি তা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাবেক নেতা নাট্যজন শামসুল আলম বকুল, রামেন্দু মজুমদারের প্রস্তাব সমর্থন করে এডহক কমিটির মাধ্যমে ফেডারেশানের কাঠামো পরিবর্তনের প্রস্তাব করে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন: ‘[...] এডহক কমিটির প্রধান কাজ হওয়া উচিত ফেডারেশানের সামগ্রিক-কাজের একটি বিশ্লেষণাত্মক মূল্যায়ন করা এবং থিয়েটারে contribute করতে পারে বা value add করতে পারে এমন একটি কাঠামো খুঁজে বের করা।’ আমার ধারণা, হাসান শাহরিয়ারের এই নিবন্ধ এডহক কমিটির মূল্যায়ন এবং কাঠামো-অন্বেষণে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। বকুল আরো লিখেছেন: ‘[...] বর্তমান কাঠামো হলো Power Politics এক কাঠামো, নাট্যচর্চার জন্য এটি কতটা সঠিক তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। এই কাঠামোতে প্রকৃত নাট্যকার, নির্দেশক বা অভিনেতাদের contribute করার কিছু নাই, কিন্তু যারা থিয়েটার নিয়ে Politics করতে চান, তাদের রয়েছে নানা সুযোগ।’
নিবন্ধের একপর্যায়ে হাসান শাহরিয়ার যুক্তি প্রদান করে কাঠামো-পরিবর্তন করার বিষয়ে বলছেন: ‘থিয়েটারচর্চায় স্থানীয়ভিত্তিক সমস্যাগুলো সমাধানে জাতীয়ভিত্তিক ফেডারেল বডির কার্যত কোনো ভূমিকা নেই। তাই স্থানীয়ভাবে দলগুলোর ফেডারেল বডি হতে পারে, যারা স্থানীয়ভাবে নাট্যচর্চার সমস্যা-সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ স্থানীয় ফেডারেল বডির তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, যেমন: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, ঢাকা; গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান, রংপুর ইত্যাদি হতে পারে। তিনি জাতীয়ভাবে ‘বাংলাদেশ’ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রয়োজনীয়তা দেখছেন না। বরং জাতীয়ভাবে এরকম সংগঠন যে ক্ষমতাদর্পে সমস্যা সৃষ্টি করে, তা যুক্তি দিয়েই বলার চেষ্টা করেছেন। মাসুম আজিজ ও শামসুল আলম বকুলের বক্তব্যও তা সমর্থন করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ফেডারেশানের কাঠামো-সংস্কারে হাসান শাহরিয়ারের এই মতের সাথে একমত পোষণ করে বলতে চাই, স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত ফেডারেশানসমূহের একটি সমন্বয় কেন্দ্রীয়ভাবে করা যেতে পারে। ফেডারেশানের বর্তমান গঠনতন্ত্রে যে সাম্মানিক সদস্য পদ আছে, তাদেরই একজন নির্দিষ্ট সময় অন্তর (ধরা যাক ৩ বছর) গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের জাতীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন। এই কমিটির নাম ‘সমন্বয় কমিটি’ বা অন্য কোনো নাম দেয়া যেতে পারে। স্থানীয় গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কোনো কর্মকাণ্ডে এই সমন্বয় কমিটি কোনো হস্তক্ষেপ করবে না, কেবল পরামর্শমূলক ভূমিকা পালন করবে। সমন্বয় কমিটিই মূলত জাতীয় বা কেন্দ্রীয়ভাবে (বাংলাদেশ) গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের কণ্ঠস্বর হবে। এই সমন্বয় কমিটির সদস্যরা হবেন থিয়েটার-সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট গুরুজন; জাতীয়ভাবে সম্মানিত এবং সুশীল সমাজের সর্বজন-শ্রদ্ধেয় নাগরিক। এই কমিটির সদস্য সর্বোচ্চ ৫-৯ জনের বেশি হবে না। তাদের ক্ষমতা বা কার্যপরিধি হবে খুবই সীমিত। তারা কেবল জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে মত প্রকাশ করবেন। জাতীয় সমন্বয় কমিটির গঠন-বিধান, কার্যপরিধি ও স্থানীয়ভিত্তিক গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের সাথে সম্পর্ক কী হবে, তা রামেন্দু মজুমদার প্রস্তাবিত ‘এডহক কমিটি’র মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানভুক্ত সদস্যদলগুলোর জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করে প্রণয়ন করা যেতে পারে।
ফেডারেশানের বর্তমানে নেতৃত্ব গঠন-প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমরা অনেকে যে শ্রম ও সময় ব্যয় করি তা অহেতুক। এরূপ নেতৃত্ব কাজের থেকে মোহ তৈরি করে বেশি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলি: এস এম সোলায়মান তখন সবেমাত্র ঢাকা পদাতিক ছেড়ে চলে এসেছেন। আমাকে একদিন ডেকে নতুন নাট্যদল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছার কথা জানালেন। ‘অন্যদল নাট্য সম্প্রদায়’ নামে ১৯৯১ সালে নতুন একটি দল নিয়ে আমরা বিপুল উদ্দীপনায় কাজ শুরু করি। এস এম সোলায়মান সেসময় ফেডারেশানের দ্বিতীয়দফা সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছিলেন। নতুন দল প্রতিষ্ঠার সময় তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘একটি নাটকের দলের মূলকাজ নাটক করা, পলিটিক্স করা নয়। ফেডারেশান এখন পলিটিক্সের জায়গা হয়ে গেছে। এসব পলিটিক্স সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে। নতুন দল কখনোই ফেডারেশানের সদস্য হবে না।’ এস এম সোলায়মানের সাথে একমত হয়েই নতুন দলটি ফেডারেশানের সদস্যপ্রার্থী হয় নি। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের দীর্ঘ-অভিজ্ঞতায় সেই নব্বই দশকেই নেতৃত্বের প্রতি তার মোহভঙ্গ ঘটেছিল। তাই তিনি স্বেচ্ছায় ফেডারেশানের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঢাকা পদাতিক ছাড়ার সাথে সাথে তাকে অবশ্য ফেডারেশানের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ গঠনতান্ত্রিকভাবে ছাড়তেই হতো। তথাপি এ বিষয়ে ফেডারেশানের বিশেষসভায় ঢাকা পদাতিকসহ অন্য কিছু দলও তাকে সদস্যপদ দিয়ে সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করেছিল বলে শুনেছিলাম। কিন্তু তিনি সেসব প্রত্যাখ্যান করে ফেডারেশান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের বর্তমান কাঠামো পরিবর্তনের পক্ষে। কাঠামোর কী পরিবর্তন হবে, কীভাবে হবে ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে হাসান শাহরিয়ারের নিবন্ধের প্রস্তাবটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা যেতে পারে। থিয়েটারচর্চাকে এগিয়ে নিতে এই পারস্পরিক আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। একথা সত্য যে ফেডারেশানের দায়িত্ব শুধু ফেডারেশানভুক্ত দলের স্বার্থ-রক্ষা নয়, বরং সামগ্রিকভাবে থিয়েটারচর্চাকে এগিয়ে নেয়া। তাই বর্তমান সংকট নিরসনে ফেডারেশানের বাইরের নাট্যদল বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরামর্শও বিবেচনায় নেয়া উচিত। ফেডারেশানের সাম্প্রতিক আর্থিক-দুর্নীতি বিষয়ে ফেডারেশানের নেতৃত্বের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধেয় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, আহমেদ ইকবাল হায়দার, মলয় ভৌমিক, মাসুম আজিজ, রাহমান চৌধুরী, মাসুম রেজা, শামসুল আলম বকুলসহ অনেকেই নানা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ ফেডারেশানের কাঠামোগত পরিবর্তনের সুপারিশও করেছেন। শিল্প-সংস্কৃতি-সম্পর্কিত সংবেদনশীল একটি ফেডারেল বডির আস্থাশীলতা, দায়িত্ব ও সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে এটির যৌক্তিক কাঠামো পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি।
মোহাম্মদ বারী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক