Full premium theme for CMS
ক্ষমতার ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও...
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
একদিন থিয়েটার বা মঞ্চনাটক কী চোখে দেখতাম আমরা, মনে করতে কতটা ঠিক পারি? কোনো একটা মনের মতো কাজকেই তো আমরা যথাসাধ্য বড়ো করে দেখি, নইলে কাজের তেমন চেতাবনি আসে না, সর্বস্ব দিয়ে সেটা করতে পারি না। এমনিতেই আমাদের জীবিকার কাজটা তো বাধ্যত বেগার খাটা, তাতে কেবল যেন দিনগত পাপক্ষয়ই হয়। বাঁচার জন্য তাই আমাদের আনন্দের কোনো কাজ খুঁজে নিতে হয়। অভিনয় বা নাটক তো মানুষের সহজাত। ছোটোবেলায় অভিনয়-অভিনয় খেলা দিয়ে যার হাতেখড়ি। তারপর নিজেরাই নানা-চরিত্রে সেজে, আসর বসিয়েছি উঠানে বা কোনো ঘরে। অভিনয়ের নানারীতি তো গ্রামদেশে চিরকালই আছে। শহরে মঞ্চনাটক কলকাতার দেখাদেখি শুরু হয়। বছরে বারকয়েক নানা উপলক্ষ্যে।
তবে স্বাধীনতার পর এই যা শুরু হলো থিয়েটারের নামে, সে তো একটা তাজ্জব কী বাত! নিয়মিত কয়েক মঞ্চে দর্শনী দিয়ে অভিনয় করা। আর তা কেবল আগের দিনের মতো সখের বিলাসমাত্র নয়। যাকে বলে গ্রুপ থিয়েটার, যে সে কথা নয়। নাটক করতে লাগে কতসব আয়োজন, মঞ্চ, আলো, সংগীত, বাদ্য, পোশাক, নানারকম সব জিনিসপত্র, সাজসজ্জা। এসব দিয়ে নাট্যনির্মাণ করে দর্শকের চোখকান, মনবুদ্ধি, আবেগ অনুভূতিতে সঞ্চার করা হয় শিল্প-রাজনীতির গভীরতর অভিভব। এই কাজ তো সকলের সাধ্য নয়, তার জন্য চিন্তাচেতনার অন্যতর মাজেজা লাগে। এভাবে একেক নাট্যদল হয়ে ওঠে একেক সাধনক্ষেত্র, মানস-শক্তিবলে পরাক্রান্ত, তাদের মধ্যে যদিও ইতরবিশেষ আছে। সমাজ-রাজনৈতিক অভ্যস্ত-মান্যতায় শিরোধার্য করি চিরকালের সে ক্ষমতারীতি। দলে যদিও ন্যায়নীতির ভাষণ ছিল একদা মুখে মুখে, আমরা সবাই একটা পরিবার। দলে সর্বেসর্বা নির্দেশকের পাশে কর্মসম্পাদকের দল ছিল, ক্ষমতা-রাজনৈতিক ঘরানায়। এহেন ক্ষমতাধর দলগুলো গঠন করে ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান’। সম্মিলিত দাবি-আদায়ের জোট। টিনের তলোয়ার নিয়ে রণ-মঞ্চভূমে অবতীর্ণ হয় তারা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আর-সবার সাথে। ‘আমাদের মঞ্চ আমরাই গড়ব’ বলে বছরকয়েক ধরে নাটুকে-নর্তনকুর্দন চলে! কত কত সব কার্যক্রম, নাট্যকল্পনায় যত যা কিছু আটানো যায় আর কি! সে সব হাতিঘোড়াবাঘ না মারলেও, ফেডারেশান বছরের পর বছর শক্তিধর হয়ে ওঠে, দেশজোড়া তার নেতৃত্ব নিয়ে রাজনৈতিক নাট্যরঙ্গ/পথনাটক অভিনীত হতে থাকে। তবে ক্ষয় আছে তো সবকিছুরই, প্রকৃতির নিয়মেই বুঝি। নাট্য বা থিয়েটার নিয়ে প্রাথমিক সেই আদর্শ-কল্প প্রেমমত্ততা কবে যে উবে যেতে থাকে কেউ তা ঠাহর করতে পারে না। দলে দলে দলবলের প্রতিষ্ঠা আর ক্ষমতা-বৈষম্য রাষ্ট্রসমাজের অনুগামী হয়। মুখেও তেমন ন্যায়নীতিরুচির উচ্চ-ঘোষণাবলি আর বলা হয় না। শিল্পনন্দনের অভ্যস্ত বুলিই কেবল একনাগাড়ে কপচানো হয়।
ফেডারেশানের পদ নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই তবু চলছে, চলবে, না জানি কত আর কী মধু আছে তাতে! মঞ্চে তেমন মনে-মননে লাগার মতো নাটকের সংখ্যা কমতে থাকে, দর্শক হাজির হয় জনাকয়েক দল বা নির্দেশকের কাজ দেখতে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে গুজগুজ, ফিসফাস চলছে তো বছরকয়েক ধরে। অকস্মাৎ পরপর তিনটা নাটকীয় ঘটনা ঘটে, মহাপরিচালক/ফেডারেশনের সভাপতির নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নোটিশ, ফেডারেশনের দুকর্মকর্তার বহিষ্কারাদেশ, প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতির ফেডারেশানের বর্তমান কমিটির কার্যক্রমের স্থগিতাদেশের আবেদনে প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদকের সম্মতি। এহেন অতিনাটকীয়, মেলোড্রামাটিক-প্রকৃত নাট্যপরিস্থিতিতে ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকার সম্পাদকের বিনীত নিবেদন, নাট্যজন সমীপে।
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, ফেডারেশানেরও তাই হয়েছে। বড়ো বড়ো সব আদর্শ-উদ্দেশ্যের উচ্চ-ঘোষণার আড়ালে ক্ষমতা ধরে রাখা, টেকানোর, বেশ একটা বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সেটা নিয়ে বলা-ভাবারও সাহস ছিল না কারো, এমনই পাকাপোক্ত, মজবুত ছিল তার বুনিয়াদ। নাট্যদলে-নাট্যদলেও যেমন ক্ষমতা-কাঠামোর নিরঙ্কুশ আধিপত্য। শিল্পে বা থিয়েটারে গণতন্ত্র চলে না বলে কায়েমি-ঘোষণা তো ছিলই। তবে ক্রমে তাতে ধস নামে, নীতির প্রশ্নে নিরাপস-ঠুলি কর্মীসাধারণের চোখ থেকে ঘুচতে থাকে, আর্থিক ও তারকায়িত নাম-কামের ভেদাভেদ কোনো নীতিকথায় আর ঢাকা পড়ে না। নাটক করে যে দেশদুনিয়া উদ্ধার করা যাবে, হেন ছেলেমানুষিতায় কেউ কাউকে তখন আর ভোলাতে পারে না। সামাজিক-উচ্চাবচ ভেদাভেদ নগ্ন-বেআব্রু হয়ে পড়ে। তার ফলে একেক দলনায়ক বা তারকার পতন হতে থাকে নাট্যজনমনে। একসময় তো রাজনৈতিক-নেতার মতো এদের এমন প্রতাপ ছিল যে, কারো মুখ খোলার সাহসও ছিল না, ‘নাট্যসমালোচনা’ বলে তাই তো কিছু দাঁড়ায় নি বাংলাদেশে। জনমনে থিয়েটার বা নাটকের সামাজিক-মানসিক পতন বুঝি ঘটে গেছে, নাটক মানে মিডিয়ার নাটকই বোঝে এখন বেশিরভাগ মানুষ। জনাকয়েক নাট্যাভিমানী অভিজাতের প্রান্তিক-সৌখিনতায় পর্যবসিত-প্রায় থিয়েটার আজ। রাজনৈতিক কোনো নীতি-ঘোষণা মুখথুবড়ে পড়েছে বলেই সরকারি কর্মকর্তা ফেডারেশানের প্রধান থাকেন বছরের পর বছর। নীতি-ফিতির বালাই যখন মুখেও আর নেই সেই কতকাল হলো! বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির যত অকাণ্ড ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়েছিল কতদিন ধরে? দুর্নীতি দমন কমিশন শেষরক্ষা করেছে বুঝি, সেই সাথে ‘বহিষ্কারনাট্য’ নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি ক্ষমতার লড়াই, সবটা উলঙ্গ করে ছেড়েছে। তাই বুঝি মানসম্মান বাঁচাতে সত্বর কিছু করা চাই।
পূর্বতন-নেতৃবর্গের ফেডারেশানের কার্যক্রম স্থগিত করার প্রস্তাবের বিকল্প হিসেবেই বুঝি ‘থিয়েটারওয়ালা’র এই প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে। ধরে ধরে অনুপুঙ্খই বলা হয়েছে যা বলার। অল্প কটা কাজ বের করা হয়েছে যা একক কোনো নাট্যদলের পক্ষে করা কঠিনই হয়। তবে সেই কাজটা দেশজোড়া বিরাট ক্ষমতানেতৃত্ব ছাড়া কেন কেউ করতে চাইবে, যৌথতার কোনো ন্যায়নীতি কি অবশিষ্ট আছে আর! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর, বেগার খাটার মতো বেকার কি পাওয়া যাবে এই বাজারবিশ্বে? একটা কোনো বিনিময়মূল্য তো থাকা চাই, অন্তত আর্থিক কোনো প্রণোদনা। এছাড়া ‘থিয়েটারওয়ালা’-সম্পাদকের বলা ‘ভালো’ থিয়েটারচর্চা বা ‘ভালো দল’ বলতে ‘ভালো’র বদলে অন্য কোনো যুৎসই শব্দ চাই। হাসান শাহরিয়ারের লেখায় আরো কী কী সব করার ভাবনাটাও সেই পুরনো ন্যায়নীতির আশা থেকে বলা। অনেকটা ‘ক্লিশে’-ভাবনা। এসব আপাতত না তোলাই ভালো মনে হয়।
মূল যে কাজগুলো ভাবা হয়েছে, সম্পাদকের লেখায়, সেটা করতে রাজি হবার ব্যবস্থাটা আগে হোক। সমষ্টিগত কোনো স্বপ্নকল্পনা এখনই না করা ভালো, দলগুলো নিজের সামর্থ্যে যা করছে তাই তো যথেষ্ট বর্তমান বাস্তবতায়। সেই ‘জোট বাঁধো, দিন বদলাও’ বলার দিন আর নেই, ওহি দিন গুজার গিয়া। একেক দল তার সাধ্যমতোই লড়ে যাচ্ছে। প্রধান অতিথি হওয়া কী সম্মাননা নেওয়া ছাড়া কাউকে আর নবীন দলের মঞ্চে পাওয়া যায় কি সেই কতকাল ধরে?
তবে একটা কোনো আশা বাঁচিয়ে রাখার নাট্যজন এখনও যে রয়ে গেছে, সেই তো বাঁচোয়া! স্বাধীনতার সুবর্ণ ফসলটা বেঁচে-বর্তে আছে, থাকবে, এতটুকু নাটুকে/নাটকীয়-আশা অন্তত করাই যায়।
জয় হোক।
ড. বিপ্লব বালা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যশিক্ষক, নাট্যসমালোচক