Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন : প্রতিক্রিয়া

Written by রামেন্দু মজুমদার.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

হাসান শাহরিয়ার তার দীর্ঘ লেখা ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান ও থিয়েটারচর্চার সামনের দিন’ নিয়ে একটা প্রতিক্রিয়া জানাতে আমাকে বারবার অনুরোধ করার প্রেক্ষিতে আমার বর্তমান লেখা। আমি কিছুদিন আগে ফেডারেশান নিয়ে নাট্যকর্মীদের কাছে একটা খোলা চিঠি লিখবার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এ প্রসঙ্গে আমি আর কোনো মন্তব্য করব না। আসলে ফেডারেশান এবং এ ধরনের অনেক সংগঠন নিয়ে আমার আর কোনো আগ্রহ নেই। যদি আরো কিছুকাল বেঁচে থাকি, তবে নিজের পছন্দসই কিছু অর্থপূর্ণ কাজ করতে চাই। যৌথ সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি আর নিজেকে জড়াতে চাই না।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান গঠনে আমার একটা ভূমিকা ছিল, তাই ফেডারেশানের বর্তমান সংকট নিরসনে অনেকেই আমার সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। আমি সবার অনুরোধের জবাবে একটা কথাই বলেছি যে, আমাদের চেয়ে বয়সে যারা তরুণ, তারা এখন নাটকের ক্ষেত্রে যথেষ্ট জ্যেষ্ঠতা অর্জন করেছে; তারাই আলোচনা করে সংকট নিরসনের পথ খুঁজে নেবে। বারবার আমাদের দিকে তাকাতে হবে কেন? এখন আমরাই তাকাব ওদের দিকে।

হাসান শাহরিয়ারের বক্তব্য দীর্ঘ, অনেক কথার পুনরাবৃত্তি আছে। আমি মোটা দাগে কয়েকটা বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করতে চাই।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ‘ড্রামা সার্কলে’র দুটো প্রযোজনা দেখেছি মার্কিন তথ্য কেন্দ্র (তখনও ‘আমেরিকান কালচারাল সেন্টার’ নামকরণ হয় নি) মিলনায়তনে। খুবই মানসম্পন্ন প্রযোজনা, যা আজকেও অনেক দলের পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব হয় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক নাট্যগোষ্ঠীর শিক্ষক তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, আমি ছিলাম ছাত্র তত্ত্বাবধায়ক। তবে মুনীর চৌধুরীর পরামর্শেই সব প্রযোজনা হতো।

হাসান শাহরিয়ার কাদের মত উল্লেখ করে ‘মঞ্চনাটকের শক্তিকে সব-সরকারপক্ষ সবসময়ই ভয় পেয়ে এসেছে’ লিখেছে আমার জানা নেই। তবে আমার ধারণা, কোনো সরকারই নাটকের শক্তিকে বড় করে দেখে নি, ভয় তো দূরের কথা। ১৯৭৪ সালে নাগরিকের নাটকে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বাধার পর কিন্তু ৬ মাস নাটক বন্ধ ছিল। ৮টি প্রদর্শনী করার ছাড়পত্র পাওয়ার কথা ঠিক নয় (আলাপনে আতাউর রহমান, ‘থিয়েটারওয়ালা’-সংখ্যা ১৭, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০০৫, পৃ. ১২৩ থেকে এ তথ্য নেয়া হয়েছে: সম্পাদক)। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু রামপুরা টেলিভিশনের নতুন ভবনে এসে আবদুল্লাহ আল-মামুনের কাছে নাটক বন্ধ হবার কারণ জানার পরই তিনি নাটকের উপর থেকে প্রমোদকর প্রত্যাহার ও নাটকের জন্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অধীনে নাটক সেন্সর কমিটি গঠন করার সরকারি আদেশ জারি করেন। কুমিল্লায় এখন দুঃসময় নাটকের ঘটনা আমরা কুমিল্লায় অভিনয় করতে গিয়ে জানতে পারি। নাম নিয়ে পুলিশের এমন মূর্খতা অকল্পনীয়। জেলা প্রশাসকের সেখানে কোনো ভূমিকা ছিল না।

বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের প্রথম গঠনতন্ত্রে হাসান শাহরিয়ার-উল্লেখিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল কিনা, তা আজ আমার আর মনে নেই। অনেকবারই গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনা হয়েছিল।

ফেডারেশান গঠিত না হলে এতদিনে নাট্যচর্চা বন্ধ হয়ে যেত বলে কেউ মনে করে বলে আমি বিশ্বাস করি না। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে সংস্কৃতিকর্মীদের একটা বড়ো অংশ ছিল ফেডারেশানভুক্ত দলের সদস্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বড়ো শক্তি ছিল বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশান। আশি বা নব্বইয়ের দশকে নাট্যচর্চায় মূল-ভূমিকা পালন করেছে দলগুলো, ফেডারেশান নয়। ফেডারেশান প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িয়েছে।

হাসান শাহরিয়ারের লেখায় উল্লেখিত ১১টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমার মন্তব্য:

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১: গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে সমুন্নত রাখার সংগ্রামকে সংহত করা:
গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ কী তা ব্যাখ্যার দাবি করে। নাটক করে জীবিকা অর্জন করলে নিশ্চয়ই গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শ-বিরোধী কাজ হবে না। আসলে সময়ের সাথে সাথে কাজের ধারা বদলায়। তবে গ্রুপ থিয়েটার নাটককে পণ্য করতে চায় না, সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে মঞ্চে সত্য উচ্চারণ করতে চায়।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ২: নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্নসময় বিষয়ভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলা:
ফেডারেশান নাট্যচর্চার স্বার্থে বিভিন্ন সময়ে বিষয়ভিত্তিক-আন্দোলন গড়ে তুলেছে। তার উজ্জ্বল উদাহরণ সেন্সরপ্রথা বাতিলের ধারাবাহিক-আন্দোলন। সভা-সমাবেশ-সেমিনার-অনশন-সেন্সরবিহীন নাটকের উৎসব, কোনো কিছুই বাদ যায় নি দীর্ঘ সে আন্দোলনে।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৩: সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা:
সারাদেশে স্থায়ী নাট্যমঞ্চ ও মুক্তমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্যে তেমন কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ ফেডারেশান নিতে পারে নি। ‘আমাদের মঞ্চ আমরাই গড়ব’ ছিল একটা আবেগনির্ভর কর্মসূচি, যা অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৪: নাটককে ব্যাপক সামাজিক-ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করা:
নাটককে ব্যাপক সামাজিক ক্রিয়ার সাথে যুক্ত করার ক্ষেত্রে সীমিত সাধ্যে চেষ্টা করা হয়েছে। নাট্যকর্মীরা বিভিন্ন সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

লক্ষ্য-উদ্দ্যে ৫: নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করা:
নিয়মিত নাট্যবিষয়ক প্রকাশনা বের করতে ফেডারেশান ব্যর্থ হয়েছে।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৬: নাট্যবিষয়ক সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা:
সংগ্রহশালাও প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। বরং ব্যক্তি উদ্যোগে বাবুল বিশ্বাসের বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভ অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। একজনের ভালোবাসা না থাকলে এ ধরনের আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৭: বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক-পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, আলোচনা ইত্যাদির ব্যবস্থা করা:
জাতীয় পর্যায়ে কিছু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজটা করেছে ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই)। আসলে ফেডারেশানের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের পদটা রাখার পেছনে কোনো যুক্তি নেই।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৮: জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব আয়োজন করা:
জাতীয় নাট্যোৎসব হয়েছে বেশ কয়েকটা, বেশিরভাগই শিল্পকলা একাডেমির সহায়তায়।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ৯: দেশে একটি থিয়েটার ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা:
থিয়েটার ইন্সটিটিউট গড়ে তোলা ফেডারেশানের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে না থাকলেই ভালো হতো।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১০: মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে নাটককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া:
এ ক্ষেত্রেও ফেডারেশান কোনো কাজ করেছে বলে আমার জানা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে আমার প্রস্তাব-অনুসারে নাট্যকলা খোলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেলিম আল দীন উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ১১: পেশাদারি থিয়েটরের ক্ষেত্র-প্রস্তুত করা:
পেশাদারি থিয়েটারের ক্ষেত্র-প্রস্তুতেও ফেডারেশানের কোনো ভূমিকা নেই।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতির ভাড়া সহনশীল রাখতে ফেডারেশানের চাপ ছিল। তবে শিল্পকলা পরিষদে ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব সদস্য হিসেবে আমি সবসময় বিরোধিতা করেছি। গত কয়েক বছর ধরে মহিলা সমিতিতে নাটকমঞ্চায়নে সরকার যে ভর্তুকি দিচ্ছে, তা ফেডারেশানের চেষ্টায় হয় নি। মহিলা সমিতি কর্তৃপক্ষ ও আমার উদ্যোগে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সময় থেকে এ ভর্তুকি চালু হয়।

ভবিষ্যতে ফেডারেশান কীভাবে নাট্যচর্চায় সহযোগিতা করতে পারে, তার প্রস্তাবনায় হাসান শাহরিয়ার উল্লেখ করেছেন জাতীয় নাট্যশালায় গাড়ি পার্কিং জোনে সেট রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবশ্যই নয়। অনেকসময় এ পার্কিং-এও গাড়ি রাখার জায়গা হয় না। শিল্পকলা-চত্বরে আর কোনো নতুন ভবন করা ঠিক হবে না। বিদ্যমান ভবনগুলোর মধ্যেই মহড়াস্থল বাড়াতে হবে। সেট রাখার দায়িত্ব শিল্পকলা নিতে পারবে না।

বিদেশে দল যাওয়া বা আনার ক্ষেত্রে যে সরকারি জটিলতা আছে, সেখানে ফেডারেশান অবশ্যই সহায়তা করতে পারে।

জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তন রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ব্যবহৃত হবে। সেটা বন্ধ করার সুযোগ নেই। তবে যত বেশিদিন নাট্যদলগুলো ব্যবহার করতে পারে সেটা দেখতে হবে। মহিলা সমিতির হল মাসে ৩০ দিনই নাটকের দল ব্যবহার করতে পারে। তবে সেখানে দর্শক হয় না বলে মাসের অর্ধেক দিনই হল খালি পড়ে থাকে, কেউ হলবরাদ্দের জন্যে আবেদন করে না।

এখন শিল্পকলায় হলবরাদ্দ দেয়াই ফেডারেশানের কর্তাব্যক্তিদের প্রধান কাজ হয়ে গেছে। সেখানে নেতাদের ক্ষমতা দেখানোর একটা ব্যাপার আছে। বর্তমান ভোটের রাজনীতিতে ভালো প্রযোজনার জন্যে বেশি দিন হলবরাদ্দ সম্ভব হবে না, কেননা সবাইকে তুষ্ট রাখতে হয়।

ফেডারেশানের নির্বাচন নিয়ে বা সাম্প্রতিক সময়ে দুজনকে অব্যাহতির ব্যাপারে আমি আর কিছু বলতে চাই না। এসব ব্যাপারে সাধারণ-সদস্যরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।

ফেডারেশান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করার ইচ্ছা, আগ্রহ বা সময় আমার নেই। জীবনে সাংগঠনিক কাজ অনেক করেছি। ৮০ বছর পার হবার পর এবার এসব থেকে দূরে থাকতে চাই। নিজের কিছু অসম্পূর্ণ কাজ যদি করতে পারি, তবেই বেঁচে থাকা অর্থপূর্ণ হবে।  

রামেন্দু মজুমদার ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যব্যক্তিত্ব