Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

শেক্সপীয়রের ভাঙা-গড়া

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে শেক্সপীয়র একটি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয়েছেন। তাঁর জন্মভূমি অ্যাভন তীরের স্ট্র্যাটফোর্ডকে বলা যেতে পারে এই শিল্পোদ্যোগের কর্পোরেট কেন্দ্র। শেক্সপীয়র বলতে গেলে সপ্তদশ শতাব্দী থেকেই বৃটিশ অহমিকার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক। এ বিষয়টি বিতর্কাতীত। যখন বৃটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, তখনই ইংরেজরা আভুবন সাম্রাজ্যের বিনিময়েও তাঁদের প্রধান কবি (Bard)-কে নিজেদের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ হিসেবে রাখতে চেয়েছিলেন। ইংরেজ সংস্কৃতির আভূমি এবং অতলস্পর্শী ভিত্তি হল শেক্সপীয়র। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শেক্সপীয়রের সাংস্কৃতিক সার্বভৌমত্বের যে ধারণা প্রতিষ্ঠা পায় ও বিকশিত হয়ে উঠে, তা-ই দিনে দিনে ক্রমবর্ধমানভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে বিশ শতক জুড়ে। ১৯৮৬ সালে স্ট্র্যাটফোর্ডের নাট্যদল রয়্যাল শেক্সপীয়র কোম্পানী রপ্তানী আয় খাতে মহারাণীর বিশেষ পদক লাভ করে। ছোট শহর স্ট্র্যাটফোর্ডের প্রধান রাজস্ব আয়ের একটি হল শেক্সপীয়র ব্যবসা। কলম, পেনসিল, কাপ, ফুলদানি, কোটপিন সবকিছুতেই এ মহাকবির অবস্থান। আর কী রমরমা বাণিজ্য তাঁকে নিয়ে। ওই শহরেরই বিয়ার প্রস্তুতকারক সংস্থা FLOWERS নামে যে বিয়ার বাজারজাত করে, তাতেও দেখা যাবে মসীহস্তে নাট্যকারের মধ্যবয়সের  ছবি। ফ্লাওয়ার এ্যান্ড সন্স কোম্পানীর বিয়ারের বোতলে কবির ছবির নিচে লেখা BEST BITTER আর উল্টোদিকে বিজ্ঞাপনের বিস্তারিত ভাষ্য। ডিম্বাকৃতি লেবেলের ওপরের দিকে লেখা ক্যাপিটাল অক্ষরে EXPERTS ON BITTER ALWAYS PICK FLOWERS. আর নিচের দিকে ক্ষুদ্রাকৃতি ক্যাপিটাল অক্ষরে IT SEEMS THE BEST IN BOTH POETRY AND BEER HAVE THE KNACK OF LASTING THROUGH THE CENTURIES. এই লিখন ট্রেডমার্কের পদ্ধতিতে দেখা। তারপর প্রথম পংক্তিতে লেখা শেক্সপীয়র ও তারপর A Winter’s Tale নাটক থেকে উদ্ধৃতি, আবার ক্যাপিটাল অক্ষরে `HERE’S FLOWERS FOR YOU`. এরপর ব্যাখ্যামূলক তথ্য। “ভালো এক বা দু’গ্লাস বিয়ার পান শেক্সপীয়র উপভোগ করতেন এ কথা সুবিদিত। সম্ভবত এটাই সঠিক যে ১৮৩১ সালে স্ট্র্যাটফোর্ডে প্রতিষ্ঠিত ফ্লাওয়ার্স কোম্পানীর সঙ্গে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। ১৮৬৪ সালে এডওয়ার্ড ফ্লাওয়ার স্ট্র্যাটফোর্ডের মেয়র ছিলেন এবং এই শহরের সর্বোত্তম খ্যাতিমান সন্তানের ত্রিশত জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছিলেন। ফ্লাওয়ার পরিবারের পরিচালনায় দ্য রয়্যাল শেক্সপীয়র থিয়েটার নির্মিত হয়েছিল এবং মহাকবি ব্রুয়ারির ট্রেড মার্ক হিসেবে গৃহীত হন।” এর নিচে প্রথমে ‘ট্রেড’ তার পাশে লিখনরত শেক্সপীয়র এবং কবির বাঁ দিকে ‘মার্ক’ লিখিত আছে।

ব্যবসার নানা মাধ্যমে শেক্সপীয়রকে ব্যবহার করা হলেও থিয়েটারের বাণিজ্যে তাঁকে নিয়ে যতসব প্রযোজনা তার মধ্যে লাভের উপাদানের অস্তিত্ব থাকলেও শিল্পচর্চার, নাট্যচর্চার ও নানান নিরীক্ষার দৃষ্টিগ্রাহ্য ও উল্লেখযোগ্য অবকাশ রয়ে গেছে। রয়্যাল শেক্সপীয়র কোম্পানীর অন্যতম শিল্প পরিচালক টেরি হ্যান্ডসকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল শুধুই শেক্সপীয়রের নাটকের প্রযোজনাকে প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে ধারণ করে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের (National institution) যৌক্তিকতা কি? টেরি হ্যান্ডস বিষয়টাকে একটা ঘটনাক্রমিক ব্যাপার হিসেবে উল্লেখ করেন। ষাটের দশকে একদল তরুণ শেক্সপীয়রকে নানাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চাইলেন। তাঁরা ভাবলেন তাঁদের এইসব উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এই নাট্যকারকে অনুধাবনের বহুস্তর পরম্পরা অতিক্রম করা যাবে, তারপরও তাঁরা হয়ত সার্বিক সাফল্য অর্জন করতে পারবেন না। টেরি হ্যান্ডসের ভাষায়:

`An important aspect of this process was a very English masochism that always celebrates defeats to a greater extent than victories and which paradoxically draws support from the notion that Shakespeare will always unattainable`.

এমন উদ্যোগের পরিপ্রেক্ষিতে আর-এস-সির কার্যকলাপের মধ্যে বাণিজ্যবোধ ও কায়েমী প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থরক্ষার কোন লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ক্রিস্টোফার জে. ম্যাককুলাফ পরের প্রশ্নেই জিজ্ঞেস করেন গত বিশ বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের শাসনামলে আর-এস-সি প্রগতিপন্থী একটি সংস্থা হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে, শুধু বর্তমান থ্যাচার সরকারের কালে নয়, তার আগের শ্রমিক দলের শাসনমলেও তা দেখা গেছে। ১৯৬৬ সালে লর্ড গুডম্যান অভিযোগ করেছিলেন যে, আর-এস-সি ক্রমাগতভাবেই অধিক বামপন্থী ও কায়েমী স্বার্থবিরোধী (anti-establishment) হয়ে উঠছে। কিন্তু এই কোম্পানী ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক ধারণার ওপরই প্রতিষ্ঠিত এবং নামের মধ্যেও রাজকীয় চিহ্ন বহন করছে। আর-এস-সি কীভাবে এই আপাতভাবে স্ব-বিরোধী সুনাম রক্ষা করে চলেছে? টেরি হ্যান্ডস স্বীকার করেছেন এমন অবস্থানের কথা, কিন্তু শব্দব্যবহারের মধ্যে যে চাতুরি আছে যেমন, প্রগতিপন্থী (radical) তা সম্পর্কে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তিনি। ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন:

`Shakespeare and the theatre in general should be concerned with the real sickness [of the society]. If they are, they are bound to be questioning whatever political party is in power, and so no theatre can be ‘establishment’, no theatre can be a ‘national institution’ though it may be a nationally recognized theatre`.

সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা দাবি করেছিলেন। তিনি বললেন, শেক্সপীয়রকে মানুষের কাছাকাছি আনার অনেক প্রচেষ্টা হয়েছে। পিটার হল শেক্সপীয়রকে নিয়ে একটা ইতিবাচক অভিজ্ঞতা (Positive experience) সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যাতে সাধারণ জনগোষ্ঠী যাঁরা পেপারব্যাক সংস্করণ কিনে থাকেন তাঁরা থিয়েটারে আসতে উদ্বুদ্ধ হন। বাজ গুডবডি ‘অন্য ক্ষেত্র’ (Other place) নামে মঞ্চ তৈরি করতে চেয়েছিলেন, তাঁর উদ্দেশ্যও ছিল শেক্সপীয়রকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসা। এবং  [টেরি হ্যান্ডস] আপনিও তো আর-এস-সি তে যোগদানের প্রথম দিকে Theatre ground-এর পরিচালক ছিলেন। আপনার কি মনে হয়, আর-এস-সি-র সাংস্কৃতিক ভিত্তি বিস্তৃত করার জন্য এইসব উদ্যোগ অত্যন্ত আন্তরিক প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য হতে পারে, এগুলির সাফল্য সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

সহজেই বোধগম্য যে, এটা অত্যন্ত কঠিন প্রশ্ন। পিটার হল এবং বাজগুডির মত উদ্যোক্তাদেও নাম উল্লেখ করা হয়েছে। টেরি হ্যান্ডস অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রশ্নটির মোকাবিলা করেছিলেন। তিনি বললেন, যে কেউ-ই থিয়েটার দেখতে আসেন, তিনিই তো জনগণের অংশ (people)। আমরা আমাদের ত্বকের নিচে সবাই-ই মানুষ। এই মানুষকে থিয়েটারে আনার ব্যাপার অনেক সময়ই অনেক রকমের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, আরও অধিক সংখ্যায় আনার চেষ্টা করা হয়েছে। শেক্সপীয়র আমাদের পরিকল্পনার মেরুদণ্ডের মত; কারণ তিনি অনেক ব্যাপকভাবে বহুসংখ্যক মানুষের কাছে তার ভাষ্য পৌঁছে দিতে পারেন। এরপর টেরি হ্যান্ডস একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, থিয়েটারে আমাদের কাজ দ্বিমুখী। মঞ্চায়নের মাধ্যমে মানুষের অন্তর ও বাহিরকে প্রকাশ করা যা দেখে দর্শকবৃন্দ নিজেদের বিশেষ বিশেষ সামাজিক গোষ্ঠী হিসেবে শনাক্ত করতে পারে। আবার আমাদের টার্গেট গোষ্ঠী স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, যারা তখনও নিজেদের উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত বা বিত্তহীন, কোন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত এমন কথা ভাবতে শেখেনি, তাদের মন ও দৃষ্টিভঙ্গি তখনও উন্মুক্ত, তেমন সময়ই শেক্সপীয়রের মাধ্যমে তাদের মনে নাড়া দেবার চেষ্টা করা যায়, শেক্সপীয়রকে অনুধাবনে এক ধরনের প্ররোচনা সৃষ্টি করা যায়। টেরি হ্যান্ডস অন্যান্য বিষয়গুলি সম্পর্কেও ব্যাখ্যামূলক উত্তর দিয়েছিলেন। আমাদের দেখার বিষয় হল, কীভাবে নানা উদ্যোগে বিবিধ পরিকল্পনায় ও বিরতিহীন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শেক্সপীয়র উজ্জীবিত হয়েছেন, কালের ক্ষয়িষ্ণুতা তাঁকে স্পর্শে করেনি, তিনি চিরকাল সমকালীন থেকে গেছেন। পোলিশ সমালোচক আয়ান কট যখন Shakespeare our Contemporary রচনা করেন, সেই ১৯৬৪ সালে, তখন এই প্রশ্নটি আমাদের কাছে আরও গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপিত হয়। এই অসাধারণ গ্রন্থটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এতটাই যে, তা এই স্ট্র্যাটফোর্ডের রয়্যাল শেক্সপীয়র কোম্পানীর প্রযোজনাসমূহের নতুন করে পুনর্বিবেচনায় প্ররোচিত করে। বিশেষ করে বিশ্বখ্যাত নাট্যপরিচালক Peter Brook এর নাম উল্লেখ করা যায়, যিনি নিজেই আয়ান কটের প্রতি তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন অকুণ্ঠভাবে।
 
আমাদের আলোচনার সূত্র ছিল শেক্সপীয়রের বাণিজ্যিক ব্যবহার। বাজার অর্থনীতিকে অবরোধ না করা গেলে মহাকবির ওই ব্যবহারকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কিন্তু শেক্সপীয়রের সমকালীনতা অথবা তাঁকে ঘিরে মঞ্চের যে শিল্প গড়ে ওঠেছে তা শুধু অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়, তা নান্দনিকতার সঙ্গেও যুক্ত। তা সাহিত্যে ও অভিনয় শিল্পে এতসব নিরীক্ষার সূত্রপাত করেছে যে, শেক্সপীয়রকে ঘিরে আমাদের জীবনের, দর্শনের ব্যাখ্যার ও উপস্থাপনার নানা কলাকৌশল সৃষ্টি হয়ে চলেছে অবিরত। আর এই নাট্যকারকে ঘিরে এই ধরনের অনুশীলন এত ব্যাপক, এত আন্তঃমহাদেশীয় চরিত্রের, এত সমাজতান্ত্রিক ব্যাখ্যাপ্রবণ, এত সাহিত্যসৃজনমূলক যে তা নিয়ে কোন তালিকা প্রণয়ন একেবারেই দুঃসাধ্য বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। আমরা অতি-পরিচিত কয়েকটি নাটকের transversion অথবা transcreation নিয়ে আলোচনা করে দেখাতে চেষ্টা করব ভাবনার বিচিত্র দ্যোতনায় ও প্রকাশভঙ্গির নানা নিরীক্ষায় এই মহান এলিজাবেথীয় নাট্যকার কী ধরনের অতিপ্রজ প্রকরণে অদ্যাবধি প্রাসঙ্গিক।

যে নাটকটির নাম প্রথমেই মনে আসছে তা হল, টম স্টপার্ডের Rosencrantz and Guildenstern are Dead. ১৯৬৬ সালে প্রথম অভিনীত ও ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত নাটকটির নামকরণ থেকেই বোঝা যায় এই নাটকটি তৈরি হয়ে ওঠার সূত্র কোথায়। হ্যামলেট নাটকের দুই অপ্রধান চরিত্র রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ। এলসিনোরের রাজপ্রাসাদে তাঁদের অবস্থান শুধুই কাহিনীর পার্শ্বক্রিয়া সম্পাদনের জন্য। তারা ছাত্রাবস্থায় হ্যামলেটের সহপাঠী ছিল, সেই সূত্রেই হ্যামলেটের পছন্দ-অপছন্দ, মন-মেজাজ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল, বন্ধুত্বের দাবি ছিল। কিন্তু ক্লডিয়স তাদের এলসিনোরে ডেকে আনেন তাঁর চক্রান্ত সাধনের জন্য। প্রাথমিক উদ্দেশ্য যদিবা ছিল হ্যামলেটের খেয়ালীপনাকে স্বাভাবিক আচরণে রূপান্তরে সহায়তা কামনা। অমন নির্দোষ কারণে নিজেদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেই এসেছিল রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ। দুই বন্ধু যেন মাণিকজোড়। রাজপ্রাসাদের ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণা বা উৎসাহ --কোনটাই ছিল না। হ্যামলেট নিজেও প্রথমে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেও কোনরকমের আঁচ করতে পারেন নি--আকস্মিকভাবে দুই পুরোনো বন্ধু কেন এল এলসিনোরে। তাদের দুজনকেই রাজা নিয়োগ করলেন হ্যামলেটের চলাফেরা, আচার-আচরণের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে। এ বিষয়টাকেও কোন বিশেষ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে নি রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ। ক্রুদ্ধ হ্যামলেট পলোনিয়সকে হত্যা করে, ভুল করেই তাঁকে ক্লডিয়স ভেবে। এরপর ক্লডিয়স রাজপ্রসাদ থেকে শুধু নয়, পৃথিবী থেকেই হ্যামলেটকে চিরতরে সরিয়ে দেবার সীলবদ্ধ আদেশসহ হ্যামলেটকে পাঠিয়ে দিলেন ইংল্যান্ডে, দুই বন্ধু রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে। সীলবদ্ধ খামে কি আদেশ আছে তা তারা জানে না, জানে শুধু ইংল্যান্ডের রাজার কাছে আর এক রাজার বার্তা। কিন্তু সমুদ্রপথে হ্যামলেট সীলবদ্ধ সেই খাম হাতে পেয়ে যায়, খুলে পড়ে কি লেখা আছে ভেতরে। তারই মৃত্যুর আদেশ। বহন করছে তারই দুই বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী। হ্যামলেট সেই আদেশে নিজের নামের পরিবর্তে জুড়ে দেয় রোজেনক্রাৎস আর গিল্ডেনষ্টার্ণের নাম। প্রতারক হিসেবে হ্যামলেট বন্ধুদেরই চিহ্নিত করলেন। সেকথা ওই দুই তরুণের জানাও হল না কোনদিন। ইংল্যান্ডের রাজা চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী মৃত্যুদ- দিলেন ওই বন্ধুযুগলকে। ইতিহাসের রাজ প্রাসাদের চক্রান্তের নির্মম বলি--রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ। হ্যামলেট কাহিনীতে তাদের চরিত্রের উদ্ভব ও বিকাশ ওই পর্যন্তই।

টম স্টপার্ড রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণকে তাঁর নাটকে সংস্থাপন করলেন বিচিত্র ও ব্যতিক্রমী অর্থে ও প্রকরণে। সমগ্র শেক্সপীয়র কাহিনীতে তাঁরা নেহাতই গৌণ, নাটকের শেষে পাঠক বা দর্শক কেউ তাঁদের তেমন করে মনে রাখে না। প্রাসাদ রাজনীতির এক সংযোগসূত্রে তাঁদের প্রবেশ এবং এরই এক আংশিক পরিণতিতে তাঁদের মরণশীল প্রস্থান। স্টপার্ড আধুনিক উদ্ভট নাটকের প্রকরণ ও প্রকাশবিমূর্ততায় ওই দুই গৌণ চরিত্রকেই প্রধান করে তুললেন কঠিন ব্যঙ্গে। তাঁর কাহিনীতেও আছে হ্যামলেট, আছে ওফেলিয়া আর ক্লডিয়স, গাট্রুড ও পলোনিয়াস, কিন্তু তাঁদের সেই শেক্সপীয়রসুলভ গৌরব নেই। নাটকের কাহিনীর কাল ও প্রেক্ষাপট খুব সচেতন প্রক্রিয়ায় সূত্রচ্যুত হয় না, অথচ নাটকের গতি, মেজাজ ও পরিবেশনা আধুনিকতার অতিরিক্ত লক্ষণে ভূষিত। হ্যামলেট এর প্রধান চরিত্ররা তাঁদের মুখ্য অবস্থান থেকে নিপতিত হয় আধুনিক কালের রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণের মঞ্চাধিপত্যে।  পাঠক ও দর্শকের দীর্ঘক্ষণ ধরে মনে হতে থাকবে এরা দুজন সন্দেহাতীতভাবেই স্যামুয়েল বেকেটের Waiting for Godot নাটকের ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাজন চরিত্রের একেবারেই সমগোত্রীয়। টম ষ্টপার্ড টি.এস.এলিয়টের যে বিখ্যাত কবিতা The Love song of J. Alfred Prufrock কবিতার দ্বারা সৃজনধর্মিতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তা বুঝতেও বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। প্রুফ্রকের সেই কথা:

No! I am not prince Hamlet nor was meant to be:
Am an attendant lord, one that will do
To swell a progress, start a scene or two,
Advice the prince, no doubt an easy tool.

বোঝা যায় তাড়িত করেছিল ষ্টপার্ডের কল্পনা ও সৃজনীশক্তিকে। প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শেষ দিকে যখন Rosencrantz and Guildenstern are Dead ইউরোপ ও আমেরিকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, তখন এবং তারপরেও বহুকাল এই নাটকের আলোচনায় প্রধানত স্যামুয়েল বেকেট ও টি.এস.এলিয়টের প্রভাবের কথাই উচ্চারিত হত। শেক্সপীয়র শুধুই সূত্র হিসেবে উল্লিখিত, যেমনভাবে শেক্সপীয়র আলোচনায় তাঁর উৎসসমূহ চিহ্নিত করা হয় কেবলই textual কারণে, ঠিক সেইভাবে। পিরান্দেল্লো, কাফকা, জেমস সনডার্স এঁদের প্রভাবের কথাও বলা হয়েছে, কিন্তু বেকেট ও এলিয়টই বৃত্তটার সিংহভাগ জুড়ে ছিলেন। ষ্টপার্ডের কল্পনায় প্রুফ্রক ছিল চালিকাশক্তি। প্রুফ্রক নিজেই,  কিছুটা হ্যামলেটের মত হলেও (বয়স ও প্রবণতায় তাঁদের দূরত্বও যদিবা খুবই দৃষ্টিগ্রাহ্য), তিনি আধুনিক absurd plays-এর চরিত্রের আদর্শিক ও ব্যবহারিক পূর্বসূরী। কিছু কিছু সমালোচক হ্যামলেট নাটকের সঙ্গে ষ্টপার্ডের নাটকের যোগকে অনেক হ্রস্ব করে দেখাতে চেয়েছেন। ষ্টপার্ডের নাটকের দীর্ঘ প্রথম অঙ্কে শেক্সপীয়র নাটকের অন্যান্য চরিত্ররা আবির্ভূতই হয় না। শুধু পরিভ্রমণকারী নাট্য কোম্পানীর নামবিহীন চরিত্রদের দেখা পাই। আবার তারাও উদ্ভট নাটকের প্রাকরণিক আদলে ’ছন্নছাড়া’ আচরণ করে, সংলাপে সংলগ্নতার অভাব পরিদৃষ্ট হয়; তারাও যেন রোজেনক্রাৎস আর গিল্ডেনষ্টার্ণের নিরুদ্দিষ্ট জীবনভঙ্গির অভিনেতা। ষ্টপার্ডের উদ্দেশ্যও তো তা-ই ছিল।

নাটকের শুরুতে দেখা যায় রোজেনক্রাৎস এবং গেল্ডেনষ্টার্ণ কয়েন দিয়ে টস করছে। রোজেনক্রাৎস প্রতিবারই (বহুবার) `heads’ নির্বাচন করছে, প্রতিবারই সে জিতছে, একবারও অন্যথা হচ্ছে না। গিল্ডেনষ্টার্ণ হারছে, তবুও তারা খেলাটা চালিয়েই যায়। কথা বলে. বিরক্তি, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি সম্পর্কে। ষ্টপার্ড পরিকল্পিতভাবেই গিল্ডেনষ্টার্ণকে দিযেছেন দীর্ঘ সংলাপ, কথোপকথনের দক্ষতায় যে উদ্ভট ও পুনরুক্তিমূলক বিষয় উল্লিখিত হয়েছে তা অতিক্রম করে তাঁর সংলাপে দার্শনিকতার গন্ধও পাওয়া যাবে। এইবাবে ষ্টপার্ড চরিত্র দুটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করেন, তাদের ভিন্নতর সত্তা নির্মাণ করেন এবং হ্যামলেট এর context থেকে তাদের দূরত্বে স্থাপন করেন দীর্ঘক্ষণ। গিল্ডনষ্টার্ণের সংলাপের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন অংশ উদ্ধৃত করা যায়।

Guil: ….he has never known any thing to write home about is nothing to write home about,..…Home
…..Syllogism the second: One, probability is a factor which operates within natural forces. Two, probability is not operating as a factor. Three, we are now within us, sub-or supernatural forces Discuss…. The scientific approach to the examination of phenomena is a defence against the pure emotion of fear.

রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ অনিবার্যভাবেই বেকেটের পূর্বোক্ত নাটকের দুই প্রধান চরিত্রের মত আচরণ করছে, কথা বলছে আপতভাবে অসংলগ্ন ও অর্থহীন, আবার ভাবনার জটিলতার গ্রন্থিতে অথবা অস্তিত্ববাদ ও সংশয়বাদের যূথপরীক্ষায় তা জীবনের ব্যাখ্যাদানের প্রচেষ্টা হিসেবে গৃহীত হয়। বিরানব্বই বার টস করা হয়ে গেছে, কেনই বা তারা এই খেলা খেলছে, কেন ক্লান্ত হচ্ছে না, অন্য কিছু করলেও কি ক্লান্ত হবে না? কিন্তু তাদের স্বতন্ত্র বিকাশ ঘটছে এইভাবেই পরিণতিহীন জীবনের গৌরচন্দ্রিকা অথবা প্রাত্যহিক কাসুন্দি।

Guil: [ওই একই সংলাপে] …...We have been spinning coins together since I don’t know when, and in all that time (if it is all that time)……I hope that doesn’t sound surprising because its very unsurprisingness is something I am trying to keep hold of …. This made for a kind of harmony and a kind of confidence. It related the fortuitous and the ordained into a reassuring union which we recognized as nature …Then a messenger arrived. We had been sent for Nothing else happened.

 হ্যামলেট নাটকের এই দুই চরিত্রকে এমন একটি অনির্দিষ্ট স্থানে কেন স্থাপন করলেন ষ্টপার্ড? তাঁদের আচরণই বা কেন এতটা উদ্ভট করে তুললেন। অনিশ্চয়তা ও অর্থহীনতার যে বৃত্তে তারা হাঁটাহাঁটি করছে অথচ বাক বিনিময় করছে তা প্রায় নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে, সময়টা অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপনের পর। তা ছাড়া কোনভাবেই তাদের pseudo-reflective কথোপকথনকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। আবার নাটকের প্রথম দু’টি শব্দেই ষ্টপার্ড তাদের Two Elezabethans বলে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তারা যে জীবনকে নিয়ে খেলছে, এলিজাবেথীয় সুরসিক সভাসদরাও অমনভাবে খেলতে পারতেন, শুধু সে যুগের দর্শকরা হয়ত এর জন্য তৈরি ছিলেন না। অতএব নাটককে এ যুগের অতি আধুনিকতার আবরণ পরাতে গিয়ে টম ষ্টপার্ড এই দুই চরিত্রের এলিজাবেথীয় অবস্থানের অর্থহীনতার সঙ্গে বর্তমানকে সংগ্রথিত করেছেন। যুদ্ধের সময় উলুখাগড়াই শুধু নয়, সাধারণ-অসাধাারণ মানুষের প্রাণও যায়। তার প্রমাণ শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয়, আরও অনেক যুদ্ধও, এলিজাবেথীয় কালের যুদ্ধ। আর যুদ্ধ তো সবসময় সুচিহ্নিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নয়, একটা যুদ্ধ, ক্ষমতায় থাকার যুদ্ধ চলতে থাকে, ক্ষমতার যুদ্ধ সদাচলমান, তার কৌশল হয়ত পরিবর্তিত ও আধুনিক হয়ে গেছে। ম্যাকবেথ নাটকে ব্যাংকো, ম্যাকডাফের স্ত্রী-পুত্র ও অজানা অনেককে প্রাণ দিতে হয় ক্ষমতা সংহত করার প্রক্রিয়ায়। আজও আফ্রিকায়, এশিয়ায় (এই বাংলাদেশে তো বটেই) ও ল্যাটিন আমেরিকায় প্রাণ দিতে হয় ক্ষমতাবানদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা শুধু নয়, সাধারণ মানুষও নিহত হয়, রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ এর মত।  এলিজাবেথীয় কালে জীবনকে নাট্যমঞ্চ বলে অভিহিত করার একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল। সেই মঞ্চে ক্ষমতা ও তার ব্যবহারই প্রধান বিমূর্ত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নামকরা সব ট্রাজিডিতে এবং অনেকগুলো কমেডিতে। ষ্টপার্ড সেই লক্ষণটিকেও আধুনিককালের ইঙ্গিতে ধারণ করার প্রয়াসী হয়েছেন। আপনারা কোন ধরনের নাটক করেন--রোজেনক্রাৎসের এই প্রশ্নের উত্তরে Player-এর সংলাপ:

Player: Tragedy, sir. Deaths and disclosures, universal and particular, denouements both unexpected and inexorable, transvestite melodrama on all level including the suggestive. We transport into a world of intrigue and illusion…. clowns, if you like, murderers-we can do you ghosts and battles, on skirmish level, heroes, villains, tormented lovers-set pieces in the poetic vein; we can do you rapiers or rape or both, by all means faithless wives and ravished virgins- flagrante delicto at a price, but that comes under realism for which there are terms.

ষ্টপার্ডের Player-এর ভাষ্যে এলিজাবেথীয় ট্রাজিডি ও হ্যামলেটের যে কাহিনীর সূত্রে বর্তমান নাটক রচিত হয়েছে, উভয় বিষয়েই তির্যক মন্তব্য করছেন। একটু পরেই Player আবার বলছে:

I can do you blood and love without the rhetoric, and I can do you blood and rhetoric without the love, and I can do you all three concurrent or consecutive, but I can’t do you love and rhetoric without the blood. Blood is compulsory-they’re all blood, you see.

এই সংলাপের মধ্যে যে ধরনের যৌগিক জটিলতা থাকুক না কেন, উদ্ভট নাটকের শব্দমালার সঙ্গে তা যতটাই যুক্ত থাকুক, আমরা হ্যামলেট নাটক বিষয়ে অথবা ওই নাটকে বিবৃত কাহিনী বা চরিত্রসমূহ সম্পর্কে আঙ্গিকগত বিপর্যয়কে অনায়াসেই সনাক্ত করতে পারি।

ষ্টপার্ডের নাটকে ওফেলিয়া, হ্যামলেট, ক্লডিয়স ও গাট্রুড প্রায় একই সময়ে মঞ্চে প্রবেশ করে। ওফেলিয়া তার স্কার্ট একটু উঁচুতে তুলে ভীত সন্ত্রস্তভাবে ছুটে আসে। তার পেছনেই হ্যামলেট। হ্যামলেটের পোশাক-আশাকে ধুলো ও মালিন্যের ছাপ। উভয়েই নির্বাক। একটু পরেই রাজকীয় ভঙ্গিতে ক্লডিয়স ও গাট্রুড প্রবেশ করেন। ক্লডিয়স--রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ--উভয়কেই সম্বর্ধনা জানান। অথচ আমরা এ পর্যন্ত যা দেখছিলাম, এই মঞ্চটা জুড়ে দুই বন্ধুই ছিল। স্থান সম্পর্কে ষ্টপার্ড কোন স্পষ্ট মঞ্চ নির্দেশনা দেন নি। কিন্তু ক্লডিয়সের প্রবেশের সঙ্গেই তা এলসিনোরে রূপান্তরিত হয়ে যায়। ক্লডিয়স তাদের দু’জনকে জানান-আমরা তোমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম, খুব দ্রুত তোমাদের ডেকে পাঠিয়েছি কারণ, তোমাদের ব্যবহার করা আমাদের বড় প্রয়োজন (the need we have to use you) তারা ব্যবহৃত হবে, কিন্তু ব্যবহারকর্তার ভাষ্যে এমন অসহায়ত্ব ও করুণা ফুটে উঠেছে যে, রাজা ও রাণীর চরিত্র তাদের সকল জৌলুস হারিয়ে ফেলে। রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণ তাদের অতি সাধারণ পরিচিতি নিয়েও নাটকের কেন্দ্রভূমি দখল করে থাকে।
 
টম ষ্টপার্ড তাঁর নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের আরম্ভে আমাদের সূত্রবদ্ধ হতে বলছেন শেক্সপীয়রের নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের ২য় দৃশ্যে। ওই দৃশ্যে হ্যামলেট, রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণের কথোপকথন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হ্যামলেট বন্ধুদ্বয়কে জিজ্ঞেস করছেন, তোমরা এমন দূর্ভাগা কেমন করে হলে যাতে এখানকার কারাগারে তোমাদের আসতেই হল। হ্যামলেটের কাছে ডেনমার্ক এক বন্দীশালা। তিনি আরও বলছেন, স্বপ্ন আর কিছু নয়, শুধু ছায়া। অস্থির, বিধ্বস্ত হ্যামলেট তখনও বাস্তব পরিস্থিতি বিচারে পারঙ্গম।

Hamlet: Beggar that I am, I am even poor in thanks, but I thank you; and sure, dear friends, my thanks are too dear a half-penny. Were you not sent for? Is it your own inclining? Is it a free visitation? Come, come, deal justly with me. Come, come, nay speak.

ষ্টপার্ডের নাটকে এই দীর্ঘ দৃশ্যের সূত্রগত যোগ আছে বটে, তবে উপস্থাপনাগত অমিলই বেশি। কারণ প্রধানত আঙ্গিকগত। রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণকেই মঞ্চে প্রাধান্য বজায় রাখতে হবে। এই নাটকে, যাকে মাইকেল স্কট ‘পরগাছা কমেডি’ বলে অভিহিত করেছেন, হ্যামলেট তাঁর দুই বন্ধুকে এলসিনোরে স্বাগত জানান। এবং শেক্সপীয়র হ্যামলেটের সংলাপে যেমন দার্শনিকতার লক্ষণ যুক্ত করেছেন, ষ্টপার্ড তা উপস্থাপন করছেন প্রতিপক্ষীয় বিন্দুতে। গিল্ডেনষ্টার্ণ জীবন সম্পর্কে গভীর শব্দাবলি উচ্চারণ করছেন: “চাকায় গতিধারা চালনা করা হয়েছে এবং চাকার নিজস্ব একটা গতি আছে, যার বিপরীতে আমরা......বিপর্যস্ত। প্রত্যেক চলমানতাই তার আগেরটির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-- শৃঙ্খলার অর্থই হল তাই”। ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিত, অর্থের ব্যঞ্জনায় ইচ্ছাকৃত দূরত্ব রচনা করেও ষ্টপার্ড আমাদের বারে বারেই মনে করিয়ে দেন শেক্সপীয়রকে, হ্যামলেট-এর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দৃষ্টি ও মনোযোগ নিবদ্ধ করতে নির্দেশ দেন। ষ্টপার্ড স্পষ্টতই দুটি সাধারণ চরিত্রের প্রতি তাঁর ‘বিশেষ সহানুভূতি’ প্রকাশ করেছেন, কাহিনীর প্রয়োজনে যাদের বলিদান করা হয়েছে। শেক্সপীয়রের হ্যামলেট নাটকের গতি ও পরিণতি ও নাট্যরীতি সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য ষ্টপার্ড এই নাটক রচনা করেছিলেন, এটিকে শুধুই কোন নিরীক্ষাধর্মী প্রচেষ্টা বলে গণ্য করলে ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে ষ্টপার্ড আর একটি নতুন নাটকই সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃজনক্রিয়ায় অন্যান্য আধুনিক নাট্যকারদের পথ ধরে হেঁটেছেন। কিন্তু তার মূলসূত্রে রয়েছেন শেক্সপীয়র। তাঁকে তিনি অনুসরণ করেছেন অপ্রকৃতিস্থতা, কাহিনী-নিরপেক্ষ পরিভ্রমণকারী নাট্যদল, রক্ত ও মৃত্যুর উল্লেখে। ষ্টপার্ড একটি ভিন্নধর্মী হ্যামলেট-এর অন্যতর পুনঃসৃজনে প্ররোচিত হয়েছেন।  

শেক্সপীয়রের এই সুবিখ্যাত নাটক হ্যামলেট-কে ভেঙে বোধ হয় নানা সমাজে বহু নাটকই পুনঃসৃজিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কয়েক বছর আগে কোলকাতার হ্যামলেট নামে একটি মঞ্চায়ন বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ঢাকাতেও হ্যামলেট-কে অবলম্বন করে আমাদের গ্রামীণ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে দর্পণ নামে একটি আলাদা নাটক রচনা করেছিলেন আলী যাকের। ১৯৯৪ সালে হ্যামলেট ওহ্ হ্যামলেট নামে শেক্সপীয়র প্রণোদিত হয়ে অন্য একটি বাংলা নাট্যভাষ্য রচনা করেছিলেন বিপ্লব বালা। একে বাংলা ভাষ্যকার বলেছিলেন একটি রাজনৈতিক মিথ্ । নাটকের নির্দেশক আশীষ খন্দকার যা বলেছিলেন তা অবশ্য বেশ দুর্বোধ্যই ছিল:

`We basically tried to synchronize the prevailing psychology and environmental flaws with the classic moment of this era. We always express our gratitude towards the original Hamlet psychology. We tried to project our Hamlet within our disabled time reference`.

প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে আমাদের সমকালীন আর একজন নাট্যকারের কথা। সৈয়দ শামসুল হক শেক্সপীয়রের জুলিয়াস সীজার অবলম্বনে রচনা করেছিলেন গণনায়ক। তিনি ভূমিকায় বলেছিলেন, তিনি ওই এলিজাবেথীয় নাট্যকারের দ্বারা বিতর্কাতীতভাবেই প্রভাবিত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি অনুকরণের পথ ধরে এগোন নি, তিনি যেন এক মহান অগ্রজের পাশে বসে ভিন্ন একটি নাটক রচনা করছিলেন।

এখন বিশেষভাবে হ্যামলেট-কে পুনঃসৃজিত যে নাটকটি নিয়ে আলোচনা করব তা Collage Hamlet নামে বিশেষভাবে পরিচিত। নাটকটি রচনা বা পুনঃনির্মাণ করেছিলেন চার্লস মারোভিৎস (Charles Marowitz)। চার্লস মারোভিৎস প্রকৃতপক্ষে নাট্যকার কি না সে বিষয়ে নিজেই কখনও কখনও সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রধানত নাট্য নির্দেশক এবং অন্যতর পরিচয়ে নাট্যসমালোচক। তাঁর মতে একজন নির্দেশক মূলত একজন সমালোচক-তিনি যেমন নাট্যকারের সমালোচক, তেমনি অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও। যাই হোক, মারোভিৎসের এই ত্রিমুখী ভূমিকা এবং নবতর ব্যাখ্যা প্রদানের গুণ তাঁকে শেক্সপীয়রের নিকটবর্তী করেছে। আবার স্বাতন্ত্র্য ও দৃষ্টিভঙ্গির আধুনিক প্রবণতা তাঁকে দূরবর্তীও করেছে। এবং এই দ্বন্দ্বকে তিনি অসামান্য নৈপুণ্যে তাঁর সৃজনক্রিয়ার মধ্যে প্রকাশ করিয়েছেন। মারোভিৎসের তত্ত্ব হল নাট্য পুন:নির্মাণে প্রকৃতপক্ষে নাটকের আঙ্গিকগত প্রকাশরীতিকে নিজস্ব ভঙ্গিতে রূপান্তরিত করতে হয়। তাঁর এই তত্ত্বকে তিনি dramatic syntax বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর ভাষায়:

In grammar, syntax is what makes possible the construction of sntenees; it is that arrangement or order which defines subjects, predicates and other kinds of agreed relationships in the formulation of language. In our terms, syntax is very much the same. It assembles the subjects and predicates of the agreed action (i.e. the play) so that comprehensible relationship can be created between them. In the theatre, unlike grammar, there are innumberable ways of interpreting the agreed action (the play) and so the making of syntax depends very largely on how individual directors and actors see the material before them…… the change of syntax, like a change in key-signature, can radically alter the way a dramatic vocabulary is expressed; and these changes can sometimes be as drastic as a piece of music peformed in a major or minor key, with a twelve-tone scale or entirely by electronic means.

মারোভিৎস syntax-এর যে তত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন তা যেমন শব্দ ব্যবহারের ব্যাকরণগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নাট্যকলার প্রয়োগকৌশলের দিক থেকেও তা সবিশেষ মনোযোগ দাবি করে। মারোভিৎস তাঁর সৃজনশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে অনুবাদই করছেন। কিন্তু ‘মৌলিক অনুবাদ’-এ ধরনের শব্দবিন্যাস থেকে যা বোঝা সম্ভব তা-ই গ্রহণ করতে হবে। ষ্টপার্ডের মত তিনিও শেক্সপীয়রের হ্যামলেট-এর কাহিনীকে গ্রহণ করেছেন, আবার প্রথমোক্ত ‘মৌলিক’ নাট্যকারের মত তিনি নব নির্মাণ প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যার দ্বন্দ্বকে প্রধান করে তোলেন নি। তিনিও অন্যতর সৃষ্টি করেছেন, এবং তা করতে গিয়ে তিনি নিজেই অনেকগুলো মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন, হ্যামলেট-এর কাহিনীর ওপর নির্ভর না করে কি নিজের কোন আলাদা অভিমত প্রকাশ করা যায়। এই নাটকের কাহিনী তো বলতে গেলে আমাদের সবারই জানা, এমন কি যাঁরা এই নাটক পড়েন নি বা এর মঞ্চায়ন দেখেন নি, তাঁদেরও। আমাদের প্রত্যেকের মনের মধ্যেই এই নাট্যকাহিনীর সূত্রে এক ধরনের collective unconcious  ক্রিয়াশীল থাকে, তা থেকেই কি নাটকটিকে এত পরিচিত বলে মনে হয়? আর যদি তাই হয়, সেক্ষেত্রে এমন সর্বজনবিদিত কোন কাহিনীকে পুননির্মাণ বা পুনর্বিন্যাস করা সম্ভবপর কি? মারোভিৎসের ভাষায়:

`If Hamlet were a precious old vase which shattered into a thousand pieces, could one glue the pieces all together into a completely new shape and still retain the spirit of the original?`

মূল নাটকের spirit রক্ষা করার কোন প্রয়োজনীয়তা বা বাধ্যবাধকতা আছে কি না এমন একটা সঙ্গত প্রশ্ন আমরা মারোভিৎসের কাছেই রাখতে পারি। শেক্সপীয়রের কর্ম সম্পর্কে ঐতিহাসিক কারণেই অনেক myth তৈরি হয়েছে, সেগুলিকে ভাঙনের কোন উদ্দেশ্য দ্বারা পুনঃসৃজনক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে না।

বরং ওইসব myth-কে গতিশীল প্রক্রিয়ায়  ও ভিন্ন মাধ্যমে রূপান্তরিত করা যায়। মারোভিৎসের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায় তিনি শেক্সপীয়রের নাটকের কাহিনী-সংগঠনের সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিতে পারছেন না। তিনি শেক্সপীয়রের নাটক থেকে বিমূর্ত চিন্তাসমষ্টিকে আলাদা করে পরীক্ষা করতে চাইছিলেন। কিন্তু এখানেই একটি বিরোধ লক্ষ্য করা যায়, মারোভিৎসের ব্যাখ্যা প্রকৃতপক্ষে গড়ে উঠেছে শেক্সপীয়রের কাহিনীর বর্ণনামূলক পাঠ থেকেই। যেমন, এমন একটা বিষয় তিনি জোরেসোরেই বলতে চান যে, নাটক আরম্ভ হবার আগেই ওফেলিয়া ও হ্যামলেটের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, তাঁর Collage Hamlet-এর ভূমিকায় সেকথাই তিনি বলেছেন। এমন একটি বিষয়কে যদি প্রতিষ্ঠা করা যায়, যা নাট্যদর্শকদের দিক থেকে, অন্তত  আধুনিককালে আর অগ্রহণযোগ্য নয়, তাতে নাটকের উপস্থাপনায় আলাদা একটা মাত্রা যুক্ত হয়, প্রেমকাহিনীর যতটুকু ব্যাপ্তি আছে শেকস্পীয়রে, তাকে আরও পরিব্যাপ্ত ও গভীর, জটিল ও দ্বন্দ্বমূলক করে তোলা যায়, অন্তত ওফেলিয়ার চরিত্রাভিনেত্রী অভিনয়ের অতিরিক্ত space সৃষ্টি করে নিতে পারেন তাঁর জন্য এবং তা দর্শকগ্রাহ্য হতে পারে। এমন কাহিনীর নির্মিতি হয়ত নান্দনিকতাকেও ক্ষুণ্ন করবে না, তবে তা যে শেক্সপীয়রের কাহিনীর বৃত্তটাকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছাকৃত উদ্যোগ বলে বিবেচিত হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

মারোভিৎসের নিজের প্রতিষ্ঠিত syntax theory-এর বাঁধনে Collage Hamlet হয়ে উঠেছে উদারপন্থী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিষয়ে  সমালোচনামূলক নিবন্ধের সমান্তরাল এক সৃষ্টি। শেক্সপীয়রের নাটক পড়ার সময় মারোভিৎস তাঁকে `romantic hero` বলেই আবিষ্কার করেছেন। মারোভিৎসের ভাঙনের পথটা ষ্টপার্ডের মত বৈপ্লবিকভাবে ভিন্ন নয়। তিনি হ্যামলেটকে দেখছেন উদারচেতা এক তরুণ হিসেবে, যে বাস্তবের মুখোমুখি পরাভব এড়াতে নানান দার্শনিকতাগন্ধী শব্দসম্ভারের মধ্যে আশ্রয় খুঁজছেন। ঐতিহ্যিক রীতিতে হ্যামলেট যেভাবে গৃহীত হয়েছে বা তার চরিত্র রূপায়ণে যা অগ্রাধিকার পেয়েছে মারোভিৎস তার মধ্য দিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতাকেই দেখতে পেয়েছেন। তাঁর ভিন্নতা শুধু এখানেই।

I attempted to delincate a criticism of the type of person Hamlet was and, by inference, to indict the values he represented; values which (i.e. misdirected moral concern, intellectual analyses as action-substitute etc.) were, in my view disreputable in our society and which derived much of their respectability and approval from traditional works such as Shakespeare’s Hamlet.

মারোভিৎস হ্যামলেটকে প্রশ্রয়প্রবণ সমালোচকবৃন্দের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চান নি। হ্যামলেটের দার্শনিকতা, দ্বিধাদ্বন্ধ, অন্তর্লীন কষ্ট-বেদনাকে এক গভীর মানবিক যন্ত্রণার অবরুদ্ধ প্রকাশ হিসেবে বিচার করার এক ধরনের ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে সমলোচক বা অনুরাগীদের মধ্যে। তাঁর পতনের কারণ হিসেবে তা চিহ্নিত হলেও হ্যামলেট tragic hero হিসেবে তাঁর স্থান অক্ষুন্ন রাখেন, তিনি পাঠক-দর্শকের দৃশ্য-অদৃশ্য অশ্রু দাবি করেন। হ্যামলেটের চরিত্র বিচারের এই প্রবণতার মধ্যেও এক ধরনের রোমান্টিকতা আছে বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেন। কিন্তু রাজকীয় ইতিহাস ও তার আবহ যখন আর মানুষের মধ্যে তেমন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে না, তখন আমাদের সামনে দৃষ্টির ঐতিহ্যিক আড়ালও ভেঙে যায়। হ্যামলেটকে আমরা আধুনিক মানুষের পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচনা করি বিবিধ কারণে, আমাদের আত্মিক বোধ ও বাস্তবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তির অভাবকে অনায়াসে হ্যামলেটের সহোদর চিন্তার প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখি--এভাবেই হ্যামলেট আমাদের আত্মিক জগতের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফলস্বরূপ আমরাও হ্যামলেটসুলভ চিন্তা-প্রতিচিন্তার বৃত্তের বন্দী হয়ে উঠি। এই লক্ষণটিরই প্রতিবাদ করেছেন কয়েকজন সমালোচক। ভাবনার বন্দীত্বকে দ্বান্দ্বিক অবস্থান থেকে পরীক্ষা করতে চান তাঁরা। চার্লস মারোভিৎসও এই প্রশ্নের প্রতি তাঁর উত্তর ছুঁড়ে দিয়েছেন; তিনি হ্যামলেটকে একটি প্রহসনমূলক চরিত্র (farcial figure) হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। হ্যামলেটের মত চরিত্র আধুনিক কালের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন, সে বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর মন্তব্য করেছেন মারোভিৎস:

...by assaulting the character of Hamlet, one was dividing the supreme prototype of the conscience-stricken but paralysed liberal. One of the most lethal and obnoxious characters in modern times.

শেক্সপীয়রের নাটকের প্রথম অঙ্কের ২য় দৃশ্যে আমরা হ্যামলেটের দীর্ঘ স্বগতোক্তি (পংক্তি ১২৯-১৫৯) শুনতে পাই। এই স্বগতোক্তিতেই হ্যামলেট সেই মন্তব্য করছেন যা অনেক সময় শেক্সপীয়রের অভিমত হিসেবে ভ্রান্তভাবে উল্লিখিত হয়ে থাকে-Frality thy name is woman. হ্যামলেট তাঁর অস্থিরতা প্রকাশ করছেন-এক মাসের মধ্যে তাঁর মা বিয়ে করেছেন তাঁর পিতৃব্যকে। এই উক্তির মধ্যেই হ্যামলেট বলছেন- O god, a beast that wants discourse of reason. তাঁর উক্তি শেষ হচ্ছে এভাবে:

O, most wicked speed, to post
with such dexterity to incestuous sheets
It is not, nor it cannot come to good.

But break my heart, for I must hold my tongue.

চার্লস মারোভিৎস এই অংশটিকে ভেঙে ক্লডিয়স ও হ্যামলেটের পিতার প্রেতাত্মার মধ্যে তুলনা করছেন এবং তা করতে গিয়ে নাটকের অন্যান্য অংশ থেকে প্রেতাত্মা, রাণী ও ক্লডিয়সের বিচ্ছিন্ন সংলাপ সংকলিত করেছেন। এই ভাঙনের ভিতর দিয়ে যে Collage Hamlet সৃষ্টি করছেন, তাই তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির ও সৃজন প্রক্রিয়ার ভিন্নতা প্রমাণ করে। এই দৃশ্যের সংগঠনে মারোভিৎস আর এক দুঃসাহসী ভাঙন রচনা করেন। এই দৃশ্যের মধ্যেই গাট্রুড ও ক্লডিয়স দৈহিক সঙ্গমে লিপ্ত হয়, দৃশ্যে তখনও হ্যামলেট রয়েছেন, কিন্তু কি ঘটছে তা দেখতে পায় না সে। এই দৃশ্যবিন্যাস আমাদের রুচির  সঙ্গে সংঘাত ঘটাতে পারে, শেক্সপীয়রীয় রীতিতে তা অকল্পনীয়, কিন্তু মারোভিৎসের উদ্দেশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট, এক অর্থে কালোপাহাড়ী (iconoclastic)। ওই দৃশ্যেই সংঘটিত বিষয়কে হ্যামলেট উপেক্ষা করছেন, কিন্তু দর্শকদের প্রতি তাকিয়ে আবার তাঁর স্বভাবজাত দার্শনিক বাকস্ফূর্তি প্রকাশ করছেন, যা ভীষণভাবে হাস্যকর বলে প্রতীয়মান হয়। আবার একবার রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণের কথা উল্লেখ করতে চাই। দ্বিতীয় অঙ্কের ২য় দৃশ্যে হ্যামলেট বন্ধুদের উদ্দেশে জীবন সম্পর্কে তাঁর বর্তমান যে ভাষ্য প্রদান করছেন, Collage Hamlet-এ মারোভিৎস সেই শব্দসম্ভারকে তুলে এনেছেন এমন বিপর্যয়কর একটি দৃশ্যে। আমরা হ্যামলেটের উক্তি স্মরণ করতে পারি।

..I have of late--but wherefore I know not--lost all my mirth, forgone all custom of exercises; and indeed it goes so heavily with my disposition, that this goodly frame the earth seems to me a sterile promontory, this most excellent canopy the air, look you, this over-hanging firmament, this majestical roof fretted with golden fire, why it appeareth nothing to me but a foul and pestilent congregation of vavoprs. What a piece of work is a man, how noble in reason, how infinite in faculties, in form and moving, how express and admirable in action, how like an angel in apprehension, how like a god: the beauty of the world, the paragon of animals. And yet to me, what is this quintessence of dust? Man delights not me, nor women neither..

হ্যামলেটের এই উক্তি পড়তে গিয়ে আমরাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। এও যেন এক গভীর বেদনার স্বগতোক্তি। বেদনা ও কষ্টের কথাটা বোঝা যায়। হ্যামলেটের কয়েকটি শব্দবন্ধ-sterile promontry, reason এবং nor women -বিচ্ছিন্ন করে নেয়া যায় এবং সেভাবেও এর বিশ্লেষণ সম্ভব, মারোভিৎসের দৃশ্য পরিকল্পনায় তখনও মঞ্চে পিতার প্রেতাত্মা রয়েছেন, উপস্থিত আছেন ফর্টিনব্রাস। হ্যামলেটের বাকস্ফূরণের পর তাঁরা বিরক্ত হয়ে মঞ্চ ছেড়ে চলে যান। মারোভিৎসের উদ্দেশ্যে ও তাঁর ভাঙনের মর্মকথা আমরা বুঝতে পারি।

পলোনিয়াসকে অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছিল হ্যামলেট। নিহত পিতার সন্তান লেয়ারটিসকে হ্যামলেটের বিপরীতে স্থাপন করেছেন মারোভিৎস। রাজার সঙ্গে লেয়ারটিসের কথোপকথনে তীব্রতা ও ঝাঁঝ লক্ষ করি। হ্যামলেটও সেখানে উপস্থিত থাকেন। লেয়ারটিসের আবেগের তীব্রতা দেখে তিনি সামান্য বিব্রত বোধ করেন মাত্র। এভাবেই মারোভিৎস এক করুণ হ্যামলেটকে আঁকেন। হ্যামলেট কিছু শিশুতোষ সংলাপ উচ্চারণ করেন। মারোভিৎসের Collage-এ হ্যামলেট রাজসভার এক ভাঁড়ের সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধের খেলায় অংশগ্রহণ করেন। একটা খেলনা তরবারী নিয়ে তিনি লম্ফঝম্প কারেন। আর ভাঁড় যেন খেলায় অংশগ্রহণ করছে এক অদক্ষ অভিনেতার সাথে। তাঁকে নাটকীয় সংলাপ বলতে প্ররোচিত করেন, কিন্তু তা তো হ্যামলেটের ক্ষমতার বাইরে। সঙ্গমদৃশ্য যাঁকে আলোড়িত করতে পারে না, জীবনকে উপেক্ষা করার সকল ক্লান্তিকে যিনি আহরণ করেছেন, তিনি জীবনের নাটকে আর প্রার্থিত ভূমিকা পালন করতে পারেন না। মারোভিৎস তাঁর নিজস্ব প্রতিক্রিয়ায় বলতে গেলে এক সংহারী পরিকল্পনায় রচনা করেছেন Collage Hamlet. মারোভিৎসের এই ভাঙন প্রক্রিয়া কোনভাবেই নিরীক্ষাধর্মী নয়, তিনি আলাদা নাটক লিখেছেন। কিন্তু তাঁর সেই পার্থক্য আবার Rosencrantz and Guildenstern are Dead এর সঙ্গে তুলনীয় নয়। দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিকল্পনাগত অগ্রাধিকার একেবারেই ভিন্ন ধরনের। হ্যামলেটকে Farcial এবং pathetic চরিত্র হিসেবে দাঁড় করাতে গিয়ে চার্লস মারোাভিৎসকে প্রহসনের কোলাজ সৃষ্টি করতে হয়েছিল। স্টপার্ডের আক্রমণের বিন্দু ছিল শেক্সপীয়রের Hamlet এর সামগ্রিক পরিকল্পনায় দু’জন নির্দোষ চরিত্রের অবস্থান ও মরণশীল পরিণতি। আর মারোভিৎসের লক্ষ্যস্থল হ্যামলেটের মেরুদদণ্ডহীন অবস্থান। তা করতে গিয়ে Collage-এ আরো অনেক অভিনব উপাদান জুড়ে দিয়েছেন তিনি। হ্যামলেট একটি ছবি (film) দেখেন, সেই ছবিতে রাজা ওফেলিয়ার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হন, হ্যামলেট বসে বসে দেখেন, কোন তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না। মারোভিৎসের হ্যামলেট এক শক্তিহীন অক্ষম রাজকুমার, অনিবার্যভাবেই যার সঙ্গে রাজনীতির যোগ রয়েছে। তাঁর সামনেই অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, অপরাধের দৃশ্য ও মাত্রা সম্পর্কে তিনি জানেন। কিন্তু তিনি শুধুই তাকিয়ে আছেন, দেখছেন না কিছুই। কথা বলছেন, বিরতিহীন দার্শনিক সংলাপ উচ্চারণ করছেন, কিন্তু কোন রকম কর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছেন না। এইখানে হ্যামলেট চরিত্রের ঐতিহ্যগত সমালোচনার সঙ্গে মারোভিৎসের সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। প্রকৃতপক্ষে এই বীতকর্ম অবস্থান থেকেই তাঁর নাটকের উদ্ভাবন। মারোভিৎস এক্ষেত্রে বহুসংখ্যক শেক্সপীয়রপ্রেমীকে আহত করেছেন হয়ত। একটি ভয়ানক দুঃসাহসী দৃশ্য রচনায় তিনি দেখাচ্ছেন, -ক্লডিয়স ও গাট্রুড হ্যামলেটকে বাধ্য করছেন তাঁর পিতার কানের ভিতর বিষ ঢেলে দিতে। আমাদের কাছে দৃশ্যটি যতই বিপর্যয়কর ও হ্যামলেটের প্রতি নির্বিচারমূলক মনে হোক মারোভিৎসের একটা আদর্শিক ব্যাখ্যা আছে। তা হল, অন্তর্মুখী ও নিষ্কর্মা জীবন যাপনের যে উদারপন্থী দর্শনের তিনি অভিসারী, তাঁর অন্তর্লীন বুর্জোয়া চরিত্র প্রমাণ করে যে, নাটকে সংঘটিত অপরাধের জন্য ক্লডিয়স যতটা দায়ী, হ্যামলেট তাঁর কর্মভীরু বাক্সর্বস্ব আচরণজনিত কারণে সমভাবেই দায়ী।

চার্লস মারোভিৎসের Collage Hamlet-এ প্রধান চরিত্রকে এমনভাবেই বার বার অন্যান্য প্রধান ও অপ্রধান চরিত্রের বিপরীতে স্থাপন করা হয়েছে। শেক্সপীয়রের নাটকেও প্রতিতুলনার সুষ্পষ্ট আভাস আছে। যেমন, হ্যামলেটের পিতার সঙ্গে ক্লডিয়স, মায়ের সঙ্গে ওফেলিয়া, নিহত পিতার পুত্র হিসেবে হ্যামলেট ও লেয়ারটিস, নরওয়ের রাজকুমার ফর্টিনব্রাস ও ডেনমার্কের রাজকুমার হ্যামলেট, রোজেনক্রাৎস ও গিল্ডেনষ্টার্ণের মধ্যে ভিন্নধর্মিতা বা বৈপরীত্য না থাকলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের সম্পূরক লক্ষণ আছে। কিন্তু শেক্সপীয়রের নাটকের অথবা আরও বিশেষভাবে উল্লেখ করতে গেলে হ্যামলেটের সঙ্গে দর্শকের সংবেদী ও আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠে বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বা বিরোধের মধ্যে ততটা নয়, যতটা তৈরি হয় হ্যামলেটের স্বগতোক্তি বা তার সহোদর আবেগপ্রবণ সংলাপের মাধ্যমে। কিন্তু মারোভিৎস ওই স্বগতোক্তি ও আবেগার্ত সংলাপসমূহকে Collage- এ হাস্যকরভাবে রূপান্তরিত করেছেন। ফর্টিনব্রাসের সঙ্গে প্রতিতুলনায় মারোািভৎস কর্ম-উদ্দীপনাকে অনেক বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর সংলাপে অনেক পৌরুষ ও শক্তিময়তার লক্ষণ দেখতে পাই আমরা। যেমন-ফর্টিনব্রাস নির্দেশ দিচ্ছেন, শেক্সপীয়রের নাটকেই-

Go, Captain, from me greet the Danish king
Tell him that by his licence Fortinbras
Craves the coveyance of the promis’d march
Over his kingdom

এর একটু পরেই কর্মভীরু হ্যামলেট আবার ৩৫ পংক্তির দীর্ঘ এক স্বগতোক্তিকে মঞ্চে নিষ্কর্মা আধিপত্য বিস্তার করেনঃ

How all occasions do inform against me,
And spur my dull revenge! What is a man,
If his chief good and market of his time
Be but to sleep and feed?
  

(বাঁকা হরফ আমার)

শেক্সপীয়রও হ্যামলেটকে কর্মভীরু চিন্তক হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যে ছিল এমন একজন ভাবুক নায়কের প্রতি আমাদের সমবেদনা ও শ্রদ্ধার উদ্বোধন। মারোভিৎস এই নায়কের আচরণের নিন্দা করার জন্যই তাঁর পুনরচিত নাটকে বিভিন্ন হাস্যকর, প্রায়-অবাস্তব ও বিদ্রুপকর দৃশ্যাবলি সংযোজন করেছেন। তিনি একটি বিদ্যালয় কক্ষের দৃশ্য সৃষ্টি করেছেন যেখানে রাণী শিক্ষিকার ভূমিকায়, ছাত্রছাত্রী হিসেবে দেখা যাবে লেয়ারটিস, ওফেলিয়া, ভাঁড় ও হ্যামলেটকে। স্কুলের ক্লাস থেকে ফর্টিনব্রাস হ্যামলেটকে ডেকে আনেন এবং এই বলে ব্যঙ্গ করেন যে, দাঁড়াও আমি তোমার জন্য একটি আয়না নিয়ে আসি, যেখানে তুমি তোমার নিজের ভেতর দিকটা দেখতে পাবে। লক্ষণীয় বিষয় হল, মারোভিৎসের Collage Hamlet কে কোনভাবেই রূপান্তর বলা যাবে না, যেমন বলা যাবে না আরও অনেকগুলো পুনর্নির্মিত নাটককে, তিনি হ্যামলেটের সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার জন্য আরেকটি নাটক লিখেছেন মাত্র। সূত্র হিসেবে শেক্সপীয়র রয়ে গেছেন, কাহিনীর প্রতি কোন দায়বদ্ধতা নেই। এখান থেকেই শেকস্পীরের নাটককে ভেঙে তারপর গড়ার যে মারোভিৎস পদ্ধতি বা Syntax theory তা অনুধাবন করতে হবে। মারোভিৎস নাট্যনির্দেশক হিসেবে যা বলার চেষ্টা করেছেন তা হল, আমরা যেন কাহিনীর দ্বারা পূর্ণত প্রভাবিত না হই, তাতে নাট্য প্রযোজনার কোন বার্তা সোচ্চার হয়ে ওঠে না, আমরা ঘটনার সংঘাতে আহত বা নিহত চরিত্রদের প্রতি দুর্বলতার প্রকাশ দ্বারাই আমাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করব সেক্ষেত্রে। নিষ্ক্রিয়তার মাশুল হ্যামলেটকেই গুনতে হয়েছে নিজের প্রাণ দিয়ে। কিন্তু ওই  প্রাণদান কি পরিপার্শ্বের অপরাধবৃত্তটাকে কোনভাবে প্রভাবিত করে, নাকি আমরা উত্তরহীন একটা জগতে আমাদের অসহায় অস্তিত্বের কথা চিন্তা করতে করতে মঞ্চগৃহ ত্যাগ করব। মারোভিৎস এখানেই বলতে গেলে শেক্সপীয়রের সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব বিতর্কে লিপ্ত হয়েছেন। শেক্সপীয়র নিজেও থিয়েটারের মানুষ ছিলেন, রাজনীতি ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বিষয়ে তাঁর ভাবনার জগতও ক্রিয়াশীল ছিল; তার তো আমরা সবিশেষে পরিচয় পেয়েছি তাঁর ঐতিহাসিক নাটকসমূহে ও অন্যান্য কয়েকটিতেও। মারোভিৎসের দৃষ্টি সাধারণ ক্ষমতার রাজনীতির বৃত্ত অতিক্রম করে আরও গভীর সমাজতাত্তিক বিশ্লেষণে নিমগ্ন ছিল। তাই হ্যামলেটকে তিনি অমন হ্রস্ব ও হাস্যকরভাবে আঁকতে পেরেছিলেন, এমনকি তাঁকে ভাঁড়ের সমকক্ষ করে তুলেছেন, যেন এইজন্যই যে, ভাঁড়ও তো কাহিনীর কোন ক্রিয়ায় অংশগ্রহণে অপরাগ। নিচের উদ্ধৃতিটি বিবেচনা করতে পারিঃ

Clown (As prompter) A father kill’d...a mother stain’d...
Hamlet (Dully) A father kill’d... a mother stain’d…
Clown (Decides to prompt from another part of the speech)
Bestial oblivion...
Hamlet (Revved up again) Now whether it be
Bestial oblivion or some craven scruple
Of thinking too precisely on the event
(Clown breathes sigh of relief and departs
Thankful he’s got the show on the road again)

শেক্সপীয়রের কাহিনীকে নিয়ে নিজের নাটক নির্মাণ করতে গিয়ে, মারোভিৎস টম স্টপার্ডের মত উদ্ভট নাটকের আবহ সৃষ্টি না করলেও ওপরের অংশটার সঙ্গে absurd drama এর দূরত্ব কিন্তু খুব বেশি নয়। কিন্তু রূপান্তরের অন্য দু’একটি ক্ষেত্রে মারোভিৎসের প্রয়োগকৌশল অনেকটা এডওয়ার্ড বন্ডের নিকটবর্তী। Collage Hamlet-এ পলোনিয়াসের মৃত্যুর জন্য হ্যামলেটকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিল. রাজকীয় বা সামন্ত সমাজের আধিপত্যবাদের জোরে অথবা নায়কের খেয়ালীপনা হিসেবে হ্যামলেট বিচার এড়াতে পারে না। অপ্রকৃতিস্থ হিসেবেই তাঁর বিচার হয়েছিল, অতএব বিচারের রায়ে তাকে একটা মানসিক রোগীদের আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করতে হয়েছিল। ফর্টিনব্রাস বলতে গেলে জোর করেই তাঁকে সেখানে আবদ্ধ করেছিল। ফর্টিনব্রাস বারে বারে চেষ্টা করেছে যাতে হ্যামলেটকে পৃথিবীর কর্মময়তার মধ্যে ফিরিয়ে আনা যায়, কিন্তু প্রতিবারই সে ব্যর্থ হয়েছে।

মারোভিৎস এলিজাবেথীয় নাট্যকারের অনুকরণে হ্যমিলেটের জন্য আমাদের সমবেদনা সৃষ্টির চেষ্টা করেন নি, বরং তিনি চেয়েছেন এই নায়কের আচরণ দেখে আমরা তাঁকে নিয়ে ঠাট্টামস্করা করি। Collage Hamlet-এর শেষ দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই হ্যামলেট সেই শব্দাবলি উচ্চারণ করছেন-To be or not to be that is the question, আর তাঁর হাতে একটা খেলনা তরবারি। তাঁর চারপাশে অন্যান্য চরিত্ররা সমাবিষ্ট হয়, তারাও তাকে নিয়ে নানা তামাসা করছে। হ্যামলেট তাঁর খেলনা তরবারি নিয়ে তাদের আহত করার নিষ্ফল চেষ্টা করছে এবং এতে আরও অধিক হাস্যরসের সৃষ্টি হচ্ছে। উদারচেতা হ্যামলেট এখন এক প্রহসনের প্রধান চরিত্র, তাঁর অস্ত্র মরচে পড়া আর তাঁর ভাষার শাণিত শক্তি অতি ব্যবহারে আজ জরাজীর্ণ।

মারোভিৎস নাটকের কাহিনী-ভিত্তিকে নাকচ করতে গিয়ে এতটাই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছেন। এইসব কালজয়ী নাটকের textual প্রযোজনা সম্পর্কে তাঁর মন্তব্যকেও আমরা খুঁজে পাব এর মধ্যে। ঘটনা বিন্যাসকে এলোমেলো করে দিয়ে এবং মাঝে মাঝেই নিজের মত কাহিনী সংগঠিত করে তিনি শেক্সপীয়রের কাহিনী থেকে নাট্য প্রযোজনাকে যথাসম্ভব প্রত্যাহার ও পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি কাহিনীর বিন্যাসে ধৃত myth ভাঙতে চান নি, তিনি চেয়েছেন অন্যদের অনুকৃতি ও তাঁদের নির্মিত Shakespeare myth টাকেই ভাঙতে। আর সেই myth কে তিনি পুনর্নিমাণ করতে চেয়েছেন আধুনিক কালের দর্শকদের জন্য, যাঁরা শুধু রাজনীতির সমাজনীতির নানান দ্বন্দ্বিক অবস্থান সম্বন্ধেই ওয়াকিবহাল নন, নাটকের নিজস্ব syntax কেও স্বীকৃতি দিতে শিখেছেন। তাই মারোভিৎসের-শেক্সপীয়র পুনর্কথন ও সৃষ্টি সমসাময়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। তাঁর  কাজের স্থায়িত্ব নিয়েও সংশয় থাকতে পারে। টম ষ্টপার্ডের আলোচিত নাটক আজ আর ততটা মূল্য বহন করে না, কিন্তু এডওয়ার্ড বন্ডের গ্রহণযোগ্যতা মোটেও হ্রাস পায় নি। কিন্তু মারোভিৎস ও এই স্কুলের সবাই আমাদের কাছে প্রশ্ন সৃষ্টি করে- শেক্সপীয়র বা এমন ধ্রুপদী সাহিত্য সম্বর্কে আমাদের ঐতিহ্যগত মনোভাাব চিরস্থায়ী কোন বিষয় নয়। মাইকেল স্কটের কথা দিয়ে শেষ করি:

Marowvitz at least has helped to problematise Shakespeare at a time when the dramatist’s work has been in danger of being dominated and misrepresented by the cliches of bourgeois culture.

শফি আহমেদ : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়