Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আবদুল্লাহ আল-মামুনের মঞ্চনাটক : ঢাকার বাইরে

Written by তপন বাগচী.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আবদুল্লাহ আল-মামুন (১৯৪৩-২০০৮) বহুমুখী প্রতিভা। তবে তাঁর এই প্রতিভার প্রকাশ অভিনয়কলার ব্যাপক ক্ষেত্র থেকে খুব বেশি দূরে যায় নি। তিনি নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ ও চিত্রনাট্য লিখেছেন, মঞ্চে ও পর্দায় অভিনয় করেছেন, মঞ্চনাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন, টেলিভিশন-নাটকের প্রযোজনা করেছেন, চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে চাকরি করেছেন- এর সকল অঞ্চলই নাট্যক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ও সঙ্গতিপূর্ণ। তবু সকল পরিচয় ছাপিয়ে তিনি নাট্যকার হিসেবেই সমধিক পরিচিতি। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন নাটক রচনা অর্থাৎ নাট্যসাহিত্যের জন্য। নাট্যকার হিসেবে এই স্বীকৃতির পরে, অন্য সকল কৃতিত্ব সত্ত্বেও প্রথম পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। তাতে প্রকৃত শিল্পীর কিছু যায়-আসে না। এই খণ্ডিত পরিচয় ভেদ করেই প্রকৃত সত্তা একসময় প্রকাশিত হয়। আমরা জানি যে, আবদুল্লাহ আল-মামুন কিছু উপন্যাসও লিখেছেন। বিশেষ করে মানব তোমার সারাজীবন, আহ দেবদাস, হায় পার্বতী, এই চুনীলাল, গুণ্ডাপাণ্ডার বাবা উপন্যাসগুলো তাঁকে শক্তিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিপন্ন করার জন্য যথেষ্ট। একজন পাঠক হিসেবে আমার বিশ্বাস একদিন নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাশাপশি কথাসাহিত্যিক আবদুল্লাহ আল-মামুনের মূল্যায়ন হবে। গুণীর কোনো অবদানই বৃথা যায় না, ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই দেয়।

ষাটের দশকেই আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যকার-জীবন শুরু হলেও সত্তর দশকে তিনি আলোচিত ও নন্দিত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গোটা ১৯৭১ সাল জুড়ে নাট্যসৃজনে সক্রিয় ছিলেন মমতাজউদদীন আহমদ, কল্যাণ মিত্র, মামুনুর রশীদ, খারুল বাসার, কালীপদ দাস, কবীর আনোয়ার প্রমুখ নাট্যকার। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের জোয়ার আসে। স্বাধীনতার প্রথম বছর অর্থাৎ ১৯৭২ সালে যে ক’জন নাট্যকার এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত (ফেরী আসছে), আ.ন.ম. বজলুর রশীদ (রক্তকমল), মামুনুর রশীদ (পশ্চিমের সিঁড়ি, রচনা ১৯৭১), আল মনসুর (রোলার এবং নিহত এলএমজি, রেভ্যুলেশান ও খ্রিস্টাব্দ সন্ধান), নিরঞ্জন অধিকারী (কালো অশোক লাল ফুল), ফরহাদ মজহার (প্রজাপতির লীলালাস্য), সেলিম আল দীন (সর্প বিষয়ক গল্প, জণ্ডিস ও বিবিধ ও বেলুন), শাহনুর খান (সভাপতি বলবেন, পেণ্ডুলামে খুন), শচীন ভট্টাচার্য (সম্রাটের মৃত্যু), কাজী জাকির হাসান (শান বাঁধানো ঘাট), সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী (অস্থির সুস্থিতি), রবীন্দ্র ভট্টাচার্য (দিন বদলের পালা), হাবিবুল হাসান (সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ) উল্লেখযোগ্য।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালে চৌধুরী জহুরুল হক (পটভূমি), দিলীপ সরকার (অনেক রক্তের পরে), রশীদ হায়দার (তৈলসংকট), মুশতারী শফি (বিধ্বস্ত বাসনা), শহীদুল হক খান (রক্তশপথ), আশুতোষ দত্ত (ছায়াছবির অঙ্গনে), কল্যাণ মিত্র (সূর্যমহল), নীলিমা ইব্রাহীম (যে অরণ্যে আলো নেই), আল মনসুর (হে জনতা আরেকবার), সেলিম আল দীন (এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা, করিম বাওয়ালির শত্রু অথবা মূল মুখ দেখা, সংবাদ কার্টুন), নুরুল করিম নাসিম (বিজন বাড়ি নেই) প্রমুখ নাট্যকার তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

ষাটের দশক থেকে নাট্যরচনায় আত্মনিয়োগ করলেও প্রায় একদশক আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের খবর আমরা পাই না। ১৯৬৪ সালে লিখেছিলেন শপথ, তারপর ব্যাপক প্রস্তুতির পরে ১৯৭৪ সালে তিনি মঞ্চে নামালেন তাঁর স্মরণীয় সৃষ্টি সুবচন নির্বাসনে। এপ্রিল মাসে এর প্রযোজনার পর পাঁচ মাস পরেই সেপ্টেম্বর মাসে মঞ্চে এল এখন দুঃসময়। এই দুটি নাটকের মাধ্যমে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ-ভূখণ্ডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের সম্মান পেয়ে গেলেন। ওই সময়ে আরো যাঁরা নাটকে সক্রিয় ছিলেন, তাঁরা হলেন- আলাউদ্দিন আল আজাদ (সংবাদ শেষাংশ), মমতাজউদ্দীন আহমদ (স্পার্টকাস বিষয়ক জটিলতা, ফলাফল নিম্নচাপ, হরিণ চিতা চিল), মামুনুর রশীদ (গন্ধর্ব-নগরী), শেখ আকরাম আলী (লাশ ’৭৪), আল মনসুর (বিদায় মোনালিসা), সেলিম আল দীন (মুনতাসীর ফ্যান্টাসী) প্রমুখ।

শপথ, সুবচন নির্বাসনে ও এখন দুঃসময়-এর পরে আবদুল্লাহ আল-মামুন লিখেছেন চারিদিকে যুদ্ধ, অরক্ষিত মতিঝিল, আয়নায় বন্ধুর মুখ, উজান পবন, এখনও ক্রীতদাস, এবার ধরা দাও, ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার, তোমরাই, বুদ্ধিজীবী, মাইক মাস্টার, মেরাজ ফকিরের মা, মেহেরজান আরেকবার, স্পর্ধা, সেনাপতি, কোকিলারা, দ্যাশের মানুষ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ নাটক। ঢাকার মঞ্চে এবং তাঁর সংগঠন ‘থিয়োটার’-প্রযোজনা হিসেবে ঢাকার বাইরের মঞ্চে আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রতিটি নটিকই যশের সঙ্গে অভিনীত হয়েছে। কিন্তু আমরা চোখ ফেরাতে চাই অন্য দিকে। ঢাকার বাইরে এই সকল নাটক স্থানীয় নাট্যকর্মীরা কতটা অভিনয় করেছে কিংবা কতটা গ্রহণ করেছে, তা থেকে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের একধরনের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করা যেতে পারে।

প্রকৃত যাত্রামঞ্চ বাদ দিলে ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায় এবং উপজেলায় নাটক মঞ্চস্থ হয়। স্কুল-কলেজ এবং অফিস-ক্লাবেও নাট্যমঞ্চায়নের রেওয়াজ চালু হয়েছিল স্বাধীনতার পরে। এখন এই ধারা অব্যাহত না থাকলেও সত্তর ও আশির দশকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও নাট্যক্রিয়ার আসর বসার খবর পাওয়া যায়। এই সময় সারা দেশে যাঁদের নাটক বেশি অভিনীত হত, তাদের মধ্যে মহেন্দ্র গুপ্ত, মন্মথ রায়, তুলসীদাস লাহিড়ী, ব্রজেন্দ্রকুমার দে, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, ইব্রাহীম খাঁ, আসকার ইবনে শাইখ, ইব্রাহীম খলিল, আ.ন.ম বজলুর রশীদ, জসীমউদ্দীন, শেখ শামসুল হক, কালীপদ দাস, অন্নদামোহন বাগচী, প্রসাদ বিশ্বাস, কল্যাণ মিত্র, চরুচন্দ্র রায়চৌধুরী, শৈলেশ গুহনিয়োগী প্রমুখ অন্যতম। কিন্তু আমাদের দেশের ‘আধুনিক’ নাট্যকারদের নাটক সারাদেশে ব্যাপকভাবে অভিনীত হতে দেখা যায় না। ঢাকার বাইরে সখের মঞ্চে অনেক সময় যাত্রাদলের জনপ্রিয় ‘পালা’ থিয়েটারের আঙ্গিকে পরিবেশন করা হয়েছে।

ঢাকার বাইরের দলগুলো স্থানীয় নাট্যকারদের নাটকের মঞ্চায়নের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। এটিই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। স্থানীয় নাট্যকার না পেলে তারা হাত বাড়ায় জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতীয় পর্যায়ে। এই সমীকরণের বাইরেও কিছু কিছু নাট্যদল দেশীয় ও আধুনিক নাট্যকারদের রচনা নির্বাচন করেছেন। এক্ষেত্রে মমতাজউদ্দীন আহমদ, আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামুনুর রশীদ, কল্যাণ মিত্র, জিয়া আনসারী, রাধারমণ ঘোষ, সেলিম আল দীনের লেখা নাটক ঢাকার বাইরের নাট্যদলের কাছে কমবেশি গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত ‘তৃতীয় জাতীয় নাট্যোৎসব ১৯৭৯-৮০’ দুপর্যায়ে বিভক্ত ছিল। এসম্পর্কে নাট্য-গবেষক ড. সুকুমার বিশ্বাস জানিয়েছেন, ‘প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি জেলায় শিল্পকলা পরিষদের ব্যবস্থাপনায় ১৯৭৯ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত নাট্য উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ উৎসব ছিল প্রতিযোগিতামূলক। দেশের বিশটি জেলায় এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত পর্যায় অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়।’১  সেই উৎসবকে কেন্দ্র করে সারাদেশের ১৬৪টি দল ১৭৩টি নাটক পরিবশেন করে। নাট্যকার ও গবেষক ড. রাহমান চৌধুরী  দেখতে পেয়েছেন ওই উৎসবে ‘সবচেয়ে বেশি মঞ্চস্থ হয়েছে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচটি নাটক চৌদ্দটি দল অভিনয় করেছে।’২ পরিবেশনার সংখ্যা বিচারে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক বেশি দলে বেশিবারে মঞ্চস্থ হয়েছে। নাটকের সংখ্যা বিচারে ওই উৎসবে বেশি নাটক ছিল নাট্যকার রাধারমণ সাহার। আমরা দেখতে পাই রাধারমণ ঘোষের ৮টি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। এরপর আবদুল্লাহ আল-মামুন ও মমতাজউদদীন আহমদের নাটক রয়েছে ৫টি করে। শৈলেশ গুহনিয়োগী ও কল্যাণ মিত্রের ৩টি নাটক রয়েছে। তবে জিয়া আনসারী ও মামুনুর রশীদের ১টি করে নাটক পরিবেশিত হলেও চোর চোর করেছে ১১টি দল এবং ওরা কদম আলী করেছে ৬টি দল।৩ এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী জাকির হাসান, শেখ আকরাম আলী, এমএস হুদা প্রমুখের একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের গ্রহণযোগ্যতাই বেশি বলে ধরে নেয়া যায়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক দেশের প্রায় সকল জেলায় মঞ্চস্থ হয়েছে। গবেষক ড. রাহমান চৌধুরীর ভাষায়, ‘বাংলাদেশের আনাচে কানাচে সত্তর দশকে আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে মঞ্চস্থ হয়েছে বহুবার’।৪ আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, তাঁর নাট্যসম্ভার থেকে কমপক্ষে ৮টি নাটক ঢাকার বাইরের দল বিভিন্ন সময়ে নিয়মিত অভিনয়ের জন্য বেছে নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি দলের কাছে যোগ্য মনে হয়েছে সুবচন নির্বাসনে। ঢাকার বাইরের ১৬টি জেলার ১৮টি নাট্যদল এই নাটকটি মঞ্চায়ন করেছে।

মূল্যবোধের অবক্ষয় ও নৈতিক পতনের বিষয়টিকে তুলে ধরা হয়েছে সুবচন নির্বাসনে নাটকে। ‘সততাই মহৎ গুণ’, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে’, আর ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ এই তিনটি প্রবচন বা সুবচনকে নমুনা হিসেবে নিয়ে নাট্যকার দেখিয়েছেন যে এগুলো বচন হিসেবে ‘সু’ অর্থাৎ উৎকৃষ্ট হলেও চলমান সমাজে এর মূল্য নেই। এই নীতিকথা এখন সমাজের সর্বস্তর থেকে ক্রমশ নির্বাসিত হতে চলছে। এই বার্তাটিও নাট্যকার পৌঁছে দিতে চান। নাটকটি সম্পর্কে গবেষক ড. মো. জাকিরুল হক বলেন-

‘গভীর জীবনবোধ বা চরিত্রের তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব এ নাটকে তেমনভাবে লক্ষ্য করা না গেলেও ঘটনা বিন্যাসের সাবলীলতায়, চরিত্রের তীক্ষ্ণ তীব্র সংলাপ উচ্চারণে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে রচিত নাট্যধারায় সুবচন নির্বাসনে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।’৫  

গবেষকের বিশ্লেষণ যা-ই হোক, একথা ঠিক যে, স্বাধীনতার প্রত্যাশাভঙ্গের চিত্রটি দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলেই সমাজের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ নাট্যকর্মীরা একে সারাদেশে প্রচারের দায় বহন করেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। তাই আমরা দেখি ১৬টি জেলার ১৮টি নাট্যদল একে নিজেদের প্রযোজনা হিসেবে বেছে নিয়েছে। জামালপুর জেলার ২টি দল ‘সৃজনী সংস্কৃতি পরিষদ’ ও ‘সংলাপ নাট্যগোষ্ঠী’ এবং দিনাজপুর জেলার ২টি দল ‘দিনাজপুর নাট্যসমিতি’ ও ‘বৈকালী নাট্যগোষ্ঠী’ এই নাটকটি মঞ্চায়ন করে। অন্য ১৪টি দল হলো, চাঁদপুরের ‘অনন্যা নাট্যগোষ্ঠী’, মাদারীপুরের ‘মাদারীপুর নাট্যগোষ্ঠী’, কুষ্টিয়ার ‘অগ্রণী ব্যাংক ক্রীড়া ও সংস্কৃতি পরিষদ’, চুয়াডাঙ্গার ‘অঙ্গ আর্ট’, পাবনার ‘বনমালী ইনস্টিটিউট’, রাজশাহীর ‘রাজশাহী সাংস্কৃতি সংঘ’, মুন্সিগঞ্জের ‘প্রবাহ নাট্যগোষ্ঠী’, বগুড়ার ‘বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী’, কিশোরগঞ্জের ‘বৃহস্পতি নাট্যগোষ্ঠী’, কুমিল্লার ‘যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী’, পটুয়াখালীর ‘পটুয়াখালী ড্রামাটিক ক্লাব’, নারায়ণগঞ্জের ‘নারায়ণগঞ্জ থিয়েটার’, যশোরের ‘যশোর ইন্সটিটিউট’ ও বরিশালের ‘বরিশাল নাটক’ সুবচন নির্বাসনে নাটক মঞ্চায়নে সফলতার পরিচয় দিয়েছে।৬ এসব দল নাটকটি অসংখ্যবার মঞ্চস্থ করে।

এবার ধরা দাও নাটকটিও কম মঞ্চপ্রিয় নয়। ঢাকার বাইরের ৮টি জেলার ৮টি নাট্যদল এটি মঞ্চায়নে এগিয়ে আসে। এই নাটকে বেকারত্ব, লোভ, মানবকিতার বিপর্যয়, হতাশা ও সামজিক বিচ্ছিন্নতার চিত্র এঁকেছেন নাট্যকার। চলমান সামাজিক পটভূমিকায় এই নাটক ব্যাপক জনচেতনা সৃষ্টির উপাদান ধারণ করেছে। আর সে কারণেই এটি দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছে বলে আমাদের ধারণা। এটি ঢাকার বাইরে মঞ্চায়ন করেছে এমন দলগুলো হলো ফরিদপুরের ‘সুনিয়ম নাট্যচক্র’, শেরপুরের ‘গণসংস্কৃতি সংসদ’, রাজশাহীর ‘গুঞ্জন সাংস্কৃতিক একাডেমী’, টাঙ্গাইলের ‘নাট্যমহল’, কুষ্টিয়ার ‘ইকবাল আসফ আলী মেমোরিয়াল কাব’, রাঙ্গামাটির ‘রাঙ্গামাটি থিয়েটার’, কিশোরগঞ্জের ‘বৃহস্পতি নাট্যগোষ্ঠী’ এবং সিলেটের ‘নাট্যালোক’। এদের মধ্যে কয়েকটি দল এই নাটক নিয়ে ঢাকায় জাতীয় নাট্যোৎসবে অংশ নিয়ে তাদের পরিবেশন-কুশলতা প্রদর্শন করেছে।

এখন দুঃসময় নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ৭টি জেলার ৭টি দলের মঞ্চে। এই নাটকে সমাজে অস্থিরতা ও অব্যবস্থাপনার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোাগ, মজুতদার-কালোবাজারিদের অসাধুতা, সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই নাটকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মুল্যবৃদ্ধির চিত্রও রয়েছে এতে। বাজারকে নাট্যকার যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করে বলা হচ্ছে, ‘বাজার কে বলেছে? বলুন যুদ্ধক্ষেত্র। যেখানে প্রতিদিন পরাজিত ক্রেতার দীর্ঘশ্বাস আর শোকাশ্রু দিয়ে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে।’ এই নাটকের আবেদন ছিল দেশময়। তাই সারাদেশের নাট্যকর্মীদের কাছে এটি গুরুত্ব পায়। বরিশালের খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার, কুমিল্লার ‘আলাউদ্দিন শিল্পী সংঘ’, মুন্সিগঞ্জের ‘প্রবাহ নাট্যগোষ্ঠী’, ময়মনসিংহের ‘বহুরূপী’, বগুড়ার ‘বগুড়া নাট্যগোষ্ঠী’, দিনাজপুরের ‘বৈকালী নাট্যগোষ্ঠী’ এবং পাবনার ‘ললিতকলা কেন্দ্র’ এটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে সামাজিক অঙ্গীকার পালন করে। এটি অনেক দলের নিয়মিত মঞ্চায়নের অংশ হয়ে ওঠে।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের জনপ্রিয় আরেকটি নাটকের নাম চারিদিকে যুদ্ধ। এটি তাঁর মৌলিক রচনা নয়। খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের গল্পের নাট্যরূপান্তর ঘটিয়ে তিনি বাংলাদেশের সমকালীন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপনের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। রূপান্তর-প্রসঙ্গে নাট্যকার বলেছেন-

‘আমি প্রধানত মৌলিক নাটক রচনায় আগ্রহী। হঠাৎ করেই একটা ব্যতিক্রম ঘটে গেল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আমরা যখন নাট্যচর্চা বেশ জোরেসোরে শুরু করলাম, তখন একটা বাংলা উপন্যাস আমাকে প্রচণ্ডভাবে আন্দোলিত করল। বলা বাহুল্য উপন্যাসটির নাম ‘চারিদিকে যুদ্ধ’। লেখক স্বনামধন্য প্রফুল্ল রায়। সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বরাবরই আমার নাটক রচনা এবং আমাদের নাট্যগোষ্ঠী ‘থিয়েটার’-এর নাটক প্রয়োজনায় উৎসাহ যুগিয়ে এসেছে। তাই ‘চারিদিকে যুদ্ধ’ উপন্যাসের বক্তব্য এবং মূল উপজীব্য বিষয় নিয়ে আমি একটি নাটক লিখলাম এবং ‘থিয়েটার’ প্রযোজনা করাল সাফল্যের সঙ্গে।’৭

সমকালীন পটভূমিকায় রচিত এই নাটকে রয়েছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ও বেঁচে থাকার নিরন্তর যুদ্ধের বিবরণ। মুক্তিযুদ্ধের পরেও মানুষের যুদ্ধ থামে নি, বেকারত্ব ও অসহায়ত্ব ডিঙিয়ে কেবলি বেঁচে থাকার যুদ্ধ। চারিদিকে কেবলই জীবনযুদ্ধ- এটিই এই নাটকের প্রতিপাদ্য।

এবার ধরা দাও এবং চারিদিকে যুদ্ধ নটকদুটি সম্পর্কে নাট্যকার ও গবেষক ড. রাহমান চৌধুরীর মূল্যায়ন স্মরণ করা যেতে পারে-

‘নাটক দুটির বিষবস্তুর মধ্যে রয়েছে মধ্যবিত্ত জীবনের অতলগামী ক্ষয়িষ্ণুতা, যুগগত মূল্যবোধগুলোর বিনষ্টি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বেগ-অনিশ্চয়তা। সাধারণ মানুষের জীবনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সকল বিড়ম্বনার চিত্র নাট্যকারের মনোভূমি স্পর্শ করেছে কিন্তু তিনি নিরাসক্ত মন নিয়ে ঘটনার কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারেন নি। সেজন্য সবকিছুকে অতিনাটকীয় করে তুলেছেন।’৮

গবেষকের কাছে অতিনাটকীয় হলেও যে এর পরিবেশনা মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রমাণ সারাদেশে এর মঞ্চায়ন-প্রচেষ্টা। এই নাটকটি কুমিল্লা, পাবনা, বরিশাল ও যশোর জেলায় নিয়মিত মঞ্চস্থ হয়েছে। দল ৪টি হলো- কুমিল্লার ‘যাত্রিক নাট্যগোষ্ঠী’, পাবনার ‘ললিতকলা কেন্দ্র’, বরিশালের ‘শব্দাবলী থিয়েটার’ এবং যশোরের ‘যশোর ইন্সটিটিউট’ পরিবেশন করে।

৩টি জেলায় ৩টি দলে মঞ্চস্থ হয়েছে ক্রসরোডে ক্রস ফায়ার। এরা হলো- ফরিদপুরের ‘জেলা শিল্পকলা পরিষদ’, পাবনার ‘বনমালী ইনস্টিটিউট’ এবং নোয়াখালীর ‘ফ্রেন্ডস কাব’। এছাড়া তাঁর উজান পবন মঞ্চায়ন করেছে কুমিল্লার ‘রেনেসাঁ নাট্যগোষ্ঠী’ এবং তোমরাই মঞ্চায়ন করেছে বরিশালের ‘বরিশাল নাটক’। তোমরাই নাটকটি স্বাধীনতা-বিরোধীদের ষড়যন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনা নিয়ে বিভ্রান্তি, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে কেন্দ্র করে রচিত। তরুণ প্রজন্ম অশুভ শক্তির চক্রান্তে কীভাবে বিপথে চালিত হচ্ছে, পরাজিত শক্তির ক্রমউত্থান কীভাবে হচ্ছে- এই বিষয়গুলো তুলে ধরে মানুষকে আবার জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়েছেন নাট্যকার। ‘বরিশাল নাটক’ এর সফল মঞ্চায়ন করে বিভিন্ন মঞ্চে।

তবে জীবন বারেবারে নামে একটি নাটকের মঞ্চায়ন করেছে ‘চুয়াডাঙ্গা নাট্য একাডেমী’। এর নাট্যকার হিসেবে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাম রয়েছে। ১৯৭৯ সালে কুষ্টিয়া নাট্যউৎসবে এটি মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকটির মঞ্চায়ন কিংবা গ্রন্থনার কোনো তথ্য আর পাওয়া যায় নি।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক কেবল রাজধানী ঢাকার মঞ্চেই নয়, ঢাকার বাইরের মূলধারার নাট্যমঞ্চেও ঔৎসুক্য সৃষ্টি করেছে। এ-বিষেয়ে আরো ব্যাপক ক্ষেত্রসমীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। আমাদের হাতে পাওয়া তথ্য থেকেই বোঝা যায় যে, আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক প্রান্তবাসী নাট্যজনের কাছেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। এর প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। তাঁর নাটক আরো অনেক দলে মঞ্চস্থ হয়েছে বলে আমাদের ধারণা। সকল তথ্য আমাদের হাতে নেই বলে এ-ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মন্তব্য করা সম্ভবপর নয়। কেবল গ্রুপ থিয়েটার নয়, সাধারণ এমেচার শিল্পীরাও আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক মঞ্চায়ন করেছে। তাঁর নাটক সর্বগামী না হলেও, বহুগামী হতে পেরেছে, এই আনন্দই বা কম কীসের!

তথ্যসংকেত:
১.    ড. সুকুমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যোৎসব : কতিপয় দলিল’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ১০৫
২.    ড. রাহমান চৌধুরী, ‘রাজনৈতিক নাট্যচিন্তা ও স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের মঞ্চনাটক’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৩৫৪
৩.    ড. সুকুমার বিশ্বাস প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যোৎসব : কতিপয় দলিল’ অবলম্বনে তথ্যটি গবেষককৃত
৪.    ড. রাহমান চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৯৭
৫.    ড. মো. জাকিরুল হক, দুই বাংলার নাটকে প্রতিবাদী চেতনা’, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১৭০
৬.    ড. সুকুমার বিশ্বাস প্রণীত বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যোৎসব : কতিপয় দলিল’ অবলম্বনে তথ্যটি গবেষককৃত
৭.    আবদুল্লাহ আল মামুন, নিবেদন, চারিদিকে যুদ্ধ, মুক্তধারা, ১৯৮৩
৮.    ড. রাহমান চৌধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৩৯

 ড. তপন বাগচী : কবি-সাংবাদিক-গবেষক।