Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

সমকাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক

Written by শফি আহমেদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

২০০৮সাল ছিল আমাদের নাট্যজগতের জন্য বেশ সংবাদবহুল। বিভিন্নমাত্রিক অর্থেই। এ বছর আমরা দেখেছি প্রাচ্যনাটের প্রযুক্তিসজ্জিত ও চোখধাঁধানো মঞ্চপরিকল্পনায় রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবেশনা; রামেন্দু মজুমদার বিশ্বব্যাপী ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনসটিটিউটের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার সূত্রে সারাদেশের নাট্যকর্মীরা গর্বে ও গৌরবে ভেসেছে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগ ঐতিহ্যবাহী দেশীয় নাট্য আঙ্গিক যাত্রা কোর্সের অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের দিয়ে দ্বিজেন্দ্রলালের বিখ্যাত নাটক সাজাহান-এর যাত্রারূপ উপস্থাপনা করেছে। কিন্তু এইসব কৃতিত্ব ও শ্রমশীল উদ্যোগ ছাপিয়ে বাংলাদেশের নাট্যজগতের বিয়োগান্ত সংবাদের পুনরাবৃত্তি আমাদের সবাইকে বেদনায় মথিত করেছে। বছরের শুরুতেই শক্তিমান নাট্যকার ও নাট্যশিক্ষক সেলিম আল দীন চলে গেলেন। তাঁর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর আকস্মিকতা আমাদের বিমূঢ় ও নির্বাক করে দিয়েছিল। তা ছিল আভিধানিক অর্থেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। তারপর আগস্ট মাসে আবার এক মৃত্যুসংবাদ আমাদের চোখে নিয়ে এলো অশ্রুর ধারা। আবদুল্লাহ আল-মামুন আর নেই- এই সংবাদ রটে গেল দিকে দিকে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হাসপাতালে নিবিড় চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাই এই সংবাদে আমরা হতবাক না হলেও প্রিয়জনকে হারানোর গভীর বেদনার অভিজ্ঞতা আমাদের কেমন নিথর করে তুলেছিল। তার কিছুদিনের মধ্যেই আর এক শোক-সংবাদ। কবি-নাট্যকার-সমালোচক-শিক্ষক জিয়া হায়দারের জীবনাবসানের সংবাদ আবার নাট্যজন মায় সকল সংস্কৃতিকর্মীদের ভারাক্রান্ত করল। স্বজনকে বিদায় দেবার সময় অশ্রুসজল চোখে সবাই বলতে লাগলেন, আমাদের নাট্যচর্চার ও নাট্যভাবনার এক কর্মিষ্ঠ অথচ প্রায়-নিঃসঙ্গ অগ্রপথিকের জীবন ও কর্মের পথ চলা শেষ হলো।

এই তিন নাট্যজন তাঁদের শ্রম ও সৃজনশীল অবদানে বাংলা নাটকের অগ্রযাত্রাকে গতিশীল করেছেন, যদিও তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকাই ছিল স্বতন্ত্র চরিত্রের। প্রত্যেকের নিজস্ব ধারা এই শিল্পের কেন্দ্রিকতার টানে নাট্যকলার মহান মোহনায় হয়তবা মিলিত হয়েছে, কিন্তু বর্তমান আলোচনাকে আমি বিশেষভাবে আবদুল্লাহ আল-মামুনের কর্মের পর্যালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। আবদুল্লাহ আল-মামুন নাটকের জগতের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান অভিনেতা, দেশের অধিকাংশ মানুষ টেলিভিশনের সৌজন্যে তাঁকে সেভাবেই চেনেন ব্যাপকভাবে। মঞ্চনাটকের দর্শকবৃন্দ ও নাট্যকর্মীজন জানেন, তিনি একজন সিদ্ধহস্ত নাট্যকার। তাঁর লেখা বহু-সংখ্যক নাটকের মঞ্চায়ন মানুষকে মুগ্ধ করেছে, টেলিভিশনেও পরিবেশিত হয়েছে তাঁর লেখা অনেকগুলো নাটক। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন প্রযোজনাকে তিনি মঞ্চের উপযোগী করে পুনর্রচনা করেছেন। আবদুল্লাহ আল-মামুনের মঞ্চাভিনয়ের এক আকর্ষণী শক্তি ছিল, মঞ্চে তাঁর চরিত্র রূপায়ণের অসামান্য দক্ষতা আমাদের স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। নাট্য পরিচালক হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশজোড়া। নিজের দল ‘থিয়েটার’-এর অধিকাংশ প্রযোজনাই গড়ে উঠেছিল তাঁর নাট্য-নির্দেশনায়। এ ছাড়া অন্য দলের নাট্যকর্মীরাও কখনো-সখনো তাঁর লেখা নাটক প্রযোজনা করেছেন। নাট্য-নির্দেশনার সূত্রেই তিনি নাট্যবস্তু অনুধাবন ও পর্যালোচনা বিষয়ে এক ধরনের শিক্ষা দিয়েছেন সর্বদাই, কিন্তু এর বাইরে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি ছিলেন থিয়েটার স্কুলের উপাধ্যক্ষ। এক বছরের সীমিত সময়ে কার্যকর শিক্ষাকোর্সের বিষয়বস্তু প্রণয়ন করেছেন। এ দিক থেকে তিনি একজন পেশাদার শিক্ষকও ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের এমন বহুমুখী ভূমিকার বিষয়ে আমরা সবাই জানি। আপাতত সেসবকে পাশে রেখে ইতিহাসের দিকে একটু ফিরে তাকাতে চাই। আমাদের নাটক আজ যে পরিণতি লাভ করেছে, তার প্রারম্ভিক ও দ্বিধাময় পদচারণার কালের সঙ্গে আবদুল্লাহ আল-মামুন সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রাবস্থায় যখন নাট্যচর্চা ছিল নেহাতই একটি মৌসুমী বিষয়, কোনো বিভাগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে ‘নাটক করা’ একটি সৌখিন উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হত, নাটকের প্রতি কোনো ধরনের বিরতিহীন উৎসাহ যখন অবাস্তব খেয়ালিপনা বলে পরিগণিত হত, সেই তখন তিনি ও তাঁর হাতে-গোনা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নাট্যচর্চায় মশগুল ছিলেন। গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবদুল্লাহ আল-মামুন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে নাটক মঞ্চায়ন অথবা নাটক সম্পর্কে অন্যান্য সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহ ছড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের জন্য একটা বড় সহায়ক শক্তি ছিলেন বাংলাদেশের নাটকের আর একজন প্রধান পুরুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের যশস্বী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। ছিলেন নূরুল মোমেন এবং আসকার ইবনে শাইখও। ইতিহাস আমাদের বলে দেয় যে, ওই সময়ে যাঁরা বাংলাদেশের নাট্যচর্চা সূচনা করেছিলেন- আবদুল্লাহ আল-মামুন, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, আতাউর রহমান, তাঁরাই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আমাদের আধুনিক নাটক প্রযোজনা ও মঞ্চায়ন বিষয়ে প্রাথমিক নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। সেই সময়, শিক্ষাজীবনের তারুণ্যময় প্রণোদনায়, অনেকে যাঁরা এঁদের সঙ্গে ছিলেন পরবর্তী জীবনে তাঁরা নানা দিকে পথ হেঁটেছেন। নাটকের চর্চা তাঁদের অন্তর্গত তাগিদের বিষয় ছিল না বলেই তাঁরা অন্য জগতের বাসিন্দা হয়েছেন। কিন্তু আবদুল্লাহ আল-মামুনের শোণিতধারায় সর্বদাই বহমান ছিল নাটক। নাট্যচর্চাকে তিনি ব্যক্তিগত তাগিদের পর্যায় থেকে সামাজিক দায়বদ্ধতায় উন্নীত করেছেন, নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায়, সংগ্রাম ও আন্তরিকতায়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আমরা আবশ্যিকভাবেই নাট্যমঞ্চের মানুষ, ‘অপেশাদারি’ কিন্তু দায়বদ্ধ নাট্যচর্চার মানুষ বলে বিবেচনা করি। তবে আজকের এই বাণিজ্যপ্রবণ প্যাকেজের যুগে, আধা-ডজন টেলিভিশন চ্যানেলের যুগে, চৌকোনো বাক্সে নাটক বা ‘ধারাবাহিক’ বলে যে তরল বিনোদন প্রবাহ আমরা দেখতে পাই, নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তো নাটকে এমন অহেতুক কৌতুক ও প্রেমব্যাধি বিস্তারের যুগলবন্দীতে আনন্দ বিলানোর জবরদস্তি ছিল না। তখন ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের নিরঙ্কুশ রাজত্ব। সাধারণ মানের বিভিন্ন প্রযোজনার সঙ্গে সাপ্তাহিক নাটকের যেসব পরিবেশনা থাকত, সেগুলো প্রস্তুতির নেপথ্যে নানা চিন্তা-ভাবনা থাকত। আমার নিজস্ব বিচারে বি.টি.ভি-র অনেকগুলো নাট্যপরিবেশনা দর্শকদের নাটক সম্পর্কে ভাবতে শিখিয়েছে, নাটককে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আর একথা স্বীকার করতে হবে যে, এই জায়গাটায় আবদুল্লাহ আল-মামুন এক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে নাটককে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি খুবই ইতিবাচক তৎপরতা দেখিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে অবশ্য আতিকুল হক চৌধুরীর কথাও আমাদের স্মরণ করতে হবে। আমার মনে হয়, টেলিভিশনে কাজ করতে করতেই আবদুল্লাহ আল-মামুন সেলুলয়েডের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন এবং তিনি এভাবেই চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। নাট্যজন মামুনের আলোচনায় এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তিনি কয়েকটি ছায়াছবিও পরিচালনা করেছিলেন এবং সেগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। স্মরণ করতে পারি, তিনি ফেরদৌসী মজুমদারের ওপর একটা প্রামাণ্য চিত্রও তৈরি করেছিলেন।

তথ্যবিবরণীর ধাঁচে আবদুল্লাহ আল-মামুন সম্পর্কে কিছু কথা বলা হলেও আমি আসলে একজন নাট্যকারের কাজের পর্যালোচনা করতে চাই। আগেই আমি বোদ্ধা পাঠক ও বিশিষ্ট মামুন অনুরাগীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি, তাঁর বিষয়ে লেখার জন্য আমি যোগ্য ব্যক্তি নই। তাঁর সব নাটক হাতের কাছে পাওয়া সহজ নয়, অনেকগুলোর মঞ্চায়ন দেখেছি বেশ আগে, আমি নিজে কোকিলারা-র একটা আলোচনা লিখেছিলাম, সে-ও অনেক আগের কথা এবং ওই লেখাও এখন আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। যাই হোক, বিভিন্ন নাটকের বিষয়বস্তু আর উপস্থাপনা-কৌশলকে সমাহৃত করে আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাসমূহ শনাক্ত করার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু প্রধান লক্ষণীয় বিষয় হল, তিনি ছিলেন ভাবনা-চিন্তায়, পেশায়-নেশায়, কর্ম ও অবসরে আপাদমস্তক একজন নাটকের মানুষ। বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাস রচনা করতে গেলে যেমন মুক্তিযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের বিষয়সমূহকে চিহ্নিত করতে হবেই, ঠিক একইভাবে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যকর্মের আলোচনায় ওপরের ওই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও একান্তই প্রাসঙ্গিক।

ষাটের দশকের তরুণ মামুন যখন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে পড়াশোনা ও সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন, তখনই ঢাকা বা সারা বাংলাদেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহে পরিবর্তনের চিহ্নসমূহ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভাষা-আন্দোলনের মাধ্যমে বা পরবর্তীকালে যুক্ত ফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের পরাজয়ের প্রতিক্রিয়ায় সমাজে উদারনৈতিকতার উদ্বোধন ও উদযাপন লক্ষ করেছিলাম আমরা, কিন্তু ১৯৫৮ সালেই সামরিক শাসনের ভয়াল শৃঙ্খল সমাজের বিবর্তনের গতি-প্রকৃতিকে ভিন্নভাবে চালিত করতে চেষ্টা করে। আমাদের সংস্কৃতির যাত্রাপথকে রক্ষণশীলতার অভিমুখে অথবা ধর্মের গ্রন্থিবদ্ধ পাকিস্তানী মানসিকতার সম্প্রচারে বহমান করার প্রচেষ্টায় সরকারি প্রশাসনযন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজ এমনিতেই নাট্যচর্চার বিষয়ে উদাসীন ছিল। অনেক শতকের পুরোনো ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিভিন্ন ধরনের নাট্যক্রিয়া, যথা- যাত্রা, পালাগান, কবির লড়াই, সারি, জারি, গম্ভীরা প্রভৃতি আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক আচরণের অঙ্গ ছিল, কিন্তু সেসবের আনুষ্ঠানিক অনুশীলনের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না এবং উচ্চমার্গের সংস্কৃতির গুরুজনরা এগুলোকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদানে যৎপরোনাস্তি কুণ্ঠিত ছিলেন। তাই, নাগরিক নাট্যচর্চা গড়ে উঠছে না, আর গ্রামীণ আঙ্গিকসমূহ গাঁয়ের সীমানার মধ্যে পড়ে থাকছে। এমন অবস্থায় নাট্য বিষয়ে ভাবনা ও তা পরিবেশনায় অগ্রাধিকার দেবার অনুকূল একটা পরিস্থিতি ছিল না পূর্ব বঙ্গে।

ফতেহ লোহানী বা বজলুর রহমান প্রমুখ শুরুর দিকটায় খুবই বড় মাপের ভূমিকা পালন করেছেন এবং সহজেই অনুমেয় যে, তাঁদের সেই পথ মোটেই সুমসৃণ ছিল না। এরকম ভাবতে প্ররোচিত বোধ করি যে, আবদুল্লাহ আল-মামুন যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে বন্ধুদের নিয়ে জমজমাট আড্ডা দিতেন, তখন নাটক করার ব্যাপারটা বারবার আলোচনায় উঠে আসতো। সামরিক শাসন অস্তিত্বমান যদিবা, তবুও তা থেকে মুক্তির আন্দোলন গড়ে ওঠার সার্বিক প্রস্তুতি তো শুরু হয়ে গেছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই এই আন্দোলনের একটা বড় শক্তি। অনুমান করি, আবদুল্লাহ আল-মামুন ও তাঁর সংস্কৃতিপ্রেমী বান্ধবকুল পাকিস্তানী প্রশাসন যন্ত্রকে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে বিচার করছেন না, তাঁরা এই শাসকদের তাঁদের প্রবল সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষ হিসেবেও দেখছেন। নাটক করার নেশা তাঁদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে হয়ত স্বভাবজাত প্রবণতায়, কিন্তু নাট্যচর্চা যে ওই পাকিস্তানী গোষ্ঠীর না-পসন্দ, একথাও তাঁরা জানতেন।

মুনীর চৌধুরী যে উৎসাহ ও প্রেরণার একটা বড় উৎসস্থল ছিলেন, সেকথা সহজেই বুঝতে পারা যায়। তিনি জেলখানায় বসে কবর নামে অবিস্মরণীয় নাটক লিখেছেন, জেলখানার চৌহদ্দির মধ্যে তা অভিনীত হয়েছে, তরুণ টগবগে নাট্যকর্মীদের কাছে এটা তো শুধু উৎসব করার মতো সংবাদ নয়, অনুসরণ করার যোগ্য একটা সম্মিলিত দায়ও বটে। কবর-এর মতো গুরু ভাবনার নাটক ছাড়াও মুনীর চৌধুরী প্রেমকে উপজীব্য করে মনোহর সরস নাটক লিখেছেন। বুঝতে পারি, নাটককে জনপ্রিয় করার জন্যই অমন বিষয়কে নির্বাচন করেছেন তিনি। আবার একই সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রহসনের কথা আমাদের মনে পড়ে যাবে। তখনকার রক্ষণশীল সমাজের চমৎকার প্রতিফলনও ঘটেছে এমন নাটকে। আবদুল্লাহ আল-মামুনরা সমাজ এবং রাজনীতিতে পরিবর্তনের সপক্ষে তাঁদের সক্রিয় সমর্থন জ্ঞাপন করছেন, কিন্তু নাটক যে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, (যেমনটি সত্তরের দশক থেকেই আমরা ভাবতে ও বিশ্বাস করতে শিখেছি) তেমন একটা সুনির্দিষ্ট মনোভঙ্গি তখন পর্যন্ত গড়ে ওঠে নি।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবদুল্লাহ আল-মামুন নাট্য-আমোদী বন্ধুবান্ধবদের প্ররোচনা ও পীড়নে ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার নামে একটা নাটক লিখেছিলেন। চরিত্রের দিক থেকে এই নাটক নিছকই বিনোদনধর্মী। নাটকটির আদি পাণ্ডুলিপি আমি দেখিনি। কিন্তু পরবর্তী কালে ১৯৮১ সালে এটি ক্ষীণকায় গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। অবশ্য তার আগে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর পত্রিকা ‘থিয়েটার’-এ তা প্রকাশিত হয়েছিল। নাট্যকার প্রদত্ত সংবাদ থেকে জানা যায়, ১৯৬৪/৬৫ সালে বাংলা একাডেমীর তৎকালীন মিলনায়তনে এই নাটকটির প্রদর্শনী হয়েছিল। নাটকের নাম থেকে এটাকে বেশ বারুদগন্ধী বলে মনে হয় এবং জন্মকাল মনে রাখলে গোলাগুলির বিষয়টা বেশ প্রাসঙ্গিক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি প্রবল রোমান্টিক ভাবনার একটি নাটক। নাট্য-উপস্থাপনা-দুর্লভ একটি সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এমন নাটক রচনার বাস্তব প্রয়োজনটা আমরা অনুধাবন করতে পারি।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যকর্ম পর্যালোচনায় আমরা প্রায়শই সুবচন নির্বাসনে (১৯৭৪) নাটকটিকে প্রারম্ভিক বিন্দু বলে বিবেচনা করি। এই বিবেচনায় যে যৌক্তিক সঙ্গতি আছে, তা আমি মান্য করি। ওই শুরুটাই তাঁর সম্পর্কে নাট্যরসিক ও দর্শকদের মধ্যে একটা বিরতিহীন উৎসাহের জন্ম দেয়। ‘আমি আসছি’-বাচক একটা ঘোষণাও যেন শোনা যায় এক প্রতিশ্র“তিশীল নাট্যকারের কাছ থেকে। আর পরবর্তী কালে তাঁর অন্য সব নাট্যকর্মের সঙ্গে সুবচন নির্বাসনে- কে বিষয় ও চিন্তাগত দিক থেকে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে যুক্ত করা যায়। এটাও একটা প্রধান কারণ।

আমি আবদুল্লাহ আল-মামুনের কর্মকে যতটা না বিচার করতে চাই,তার চেয়ে বেশি চাই তাঁকে ফিরে দেখতে। তিনি একবার লিখেছিলেন যে, মৌলিক নাট্যরচনা ব্যতীত কোনো সমাজের নাট্যচর্চাকে এগিয়ে নেয়া যায় না। এবং সমকালীন বাংলা নাট্যসাহিত্যের এমন এক হতভাগা রূপ দেখেই তিনি নাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর মতো একজন নিবেদিতচিত্ত নাট্যজন যখন এমন মন্তব্য করেন, তখন বিষয়টাকে দু’দিক থেকে বিবেচনা করা বিধেয়। এক, তিনি একজন অভিনেতা হিসেবে, একটি নাট্যগোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে দেখছেন নাট্যপ্রযোজনার ক্ষেত্রে অভিনয়বান্ধব নাটকের অভাব নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করছে। দ্বিতীয়ত, এমন মৌলিক নাটকের অভাবের জন্য নাট্যকর্মীরা অযথার্থ অনুষঙ্গ বা নব্য দেশীয় পরিপ্রেক্ষিতকরণের ঝুঁকির কথা না ভেবেই আমাদের মঞ্চে বিদেশী নাটকের আমদানী করতে প্রবৃত্ত হচ্ছেন।

তবে এ বিষয়টি সম্পর্কে একটি মন্তব্য করে নেয়া ভালো। যদিও আবদুল্লাহ আল-মামুন দলের প্রয়োজন ও প্রদর্শনীর কথা মাথায় রেখে নাটক লিখেছেন, কিন্তু তাঁর নাট্যকর্মের সিদ্ধি শুধু ওই প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের সবচেয়ে খ্যাতনামা অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তাঁর (মামুন) সম্পর্কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে গিয়ে লিখেছিলেন, সেই ১৯৭৩ সাল থেকে মামুন ‘থিয়েটার’ নাট্যগোষ্ঠীর প্রধান অভিনেত্রীর কথা মাথায় রেখে অবিরাম লিখে যাচ্ছেন, ‘যখন যে বয়সে যেটা মানায়। এত খেয়াল, এত বদান্যতা ... আমি যেন তাঁর নাটক লেখায় সতত বিরাজমান।’ আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যকর্মের দিকে ফিরে দেখতে চাইলে ফেরদৌসী মজুমদারের এমন মন্তব্য দৃষ্টিকে যেন একটা জায়গায় নির্দিষ্ট করে রাখতে চায়। নিজস্ব নাট্যগোষ্ঠীর ভাবনাটা মাথায় রাখলেও অমন একটা বেড়ার বাইরে পা ফেলা একটু কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে।

আমরা যারা প্রায় ধারাক্রমিকভাবে থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠার ইতিবৃত্তের সাক্ষী, যাঁরা দেখেছি বিভিন্ন নাটকে ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয় এবং আমরা যারা আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যসম্ভার সমৃদ্ধ হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষদর্শী, তাদের জন্য এই ফিরে দেখাটা কেমন একটা ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার সূত্রে বাঁধা পড়ে যায়। এই দেখাটা তখন আর তার প্রার্থিত ও পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। কিন্তু নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুন তো আবশ্যিকভাবেই গোষ্ঠী-নিরপেক্ষ, কোনো বিশেষ অভিনেত্রী-নিরপেক্ষ এবং এমনকি পরিপ্রেক্ষিত-নিরপেক্ষ নাট্যসৃজনের দাবিদার হতে পারেন। তত্ত্বগত দিক থেকে তাঁর বিচারটা তো তেমনই হওয়া উচিত। আমি বর্তমানের পাঠক, আমি তো এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই বা তৃতীয় পুরুষ-কে কোনো নাট্য দলের প্রয়োজন অথবা দলভুক্ত কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীর ক্ষমতার ওপর কতটা নির্ভরশীল সেকথা আমলে না নিয়েই, নাটকগুলোর নিজস্ব গুণে পাঠ্যবস্তু বলে বিবেচনা করি। সত্যি বলতে কি, আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের সংলাপ বা ব্যবহৃত শব্দাবলির বিবিধ ময়না তদন্ত করে তার রচনাকে আধুনিক সাহিত্যের নানা তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যায়। পরে এ বিষয়ে কোনো এক লেখায় আলোচনার চেষ্টা করব। আপাতত আমি যা বোঝাতে চাই তা হল, ভাবীকালের পাঠক আবদুল্লাহ আল-মামুনের রচনাকে তো একটা নিরপেক্ষ দূরত্ব থেকেই পাঠ করবেন বা যাচাই করবেন, তার জন্য তো নির্দিষ্ট কোনো পরিপ্রেক্ষিতজাত বিবেচনা প্রাসঙ্গিক নয়। আর এখানেই কোনো লেখক বা নাট্যকারের কৌলীন্যের বিষয়টা নিহিত থাকে।

হাতের কাছে পাওয়া আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটক পড়তে নিয়ে (কোনোটি দ্বিতীয় বার) কয়েকটি বিশেষ এলাকার প্রতি আবশ্যিকভাবেই চোখ পড়ে। আর ঠিক তখনই ‘থিয়েটার’ নামে দলটির বেড়ে ওঠা, বিভিন্ন প্রযোজনা, এই দলের একটা নির্দিষ্ট দর্শন, দলের সদস্যদের সম্মিলিত শ্রম ও উদ্যোগ ইত্যাদি বিষয়ে একটা ধারাক্রমিক ধারণা গড়ে ওঠে, এবং এরও একটা ইতিবাচক দিক আছে। আমি প্রায় যুগপৎভাবে বাংলাদেশের অন্যান্য প্রধান দলগুলোর নেতৃত্বে যাঁরা আছেন এবং তাঁরা ধারাবাহিকভাবে যেসব প্রযোজনা করেছেন তা থেকে এইসব দলের গুণগত স্বাতন্ত্র্য এবং একই সঙ্গে তাদের ভ্রাতৃত্বসুলভ সামাজিক সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা শিল্পদর্শনের ঐক্যকেও শনাক্ত করতে পারি। সমালোচক হিসেবে আমি যখন বিষয়টাকে এভাবে দেখি, তখন আর আবদুল্লাহ আল-মামুন নিতান্তই কোনো একটি নাট্যদলের সদস্য বা নাট্যকার হিসেবে আমার কাছে প্রতিভাত হন না, তিনি তখন সেই দর্শনের প্রতিনিধি, যা তিনি তাঁর নাট্যকর্ম বা অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন অথবা অন্যরা সেই অভিন্ন অন্বেষণেই হয়ত চলে গেছেন আমাদের দেশজ সংস্কৃতির দুয়োরাণীর সাম্রাজ্যে অথবা কোনো ভিনদেশী নাট্যকারের কাছে, তাঁর নাট্যবিধৃত বিষয়কে দেশীয়করণের মাধ্যমে যোগাযোগসম্ভব করে তোলার অভিপ্রায়ে। আবদুল্লাহ আল-মামুন যা লিখেছেন তা তো ওই যৌথ সামাজিক দায়বদ্ধতারই অংশ।

তাঁর নাটকের, আমার বিচারে, প্রধান বিষয়গুলো আলোচনা করার আগে, আমি তাঁর একটি নাটকের কথা উল্লেখ করতে চাই। শপথ নামের এই নাটকটি কোন সালে প্রকাশিত হয়েছিল বা এর কোনো প্রদর্শনী হয়েছিল কি না, সে তথ্য কোথাও পাই নি। অন্যপ্রকাশ সংস্থা থেকে প্রকাশিত ‘নাটক সমগ্র’-এর প্রথম খণ্ডে এটি সংকলিত হয়েছে। এ ধরনের সংকলনে সাধারণত গ্রন্থাদি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়, কিন্তু এখানে তা নেই। নাট্যকারও তাঁর সংক্ষিপ্ত নিবেদনে কোনো কিছুই আমাদের জানান নি। যাই হোক, এই নাটকটির কথা প্রথমেই উল্লেখ করছি, কারণ, আবদুল্লাহ আল-মামুনের আর কোনো নাটকের আঙ্গিক বা পরিবেশন রীতির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। সাধারণভাব তাঁর নাটক বক্তব্যপ্রধান, এবং অনেকসময়ই বক্তব্যপ্রদানের সুরটা চড়া থাকে, কিন্তু এই নাটকের বক্তব্য এতই প্রবল ও সুনির্দিষ্ট যে, পাঠককে নাট্যকারের অভীষ্ট সম্পর্কে দ্বিতীয় বার ভাবতে হয় হয় না। রাজনীতি, আন্তর্জতিক সম্পর্ক, ধনতন্ত্র ইত্যাদি বিমূর্ত যেসব ধারণা আমাদের সাধারণ ও মূর্ত জীবনকে নানা অভিঘাতে প্রপীড়িত করে, তার এক স্পষ্ট নির্বেদ রচনা করা হয়েছে।

শপথ নাটকটিকে কোনো গোত্রভুক্ত করা বেশ মুশকিল। এই নাটকের চরিত্রের নাম সূর্য, বাতাস, মৃত্তিকা, আকাশ এবং এইসব অনাদি প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গে আছে আধুনিক বিশ্বের সমকালীন শক্তি- যুদ্ধ, উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ, শান্তি ও বিশ্ব ইত্যাদি। বোধ হয়, এই নাটক আবদুল্লাহ আল-মামুনের এক স্বেচ্ছা-নিরীক্ষা। তিনি নিজে অভিনয়কলায় ও নির্দেশনায় পারদর্শী এক ব্যক্তি হয়ে নিশ্চয়ই একথা বুঝেছেন, এমন নাটক মঞ্চায়নযোগ্য নয় এবং এর বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্তর্নিহিত শক্তি থাকলেও, তা যুগপৎ এমনই সশব্দ ও সরল যে, বিষয়ধৃত নাটকীয় দ্বন্দ্ব যার ক্রীড়া-প্রতিক্রীড়া পরিবেশনাকালীন সময়ের জন্য অর্থবহ, এই ব্যাপারটা প্রায় অর্জন অসাধ্য।

নাট্যকার বোধহয় ইংরেজ রোমান্টিক কবি শেলীর প্রমিথিউস আনবাউন্ড নামের কাব্যধর্মী নাটক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেখানেও কবি শেলী নাট্যনিরীক্ষায় নিমগ্ন হয়ে কল্পনার উড্ডয়নে অসম্ভবকে মৃত্তিকার সংলগ্ন করার বিলাসী নেশায় মগ্ন হয়েছিলেন। আবদুল্লাহ আল-মামুনের গন্তব্য শেলীর উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনিবেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারি সমকালীন বিশ্বব্যবস্থায় রাষ্ট্রশক্তির যে ভারসাম্যহীনতা মানব জীবনকে সংকটময় করে তুলেছে, তা নিয়ে নাট্যকার গভীরভাবে শঙ্কিত। একটু দীর্ঘ হলেও এই নাটকের একটা সংলাপ উদ্ধৃত করতে চাই। তা থেকে অনেকের এমন মনেও হতে পারে যে, এমন কাব্যময় পঙক্তি নিশ্চয় এখনও ক্রীতদাস অথবা মেরাজ ফকিরের মা নাটকের রচয়িতার কলম নিঃসৃত নয়। এমনকি সুবচন নির্বাসনে থেকেও এই সংলাপ বেশ দূরবর্তী।

বিশ্ব    মন আমার হয়েছে স্থির। মহাকাল,
        দেখা হলো দুর্বিনীত পুত্রের
        আস্ফালন? ভেবেছিলাম আমার
        ধৈর্যের বাঁধে হানবে না সে কুৎসিত
        অস্ত্র। অতিক্রম করবে না সহ্যের
        সীমা। কিন্তু সবই সে করে গেল।
        ভগিনী শান্তিরে পর্যন্ত তার হতেছে না সহ্য।
        অবশেষে প্রতিযোগিতায় নামতে হলো
        পুত্রের সনে। দেখা যাক, পুত্র পিতার
        তরে, না পিতা পুত্রের, যুদ্ধের তরে
        বিশ্ব, না বিশ্বের তরে যুদ্ধ।
        কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন মুখোমুখি
        আলাপের। এবার বিশ্বের
        পক্ষে হবে সামিল শান্তির সব
        মিত্র। সুতরাং যুদ্ধের সঙ্গে জনতার
        আলাপটা হওয়া চাই চূড়ান্ত।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি আবদুল্লাহ আল-মামুন একটা যুদ্ধবিরোধী নাটক লিখলেন। কাব্যনাট্যের ভঙ্গিতে। নাট্যকার এক আলাপনে জানিয়েছিলেন, বাংলা একাডেমীর খোলা জায়গায় যে সৌখিন নাট্যচর্চা হতো, তার কথা ভেবেই এটি লেখা। কিন্তু সেখানেও এটা অভিনীত হয়েছিল কি না নিশ্চিত করে বলা যায় না। এই নাটকটা নিয়ে এত কথা বলছি, তার কারণ এর ব্যতিক্রমী চরিত্র। নাট্যকার কি তখনকার দিনের ছাত্র আন্দোলন দ্বারা প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন? তাঁর আনুগত্যের জায়গাটা চিহ্নিত করা যায়, দায়বদ্ধতার বিষয়টাও অনস্বীকার্য, কিন্তু একটা আর্ন্তজাতিকতাবাদী অবস্থান গ্রহণ এবং তা প্রকাশের তাগিদে মৌসুমী নাটক-খেলার উঠোনে প্রদর্শনীর জন্য তিনি এমন রূপক-সাংকেতিকতার আশ্রয় নিলেন কেন? একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে, নূরুল মোমেন এবং আসকার ইবনে শাইখদের কাজ দেখতে দেখতে নাট্যভুবনের প্রতি আকর্ষণটা প্রবলভাবে অনুভব করছেন, কিন্তু নিজের ক্ষমতা নিয়ে ততটা আস্থাবান হতে পারছিলেন না, অন্তত তখনো। তাই নাটকও হলো, রাজনতিক আদর্শের উপস্থাপনও হলো, কাব্যের চাদর দিয়ে মুড়িয়ে শিল্প অনুশীলনের একটা নিরীক্ষাও হলো।

আবদুল্লাহ আল-মামুন সর্বদাই বলতে চেয়েছেন, তিনি সমকালীন জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহী। জীবনে প্রথম যে নাটক লিখেছিলেন, স্কুলে ছাত্রাবস্থায়, সে ছিল এক বাধ্যতামূলক অনুশীলন। তাঁর বাবা কাহিনীর সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। বিষয় ছিল: এক সফল সরকারি কর্মকর্তার ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স। তিনি সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাবার পর নিজের বাবাকে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেননি। (সূত্র: ‘থিয়েটারওয়ালা’, ৮ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যা, অক্টোবর-ডিসেম্বর, ২০০৬) আমি বেশ বুঝতে পারি, এমন এক নড়বড়ে মধ্যবিত্ত মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক সম্পর্ক, দুই প্রজন্মের যোগাযোগ সংকট আবদুল্লাহ আল-মামুনকে সব সময়ই ভাবিয়েছে। তাই শপথ নাটকটার জন্মকথা, তার প্রেরণা ও নাট্যদ্বন্দ্বের প্রকাশ সম্পর্কে মনের মধ্যে সংশয় রয়েই গেল। তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই, থাকলে বিষয়টার বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রায়োগিক পটভূমি নিয়ে একটা আলাপনে বসতাম তাঁর সঙ্গে।

স্বাভাবিক কারণেই তাঁর নাটক নিয়ে আলোচনার শুরুটা হতে হবে সুবচন নির্বাসনে-কে দিয়ে। কিন্তু আমি ঠিক প্রদর্শনী বা প্রকাশনার ইতিহাসটা ধরে এগোতে চাইছি না। বরং প্রবণতার বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করতে পারলেই একটা যুক্তিযুক্ত মূল্যায়ন সম্ভবপর হয়ে উঠবে। তাঁর কথা থেকে আমরা জেনেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের নাটকে প্রম্পটার হিসেবে কাজ করতে গিয়েই তিনি নাটকের জগতে এসেছেন। এই কাজটার সঙ্গে সবটা নাটকের কাহিনী ও সংলাপ পড়ে যাবার নিদারুণ মনোযোগসাপেক্ষ দায়িত্বের যোগ থাকে। এ এক অব্যর্থ অনুশীলন, যার মধ্য দিয়ে চরিত্রায়ন, কাহিনী-সংগঠন, সংলাপ উচ্চারণের কড়ি ও কোমল- সবকিছু যুক্ত থাকে। তাই নাট্যকার ও অভিনেতা হয়ে ওঠার এটা একটা দারুণ ইতিবাচক কর্মনবিশী পর্যায়। কথিত আছে, শেক্সপীয়রও মাঝে মাঝে প্রম্পটারের কাজ করতেন। ছাত্রাবস্থা পেরিয়ে ‘সংবাদ’ নামক দৈনিকে কাজ করার সময় টেলিভিশনের সাপ্তাহিক নাটক রিভিউ করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, আর তা করেছেন খুবই আনন্দের সঙ্গে। নাটকের প্রতি একটা পুরোনো আকর্ষণ তো ছিলই, তদুপরি সংবাদপত্রে দায়িত্ব নিয়েই পর্যালোচনা, এমন সুযোগ তাঁর নিজস্ব শিল্পপ্রবৃত্তিকে নিশ্চিতভাবেই উৎসাহিত করেছিল। এই সূত্রে আর এক বিশ্বখ্যাত নাট্যকার জর্জ বার্ণাড শ’-এর কথা মনে পড়ে যায়। তিনি নাটকের রিভিউ করতে করতেই মৌলিক নাট্যরচনা শুরু করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠজীবনে বাম-ঘেঁষা ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অতএব সমাজব্যবস্থা, সমাজবাস্তবতা, শাসন-শোষণ, দাবি-অধিকার, দারিদ্র্য ও পুঁজিবাদ ইত্যাদি তাঁর মগজের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। তাই আবদুল্লাহ আল-মামুন যখন দেশ স্বাধীন হবার পর প্রত্যাশা আর অপ্রাপ্তির সমাহারে একটা সমাজ অবলোকন করলেন, তাঁর পক্ষে তখন সুবচন নির্বাসনে রচনা করাই স্বাভাবিক ছিল।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে নানা কারণেই সমসাময়িক নাটকের ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একইভাবে নাট্যকারের পরবর্তী উত্তরণ, প্রবণতা ও পরিণতি বিশ্লেষণের জন্যও খুবই উল্লেখযোগ্য। ঢাকার মঞ্চনাটক যখন হামাগুড়ি থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, এই নাটক তখনকার সৃষ্টি। গাঁটের পয়সা খরচ করে লোকজন নাটক দেখতে আসবে, এমন একটা পরিকল্পনা তখন সবেমাত্র নাট্যকর্মীদের মধ্যে উঁকি মারছে। আর তা যদি হয়, নাট্যদলকে  ভেবে দেখতে হবে, মঞ্চ তাঁদের কোন ধরনের প্রত্যাশা পূরণ করলে তাঁরা নাটক দেখতে আসতে আগ্রহ বোধ করবেন। নাটক কতটা জীবনের প্রতিবিম্ব, কতটা আদর্শিক প্রতিবাদের হাতিয়ার এবং তার অনুপাতে কতটা বিনোদনের মশলা মেশালে রুচিও গড়ে তোলা যায়, আবার দর্শকের গ্রহণের সীমাবদ্ধতাকেও আমলে নেয়া যায়, এমন সব ইচ্ছার সম্ভাব্য পূরণ এবং এসবের মধ্যে ঝুঁকির উপাদান কতটা থাকে,- এই সবই নাট্যকর্মীদের ভাবনা-চিন্তার অন্তর্ভুক্ত করতে হয়েছিল।

সুবচন নির্বাসনে রচনা ও প্রযোজনার মধ্যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের একটি নবগঠিত থিয়েটার দলের তরুণ কলাকুশলীদের আত্মপ্রকাশের একটা দীপ্ত বাসনাও ছিল। ওই সময়, ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে সমাজ সত্যিই একটা সন্ধিক্ষণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধ এবং এই যুদ্ধে বাংলাদেশের রক্তাক্ত বিজয় অনেকের মনেই এমন একটা ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে, কিছু বিষয় যা সমাজকে এযাবৎ রোগাক্রান্ত করে রেখেছিল, সেসবের সন্তোষজনক পরিসমাপ্তি ঘটেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, যুদ্ধ বিজয়ে যে আবেগ ও প্রেরণা থাকে, তা বিজয়কে সম্ভবপর করে তুলতে পারে, কিন্তু বহু বছরের জীর্ণ সব অভ্যাস যা প্রায় পাহাড়ী অনড়তায় সমাজদেহে বাসা বেঁধেছে,তা যে সহজেই বিলুপ্ত হবার নয়, এই বোধ, এই আবিষ্কার সমাজের সচেতন মানুষকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।

সুবচন নির্বাসনে সমাজচিত্রের ওই দিকটা নাটকীয় ও গ্রহণীয় ভঙ্গিতে ধারণ করেছে। মঞ্চ যে এ বিষয়ে কথা বলার একটা জায়গা তা প্রমাণ করেছে। অভিনয় যে শুধু বিনোদনের অপর নাম নয় তা বলার চেষ্টা করেছে। থেটারের মানুষজনকে নাট্যকর্মীতে রূপান্তরিত করেছে। আমাদের মঞ্চনাটকের নব উদ্বোধনে এই নাটক তাই একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। নাটকের রচনারীতি ও পরিবেশনাভঙ্গি যে গতানুগতিকতা ভেঙ্গে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যায়, সেই সংকেত শনাক্ত করা যাবে আবদুল্লাহ আল-মামুনের সুবচন নির্বাসনে-র সৃজনকুশলতায়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যসম্ভার বিশ্লেষণ করলে একথা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, নাটকে তিনি বাস্তববাদের অনুসারী। রূপক বা প্রতীকীবাদের প্রতিফলন যেটুকু লক্ষ করা যায় তা গৌণ। প্রকৃতপক্ষে বাস্তব ও সমকালীন বিষয় ও অনুষঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে সমাজের সমস্যাসমূহকে চিহ্নিত করার প্রবণতা তাঁর নাটকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিক ইউরোপীয় সমাজ বাস্তবতাবাদী অথবা প্রবলেম প্লে রীতির প্রভাব ছিল তাঁর ওপর। তিনি এই বাস্তবতাকে অনেক সময়ই কমেডিসুলভ অতিশয়োক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছেন যার মধ্য দিয়ে বক্তব্যের ধার আরও শাণিত হয়ে ওঠে। আবদুল্লাহ আল-মামুন অনেক সময়ই সমাজের এই সমস্যা বা অবক্ষয়কে অতীতের ঐতিহ্যনিষ্ঠ সত্যানুগতা বা বিশুদ্ধতার সঙ্গে বর্তমানের পচনশীলতাকে প্রতিতুলনীয় করেছেন। আর তা করতে গিয়ে তিনি প্রজন্মগত দূরত্ব ও পরিপ্রেক্ষিতকে তুলে ধরেছেন। পিতা-মাতা যে অতীত বা সামাজিক অবস্থানের সততা ও ভারসাম্যের প্রতিনিধিত্ব করেন, পুত্র-কন্যা বা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কালিক বিষয়ে সেসবের অসারতা বা দুর্বলতা ধরা দেয়। তিনি কাহিনীকে বিস্তার করেই নাটক গড়ে তোলেন।

তাঁর নাটকের গঠনপ্রক্রিয়া ক্লাইম্যাকটিক; এখানেই তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এপিসোডিক আঙ্গিক তিনি ব্যবহার করেননি। আমরা যেগুলোকে সামাজিক নাটক বলে গোত্রভুক্ত করি, তিনি সেই ধারার সঙ্গেই আরো গতিময় যোগাযোগক্ষম সংলাপ যুক্ত করেছিলেন। তাঁর নাটকের মূল কেন্দ্র প্রধানত, পরিবার বা বন্ধুমহল। এই পরিবারকে বা সামাজিক সংযোগে স্থাপিত বান্ধব সম্পর্ককে তিনি নাটকের সামাজিক-রাজনৈতিক-নৈতিক ছকে স্থাপন করেন। সুবচন নির্বাসনে নাটকে পিতা আর তার সন্তানদের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দেখা যায়, তা আসলে অনেকটাই এ্যালিগোরিক্যাল। কিন্তু পরিবারটাকে আমরা ঠিকই চিহ্নিত করি; আবার পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে নাটকের প্রয়োজনে, নাটকের মূল গন্তব্য পরিবারকে নির্ভর করে গড়ে উঠছে না।

সমাজের সুপ্রাচীন যেসব ইতিবাচক প্রবচনকে এমনকি কালনিরপেক্ষভাবে অক্ষয় বলে বিবেচনা করা হয়েছে সেই আদিকাল থেকে, তার অনুসরণে এবং সমর্থনে এক স্কুল শিক্ষক (বাংলাদেশর সমাজে এরা টিপিক্যাল নীতিবাদী/বাগীশ) তাঁর সন্তানদের শিখিয়েছেন সেই সব প্রায় অভ্রান্ত আপ্তবাক্য, যা তিনিও নিশ্চয়ই উত্তরাধিকার সূত্রে শিখেছিলেন। এই নাটকে দেখানো হয়েছে বহুদিনের আদৃত ও প্রচারিত সুবচনসমূহ এযুগে আর তেমন কার্যকর নয়। সততাই মহৎ গুণ, লেখা পড়া করে যেই, গাড়ী ঘোড়া চড়ে সেই এবং সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে প্রভৃতি আপ্তবাক্য সৃজিত ও প্রতিষ্ঠিত হতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল, সর্বকালেই তার ব্যতিক্রম হয়ত দেখা গেছে, কিন্তু এগুলোর সঙ্গে যুক্ত যে নীতিবোধ তা যেন ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষয় হতে হতে এই সমকালে এসে মহাবিপর্যয়ের মুখোমুখি।

এমন বিষয় নাট্যকারের সমাজ সচেতনতা ও প্রবণতাকে যেমন প্রকাশ করে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যখন কিছু কিছু আশাকে কেমন যেন ছলনাময়ী মনে হচ্ছে, তখন তা দর্শকমানসে সত্যিকার দাগ কেটেছিল। বাবা ও সন্তানের দূরত্ব ও দ্বন্দ্ব নতুন প্রজন্মের ধারণা এবং কাজের ও বিশ্বাসের ভিন্নতা আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের এক পুনরাবৃত্ত অন্বেষণ। তিনি অনেকগুলো নাটকে ‘জেনারেশন’ শব্দটাকে বার বার ব্যবহার করে তাঁর আক্ষেপের জায়গাটাকে দেখিয়েছেন। সমকালের নৈতিক অবক্ষয় ও সংকটের কথা তো আগেই বলেছি।

তাঁর আর একটি বিশেষ গুরুত্বের জায়গা হল, নারীর সামাজিক অবস্থান। বিষয় হিসেবে এটাও তাঁর নাটকে ফিরে ফিরে এসেছে। সুবচন নির্বাসনে এই সব লক্ষণসমূহকেই ধারণ করেই গড়ে উঠেছে। এই নাটকের কন্যা সন্তান রানু। তাই তাঁকে শিখতে হয়েছিল, সংসারের সুখবর্ধনের জন্য নারীর কত কত গুণ থাকতে হয়। রানুর একটি সংলাপ উদ্ধৃত করছি। আবদুল্লাহ আল-মামুনের পরের অনেকগুলো নাটকে একথার প্রতিধ্বনি শোনা যাবে।

আমি তৈরি বাবা। তুমি যেমন যেমন বলেছিলে তেমনভাবে তৈরি। বলেছিলে একটা মেয়েকে এক এক করে তিনটি সংসারে পা রাখতে হয়। বাপের সংসার থেকে শ্বশুরের সংসার, তারপর নিজের সংসার। অবশ্য একথাও বলেছিল, শ্বশুরের সংসারটাই আসলে নিজের সংসার। তুমি আমাকে খুঁটিনাটি সব বুঝিয়ে দিয়েছো। ক্লাসে যেমন করে তুমি ছাত্র পড়াও তেমনিভাবে। শ্বশুরের সংসারে গিয়ে আমি বাপের সংসারের কোনো আলাপই করব না, কোনো বুদ্ধিমতী মেয়েরই তা করা উচিত নয়। শ্বশুর-শাশুড়ী গালমন্দ করলেও স্বামীকে হাসিমুখে বলবো, ‘সুখে আছি।’ সেটাই নিয়ম। তোমার সব কথা আমি মনে রেখেছি। স্বামীর পদতলে যে স্ত্রীর আশ্রয়ের উল্লেখ তুমি বার বার করেছো, তাও মনে রেখেছি। হোক সে পদযুগল যত নোংরা।

সুবচন নির্বাসনে স্পষ্টভাবেই এই নির্দেশনা দেয় যে, আবদুল্লাহ আল মামুন সমসাময়িক সামাজিক সংকট বিষয়ে ভাবিত এবং তিনি তাঁর নাটকের মাধ্যমে তা দর্শকের কাছে তুলে ধরতে চান। এই নাটকে যে প্রতীকী চিত্র আছে, পরের নাটক এখন দুঃসময়-এ তা মূর্ততার রূপ পরিগ্রহ করল, সাম্প্রতিকতার বিষয়কে আরো নির্মোহভাবে স্পর্শ করলো। তাঁর ভাবনা-দুর্ভাবনার এলাকাটা সহজেই বোঝা যায়। বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যখন সাধারণ মানুষকে বিপর্যস্ত করে তোলে, তারা যখন অসহায়ত্বের নির্বিকার শিকার হয়ে পড়ে, তখন লোভী মানুষ তাদের কপট কৌশলে শোষণের যন্ত্রকে আরো সচল করে তোলে। সুবচন যেমন নির্বাসনে চলে গেছে, তেমনি সমাজে মানবিক সুনীতিও দুর্লভ হয়ে ওঠে। মহাজন খাদ্য মজুদ করে, বন্যার্ত তরুণীর দিকে সাহায্যের নামে লোভাতুর হাত বাড়িয়ে দেয়। এভাইে দুর্নীতির বিস্তার ঘটতে থাকে। এই নাটকেও আবদুল্লাহ আল-মামুন বাস্তবতাকে আঁকেন প্রচলিত সামাজিক নাটকের ঘরানাকে পরিমার্জিত করে। পরিবেশনার এই কৌশল কাহিনীকে এগিয়ে নেয় গ্রহণযোগ্য নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে। বন্যার পানি বাড়ার সংকটকে মহাজন ও বেপারি তাদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগাতে চায়। জরিনা নামের এক নারী পরিবারবিচ্ছিন্ন হয়ে এক আধা-কাল্পনিক জায়গায় এসে পড়ে। অথচ জরিনার মধ্যে এর প্রতিক্রিয়ায় যে ভীতি বা অসহায়ত্ব দেখা যাবার কথা, অর্থাৎ বাস্তববাদিতার পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন থাকলে যা ঘটতে পারত, তার লক্ষণ দেখতে পাই না। পক্ষান্তরে, বেপারির পাহারাদারের সঙ্গে তার ব্যর্থ প্রণয়-সম্পর্কের সামাজিক আখ্যান পরিবেশন করেন নাট্যকার। এমন করে অচেনা স্পেসে তিনি চেনা অতীতকে প্রক্ষিপ্ত করেন বিপন্ন বর্তমানে। সোনার জীবন কাহিনীতে আবার সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রাম্য বিশ্বাসের সন্ধান পাই। তার দ্বারা লোভ ও দুর্নীতিগ্রস্ত বর্তমানের সঙ্গে পুরাতনের একটা যোগ গড়ে ওঠে। নাটকের শেষে যেভাবে মৃত্যুতে সবকিছুর পরিসমাপ্তি ঘটে, তার মধ্যেও বন্দুকের গুলি ও বন্যার জলের তোড় একাকার হয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে আবদুল্লাহ আল মামুন কি আধুনিক সমাজের অবক্ষয় চিহ্নিত করার জন্য ফিরে গেলেন আদিকালের পোয়েটিক জাস্টিসের কাছে? খুব নির্দিষ্ট উত্তর দেয়া অসম্ভব।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রতিটি নাটকের এমন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাঁর উত্তরণকে বুঝতে সহায়তা করে এবং সেজন্য তা হয়ত একটা প্রয়োজনীয় কাজ। কিন্তু এই প্রবন্ধের পরিসরে তার অবকাশ নেহাতই সীমিত। সমাজ, সমকাল, নারী, দুর্নীতি এবং একই সঙ্গে এই ধরনের নানা অসঙ্গতির সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন কৌতুক তাঁর নাটককে স্বাতন্ত্র্য প্রদান করেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে ধোঁয়াটে বর্তমান যে সীমাহীন অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে, এই বিষয়টা বার বার তাকে পীড়িত করেছে, বহু কৌণিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এবার ধরা দাও নাটকে তরুণ আছে, পেশায় মেয়ে দালাল আছে, তরুণের বাবা-বোন আছে। নানা সমস্যা আছে, তার পরিবেশনায় আছে লঘু পরিহাস। আর যা বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নাট্যকার তা পেশ করেছেন নাটকের শেষ সংলাপে।

আমার সামনে দুটি পথ খোলা আছে। একদিকে নিশ্চিত প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে নিশ্চিত ধ্বংস। আমি ভালো থাকতে চাই। আপনারা আমাকে বাঁচান। আপনাদের একটা জেনারেশন নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আপনারা কি তাকে হারিয়ে যেতে দেবেন? ধ্বংস হতে দেবেন? এই জেনারেশন যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তা হলে ধ্বংসের হাত থেকে আপনারাও বাঁচবেন না। তাই বলছি, আমাকে পথ নির্দেশ করুন। নিজের স্বার্থে আমাদের এই বয়সী পৃথিবীর স্বার্থে আপনারা আমাকে বলে দিন, আমি কি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াব? একটা জেনারেশনের ভিত্ কি তবে সত্যি নড়ে যাবে?

বিবর্তন বা পরিণতির পানে অভিযাত্রার কথা বিচার করলে আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রাথমিক পর্বের সবশেষ উল্লেখযোগ্য নাটক হলো সেনাপতি। সমকাল ও স্বদেশ প্রেক্ষাপট হিসেবে ঠিকই আছে। অবক্ষয়ের যে ধারা এই সমাজকে এবং আমাদের আলোচ্য নাট্যকারকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তার আর এক ভিন্নধর্মী পরিবেশনা সেনাপতি। এই নামকরণের মধ্যেই যে একটা প্রতীকী অভিব্যক্তি আছে, তা বুঝতে পাঠক-দর্শক কারো অসুবিধা হয় না। নাট্যকার এই নাটকেও বাস্তবসংলগ্ন সংকটকে প্রকাশ করার জন্য অধিবাস্তব প্রকরণের ব্যবহার করছেন। শুধুই পাঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে এই নাটকের কাহিনী কেমন প্রচ্ছায়ার মতো দুর্বোধ্য মনে হতে পারে এবং তা ঘটে প্রধানত একটি চরিত্রের জন্য যার কোনো ব্যক্তিনাম নেই, নাট্যকারের ভাষ্যে ‘তিনি নামেই প্রকাশিত’- ‘শখের প্রদীপ আহরণকারী’। এই চরিত্রায়নে যে ইচ্ছাকৃত ফ্যান্টাসি আছে, তা আবশ্যিকভাবেই আমাদের আরব্য রজনীর আলাদীনের প্রদীপের কথা মনে করিয়ে দেয়। এই যে অতীত পুরাণ, তার গূঢ়ার্থ নাটকে নবতর অর্থ সংযোজন করে, কিন্তু আবদুল্লাহ আল-মামুন তো সমকালকে ধরতে চান। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে তিনি একালের প্রতারণা, অসততা, কপটতা ও স্বার্থসিদ্ধির ক্রমবর্ধমান প্রবণতাকে প্রকাশ করতে চান। কিন্তু যাদুকরী হারিকেনের সঙ্গে কারখানার শ্রমিক, তাদের আন্দোলন ও সংগঠনকে যুক্ত করে তিনি এক রহস্যময়তা সৃষ্টি করেন। নাটকের গতি ও বক্তব্য কিন্তু তখনো খুব স্পষ্ট ও প্রকাশ্য থাকে। অবক্ষয়িষ্ণুতা ও শঠতার বিস্তার যে ধ্বংস ডেকে আনে, সমাজশৃঙ্খলায় অনাচার সৃষ্টি করে, তাঁর এই নাটকে তিনি সেকথা পুনর্বার ব্যক্ত করলেন। এই নাটকের সেনাপতি তো আসলে এখন দুঃসময়-এর মহাজনের বংশধর। হারিকেন এখানে একটা প্রতীকী মাধ্যমমাত্র। সমকালকে পরিহাস করার প্রতীক।

এই প্রাথমিক পর্ব থেকে আবদুল্লাহ আল-মামুনের উত্তরণ কিন্তু খুবই সঙ্গতিপূর্ণ। দায়বদ্ধতার দিক থেকে তা একরৈখিক, কিন্তু বিষয়চিন্তনে বহুমাত্রিক। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, তাঁর উদ্বেগের একটা প্রধান এলাকা হল- জেনারেশন। নতুন প্রজন্ম ধ্বংসের মুখোমুখি হচ্ছে, তাদের এগিয়ে যাবার পথে নানা বাধা, বিবিধ প্রলোভন, মোহিনী পিচ্ছিলতা অথবা দুর্বিনীত দূরত্ব। প্রথম পর্বের নাটকগুলোতে তিনি এই বিষয়কে যেভাবে দেখেছেন, তার সঙ্গে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে পরবর্তী কালে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নতুন প্রজন্মের জীবনের সংঘাত চিহ্নিত করতে গিয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুন কিন্তু কোনোরকম অতীতমুখী রোমান্টিকতায় ভোগেননি অথবা এর দ্বারা অতীত-সংলগ্ন কোনো রক্ষণশীলতাকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। নাট্যকার হিসেবে সংলাপ রচনায় তিনি বিভিন্ন শব্দের মিশেল ঘটান এবং আবশ্যিকভাবেই তিনি তা করেন দর্শক-পাঠকের সঙ্গে ত্বরিত ও নিবিড় যোগাযোগের জন্য। তাঁর নাটকের সংলাপে এমন শব্দরাজি বা সংকর প্রকরণ তিনি যুক্ত করেন, কখনো মধ্যবিত্ত কথোপকথনের অনিবার্য উপাদান হিসেবে, কখনো বা সাধারণের শব্দ ব্যবহারের নবার্জিত লক্ষণ হিসেবে। কিন্তু ‘জেনারেশন’ শব্দটি তিনি বার বার ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে। প্রাথমিক পর্বে আমরা জেনারেশনের অভিমুখিনতা বিষয়ে সংকটের কথা জেনেছি। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে আবদুল্লাহ আল-মামুনের প্রধান উদ্বেগের জায়গা হল: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অবক্ষয়, মুক্তিযুদ্ধের অপূর্ণতা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির ধীর পুনরুত্থান। এই সূত্রে তাঁর যে হতাশা, অন্তর্গত ক্ষোভ ও ক্রোধ, তা তিনি বার বার নিয়ে এসেছেন নাটকের হৃদয় ও শরীরে। মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে খুব স্বাভাবিকভাবেই আলোড়িত করেছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা অধোমুখী হওয়ার মধ্য দিয়েই যে নতুন জেনারেশনের যাত্রা বেপথু হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি।

১৯৭৫ সালের মধ্য-আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে সমাজে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আর তার প্রতিক্রিয়ায় যে এ ধরনের অপরাধী ও তাদের সংগঠনই শুধু পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার সুযোগ পেয়েছে তা নয়, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও গন্তব্যসমূহকেও ধ্বংস করার একটা প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়। এমন একটা সময়ে দেশে এই রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে, যখন আমাদের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে পালে অনুকূল বাতাস লেগেছে। নাট্যচর্চার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের প্রায় সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার কাজে একাগ্রচিত্ত, এঁদের মধ্যে অনেকে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছেন। তাই তখন মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের নাটকের একটা অভীষ্ট বিষয়। নাটকে তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধারণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে, রাজাকার ও তাদের দোসরদের অপকর্ম উপস্থাপন করা হচ্ছে। এটা ছিল তখনকার নাটকের এক স্বাভাবিক প্রবণতা।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে সর্বদাই মুক্তিযুদ্ধের এক অনুপ্রাণিত উপস্থিতি লক্ষ করি আমরা। সৈয়দ শামসুল হকের পাযের আওয়াজ পাওয়া যায় নির্দেশনা দান ও অভিনয় করার মধ্য দিয়ে তাঁর যে শুরুটা লক্ষ করেছি, তা ছিল বিরতিহীন। মুক্তিযুদ্ধ মামুনের নাটকে ফিরে ফিরে এসেছে এবং তা এসেছে নানা মাত্রিকতায়। মুক্তিযোদ্ধার অবমাননায় তিনি যে প্রবলভাবে ব্যথিত হচ্ছেন, তা বোঝা যায় এবং এর মাধ্যমে যে আদর্শিক ক্ষয়ের সৃষ্টি হচ্ছে তার ব্যাপকতর সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে তিনি সর্বদাই সজাগ ছিলেন। তাই তাঁর নাটকে মুক্তিযুদ্ধের এপিসোড বা মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রায়ন যতটা দেখতে পাই, তার চেয়ে অনেকটা বেশি জায়গা জুড়ে আছে ওই আদর্শিক ক্ষয়ের জন্য সমাজের পশ্চাদযাত্রা। এই যে সংকট যা নিয়ে ব্যর্থ রাজনীতিকরা ভেবেছেন, সমাজবিজ্ঞানীরা ভেবেছেন, সেটারই অন্তঃপুরের দিকে নির্দেশ করেছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। তাতে সমাজের পুনর্দর্শন আছে, বেদনা আছে আর আছে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গির কথা মনে হয়েছে আমার। তিনি চারদিকে দেখা নানা প্রবঞ্চনা ও ধ্বংসের মধ্যেও হতাশ হন নি। যেখানে মনে হয় প্রতারক, স্বার্থান্বেষী বণিক ও তার চাটুকাররা সমাজটাকে শুষে কাচ্ছে, সেখানেও চূড়ান্ত ভাষ্যটা আত্মসমর্পণের নয়। এবং এর মাধ্যমেই তিনি নতুন যে জেনারেশন নানা ধরনের প্রলোভনের পঙ্কিলতায় পা ফেলছে, তাদের সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও কর্মের অংশ করতে চেয়েছিলেন।

এটা একটা দুর্বাগ্যজনক বাস্তবতা যে, আমাদের নাটকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবাদী ও সৃজনশীল পরিপ্রেক্ষিত যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি জায়গা পেয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ ও চেতনা বাস্তবায়নের ব্যর্থতা। অবশ্যই এর একটা যুক্তিযুক্ত ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা আছে। এবং ব্যর্থতার ইতিহাসটা এমন অপ্রত্যাশিত দ্রুততায় শুরু হয়েছিল যে, একটা নির্মোহ বীক্ষণের আভাসও পাওয়া যায়নি। যাই হোক,  আবদুল্লাহ আল-মামুন কিন্তু মূলত তাঁর নাট্যকার পরিচয়টাকেই তুলে ধরেন তাঁর সৃষ্টিতে, ইতিহাসের অংশ তাতে প্রবেশ করে প্রাসঙ্গিকভাবে। তাঁর একটি জনপ্রিয় নাটক হল- দ্যাশের মানুষ। নামকরণে ‘দেশের’ যে কথ্য শব্দরূপ দেখতে পাই তাতেই উপহাস ও গন্তব্যের খোঁজ পেয়ে যাই আমরা। এই নাট্যগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশের সমসাময়িক গণআন্দোলনের দুই বীর শহীদ নূর হোসেন ও ডাঃ মিলনের নামে। ‘নাটক শুরু হচ্ছে যেকোনো একটা দিনে নয়। স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ছাব্বিশে মার্চের পরের দিনই ধরা যাক। আগের দিন কারা যেন স্মৃতিসৌধের গায়ে বাংলাদেশের পতাকা দিয়ে সস্তা দামের দড়ির মালা পরিয়ে দিয়ে গেছে।’ নাট্যকার সূচনা দৃশ্যের মঞ্চ-নির্দেশনায় এইসব কথা বলেছেন।

রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে (‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’) অর্জিত স্বাধীনতা কয়েক বছরের মধ্যে কোন সে ধূসর পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধকেই যেন অসার ‘গণ্ডগোল’ বানিয়ে দিয়েছে। আবদুল্লাহ আল-মামুনের কৌশলী-পরিবেশনায় এই নাটকে সমাজের দুর্নীতি ও অবক্ষয়, যা কিনা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার অংশ, তার উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর একাত্তরের চেতনার অধোগতি। তিনি অনেকগুলো বিষয়কে এক সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন, সমন্বিত করতে পারেন, এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা। এখানে যেমন দেশটাকে দেখতে পাই একটা বিপন্ন শহীদ পরিবারের প্রতিচ্ছবিতে। সেই পরিবারে শ্বশুর-শাশুড়ির চিরাচরিত আচরণ-আবদার-সমালোচনা আছে। কিন্তু আছেন সাহানা নামের এক নারী, এক মা, মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী, সাহসী স্কুল শিক্ষিকা এবং তিনি গৃহবধূও বটেন। সাহানা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করছেন তাঁর নিজস্ব অধিকার আদায়ের একক সংগ্রাম হিসেবে। সমাজ কোথায় এই মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীর পাশে এসে দাঁড়াবে, তা নয়, পুলিশ প্রশাসনও সহায়ক নয়, তবুও সাহানা তাঁর সংগ্রাম চালিয়েছেন এই নির্বিকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিস্মৃত সমাজের বিরুদ্ধে, রাজাকারের বিরুদ্ধে, এটাই তাঁর মুক্তিসংগ্রাম। তাঁর কন্যা রুণুর জন্য এ এক মহৎ দৃষ্টান্ত। জেনারেশনের সেই সূত্রটা আবার ধরা দেয়।

মনে পড়ে যায় তোমরাই নাটকের কথা। আমার বিচারে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আবদুল্লাহ আল-মামুনের এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটা যেন সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করা যায় এই নাটকে। স্বাধীনতার পরবর্তী দুর্দশার দিনলিপি এখানেও প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বার বার ভেসে আসে সংগ্রামের কথা, দেখতে পাই তার প্রতিচিত্র। স্মৃতিকথার ভেতর দিয়ে উঠে আসে অমন চিত্র, এভাবেই আবার নাট্যকার তাঁর প্রধান অন্বেষা- অতীত ও বর্তমানকে যূথবদ্ধ করেন। এই নাটকেই তিনি সংগ্রামের সঙ্গে ত্যাগের, প্রেরণার সঙ্গে হাহাকারের কথা বলেন আকবরের সংলাপে।

জানিস পলা, যুদ্ধের সময় আমরা প্রায়ই রিক্সার গদির নিচে গোলাবারুদ, বন্দুক, পিস্তল লুকিয়ে রাখতাম। রিকশাওয়ালারাই সেগুলো জায়গামতো পৌঁছে দিত। রিকশাওয়ালাদের সাহস দেখেছি তখন। .... (যুদ্ধের চিত্র ভেসে ওঠে যেন।) স্বাধীন দেশ, মানুষের মুখে হাসি। ওরা বুক উঁচু করে হাঁটে। রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমায়। এই তো চেয়েছিলাম। এরি জন্য তো যুদ্ধ করেছিলাম। (মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা ধ্বনিত হয়) ...[হঠাৎ পরিবেশ ভুলে গিয়ে] মা-মাগো আমাকে তোমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখো না। আমি যুদ্ধে যাব। তোমার জন্য স্বাধীনতা আনবো। আমি না ফেরা পর্যন্ত বেঁচে থেকো মা। [পজ] মা, মাগো, আমি ফিরে এসেছি। এই যে দ্যাখো। আমি তোমার আকবর। তোমার কোলে ফিরে এসেছি। অমন করে তাকিয়ে কি দেখছো মা? একটা পা হারিয়েছি? কিন্তু দেশ তো স্বাধীন হয়েছে। মা তুমি পড়ে যাচ্ছ কেনো? চোখ খোল মা। আমার দিকে তাকাও- মা, মাগো [পজ] মা আর চোখ খোলে নি। মরবার আগে শুধু চিৎকার করে বলেছিল, ফিরিয়ে দাও, আমার সেই ছেলে ফিরিয়ে দাও, যার দুটো পা ছিল। আমি স্পষ্ট শুনতে পাই, মায়ের সেই চিৎকার এখনও বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। এদেশের স্বাধীনতা যদি সত্যি হয়, তা হলে একদিন এদেশকে আমার মায়ের চিৎকারের জবাব দিতেই হবে।

অনেকগুলো চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি। যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে মায়ের কাছ থেকে আকবরের বিদায়ের দৃশ্য। তারপর কিছু চিত্র আমরা অনায়াসে গড়ে তুলি নানাভাবে। আকবরের সমরকলা শিখন, জয় বাংলা স্লোগান, তার যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং আবশ্যিকভাবেই দু-একটি লড়াই-এ বীরত্ব আর তার পায়ে গুলির আঘাত লাগার পরও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, ক্রাচে ভর দিয়ে তার প্রত্যাবর্তন। মায়ের মৃত্যু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তার অশ্রুসজল ব্যাকুলতা। আকবরের মা যে ছেলের পঙ্গু অবস্থা দেখে শোকের আঘাতে মারা গেলেন, তিনি কি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ হিসেবে বিবেচিত হবেন না?

আকবরের মা মারা গেছেন। এমন নাট্যদৃশ্য অবশ্য আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নাটকে তিনি মা চরিত্রসৃজনের মাধ্যমে সমাজে নারীর সংগ্রামী ও নেতৃত্বমূলক ভূমিকার ওপরই অধিকতর জোর দিয়েছেন। দ্যাশের মানুষ-এ সাহানাকে দেখেছি আমরা। কিন্তু এমন শক্তির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল তোমরাই নাটকের মা। এই নাটকে নাট্যকার মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অবক্ষয়, নতুন প্রজন্মের বিপথগামিতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজাকারদের নব্য উৎপাত, সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন। পুত্র রঞ্জু যখন সাম্প্রতিক সময়ের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়, তখন মায়ের এক অসামান্য প্রতিবাদী রূপ দেখতে পাই আমরা। একজন মা তাঁর অন্তর্গত শক্তি নিয়ে এমন সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন এবং পচনশীল জেনারেশনকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, নাট্যকার এমনটাই বিশ্বাস করেন।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশ সমাজে চেতনার অবলোপন নিয়ে তিনি লিখেছেন আয়নায় বন্ধুর মুখ, সেখানে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশের সমাজের আদর্শিক দৈন্যের সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্ব ও প্রেমের বিষয়ও স্থান পেয়েছে। তৃতীয় পুরুষ নাটকের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের একটা ভিন্নমাত্রিক যোগ আছে। আয়নায় বন্ধুর মুখ-এ রানার মতো এখানেও ইমাম মুক্তিযুদ্ধে নিজেদের ইতিবাচক ভূমিকার কথা বিস্মৃত হয়ে নতুন ভোগবাদী সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ নেতা হয়ে উঠেছে। লায়লা তাকে ধরিয়ে দেয় পুলিশের কাছে। কাহিনীর এই সারল্যকে ছাপিয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুন এই নাটকের সংলাপ রচনায় অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। দীর্ঘ ও হ্রস্ব সংলাপে নাটকীয়তা যেমন সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি অতীতমুখিনতা এক ধরনের কাব্যিক পরিবেশ তৈরি করে।

এখনও ক্রীতদাস তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। এই নাটককে আবদুল্লাহ আল-মামুনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাট্যসম্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেটার যৌক্তিকতা নিয়ে আমার সংশয় আছে। অবশ্যই এই নাটকের অন্যতম প্রধান চরিত্র বাক্কা মিয়া মুক্তিযুদ্ধে আহত হয়ে এখন পঙ্গু অবস্থায় শোচনীয় দিনযাপন করেন। কিন্তু তিনি নিজেই জানিয়ে দেন, ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযোদ্ধা হবার কোনো সাধ বা পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। এর দ্বারা অবশ্য ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বিদ্রƒপ প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু এই নাটক কাহিনীর গতি-পরম্পরায় অসাধারণ হয়ে উঠেছে, কারণ এখানে দারিদ্র্যের এক উলঙ্গ রূপ দেখা যায়, দরিদ্র নারীর নিদারুণ অসহায়ত্ব দেখা যায়। হতে পারে নাট্যকারের বিচারে স্বাধীনতার পর এমন দারিদ্র্য আর গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই অসাধারণ নাটকের শক্তি নিহিত আছে দরিদ্রজনের বেঁচে ওঠার সুতীব্র বাসনায়। এই নাটকের সঙ্গে বিবিসাব-এর মিল সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। নারী তার শ্রম দিয়ে বৈরী জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। এই দারিদ্র্য এমন যে, চুরি, লাথির আঘাত, কিশোরী কন্যার উন্মার্গগামিতায় মাতার ঔদাসীন্য সবই কেমন স্বাভাবিক মনে হয়। এই দারিদ্র্য এক অশেষ গন্তব্যের দিকে ধাবমান। আবদুল্লাহ আল-মামুন অসাধারণ কুশলতায় কান্দুনি চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাহানা ও লায়লার এক হতভাগ্য ও জেদী রূপ খুঁজে পাওয়া যায়।

দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কথাই আবদুল্লাহ আল-মামুন এখনও ক্রীতদাস-এ বলতে চেয়েছেন। এই নাটক যাঁরা দেখেছেন, এর মঞ্চসজ্জার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাবে। বস্তিবাসীর জীবন। যে জীবনে কোনো ছন্দ নেই, স্থিরতা নেই, আগামীকালের কোনো রূপরেখা নেই, তাই স্বপ্ন থাকার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। অথর্ব বাক্কা মিয়া আর কান্দুনির মেয়ে মর্জিনা সস্তা প্রলোভনে সহজেই পা বাড়িয়ে দেয়। অবশ্যই এটাকে বাক্কা মিয়ার জীবনকথা বলে অভিহিত করা যায়। ট্রাকচালক হিসেবে সে তো একটা সংসার মোটামুটি চালিয়েই নিতে পারতো।

সে-ই তো এই নাটকের প্রধান ও সবচেয়ে করুণাপ্রার্থী চরিত্র। সে পা হারায়, জীবনে বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা হারায়, স্ত্রী ও কন্যাকেও হারায় অবশেষে। কিন্তু এটা তো নারীর গল্পও বটে। বাক্কা মিয়া পঙ্গু হয়ে যা হারিয়েছে কান্দুনি ও মর্জিনা শুধু দারিদ্র্যের কারণে তার চেয়ে বেশি হারিয়েছে। কাহিনীটাকে ওই দু’জনার বিবেচনা করলে তা আর পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে থাকে না। বাক্কা মিয়ার যে বস্তিতে বাস, সেখানকার অনেকেরই অনুরূপ কাহিনীর শব্দাবলি অদৃশ্যভাবে আমাদের কানে বাজে।

দারিদ্র্যকেই এই নাটকের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু করতে চেয়েছেন আবদুল্লাহ আল-মামুন। আর সমাজতত্ত্ব ও অর্থনীতির বিশ্লেষণে একটা প্রধান নির্দেশক হল দারিদ্র্য নারীকেই পুরুষ অপেক্ষা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাই কান্দুনির জীবনের বিপর্যয়টাকেও নাট্যকার গুরুত্ব দিয়েছেন। মামুনের একটি উল্লেখযোগ্য প্রবণতা ছিল নারীকে শক্তিমতী মাতৃস্বরূপে প্রকাশ করা। এই নাটকেও তার অবকাশ ছিল, অথবা বলা যায়, তিনি যে ধরনের কথক তাতে কাহিনীর নতুন মোড় তিনি রচনা করতে পারতেন। বস্তিবাসী হতদরিদ্র মানুষের গল্পটাই তাঁর কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু তাঁর নাটকগুলোর পুনর্পঠন করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, মামুনের মা-চরিত্র নিয়ে একটা আলাদা প্রবন্ধ রচনা করা যায়। তোমরাই নাটকে মায়ের যে চরিত্র এঁকেছেন, তার দ্বারা সত্যিই তিনি সমাজনেতাদের কাছে একটা বার্তা পাঠাতে চেয়েছিলেন, মহিলা-সংগঠনের জন্য একটা সাংকেতিক উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচির অনুচ্চ স্বরের মন্ত্র পাঠিয়েছিলেন। মায়েরা যদি এমন শক্তি নিয়ে পরিবারের মধ্যে নেতৃত্বের আসন সংগঠিত করতে পারেন, তাহলে আজকের যে ব্যাপক সন্ত্রাসযজ্ঞ, যে মাদকাসক্তি, ঈভ-টিজিং এসব অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। দ্যাশের মানুষ-এর সাহানাকে আমরা দেখেছি, মা হিসেবে কন্যার সামনে তিনি এক আপোষহীন প্রতিবাদী দৃষ্টান্ত। আবার স্পর্ধা-য় জেনারেশন অবক্ষয়ের সমস্যাকে প্রাধান্য দেবার জন্য তিনি এক আত্মসমর্পণকারী মা সৃষ্টি করেছেন। স্বল্পদৈর্ঘ্য পথনাটক কুরসী, সেখানেও এক তেজী মায়ের চরিত্র দেখতে পাই আমরা।

তবে আবদুল্লাহ আল-মামুনের শ্রেষ্ঠ মাতা-চরিত্র হল মেরাজ ফকিরের মা। এই নামের যে নাটক তিনি লিখেছিলেন, আমার বিচারে এটাই তাঁর সবচেয়ে দুঃসাহসী নাটক। এই নাটকে তিনি মৌলবাদ, ধর্ম নিয়ে রাজনীতিব্যবসা, ফতোয়াবাজি, ইসলামকে পুঁজি করে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দাম্ভিকতা, সংকীর্ণতা, কূপমণ্ডুকতা, ধর্মের নামে অমানবিকতা ইত্যাদিকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। নাটকটির একটা জন্মকথা আছে। প্রগতিশীল একটি সংগঠনের অনুরোধে আবদুল্লাহ আল-মামুন এই নাটকটি লেখেন। সেদিক থেকে এটি একটি ফরমায়েশী রচনা। কিন্তু নাটকটি রচনার শেষে এর পাণ্ডুলিপি পড়ার পর ওই সংগঠনের কর্মীরা আর এই নাটক পরিবেশনায় আগ্রহী হন নি। পরবর্তীকালে থিয়েটার (নাট্যগোষ্ঠী) এটিকে মঞ্চে আনে। এই নাটকের প্রতিবাদের ভাষা দর্শকের কপালে রীতিমতো ভাঁজ ফেলে দেয়। অত্যন্ত আনন্দের কথা যে, এই নাটক বিগত কয়েক বছর ধরে প্রদর্শিত হয়েছে এবং মেরাজ ফকিরের মা দেশে-বিদেশে সম্বর্ধিত হয়েছে। মেরাজ ফকিরের মা শক্তিমতী প্রতিবাদমুখর কোনো নারী নন। বরং তিনি এক ধরনের অনিবার্য অসহায়ত্বের প্রতিনিধিত্ব করেন। গ্রাম্য দুই পীরের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে তিনি মাঝখানে অবস্থান করেন। আবার মা হিসেবে তিনি আধুনিকতাকেও যেমন প্রশ্রয় দিয়েছেন, তেমনি এক সন্তানের পীর-গিরির বিরুদ্ধেও দাঁড়ান নি। তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অজানিত তথ্যের জন্য যে বিপর্যয়, তার অবসান ঘটে তাঁর মর্যাদার স্বীকৃতির মাধ্যমে। তিনি বিনাশকে রোধ করেন, মৌলবাদের প্রতিপক্ষীয় প্রতীক হয়ে ওঠেন, সমন্বয়ের সুরে কলহের অবসান ঘটান। এই মা যেন চিরায়ত শক্তি ও স্নেহের দৃষ্টান্ত, এই মা যেন আমাদের স্বদেশ অথবা তা অতিক্রম করে সমগ্র ধরিত্রী।

এই সূত্রে আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটকে নারী নিয়ে আলোচনা করতে চাই। এই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় সবশেষে তার পর্যালোচনাই বিধেয়। সুবচন নির্বাসনে থেকেই শুরু করা যায়। তিন সুবচনের একটিই কন্যা রানুর জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু সেইটাই আমাদের সমাজব্যবস্থার মূলকেন্দ্রে প্রোথিত। সমাজে নারীর অবস্থান কীভাবে নির্ণীত হয়? রানু তো প্রায় ইবসেনের নোরার প্রতিধ্বনি করে। সে বাবার বাড়ি, স্বামীর ঘর ইত্যাদির প্রতি পরিহাসময় অঙ্গুলি নির্দেশ করে। রক্ষণশীল সমাজে নারী হিসেবে যাবতীয় কিছু মানিয়ে নেবার, মেনে নেবার দায় রানুর, তা না হলে যে সংসারের সুখপাখি উড়ে যায়। নিশানাটা চিনিয়ে দিয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন ওই প্রথম পর্বে। রানুর  মতো নিম্নমধ্যবিত্ত বৃত্তে আছে মেরী, সাহানা, লায়লা, এঁরা সব। এমন আরো কয়েকজনকে দেখতে পাওয়া যায় তাঁর বিভিন্ন নাটকে। এরা সবাই সমাজব্যবস্থার শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই নিজেদের বেঁচে থাকার এবং অন্যদের ভালোবাসার একটা ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু নারীর অবস্থানই তাদের আকাক্সক্ষার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এইসব চরিত্র বিশ্লেষণ করে অবশ্য আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাটককে নারীবাদী তত্ত্বের চশমা দিয়ে দেখাটা যৌক্তিক হবে না। তিনি নারীর ভঙ্গুর অবস্থান বিষয়ে সজাগ ও সোচ্চার ছিলেন, তা হয়ত বলা যাবে। কিন্তু নাটকীয়তা সৃষ্টি করতে এবং বিনোদনের উপাদান হিসেবে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে তিনি অনেক সময়ই লঘু ভঙ্গিতে পরিবেশন করেছেন। কিন্তু সেই তিনিই শক্ত নারীবাদী অবস্থান গ্রহণ করলেন কোকিলারা রচনা করে। বোঝা যায়, এই নাটকের ভাবনা স্বতঃস্ফূর্ত নয়, গভীরভাবে সুচিন্তিত, তিনি বুদ্ধিজৈবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে নারীকে দেখছেন, বিচার করছেন, উপস্থাপন করছেন। কোকিলারা আবদুল্লাহ আল-মামুনের এক দুঃসাহসী নিরীক্ষা, ফেরদৌসী মজুমদারেরও বটে। তৃপ্তি মিত্রের অপরাজিতা দেখে এর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, নাট্যকার এমন কথা জানিয়েছেন। উৎস হিসেবে সে-কথা মানি। কিন্তু তারপরও মনে হয় অন্যান্য নাটকে কাহিনীর অন্তর্বর্তিনী হয়ে নারী যে বন্দীদশা ও নির্যাতনের শিকার, তাকে আলাদা করে নারীর একক অভিনয়ে সমগ্র ব্যবস্থার মধ্যে তার চিরকালীন দীনতা প্রকাশের একটা আলাদা প্রণোদনা ছিল তাঁর মধ্যে। মধ্যবিত্ত পরিবারে নারী যখন বুয়া,তখন বিত্তের বিচারে যিনি গৃহকর্ত্রী, তিনি তার চেয়ে উচ্চাসনে আসীন থাকতে পারেন, কিন্তু ওই গৃহের বলয়ের মধ্যেও নারী হিসেবে তার স্থানটা কিন্তু কখনো উচ্চ নয়, সুস্থির নয়, সম্মানের নয়।

নারী সর্বত্রই কোকিলা। বহুবাচনিক শব্দের ব্যবহারে নাট্যকার ওই কথা স্পষ্টভাবেই বোঝাতে চেয়েছেন। প্রথম কোকিলা জানায় বাসাবাড়িতে কাজ করতে গেলে নানান গালমন্দ শুনতে হয়, স্বাধীনতা থাকে না, তার চেয়ে গার্মেন্টসে কাজ অনেক ভালো। কত যে ভালো তা আবার সমকালের পাঠক সংবাদপত্র পড়ে জেনে যায়। আনু নামে এক রাজনৈতিক কর্মী কোকিলাকে ফুঁসলিয়ে তার শরীর ভোগ করে। নিম্ন মধ্যবিত্ত আকাক্সক্ষায় মগ্ন সেই তিনি মুখে হয়ত আদর্শের খই ফোটানো প্রতারক এক মানুষ। এমন নিত্যদিনের গল্প আমাদের জানা। দরিদ্র নারীদের এই তো নিয়তি। কিন্তু এই কোকিলাকে তো শুধু নির্যাতিতা হয়ে থাকলে চলবে না। তাই সে-ও চালাকি করে, নিজের অবচেতনে একটা নারীবাদী অবস্থান গ্রহণ করে। বাড়ির কর্তার নামে বদনাম রটিয়ে দেয়, হোক না তা যতই অনৈতিক, কিন্তু নারী হিসেবে তার জায়গাটার স্থিরতা চায় সে। কিন্তু এই কোকিলা যদি সফল হয়, তাহলে তো সমাজে বিপ্লব ঘটাতে হয়। তা তো ঘটে না; বরং কোকিলার আত্মহত্যাকেই অনেক গ্রহণযোগ্য ও পরিবেশনযোগ্য মনে হয়। দ্বিতীয় পর্বের কোকিলা এক সহজ সরল গৃহবধূ, শিক্ষিতা, কিন্তু অতীব পতিপরায়ণ। খবরের কাগজ পড়ে সে জানতে পারে অন্তঃসত্ত্বা এক মহিলার ট্রেনের চাকার তলে আত্মহত্যার কথা। এই হল আমাদের সেই আগের কোকিলা, যে বুয়ার দৃষ্টি দিয়ে বৈষম্যটাকে দেখেছিল। আর বর্তমান কোকিলা বলছেন:

আমি জানি, আপনারাও জানেন, সেই বিশ্বাসঘাতকটা একটা পুরুষ। এবং পুরুষ বলেই সে যখন এই পুরুষশাসিত সমাজে মাথা উঁচু করে হেঁটে বেড়াচ্ছে তখন এই হতভাগিনী পেটে অবৈধ সন্তান নিয়ে রেলের তলায় মাথা পেতে দিচ্ছে। এই পুরুষটি হয়ত আজীবন এমনি আরো মেয়েকে  হতভাগিনী বানিয়ে রেলের চাকার তলায় ঠেলে দেবে। কোনোদিন তার বিচার হবে না। এই অপরাধের কোনো প্রতিবিধান নেই। সমাজ নামক খাঁচার মধ্যে আমরা সবাই বন্দী। এই বন্দীদশা থেকে পুরুষ হয়ত একদিন তার সুবিধামতন মুক্তি খুঁজে নেবে। কিন্তু নারীরা মুক্তি পাবে না।

তৃতীয় পর্বের কোকিলার গল্প শোনা এখন বাহুল্যমাত্র। আবদুল্লাহ আল-মামুন তিন পর্বে অত্যন্ত নিরাভরণ নাটকীয় ভঙ্গিতে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। এই নাটকের বিশিষ্টতা এখানেই যে, একটা সুনির্দিষ্ট গন্তব্যের কথা জানার পরও নাট্যকারের কথনরীতিতে আমাদের মুগ্ধ হতে হয়। মনে পড়ে ফেরদৌসী মজুমদারের সেই অতুলন অভিনয়।

আবদুল্লাহ আল-মামুনের নাট্যসৃজন সম্পর্কে অনেক বিষয় অনুল্লেখিত থেকে গেল। তাঁর সংলাপ রচনা বিষয়েই একটি আলাদা প্রবন্ধে আলোচনা করা যেতে পারে। শব্দব্যঞ্জনার সঙ্গে গতিময়তার কী দারুণ সন্ধি! সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষাকে এমন মুন্সিয়ানার সঙ্গে তিনি তুলে এনেছেন যে, তার অনুকরণও দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।

আবদুল্লাহ আল-মামুন নাট্যকলার সকল বিষয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেই তিনি বক্তব্যের প্রয়োজন এবং দর্শকের চাহিদাকে মনে রাখতেন। বুঝতেন, নাটককে চূড়ান্তভাবে যোগাযোগসক্ষম ও সৃজনমুখর হয়ে উঠতে হবে। তাঁর নাটকের সংলাপ যেমন স্বতঃস্ফূর্ত, তেমনি শব্দ বা প্রয়োগ নির্বাচনে সুচিন্তিত। তাঁর বিভিন্ন নাটকের কতিপয় সংলাপ কোনোরকম বিশ্লেষণ ছাড়াই উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

ক.     চোটপাট। আমার লগে চোটপাট করে। মনে করছে আমি মাইয়া মানু, হের চোটপাট দেইখ্যা আমার দাঁতে কেটকী লাগবো? আরে যা ... তোর মতন এইরহম দুই পয়সার মোল্লা কত দেখছি। চান্দিতে টুপী লাগাইলেই মোল্লা হওন যায় না। মোল্লা হইতে পেটে এলেম লাগে। আমারে কয় রিশকার গ্যারেজ এইহান থিকা তুইলা দিতে। তর বাপের জা’গা নিহি? তুই কইলি আর আমি লগে লগে তর কথা মাইন্যা লইলাম? ... মনে করছস আমার সোয়ামী নাই, জুয়ান পোলা নাই। আমি একলা তর লগে ফাইট করতে পারুম না? তুই আমারে জুর কইরা ঠেইলা উঠাইবি? এই মইরাম বিবিরে তুই অহনতরি চিনতে পারস নাই। তোর মোল্লাগিরি আর কেউ ছুডাইতে না পারুক, আমি পারুম। (মরিয়মের সংলাপ: বিবিসাব)

খ.     আজ ভাবো তো ইমাম, এই জাফর যদি বেঁচে থাকতো, তুমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারতে? বুকে হাত দিয়ে বলতো, পঁচিশে মার্চের পর ঢাকা ছাড়ার সময় জাফরের সঙ্গে একটিবার যোগাযোগ না করে তুমি বেঈমানি করো নি? তুমি জানতে, তোমাদের আর সব সঙ্গী সাথীরা তাদের নেতা জাফরের সঙ্গে ঠিকই যোগাযোগ করেছে, তার নির্দেশ নিয়েছেÑ কিন্তু তুমি, তুমি ইমাম, জাফরের একটা খোঁজ নেবারও প্রয়োজন বোধ করনি। মুহূর্তে তুমি হয়ে উঠলে অন্য মানুষ। (ইমামের স্বগত সংলাপ: তৃতীয় পুরুষ)

গ.     আসল মুক্তিবাহিনী। অই শালা বেক্কল, আমি যদি আসল মুক্তিবাহিনী হই, তাইলে দ্যাশে জা’গা পাই না ক্যান? ঘর নাই ক্যান? বারী নাই ক্যান? বাপ-দাদার ভিটা গ্যালো কই? একখান ঠ্যাং লইয়া গলাচিপা বস্তির মইদ্যে ঘাউরা কুত্তার মতন কাইমাই করতাছি। মায়ে জিয়ে মিল্যা আমারে বান্দর নাচ নাচাইতেছে। একজন কয় লুলা আরেকজন কয় শালা। (বাক্কা মিয়ার সংলাপ: এখনও ক্রীতদাস)

ঘ.     চোউপ ধান্দাবাজ ফকির। মায়ের ধর্ম জানস তুই? মায়ের আসল ধর্ম সে মা। মায়ের অন্য ধর্ম, সেটা অতিরিক্ত। দুনিয়া জাহানে এক আল্লা ছাড়া কেউ তারে বিধান দিবার ক্ষমতা রাখে না। তুই তো এক মতলববাজ ফকির। তুই কি আমার মারে বিধান দিবি? যা ফকির, পারলে নিজের জান্নাতবাসী মায়ের মুখটা স্মরণ কর গিয়া। ( মেরাজ ফকিরের সংলাপ: মেরাজ ফকিরের মা)

তাঁর নাটকে স্বদেশ, তাঁর চেনা সমাজ ও এর গতিপ্রকৃতির অনৈতিক পরিবর্তন, সমকাল, মুক্তিযুদ্ধ এইসব সমসাময়িক প্রশ্ন গায়ে গায়ে জড়িয়ে থাকে। দুর্নীতির বিস্তারকে তিনি অবলোকন করেছেন। অনেকগুলো নাটক বিষয়ে মন্তব্য করার মতো অবকাশ বা পরিসর আর পাওয়া গেল না। বিশেষ করে চারদিকে যুদ্ধ-এর কথা মনে পড়ছে। অরক্ষিত মতিঝিল, স্পর্ধা, শাহজাদীর কালো নেকাব, দূরপাল্লা অথবা মেহেরজান আরেকবার ইত্যাদি নিয়েও কোনো আলোচনা করা হয় নি। এ জাতীয় আরো কিছু সীমাবদ্ধতার কথা কবুল করে নিচ্ছি।


শফি আহমেদ : অধ্যাপক। শিল্প-সমালোচক