Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা ২০০৮-এর বৈঠক : মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক

Written by অনুলিখন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[১৯ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার ২০০৮ তারিখে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীর ভেতর ও বাইরের প্রাঙ্গণ ঘিরে আয়োজিত হলো- রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা ২০০৮। দ্বিতীয়বারের মতো এই মেলার আয়োজন করেছিল নাট্যপত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’। দিনব্যাপী এই মেলায় বিভিন্ন নাট্যদল তাদের নিজস্ব স্টলে পরিবেশন করেছিল তাদেরই এতদিনকার কর্মযজ্ঞ। মেলায় সবার সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ আয়োজকদের উৎসাহিত করেছে নিঃসন্দেহে। মেলার অংশ হিসেবে দুপুরে আয়োজন করা হয়েছিল এক উন্মুক্ত বৈঠকের। বৈঠকের শিরোনাম ছিল- মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক। বৈঠকটির মূল আলোচক ছিলেন অধ্যাপক আজফার হোসেন আর সঞ্চালকের দায়িত্বে ছিলেন নাট্যজন আজাদ আবুল কালাম। নাট্যজন-নাট্যদর্শক-সমালোকের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হওয়া বৈঠকের অনুলিখন ছাপা হলো পাঠকদের জন্য ]

আজাদ আবুল কালাম
সবাইকে শুভেচ্ছা। রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা ২০০৮-এর এখনকার পর্ব হচ্ছে উন্মুক্ত বৈঠক। বৈঠকের শিরোনাম- মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক। আমাদের মূল আলোচক আজফার হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, লেখক, রাজনীতি-সাহিত্য-শিল্প সমালোচক এবং আমাদের নাটকের একজন ঘনিষ্ট বন্ধু। উনি প্রথমে কিছু বলবেন। তারপর আমরা যারা আছি তাদের মধ্য থেকে যে-কেউ প্রশ্ন বা আরও কিছু আলোচনার সূত্রপাত করিয়ে দিতে পারবেন। আপনারা যারা প্রশ্ন করবেন, নিজের নাম এবং কী করেন সেটা একটু উল্লেখ করবেন আর লক্ষ্য রাখবেন প্রশ্ন যেন খুব ছোট হয়, অনেকে যেন অংশগ্রহণ করতে পারে। আমি আজফার হোসেনকে আলোচনা শুরু করার জন্য অনুরোধ করছি।

আজফার হোসেন
ধন্যবাদ। আপনারা যারা এখানে একত্রিত হয়েছেন এবং এই আয়োজন যারা করেছেন তাদের সবাইকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাদের উপস্থিতি, বাইরে এতক্ষণ যে বিভিন্ন নাট্যদলের পরিবেশনা হলো, এসব দেখে এটাকে ঠিক আয়োজন বলা যাবে না; বরঞ্চ একে বলতে হবে মহা-আয়োজন। থিয়েটারওয়ালার এই মহা-আয়োজনে আমিও সামিল হতে পারলাম, এতে আমিও আনন্দিত।  

ঔপনিবেশিকতার সাথে নাটকের যে সম্পর্ক সেটি কখনো সংঘর্ষের সম্পর্ক, কখনো প্রতিরোধের, আবার কখনো তা গ্রহণ করারও সম্পর্ক। সম্পর্কের এই ভিন্নতাকেই আমি আমার কথায় সামনে আনবো। কিন্তু প্রথমেই আমি দুটো ধারণাকে উপস্থিত করতে চাই। একটা হলো ঐতিহাসিকতা, আরেকটি হলো ইতিহাসবাদ। এ দুটি ধারণা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এগুলো দিয়ে একটা পর্যায় পর্যন্ত, সমস্ত পর্যায় পর্যন্ত না হলেও, ইতিহাসের ভেতরে কাজ-করে-যাওয়া বিভিন্ন ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্পৃষ্ট নাটকের সাথে মতাদর্শের কী সম্পর্ক, সে সম্পর্কটা খানিকটা চিহ্নিত করতে পারবো। আমরা যখন ইতিহাসের কথা বলি, তখন আমরা বলি ইতিহাসের প্রভাবের কথা- ইতিহাস কীভাবে আমাদের জীবনকে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে, আমাদের মতাদর্শকে প্রভাবিত করে, তার কথা। এ ধরনের কার্য-কারণ-মার্কা বয়ান ও জ্ঞানভাষ্যিক অনুশীলনের ওপর ভিত্তি করে যে প্রতার্কিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি হয়, তাকে আমি বলছি ইতিহাসবাদ (আমি এখানে অবশ্য খানিকটা ইতালীয় মার্কসবাদী চিন্তক ও অ্যাকটিভিস্ট আন্তোনিও গ্রামসিকে কাজে লাগাচ্ছি।)। এখন কথা হলো ইতিহাসে যা ঘটেছে, ধরা যাক ঊনিশ শতকের এই সময়ে যা ঘটেছিল তা কি এখনও একইভাবে আবারও ঘটবে? না-ও ঘটতে পারে। এই যে ‘না-ও ঘটতে পারে’, এ-ধরনের বয়ানের দ্বারা অবশ্য ইতিহাসকে খারিজ করা হচ্ছে না, কারণ ইতিহাসের প্রভাবটা কিন্তু এখনও এই সময়ে পড়বে। তো এই যে প্রভাব, তার চরিত্র ও সম্ভাবনাকে ‘ক্রিটিক্যালি’ পরখ করে ইতিহাসের ভেতরে থেকেই ইতিহাস নির্মাণের প্রচেষ্টা হচ্ছে ঐতিহাসিকতা। কিন্তু ইতিহাসবাদের একটা সমস্যা হচ্ছে যে, ইতিহাসই সব নিয়ন্ত্রণ করছে। আমরা অতীতে ফিরে যাচ্ছি, নাটকের রসদ সংগ্রহের জন্য অতীতে যাচ্ছি, আমরা ঐতিহ্য অনুসন্ধান করছি, কিন্তু প্রশ্ন হলো এই অতীতই কি এককভাবে, রৈখিকভাবে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছে? আরেকটা প্রশ্ন হলো: অতীত থেকে রসদ বা ঐতিহ্যের সন্ধান করছি বটে, কিন্তু সেই রসদ আমরা কীভাবে ব্যবহার করছি? ইতিহাসবাদের একটা বড় সমস্যা হলো সে খপ্পর তৈরি করে। সুতরাং সেই খপ্পরগুলোকে চিহ্নিত করা দরকার।

এই কথা বলে এখন আমরা যাব আমাদের নাটকের ইতিহাসের কাছে। বাংলা ভাষায় লিখিত যে নাটকের কথা বলা হয়, তার ইতিহাসের একটা শুরু চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সেই ইতিহাস এখনো চলছে। বলা দরকার, ইতিহাস মানেই কেবল অতীত নয়; ইতিহাস বর্তমানকেও সঙ্গে নেয়, ধারণ করে, তার দ্বারা এমনকি বিভিন্নমাত্রায় প্রভাবিত হয় বটে। কিন্তু লিখিত ইতিহাসের বাইরে যে ইতিহাস আছে তাকে আমরা সামনে আনি না। যার ফলে বাংলা নাটকের বয়স ঘিরে একটা তর্ক আছে। বাংলা নাটকের বয়স নির্ধারণের সময় যদি আমরা ঔপনিবেশিক বা পশ্চিমা উপনিবেশের ‘লেন্স’ ব্যবহার করি তাহলে বিপদ আছে। কেননা লিখিতরূপের আগেও এখানে নাটক ছিল। এই যে গুটেনবাগ মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার এবং তার বাজারজাতকরণ, তার ফলেই আমাদের দেশে মুদ্রণযন্ত্রের প্রবেশ এবং বলতেই হয় যে, এর সাথে উপনিবেশের সরাসরি সম্পর্ক আছে। এই যন্ত্রের কল্যাণে বা অকল্যাণে আমরা কিন্তু নাটকের শুরুটা ভেবেই নিচ্ছি লিখিতরূপের পর থেকেই। এই যে উপনিবেশের প্রবেশ এবং তার যন্ত্রের প্রবেশ এর ফলে আমরা লক্ষ্য করলাম যে, উপনিবেশবাদের সুবাদে আমরা যাকে শিল্প বলে চিহ্নিত করতে শিখেছি বা অভ্যস্ত হয়েছি, তা থেকে দেহের একটা বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা ঘটলো। শিল্পের সাথে পারফরমেন্সের একটা বড় ধরনের বিচ্ছিন্নতা ঘটলো। কবিতার ক্ষেত্রে বলা যায়, সেখানে একটা আধুনিকতাবাদী পর্বের উন্মেষ লক্ষ্য করা গেল। একে আমরা সাধারণত তিরিশের আধুনিকতাবাদ বলি। সেখানে আমরা দেখলাম যে মুদ্রিত অক্ষরের উপর একপেশে জোর দেয়ার ফলে দেহের সঙ্গে হরফের, বা দেহের সঙ্গে এমনকি ধ্বনির বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে, যদিও ভাষার দেহতত্ত্বকে যদি মানি তাহলে বলতে পারি যে, ভাষা নিজেই উৎসারিত হয় প্রথমত দেহ থেকে। তারপরও মুদ্রিত অক্ষরের নির্দিষ্ট চাপ তৈরি হয়েছে। এতে ওই অক্ষর আর দেহনির্ভর থাকছে না। নাটকের ক্ষেত্রেও এক অর্থে তাই হয়েছে। তারপরও নাটক এমন একটা মাধ্যম যেখানে দেখা যাচ্ছে যে, মুদ্রিত অক্ষর চূড়ান্ত অর্থে বিজয়ী না, মুদ্রিত অক্ষরের বাইরেও কাজ চলছে। এবং এটি একদিক থেকে আধুনিকতাবাদী সাহিত্যের যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের মধ্যে এক ধরনের ‘প্রভিশনাল রাপচার’ হিসেবে কাজ করেছে। নাটক এখনো মুদ্রিত অক্ষরের আধিপত্যের বাইরে দাঁড়াতে পারে। কারণ নাটক করতে গেলে দেহের ব্যবহার, কণ্ঠের ব্যবহার, সঙ্গীতের ব্যবহার- অর্থাৎ পারফরমেন্সের তাবৎ অনুষঙ্গের ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে মুদ্রিত অক্ষরই এর শেষ কথা আর থাকে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কিন্তু নাটককে উপনিবেশবাদবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাই বলে নাটক আপনা-আপনি উপনিবেশবাদবিরোধী হযে ওঠে না। এই প্রসঙ্গে আমি একটু পরে আসছি। এর আগে আমি নাটকের ইতিহাসের যে কথাটা বললাম, সেখানে যাচ্ছি। নাটকের ইতিহাস দেখার ব্যাপারেও কিন্তু একটা উপনিবেশী মানসিকতা কাজ করে। যার ফলে অনেকেই মনে করেন যে, নাটকের ইতিহাস ঊনিশ শতকে উপনিবেশবাদের হাত ধরেই শুরু হয়েছে। এটা সত্য যে, নাটক একটা চেহারা নিয়েছে উপনিবেশের সাথে তার এনকাউন্টারের ভেতর দিয়ে। কিন্তু তার মানে এই না যে, তার আগে নাটক ছিল না। নাটকের উপস্থিতি আমরা তার আগেই লক্ষ্য করি যদি আমরা নাটককে আবার সংজ্ঞায়িত করি। সেজন্যই বললাম যে নাটকের ইতিহাসটা দেখার ব্যাপারেও একটা ঔপনিবেশিক লেন্স কাজ করছে।

এখানে আমি একজনের নাম উল্লেখ করতে চাই। তার কথা অবশ্য আমি কয়েকদিন আগে সেলিম আল দীনের জন্ম উৎসবে যে সেমিনার হয়েছিল সেখানেও কিছুটা বলেছি। এখানেও বলতে চাই। তিনি হলেন এ্যারিস্টটল। ইনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, ইনি হলেন পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির একজন প্রতিনিধির নাম। সেই এ্যারিস্টটলের প্রসঙ্গে বলি- আমরা এই যে ‘নাটক’ বলছি, এবং নাটকের যে শ্রেণীবিন্যাস করছি- এটি ট্র্যাজিডি, এটি কমেডি, এটি ফার্স ইত্যাদি, তো এই যে বিভাজনগুলো বা লেভেলগুলো আমরা তৈরি করতে শিখেছি, এই ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের একটা বড় ধরনের ভূমিকা আছে। এটা আমরা তাঁর পোয়েটিক্স-র কথা মনে রাখলেই বুঝবো। তাই বলে কি সমস্ত বিভাজনই অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক? তাই বলে কি এ্যারিস্টটল এগুলো করেছেন বলেই তাদের বর্জন করতে হবে? না। আমি সে-কথাটা বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু আমি বলতে চাচ্ছি তাঁদের কথা যাঁরা ইতিহাসের কিছু নির্দিষ্ট পর্বে দাঁড়িয়ে গেছেন ওইসব বিন্যাস ও বিভাজনের বিপক্ষে। যেমন সেলিম আল দীন। তাঁর নাটকে একটা ‘মাল্টিজনরা’ প্রেজেনটেশন থাকে, মানে নাটক হয়তো বলছি কিন্তু এই নাটকের ভেতরেই তথাকথিত সেই পাশ্চাত্যের বা এ্যারিস্টটলের সংজ্ঞায় যাকে নাটক বলে তাকে ভেঙে দেয়ার একটা প্রচেষ্টাও আছে। উপন্যাসের উপাদান, সংগীতের উপাদান ইত্যাদি মিলে যে একধরনের ‘অর্কেস্ট্রেটেড’ রূপ পাচ্ছে এই ব্যাপারটা বোঝা দরকার। এবং এ-ও খেয়াল রাখা দরকার যে আমরা প্রতিনিয়তই এ্যারিস্টটলের হাত ধরে বা ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে, এমন কি আমি নিজেও, বিভিন্ন ডিসকোর্সে বিভাজন তৈরি করে যাচ্ছি। বিভাজন ভাঙতে গিয়েও কিন্তু বিভাজন তৈরি করে চলেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো: বিভাজন মানেই কি খারাপ? আমি বলবো: বিভাজন অর্ন্তনিহিতভাবে খারাপ কিংবা ভালো না। তাহলে এখন প্রশ্ন তোলা যায়: এই বিভাজন ভাঙার জন্য আমরা কী করবো? কোন বিভাজন কী কাজ করে? বর্তমানে বিরাজমান বিভাজনগুলো দিয়ে আমরা কোন জায়গায় যাব? কোন কাজ করবো?

তাহলে ফিরে আসি এ্যারিস্টটলে। এ্যারিস্টটল সম্পর্কে এ-ও বলা দরকার যে, উনি কিছু কিছু নাটককে মহৎ নাটক হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, আমাদেরকে চিনতে সাহায্য করেছেন। আমাদের বলতে আমরা যারা উপনিবেশবাদ দ্বারা বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছি, যারা উপনিবেশবাদের একটা দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে থেকেছি, এখনও যারা আছি। এই আমাদেরকেই এ্যারিস্টটল শিখিয়েছেন যে, গ্রীক নাটক অত্যন্ত মহৎ নাটক, সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাটক। এ্যারিস্টটলের প্রভাবেই অনেক সময় আমরাই গড়গড় করে বলতে থাকি যে, মানুষের সমস্ত অনুভূতির ধারক ও বাহক, সমস্ত অভিজ্ঞতার সারাৎসার হলো গ্রীক নাটক। এভাবেই জানতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: সমস্ত অভিজ্ঞতার সারাৎসার বলতে আসলে কী বোঝায়। এই সময়ে, এই ২০০৮-এ-ও গ্রীক নাটক নিয়ে একটা মোহ আছে। কেবল আমাদের এখানেই না, পাশ্চাত্যেও আছে। পাশ্চাত্যে বিভিন্ন ধরনের তথাকথিত র‌্যাডিক্যাল আন্দোলন বা চিন্তার ক্ষেত্রে আন্দোলন আমরা লক্ষ্য করেছি; বিশেষ করে ইউরোপকেন্দ্রিকতাবিরোধী চিন্তার আন্দোলনও আমরা লক্ষ্য করেছি, তার কিছু উন্মেষ আমরা দেখেছি, প্রসারও দেখেছি। তা সত্বেও এখনও এই ধারণা জারী আছে যে, গ্রীক নাটক হচ্ছে সমস্ত নাটকের মানদণ্ড। কিন্তু কীভাবে? কেন? এই কথাটা আমরা কেন বলছি? আমরা গ্রীক নাটকের সাথে নিজেদেরকে কীভাবে সম্পৃক্ত করি? আমরা যখন অনুবাদের মাধ্যমে গ্রীক নাটককে এখানে নিয়ে আসি, তখন মূল গ্রীক নাটকের কতটুকু ধরতে পারি? অনুবাদের মাধ্যমে যদি গ্রীক নাটককে এনে গ্রীক নাটককেই বড় করে দেখি, তাহলে আমাদের কী হচ্ছে? এসব প্রশ্ন আমার মনে হয় তোলা উচিত, সামনে আনা উচিত। কেননা গ্রীক নাটক নিয়ে এখনো আমাদের একটা মোহ কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গ্রীক নাটক পড়ানো হয় কেবল তা না; গ্রীক নাটক নিয়ে একটা মোহ-ও শিক্ষার্থীদের ভেতরে ঢোকানো হয়। এমনকি পাশ্চাত্যের বিভিন্ন মহারথীদের রেফারেন্স দিয়েও ঐসব নাটক নিয়ে একটা মোহ তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করি। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, এর বাইরেও। সুতরাং আমাদের উপনিবেশায়িত মগজকে যদি ভাঙতে হয়, তাহলে এ প্রশ্ন তোলাটা জরুরি যে: কীভাবে গ্রীক নাটক মানুষের সমস্ত অনুভূতির সারাৎসার হয়, সর্বকালের মহৎ হয়?

এখানে এ কথাও বলে নেয়া দরকার যে, এই গ্রীসকে সভ্যতার কেন্দ্রে স্থাপন করার একটা পাঁয়তারা, কেবল পাঁয়তারা না, প্রতার্কিক একটা প্রাতিষ্ঠানিক ঐতিহ্য তৈরি হয়ে আসছে। বলা হয়, সভ্যতার শুরু গ্রীসে; বলা হয় অনেক কিছুর শুরুই হয়েছে গ্রীসে। এই গ্রীসকেন্দ্রিকতার সঙ্গে কিন্তু ইউরোপকেন্দ্রিকতার একটা সম্পর্ক আছে। এখানে না বলে পারছি না, উৎস সন্ধানের জন্য কেবল উৎসে যাওয়াই যথেষ্ট না এবং উৎসকে মহিমান্বিত করাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেই বা প্রতিরোধের কারণেই অতীতের কিছু কিছু জিনিস চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। সেই স্পিরিট থেকে আমরা বলতে পারি, গ্রীসের আগেও, আমরা যে মহাকাব্যের কথা বলি, যদিও এই ‘মহাকাব্য’ নামটিও এ্যারিস্টটলের কাছ থেকে এসেছে, তো আমরা যদি সেই টার্মটাও নিই, পাল্টা প্রয়োগের জন্য, দেখবো যে সেই মহাকাব্য, হোমারের ওডিসি, ইলিয়াড, এইসব মহাকাব্যের অনেক অনেক শতাব্দী আগেই ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মাঝখানে অর্থাৎ আজকের ইরাকে, তার যাত্রা শুরু হয়, এই মহাকব্যের নাম গিলগামেশ। অনেকে মনে করেন, এটিই প্রথম মহাকাব্য। তবে আমরা প্রথম না ধরলেও বলতে পারি গিলগামেশে-র শুরু ইলিয়াড ওডিসির আগে তো বটেই। এমনকি লিখন, আমরা যে লিখি, মুদ্রণ না, হাতে লেখা, সেটারও আবিষ্কার হয়েছে পাশ্চাত্যে, এমনটি বলা হয়। কিন্তু না, এর আবিষ্কার প্রথমে হয় আরব জগতে, মেসোপটেমিয়ায়, এশিয়ায়। এখানে মার্টিন বার্নালের কথা বলতে হয়। বার্নাল একজন সমকালীন উপনিবেশবাদবিরোধী তাত্ত্বিক, ইতিহাসবিদ, পুরাণ তাত্ত্বিক এবং তাঁর একটি বই আছে যার নাম ব্ল্যাক এথিনা। এই বইতে তিনি ধরিয়ে দিতে চাচ্ছেন যে, আমরা যাকে গ্রিক সভ্যতা বলছি এবং যে সভ্যতার দোহাই পেড়ে আমরা এ-ও বলতে ছাড়ছি না যে, যা কিছু নতুন তা আসলে গ্রিকরা প্রথম চিন্তা করে ফেলেছে বা উদ্ভাবন করেছে, সেই সভ্যতা ইতিহাসের কোনো একক আদিপর্বকে চিহ্নিত করে না মোটেই। হ্যাঁ, ফুকুইয়ামা যেমন নব্বইয়ের দশকে ইতিহাসের ‘শেষ’ ঘোষণা করতে চেয়েছিলেন, তেমনি ইতিহাসের ‘শুরু’ নির্দেশ বা নির্দিষ্ট করার ঘটনাও ঘটেছে অনেক আগেই, ওই পশ্চিমা মুল্লুকেই। অর্থাৎ ইতিহাসের ‘শুরু’ মানেই গ্রিক সভ্যতা। কিন্তু গ্রীসের আগেও মানুষ ছিল, পৃথিবী ছিল, মানুষের কাজ ছিল, চিন্তা ছিল, অনুশীলন ছিল। এবং রাজনৈতিক কারণেই এই এসব কাজের ভৌগলিক জায়গাটাও বার্নাল চিহ্নিত করেছেন। সেটা হলো এশিয়া ও আফ্রিকা। বার্নালের কাজ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে; আমি সেদিকে যাচ্ছি না। কিন্তু তার স্পিরিটটা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ; এই স্পিরিটটা হচ্ছে এই যে, পশ্চিমা জ্ঞানের যে আধিপত্য, সেই আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা চাই। তিনি এ-ও দেখাচ্ছেন কীভাবে ইতিহাসের ভেতর থেকেই এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়।

এটুকু বলার পর আমি একটু শেক্সপীয়রের কাছে আসতে চাই। শেক্সপীয়রকে নিয়েও আমাদের একটা বড় ধরনের মোহ আছে। এবং এটা আমি এখনও দেখি- শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা প্রচারণা আছে যে, যারা শেক্সপীয়র পড়েন না তারা অশিক্ষিত। শেক্সপীয়রকে একজন শ্রেষ্ঠ নাট্যকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ইংরেজিতে তারা আওড়ান শেক্সপীয়র ইজ দ্য গ্রেটেস্ট প্লেরাইট অব অল টাইমস। এভাবে শেক্সপীয়রকে যারা চিহ্নিত করতে পারেন না তারা আদতে সংস্কৃতিই বোঝেন না, এমন একটা ব্যাপার বা মানসিকতা আমরা লক্ষ্য করে থাকবো। এ সঙ্গে নিঃসন্দেহে ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে। আমরা কী করে জানি যে শেক্সপীয়র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ নাট্যকার? এটি একটা প্রশ্ন। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো: শেক্সপীয়রকে কি আমরা বড় করে চিনতাম যদি উপনিবেশবাদ শেক্সপীয়রকে এভাবে উপস্থিত না করতো? তৃতীয়ত, শেক্সপীয়রকে আমরা কতটুকু জেনে, তাঁর সাথে কতটুকু সম্পর্কিত হয়ে তাঁর ব্যাপারে ঐ কথাগুলো বলছি? মানে দেখা যাচ্ছে, যখন আমরা মোহাচ্ছন্নতার কথা বলছি, মোহাচ্ছনতা কিন্তু সম্পর্ক তৈরি করছে না বরং মোহাচ্ছন্নতা একটা বিচ্ছিন্নতার নাম। কারো সাথে সম্পর্কিত না হয়েই বরং তার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হওয়ার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। এই বিষয়টা ভাবা দরকার।

আরেকটি জায়গায় আমি যাচ্ছি; সেটি হলো পাশ্চাত্য নাটকের অনুবাদ। আমাদের এখানে পাশ্চাত্য নাটকের অনুবাদ করা হয়েছে। এবং ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নাটকের অনুবাদের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখবো যে, বিশ্বনাটকের ‘বিশ্ব’ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ। এই ইউরোপের এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাটক ছাড়া দুনিয়ায় যেন আর কোনো নাটক নেই! কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ হলো পৃথিবীর একাংশ, একটা ভগ্নাংশ মাত্র। পৃথিবীর কথা যদি বলতে হয়, বিশ্বের কথা যদি বলতে হয়, একেবারে আক্ষরিক অর্থেই যদি বিশ্বের কথা বলি, মানুষের সংখ্যার নিরিখে যদি বিশ্বের কথা বলি, তাহলে আমাদের তো বলতে হবে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার কথা। অথচ এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার নাটকের অনুবাদ আমাদের এখানে একেবারেই নগণ্য পর্যায়ের। এই নগণ্য হওয়ার কারণে এইসব জায়গার নাটকের সাথে আমাদের সম্পর্কিত হওয়ার সুযোগ থাকলেও সে-সুযোগ আমরা ব্যবহার করতে পারি নি। সুতরাং এক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, এই এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার যে নাটকগুলো এখনো জীবন্ত রয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের নাটকের দেয়া-নেয়ার কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে পারি কিনা, সেটা বিবেচনায় রাখা উচিত। এখানে একটা কথা বলে রাখি যে, উপনিবেশবাদবিরোধিতা মানে কিন্তু পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া না। অনেকে মনে করে যে, উপনিবেশবাদবিরোধিতা মানে কেবল ঐতিহ্য অনুসন্ধানের বিষয়। অবশ্যই ঐতিহ্য অনুসন্ধান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, আমাদের নিজেদের যে ভাব-সম্পদ আছে তার সৃজনশীল ব্যবহার করা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটাকে অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু অতীতে গিয়ে যদি আমরা আটকে থাকি এবং অতীতকে আমরা যদি রোমান্টিসাইজ করি, অতীতকে যদি আমরা আদর্শায়িত করে অতীতেই মজে থাকি এবং অতীতের আশ্রয়ে থেকে আর অতীতের দোহাই পেড়ে যদি ‘আমি কী হনুরে’ ভাব ধরে বসে থাকি, নিজিতে নিজে বিলীন হয়ে যাই- তাহলে কিন্তু বেশি দূর যাওয়া যাবে না এবং তাতে এই যে উপনিবেশবাদবিরোধি ক্ষেত্র তৈরি করা, তা তেমন ফলপ্রসু হবে না। উপনিবেশবাদবিরোধিতা কিন্তু কেবল অতীতকে রোমান্টিসাইজ করা বা নিজেতে নিজে মজে থাকা না। উপনিবেশবাদবিরোধিতাও কিন্তু এক ধরনের সম্পর্কিত হওয়া। এবং সেই সম্পর্কিত হওয়ার স্বার্থেই আমি মনে করি, এশিয়া-আফিকা-ল্যাটিন আমেরিকার যে নাট্য আন্দোলনের চেহারা ও চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে সেগুলোর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেইসব নাট্য-আন্দোলনসহ সেখানকার বিভিন্ন নাটকের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়া যায়। এখানে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে যে কাজটিকে গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে অনুবাদ। বলা দরকার, এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার প্রচুর নাটক ইংরেজি অনুবাদেও পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলায় অনুবাদের কাজটা তো জোরেসোরেই করতে হবে, একটা উপনিবেশবাদবিরোধী ভিশন নিয়েই। অনুবাদও তো এখানে হয়ে উঠতে পারে ‘প্র্যাক্সিস’। তাহলে অনুবাদ মানে এখানে কেবল ভাষান্তর নয়; অনুবাদ বরঞ্চ ইউরোপকেন্দ্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করার স্বার্থে হয়ে উঠতে পারে একধরনের রাজনৈতিক-মতাদর্শিক হাতিয়ার।

ওই রাজনৈতিক-মতাদর্শিক হাতিয়ারের কথা বিবেচনায় রেখেই আমি আরেকটি প্রসঙ্গে যাচ্ছি। প্রসঙ্গটি হলো পূর্বের সাথে পশ্চিমের সম্পর্ক। উদারনৈতিক মানবতাবাদ বহুদিন ধরে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছে, পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের মিলনই তো কাম্য। কিন্তু কী এই পূর্ব? কী এই পশ্চিম? এই পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন কি ধোপে শেষ পর্যন্ত টেকে? বিভাজনটা ধসিয়ে দেয়ার জন্য অনেকেই মনে করেন, এবং সেই মনে করার পেছনে কারণও আছে, যে, পূর্বের ভেতরে পশ্চিম ঢুকে থাকে এবং পশ্চিমের ভেতরে পূর্ব। ধরা যাক শেক্সপীয়রের সেই টেমিং অব দি শ্র“ নাটকটির কথা। এই নাটকটি তো আমাদের এখানে বাংলায় ভাষান্তরিত হয়েছে। কিন্তু কোত্থেকে এসেছে এই নাটকের মূল কাহিনী? আমরা জানি, সৃজনশীলতার একটা শক্তি হচ্ছে চুরির কাজটাকে শিল্পে রূপান্তরিত করা। তো, শেক্সপীয়র তাঁর ওই নাটকের কাহিনীটা প্রায় সরাসরি নিয়েছেন মৃত্যুকে-বাগে-আনা গল্প-বলিয়ে শেরেজাদের কাছ থেকে- অর্থাৎ আরব্য রজনী থেকে। শেক্সপীয়রের নাটকেই তো বিভিন্নভাবে আরব জগত হাজির থাকে, শুধু ইউরোপই না। আর এ-ও সত্য যে, যাকে আমরা ইউরোপীয় রেনেসাঁস বলে তাকে মাথায় নিয়ে ধেই ধেই করে নাচি, সেই ইউরোপীয় রেনেসাঁস-এর ওপর আরব জগতের বিভিন্ন জ্ঞানভাষ্যেরও প্রতার্কিক অনুশীলনের একেবারেই সরাসরি প্রভাব আছে। তাহলে এভাবে তো বলা যায় যে, পশ্চিমের ভেতর পূর্ব আছে। আবার মধুসূদন ও বঙ্কিম এবং এমনকি রবীন্দ্রনাথ পড়ে কেউ এ-ও বলতে পারেন যে, পূর্বের ভেতরেও পশ্চিম আছে। তাহলে কেন পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন? অনেকে সরলভাবে বলেন যে কোনো বিভাজন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক কারণেই কিছু কিছু বিভাজনকে বুঝতে হবে। প্রথম কথা হলো এই যে, পূর্ব আর পশ্চিমকে আলাদাভাবে দেখার রেওয়াজটা কিন্তু আমরা প্রথমে শুরু করি নি। ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশবাদের সুবাদেই ওই বিভাজনটা আমাদের কাছে এসেছে। এখন এই পূর্ব ও পশ্চিমের বিভাজনটার একটা পাল্টা ব্যবহার করছি এভাবে যে, পূর্ব বলতে আমরা ভৌগোলিকভাবে পূর্ব বলছি না, পশ্চিম বলতে ভৌগোলিকভাবে পশ্চিম বলছি না। আমরা বোঝাতে চাচ্ছি যে, পূর্ব ও পশ্চিম এখানে একটি ক্ষমতা-সম্পর্কের বিষয়। অর্থাৎ  এখানে পূর্ব ও পশ্চিম কেবল ভৌগোলিক বর্গ না হয়ে রাজনৈতিক বর্গে রূপান্তরিত হচ্ছে, যে বর্গগুলো আধিপত্যবাদী অসম ক্ষমতা-সম্পর্ককেই নির্দেশ করে বটে। অন্য কথায়, পশ্চিম এখানে আধিপত্যবাদের রূপক হয়ে উঠছে।

আগেই বলা হয়েছে, উদারনৈতিক মানবতাবাদ ভালোবাসার নামে পূর্ব ও পশ্চিমের মিলন ঘটাতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো পশ্চিমের সাথে পূর্ব মিলবে কী করে? যেখানে পশ্চিম এর মধ্যেই তার বিভিন্ন ধরনের আধিপত্য তৈরি করে রেখেছে? শত শত আধিপত্যবাদী বিভাজন তৈরি করে পশ্চিম ডাকছে: এসো আমরা মিলিত হই। কিন্তু এভাবে তো মিলন সম্ভব না। সমতা ছাড়া সত্যিকারের মিলন সম্ভব না। সুতরাং যারা অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক বিবেচনায় না নিয়ে বা তাকে মুছে দিয়ে মিলনের ডাক দেন, তারা আসলে এক অর্থে ঐ আধিপত্যবাদী অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের পুনরুৎপাদনে এক ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে আমার মনে হয়, সচেতনতা থাকা জরুরি। অর্থাৎ বারবারই ওইসব প্রশ্ন তোলা জরুরি: কার সঙ্গে কিসের সম্পর্ক? কী কারণে সেই সম্পর্ক? সেই সম্পর্ক আমাদেরকে কোনদিকে নিয়ে যাবে? এই প্রশ্নগুলো শুরুতে না থাকলে, এসব মিলনের ডাক দিয়ে কিছু হবে না। নাটকের যদি কোনো উপনিবেশবাদবিরোধী চেহারা তৈরি করতে চাই সেটাও সম্ভব হবে না।

ঠিক এই কথার সূত্র ধরে এবং তার অনুষঙ্গেই আমি আরেকটা প্রসঙ্গ সামনে আনতে চাই। সেটা হলো নাট্য-সংহতি তৈরি করার প্রসঙ্গ। একটা ত্রিমহাদেশীয় নাট্য-সংহতি তৈরি করা যায় কিনা? যেটির সাথে আমরা সম্পর্কিত করবো জাতীয় নাট্য-সংস্কৃতিকে, জাতীয় নাট্য-সংস্কৃতি আমরা তৈরি করতে পারি কিনা? আজকে আমাকে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতেও বলা হয়েছে। সেকারণেই আমি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করছি। তো এখন আমার প্রশ্নের পর পাল্টা প্রশ্ন হতে পারে: ত্রিমহাদেশীয় নাট্য-সংহতি বলতে কী বোঝায়? আমার কথা হলো, যারা উপনিবেশবাদের কবলে ছিল, কোনো না কোনোভাবে এখনো উপনিবেশবাদের দ্বারা আক্রান্ত আছে- যাকে আমরা লুজলি বলি তৃতীয় বিশ্ব অথবা এই যে এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকা, এদের যে নাট্য আন্দোলন, এই নাট্য আন্দোলনের সাথে আমরা কোনোভাবে সম্পর্কি হতে পারি কিনা? এটা একটা প্রশ্ন। সংহতির প্রশ্নটাকে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে বিবেচনা করি বর্তমান দুনিয়ায়। উত্তরাধুনিকতাবাদীদের অনেকেই ‘ক্ষুদে রাজনীতি’ কিংবা ‘নির্দিষ্ট ও কংক্রিট জায়গা’র ওপর একপেশে জোর দিতে গিয়ে ওইসব রাজনীতি ও জায়গার সঙ্গে বিরাজমান বড়-বড় ক্ষমতার কাঠামো বা ব্লকের যে সম্পর্ক বিভিন্নভাবেই বিভিন্ন পরিসরে কাজ করে তাদের ‘শর্ট সার্কিটিং’ ঘটায়। এর ফলে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড়ধরনের এবং শক্তিশালী সংহতি তৈরির সম্ভাবনা শুরুতেই ভেস্তে যায়। এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার। হ্যাঁ, বাংলাদেশে তো ক্ষুদে উত্তরাধুনিকতাবাদীদের উৎপাত আছেই। তবে আমরা যে-সময়ে বাস করছি, সে-সময়ে সাম্রাজ্যবাদের লজিকেই স্থানের সঙ্গে স্থান বা সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতি সম্পর্কিত হয়ে আছে, সেই সময়ের তাগিদেই প্রতিরোধের কেবল স্থানিক চেহারাই নয়, তার বৈশ্বিক চেহারাও তৈরি করা চাই। এই সময় আবার মগজে উপনিবেশের বিভিন্নভাবে কাজ করে যাবার সময়ও বটে। যার কথা আমি আগেই বলেছি, যার উদাহরণও আমি দিয়েছি। আবারও ফিরি সেই প্রসঙ্গে।

তাহলে কীভাবে মগজে উপনিবেশ কাজ করে? ধরা যাক ইংরেজি ভাষার কথা। তার আধিপত্যের কথা। একটা বাস্তব জীবনের গল্প আমি প্রায়ই বলে থাকি। আমার বাবা ও তাঁর বন্ধু একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন, দূরে কোথাও সিনেমা দেখতে। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে তাঁদের টিকেট কাটা হয় নি। তো যখন টিকেট চেকার আসলেন, বেশ গম্ভীরভাবে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন টিকেট কোথায়। তখন আমার বাবার বন্ধুর একটা ইংরেজি কবিতার সামারি মুখস্ত ছিল, তো তিনি ঝাড়া ঐ সারাংশ বলে গেলেন। চেকার তখন থতমত খেয়ে চলে গেলেন এবং অন্যরা যারা আশেপাশে ছিলেন তারা বলতে লাগলেন দেখেছো আমাদের ছেলে কেমন ইংরেজি জানে! তো এটাই হলো মগজে ঢুকে গেছে যে ইংরেজি জানা মানে বড় কিছু। এটা কিন্তু এখনো আছে। যে ইংরেজি জানে তার ভেতরে যেমন ঢুকে আছে, যে ইংরেজি শুনছে তার ভেতরও ঢুকে আছে। তার মানে কিন্তু আবার এই না যে আমি ইংরেজি ভাষাকে পরিত্যাগ করতে বলছি। কিন্তু ইংরেজি ভাষার যে আধিপত্যবাদী ক্ষমতা-সম্পর্কের দিক আছে, তাকে বারবারই চ্যালেঞ্জ করা দরকার।

এবার আমি আমার কথার শেষ দিকে চলে এসেছি। মানে আমাকে প্রথমে যে সুযোগ দেয়া হলো এক নাগাড়ে বলার, তার সময় শেষ হয়ে আসছে। পরে আবার বলা যাবে। তো শেষ প্রসঙ্গটি হলো এই: নান্দনিকতা একটা ঘোর তৈরি করে, অনেক সময়। দেখা গেল যে আমরা নাটকের প্রয়োজনে রূপকথা ব্যবহার করছি, প্রবচন ব্যবহার করছি, প্রাচীন নাটকের বিভিন্ন রসদ ব্যবহার করছি ... যদিও আমি আগেই বলেছি যে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ, কিন্তু এ-ধরনের কাজ যদি কোনো ঘোর তৈরি করে, নান্দনিকতার নিছক উৎসবে রূপান্তরিত হয়, তাহলে কিন্তু মুশকিল। অর্থাৎ শিল্পের যে একটা রাজনীতিকীকরণের ব্যাপার আছে, সেইটি তখন তেমন কাজ করে না। আমাকে এখন আমার কথা শেষ করতে হচ্ছে। সময়ের পরিসর বিবেচনায় রেখেই উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের স্বার্থে এবং নাটকের কাজের স্বার্থেই আমার উদ্দেশ্যই ছিল আপনাদের সামনে দু-একটি প্রশ্ন উত্থাপন করা, যার সূত্র ধরে আলোচনা আরো চলতে পারে অবশ্যই। আর হ্যাঁ, বর্তমান সময়ের নাটক বলতে কেবল নাটকের খতিয়ান দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিল না, তবে সামগ্রিকভাবে নাটকের কিছু মতাদর্শিক অভিক্ষেপকে প্রশ্নের ভেতর দিয়ে চিহ্নিত করেছি। তা নিয়েও আলোচনা চলতে পারে। সবশেষে আমার অনুবাদে আমি একটি কবিতা পড়ে শোনাব। কবিতাটি এক কালো কবির, যিনি প্রতিনিয়তই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। এই কবিতাও আমি উপস্থিত করছি আমার বক্তব্যের সমর্থনে। কবিতাটির নাম-

কামলা নকসুর উল্টো-লিখন
অ্যালেক্সিস্ নিউন্দাই

    শস্যের দানায় দানায় কামলা নকসুর নোকতা-ভরা নোনতা ঘাম
    শস্যের দানায় দানায় টকটকে রক্ত ছলকে ওঠে দাউ দাউ পূর্ণিমায়
    রক্তের টান জমিনের টান জবানের টান জোয়ারের টান
    টানে টান টান টান টান টানে টান টান টান টান

    দারুণ টানে ফিরে আসে আমাদের বাক্যসব-
    আমাদের চিহ্নগুলো ডাক ছাড়ে রক্তাক্ত দিগন্তের তাণ্ডব শেষে:
    আমাদেরও টগবগ-করা মহাকাব্য আছে
    আমাদেরও আছে বলকানো ইশতেহার
    কালো মানুষের দেহের পরতে পরতে দমকে দমকে ওঠে
    আমাদের নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে রচিত আখ্যান সব।
    
    আমাদেরও আখ্যান আছে
    আমাদেরও নদী নক্ষত্র নয়শ মোহনার নয়শ আকাশ আছে
    আমাদের দেহের ছন্দঃস্পন্দে ভাষার সীমান্ত-ভাঙা অঢেল জমিন আছে
    আমাদের ইতিহাসে কামলা নকসুর নোকতা-ভরা ঘামে
    শত শত কাব্য-পঙতির ভেতরে খুন ঝরে- ঝরঝর ঝরঝর ঝরঝর
    অথবা অঝোর ধারায় ধ্বনির দৃষ্টি মাতানো বৃষ্টি- বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
    ভীষণ উল্লাসে ধেয়ে-চলা আমাদেরই কাহিনী-কিস্সা
    
    তোমাদের উপনিবেশ ভেঙে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
    ভেঙে ভেঙে ভেঙে ভেঙে
    তোমাদের গাঁইগুই গাঁইগুই করা উপনিবেশ

    কামলা নকসু
    কামলা নকসু
    কামলা নকসু
    কামলা নকসু
    
    কামলা নকসুর নোকতা-ভরা নোনতা ঘামে
    লাঙলের ফলা কাব্য ফলায় জমিনের গতরে
    গাঙে ওঠে ঢেউ- চন্দ্রিমায় বর্ণমালা তড়পায় তড়পায়
    সভ্যতার নামে বর্বরতার বেসামাল আস্ফালনে
    আমাদের ইতিহাস জ্বলে দাউ দাউ দাউ দাউ
    তারপরও আমরা জাগি
    ভোরকে সামনে রেখে
    ওঠে কামলা নকসু
    
    যাত্রা তার শুরু হয় মহাকব্যের সর্গ থেকে সর্গে
    সীমান্ত ধ্বংস-করা মানুষের মানচিত্রহীন মানচিত্রে।

আজাদ আবুল কালাম
ধন্যবাদ, আজফার হোসেনকে তাঁর মূল্যবান কথাগুলো বলার জন্য। আজফার হোসেন অনেকগুলো প্রসঙ্গ এনেছেন। উপনিবেশবাদ ছাড়াও আমাদের ঐতিহ্য সন্ধান, এর রাজনৈতিক তাৎপর্য, থিয়েটারে আমরা যে ঐক্যের কথা বলি, বলে এসেছি এতদিন, সেই ঐক্য যে কেবল পাশ্চাত্যের সাথে না, এর বাইরেও, আফ্রিকা আছে, ল্যাটিন আমেরিকা আছে, এমন কি এশিয়ার অন্যান্য থিয়েটারের সাথেও যে আমাদের মেলবন্ধন হতে পারে, যোগাযোগ হতে পারে, সেই সম্ভাবনাগুলোর কথা বলেছেন। আমরা আগেই বলেছি, আপনাদের যার কিছু বলার আছে তিনি হাত তুলবেন এবং সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন রাখবেন। তাহলে শুরু করা যাক।

ব্রাত্য আমিন
[সদস্য- বটতলা]
আজফার স্যার একটা প্রসঙ্গ তুলে বললেন, বিষয়টা নিয়ে ভাবার জন্য, কিন্তু আমি নিজেই আসলে পরিষ্কার না বিষয়টার মানে কী? সেটা হলো আপনি বললেন নান্দনিকতার ঘোর বিষয়ে। ব্যাপারটা আরেকটু যদি পরিষ্কার করতেন।

আজফার হোসেন
নান্দনিকতার ঘোর এই অর্থে যে, যখন আমরা কেবল সৌন্দর্যের দোহাই পেড়ে বাদ বাকী বিষয়গুলোকে সৌন্দর্য থেকে বিযুক্ত করি, তখন একটা ঘোর তৈরি কর হয়। আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি- আমার একজন পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে বেশ কয়েকমাস আগে; তিনি সালমান রুশদীর খুব ভক্ত। তো আমাকে তিনি প্রশ্ন করলেন: আপনি সালমান রুশদীর অমোক উপন্যাসটা পড়েছেন? আমি বললাম- হ্যাঁ পড়েছি। তার উত্তরে তিনি বললেন- ওহ! কী দারুণ তাই না? আবার জিজ্ঞেস করলেন- আপনি কি অমোক উপন্যাসটা পড়েছেন? আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি বললেন- ওহ! বিউটিফুল! এমন করে যেটিই বলছি যে পড়েছি, তার উত্তরে তিনি বলেই চলেছেন- ওহ! আহ! দারুণ ইত্যাদি। তো আমি তাকে বললাম:- কী ওহ! বা কী বিউটিফুল? তো তিনি বললেন- দেখলেন না, ইংরেজি ভাষাটাকে কী দারুণভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ওইসব উপন্যাসে! এই যে কেবল ইংরেজির মোহে পড়ে অন্য আর সব কিছু তার চোখে লাগছে না, ফলে সে একটা পুনরাবৃত্তির মধ্যে আটকে আছে, সেটা তো আমাদেরকে বেশি দূর নিয়ে যায় না। তো নান্দনিকতার ঘোর হচ্ছে সেই ঘোর তৈরি করা যার ফলে আমরা সৌন্দর্যের বিষয়টাকে পৃথিবীর তাবৎ অনুশীলনের ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে কেবল সৌন্দর্যটা দেখতে থাকি। এটা একধরনের ‘ভায়োলেন্স’ও বটে, যার ফলে ‘সৌন্দর্য’কে কতটা সৌন্দর্য বলা যায় তা নিয়ে প্রশ্ন থাকে বটে। এছাড়া সৌন্দর্যের ধারণাটা যতটা না শাশ্বত তার চেয়ে বেশি তা ঐতিহাসিকভাবে উৎপাদিত এবং সামাজিকভাবে ‘কনস্ট্রাকটেড্’।

সে-কারণে ‘সৌন্দর্য’ মোটেই মতাদর্শনিরপেক্ষ নয়। হ্যাঁ, বাংলাদেশের একজন কৃষক যাকে সুন্দর বলেন, তাকে তো পিকাসোর সমঝদার সুন্দর না-ও বলতে পারেন। ধরা যাক তিরিশের আধুনিকতাবাদের  বিষয়টা। কেউ কেউ বলেন- বুদ্ধদেব বসু তো দারুণ লেখেন, চমৎকার গদ্য লেখেন, সুখপাঠ্য ... একেবারে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেন। কিন্তু যখন প্রশ্ন করা হয়, কেন গদ্য সুখপাঠ্য হলো, সুখটা কার বা কেন একজন কিছু পাঠ করে সুখ পায়, তখন উত্তরে যা মেলে তার নাম ঘোর। নান্দনিকতার ঘোর অনেক সময় কাউকে বড় করতে গিয়ে অন্যকে খারিজ করার প্রবণতাও তৈরি করে। আবার ধরা যাক, আর এক দল বলে- রাজনীতি নাকি কবিতাক স্পর্শ করলে, নাটককে স্পর্শ করলে বা শিল্পকে স্পর্শ করলে শিল্পের কাজের অযু নষ্ট হয়ে যায়, পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায়। একজনের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম, তিনি বলছেন, রাজনীতি কবিতাকে স্পর্শ করে না, আমি রাজনীতি থেকে বাইরে আছি। এটার অর্থটা কী? রাজনীতি থেকে কি আমরা বাইরে আছি? রাজনীতি মানে কি কেবল হাসিনা আর খালেদা যা বলে এবং করে তাই নাকি? তা তো না। যেখানেই ক্ষমতা আছে, যেখানেই ক্ষমতা-সম্পর্ক বিরাজ করছে, সেখানেই রাজনীতির প্রসঙ্গটা থাকেই। এই সময়ে বা কোনো সময়ে দাঁড়িয়ে কোনো কবি যখন শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেন, শব্দ এবং বাক্য দিয়ে যখন তিনি একজন মানুষকে ধরার চেষ্টা করেন বা যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেন, তখন সেই কবি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। শব্দের তো একটা ক্ষমতা আছে, নইলে সে যোগাযোগ স্থাপন করছে কীভাবে, তাহলে এই যে শব্দের ক্ষমতা আছে, তার মানেই তো এখানে রাজনীতি আছে। তো এধরনের যে ধারণা, রাজনীতি শিল্পে প্রবেশ করলে শিল্পের পবিত্রতা নষ্ট হয়, সেটিই হচ্ছে নান্দনিকতার ঘোর। এসব ঘোরকে চ্যালেঞ্জ করা দরকার। একটা জগতের মধ্যে থেকে একটা বিষয়কে দারুণভাবে সেলিব্রেট করে বাকি সব কিছুকে খারিজ করে দেয়া, আমি সেই অর্থেই ঘোরের কথা বলছি। এটাকে একধরনের কমোডিটি ফেটিশিজম বলা হয়ে থাকে। একটা টার্ম আছে ফেটিশিজম, যেটা এসেছে কার্ল মার্কসের কাছ থেকে এবং এটা আমরা ব্যবহার করতে পারি আমাদের কাজের স্বার্থে। অন্য কাউকে আমাদের সময়ে ব্যবহার করা মানেই যে আবার উপনিবেশের খপ্পরে পড়া তা-ও না। ফিরে যাই কমোডিটি ফেটিশিজম প্রসঙ্গে। একটা পণ্য যখন উৎপাদিত হয়, তখন তার মোড়কে যখন মূল্যের ট্যাগ বসানো হয়, ঝকঝকে মোড়ক বসানো হয়, তখন আমরা কেবল একটা পণ্যের মূল্যটাকেই দেখছি। কিন্তু এই পণ্য উৎপাদনে পেছনের যে উৎপাদন প্রক্রিয়া থাকে, শ্রমিকের রক্তের দাগ থাকে, সেটিকে কিন্তু আমরা দেখি না। কারণ, দৃশ্যত ঐ ঝকঝকে মোড়কে কোনো রক্তের দাগ নাই। কিন্তু ঐ রক্তের দাগটা দেখা দরকার। যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা উপনিবেশবিরোধিতা করতে চাই, তাহলে কেবল মোড়ক দেখলে চলবে না। রক্তের দাগটাও দেখতে হবে। তো যারা কেবল ঝকঝকে মোড়কে পণ্যের দাম দেখে তারা একধরনের নান্দনিকতার ঘোরের মধ্যে থাকে বলে আমি মনে করি। ধন্যবাদ।

আজাদ আবুল কালাম
এই প্রসঙ্গে আমার মনে হচ্ছে যে, আমরা উপনিবেশবাদ বলছি এবং বারবার কেবল পাশ্চাত্যের দিকে তাক করছি। আসলে কিন্তু উপনিবেশ মানেই কেবল পাশ্চাত্য না। আমরা যদি আমাদের টেলিভিশন বা চলচ্চিত্রের দিকে তাকাই দেখবো যে, পাশ্চাত্য আমাদের যত না প্রভাব ফেলছে তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। এবং এটাও কিন্তু অর্থনীতির সাথে সম্পর্কিত। টাটার গাড়ির সাথে কিন্তু কেবল টাটা আসছে না, ঐশ্বরিয়ার ছবিও আসছে। এবং ওনার শরীর দেখিয়ে বোঝানো হচ্ছে যে, এরকমই হতে হবে শরীর।

আজফার হোসেন
হ্যাঁ, এটাই হলো প্রভাব বিস্তার করা। আমি উপনিবেশবাদ বলতে বোঝাচ্ছি একাধিক পরিসরেই বিভিন্নমাত্রায় কাজ করে যাওয়া আধিপত্যবাদী ও অসম ক্ষমতা-সম্পর্ককে। কিন্তু আমরা যখন ধ্রুপদী উপনিবেশবাদের কথা বলি তখন তাদের কথাই আসে যারা অন্য জায়গা থেকে আরেকজনের জায়গায় এসে তাকে শাসন করে, দমন করে, তাদের সংস্কৃতি-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। এই প্রভাব কিন্তু খামাখাই বিস্তার করে না। করে পুঁজির প্রসারের জন্য। সুতরাং আমরা যখন উপনিবেশবাদের কথা বলবো তখন কোনোভাবেই পুঁজিকে বাদ দিয়ে বলা যাবে না। উপনিবেশবাদ আর পুঁজিবাদ কিন্তু পরষ্পর সম্পর্কযুক্ত। আর আধুনিক যে উপনিবেশবাদের কথা বলা হয়, যাকে আবার ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ বলা হয়, তার একটা সময়কাল মোটামুটিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৯২ সাল থেকে। আর হ্যাঁ, পুঁজির প্রবেশ কিন্তু কেবল টাকার প্রবেশ না; পুঁজির প্রবেশের সঙ্গে বাইরে থেকে সংস্কৃতি প্রবেশ করে, রাজনীতি প্রবেশ করে, অনেক ডিসকোর্স প্রবেশ করে। পুঁজি একাকি উড়ে উড়ে পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়ায় না বা কেবল উড়ে এসে জুড়ে বসে না। তার সঙ্গে থাকে তার ‘রেটোরিক’-এর ‘আমি’, তার মতাদর্শিক-সাংস্কৃতিক বিকীরণ ও বিস্তার। পুঁজির এই পুনরুৎপাদনী সাংস্কৃতিক লাজিক থেকে বর্তমান সময়ের উপনিবেশবাদকে- যে উপনিবেশবাদকে আমি ‘লেট কলোনিয়ালজিম’ও বলে থাকি- তাকে আলাদা করে দেখা যাবে না।

মোহাম্মদ বারী
[সদস্য- থিয়েটার আর্ট ইউনিট]
আপনি উপনিবেশবাদ বা মগজে উপনিবেশ নিয়ে কথা বলেছেন, এখন ‘এ সময়ের নাটক’ নিয়ে কিছু বলতেন। আর একটা প্রসঙ্গ এনেছেন যে, জাতীয় নাট্য-সংস্কৃতি গড়ে তোলা, তো সেটা কী আমাদের ঐতিহ্য অনুসন্ধানের নাটকগুলোকে সূত্র ধরেই করবো? এব্যাপরে আপনার কী মত?

আজফার হোসেন
এ সময়ের নাটক বলতে একাত্তরের পরের নাট্যচর্চার কথা বোঝাতে চেয়েছি। এ সময়ের নাটকে উপনিবেশবিরোধিতা যে একেবারে অনুপস্থিত তা বলা যাবে না; কিন্তু খুব স্পষ্ট করে উপনিবেশবাদকে যে মুছে ফেলতে পেরেছি তা-ও বলা যাবে না। তবে এ সময়ের নাটকের কথা বললে তার আগের নাটকের কথাও আসবে। পাকিস্তান আমলের নাটকের কথা। এমনকি তারও আগের উপনিবেশ আমলের নাটকের কথাও আসে। সেই তুলনায় এখনকার নাটকে একটা জিনিস ঘটেছে, এবং এটাকে ইতিবাচক মনে করি, সেটি হচ্ছে- স্বাধীনতার পর যে নাটক মঞ্চে নিয়মিত হয়েছে, দর্শক হয়েছে, প্রচুর নাটক লেখা হচ্ছে, এমনকি কিছু নাটক অনুবাদ হচ্ছে- এই ব্যাপারটি কিন্তু আগে ছিল না। এব্যাপারে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় তাদের কথা যারা মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশে নিয়মিত নাট্যচর্চাটা শুরু করেছেন এবং নাটকের যে উপনিবেশবাদবিরোধী স্পষ্ট মনোভাব থাকা দরকার সেই জায়গাটায় যাওয়ার জন্য সেলিম আল দীনকে স্মরণ করতে হয়। এ সময়ে নাটকটা মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার ফলে, নাটকের যে সম্পর্ক বিস্তারের বিষয়টি, সেটি সামনে এসেছে। যা কিনা পাকিস্তান আমলে ছিল না বা তার আগেও ছিল না। ধরা যাক ঐ সময়ের নাট্যকার যাঁরা ছিলেন তাঁদের কথা- আসকার ইবনে শাইখ, নূরুল মোমেন, আনিস চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী এমনকি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহও গুরুত্বপূর্ণ নাটক লিখেছিলেন, তারপর সাঈদ আহমদ। তো ওনারা যে ভালো নাটক লেখেন নি তা কিন্তু না, কিন্তু সেগুলো বহুল বা নিয়মিত মঞ্চায়িত না হওয়ার ফলে নাটক যে সম্পর্ক স্থাপনের কাজ করে সেই কাজটা হয় নি। সেই কাজটা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর। কিন্তু কথা হলো একটা নিদেনপক্ষে স্বাধীন দেশে নাটক যে সম্পর্ক স্থাপন করা শুরু করলো তা কীভাবে আরও এগিয়ে নেয়া যায়? জনগণের বা শিল্পীর চিন্তা-চেতনার যে জায়গা থাকা উচিত সেই জায়াগাটা কাজে লাগিয়ে নাটক আরও কত উপনিবেশবাদবিরোধী বা আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান নিতে পারে, সেই ভাবনাটা সামনে আনতে চাই। অনেকেই আছেন, তারপরও যদি সেলিম আল দীনকেই ধরি, এই সময়ের নাটকে, ঐতিহ্য সন্ধানের বিষয়টি যেমন দেখি, সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু এই ঐতিহ্য সন্ধান করতে গিয়ে তিনি কি রোমান্টিসিজমে ভুগছেন, নাকি উপনিবেশবাদের খপ্পর থেকে বাইরে আসতে চাচ্ছেন? এগুলো কিন্তু জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন। আমরা প্রশ্ন করতে শিখলে তো উত্তর পাব, তা না হলে হবে না।

আর হ্যাঁ, জাতীয় নাট্য-সংস্কৃতি বলতে বর্তমান সাম্রাজ্যবাদের এই পর্বে গোলকায়নের আগ্রাসনের মুখে সৃজনশীল নাট্যচর্চার স্বার্থেই উপনিবেশবাদবিরোধী নাট্যান্দোলনের কথা বোঝাতে চেয়েছি। বলা দরকার, আজকাল অনেকেই ‘জাতি’, ‘জাতি-রাষ্ট্র’, ‘জাতীয়তাবাদ’, এবং ‘জাতীয়’ বর্গগুলো গুলিয়ে ফেলেন, একাকার করেন। এখানে ‘জাতীয়’ বলতে আমি ‘স্ট্রাজিক’ নির্মাণকে বোঝাতে চাচ্ছি। বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতাকে মুছে না ফেলেই বিভিন্ন নাট্যদল জাতীয় পর্যায়ে উপনিবেশবাদবিরোধিতার স্বার্থেই কীভাবে সম্পর্কিত হতে পারে তার সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখার কথা বোঝাতে চেয়েছি।

সামিনা লুৎফা নিত্রা
[সদস্য- বটতলা]
স্যারের কাছে আমার একটা প্রশ্ন, আপনি সেলিম আল দীনের নাটকের কথা বলেছেন, আমরা যে কাজগুলো করছি বা আমরা যখন উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করছি, যখন লিখছি, তখন একটা বিষয়ের অবতাড়না হয়েছে, সেটি হলো ঐতিহ্যকে নিয়ে একটা রোমান্টিসিজম বা ভাবালুতায় ডুবে যাওয়া। তো যখন সেলিম আল দীনের নাটক পড়ি, দেখি যে, ঐতিহ্যের কাছে যাওয়া বা শেকড়ের কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা আছে। কিন্তু ঐ যে বললেন যে, উপনিবেশকে মুখে বিরোধিতা করা হচ্ছে বা লেখায় বিরোধিতা করা হচ্ছে অথচ প্রকৃত অর্থে ভাবালুতার মধ্যেই ডুবে থাকছে, এই ব্যাপারটা কেন ঘটে? মানে আমি নিজেও যেহেতু লিখি, তো আমিও চাইবো এসব বিষয় থেকে মুক্ত হতে। আমি চাইবো লিখতে গিয়ে যেন ভাবালুতায় ডুবে না যাই। তো আপনি কী সেলিম আল দীনের নাটকের নাম উল্লেখ করে বলতে পারেন যে, কোন নাটকে ঐতিহ্যের সন্ধান আছে পাশাপাশি রোমান্টিসিজমে ভুগেছেন মনে হয়েছে?

আজফার হোসেন
না, আমি কিন্তু সেলিম আল দীনকে নিয়ে একটা প্রশ্ন তুলেছি মাত্র। বলেছি ভেবে দেখতে। কারণ কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তোলাটা খুব জরুরি। এখন ভাবালুতা থেকে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে, সেটার ব্যাপারে কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো ব্লুু-প্রিন্ট দেয়া যাবে না। তবে ভাবালুতা কী কাজ করে সেটা দেখা যায়। কারণ হচ্ছে উপনিবেশবিরোধিতা তো একটা স্ট্রাগলের ব্যাপার। এটা তো আমাদের প্রতিনিয়ত অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। হুট করে কোনো এক সকালে উঠে আপনি উপনিবেশবাদবিরোধী হয়ে যাবেন, সেটা তো সম্ভব না। প্রতিনিয়তই আমাদেরকে স্ট্রাগল-এর ভেতরে থাকতে হবে। সেদিক থেকে সেলিম আল দীনের দীর্ঘ দিনের কাজে একদিক থেকে যেমন উপনিবেশবাদবিরোধিতা লক্ষ্য করি, যার জন্য আমার শ্রদ্ধা তো আছেই, অন্য দিকে, তাঁর কাজে একধরনের ভাবালুতাও লক্ষ্য করি। যেমন গ্যেটেকে নিয়েও তাঁর দারুণ অভিভব প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিভিন্ন উচ্চারণে এবং সেই অভিভব এমনভাবে প্রকাশ করেন যে, অন্যান্য ক্ষেত্রে গ্যেটে আমাদেরকে কীভাবে দেখেছেন সেখানে তিনি (সেলিম আল দীন) যেতে রাজি না। এই যে অন্য জায়গায় যেতে রাজি না, এই রাজি না হওয়ার ফলে কিছু বিপত্তি তো ঘটেই। গ্যেটে মহাশয় যেমন ‘বিশ্বসাহিত্য’-এর ডাক দেয়ার পরও এবং ‘জাতীয় সাহিত্য’-এর সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করা সত্ত্বেও বুঝিযেছেন যে ওই ‘বিশ্বসাহিত্যের’ ‘বিশ্ব’ বলতে মূলত ইউরোপকে বুঝিয়েছেন, সেই বিষয়টা নিয়ে এই পর্যন্ত আমি আমাদের দেশের কোনো গ্যেটে-ভক্তকে প্রশ্ন তুলতে দেখি নি। তো, যাই হোক, ভাবালুতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমার মনে হয় একধরনের সার্বক্ষণিক সম্পর্ক দেখার একটা ব্যাপার আছে এবং সেটিও একটা চর্চার ব্যাপার। অনেকেই এই সম্পর্কগুলোকে শর্ট-সার্কিট করে ফেলেন। শর্ট-সার্কিট না করে সম্পর্কগুলোকে বিস্তারের মধ্যে নেয়াটাই জরুরি। এভাবে যদি ভাবা যায়।

আজাদ আবুল কালাম
আমি একটু জানতে চাই যে, এই যে ভাবালুতা বা বললেন যে, নান্দনিকতার ঘোর তৈরি করে, এই ঘোরের ফলে কি এমন পরিস্থিতি হয় যে- আমাকে দেখ, আমি কে দেখ। ... এমন জায়গা কি তৈরি হয়?

আজফার হোসেন
অবশ্যই হয়। এবং বলে রাখি যে ক্ষেত্র বিশেষে এই ‘আমাকে দেখ’ এমনটা হওয়া জরুরিও বটে। আমি বলছিলাম মজে থাকার কথা। এখন কথা হচ্ছে মজে থাকার পর আমি কী করছি। এটা তো ক্ষেত্র-বিশেষে নিজেকে এ্যাসার্ট করা যে, ‘আমাকে দেখা হচ্ছে না’, অতএব ‘আমাকে দেখ’। এটাকে কিন্তু আমি খারিজ করে দিতে বলছি না। আমি বোঝাতে চাইছি না যে, নিজেকে দেখানো যাবে না, অতএব, ঐতিহ্য থেকে ফিরে এসে কেবলমাত্র বর্তমানকে একটা বিশুদ্ধ বর্গ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আমরা জানি, উপনিবেশবাদ নিজেই উপনিবেশিতের পরিচয়, ইতিহাস, ঐতিহ্যকে মুছে ফেলতে চায়। সে-ক্ষেত্রে ‘আমি আছি’ বা ‘আমাকে দেখো’ বলাটা জরুরি হয়ে পড়ে। আমি বোঝাতে চাইছি, ‘আমাকে দেখ’র জায়গা থেকে কোনো নতুন নির্মাণের দিকে যাওয়া যায় কিনা।

মাহমুদুল ইসলাম সেলিম
[সদস্য- নাগরিক নাট্যাঙ্গন]
এই যে বলা হচ্ছে মগজে উপনিবেশ, তো এব্যাপারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

আজফার হোসেন
রবীন্দ্রনাথের সাথে উপনিবেশবাদের সম্পর্কটা কী, এটা সংক্ষেপে বলা কিন্তু আমার পক্ষে কঠিন এবং বিপজ্জনকও বটে। তবু একটু বলি- সম্পর্কটা হচ্ছে টানাপোড়েনের সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের উপনিবেশবাদবিরোধিতায় গায়ে ঔপনিবেশিকতার চিহ্ন লেগে থাকে। সংক্ষেপে বললে এই দাঁড়ায়। এখন বিষয়টা আরেকটু পরিষ্কার করি। সেটা হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে উপনিবেশের বিরুদ্ধে যেখানে তাঁর দাঁড়াবার কথা সেখানে ঠিক তিনি দাঁড়াচ্ছেন না। এটি যেমন দেখি, ঠিক একইভাবে আমরা দেখি পাশ্চাত্যে সভ্যতার নামে যে ‘বর্বরতা’ চলছে বা সভ্যতাকে কলুষিত করছে, এই ব্যাপারগুলোকে তিনি ধরতে চাচ্ছেন একধরনের মানবতাবাদী অবস্থান থেকে। কথাটা আমার নিজস্ব পঠন থেকে বললাম। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কমছে কম ৫০টি প্রবন্ধ আছে। এবং তাঁর সমগ্র লেখার প্রায় হাজারখানেক পৃষ্ঠায় তিনি প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য বিষয়টা এনেছেন। সুতরাং রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে চট করে কোনো অবস্থানে যাওয়া খুবই কঠিন। তারপরও আমি বলছি যে, রবীন্দ্রনাথকে আমি চিনি তাঁর ঔপনিবেশিক টানাপোড়েনের ভেতর দিয়েই। এবং এই ঔপনিবেশিক টানাপোড়েনে উপনিবেশবাদবিরোধিতা যেমন লক্ষ্য করি, ঠিক তেমনি উপনিবেশবাদের খপ্পরে যে তিনি পড়েছেন সেটিও আমরা দেখতে পারি। এব্যাপারে আমি দুটি প্রবন্ধের কথা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে উনি সরাসরি পশ্চিমা সভ্যতা নিয়ে বক্তব্য নিয়ে এসছেন- একটি হচ্ছে ‘সভ্যতার সংকট’। ‘সভ্যতার সংকট’ পড়লে, আমি যতবারই পড়েছি, মনে হয়েছে যে, এটি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যাশাভঙ্গজনিত দীর্ঘশ্বাস। মনে হচ্ছে, পশ্চিমের কাছে তিনি চেয়েছিলেন অনেক, আশা করেছিলেন অনেক এবং সেই আশা বা প্রত্যাশা ভঙ্গ হয়েছে। এবং লক্ষ্য করা যাবে, এই প্রবন্ধের শেষে গিয়ে তিনি আবার বলছেন- মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। কিন্তু বলছেন না, কোন মানুষ? পাপ আসলে কী? এসব প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত থেকে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের ঔপনিবেশিক টানাপোড়েন দেখি। এবং বলা দরকার, রবীন্দ্রনাথের এই প্রবন্ধটাকে তাঁর উপনিবেশবাদবিরোধী দলিল হিসেবে দেখা হয়। আরেকটা প্রবন্ধ হলো ‘শিক্ষার মিলন’। সেখানে কিন্তু তিনি বলছেন যে, পূর্ব এবং পশ্চিমকে মিলতে হবে বটে কিন্তু হুট করে ডাক দিলেই তো মিলন হয় না। রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই প্রবন্ধে বলছেন যে- কুলির সাথে মজুরের যে ঐক্য সেই ঐক্য সত্য নয়। ... তার মানে কী? ঐক্যের জন্য কী দরকার? অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক ভাঙা দরকার, আর সেটার জন্য সংগ্রাম দরকার। তো দেখা যায় ১৯২১ সালে লেখা এই প্রবন্ধে যা বলছেন আর ১৯৪১ সালে, মৃত্যুর আগে যা লিখেছেন এর মধ্যে ২০ বছর আগের ভাবনাটা আমার কাছে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে বেশি জরুরি মনে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে আপাতত এতটুকুই থাক।

সুজন
আমাদের সংস্কৃতির সূত্রগুলো উপনিবেশবাদবিরোধিতার ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করে? আর অনুবাদের ব্যাপারে বলছি, আমরা কি পাশ্চাত্য বা মার্কিন নাটক ছাড়া অন্য কোনো অনুবাদ পাই নি?

আজফার হোসেন
আমি তো আগেই বলেছি, উপনিবেশবাদবিরোধিতা সার্বক্ষণিক একটা স্ট্রাগলের ব্যাপার। আমার মনে হয়, উপনিবেশবাদবিরোধিতার স্বার্থেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে আমরা যদি একটা লড়াকু জ্ঞানতত্ত্ব তৈরি করতে পারি। এবং সেটাও নির্মাণের ব্যাপার। একদিনে তো একটা থিয়েটার তৈরি হয় না। একদিনে একটা তত্ত্বও তৈরি হয় না। লড়াকু জ্ঞানতত্ত্বটা হবে এমন যে, এই জ্ঞানতত্ত্বের নিরিখে আমরা বিভিন্ন সম্পর্কগুলোকে দেখে সেই সম্পর্কগুলোকে প্রতিহত করার জন্য আমাদের দাঁড়াবার জায়গা তৈরি করা যাবে। এবং আমি এটা মনে করি এই সময়ে, যে সময়ে আমরা আছি, কোনো একটা বিশেষ ধারণার, বিশেষ কাজের, বিশেষ বিষয়ের, বিশেষ অনুশীলনের তাৎপর্য বোঝা আমাদের খুবই কষ্ট হবে যদি আমরা পুঁজির লজিক, মাইক্রো লজিক এবং ম্যক্রো লজিক, কীভাবে কাজ করে, তা না বুঝি। অর্থাৎ পুঁজিবাদ কীভাবে সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে, সাম্রাজ্যবাদ কীভাবে পুঁজিবাদী হয়ে ওঠে, এই বাস্তবতার অনুপুঙ্খ পাঠের ভেতর যদি না থাকা যায় তাহলে কিন্তু আমরা বারবারই খপ্পরে পড়বো। আমি এভাবেই ওই প্রশ্নটির জবাব দিতে চাই।

আর অনুবাদের ব্যাপারে আমি আগেই তো বলেছি। আবারও বলি। মাঝে মাঝে মলিয়ের আর ব্রেখটের কথা বলা হয়। তাঁদের কিছু কাজ ভাষান্তরিত হয়েছে কিন্তু আমরা ‘তৃতীয় বিশ্ব’-এর বা ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের পৃথিবীর অনেক নাট্যকারের সাথেই পরিচিত না। যেমন ধরা যাক থিয়ূঙ্গ, পেদ্রো পিয়েত্রি, বুর্গোসের কথা (কালো নারীবাদী নাটক তৈরি করেছেন)। এঁদের ও এঁদের মতো অনেকেরই নাটক কিন্তু সে পরিমানে আসে নি, যদিও এগুলো ইংরেজি অনুবাদে পাওয়া যায়। তারপরও কিন্তু এগুলোর অনুবাদ হয় নি। কেন হয় নি? আমার কাছে একটা কারণ মনে হয়, একমাত্র না হলেও, সেটি হলো একধরনের ঔপনিবেশিক মনোগঠন। কারণ আমাদেরকে শেখানো হয়েছে অমোক হচ্ছেন বিশাল নাট্যকার, ইউরোপ ‘বড়’, তার নাট্যকারেরা ‘বড়’ ইত্যাদি। তো আমাদের মনোগঠনে নিদেনপক্ষে প্রচ্ছন্নভাবে আছে এ ব্যাপারগুলো। ফলে কোনটাকে আমি সামনে আনছি, কোনটাকে লুকিয়ে রাখছি, এগুলো কোনো নিরীহ ব্যাপার না। এইগুলো ঔপনিবেশিক মানসিকতার ব্যাপার এবং এ কারণে আমার মনে হয় অন্যান্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো বটেই, নাটক অনুবাদের ব্যাপারে প্রচণ্ডরকম ইউরোপকেন্দ্রিকতা আছে।

ব্রাত্য রাইসু
[কবি]
আজফার স্যারের কথা-বার্তা ভালো লাগতাছে। একটা প্রশ্ন করি, এক হইলো যে, উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাড়াইয়া আমার ঐতিহ্যের কাছে কেন যাইতে হবে? আমার বর্তমান কি যথেষ্ট না? আরেকটা হইলো ঐতিহ্য নিজেই তো উপনিবেশ দ্বারা আক্রান্ত থাকতে পারে। আমার হাজার বছরের ইতিহাস হইলো উপনিবেশবাদ দ্বারা আক্রান্ত ইতিহাস, তাইলে বর্তমান বাদ দিয়ে কতদূর ইতিহাসের কাছে যাব? সবটাই তো উপনিবেশবাদের ইতিহাস। এখন আমি যদি ঐতিহ্য থেকে একটা কিছু আইনা সেলিম আল দীনের নাটকের মধ্যে ঢুকাইয়া দিলাম, তারপর যা দাড়াইবো সেটাও তো আরেকটা উপনিবেশবাদ। তো এই বহির্দেশীয় উপনিবেশবাদ এবং আমার ঐতিহ্যের উপনিবেশবাদ, এই দুইটা উপনিবেশবাদের খপ্পরে আমি পড়তে পারি। তো এর বাইরে কিছু সম্ভব কিনা? অর্থাৎ আমার ‘বর্তমান’ আমাকে কিছু দিতে পারে কিনা। নাকি আমার ‘বর্তমান’ এমনই যে উপনিবেশবাদের বাইরে কিছুই নাই? যদি থাকে তাইলে আমাকে কেন ঐতিহ্যের দিকে যাইতে হবে?

আজফার হোসেন
রাইসু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন এবং এটা বলা দরকার যে, এই প্রশ্নটা আমারও ছিল এবং বোধকরি আমার কথায় প্রশ্নটা এসেছে- ঐতিহ্যের কাছে কেন যেতে হবে? কেবল ঐতিহ্যকেন্দ্রিকতা খুব বেশিদূর যে নিয়ে যাবে তা না। ঐতিহ্যকেন্দ্রিকতা এক ধরনের ঐতিহ্য-ফেটিশও তৈরি করতে পারে, তৈরি করতে পারে বিচ্ছিন্নতা, যা উপনিবেশবাদও চায় বটে। কিন্তু আমরা তো ঠিক করে দিতে পারি না একজন সৃজনশীল নাট্যকার কোন দিকে, কীভাবে, কতদূর যাবে। যাকে ঐতিহ্য বলছি, সেটা তো একটা বর্গ, যেটাকে তৈরি করা হয়েছে, বর্তমানের প্রেক্ষাপটেই তৈরি করা হয়েছে। বিশুদ্ধ ঐতিহ্য বলে কী আছে আমাদের? আমরা নিজেদের বাঙালি বলি, আবহমানকাল ধরে নাকি আমরা বাঙালি। তো এই আবহমানকাল’ বলতে কী বোঝাচ্ছে এবং ‘আবহমানকাল’ ধরে আমরা কীভাবে বাঙালি থাকছি? আর ‘অতীত’ যে বলছি, সেটাও কিন্তু একটা তৈরি করা বিভাজন। ‘অতীত’, বর্তমান’, ভবিষ্যৎ’ এ সবই তো বিভাজন। আমি আগেই বলেছি, আমরা উপনিবেশবাদের খপ্পরে এমনভাবে পড়ছি যে সেটাকে আগে খতিয়ে দেখা দরকার। আমি প্রায়ই বলি যে, একটা গর্তের মধ্যে পড়ে যদি গর্তটাকে পৃথিবী ভাবি, তাহলে ঐ গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা কম। আর গর্তের ভেতরে পড়ে যদি আমরা বুঝতে পারি যে এটা ‘গর্ত’, পৃথিবী না, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে যেই বিভাজন, অনেকে মনে করেন এই বিভাজনও উপনিবেশের হাত ধরে এসেছে, এই যে আমরা কথা বলছি- একজন প্রশ্ন করছি আরেকজন উত্তর দিচ্ছি, ফলে যে রৈখিকতা তৈরি হয়, এটিও উপনিবেশবাদের ব্যাপার। এই যে আমি বেশি কথা বলছি তুলনামূলকভাবে, আপনারা কম কথা বলছেন, এই যে আমি একটু উপরে বসে আছি, আপনারা নিচে- এই যে হায়ারার্কির ব্যাপারটা, এটাও হয়তো বা উপনিবেশের কাছ থেকে এসেছে। এভাবে অনেক বিষয়কেই অনন্তকাল ধরেই সমস্যাক্রান্ত করা যায়। কিন্তু আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো এই যে, স্ট্র্যাটিজিক্যালি অনেক সময় অতীতকে চিহ্নিত করতে হয়। পূবকে, পশ্চিমকে চিহ্নিত করতে হয়। ইতিহাস বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা আমাদের যতটুকু শিক্ষা দেয়, তার থেকে অন্তত এটুকু বলা যাবে যে, প্রতিরোধের কারণেই অনেক সময় এই বিভাজনগুলোকে রাখতে হয়। আমি আবারও বলছি, বিভাজন মানেই অন্তর্নিহিতভাবে খারাপ জিনিস না। এও জানি, উত্তরাধুনিকতাবাদীদের একটা বড় দল সব বিভাজনকে এক করে গুলিয়ে ফেলে তাদের ধসিয়ে দেয়ার চেষ্টায় নিজেরা যুৎসই প্রতিরোধের জায়গা তৈরি করতে পারে না। তো, আমরা কোন কাজে, কোন প্রেক্ষিতে একটা বিভাজনকে ব্যবহার করি, সেটা দেখা জরুরি। এখন আমি রাইসুর কথায় আসি: ঐতিহ্যের কাছে কি যেতেই হবে? না, এমন কোনো ধরাবাধা কথা নেই, নিয়ম নেই এবং আমি বলিও নি যে, ঐতিহ্যের কাছে যেতেই হবে। কিন্তু যারা ঐতিহ্যের কাছে গিয়ে মজে থাকে, ঐতিহ্যের সাথে বর্তমানকে সম্পর্কহীন করে, তাদের সমস্যা নিয়ে কথা তো আগেই বলেছি। আমি হয়তো অনেক কথা বলে ফেললাম, শেক্সপীয়র থেকে ১০টা লাইন বলতে পারলাম, কিন্তু আলাওল থেকে একটা লাইনও বলতে পারলাম না, এটা যেমন সমস্যা, ঠিক একইভাবে বেহুলা লক্ষিন্দরের আখ্যান পুরোটাই পুনরুৎপাদন করলাম কিন্তু আমরা যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করি তার সাথে বহুজাতিক কোম্পানির লাভের যে সম্পর্ক এবং তার সাথে একজন কৃষকের রক্ত ঝরে যাওয়ার যে ব্যাপারটা, তা বুঝতে পারছি না, তাহলেও একই সমস্যা দাঁড়ায়। আর বর্তমান বলতে কোনো বিশুদ্ধ জিনিস নাই, অতীত বলতেও বিশুদ্ধ কোনো ব্যাপার নাই। আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে যদি অতীতের কথা বলি, তাহলে সেটা বিশুদ্ধ অতীত হবে না। বর্তমানের ভেতরে এসে সেই অতীত বর্তমানায়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সুতরাং বিশুদ্ধ অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কোনোটাই নাই। কিন্তু আমাদের কিছু কিছু কথা বোঝানোর জন্য, বলার জন্য এবং বাস্তব পৃথিবীতে প্রতিরোধের স্বার্থেই এই বিভাজনগুলোকে উল্লেখ করতে হয়, তা না হলে তো কোনো কথাই বলা যাবে না, কোনো লক্ষ্যে পৌঁছানোই যাবে না। আর উপনিবেশবাদের সর্বব্যাপিতা ও সর্বগ্রাসিতা উপনিবেশবাদ, হেজিমনির মতোই, নিরঙ্কুশ নয়। তাই উপনিবেশবাদ সব সময়ই ছিল, তাই থাকতে বাধ্য, এমন যুক্তি উপনিবেশবাদকে প্রশ্রয় দিতে পারে।

আসাদুল ইসলাম আসাদ
[সদস্য- সুবচন নাট্য সংসদ]
আমার বিষয়টা ভারী, কিন্তু প্রশ্নটা খুবই হালকা ...

আজফার হোসেন
প্রশ্নটা হালকা কিনা, সেটা তো বুঝবে যিনি উত্তর দেবেন। আপনার কাছে যা হালকা তা আমার কাছে হালকা না-ও হতে পারে হাঃ হাঃ, যাক প্লিজ প্রশ্নটা শেষ করুন।

আসাদুল ইসলাম আসাদ
যাক, আমরা দেখছি যে আলোচনায় ‘এ সময়’, ‘নাটক’, ‘মগজ’, ‘উপনিবেশ’- একথাগুলো এসেছে। তো এই সময়টা কী? সময়টা হলো ব্রড ব্যান্ডের। আরও পরিষ্কার করে বললে বিল গেটস এর প্রতিভূ। আর আমরা যদি নাটকটাকে ধরি- এখনকার নাটক- ধরা যাক প্রাচ্যনাটের রাজা ও অন্যান্য ... তো এই যে বিল গেটস আর রাজা এবং অন্যান্য সেক্ষেত্রে যদি আমরা অগ্রসরমানতার কথা বলি, তাহলে বিভেদ হয়ে যাচ্ছে উপনিবেশবাদের বিরোধিতা করা। আমার প্রশ্ন হলো- আমাদের আধুনিকতা এবং উপনিবেশবাদবিরোধিতা, এ দুটা পরষ্পর-বিরোধী কিনা?

আজফার হোসেন
প্রশ্ন হচ্ছে কার আধুনিকতা? সেই আধুনিকতা কী কাজ করে? কোথা থেকে এই আধুনিকতা এসেছে? ঐ যে প্রথমেই ঐতিহাসিকতা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা বিবেচনায় নেয়া দরকার। আমাদের এখানে আমরা যে আধুনিক হয়েছি, তার অর্থটা কী? মধ্যবিত্ত যে আধিপত্য বিস্তার করে, যে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে যে আধুনিকতার ধারণাকে সামনে এনেছে, সেই আধুনিকতা কী ধরনের? উপনিবেশবাদের সুবাদে আমাদের এখানে যে আধুনিকতা এসেছে সেই আধুনিকতা আমাদেরকে ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্র দিয়েছে, ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা দিয়েছে, অনেক কায়দা-কানুন শিখিয়েছে- যার ফলে এখনো আমরা বাংলার সাথে ইংরেজির অসম ক্ষমতা-সম্পর্ককে জিইয়ে রেখেছি: এই কারণেই এখনো আমরা  বাংলার সঙ্গে সংখ্যালঘু জাতিসত্ত্বার ভাষার যে অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক সেটাকে জিইয়ে রেখেছি। এই যে অসম ক্ষমতা-সম্পর্ক জিইয়ে রাখার কায়দা-কানুন, এই কায়দা-কানুন জাতীয় আধুনিকতা এখানে উপস্থিত হয়েছে। তো, আমরা কি এই আধুনিকতা চাই, নাকি অন্য কোনো আধুনিকতার কথা বলবো? এই প্রশ্নটা আমার এক অত্যন্ত প্রিয় কবি, কালো কবি বলেছেন যে, সাদা চামড়ারা যে আধুনিকতা আমাদেরকে দিচ্ছে, সেই আধুনিকতাকে আঁকড়ে আমরা ধরবো, নাকি আমরা আমাদের মতো করে আধুনিকতা তৈরি করবো? সেই হিসেবে আমি বলবো, আমরা যে আধুনিকতা চাই সেই আধুনিকতা নির্মাণে উপনিবেশবাদবিরোধিতা প্রয়োজন, এটা মোটেই পরষ্পর-বিরোধী না। আর ঐতিহাসিকভাবে উপনিবেশবাদের হাত ধরে যে ‘আধুনিকতা’ আমাদের এখানে এসেছে, সে আধুনিকতা নিজেই তো উপনিবেশবাদী।

সেতু
[নাট্যদর্শক]
মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক, উপনিবেশবাদটা আমাদের কীভাবে খেয়ে ফেলছে সেটা শুনলাম। এই যে ব্যানারটা এখানে টাঙানো আছে, সেখানে লেখা আছে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৮, তো এখানে কিন্তু বাংলা সাল ১৪১৫ লেখা নাই। তার মানে উপনিবেশবাদটা অসচেতনভাবে আমাদের ভেতর মিশে যাচ্ছে।

আজাদ আবুল কালাম
আপনি যেটাকে বাংলা সাল বলছেন, সেটাও বাংলা সাল না এটা ...

সেতু
আমি একটু ব্যাখ্যাটা করতে চাই সেটা হলো, ২০০৮ বললে যে কম্যুনিকেশনটা তৈরি হয়, ১৪১৫ বললে হয়তো হয় না। প্রতি নিয়তই আমরা উপনিবেশবাদের সাথে ইনভলভ্ হচ্ছি, আমি জানতে চাচ্ছি এর থেকে উত্তরণের উপায়টা কী? ধন্যবাদ।

আজফার হোসেন
প্রথমে বলে নিই যে, যদি এখানে ১৪১৫ সাল লেখা হতো, বাংলা তারিখ লেখা যেত, তাহলেই ব্যাপারটা যে উপনিবেশবাদবিরোধী হয়ে যেত তাও কিন্তু না। অনেকে বাংলা ব্যবহার করেও মনোগঠনের দিক থেকে ঔপনিবেশিক থাকার সম্ভাবনা দেখায়। আপনি এই কথাগুলো বলার সময় বললেন ‘কম্যুনিকেশন’, ‘ইনভলভ্’। এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন যেগুলো ইংরেজি শব্দ। আমি আবারও বলতে চাই যে, এই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা মানেই এই না যে আপনি উপনিবেশবাদের পক্ষে আপনা আপনি চলে গেলেন। বিষয়টা বোধকরি এতটা সরল নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ, বিষয়টা হচ্ছে মনোগঠনের ব্যাপার। আপনি উত্তরণের উপায় জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু এটা তো কোনো সূত্র দিয়ে হবে না। তবে প্রথমত জরুরি হচ্ছে এ ব্যাপারগুলোকে সনাক্ত করা; বারবার এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। বারবার সনাক্ত করতে করতে যখন এটা আমাদের প্রাত্যহিক আচরণের অন্তর্গত হবে তখন হয়তো আমরা একটা জায়গায় যাব। আবারও বলছি হুট করে কোনো এক সকালে আমি ও আপনি পরিষ্কারভাবে উপনিবেশবাদবিরোধী হতে পারবো না। আমরা যে খপ্পরে আছি এটা আগে বুঝতে হবে।

ফারুক ওয়াসিফ
[লেখক]
আলোচনায় অনেক সময় মনে হয় যে, ঐতিহ্য একটা অতীত বিষয় এবং এটা মাটির তলায় ছিল, সেটাকে টেনে তুলছি। কিন্তু আমরা সব সময় দেখেছি যে ঐতিহ্য সব সময় বর্তমানকে অবলম্বন করে দাঁড়িয়েছে। মাইকেল ইউরোপীয় ঐতিহ্য আর ভারতীয় ঐতিহ্যকে মিলিয়ে উদ্ভাবন করেছেন। ঐতিহ্যের সাথে যে উদ্ভাবনার বিষয়টা, সেক্ষেত্রে আমরা যদি প্রশ্নটা সুনির্দিষ্ট করি যে, হেলেনিক যে সৌন্দর্যতত্ত্ব, এ্যারিস্টটলের নাট্যশাস্ত্র, ভেনিসীয় সৌন্দর্য- এটা আমার এখনো মনে হয় যে আমাদের দৃশ্যসংস্কৃতির মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত। তো একে প্রশ্ন না করে আমরা উপনিবেশবিরোধী নাট্যকলার বিস্তার ঘটাতে পারি কি না? এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় কেউবা এ্যারিস্টটলের নাট্যশাস্ত্রের বা ইউরোপীয় নাট্যশাস্ত্রের বিপরীতে সংস্কৃতীয় নাট্যশাস্ত্রকে প্রস্তাব করছেন। সেটাও তো আরেক ধরনের ঔপনিবেশিক অস্তিত্ব যা এখন আবার আমাদের মধ্যে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। তো এই যে সংঘাতের জায়গা এবং তার ক্ষেত্রে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে বি-উপনিবেশীকরণ বলি আর আমাদের নাট্যকলার বিস্তার বলি (আমি নাটকের লোক নই, বাইরের হয়েই জানতে চাচ্ছি), সেক্ষেত্রে এলাকাগুলোকে আমরা কী করে চিহ্নিত করতে পারি? ভাষা, ঐতিহ্য, জনগণের ঠিক কোন অংশ, কোন শ্রেণী, কোন ধরনের সাংস্কৃতিক প্রবণতা যার মধ্যে এই ঐতিহ্যের যে বীজগুলো রয়েছে সেগুলো বর্তমানের সংযোগে নতুন করে আবার দানা বাঁধতে পারে এবং বৃহত্তর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর আকার আয়তন কী হতে পারে?

আজফার হোসেন
বাহ! প্রশ্নের আকারে আমরা একটা নাতিদীর্ঘ আলোচনা পেয়ে গেছি। গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এসেছে; বিশ্ব-সংস্কৃতির কথা বলা হয়েছে। তাহলে আবারও আমরা ফিরে যাই পূর্ব এবং পশ্চিম প্রসঙ্গে। এবং ভুল বোঝাবুঝি এড়াবার জন্য আবারও বলি, পূর্বের দোহাই পেড়ে কিংবা তাকে প্রশ্নহীনভাবে আদর্শায়িত করে পশ্চিমকে না জেনে না বুঝে এবং অসমালোচনামূলকভাবে বর্জন করা কিন্তু আমাদের উপনিবেশবাদবিরোধী কাজকে সাহায্য করবে না। একইভাবে না জেনে না বুঝে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার নামে কিংবা গোলকায়নের নামে পশ্চিমকে অন্ধভাবে গ্রহণ করাও উদ্দেশ্য হতে পারে না। আমি পূর্ব এবং পশ্চিমের রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে বিশ্বাস করি। এই সম্পর্ককে ইতিহাসের একটা বিশেষ মুহূর্তে, ধরা যাক এখন, এখন এটাকে ব্যবহার করতে পারি কি না? তো, ফারুকের কথায় এটা উঠে এসেছে যে, এই যে ব্যবহার করবো, সেটা কার পক্ষে ব্যবহার করবো? সেক্ষেত্রে অবশ্যই অধিকাংশ মানুষের কথাই বলতে হবে এবং তাহলে প্রশ্ন ওঠে, এই ‘অধিকাংশ মানুষ’ কারা? আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ মানেই খেটে-খাওয়া মানুষ। ফলে এই খেটে-খাওয়া মানুষের সাথে যদি সম্পর্কিত না হই তাহলে উপনিবেশবাদবিরোধিতাও সম্ভব না। এটা আমি মনে করি। কারণ খেটে-খাওয়া মানুষদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার ভেতর দিয়েই প্রশ্নগুলো আনতে হবে যে, কোনটি দরকার আর কোনটি দরকার না। ঐতিহ্য বলে যাকে আমরা চিহ্নিত করছি, কৌশলগত কারণে, সেখান থেকে যদি রসদ তুলে নিয়ে বর্তমানে ব্যবহার করা যেতে পারে, এবং ব্যবহার করা যেতে পারে সেই ‘অধিকাংশ মানুষের’ মুক্তির লক্ষ্যে তাহলে সেটা ইতিবাচক কাজ হবে। পশ্চিমের সাথে আমরা সম্পর্কিত হবো কীভাবে? সম্পর্কিত হবো এভাবে যেন পশ্চিমের আধিপত্যবাদের খপ্পরে আমরা না পড়ি। ফলে পশ্চিমকে জানতে হবে, তার আধিপত্যবাদী ও আধিপত্যকামী তত্ত্ব ও অনুশীলনসহ পুরো সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পকেই চ্যালেঞ্জ করবো এবং তাদের বিরুদ্ধে শুধু একটি পরিসরেই নয় বিভিন্ন পরিসরেই আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখবো। আর এটা করতে হলে আমাদের দরকার তত্ত্ব, অনুশীলন, অধিকাংশ মানুষের সাথে সম্পর্কিত হওয়া এবং প্রাত্যহিক সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তো, এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব একটা তত্ত্ব আছে। সেটা হলো এই যে, উপনিবেশবাদবিরোধিতার জন্য ৪ টি এলাকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা উপনিবেশবাদবিরোধী নাটক লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন তাঁদের মধ্যেও আমি লক্ষ্য করেছি, এই ৪ টি এলাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ৪ টি এলাকা হলো- দেহ, ভাষা, ভূমি এবং শ্রম। এই ৪ টি এলাকা কিন্তু পরস্পর-মুক্ত না। কার থেকে মুক্ত না? সেখানেও আরও ৪ টি বিষয়কে আনতে হয়- পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদ ও পুরুষতন্ত্র। এই ৪ টি ক্ষমতা-সম্পর্কের ও উৎপাদন-সম্পর্কের কাঠামো মানুষের দেহ, ভাষা, ভূমি ও শ্রমকে টার্গেট করে এবং ওগুলোকে নিজেদের বলয়ে নিয়ে আসে। ৪ টি এলাকাকে মুক্ত করার কাজই উপনিবেশবাদবিরোধী কাজ। আর সে ক্ষেত্রে সৃজনশীল কর্মকাণ্ড জরুরি এবং নাট্য-সংস্কৃতি তার কাণ্ডারী হতে পারে।

জয়
[সদস্য- বটতলা]
ধরা যাক ভারতে আগুন আবি®কৃত হয়েছে, তারা আগুন দিয়ে নিজেদের কাজ করে আর বাংলাদেশে এখনো সূর্যের তাপে সব কিছু সেদ্ধ করা হয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কি ভারত থেকে আগুন ধরানো শিখবো না? নাকি উপনিবেশবাদবিরোধিতার কথা বলে সূর্যের তাপেই কাজ করবো?

আজফার হোসেন
আমি তো প্রথম থেকেই বলছি যে, উপনিবেশবাদবিরোধিতা মানে বিচ্ছিন্নতা না। উপনিবেশবাদবিরোধিতা মানে না জেনে, না বুঝে বর্জন না। হ্যাঁ, এখনো তো শেক্সপীয়রের কথা আমরা বলি। তো, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা আমাদের কাজে শেক্সপীয়রকে কীভাবে ব্যবহার করছি। তাঁর টেম্পেস্ট নাটকের একটি চরিত্রের নাম প্রসপেরো, আরেকটি চরিত্রের নাম ক্যালিবান। ক্যালিবান হচ্ছে একজন ক্রীতদাস। তার ভূমি, দেহ, ভাষা, শ্রম সবকিছু প্রসপেরোর দখলে। প্রসপেরো ক্যালিবানকে ভাষা শেখায়, ইংরেজি ভাষা। তো, প্রতিবাদের এক পর্যায়ে ক্যালিবান চিৎকার দিয়ে বলে- হ্যাঁ, তোমার কাছ থেকে আমি ইংরেজি ভাষা শিখেছি এবং এখন তোমাকে আমি ইংরেজি ভাষায় বলতে পারবো- হারামজাদা এবং শুয়োরের বাচ্চা। তাহলে দেখুন শেক্সপীয়রকে ব্যবহার করেই আমরা শিখে নিতে পারি কীভাবে কোনো কিছুর পাল্টা ব্যবহার করতে হয়।

আজাদ আবুল কালাম
আমি ওর প্রসঙ্গে একটু বলি যে- আপনি বললেন আগুন আবিষ্কারের কথা। একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে এই যে আবিষ্কার, বিজ্ঞান এটা কিন্তু কারো বাবার সম্পত্তি না। রেডিও আবিষ্কার হয়েছে এই আমাদের কাছের জায়গা থেকে। যখনই কিছু আবিষ্কার হয় সেটার অংশীদার সবাই হয়ে যায়। আরেকটা ব্যাপার হলো বিজ্ঞানের, আবিষ্কারের কিন্তু একটা ধারাবাহিকতা আছে। কেউ একজন হঠাৎ করে, আকাশ থেকে পড়ে, একজন শাদা মানুষ কিছু আবিষ্কার করে না। এখন গ্লোবালি যদি চিন্তা করি, বৈশ্বিকভাবে যদি চিন্তা করি, এই ধারাবাহিকতার প্রত্যেকটার অংশ কিন্তু আমরাও। সেখানে কিন্তু আমাদেরও একটা অধিকার আছে। এটা ওদের কাছ থেকে ধার করা না।

আজফার হোসেন
বিষয়টির সাথে আমি একটু যুক্ত করি। বৈশ্বিক এবং স্থানিক এই দুই পরিসরকেই সম্পর্কিত করা খুব জরুরি। সেই কারণেই আমি বারবার জোর দিচ্ছি, উপনিবেশবাদবিরোধিতার স্বার্থে আমাদেরকে বিশ্বেও প্রবেশ করতে হবে। এবং বিশ্ব বলতে আমরা কেবল ইউরোপ আর আমেরিকাকে বোঝাবো না, বোঝাবো এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকাকেও। কেন না? সেখানে আমরা সংহতি নির্মাণ করতে পারি। আর বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতা বলতে হলে বুঝতে হবে যে, বিজ্ঞান কিন্তু নিরীহ না, নিরপেক্ষ না। কিন্তু ধরতে হবে বিজ্ঞানকে কে কীভাবে ব্যবহার  করছে সেই বিষয়টি। যে কথাটি আজাদ আবুল কালাম বললেন, যথার্থ বলেছেন যে, বিজ্ঞান কোনো আকাশ থেকে পড়া জিনিস না; এই বিজ্ঞান তৈরির পেছনে আমাদেরও অবদান আছে। যে মহাকাব্যের কথা বলা হয়, সেই মহাকাব্য তৈরির পেছনে আমাদেরও অবদান আছে এবং সেই কথাটার জন্যই আমি শুরুতেই ঐতিহাসিকতার প্রসঙ্গ এনেছিলাম। ইতিহাসের ভেতরে ক্রিয়াশীল বিভিন্ন লব্ধি খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে। আমরা যেগুলোকে শেক্সপীয়রের মৌলিক নাটক বলছি, সেগুলো কতটা মৌলিক? আরব জগতের উপস্থিতি ছাড়া রেনেসাঁসের অনেক জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রসরমানতা হতো না। আসলে কি প্লেটো এবং এ্যারিস্টটল, যাদেরকে দিয়ে বিশ্ব দর্শনের শুরুটা দেখাতে চায়, একটু পেছনে গেলে যদি পিথাগোরেসর কথা বলি- এর পরে সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিস্টটল এদের ডিসকোর্সের ওপর প্রচুর প্রভাব আছে এশিয়া এবং আফ্রিকার ডিসকোর্সের। সুতরাং ঐতিহাসিকতা নিজেই একটা হাতিয়ার যাকে আমরা এই ২০০৮ সালে এসে ব্যবহার করতে পারি উপনিবেশবাদবিরোধী কাজের স্বার্থেই। আমাদের এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে। এটা হতে পারে নাট্য-সংস্কৃতির এজেন্ডা, এটা হতে পারে যেকোনো সৃজনশীল মানুষের জন্য। আরেকটা কথা বলি: এই সৃজনশীলতার উপর যে উপনিবেশের হাত আছে, সেটা বুঝতে হবে। সৃজনশীল কারা? প্রচলিত হয়ে গেছে যে, সৃজনশীল তারা যারা কবিতা লেখে, নাটক লেখে বা গল্প লেখে। কেন এর বাইরে কি সৃজনশীলতা নাই? যে ব্যাক স্টেজে কাজ করে, যে ক্যামেরার পেছনে থাকে সে সৃজনশীল না? যে দর্শক নাটক দেখে, যে দর্শক একটা চিত্রকলা দেখে, সে সৃজনশীল না? সুতরাং সৃজনশীলতাও কারো বাপ-দাদার সম্পত্তি না; সৃজনশীলতা জনগণেরই। একজন মানুষ বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সৃজনশীল হতে পারে। একজন কৃষকের ভেতর, ব্যাংকের ক্লার্ক-এর ভেতর কি সৃজনশীলতা কাজ করতে পারে না? আমরা ঔপনিবেশিক মানসিকতায় গালি দিই, কী বলি? বলি যে, ওর চিন্তা-ভাবনা তো রিক্সাওয়ালার মতো, বা ও যা লেখে তাতো একজন ক্লার-এর লেখার চেয়েও খারাপ ইত্যাদি। এই যে সৃজনশীলতাকে একটা গোষ্ঠীবদ্ধ শ্রেণীর বাপ-দাদার সম্পত্তি হিসেবে দেখা এটা কিন্তু শ্রেণী বিভাজনকে উস্কে দেয়া কিংবা লৈঙ্গিক বৈষম্যকে উস্কে দেয়া ঔপনিবেশিক মনোগঠনের ফলে হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে প্রথমত আমাকে সনাক্ত করতে হবে যে এগুলো ঔপনিবেশিক মনোগঠনের ফল। এই সনাক্ত করার কাজটিই তো যথেষ্ট পরিমানে হয় নি। তারপর তো বের হওয়ার প্রশ্ন।

আজাদ আবুল কালাম
অনেকেই হাত উঠিয়ে অপেক্ষা করছেন, কিন্তু আমরা সময়ের দিক থেকে শেষ সময়ে আছি। সাড়ে ৪ টা থেকে আমাদের বাইরের পারফরমেন্স স্পেসগুলোতে আবার কাজ শুরু হবে। সুতরাং এই বৈঠক শেষ করতে হবে।

জাহিদ রিপন
[সদস্য- স্বপ্নদল]
আসলে আমাদের মগজে উপনিবেশ মিশে আছে, মিশে থাকে। এই যে ব্যানারের যে বিষয়টা নিয়ে আমরা এখানে আলোচনা করছি, আমাদেরকে কে জিজ্ঞাসা করেছে যে, এই বিষয় নিয়ে আমাদের আলোচনার কোনো দরকার আছে কিনা? আপনারা মনে করেছেন যে, এই বিষয়ে আলোচনা দরকার, আপনারা আমাদেরকে শোনাচ্ছেন। এবং আমাদেরকে অল্প অল্প করে বলার সুযোগ দিয়ে আমাদেরকে ধন্য করছেন যে, তোমাদেরকে সুযোগ দিলাম। এটাও কিন্তু ঔপনিবেশিক মনোভাবেরই প্রকাশ। যাক, এর থেকে বের হতে হয়তো আরও সময় লাগবে। স্যারের কাছে আমার প্রশ্ন হলো যে- ‘এ সময়ের নাটক’ বলতে আপনি পাণ্ডুলিপিকে বোঝাচ্ছেন না প্রডাকশনকে বোঝাচ্ছেন? হয়তো দুটোই। সেক্ষত্রে পাণ্ডুলিপি বোঝাতে আপনি নাটক ব্যবহার করলে এবং প্রোডাকশন বোঝাতে থিয়েটার বা নাট্য বললে আমাদের সুবিধা হতো। আরেকটি কথা হলো যেহেতু আমরা উপনিবেশের পর থেকে বর্তমান পর্যায়ে এসেছি, এই সময়ে কিন্তু একটা সাংস্কৃতিক ভাবালুতার মধ্যে থাকাটা আমি জরুরি মনে করি। যদি কিছু নির্মাণ করতে চাই। আমি এখানে ছোট্ট একটা প্রসঙ্গ টানবো, আশা করি কেউ কিছু মনে করবেন না। সেটা হলো কিছুদিন আগে আমাদের একটা বন্ধু নাট্যদলের মধ্যে কিছু বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল, ফলে সেই দলটি থেকে কেউ কেউ বের হয়ে নতুন নাট্যদল তৈরি করেছে। আজকে এখানে দুই দলের সদস্যরাই উপস্থিত। কিন্তু আগের দলের সদস্যরা সাধারাণ পোশাকে থাকলেও নতুন দলটি সবার থেকে আলাদা পোশাক পড়ে এসেছে, এসেছে কেন? তাদের শক্তি বোঝানোর জন্য, আসলে যে তাদের ক্ষমতা আছে সেটা বোঝানোর জন্য। আমি বলতে চাচ্ছি, এত বছরের উপনিবেশ থেকে বের হয়ে আজকে আমাদের সময় এসেছে আমাদের ঐতিহ্যের উপকরণগুলোকে নিয়ে আমাদের আধুনিকতা তৈরি করা, সম্মুখের স্বপ্ন তৈরি করা। অতএব আমি মনে করি এই মুহূর্তে ভাবালুতা তৈরি হওয়া খুবই জরুরি। আমরা বিশ্ব-সংস্কৃতির উপাদান নিয়ে আমাদের মধ্যে ধারণ করে আমাদের ঐতিহ্যকেই সমকালীন এবং আধুনিক করবো। ধন্যবাদ।

আজফার হোসেন
আপনার শেষ কথাটার সাথে আমি একমত। সেটা হলো, বিশ্ব-সংস্কৃতির উপাদান ব্যবহার করে আমরা আমাদের ঐতিহ্যকেই সমকালীন করবো। কথাটা তো ইতোমধ্যে বলাও হয়েছে। কিন্তু কথা হলো, ব্যবহার করতে গিয়ে ভাবালুতা যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, ব্যবহার করতে গিয়ে যদি আমরা সম্পর্কহীনতায় ভুগি, ব্যবহার করতে গিয়ে কোনো আবিষ্কারকে যদি না জেনেই বর্জন করতে থাকি, ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা যদি আমাদের পরিসীমা বৃদ্ধি করার পরিবর্তে সীমিত করতে থাকি, ব্যবহার করতে গিয়ে যদি নিজেদের মধ্যে একটা উগ্র আত্মপন্থিতা তৈরি করি কিংবা ব্যবহার করতে গিয়ে যদি আমরা শ্রেণীগত বা লৈঙ্গিক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকি- তখন তো প্রশ্ন উঠবেই। ভাবালুতা কিন্তু কোনো নিরপেক্ষ বিষয় না; সুতরাং তাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবেই। কার ভাবালুতা? কী নিয়ে ভাবালুতা? অবশ্যই আমরা আমাদের ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করবো, যেমন এখানে উল্লেখ করা যায় সেলিম আল দীন-সহ আরও অনেকের কাজকে, আমি সাধুবাদ জানাই তাঁদের কাজকে, কিন্তু মনে রাখতে হবে সেটিই যথেষ্ট না। এধরনের কাজের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় যে, এক ধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয় এবং বিচ্ছিন্ন হওয়ার মনোভাবও তৈরি হয়। সেটা তো ক্ষতিকর।

এবার আমি যাই আপনার প্রথম কথাটিতে যে, আয়োজকরা একটা বিষয় চাপিয়ে দিয়েছে এবং আপনার মনে হয়েছে উপনিবেশী মনোগঠন থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে নি। ঠিকই ধরেছেন; এই যে আপনি বুঝতে পেরেছেন যে আমরা উপনিবেশের খপ্পরে আছি, সেটা বোঝানোর জন্যই এই আয়োজন করা হয়েছে। হুট করে সূত্রের আকারে কোনো সমাধান বের করার জন্য না। আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে যে, আমরা গর্তের মধ্যে পড়েছি, নাকি গর্তটাকে পৃথিবী ভাবছি। আরেকটা কথা হলো, আপনি ধরেই নিয়েছেন যে, আয়োজকরা এ বিষয় নিয়ে কাউকে বলে নি। সেটা সঠিক না-ও হতে পারে। ‘আপনাকে’ না বলা মানেই যে ‘আমাদেরকে’ না বলা, এ ধারণাতেও সমস্যা হয়তো আছে। ধন্যবাদ।

আজাদ আবুল কালাম
জাহিদ রিপনের একটা প্রসঙ্গ ধরে একটু বলতে চাই, একটা নতুন দল তাদের নতুন পোশাক পড়ে এসেছে, সেটা নিয়ে আপনার মন্তব্যটা একটু আপত্তিকর। কেননা আমার মনে হয়েছে, এই দলটি তাদের জন্মটাকে সেলিব্রেট করছে এবং আমাদের সাথে ভাগ করে নিতে এসেছে। এটা মোটেই তাদের শক্তি প্রদর্শন করার জন্য না। এছাড়াও বিনীতভাবেই বলছি, আপনার এই প্রসঙ্গটাই বড় বেশি অপ্রাসঙ্গিক ছিল। আমি এবার দর্শক শ্রোতাদের বলছি যে, আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে, আমরা অনেক হাত দেখছি, আপনারা কথা বলতে চাচ্ছেন, প্রশ্ন করতে চাচ্ছেন, কিন্তু সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে সবাইকে কথা বলতে দেয়া যাচ্ছে না। বিষয়টাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।

জনৈক
‘মগজে উপনিবেশ’ না হয়ে যদি ‘উপনিবেশের মগজে’ আমাদের আছর করতে হয়, তাহলে এটার রূপটা কেমন হবে এবং তা কতটা আরামদায়ক হবে?

আজফার হোসেন
ওটা যাদের মগজে পড়বে তাদের জন্য মোটেই আরামদায়ক হবে না। যারা এতদিন অন্য মগজকে শাসন করার চেষ্টা করছিল, তাদের জন্য দারুণ যন্ত্রনাদায়ক হবে।

জনৈক
মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক- এ ব্যাপারে কিছু কথা শুনলাম। এবার শেষের দিকে আছি, আমি স্যারের কাছে জানতে চাচ্ছি বর্তমানে এই বিষয়টাকে মাথায় রেখে আমাদের নাটকের রূপরেখা কী হওয়া উচিত?

আজফার হোসেন
রূপরেখা দেয়াটা কিন্তু কেবল একটা নির্দিষ্ট মুহূর্তের কাজ না। আর রূপরেখা তো বেরুবে একেকটা নাট্যদলের নিজস্ব স্ট্রাগলের ভেতর থেকে। এখানে অনেক আলোচনা হলো। এই আলোচনাকে মাথায় রেখে এবং তাকে সম্প্রসারিত বা প্রশ্নবিদ্ধ করে কোনো রূপরেখা বেরিয়ে আসতে পারে। যেমন আমার জন্য রূপরেখা কী হতে পারে সেটা আমি বলতে পারি। আমি কী করে উপনিবেশবাদবিরোধী কাজ করবো? আমি যেখানেই উপনিবেশবাদী কিছু দেখি, সর্ব প্রথম আমি সেটাকে সনাক্ত করতে চাই। আমি যে নিজেই উপনিবেশবাদের খপ্পরে পড়ি, সেটাকেও আমি স্বীকার করতে চাই। কারণ আমি জানি যে, এই খপ্পরটাকে সনাক্ত করতে না পারলে এই খপ্পর থেকে বের হওয়া সম্ভব না। আরেকটা হলো, আমি যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই, সেখানে আমি যদি উপনিবেশবাদী সংস্কৃতির অনুশীলন দেখি সেগুলোকে সনাক্ত করি। আমি যেহেতু লিখি- আমার লেখায় আমি উপনিবেশবাদকে চ্যালেঞ্জ করি। কোনো কবিতায়, উপন্যাসে যদি উপনিবেশবাদী অভিক্ষেপ দেখি, তখন সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করি। সুতরাং বিভিন্ন অনুশীলনে এই উপনিবেশবাদবিরোধিতা হতে পারে। মনে রাখতে হবে ‘বিভিন্ন অনুশীলনে’ই আমরা উপনিবেশবাদবিরোধিতা দেখতে চাই। আরেকটি বড় জায়গা থেকে লড়াইটা হতে পারে। সেটা হলো- একটা সংহতি নির্মাণের ভেতর দিয়ে। একজন প্রশ্ন করেছেন, আমরা বাইরে পৌঁছাবো কীভাবে? একারণেই আমি উল্লেখ করেছি, আবারও করছি- আমাদের দরকার একটা ত্রিমহাদেশীয় সংহতি নির্মাণ করা; ত্রিমহাদেশীয় নাট্য-সংহতি তৈরি করা। সংহতি মানে সম্পর্কিত হওয়া। আর এই সম্পর্কিত হওয়া মানে কেবল তাদেরটা আমরা অনুবাদ করবো তা না। আমাদেরটাও তাদের কাছে অনুবাদিত হতে হবে। এবাবেই লেনদেনকে অব্যাহত রাখা যায় ওই উপনিবেশবাদবিরোধিতার স্বার্থেই।  

জনৈক
ত্রিমাহদেশীয় বলছেন এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকাকে। তাহলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ তধা পশ্চিমকে বাদ দিয়ে?

আজফার হোসেন
এটা তো রাজনৈতিক প্রশ্ন। আমি এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকা বলেছি একারণে যে, এরা সরাসরি উপনিবেশের দ্বারা আক্রান্ত ছিল শত শত বছর। আর পূর্ব কেন বলছি, পশ্চিম কেন বলছি, সেটা বোঝানোর জন্য প্রথমেই বেশ কিছু সময় নিয়েছি। কিছু বোঝাতে হলে আমাদের কোনো না কোনো বর্গ ব্যবহার করতে হয় এবং আমরা আমাদের স্বার্থে বা প্রয়োজনে বা রাজনৈতিক কারণে, কৌশলগত কারণে সেই বর্গের পাল্টা ব্যবহার করতে চাই। এখানে ত্রিমহাদেশীয় বলতে এদের মধ্যে একটা ঐক্যের কথা বলছি যারা সরসরি ইউরোপসহ বিভিন্ন ধরনের উপনিবেশবাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল এবং তাদের উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আছে। আবারও বলছি, পাশ্চাত্য বলতে যা শিখেছি সেটাতো একটা বর্গ যেটা ওরাই তৈরি করেছে। সেকারণেই তার পাল্টা ব্যবহারের সময় তাকে বাদ দিচ্ছি। কিন্তু পাশ্চাত্যের ভেতরেই উপনিবেশবাদবিরোধী লড়াইয়ের সাথে সংহতি হতে পারে না, তা বলছি না। পাশ্চাত্যকে রূপক হিসেবেও ব্যবহার করেছি। অর্থাৎ আধিপত্যবাদী অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের নাম দিয়েছি ‘পাশ্চাত্য’; এর চেয়ে বেশি কিছু না।

জনৈক
ঐতিহাসিকভাবে আপনার কী মনে, আমাদের কি সুযোগ আছে এই উপনিবেশবাদবিরোধী অবস্থানকে সফল করা?

আজফার হোসেন
যথেষ্ট সুযোগ আছে। আমরা কিন্তু ইতিহাসের কাছে বন্দী হয়ে নেই। এই জন্য ঐতিহাসকতার প্রশ্ন ওঠে- ইতিহাস আমাদের উপর এমন কোনো প্রভাব ফেলে না যে, আমরা যন্ত্র হয়ে বসে থাকবো। আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উপনিবেশবাদবিরোধী হয়ে উঠতে পারি। তার জন্য, আমি আগেই বলেছি, উপনিবেশবাদবিরোধী অনুশীলনকে আমাদের অভ্যাসের অন্তর্গত করতে হবে। এই যে এখানে বসে উপনিবেশবাদবিরোধী আলোচনা করলাম, এত এত প্রশ্ন উঠলো সেটার প্রয়োজন আছে। তবে এটাই যথেষ্ট না, এই চর্চাটা অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এই অভ্যাস তৈরির ক্ষেত্র হিসেবে একটা জাতীয় নাট্য-সংস্কৃতি নির্মাণ করতে পারি; আন্তর্জাতিকভাবে ত্রিমহাদেশীয় নাট্য-সংহতিও নির্মাণ করতে পারি ইত্যাদি। এগুলোই হলো সুযোগ।

আজাদ আবুল কালাম
এবার শেষ করতেই হয়। শেষের আগে দুচারটা কথা বলি। আমরা যে ঔপনিবেশিক মস্তিষ্কের কথা বলছিলাম, সেটা আসলে হঠাৎ করেই আসে নি। আমি একটা নাটকের কাজ করেছিলাম- বাবরনামা, বাবরের অটোবায়োগ্রাফি নিয়ে, তাঁর নিজের হাতের লেখা এবং সম্ভবত মুসলিম লিটারেচারের মধ্যে এটা হচ্ছে প্রথম অটোবায়োগ্রাফি। ওখানে আমি দেখিয়েছিলাম তাঁর জার্নিটা। ওনার জন্মস্থান থেকে কীভাবে কীভাবে দিল্লি পর্যন্ত আসলেন। এই আসার মধ্যে ইউরোপ আছে, পারস্য আছে, আফগানিস্তান আছে। এই আসার পথে ওনারা অনেক কিছু শিখেছিলেন, অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন। পোশাক থেকে শুরু করে খাদ্যাভ্যাস অনেক কিছু গ্রহণ করেছিলেন আবার অনেক কিছু বর্জনও করেছিলেন। বর্জন করেছিলেন সে-সব আচার বা খাদ্যাভ্যাস যা তারা বহু যুগ ধরে করে এসেছিলেন। এই বর্জন করতে তারা কিন্তু বাধ্য হয়েছিলেন। পরে যখন দিল্লির মসনদে আসেন, তখন তারা তাদের এই অধিত বিদ্যা, অভ্যাস বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দেন। এটাও কিন্তু একটা উপনিবেশই বলতে হবে। মুগলরা তো নিশ্চয়ই উপনিবেশ ছিল। কিন্তু এ সময়ে আমরা যখন উপনিবেশের কথা বলি তখন সাধারণত বা মূলত ইউরোপীয় উপনিবেশের কথাই বলি। দু’শ বছরের মস্তিষ্ক গঠনই আমাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের আলোচনায় এ সবকিছুই উঠে এসেছে। আজফার হোসেনকে ধন্যবাদ এই মূল্যবান বিষয়ে আলোকপাত করার জন্য।

আজফার হোসেন
আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি এমন একটা প্রাণবন্ত ফোরামে আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেয়ার জন্য। আপনাদের সবাইকে, আয়োজদেরকে আমার শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

আজাদ আবুল কালাম
দর্শককে ধন্যবাদ স্বতঃফূর্তভাবে অংশ নেয়ার জন্য। আমাদের কিছু অনুষ্ঠান বাইরে হবে আর কিছু অনুষ্ঠান এই মঞ্চেই হবে। সকাল থেকে যে নাট্যদলগুলো তাদের কাজ প্রদর্শন করছিল সেগুলো আবারও এখন হবে। যারা সকালে আসেন নি, এখন এসেছেন, তাদের সুযোগ রইলো সেগুলো দেখার এবং আমরা আমন্ত্রণ জানাই সেগুলো দেখার জন্য। থিয়েটারওয়ালার এই আয়োজনে আয়োজকদের পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে আবারও ধন্যবাদ জানাই প্রাণবন্ত উপস্থিতির জন্য।