Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : কুড়ি বছরের নাট্যরঙ্গ- একটি চকিত পরিভ্রমণ

Written by শুভাশিস সিনহা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

Theatre is a weapon, for that reason it must be fought for.
-Auggusto Boal

হ্যাঁ, বাংলাদেশের নাট্যকর্মীদের কাছে থিয়েটার অগাস্টো বোয়াল কথিত রাজনৈতিক অর্থসূচক হাতিয়ার না হতে পারে, কিন্তু এক অর্থে তা হাতিয়ারই, যা তাদের শৈল্পিক মগ্নতার গুহার কপাট কিংবা ক্ষ্যাপাটেপনার আগল খুলে দৌড়ানোর সমস্ত দরোজা এখনো খুলে দিতে পারে।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটারে কী কী ঘটেছে বা পরিবর্তন এসেছে, কী নতুন কাজ হলো সেসবের আগের কথা, এই ২০ বছরে একটা থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা এলো, যেটি তার ভাবনায়, আইডিয়ায়, আধুনিকতায় একটা নতুন পথ তৈরি করে দিল। তার নাম ‘থিয়েটারওয়ালা’। হাসান শাহরিয়ার যার সম্পাদক।

বাংলাদেশে এম্নিতেও থিয়েটারবিষয়ক পত্রিকা বা কাগজ হাতেগোনা। এর মধ্যে রামেন্দু মজুমদার সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ পত্রিকাটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো এবং নিয়মিত। বাকি অনেক পত্রিকাই কয়েকটি সংখ্যার পর বন্ধ হয়ে গেছে। মনে করা যায় সেলিম রেজা সেন্টু সম্পাদিত ‘দুই বাংলার থিয়েটার’, ওয়াহিদুল ইসলাম সম্পাদিত ‘মঞ্চকথা’, কিংবা রোকেয়া প্রাচী সম্পাদিত ‘নটনন্দন’-এর কথা। কিংবা, এক্ষণে সবেগে যাত্রা শুরু করেছে পাভেল রহমান সম্পাদিত ‘ক্ষ্যাপা’ ও রাজশাহী থেকে রহমান রাজু সম্পাদিত ‘আনর্ত’ পত্রিকাটিও। অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ থেকে বার্ষিক/ষান্মাসিকভিত্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে থিয়েটারবিষয়ক জার্নাল ‘থিয়েটার স্টাডিজ’।

‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকাটি তার লেখা কিংবা বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে একটা স্বতন্ত্র পথ নিয়েছে বলা যায়, যেখানে সমকালের কিংবা তারুণ্যের স্পর্ধিত শিল্প-স্পন্দনকে ধরার চেষ্টা আছে। পত্রিকাটি এখন মুদ্রণযন্ত্রের দায় ছেড়ে ভার্চুয়াল জগতে প্রকাশের পথ নিয়েছে। সব মিলিয়ে তার পথ চলার ২০ বছর পূর্ণ হল। এই মাহেন্দ্র তিথিতে আমরা নাট্যবিষয়ক একটি পত্রিকার কর্মযাপনকালে নাট্যেরই কায়কারবারকে চকিতে দেখে নেবার চেষ্টা করব। বাংলাদেশে গতিশীল একটি শিল্পমাধ্যমের বিশ বছরের চুলচেরা খতিয়ান দুরূহ একটি কাজ, ঢাকা থেকে দূরে থাকি প্রায় ১২ বছর বা এক যুগ ধরে, সেক্ষেত্রে সব নাটক দেখার সুযোগ ঘটে না, কেবল একজন নাট্যকর্মী, নাট্যতৎপর এবং উৎসাহী দর্শক হিসেবে আমার সামান্য পর্যবেক্ষণে কয়েকটি নাটক ধরা পড়বে, বাদ পড়বে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য অনেক কাজ। ব্যক্তির স্থানিক এবং বহবিধ সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়ে বিষয়টাকে দেখলে একটা সহজ সমাধান হতে পারে।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক যেমন অনেক উত্থান-পতন আছে, নানান নতুন শক্তির আবির্ভাাব ঘটেছে, বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া যেমন এসে লেগেছে, তেমনি কর্পোরেট লেভেলে নাগরিক মানুষের সম্পৃক্ততাও বেড়েছে। হাতে এসেছে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট আরও সহজলভ্য হয়েছে, নানান ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। শিল্পসাহিত্যের সাথে মানুষের সম্পর্কও বলতে গেলে খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক চুজি হয়েছে। তার হাতে অবসর যাপনের ডিভাইসের অভাব নেই। সেসবের ভেতর থিয়েটার তার নিজের জায়গা করে নেবার জন্য অবশ্যই একটা লড়াইয়ের মুখে তো পড়েছেই।

আমাদের মতো দেশে থিয়েটার বস্তুগত অর্থে একদমই অনুৎপাদনশীল খাত। কেবল প্রাণের তাগিদে, ভালোবাসার জোরে, নেশায়-আবেগে সমমাত্রিক মিলনায়তনে দর্শকদের সাথে একাত্ম হবার আর গৃহীত হবার আনন্দেই থিয়েটার চলছে এতকাল। এমন অবস্থায় নতুন আর্থসামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জন্মানো বাস্তবতায় তার অবশ্যই মুখ থুবড়ে পড়ার কথা। সংকট ও সমস্যা সত্ত্বেও আশার কথা বাংলাদেশে তা ঘটে নাই।
 
আমার এ লেখাটিকে কোনো গবেষণাকর্ম বা ক্রনোলজিকালি জাস্টিফাইড রচনা হিসেবে না দেখে একজন পরিব্রাজকের চোখে দেখা নাগরিক নাট্যবাংলার রূপ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তো ২০ বছরে নানান ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও মোটা দাগে প্রযোজিত নাট্যগুলোকে আমরা এভাবে ভাগ করে ফেলতে পারি: প্রথাগত বা কনভেনশনাল থিয়েটার, নিরীক্ষাধর্মী থিয়েটার, বিদেশি রচনা থেকে নাটক বা হুবহু বিদেশি নাটকের মঞ্চায়ন, বক্তব্যধর্মী নাট্য, শিল্প-উচ্চাকাঙ্ক্ষী নাট্য।

কোনো নাটককে এসব ধারার সাথে বিশেষায়িত না করে আলোচনাটি চালিয়ে নেয়া হবে, সচেতন পাঠক বুঝে নেবেন কোন নাটকটি উপর্যুক্ত কোন ধারার সাথে অন্বিত থাকে, তাতে আলোচকের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়টি কমে যায়।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটারে সবচেয়ে বেশি নিরীক্ষা হয়েছে বলা যায়। এসব নিরীক্ষা হয়েছে তিন ধারায়, একাডেমিক থিয়েটারে বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থিয়েটার ডিপার্টমেন্টগুলোতে, রেপাটরি থিয়েটারে এবং গ্রুপ থিয়েটারে।
 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে সৈয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশনা দিয়েছিলেন ‘বেহুলার ভাসান’। রচনাটির নবনাট্যায়ন করেছিলেন ‘বিপ্লব বালা’।
 
বাংলাদেশে আমরা যেটাকে নিও-রুট থিয়েটার বলতে পারি, তার একটা সুচারু পরীক্ষা-নিরীক্ষা মোটামুটি এ প্রযোজনায় করা হয়েছিল। বিষয়ের দিক দিয়ে এটি ছিল পুরাণকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস, নারীকে পুরাণের নানান খোলসের ভেতর থেকে বের করে এনে তার ঐতিহাসিক অসহায়ত্বকে বোঝানোর চেষ্টা। কিন্তু বিষয়কে ছাপিয়েও আধুনিক নাগরিক নাট্যমঞ্চে এ প্রযোজনা জন্ম দিয়েছিল আঙ্গিকগত ঐতিহ্যিক বিনির্মাণের।
 
ন্যারেটিভ ফর্ম বা কথনে-গীতে গল্প বলা বা স্টোরি টেলিংয়ের যে ধারা বাংলার লোকালয়ে এখনো বেগবান, যেখানে সুর-ছন্দ-গতি-অভিনয়-তাল-বাদ্য অপরিহার্য, তাকে নগরের পরিসরে তার প্রকাশভঙ্গিমার সমস্ত শক্তি ও সৌন্দর্য নিয়ে হাজির করেছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ।

এর পরবর্তীকালে এ ধারায় অনেক নাট্যমঞ্চায়ন হয়েছে,  লোকনাট্যদলের ‘সোনাই মাধব’, নাট্যধারার ‘আয়না বিবির পালা’, সাম্প্রতিক সায়িক সিদ্দিকীর ‘ভানুসুন্দরীর পালা’ কিংবা ‘রূপচান সুন্দরীর পালা’-র অন্তর্গত প্রেরণা নিশ্চয় বেহুলার ভাসান, যদিও দু’টো প্রযেজনার মধ্যে পরিবেশনার দর্শনগত বিস্তর ফারাক আছে। মণিপুরি থিয়েটারের ‘ইঙাল আধার পালা’-ও খানিকটা এরকম হলেও, সেখানে পদাবলী কীর্তনের ধারাকেই গায়েন বা সূত্রধারের কথনভঙ্গিমা হিসেবে মূলত গ্রহণ করা হয়েছে, যার সাথে যুক্ত হয়েছে মণিপুরি নটপালার গায়েনের ভঙ্গিমা।

মূলধারার থিয়েটারে আলোচিত একটি প্রযোজনা দেশ নাটক-এর ‘নিত্যপুরাণ’। পুরাণকে ব্রাত্যজন বা সদাবঞ্চিত মানুষের জায়গা থেকে প্রশ্ন করার জন্য এই নাটক এখনো লোকমুখে প্রিয়। দিলীপ চক্রবর্তীর অভিনয় ছিল এ নাটকের প্রাণ। সাথে দ্রৌপদী হিসেবে নাজনীন চুমকিও দারুণ। শক্তিশালী রচনা, পরিমিত কোরিওগ্রাফি, যুৎসই আবহসংগীত, বাচিক অভিনয়ের অনন্যতা সব মিলিয়ে নাটকটি দর্শকমনে আলোড়ন তুলতে পেরেছিল। ‘নিত্যপুরাণ’ আমাদের দেখিয়েছে কীভাবে টেক্সট বা রচনার প্রতি আনুগত্য রেখে তার প্রতিপাঠ তৈরি করা যায়, এবং স্ক্রিপ্টের সুচারু ড্রামাটাইজেশন মঞ্চে সুন্দর রূপ নিতে পারে।

‘সময়’ নাট্যদলের ‘শেষ সংলাপ’ রাজতান্ত্রিক দুনিয়ার ষড়যন্ত্রের কিসসা। অভিনয়ের পরিশীলিত ব্যবহারের কারণে সাদামাটা প্রযোজনা হলেও দর্শককে মিলনায়তনে ধরে রাখতে পেরেছে প্রযোজনাটি।

‘উদীচী’র ‘চিলেকোঠাই সেপাই’, উপন্যাসের নট্যরূপায়ণের একটি সার্থক উদাহরণ। এই প্রযোজনার আগে উপন্যাসের নাট্যায়ন খুব কমই হয়েছে বলা যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এ উপন্যাসে রাজনীতি, সমাজিক যৌন-অবদমন, মানবিক পরাজয়ের বেদনা, মধ্যবিত্তের বিবমিষা অবসাদ সবকিছু ফুটে উঠেছে। মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে রতন সিদ্দিকী টেক্সট অনুগত থেকে চেয়েছেন উপন্যাসের বিষয়বস্তুকে ঠিক রেখে মঞ্চে নাট্যমুহূর্তাবলী রচনার।  

‘মহাকাল নাট্য সম্প্রদায়’ প্রযোজনা ‘শিখণ্ডী কথা’ একটি এথনোগ্রাফিক ফিকশন। হিজড়া নামে পরিচিত সম্প্রদায়টির জীবনের ডিটেইল গ্রাফ নাটকটির টেক্সটকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। অভিনয়ও ছিল সাবলীল।

‘সুবচন নাট্য সংসদ’ প্রযোজিত ‘মহাজনের নাও’ জীবনীভিত্তিক নাট্যপ্রযোজনার একটি উজ্জ্বল স্বাক্ষর। লোকগানের অসামান্য শিল্পী শাহ আব্দুল করিমের জীবনী নিয়েই নাটকটি রচিত। রচনা করেছেন শাকুর মজিদ। গীতবহুল এই প্রযোজনা অভিনেতৃদের ছন্দময় মঞ্চ-চারণা, গানের থিয়েট্রিক্যাল ব্যবহার, সুচারু কম্পোজিশন সবকিছু নিয়ে অনন্যতা পেয়েছে।

‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’ (সিএটি)-র নাটক মানেই এক একটি নতুন নাট্য-নিরীক্ষা। তার অনেকটাই কনটেম্পরারি ওয়েস্টার্ন থিয়েটারের দক্ষিণ এশীয় প্যারালাল উপস্থাপনা। ‘মেটামরফোসিস’ বা ‘অ্যাম্পিউটেশন’ সেরকমই প্রযোজনা। ‘অ্যাম্পিউটেশন’ নাটকে জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চকে পেছন দিকে দেয়াল পর্যন্ত বিস্তৃত করে মঞ্চের ক্যানভাস বিশালভাবে ব্যবহার করার একটা সৌদর্য পাওয়া গেল। মানবকি পৃথিবীর অমানবিক সন্ত্রাস নির্মমভাবে রূপায়িত হলো একটা ডিটাচমেন্ট নিয়ে।

‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী গল্প ‘প্রাগৈতিহাসিক’-কে মঞ্চে এনেছিল। প্রযোজনার মঞ্চসফলতা যা-ই হোক, বাংলা ভাষার সর্বকালের সেরা একটি গল্পের নাট্যরূপায়নের জন্য তারা ধন্যবাদ পেতে পারেন।  

বাংলাদেশের থিয়েটারে ‘প্রাচ্যনাট’-কে বলা যায় একটি উতল হাওয়ার দোলা। থিয়েটার ও ডিজাইন নিয়ে সর্বতোভাবে সময়োপযোগী ক্রিয়াকলাপ, প্রশিক্ষণ আর নিরন্তর কর্মীদেরকে থিয়েটারবিষয়ক কাজকর্মের সাথে সম্পৃক্ত রাখার মধ্য দিয়ে দলটি থিয়েটারকে সতেজ করে রাখে। প্রাচ্যনাট তাদের কর্মে-ভাবে তারুণ্যকে বুঝতে চেষ্টা করেছে, প্রয়াসী হয়েছে সময়ের ভাষাকে পাঠ করবার। সে কারণে তাদের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে দিন দিন। আজাদ আবুল কালামের রচনা ও নির্দেশনায় ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটকটি প্রাচ্যনাটের মেইনস্ট্রিম থিয়েটারের প্রথম কাজ বলা যায়। একটি সার্কাস দলের ভেতরকার হাসি-আনন্দ-বেদনা খুব সাবলীলভাবে মঞ্চে দেখতে পাওয়া যায়। এক ঝাঁক তরুণতর শিল্পী প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন সার্কাস দলের টীমমেট। হাসিখেলার মধ্য দিয়ে তারা এক সময় মুখোমুখি হয় ধর্মীয় গোঁড়ামির অবয়বে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার। তাদের ওপর আসে আক্রমণ। এ ধরনের কাজ আমরা দেখতে পাই হাবীব তানভীরের নাটকে, কতকটা মামুনর রশীদেও তা আছে। কিন্তু প্রাচ্যনাট অভিনেতাদের স্টেজ কানেকটিভিটি এবং কম্পোজিশনে একটা দারুণ গতি ছন্দ নিয়ে এসে নবতর মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছে। পরবর্তীকালে ‘এ ম্যান ফর অল সিজনস্’ নাটকে প্রাচ্যনাট পূর্ববর্তী প্রযোজনা থেকে একদমই ভিন্ন একটি টেক্সট দর্শককে উপহার দেয়। নাট্য-আঙ্গিকেও ছিল ভিন্নতা। ‘কইন্যা’ নাটকে লোকমানুষের মিথ অন্ধত্ব প্রেম সংস্কার সবকিছু একদমই স্থানিক গতিরঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। তৌফিকুল ইসলাম ইমন নির্দেশিত ‘কিনু কাহারের থেটার’ একটি থিয়েটারদলের ক্ষয়িষ্ণু অবস্থাকে রূপায়ণ করে। তবে ‘রাজা এবং অন্যান্য’ ছিল একটা সাহসী রবীন্দ্র-ফিউশন। রবীন্দ্রনাথের রাজা নাটকের সাথে সমকালের নানান ব্যাখ্যা ভঙ্গি প্রশ্ন যুক্ত হয়েছে নাটকটিতে। রবীন্দ্রসংগীতের পেশল ও গতিশীল মুদ্রায়ন ছিল মুগ্ধ করার মতো। অদৃশ্য রাজার অঙ্গুলি চালিত সাম্রাজ্যকে আমারা এমনকি কর্পোরেট দুনিয়ার নানান আগ্রাসনের সাথে মিল করে দেখতে পারি।  তরুণ নির্দেশক বাকার বকুলের ‘বনমানুষ’ ইউজিন ও নীলের হেয়ারি এপ থেকে নেয়া হলেও উপস্থাপনায় একটা সর্বজনীন রূপ দেবার প্রয়াস দেখা যায়। শ্রমদায়বদ্ধ মানুষের প্রেম-বেদনা-পরাজয়কে খুব শক্তিশালী দেহভাষা ছন্দ অর্কেস্ট্রেশন নিয়ে এ নাটকে বাজিয়ে তোলা হয়েছিল।

‘নাট্যকেন্দ্র’ বরাবরই বিদেশি নাটকের দেশীয় রূপান্তরকরণের ধারায় নাটক প্রযোজনা করে এলেও ‘আরজ চরিতামৃত’ তাদের একটা নাট্যিক ভিন্নতর অভিক্ষেপ। গ্রামীণ জনপদে চিন্তা আর জিজ্ঞাসার বুদ্ধিবৃত্তিক সাহস নিয়ে আরজ আলী মাতুব্বর গত শতকের এক বিস্ময়-জাগরুক মনীষী। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নন, কিন্তু প্রথা আর সংস্কারের বেড়াজাল ডিঙিয়ে চিন্তার স্বাধীনতায়, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পর্যন্ত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে একটা ভাবভূ-কম্পন এনেছিলেন মাতুব্বর। তার জীবনী ও ভাবনা-জগতের খানিকটা অংশ নিয়ে মাসুম রেজা লিখিত একটি পাণ্ডুলিপি নিয়ে নাটকটি প্রযোজিত। আবার রূপকথার মিথকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রূপক হিসেবে উপস্থাপন করে মঞ্চায়নের প্রয়াস নাট্যকেন্দ্রের ‘ডালিমকুমার’।

‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’-এর নাটক মানেই খানিকটা গীতধর্মী পরিবেশনা। মিউজিক্যাল থিয়েটরের বঙ্গীয় নাগরিক অভিপ্রকাশ এ দলটির উল্লেখযোগ্য নাট্যসূচক। গত ২০ বছরে বৈচিত্র্যপূর্ণ বিষয় ও আঙ্গিক নিয়ে বেশ ক’টি প্রযোজনা মঞ্চে এনেছে দলটি। লোকজ গল্প নিয়ে ‘আমিনা সুন্দরী’, দেশ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ‘সময়ের প্রয়োজনে’, আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূটচাল ও মানুষের অবদমনের কথা নিয়ে ‘মর্ষকাম’, রাবীন্দ্রিক প্রেমনির্ভর সাহিত্যের রূপায়ণে ‘শেষের কবিতা’, মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকট নিয়ে ‘না-মানুষি জমিন’। গুণগত উৎকর্ষসহ নানান বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক নাট্যপ্রযোজনা করে যাওয়া অবশ্যই বড় ব্যাপার, যা এই দলটি পেরেছে। পাশাপাশি এস এম সোলায়মানের নামে নাট্যপ্রণোদনা দিয়ে তরুণ নাট্যশিল্পীদেরকে উৎসাহিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এছাড়াও একই দিন থিয়েটারবিষযক একটি বক্তৃতার আয়োজন আর তার প্রকাশনা- সব মিলিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ আছে দলটিতে।

‘ঢাকা থিয়েটার’ গত ২০ বছরে মঞ্চে এনেছে ‘নিমজ্জন’, ‘ধাবমান’, ‘টেম্পেস্ট’, ‘পঞ্চনারী আখ্যান’, ‘ঊষা উৎসব’, ‘অমৃত উপাখ্যান’, ‘ইতি পত্রমিতা’সহ ছোট-বড় বেশ কয়েকটি প্রযোজনা। ‘নিমজ্জন’ দলটির ল্যান্ডমার্ক প্রযোজনা। কোলাজ ন্যারেটিভসকে মঞ্চে পয়েটিক আর আর্টিস্টিক সাজেশনে প্রকাশ ঘটানোর যে নতুন খেলা খেলেছেন নাসির উদ্দিন ইউসুফ, তা তার নাট্যযাত্রায় নতুন চিহ্ন খচিত করেছিল নিঃসন্দেহে। তেমনি ‘ধাবমান’-এ শিমূল ইউসুফ নির্দেশক হিসেবে ডেব্যু করেও গীত-নৃত্য-দেহবিন্যাসের পরিমিত কিন্তু বর্ণিল উপস্থাপনে দলগত প্রযোজনায় ভিন্ন স্বাদ দিতে পেরেছিলেন।

‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ মঞ্চে এনেছে ‘নামগোত্রহীন’ সহ একাধিক নতুন নাটক। ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ আর ‘গ্যালিলিও’-র নবনাট্যায়ন দলটিতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়েছে। অতি-জনপ্রিয় নাটক দু’টোকে আবার মঞ্চের সামনে আনতে পারা দর্শকের জন্যও ছিল আনন্দের। আবুল হায়াত, আলী যাকের, আসাদুজ্জামান নূরের মতো অভিনেতাদেরকে নতুন করে মঞ্চে দেখতে পাওয়া ঢাকার নাট্যজগতে আলোড়ন তোলার মতোই ব্যাপার হয়েছে।  

‘থিয়েটার’ (নাটক সরণি) ‘কোকিলারা’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ নাটকের নবরূপায়ণ করে। তবে থিয়েটার দলটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় তাদের নাট্যমঞ্চায়নের নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ। উৎসব বা নানামুখি আয়োজনের দিকে মন না দিয়ে নিয়মিত নাটক মঞ্চস্থ করে গেছে দলটি। পাশাপাশি রামেন্দু মজুমদারের সম্পাদনায় ‘থিয়েটার’ পত্রিকাটির প্রকাশ অব্যাহত ছিল। এছাড়া মুনীর চৌধুরী আর জাকারিয়া স্মৃতি পদক নাট্যাঙ্গনে আকর্ষণীয় আয়োজন। তবে থিয়েটারের যে প্রযোজনাটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে, তার নাম ‘মুক্তি’। ত্রপা মজুমদারের নির্দেশনায় নাটকটিতে সময়ের অস্থিরতায় অবিশ্বাসে একটি পরিবারের সংকটের রূপ চিত্রিত হয়েছে। সাবলীল অভিনয়ে, নিরাভরণ আয়োজনে, একবারেই সংলাপ আর অভিনয়ের নাটকও যে দর্শককে নতুন করে থিয়েটারের প্রগাঢ় আনন্দ দিতে পারে, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ ‘মুক্তি’।

‘আরণ্যক নাট্যদল’ বরাবরই নাট্যমঞ্চায়নের লক্ষ্যেই কাজ করে গেছে। এছাড়া দলের ভেতরে বাইরে প্রশিক্ষণের আয়োজন নিয়ে দলটি সবসময়ই সরব। মঞ্চনাটকের পাশাপাশি পথনাটক নিয়ে দলটি বেশ সক্রিয়। গত ২০ বছরে আরণ্যক মঞ্চে এনেছে ‘সংক্রান্তি’, ‘রাঢ়াঙ’, ‘ময়ূর সিংহাসন’, ‘এবং বিদ্যাসাগর’, ভঙ্গবঙ্গ, ‘দ্য জুবিলী হোটেল’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ ও পথনাটক। ‘রাঢ়াঙ’ আরণ্যকের একটি নাট্য-মাইলফলক। সাঁওতালদের লড়াই-সংগ্রামের কাহিনি নিয়ে মামুনুর রশীদ  রচিত ও নির্দেশিত এ নাটক এরেনা স্পেস ব্যবহার থেকে শুরু করে গীত-বাদ্য-ছন্দময় অভিনয়, বলিষ্ঠ বচন ও দৃঢ় বক্তব্যের জন্য সমাদৃত। আরণ্যক বরাবরের মতোই সমাজদায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নাটকের পাণ্ডুলিপি নির্বাচন করে। তাই বিদ্যাসাগরের মতো এক সমাজচিন্তকের জীবনী নিয়ে নাটক করেছে তারা, বঙ্গভঙ্গের বেদনা নিয়ে নাটক করেছে, ফের কালের স্বাক্ষী জুবিলী হোটেল নিয়েও নাটক মঞ্চে এনেছে। নাটকের প্রকরণগত গুরুত্ববহ নিরীক্ষা যা ‘রাঢ়াঙ’ বা ‘সংক্রান্তি’-তে দেখা গেছে, পরবর্তীকালে তা তেমন না ঘটলেও বিষয়বৈচিত্র্যে থিয়েটার-তৎপরতায় আরণ্যক অবশ্যই এখনো যথেষ্ট সক্রিয় সমুজ্জ্বল।

‘পালাকার’-এর ‘মানগুলা’ (আমিনুর রহমান মুকুল নির্দেশিত) এবং ‘ডাকঘর’ (শামীম সাগর নির্দেশিত) দু’টো উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। গোলাম শফিকের রচনায় ‘মানগুলা’-তে প্রাকৃতজীবনের স্বপ্ন-বঞ্চনার কথা ব্যাপক মঞ্চ-স্পেস-আয়োজনে, নতুন ব্লক-কম্পোজিশনে সাড়া জাগিয়েছে, অপর দিকে শামীম সাগরের ‘ডাকঘর’ সহজিয়া আনন্দে রবীন্দ্র-আইডিয়াকে দর্শকচিত্তে জাগরুক করে তোলার খেলা।  

‘স্বপ্নদল’-এর ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ একটি ভূ-রাজনৈতিক অভিশপ্ত ইতিহাসকে মঞ্চায়িত করেছে।  

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটার চর্চায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন রেপাটরি নাট্যদল। যদিও, যে অর্থে বিশ্বব্যাপী রেপাটরি থিয়েটারের প্রকাশ ও বিকাশ, পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে বাংলাদেশে তা নয়, তবু বিভিন্ন নাট্যদল থেকে অভিনয়শিল্পী বাছাই করে নাটক মঞ্চায়নের ধারাটি রেপাটরি ভাবানার একটি ফসল। এই ধারায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর ‘শূন্যন’ প্রযোজিত মোমেনা চৌধুরীর একক অভিনীত নাটক ‘লাল জমিন’। মান্নান হীরার রচনায় সুদীপ চক্রবতীর নির্দেশনায় ‘লাল জমিন’ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিপীড়িত নারীর যুদ্ধ-পরবর্তী করুণ-অবস্থা নিয়ে সুলিখিত একটি কাব্যিক পাণ্ডুলিপির মঞ্চায়ন। বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সহযোগিতায় নাটকটি দেশের প্রধান প্রধান শহরের মিলনায়তনে এবং আনাচে-কানাচে  নিয়মিত মঞ্চায়িত হচ্ছে। বিদেশের মাটিতেও মঞ্চায়িত হয়েছে ‘লাল জমিন’। ইতোমধ্যে ২০০টি প্রদর্শনী সম্পন্ন হয়েছে নাটকটির।

‘নাট্যম রেপার্টরি’-র ‘দমের মাদার’ একটি উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাট্য। সাধনা আহমেদের রচনায় আইরিন পারভীন লোপার নির্দেশনায় নাটকটি ধর্মীয় উগ্রবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, তবে শৈল্পিক শর্তকে আমলে নিয়েই।

‘থিয়েটারওয়ালা রেপাটরি’র ‘শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’ ছিল রেপাটরি নাট্যধারার একদম প্রথম দিকের প্রযোজনা। হাসান শাহরিয়ারের রচনায় ও আজাদ আবুল কালামের নির্দেশনায় নাটকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পুঁজিবাদী সভ্যতার অসুখ আর মুল্যবোধের অবক্ষয় নাটকটির উপজীব্য।

‘ম্যাড থেটারে’র ‘নদ্দিউ নতিম’ রেপাটরি নাট্যধারার আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। হুমায়ূন আহমেদের ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটিতে মধ্যবিত্ত এক যুবকের সময়-অভিযোজনের সংকট এবং একটি অটিস্টিক শিশুর মনোজগতের রহস্যকে নান্দনিক করে তুলে ধরা হয়েছে। ‘ওপেন স্পেস থিয়েটার’র ‘টুয়েলভ এংরি ম্যান’ নাটকটিও এ্যাকটিং ডিজাইন, স্পিচুয়াল-রিদম সব মিলিয়ে দর্শকদের কাছে অন্যতর আবেদন জাগাতে সক্ষম হয়েছে।

ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে ওঠা রেপাটরি নাট্যদলের পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমির প্রত্যক্ষ প্রযোজনাতেও একাধিক নাটক মঞ্চে এসেছে। উল্লেখযোগ্য ‘পুত্র’, ‘বাঁধ’, ‘বিদেহ’, ‘মুল্লুক’, ‘হ্যামলেট’ ইত্যাদি। শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় মোহাম্মদ জসিম উদ্দীনের নির্দেশনায় সেলিম আল দীনের লেখা ‘পুত্র’ নাটকটি অভিনয় ও অন্তর্গত নাট্যস্পর্শী দৃশ্য-বিন্যাসের জন্য দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।  

ঢাকার বাইরের নাট্যদল হলেও ঢাকায় প্রায় নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করেছে ‘মণিপুরি থিয়েটার’। মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) ভাষার পাশাপাশি তারা বাংলাতেও নাটক মঞ্চায়ন করেছে। এর মধ্যে ‘কহে বীরাঙ্গনা’ ছিল সর্বাধিক আলোচিত। একক অভিনয়ে শারীরিক-বাচিক-অভিব্যক্তিমূলক একটি বহুমাত্রিক পূর্ণাঙ্গ প্রকরণ এ নাটকে দেখাতে সক্ষম হয়েছেন জ্যোতি সিনহা, যাকে টোটাল এ্যাকটিং বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও দলটির ‘দেবতার গ্রাস’, ‘ইঙাল আধার পালা’, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, ‘লেইমা’ প্রভৃতি নাটক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। দলটি গ্রামে নিজেদের থিয়েটার স্টুডিও গড়ে তুলেছে। গ্রাম পর্যায়ে এটিই একমাত্র থিয়েটার-স্টুডিও।

এছাড়াও ঢাকা ও নানান বিভাগীয় শহরে নানান সময়ে নাটক মঞ্চায়ন করেছে হবিগঞ্জের ‘জীবনসংকেত’। সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় রুমা মোদকের রচনায় দলটির ‘জ্যোতিসংহিতা’ একটা বড় টীমওয়ার্ক আর নানাবিধ অভিনয়ের যুৎসই সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, পেয়েছে দর্শক-সমালোচকের বিপুল প্রশংসা। জীবনসংকেতের ‘বিভাজন’ ও ‘স্ত্রীর পত্র’ নাটক দুটিও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। শাহমান মৈশান রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশিত বরিশালের ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’-এর ‘ফণা’ নাটকটিও ঢাকার মঞ্চে একাধিকবার প্রদর্শিত হয়েছে।   

২০ বছরে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় ছিল একক অভিনীত নাটকের ছড়াছড়ি। ‘কোকিলারা’র পর তেমন আর একক অভিনীত নাটক হয় নি। পরবর্তীকালে ঢাকা থিয়েটারের ‘বিনোদিনী’ (শিমূল ইউসুফ অভিনীত), নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ (লাকী ইনাম অভিনীত) প্রযোজনা আসার পর মঞ্চে একক অভিনীত নাটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ‘সাধনা’ প্রযোজিত, নাজনিন চুমকি অভিনীত ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’, জ্যোতি সিনহা অভিনীত, মণিপুরি থিয়েটারের ‘কহে বীরাঙ্গনা’র পর একে একে মঞ্চে আসে মোমেনা চৌধুরী অভিনীত ‘লাল জমিন’, রোজী সিদ্দিকী অভিনীত ‘পঞ্চনারী আখ্যান’, সামিউন জাহান দোলা অভিনীত ‘নভেরা’, শামসি সায়েকা অভিনীত ‘গহনযাত্রা’সহ বেশ কয়েকটি নাটক। নাটকগুলো দর্শকপ্রিয়তাও পায়।

দুনিয়াজোড়া এখন একটা মিনিমালিস্ট এপ্রোচ লক্ষ করা যায় থিয়েটারে। এক থেকে তিনজন অভিনেতৃ, ব্যাপ্তিকাল ১ ঘন্টা, বহনযোগ্য পরিমিত সেট, অল্প আয়োজনের লাইট নিয়ে নাটক নির্মিত হয় । বাংলাদেশেও ‘শাইলক এ্যান্ড সিকোফ্যান্টস’, ‘জবর আজব ভালোবাসা’, ‘অতঃপর মাধো’, ‘ওপেন কাপল’, ‘মুক্তি’, ‘জেরা’ ইত্যাদি নাটকে মিনিমালিস্ট এপ্রোচটা লক্ষ করা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বা একাডেমিক থিয়েটার চর্চাটি ২০ বছরে বেশ শক্তিশালী ছিল। বিশেষত ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলাবিষয়ক বিভাগ বেশ তৎপর ছিল নাট্য প্রযোজনায়। পরীক্ষার অংশ হিসেবে প্রযোজিত হলেও পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি নাটক মূলধারার থিয়েটারে প্রদর্শিত হয়েছে, একাধিকবার।

এর মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে ইউসুফ হাসান অর্ক নির্দেশিত ‘কবি’, ‘জেরা’, ‘দেবদাস’ প্রভৃতি নাটক বিভাগীয় সীমার বাইরে প্রদর্শিত ও নন্দিত হয়েছে। রেজা আরিফের নির্দেশনায় ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ ছিল উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। যেটি পরবর্তীকালে ‘আরশিনগর’ দলের নিয়মিত নাট্যপ্রযোজনা হিসেবে এখনো চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ‘বেহুলার ভাসান’, ‘কমলারানীর সাগরদীঘি’ প্রভৃতি নাটক ডিপার্টমেন্টের বাইরেও মঞ্চাায়িত হয়েছে।

‘থিয়েট্রেক্স’ থেকে সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় ‘দক্ষিণা সুন্দরী’ কমনওয়েলথের এক উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। রেজা আরিফের নির্দেশনায় ‘আরশিনগর’ মঞ্চে আনে শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। একটি পরাবাস্তব ধাঁচের জটিল উপন্যাসের নাট্যায়ন কঠিন কাজ ছিল। রেজা আরিফ শরীর-হৃদয়ের একাত্ম গ্রন্থনে মঞ্চে যথার্থ দৃশ্যকাব্য রচনা করতে পেরেছেন। নাটকটি ভারতের মণিপুরেও আমন্ত্রিত হয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য উৎসবে।

এসব আয়োজনের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজনের কথা না বললেই নয়, সেটি হলো ‘থিয়েটারওয়ালা’র আয়োজনে তিনপ্রজন্মের তিন নির্দেশকের নাটক নিয়ে উৎসব। ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালাম ও শুভাশিস সিনহাকে নিয়ে উৎসবটির আয়োজন। নাটকের পাশাপাশি নির্দেশক-দর্শক মুখোমুখি পর্বও রাখা হয়েছিল। জাতীয় নাট্যশালার লবিতে ছিল গানের আয়োজন। কিন্তু পরবর্তীকালে এই আয়োজনটি আর করা হয় নি।

‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ ছিল নাট্যকর্মীদের প্রাণের আয়োজন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দলগুলো তাদের ওপেন পারফরমেন্স নিয়ে শিল্পকলা চত্বর মুখর করে তোলে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এই আয়োজনটি করে ‘থিয়েটারওয়ালা’ এবং ২০১৩ ও ২০১৫ সালে আয়োজন করে যথাক্রমে ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ ও ‘প্রাচ্যনাট’। এস এম সোলায়মানের মতো ক্ষ্যাপাটে নাট্যজনের স্মরণে এই ধরনের ক্ষ্যাপাটে আয়োজন যথার্থ বলা যায়।

‘প্রাঙ্গণেমোর’ দলটির নাট্যতৎপরতা, প্রদর্শনী, বাংলাদেশের শহরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চার ধারায় দৃষ্টান্তসূচক বলা যায়। নিয়মিত নতুন নাটক মঞ্চে নিয়ে আসা, বছর জুড়ে নাটক প্রদর্শন করা, ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরেই বেশি নাটক মঞ্চায়ন করা দলটির উল্লেখযোগ্য সাফল্য। শহরের নানান সমস্যার মধ্যে প্রচুর সদস্য নিয়ে ব্যাপক পরিসরে নাট্যমঞ্চায়ন প্রযোজনা গড়ে তোলা আনন্দের ব্যাপার বৈকি! দলটির ‘ঈর্ষা’, ‘আমি ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘লোকনায়ক’ দর্শকনন্দিত প্রযোজনা।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য আবির্ভাব ‘বটতলা’। দলটি তাদের নাটক নির্বাচন থেকে শুরু করে নাটক নিয়ে নানামুখি আয়োজন, মানসম্মত বিদেশি নাটক নিয়ে উৎসব, সেমিনার, সম্মাননা সবকিছুতেই খুব সরব। এবং তা যথেষ্ট কার্যকর। এ দলের ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকটি বিষয়বস্তু, সাহসী বক্তব্য, সব কিছু নিয়ে আলোচিত হয়েছে। অভিনয় ও ডিজাইনের দিক দিয়েও বেশ আলোচিত নাটকটি।  

এর মধ্যে গত এক দশকে একথাও প্রায়শই আলোচনা কী বিতর্ক তুলেছে: আমাদের থিয়েটার ডিজাইনসর্বস্ব হয়ে পড়েছে কিনা। সেখানে থিয়েটারের কথিত ‘প্রাণভ্রোমরা’ অভিনয় মরে যাচ্ছে কিনা। গল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে কিনা। তবে এ-ও সত্য বহুবিধ ও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের থিয়েটারের যে চিত্রটি প্রকাশ পায় সেখানে বিপরীতমুখি নানান ধারার থিয়েটার দেখা যায়, এবং সবকিছুর মধ্য দিয়ে একটি ডাইমেনশনাল ও ডাইভারসিফাইড থিয়েটারের রূপ আমরা চিনে নিই, যা একটি দেশের যে-কোনো শিল্পমাধ্যমের জন্যই সঞ্জীবনী শর্ত।

নাট্যপ্রযোজনার পাশাপাশি পদক-সম্মাননা প্রদানমূলক অনুষ্ঠান, আন্তর্জাতিক সেমিনার, কর্মশালা, মুক্তপ্রাঙ্গণের আয়োজন, বনবিহার নানান আয়োজন তো চলেছেই। এর মধ্যে ২০১১ সালে রবীন্দ্র সার্ধশত জন্মজয়ন্তী উদযাপনের অংশ হিসেবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮টি নাটকের মঞ্চায়ন একটি দারুণ ঘটনা। তেমনি শেক্সপীয়রের ৪০০তম জন্মজয়ন্তীর বিশ্বব্যাপী উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের মঞ্চায়ন ও ইংল্যান্ডের ‘গ্লোব থিয়েটার’র ‘হ্যামলেট’ প্রদর্শন গৌরবজনক ঘটনা বলা যায়। ভারতে হয়ে যাওয়া ৮ম থিয়েটার অলিম্পিকসে বাংলাদেশের ৯টি নাটকের মঞ্চায়নের বিষয়টিও বিশেষ সম্মানের।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটারে গভীর পর্যবেক্ষণের আলোকরশ্মি ফেললে আমরা শিল্পের সেই চিহ্নগুলোকে খুঁজে পাবো নিশ্চয়, যেগুলো বস্তুগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে শিল্পের নেশায় কাজ করে যাওয়া মানুষের ভালোবাসার আকাক্সক্ষা কিংবা কহতব্য কথাগুলোকে শিল্পের মোড়কে পেশ করার তাগিদ থেকে জন্ম নেয়া ক্ষরণের-উৎসজাত।

হতাশার কথাটিও সেখানেই থেকে যায়। এখনো একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে কী দেশে, মানুষের একেবারে কাছাকাছি মানুষের কথা বলার এই জীবন্ত সমমাত্রিক মাধ্যমটি তৈরি করতে পারে নি শিল্পীদের জীবিকার রসদ। লক্ষ্মী আর সরস্বতীকে বসাতে পারে নি একই আসনে। অন্তর ও বাহিরের টানাপোড়েন বেড়েছে দিনকে দিন।

থিয়েটারবিষয়ক একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমি বা ইনস্টিটিউট হয় নি, হয় নি কোনো আর্কাইভ।  

বিদ্যায়তনে নাট্যশিল্প পঠিতব্য হয় নি, যেখানে গীত-নৃত্য-অভিনয়ময় প্রকাশভঙ্গিমার এই দেশে অনেক সুযোগ আছে শিশু-কিশোরদের সাথে গল্প-কবিতার নাট্যমূলক আনন্দদায়ক সম্পর্ক গড়ে দেবার।

এখনো থিয়েটারে দর্শক আশানুরূপ তো হচ্ছে না, বরং বলা যায় কমছেই। কিন্তু তার জন্য থিয়েটার খোদ দায়ী, নাকি থিয়েটার-টেকনোক্রেটই দায়ী সেকথাও ভাববার বিষয়।

তবু আশা তো দেখাই যায়। গত ২০ বছরের এই গ্রাফ কী প্যারামিটার আমাদেরকে একেবারে হতাশ তো করেই না, বরং মাথা তুলে দাঁড়াবার স্পর্ধা দেয়।  

শুভাশিস সিনহা ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): নাট্যকার, নির্দেশক। সদস্য- মণিপুরি থিয়েটার।