Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গত ২০ বছরে আমাদের থিয়েটার : আড্ডা-আয়োজন, ঘটনা-দুর্ঘটনা

Written by মোহাম্মদ বারী.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় সমান বয়সী। নানা বাঁক পরিবর্তন করে এই নবনাট্য চর্চা কী রূপ ধারণ করল, তার সরজমিনপ্রতিবেদন তৈরি কঠিন নয় বৈকি। মাত্র ৪৫/৪৬ বছরের এই পথ পরিক্রমণে বাঁকগুলো স্পষ্ট করার যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত সকলের চোখের সামনেই আছে। এরই মধ্যে কখন যে সময় গড়িয়ে আমরা,  মানে আমাদের প্রজন্মও এই যাত্রায় অনেকখানি পথ পাড়ি দিলাম, তা ভেবে অবাকই হতে হয়। আমাদের প্রজন্মের গুরুত্বপূর্ণ থিয়েটারকেন্দ্রিক পত্রিকা ‘থিয়েটারওয়ালা’ এক কুড়ি বছর পার করেছে, এ সংবাদ জানিয়ে পত্রিকার সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার যখন একটি লেখা আহ্বান করলেন, তখন অন্তরে ডাক দিল প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা ‘কুড়ি বছর পরে’। ‘.... জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার’।

সম্পাদক জানালেন, গত এক কুড়ি বছরে আমার পর্যবেক্ষণে আমাদের থিয়েটার বা থিয়েটারকেন্দ্রিক যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি তা যেন লিখি। ঢাকানগরকেন্দ্রিক আমার থিয়েটারজীবন প্রায় ত্রিশ বছরের। এর মধ্যে প্রথম দশ বছর তো এর অলি-গলি-পথ চিনতেই চলে গেছে। সুতরাং অর্বাচীন এই নাট্যকর্মীর বিশ বছরের পর্যবেক্ষণ কিঞ্চিৎগুরুত্বপূর্ণ না হলেও খুব অগুরুত্বপূর্ণ হবে না- এই ভরসায় দু’কলম লিখতে বসা। থিয়েটারকেন্দ্রিক বিপুল বিষয় এক নিবন্ধে ধরা অসম্ভব। তাই আমার আগ্রহ গত দু’দশকে, বিশেষত ঢাকার নাট্যাঙ্গনে আড্ডা-আলোচনার আয়োজন আর ঘটনা-দুর্ঘটনা বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা।
 
প্রথমেই দু’কথা বলতে চাই আড্ডা নিয়ে। আড্ডা জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। আড্ডা ছাড়া কোনো মানুষ তার জীবনচক্র শেষ করেছেন এমন দাবি বিরল। শিল্পকলার যেকোনো মাধ্যমের সৃজনশীলতার আঁতুরঘর হচ্ছে আড্ডা। আড্ডা নিয়ে বহু মনীষী বহু কথা বলে গেছেন। আড্ডা এমন এক অনুষঙ্গ যা শিল্পের সৃজনশীল বিকাশকে কেবল তরান্বিতই করে না, সমৃদ্ধও করে। বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যে আড্ডা নিয়ে বিপুল বিচিত্র অভিজ্ঞতার সরস বর্ণনা আছে। শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্য অঙ্গনে যারা লিজেন্ড, তাঁদের প্রত্যেকের মুখেই আড্ডার নানা বিষয় নিয়ে নানা কথা আমরা অনেক শুনেছি। আড্ডায় তারা কীভাবে মত্ত হয়েছেন, কীভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন, কীভাবে ঋদ্ধ হয়েছেন, কীভাবে আড্ডাই তাঁদেরকে মহিমা দিয়েছে, সে গল্প তাঁরা অনেকেই বক্তৃতায়, গল্পে, রচনায় উল্লেখ করেছেন। থিয়েটার বা নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা, তাদের জন্য তো এই আড্ডা বিষয়টি বরং আরো এককাঠি উপরে। কারণ, নাট্যকর্মটি ঘটে দলগতভাবে। আর আড্ডার মূল কাঠামো হচ্ছে দল, নিদেনপক্ষে দু’জনের একটি দল। তো, নাটকের ক্ষেত্রে, মানে নাট্যকর্মী/নাট্যজনদের গত বিশ বছরে এই আড্ডার ধরনটা কোথা থেকে কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো, সেদিকে একটু দৃষ্টি ফেলা যাক।
 
আমাদের প্রজন্মের নাট্যকর্মীরা মান্না দে’র বিখ্যাত গানের সুর ভাজ করে এখন গাইতেই পারেন- ‘মহিলা সমিতির আড্ডাটা আজ আর নেই....’। সময়টা শুরু করা যাক ১৯৯৮ সাল থেকে, ‘থিয়েটারওয়ালা’র উন্মেষকাল ধরে। অর্থাৎ আমাদের বিবেচ্যকাল অনেকটা এ শতাব্দীর শুরুর দুই দশক বলা যেতে পারে। তখন বেইলি রোডের (বর্তমান নাটক সরণি) মহিলা সমিতি বা গাইড হাউস মিলনায়তনে ছিল নাটকের নিয়মিত মঞ্চায়ন। আর এই মঞ্চায়ন ঘিরে মহিলা সমিতির বারান্দা, উঠোন কিংবা সামনের ফুটপাত জুড়ে থাকতো নাট্যকর্মীদের প্রাণের আড্ডা। এই আড্ডা চলতো প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত। কেবল তরুণ নাট্যকর্মীই না, অগ্রজ নাট্যজনদেরও দেখেছি কী অসাধারণ মিথষ্ক্রিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা জমিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। নাটক ছাড়াও সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি-বিজ্ঞান-দর্শন এমনকি ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা-প্রেম-বিরহ-বিচ্ছেদ, কী-না ছিল সেসব আড্ডায়!

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নবনির্মিত জাতীয় নাট্যশালার পরীক্ষণ থিয়েটার হলের যাত্রা শুরু ২০০৩ সালে। আর মূল হলে নাটক মঞ্চায়নের বরাদ্দ দেয়া শুরু হলো ২০০৫ সাল থেকে। মহিলা সমিতি, গাইড হাউসের তুলনায় নাট্যমঞ্চায়নের অবকাঠামো ও আনুষাঙ্গিক সুবিধা, খরচ ইত্যাদি বিবেচনায় ঢাকার নাট্যদলগুলো জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চায়ন শুরু করল। আমার বিবেচনায় এটি বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের নাট্য-আন্দোলনের গতি প্রকৃতির বড় বাঁকটি মোড় নিয়েছে। ইতোমধ্যে জমে উঠেছে সেগুনবাগিচার জাতীয় নাট্যশালা। ধীরে ধীরে নাটক সরণির বা বেইলি রোডের আড্ডাটা স্থানান্তর হলো বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। আকাশ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে ততদিনে। দেদারসে প্যাকেজ নাটক নির্মিত হচ্ছে। নাট্যকর্মীরাও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার হাতছানিতে চঞ্চল হয়ে উঠছে। শিল্পকলার আড্ডার নান্দনিক বিষয় পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সিডিউল মেলানোর আড্ডায়। মহিলা সমিতির সিনিয়র-জুনিয়রদের মিলনমেলা সেভাবে আর চোখে পড়ছে না। আড্ডার চিন্তাশীল বা সৃজনশীল চরিত্রটাও যেন স্বতঃস্ফূর্ততা হারাতে শুরু করল। ধূমায়িত চায়ের কাপের আড্ডায় বিদগ্ধ নাট্যকর্মীরা হয়তো মিলছেন, কিন্তু আশার থেকে হতাশার কথাই তাদের মুখে বেশি শোনা যাচ্ছে। গ্রুপভিত্তিক নাট্যচর্চায় পেশাদারিত্বের অঙ্গীকার নিয়ে নাট্যকর্মীরা যে চূড়ান্ত শৃঙ্খলায় দীক্ষা নিল গত শতাব্দীর ৮০ বা ৯০ দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত; নতুন শতাব্দীর শুরুতে এসে লক্ষণটা ভালো করেই টের পাওয়া গেল যে, সেটায় ঘুণ ধরেছে অনেক আগেই। নাট্যকর্মীদের যে উদ্বৃত্ত সময় ছিল নবনাট্য আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ, সে ‘সময়’ই কাল হয়ে গেল থিয়েটারের। সময় নেই, সময় নেই, কারো হাতে সময় নেই। সবাই ছুটছে। হাতে আসছে টাকা, আসছে নতুন মডেলের মোবাইল সেট, ইন্টারনেট প্যাকেজ ডাটা। কাজেই টাকা উপার্জন হয়ে উঠলো মুখ্য বিষয়- তারও, যে ছিল থিয়েটারঅন্তঃপ্রাণ ত্যাগী এক নাট্যকর্মী। এভাবেই মুক্ত বাজার অর্থনীতির কালো ছায়া পড়লো আমাদের থিয়েটারের আঙ্গিনায় নতুন শতাব্দীর শুরুতেই। আর তার সর্বগ্রাস যেন ভেঙ্গে খান খান করতে থাকলো আমাদের স্বপ্নগুলোকে।

তো, এরকম এক অস্থির সময়ে সুস্থির এক সম্পাদক আমাদের মুখোমুখি হলেন ‘থিয়েটারওয়ালা’ হয়ে। থিয়েটারের ফেরিই  হোক আর থিয়েটার মালিকই হোক, ‘থিয়েটারওয়ালা’ আমাদের জন্য সুবাতাস নিয়ে এলো- একথা অনস্বীকার্য। থিয়েটারের জন্য লেখাপড়ার বিষয়টি আমরা যারা ভুলেই যাচ্ছিলাম অথবা থিয়েটারের জন্য আদৌ কোনো পড়াশোনার প্রয়োজন নেই- এ মতবাদে যারা বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার দায় নিয়েই ‘থিয়েটারওয়ালা’র লোগোতে দেখা গেল এক স্লোগান- ‘থিয়েটার করতে পড়তে হয়’। গত শতকের নব্বই দশকের একেবারে শেষদিকে পত্রিকাটির আত্মপ্রকাশ। ভিতরের আর বাইরের আয়োজন মিলে থিয়েটার অঙ্গনে গত বিশ বছরের একটি তাৎপর্যময় ঘটনা এই ‘থিয়েটারওয়ালা’। ভিতরের আয়োজন বলতে পত্রিকাটির ভিতরের যে কনটেন্ট বা সামগ্রী থাকে তার পরিবেশনভঙ্গির অভিনবত্ব যেমন চোখে পড়ে, তেমনি বাইরের আয়োজন অর্থাৎ থিয়েটারবিষয়ে আলোচনা, মুখোমুখি, আড্ডা, আলাপন ইত্যাদি নিয়ে সৃজনশীল যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে, তা এই এক কুড়ি বছরের অনন্য অভিজ্ঞতা।

ধরা যাক, আলোচ্য আড্ডার কথাই, যা দিয়ে শুরু করেছি। বলছিলাম যে, আড্ডার চিন্তাশীল বা সৃজনশীলতার স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রটায় খামতি চোখে পড়ছিল নব্বই দশকের শেষ দিকে এসেই। শিল্পকলার আড্ডার বিষয় যদি অর্থ উপার্জন হয়, তবে তার সৃজনশীলতা আলু-পটল কেনা-বেচার সৃজনশীলতার নামান্তর বটে। দুঃসময়ের এই সংকট ‘থিয়েটারওয়ালা’ অনুধাবনে নিয়েছিল। তাই প্রথম সংখ্যাতেই ‘আলাপন’ শিরোনামে আড্ডার এক নিবন্ধে চোখ আটকে গিয়েছিল আমাদের। রেকর্ডার দিয়ে পুরো আড্ডার কথাপোকথন ধারণ করে তার অনুলিখন। ১৯৯৮ সালের সেই আড্ডায় অংশ নিয়েছিলেন অগ্রজ নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনেতা মামুনুর রশীদের সাথে কয়েকজন তরুণ নাট্যকর্মী। এই তরুণ নাট্যকর্মী বেছে নেয়া হয়েছিল ওই দুঃসময়েও যারা বাজারের হাতছানির বাইরে থেকেই থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইছিলেন ভালোবাসায়, মমতায়, প্রতিজ্ঞায়। মামুনুর রশীদের মতো বটবৃক্ষের সাথে এই আড্ডার আয়োজন নবীন নাট্যকর্মীদের জন্য একটা স্বীকৃতিও বটে। দ্বিতীয় সংখ্যাতেই চমৎকৃত হই ‘আলাপন’ শিরোনামে আরেক আড্ডা দেখে। সেই আড্ডায় তখনকার থিয়েটার নিয়ে নানান ভাবনা-চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন এস এম সোলায়মান, ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালাম। নামগুলোর ‘ভার’ এখনো নিশ্চয়ই বাংলাদেশের থিয়েটারচর্চায় নিবেদিত প্রবীণ ও নবীনেরা খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছেন আশা করি। পরবর্তী সময়ে নানা রূপে, নানা ঢংয়ে, একের পর এক এরকম সৃজনশীল আড্ডার আয়োজন করেছে পত্রিকাটি। কখনো কারো বাসায় বা অফিসে, কখনো কোনো নাট্যজনের জন্মদিনে, কখনো-বা একেবারে আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে। এসব আড্ডা যদিও স্বতঃস্ফূর্ত নয়, একটা আনুষ্ঠানিকতার মতো গাম্ভীর্য নিয়ে শুরু হয়, কিন্তু শেষ বিচারে সেগুলো মনমুগ্ধকর নিরেট আড্ডাই হয়ে ওঠে। লক্ষ করেছি, ‘থিয়েটারওয়ালা’র এসব আড্ডায় একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে- বিষয় এবং আঙ্গিকে। যেমন ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’র (‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ বিষয়ে প্রবন্ধের পরের অংশে আলোচনা করেছি।) ২০০৭ ও ২০০৮-এ যে দু’টি বিষয়ে আড্ডা হয়েছিল, তা হয়েছিল ‘বৈঠক’ শিরোনামে। বৈঠকের বিষয় ছিল ‘এই বাজারে কী নিয়ে কীভাবে নাটক’ (২০০৭) এবং ‘মগজে উপনিবেশ ও এ সময়ের নাটক’ (২০০৮)। এ দু’টো আড্ডা বিষয়বিবেচনায় যেমন অসাধারণ, তেমনি আড্ডার আঙ্গিক বিচারেও ছিল চমৎকারিত্ব। জাতীয় নাট্যশালার মূল হলের মূল মঞ্চে গোল হয়ে বসে আড্ডা। স্বতঃস্ফূর্ত আড্ডায় কোনো বিষয় বা সঞ্চালক থাকে না, এখানে ছিল। কারণ, এটা ছিল আনুষ্ঠানিক আয়োজন। ফলে এ ধরনের আয়োজনকে ‘আড্ডা’ বলা যায় কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আবার আয়োজনটি সেমিনার বা আলোচনাসভা চরিত্রেরও নয়। কিন্তু বৈঠকে বসে সবাই যে ধরনের মিথষ্ক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তা অনেকটা ‘আড্ডা’ই হয়ে ওঠে। আবার অনুজপ্রতিম তারেকের বাসায় বা অন্য কোথাও একাধিক আড্ডা ছিল একেবারে অনানুষ্ঠানিক। উদোক্তা যথারীতি ‘থিয়েটারওয়ালা’। নানা মাধ্যমের শিল্পীদের আড্ডা। সেখানে ছিলেন এই প্রজন্মের কবি, গল্পকার, ফাইন আর্টসের শিল্পী, সাংবাদিক, নাটকের অভিনেতা নির্দেশক- নানাজন। আলোচ্য কুড়ি বছরের আরেকটি পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এক মাধ্যমের শিল্পীর সাথে অন্য মাধ্যমের শিল্পীর মিথষ্ক্রিয়া। একে অপরের কাজের প্রতি অনিহার প্রকাশ। এই সময়ের কবি তার সময়ের চিত্রশিল্পীকে চেনেন না বা জানেন না। আবার একই সময়ের নাট্যকর্মী তার সময়ের কবিতা পড়েন না- কবিকেও চেনেন না। এই সময়ের সংগীত শিল্পী যেমন নাটক পাড়ায় পা দেন না, তেমনি নাটকের শিল্পীরও সংগীত শিল্পীর সাথে দূরত্ব অনেকখানি। এরকম সবাই নিজ নিজ মাধ্যমের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। একই প্রজন্মের নানা মাধ্যমে যারা সিরিয়াসলি কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে চিন্তার আদান-প্রদানই ছিল ‘থিয়েটারওয়ালা’র আড্ডার উদ্দেশ্য। এরকম একাধিক আড্ডায় অংশগ্রহণ করে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি। এই সময়কালে অর্থাৎ বিগত কুড়ি বছরে নাট্যকর্মীরা অন্য মাধ্যমের শিল্পচর্চার সাথে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ সেভাবে লক্ষ করা যায় না। এমনকি বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কও সেরকম লক্ষ করা যায় না। অথচ অগ্রজদের মুখে শুনেছি গত শতকের ষাট বা সত্তরের দশকে নানা মাধ্যমের শিল্পীদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া ছিল। পারস্পরিক বন্ধুত্বে তারা কীভাবে উপকৃত হয়েছেন, তা-ও শুনেছি। তো ‘থিয়েটারওয়ালা’ বিষয়টা উপলব্ধি করেই বোধকরি সমকালীন বিভিন্ন শিল্পীদের আড্ডায় বসিয়েছিল। চাওয়াটা ছিল এই যে, আগে আমাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ হোক। একে অন্যকে চিনি, একে অপরের কাজকে বুঝি, নিজেদের সমৃদ্ধ করি। এরকম আড্ডায় দেখেছি বিশেষ বিশেষ নাটক নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। কবিবৃন্দ ধুয়ে দিয়েছেন নাট্যকার বা নির্দেশককে আবার নাটকের অভিনেতাও প্রশ্ন তুলেছেন কবির কবিতা বা কথাসাহিত্যিকের কাজ নিয়ে।
 
‘থিয়েটারওয়ালা’ আরেকরকম আড্ডার আয়োজন করেছিল, নতুন নাটক মহড়ায় থাকাকালীন সময় নিয়ে। এ ধরনের আয়োজন আগে কখনো দেখি নি। বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনার উপর এ ধরনের আয়োজন পত্রিকাটি শুরু করে সম্ভবত ২০০১ সালে। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ‘রক্তকরবী’, সুবচন নাট্য সংসদের ‘তীর্থঙ্কর’ বা প্রাচ্যনাটের ‘রাজা এবং অন্যান্য...’ নিয়ে জমজমাট আড্ডা জমেছিল। নাট্য নির্মাণ পর্বের অর্থাৎ মহড়া চলাকালীন সময়ে নানা শৈল্পিক ভাবনার অংশীদার হওয়া নির্দেশক-অভিনেতৃ-ডিজাইনারদের আসন্ন নাটক নিয়ে ভাবনা-চিন্তা নিয়ে ছিল এসব আড্ডা।

পত্রিকাটি ‘আলাপন’, ‘দর্শকের মুখোমুখি’, ‘আড্ডা’, ‘নির্মাণ’ ইত্যাদি নানা শিরোনামে এ ধরনের অনেক আড্ডার আয়োজন করেছে গত বিশ বছরে। আমার মনে পড়ে ২০০৫ সালের এক আয়োজনের কথা। দর্শকের মুখোমুখি হয়েছিলেন আবদুল্লাহ আল-মামুন, আতাউর রহমান, আলী যাকের, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দিন ইউসুফ আর সৈয়দ জামিল আহমেদ। বরেণ্য নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক সে অনুষ্ঠানে আসবার কথা থাকলেও তিনি শেষ পর্যন্ত আসতে পারেন নি। গ্যালারিভর্তি বিভিন্ন বয়সী নাট্যপিপাসুদের উপস্থিতিতে হওয়া এই আয়োজন উপভোগের উত্তেজনা আজও অনুভব করি।

২০০৬ সালের আয়োজিত অনুরূপ ‘মুখোমুখি’ আড্ডা অনুষ্ঠানে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য নাটকের সাথে ঢাকায় আমার নির্দেশিত প্রথম নাটক ‘সময়ের প্রয়োজনে’ও নির্বাচিত হয়েছিল। ভেবে এখনও আনন্দবোধ করি যে, ‘দর্শকের মুখোমুখি’ সেই অনুষ্ঠানে নির্দেশক হিসেবে মঞ্চে বসে আমি জবাব দিচ্ছি আর হলভর্তি দর্শকের সারিতে বসে আমাকে প্রশ্ন করছেন সৈয়দ শামসুল হক বা মামুনুর রশীদ। এই আড্ডাগুলোর মাত্রা ছিল উচ্চতর। ‘থিয়েটারওয়ালা’ পরবর্তী সময়ে এরকম আয়োজন করে নি বা করার আগ্রহবোধ করে নি। আমি সম্পাদককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এর কারণ কী? জবাবে সম্পাদক জানিয়েছিলেন, ‘থিয়েটারওয়ালা’ চায় এ ধরনের আয়োজন ছড়িয়ে পড়ুক। শুরুটা হয়তো ‘থিয়েটারওয়ালা’ করেছে, কিন্তু এটা যদি ভালো আয়োজন হয় তবে অন্যান্য সংগঠন বা দলও তা করতে পারে। তা হয়েছেও। ‘সুবচন নাট্য সংসদ’ তাদের ‘খনা’ প্রযোজনা নিয়ে ছায়াটন ভবনে নাট্যকার-ডিজাইনার-দর্শক নিয়ে একটা আড্ডা বসিয়েছিল। নাট্যদল ‘বটতলা’ও তাদের প্রযোজনাকে দর্শকের মুখোমুখি করেছিল। তার মানে একথা সত্য, ‘থিয়েটারওয়ালা’র আঙ্গিকে পরে অনেক সংগঠন এরকম আয়োজন-অনুষ্ঠানে আগ্রহী হয়েছে এবং তা সফলও হয়েছে। তৎকালীন সময়ে অর্থাৎ ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটের উদ্বোধন প্রাককালে ঢাকায় এই ইনস্টিটিউট বিষয়ে বিশিষ্টজনদের পাশাপাশি দর্শকসারিতে বসা সাধারণ মানুষও প্রশ্ন করার বা মতামত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন। গত বিশ বছরে বিভিন্ন দল বা সংগঠন বিশেষ বিশেষ দিন বা উৎসব উপলক্ষে সেমিনার বা বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে অনেক ‘আলাপন’ বা ‘আড্ডা’র আয়োজন করেছে, যা ছিল ‘থিয়েটারওয়ালা’র আয়োজনের আঙ্গিকে। এ ধরনের আয়োজনে দর্শকশ্রোতাগণের খোলা মত প্রকাশের বা দর্শক-শ্রোতাগণের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা থাকে অবারিত। গত বিশ বছরের আগে এ ধরনের আয়োজনের প্রবণতার কথা মনে পড়ে না। সম্প্রতি নবগঠিত থিয়েটার ডিরেক্টরস ইউনিটির এরকম দর্শকের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বরেণ্য নাট্যজন মামুনুর রশীদ ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ। দর্শকের সারিতে অনেকের সাথে ছিলেন বাংলা নাটকের আরেক দিকপাল ওপার বাংলার বিভাস চক্রবর্তী। বিভাস চক্রবর্তী সে অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তিনি অভিভূত। একই সঙ্গে এ-ও বলে আক্ষেপ করেছিলেন যে কলকাতায় এ ধরনের আয়োজন হয় না। অতি সম্প্রতি মহিলা সমিতিতে সৈয়দ জামিল আহমেদকে দর্শকের মুখোমুখি করে ‘বটতলা’ আড্ডার যে আয়োজন করেছিল, তাও ছিল শতভাগ সফল।

‘থিয়েটারওয়ালা’র আয়োজনে এ ধরনের বহিরাঙ্গনে যত অনুষ্ঠান হয়েছে তা অডিও রেকর্ড নিয়েছে এবং পরে রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠানের সম্পাদনা করে তার লিখিতরূপ ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির এই পদ্ধতিটিও আমার কাছে সৃজনশীল মনে হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত আড্ডাটি পড়তে পড়তে যেমন জীবন্ত মনে হয়, তেমনি প্রথাগত প্রতিবেদন পাঠের থেকে তা অনেক বেশি আনন্দময়ও হয়ে ওঠে। ‘থিয়েটারওয়ালা’র সৃজনশীলতায় পাওয়া আড্ডা-আলোচনার এই রূপবৈশিষ্ট্য আমাদের থিয়েটার অঙ্গনে গত বিশ বছরে পাওয়া এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আর তাই এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নেই যে, গত বিশ বছরে ‘থিয়েটারওয়ালা’ কেবল একটি নাট্যবিষয়ক পত্রিকা হিসেবেই নয়, এর বাইরেও আমাদের থিয়েটারকেন্দ্রিক সংস্কৃতির গুণগত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই পত্রিকার ভিতরের কনটেন্ট বা সামগ্রীতে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি বাইরের আয়োজনগুলোও অভিনব সৃজনশীল। এই আয়োজনগুলোতে তরুণ প্রজন্মের নাট্যকর্মীদের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মতো। আর এসব আয়োজনের ভিতর দিয়ে নাট্যকর্মীদের সংহত ও সুশিক্ষিত করার  যে কৌশলী প্রয়াস, তা ঐতিহাসিক।
 
এবার পত্রিকাটির দুটি বিশেষ আয়োজনের কথা বলতে চাই। এর একটির শিরোনাম ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ আর অপরটির শিরোনাম ‘ফয়েজ জহির-আজাদ আবুল কালাম-শুভাশিস সিনহা নাট্যযজ্ঞ’। দু’টি আয়োজনে পত্রিকাটির সাথে আমি বা আমরা যুক্ত ছিলাম বলে আলাদাভাবে দু’কথা বলতে চাইছি। ‘আমরা’ মানে পত্রিকাটির সম্পাদকের কাছের বন্ধুরা। আবার এ-ও বলা যায়, একই প্রজন্মের একই চিন্তা-চেতনার বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের বন্ধুরা। এখানে একত্রিত হয়েছিলাম কবি, চিত্রশিল্পী, নাট্যশিল্পী, কথাশিল্পী, সাংবাদিক এরকম নানা মাধ্যমের বন্ধুরা। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’ হয়েছিল সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় নাট্যশালার মূল হল ও এক্সপেরিমেন্টাল হল জুড়ে। সকাল থেকে রাত অব্দি বিরতিহীন এ আয়োজনে ছিল পাশ্চাত্যের ‘কার্নিভ্যাল’ মেজাজের। ঢাকার বিভিন্ন নাট্য-সংগঠন সুনির্দিষ্ট স্টলে দিনব্যাপী স্বল্প দৈর্ঘ্যরে নাট্য উপস্থাপনার পাশাপাশি স্টল সজ্জার অভিনবত্ব দিয়ে ‘গ্রামীণ মেলা’র মেজাজে নাট্যকর্মী-দর্শকের মন জয় করেছিল। বিকেলে ছিল ‘বৈঠক’ শিরোনামে আড্ডা আর রাতে নাট্যপ্রদর্শনী। সব মিলে একটা জমজমাট সৃজনশীল রঙ্গফূর্তির দিন। সকালবেলা একেবারে অনানুষ্ঠানিকভাবে ছোট্ট ঘোষণায় দিন শুরু হয়েছিল। জাতীয় নাট্যশালার পুরো চত্ত্বর জুড়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের অনেক নাট্যদলের নাট্যকর্মীদের সারাদিনমান এমন মিলনমেলা আর প্রাণের আবেগ আগে কখনো দেখি নি। শিল্পকলা একাডেমির মূল গেটের সামনেই একটি স্টলে ১৫/২০ মিনিটের পারফর্মেন্স দেখে অদূরে আরেকটি দলের স্টলের সামনে দর্শক যাচ্ছে, দেখছে সেখানকার পারফর্মেন্স। এরপরের স্টল বা পারফর্মেন্স মূল হলের সিঁড়ির নিচে, আরেকটি আবার উপরের বারান্দা বা করিডোরের ডানে বা বামে। দরোজা ঠেলে হলের লাউঞ্জে ঢুকলেই বাঁয়ে একটি, আবার ডানের কোণায় আরেকটি পারফর্মেন্স। গ্রামের মেলায় ঘুরে ঘুরে বিকিকিনি দেখার মতোই পারফর্মেন্স দেখা। এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বিকেলের বৈঠকের কথা আগেই বলেছি। এসব কিছু হয়েছিল এস এম সোলায়মানের জন্ম ও মৃত্যু দিবসকে ঘিরে। এস এম সোলায়মানের নামাঙ্কিত এ আয়োজনে সোলায়মানকে স্মরণ করার চেয়েও বড় ব্যাপার ছিল নাটক নিয়ে সোলায়মানের ‘খ্যাপামি’ অর্থাৎ মাতামাতির স্পিরিট ধারণ করা। এস এম সোলায়মান তাঁর স্বল্পকালীন নাট্যজীবনে যা করে গেছেন, তাকে একরকম ‘খ্যাপামি’ বলা যেতে পারে। আমরা, মানে ‘থিয়েটারওয়ালা’র আহ্বানে যুক্ত হওয়া সকলেই একমত হয়েছিলাম যে, বাজার অর্থনীতির গোগ্রাসী সময়ের সংকটকালে থিয়েটারের জন্য একটা স্পিরিট বা ভিতরগত তাড়না প্রয়োজন। আর তা সোলায়মানের নামে হলে বেশ যুঁৎসই হয়। পরপর দু’বছর এ ঘটনার পর পত্রিকাটি ঘোষণা দেয় যে, এটি একটি অনিয়মিত আয়োজন হলে ভালো হয়। যেকোনো নাট্যদল প্রেরণা বোধ করলে এ আয়োজন করতে পারে। পরবর্তী সময়ে ‘থিয়েটার আর্ট ইউনিট’ ও ‘প্রাচ্যনাট’ একই আঙ্গিকে আরো দু’টি ‘রঙ্গমাতন সোলায়মান মেলা’র আয়োজন করেছিল। এই আয়োজন নিয়ে তরুণ নাট্যকর্মীদের বিপুল আগ্রহ লক্ষ করেছি। অনিয়মিত হলেও একেক বছর একেক দল আয়োজক হলে আয়োজনটি সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে- এরকম ধারণার কথা জানিয়েছিলেন থিয়েটারওয়ালা সম্পাদক। তবে সন্দেহ নেই, এই আয়োজনটি তরুণ নাট্যকর্মী ও সাধারণ দর্শকের মধ্যে এক অনন্য মেলবন্ধনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।

‘থিয়েটারাওয়ালা’র শুভাকাঙ্খী বন্ধুরা তাদের প্রজন্মের তিনজন গুণী ও মেধাবী নির্দেশককে সম্মাননা প্রদান করে ২০১১ সালে। এই তিনজন হলেন ফয়েজ জহির, আজাদ আবুল কালাম আর শুভাশিস সিনহা। তাঁদের নামের সাথে ‘নাট্যযজ্ঞ’ শিরোনামে এই আয়োজনটিও ছিল অভিনব। গানে-বাদ্যে তাদের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশ শিল্পকলা এাকাডেমির প্রাঙ্গণে-সিঁড়িতে-লবিতে। আর এসব উত্তরীয় পরিয়ে দেন একই প্রজন্মের অন্যান্য নির্দেশকেরা। অনানুষ্ঠানিকতার মধ্যেও এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতা তৈরির সৃজনশীল এই আয়োজন ছিল একেবারেই প্রথাবিরোধী। একধরনের দ্রোহ বা প্রথা ভাঙার সুর লক্ষ করা যায় এসব আয়োজনে। কোথাও গিয়ে যেন মনে হয়, কাউকে বা কিছুকে অস্বীকার করার ডাক দেয় এসব আয়োজন। আর সে ডাকে ছুটে আসে মূলত তরুণরাই, যারা চিরকালই অপঙ্কিল ও ঋজু। প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস কেবল তারাই রাখে। ‘থিয়েটারওয়ালা’ গত বিশ বছরে এসব আয়োজনের ভিতর দিয়ে কেবল সেই সাহসটাকেই উসকে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এই উসকানি কতখানি কার্যকর হয়েছে, সে বিচার সময়ই করবে।

‘থিয়েটারওয়ালা’র জন্য এ রচনাটি করতে চেয়েছিলাম মূলত গত ২০ বছরে বাংলাদেশের থিয়েটারকেন্দ্রিক ঘটনা বা দুর্ঘটনার উপর আলোকপাতের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। কিন্তু লিখতে বসে ‘থিয়েটারওয়ালা’র ঘটনাগুলোই বেশি মনে পড়ল। আমার কাছে তা গুরুত্বপূর্ণও মনে হলো। তবে এর বাইরেও নিঃসন্দেহে বড় অনেক ঘটনা আছে। গত বিশ বছরের মধ্যেই তো আমরা জাতীয় নাট্যশালা পেলাম। সেই নাট্যশালায় তিন-তিনটি মিলনায়তন, মহড়াকক্ষ, প্রশিক্ষণ হল, সেমিনার হল মিলে যে কমপ্লেক্স, তা পুরো নাট্যচর্চার জন্য একটা বিরাট বাঁক বদল। আরেকটি বড় ঘটনা- এই সময়কালেই জাতীয় সংসদে বাতিল হয়েছে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন-এর মতো একটি প্রাচীন কালো আইন। গত বিশ বছরে নতুন নতুন নাটকের দল আর নতুন নতুন নিরীক্ষার নাটক, নতুন অভিনেতা-নির্দেশক-নাট্যকার আমাদের আশাবাদী করেছে। গত বিশ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যবিষয়ক একাডেমিক শিক্ষার বিস্তার আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, বিশেষ করে নাটকের জন্য আর্থিক অনুদান কম বড় ঘটনা না। এ সময়কালেই লক্ষ করি দেশ-বিদেশে নাট্য উৎসব আয়োজনের প্রসার। নাটক নিয়ে বিদেশ সফরও আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। এ সময়কালেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া থিয়েটারকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা শুরু করেছে। এ সময়ের ভিতরেই মহিলা সমিতির ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস তৈরি হয়েছে। মঞ্চের আকালে পেয়েছি নতুন মঞ্চ- জহির রায়হান মিলনায়তন। এসেছে থিয়েটারকেন্দ্রিক নতুন পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকা। এ সময়কালের মধ্যেই আইটিআই’র বিশ্ব সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আমাদের সকলের প্রিয় নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় যেমন রেপাটরি থিয়েটার এসেছে, আবার ৬৫ জেলায় বিষয়ভিত্তিক নানা সময়ে নানাভাবে নতুন নাট্যরচনা ও নির্মাণও হয়েছে। এ সময়কালের মধ্যেই রেপাটরি দলের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। সম্প্রতি আমরা এ-ও লক্ষ করলাম ঈদের ছুটিকে কেন্দ্র করে কোনো নাটকের একটানা অনেকগুলো প্রদর্শনী বা প্রকল্পভিত্তিক নাট্যনির্মাণের ধারণা। ঢাকার বাইরে বরিশাল, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে স্টুডিও থিয়েটারের উন্নত সংস্কার আর চট্টগ্রামে থিয়েটার ইনস্টিটিউট আর দনিয়া পাঠাগারের স্টুডিও থিয়েটার হল প্রতিষ্ঠা হয়েছে এই সময়ের মধ্যেই। এরকম অনেক প্রেরণাদায়ী ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়, যে ঘটনাগুলো আমাদের উৎফুল্ল করে।

কিন্তু এর বিপরীতে হতাশার ঘটনা কী নেই?

আছে। বেদনার দুঃখের নিরাশার ঘটনাও আছে এই এক কুড়ি বছরে। যে ঘটনাসমূহ আমাদের বিপন্ন করে, আমাদের দীর্ঘশ্বাসী করে তোলে। কোনো কোনো ঘটনা লজ্জাও দেয় বটে। ছোট করে হলেও সেসব দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে দায়মুক্তি হয় না। গত কুড়ি বছরে একটা বড় দীর্ঘশ্বাসী ঘটনা হচ্ছে থিয়েটারে নতুন দর্শক তৈরি করতে না পারা। স্বাধীনতার পর যে বিপুল উদ্যম আর আশা জাগানিয়া নবনাট্য আন্দোলন শুরু হলো, গত শতাব্দীর আশি বা নব্বই দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত, সেই অভিযাত্রায় নতুন দর্শক তৈরির যে জৌলুস আর তেজ, তা গত বিশ/পঁচিশ বছরে ক্রমাগতভাবে নিম্নগামী হয়েছে। মহিলা সমিতিতে ছুটির দিনে সকালের প্রদর্শনীতে হলভর্তি দর্শকের স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। ‘হল নাই’ ‘হল নাই’ বলে আমরা সারাজীবন চিৎকার করেছি। জাতীয় নাট্যশালায় ৩টি হল পেলাম, সেখনে নিয়মিত নাটকের প্রদর্শনী হচ্ছে। হল বরাদ্দ পাওয়ার প্রতিযোগিতাও চোখে পড়ার মতো। অথচ দর্শক! সম্প্রতি ‘বটতলা’র এক আড্ডা-আয়োজনে নির্দেশক-ডিজাইনার সৈয়দ জামিল আহমেদ উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর ধারণা ঢাকা শহরে নাটকের দর্শক সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার (হয়তো এতটা কম না, আবার খুব বেশি বলেও মনে হয় না)। দুই কোটি মানুষের বসবাসের শহর এই ঢাকায় নাটকের দর্শক মাত্র ৫ হাজার, অর্থাৎ ০.০২৫ ভাগ! গত ৪৬ বছরে আমাদের রাজধানী শহরের নাট্য-দর্শক অর্জনের এই হলো অবস্থা! ঢাকার বাইরে তো আরো করুণ। গত ২০ বছরে ঢাকার বাইরে বহু নাট্যদলের বিলুপ্তি ঘটেছে বা নিয়মিত প্রদর্শনী ব্যাহত হয়েছে। কিশোর বয়সে রংপুর শহরে যে শিখা সংসদের ‘নহবত’, ‘ছেঁড়াতার’, ‘নৃপেন দারোগার দায়ভার’-এর মতো জনপ্রিয় নাটক দেখে নাটকের প্রতি আমার অনুরাগ; সেই শিখা সংসদ এখন বিলুপ্তির পথে। সেখানে আরো নতুন নতুন  দলের জন্ম হয়েছে হয়তো, কিন্তু গত শতকের আশির দশকের শিখা সংসদের নাটকের দর্শকের সেই স্রোতধারা বা নিয়মিত মঞ্চায়ন কোথায় হারিয়ে গেল! আমার ধারণা অন্যান্য জেলা শহরগুলোতেও প্রায় একই দৃশ্য। সামগ্রীক বিবেচনায় আমাদের নতুন দর্শক তৈরির হার আশঙ্কাজনক। বরং পুরাতন নাট্যদর্শকও আমরা হারিয়ে ফেলছি। এই বিশ বছরের মধ্যেই পুরান ঢাকায় জহির রায়হান মিলনায়তন পেলাম, অথচ সেখানে নিয়মিত নাট্যপ্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা গেল না কেবল দর্শক-অভাবে।

গত বিশ বছরে থিয়েটার চর্চার আরেকটি জায়গার চরম বিপর্যয় ঘটেছে, তা হলো নাট্যদলের রেজিমেন্টেশন বা শৃঙ্খলা। দলে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা ছিল বাংলাদেশের নবনাট্য আন্দোলনের উজ্জ্বলতম প্রাপ্তি। গত শতকের আশি বা নব্বই দশকে নাটকের দলের শৃঙ্খলা বা রেজিমেন্টেশন- সেনাবাহিনীর সাথে তুলনা করা হতো। রেজিমেন্টেশনের ভিতর দিয়ে সম্পন্ন থিয়েটারকর্মী গড়ে তোলার চর্চাটা গত বিশ বছরে ক্রমাগত হ্রাস পেতে পেতে বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, অধিকাংশ দলের জন্য নাট্য প্রদর্শনীর আগে একটি/দু’টি কমপ্লিট রানথ্রু করা দুরূহ হয়ে গেছে।

কুড়ি/পঁচিশ বছর আগে বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটারভিত্তিক নাট্যচর্চার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ- দুর্ঘটনায় নাট্যকর্মীদের সামাজিক দায়িত্ব পালন। এরকম দায়িত্ব আমি নিজেও পালন করেছি একাধিকবার। এই দায়িত্ব পালনে যে অপার আনন্দ তা বর্ণনাতীত। বন্যাকবলিত বা ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকার জন্য ছোট ছোট দল বেঁধে ‘জাগো জাগো পুরবাসী’ বলে রাস্তায় রাস্তায় অর্থ বা ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ, মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে পুরাতন বস্ত্র সংগ্রহ বা রাত জেগে পালাক্রমে নাট্যকর্মীদের রুটি তৈরির ঘটনা এখন গল্পের মতো শোনাবে। নাট্যকর্মীদের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সমাজে তাদের মর্যাদা ছিল উচ্চতর। নাট্যকর্মীদের প্রতি মানুষের ছিল বিপুল শ্রদ্ধা-ভালবাসা। নাট্যকর্মীদের এই ত্যাগী চরিত্রটা গত বিশ বছরে আমরা অনেকটাই খুঁইয়েছি।

গত বিশ বছরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা নাট্যামোদী সমাজের অন্যতম বড় অর্জন এটা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু এর বিপরীতে এই জাতীয় নাট্যশালার অব্যবস্থাপনাও একটি হতাশার বিষয়। বিশেষ করে হল বরাদ্দ বিষয়টি নিয়ে হরহামেশাই নাট্যকর্মীদের হতাশা ও ক্ষোভের কথা শুনি। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠার প্রায় ২০/২১ বছর পরেও আমরা জাতীয় নাট্যশালার যথোপযুক্ত মর্যাদা নির্মাণ করতে পারি নি। জাতীয় নাট্যশালায় কোন মানের নাটক বা অনুষ্ঠান হবে তা নিয়ে চরম হতাশা আছে বিদগ্ধ নাট্যজন-নাট্যকর্মীদের। আমি যতদূর জানি যে, জাতীয় নাট্যশালার মিলনায়তন বরাদ্দের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক কমিটি করে দেয়া হয়েছে। অথচ জাতীয় নাট্যশালার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এই দায় কোনো কমিটির উপর বর্তায় না। বাংলদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিজেরই এই দায় নেয়া উচিত বলে মনে করি। নতুন দর্শক তৈরি না হওয়ার অন্যতম বড় কারণ জাতীয় নাট্যশালায় নিম্নমান ও নিম্ন রুচির নাটক প্রদর্শনী। গত বিশ বছরের ব্যর্থতার তালিকায় এই হতাশাও উল্লেখযোগ্য।
 
এই রচনা লেখার আগে আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অর্থাৎ ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে ফেসবুক বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যে ‘গত বিশ বছরে আপনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশে থিয়েটারকেন্দ্রিক বড় ঘটনা/দুর্ঘটনা কী?’ এই ঘোষণায় অনেক বন্ধু মন্তব্য করেছেন যাদের অধিকাংশই বিদগ্ধনাট্যকর্মী। তাদের অনেকের মন্তব্যে নানা বিষয়ে যেমন ক্ষোভ ঝরেছে, তেমনি অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু অভিমতও ব্যক্ত করেছেন। অধিকাংশের অনুভূতির সাথে আমি একমত। কয়েকজনের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। বলে নেয়া ভালো, তাঁদের মন্তব্যে বন্ধনী অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলো লেখকের।

মুকুল মিয়া
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে থিয়েটারকে পেশা হিসেবে নিলেও বাংলাদেশে থিয়েটারকে পেশার জায়গায় উন্নত করতে না পারা।

দোলন আজিজ
থিয়েটার তার দ্রোহ কিংবা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়েছে, সত্য উচ্চারণে ভয় পায়।

শাহীদুল সোহেল
থিয়েটার উদ্দেশ্য ও আদর্শ হারিয়ে শাসক গোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।

সম্রাট প্রামাণিক
ঘটনা: কাক, জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা।

হুমায়ূন আজম রেওয়াজ
ক্ষমতার আনুকূল্য লাভের ইঁদুর দৌড়ে ক্রমশ ক্ষীণ স্বর আর সীমিত ভূগোলে আবদ্ধ কলহাস্য।

আসলাম অরণ্য
ক্রমেই গ্রুপ থিয়েটারে পারিবারিক আধিপত্য বিস্তার করে সামন্তবাদের চর্চা হচ্ছে; নেতৃত্বের সংকটে নতুন নির্দেশকের জন্য নতুন দল তৈরি হচ্ছে এবং রাজনৈতিক সুবিধা বজায় রাখার লক্ষ্যে পেশাদারী থিয়েটারে প্রবেশ করছে না মহারথিরা।

সাজ্জদ কাদির
ঘটনা: ২০০১ সালের ৩০ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে ‘অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন-১৮৭৬’ রহিত করা হয়। দুর্ঘটনা: ঢাকার মঞ্চ বেইলি রোড (বর্তমানে নাটক সরণি) ও (বাংলাদেশ) শিল্পকলা একাডেমি গ-ির মধ্য থেকে বের হতে না পারা।

জুলফিকার চঞ্চল
বিশ্ববিদ্যালয়-স্কুল-কলেজগুলোতে রিহার্সেল করতে না দেয়া (সম্ভবত তিনি রিহার্সেল রুম সংকটের বিষয়টি বলতে চেয়েছেন), পাড়া-মহল্লায় মঞ্চ করতে হলে থানার অনুমতি নিতে হবে, এমন আদেশ জারি হওয়া। বছর শেষে বিভিন্ন পাড়া মহল্লার অনুষ্ঠান (সম্ভবত নাট্যানুষ্ঠান) বন্ধ হওয়া। থিয়েটারের উদ্দেশ্য ও আদর্শ হারিয়ে শাসক গোষ্ঠীর হাতিয়ারে পরিণত হওয়া।
 
রাসেল আলী
ঘটনা: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন। দুর্ঘটনা: গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন।

দেবাশীষ ভৌমিক
আগে প্রতিটি স্কুলে ও কলেজে বছরে একটি নাটক হতো, এখন আর হয় না।

মরু ভাস্কর
নতুন প্রজন্মকে অভিনয়ের বাইরে অন্যান্য বিষয়, যেমন লাইট, সেট, মিউজিক, স্ক্রিপ্ট ইত্যাদিতে দক্ষ করা হয় নি।

কাজী রোকসানা রুমা
দুর্ঘটনা ১: দেশের যেকোনো সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যুতে বা মানবাধিকারের পক্ষে অধিকাংশ থিয়েটার দলের নিশ্চুপ থাকা। দুর্ঘটনা ২: গত (২০১৮) গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ঘটনা/সংবাদ। দুর্ঘটনা ৩: সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আনু মুহাম্মদ-এর সাথে বাহাস এবং নাট্যপ্রদর্শনী বন্ধ তথা ‘তীরন্দাজ রিপার্টরি’কে এখনও শিল্পকলাতে (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি) নাটক প্রদর্শনীর অনুমতি না দেয়া এবং কোনো কারণ ছাড়াই ‘বটতলাকে’ও দেড় বছর শিল্পকলাতে (বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি) কোনো হল বরাদ্দ না দেয়া। দুর্ঘটনা ৪: এখন পর্যন্ত থিয়েটারকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া হয় নি। (বাংলাদেশ) মহিলা সমিতি ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকেন্দ্রিক নাট্য প্রদর্শনী নিয়েই আমরা পড়ে আছি। ঘটনা ১: বগুড়াতে বিশাল বাজেটে কয়েক’শ নাট্যকর্মী নিয়ে নাট্য নির্মাণ (সম্ভবত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির ‘মহাস্থানগড়’ নাটকটি।)।

আব্দুস শহীদ মিঠু
ঘটনা: অনেকে থিয়েটারকেন্দ্রিক পড়াশোনা করে থিয়েটার করছে। দুর্ঘটনা: এটাকে আমরা পেশা হিসেবে কেউ নিতে পারি নি।

রাজু জোবেদ
থিয়েটার শৃঙ্খলিত। সত্য কার্যকরভাবে বলতে পারছে না।

সাজু আহমেদ
থিয়েটারে দর্শক কমে যাওয়া। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিভিত্তিক থিয়েটার চর্চা।

সৈয়দ ইকবাল
সরকারের তোষামোদ করে থিয়েটারচর্চা করা এবং মুক্ত চিন্তার থিয়েটারচর্চা কম হওয়া।

শুভাশিস ভৌমিক
ঘটনা: রাষ্ট্রীয়ভাবে থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষকতা বেড়েছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে। দুর্ঘটনা: একটি রাষ্ট্রীয় থিয়েটার গ্রুপ গঠনের কথা আমরা এখনো চিন্তা করি নি, যারা দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের নাটকের প্রতিনিধিত্ব করতে পারতো। সব দলের সমন্বয়ে সার্বক্ষণিক নাট্যকর্মীদের নিয়ে গঠিত হতে পারতো সেই দল।

সবশেষ মন্তব্যটি নিতে চাই কবি ও সাংবাদিক আলতাফ শাহনেওয়াজের। তিনি বলছেন: জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে থিয়েটার শিল্পের আত্মসমর্পন; এটাকে কি ঘটনা বলব না দুর্ঘটনা বলব!

এই মন্তব্যগুলো মন্তব্যকারীর নিজস্ব; অনেকের ভিন্ন মতও থাকতে পারে। থিয়েটার অঙ্গনে গত বিশ বছরের পর্যবেক্ষণ থেকে তাদের এই মতামত। এসব মন্তব্যের খুব গুরুত্বপূর্ণ সারমর্মটি হচ্ছে গত এক কুড়ি বছরে যা কিছু তাঁদের কাছে উল্লেখযোগ্য তার অধিকাংশই হতাশার। এরমধ্যে নাটকের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চরিত্রের যে মহিমা, তার অবলোপের মতো হতাশা খুবই প্রণিধানযোগ্য। গত এক কুড়ি বছরে সত্যিই আমাদের থিয়েটার রাজনৈতিক চরিত্রে প্রতিষ্ঠানের কাছে আত্মসমর্পন করেছে। এই হতাশা বেদনার, দুঃখের ও লজ্জার। গুণী অভিনেতা শুভাশিস ভৌমিকের মন্তব্যটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি রেপাটরি আদলে একটি জাতীয় নাট্যদল গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে পেশাদার নাটকের ক্ষেত্রে তা হতে পারতো একধাপ অগ্রগতি।

এই আলোচনা মূলত ‘থিয়েটারওয়ালা’ পত্রিকার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে। বিশ বছরের খতিয়ান তৈরি এই রচনার উদ্দেশ্য না। সময় গতিশীল। গতিসূত্রের মূলকথা পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে সমাজ-বাস্তবতা বদলায়। আর সমাজের এই গতি নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি বা অর্থনীতি। নাট্যাঙ্গন সমাজ-বাস্তবতার বাইরে কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। তাই এই এক কুড়ি বছরের সমাজ-বাস্তবতার সাথে আমাদের নাটকের গতিপ্রকৃতিরও বাঁক বদল হয়েছে। সে বদলে সাফল্যের জয়গান যেমন আছে, আছে ব্যর্থতার বেদনাও। ‘থিয়েটারওয়ালা’ও এই এক কুড়ি বছরে তার বাঁক বদল করেছে। হার্ডপ্রিন্ট মাধ্যম থেকে চলে গেছে অনলাইন মাধ্যমে; বাস্তব-জগত থেকে ভার্চুয়াল জগতে। পত্রিকাটির আড্ডা-বিষয়ক যে আলোকিত অংশ নিয়ে প্রবন্ধের সিংহভাগ আলোচনায় ব্যস্ত থেকেছি, ওয়েবসাইট সংখ্যাগুলোতে সেই আড্ডা-আলাপন-মুখোমুখি আর পাওয়া যাচ্ছে না। থিয়েটার নিয়ে যেসব আয়োজন এতকাল করে এসেছে ‘থিয়েটারওয়ালা’, তারও কোনো উদ্যোগ অনেকদিন ধরেই আর চোখে পড়ছে না। এটাকে ঘটনা নাকি দুর্ঘটনা বলব সে সংশয় আমার থেকেই গেল। তবে ‘থিয়েটারওয়ালা’ বন্ধ হয় নি, সেটি নিশ্চয়ই বড় ঘটনা।

জয় হোক ‘থিয়েটারওয়ালা’র, জয় হোক থিয়েটারের।

মোহাম্মদ বারী ( This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it. ): অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক। সদস্য- অনুস্বর।