Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঢাকা ঢাকা ডাক পাড়ি।। ঢাকা গেছে কার বাড়ি [৪]

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ফরিদপুর টাউন থিয়েটার: কিশোরবেলার মহারঙ্গশালা

বছরে অন্তত একবার দিনকয়েকের মহোচ্ছব ছিল আমাদের। সেই সে কিশোরবেলায়। আমি আর মাহাবুব- পকেট খালি দুই হাভাতে বালক-বন্ধু, সন্ধে থেকে ঘুরঘুর করি টাউন থিয়েটারের সিনেমা হলে কী পরের দিকে জসীমউদদীন মঞ্চের বাইরে। টানা তিনদিনে তিন নাটক। ‘প্রফুল্ল’, ‘দায়ী কে’, ‘কিন্তু কেন’- হাতে লেখা নাকি ছাপানো পোস্টার দেখি দেয়ালে দেয়ালে। কী যে যাদুর বাঁশির কুহক হাতছানি তাতে। ফরিদপুরের মহানটবর যামিনী লাহিড়ী, অনিল কুণ্ড, সুধীর চক্রবর্তী, দ্বিজেনবাবু, কালীপদ কম্পাউন্ডার, মহীউদ্দিন আহমেদ কেবল নন- ঢাকা থেকে আসবে এবার খলিল, চন্দনা, আনোয়ারা। নাটকের নাম ‘সাগর সেঁচা মানিক’। ‘সিরাজোদ্দৌলা’র আলেয়া আর ‘রূপবান’-এর তাজেল- কোন সে মায়া ছায়ালোক থেকে অবতীর্ণ হবে আমাদের এই শহরে। তবে রূপকথার কল্পলোক চাক্ষুস হবে কী করে? নাটকের কার্ড বা টিকিটের নাগাল মেলে কী করে যে! তবু সন্ধে হতে ঘুর ঘুর দুই ফটিক-তারাপদ মঞ্চ মিলনায়তনের দরজায়-জানালায়। যদি কারো দয়ায় মেলে ভেতরে ঢোকার সুযোগ। যতই নাটক শুরুর ঘন্টা বাজে ততই মত্ত মরিয়া নাছোড় রোখ ছুটিয়ে মারে- কোনোমতে কী করে ঢুকি সে রঙ্গনাট্যশালায়! ধন্য আশা কুহকিনী।

কলিকাতা ন্যাশনাল থিয়েটারের সমবয়সি ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের (১৮৭৩) বার্ষিক নাটকের এমনই ছিল হ্যামিলনের বাঁশির কুহক-মদির টান।

সেই থেকে টাউন থিয়েটার রূপকথার আশ্চর্য প্রদীপ আমাদের কাছে। পাকিস্তান আমলে তার কাছ ঘেঁষার ভাগ্য হয়নি নবীন কিশোর-তরুণের। স্বাধীনতা মেলায় সে দৈব ধনশালায় প্রবেশের ছাড়পত্র। বাহাত্তরেই বুঝি আসে সে মাহেন্দ্রযোগ। আমরা যত নাট্যমদ্যপ ছিলাম শহরে- পান্টু দা, গুণী নট পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সেরা অভিনেতা আযাদ ভাই, কানাই দা, ফরিদভাই, মানস বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল-বাবলু-মাহাবুব ঢুকে পড়ি স্বাধীন দেশে ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের প্রথম নাটকে। পরে ‘অন্যছায়া’য় তাতে মহানটেরা কে কে ছিলেন মনে পড়ছে না। যামিনী লাহিড়ী, অনিল কুণ্ড, কালীপদ কম্পাউন্ডার ছিলেন মনে পড়ে- মহীউদ্দিন আহমেদ তখনো বোধহয় পলাতক ছিলেন- পাকিস্তানি সহযোগের দায়ে। আমাদের শহরের শিশির ভাদুড়ী ছিলেন যামিনী বাবু- তাঁর অমন রূপগুণের রাজকীয় নাটকীয় আভিজাত্যে-কণ্ঠস্বরের অতুল মহিমায়। পাকিস্তান আমলে আমি নির্মল ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ শিখতে যেতাম তাঁর দোতলা ঘরে। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অংশগ্রহণের তাড়নায়। স্কুলের অনুষ্ঠান ছাড়া ইঞ্জিনিয়র রাজ্জাক উদ্যোগী হতেন শহরের বড় অনুষ্ঠানটির আয়োজনে। তাতে বুঝি এক রূপনগরের রাজকন্যা নাকি শাপভ্রষ্টা দেববালা নাচতেন। আর তাতেই আকুল হতো আমাদের অমন কৈশোরক অভীপ্সা। অনিল কুণ্ড ছিলেন অর্ধেন্দুশেখর ঘরানার, সেকালে দুর্লভ আন্ডার-অ্যাক্টিংয়ের মহানট এক। দ্বিজেন বাবু-কালীপদ বাবু- আব্দুল মতিন-আব্দুল জব্বার ছিলেন প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা। মহীউদ্দিন আহমেদ নতুনকালের বিকাশ রায় ঘরানার আধুনিক অভিনেতা। মুগ্ধ হয়ে তাঁর অভিনেয় নাটকে কৃৎকৌশল দেখতাম- ‘ডাঃ মরিস আজিজ মরে গেছে- কিন্তু তাঁর প্রেতাত্মা তোমার কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে ঐ দূর থেকে হাসছে... হাঃ হাঃ হাঃ... ফেইস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড।’ বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতায় ঘরছাড়া যার স্ত্রী সেই অর্ধোন্মাদ ডাঃ মরিসের ভূমিকায় অভিনয় করার দুর্লভ সুযোগ পরে ঘটে।

টাউন থিয়েটারের বার্ষিক নাটক ছাড়াও পাড়ায় পাড়ায় নানা ক্লাবের নাটকও তো হতো- বছরে দু-একবার। খাবাসপুর ক্লাব অনেকদিন ধরে রাখে সে ঐতিহ্য। ঝিলটুলির ভিক্টোরিয়া আগেই বন্ধ হয়। গোয়াল চামটে এমন কোনো ক্লাবে হতো নাটক। রাজেন্দ্র কলেজের বার্ষিক নাটক ছিল শহরের বর্ষসেরা এক আকর্ষণ। ‘পাথরবাড়ী’ নাটকের সমতুল্য প্রযোজনা ক’টা হয় বা হয়েছে দেশজোড়া গ্রুপ থিয়েটারে- বলা মুশকিল। তাতে শহরের এক একমেবাদ্বিতীয়ম রাজপুত্র, নায়কবর জহুরুল ইসলামের অভিনয় মহানায়ক উত্তমকুমার-তুল্যই বলা যায়। কেবলি কিশোরমন বা নারীচিত্তহরণক্ষম নয়- তাবৎ দর্শক মনে আজীবন মুদ্রিত হয়ে যেত সেই অভিনয়। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তন্দ্রা চক্রবর্তী, নমিতা কুণ্ড, রথীন সাহার অভিনয়। তাছাড়া কারো বাসায় মায়েদের শাড়ি দিয়ে মঞ্চ তৈরি করে অভিনয় করেনি এমন কিশোর-কিশোরী ছিল কি সেই সে ‘সব পেয়েছির দেশে’র যুগে! স্কুলেও তো হতো নারীবর্জিত শিক্ষামূলক নাটক। আকাশবাণী ছিল তো তাবৎ নাটক-গানের শিক্ষণ-চর্চার একক বিশ্ববিদ্যালয়। তার বলে বলীয়ান হয়ে যত নিধিরামের দলের টিনের তলোয়ারে রাজা-উজির বধ পালা।

শহরের এই প্রায় সর্বজনের নাট্য-সংস্কৃতি উৎসাহ কোথায় গেল, স্বাধীন দেশের কোন মরুপথে হলো হারা বিদিশায়? আমাদের অমন যে বিখ্যাত গ্রুপ থিয়েটার চর্চা-আন্দোলনেও কি ফেরানো গেল সেই হারামণি সমাজ-সংস্কৃতি-শিল্পচর্চার সাধারণ ধারা। শহরে শহরে গ্রুপ তো কম হয়নি- তাতে আগেকার সেই সাধারণ দর্শকের নাগাল মেলে কই!

এতই আমরা হলাম কি ‘আধুনিক’ আর ‘নিরীক্ষামূলক’ ‘ব্যতিক্রমী’ বাতিকগ্রস্ত-অহংকারে ফুলে ঢোল- সবার জন্য নয় বুঝি আধুনিক নাট্যচর্চা।

শতবর্ষ-প্রবীণ টাউন থিয়েটার ধুঁকে ধুঁকে প্রৌঢ়ত্ব বার্ধক্যে জরজর হয়েছে কবে যে সবার অলক্ষ্যে। নবীনেরা দলে দলে ঢুকেও তার ব্যাধি নিরাময় ঘটেনি- তাদেরই যৌবন নিঃশেষিত হয়েছে কী করে কেউ তা ঠাহর করে নাই। একটা কানাঘুঁষা আগেও শুনতাম- এত ‘শ্রী’ কেনো কমিটিতে? এই ‘শ্রীত্ব’ ঘোচানোর লাগাতার লড়াই চলেছে চলছে ‘সব মানুষের’ এই সে স্বাধীন বাংলাদেশে। হতশ্রীর বদলে চাই হাল আমলের মোটাতাজা চেহারাসুরত- তবেই না হালাল হবে নববাংলাদেশি কমিটি।  ব্রিটিশ-পাক ঘরানায় প্রশাসনের হাতে চলে সে। তারই মেজাজ-মর্জি মতো ভোল পাল্টায় তার একটু আধটু। এই যেমন কতকাল পরে উৎসব হচ্ছে। নইলে বছরের পর বছর কেবল তাসখেলা-গল্পগুজব-টিভি-পত্রিকার এক ক্লাবের পরিণতি। বছরে একবার হয়তো পুরনো নাটকের চর্বিত চর্বণ।

সারাদেশের যত শতবর্ষী থিয়েটারেরও একই দশা বুঝি। শিল্পকলা একাডেমিরও দেখি একই হালহকিকত। পাকিস্তান আমলের ‘আর্টস কাউন্সিল’ ঘরানায়। ভোটের জন্য সদস্য করা হয়- আর যতই কেন সরকার পাল্টাক কোনোও নড়চড় হয় না তার চর্চা-চরিত্র। উপরে ভোল কিছু বদলালেও এক-আধজন কর্তা-পরিবর্তন হলেও। ইহা উপনিবেশিকতা- ইহা আমলাতন্ত্র- রাষ্ট্র স্বয়ং যার হাতের পুতুল- শিল্প-সংস্কৃতির বেলা কী করে হয় তার অন্যথা।

লিয়াকত আলী লাকীরও সাধ্য হয়নি তার কোনো মৌলিক রূপান্তরণ। আসাদুজ্জামান নূরও দুর্ভেদ্য এ কেল্লায় হাত দিতে অপারগই হবেন- বলা যায়।

দুই-দুইবার স্বাধীনতায়ও অন্য ফল ফললো কি? তবুও তার মধ্যেও এই উৎসব- এরচেয়ে বেশি আর কী-ই বা চাই!

বিপ্লব বালা: নাট্যশিক্ষক, প্রশিক্ষক ও সমালোচক