Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

‘যমুনা’ নাট্য : বীরাঙ্গনা এক শিল্পীর অন্তর্যাত্রা

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

থিয়েটার ফোকস অক্সফোর্ডের একটি নাট্যদল। প্রবাসী বাঙালি আর তাদের ওদেশীয় বন্ধু নাট্যজন কুশীলব তার। সেলিনা শেলি লিখিত-অভিনীত নাট্য ‘যমুনা’। নাটককার জানান, হতাশা আর ক্রোধ থেকেই এ রচনা। যুদ্ধাপরাধী বিচারে গঠিত ট্রাইবুনাল নিয়ে চলছে যখন বিতর্ক; একাত্তরের গণহত্যা লঘু করতে উদ্যত দেশি-বিদেশি চক্রান্ত। নিজের দেশেও নারীর অস্বীকৃত, নির্বাক, অদৃশ্য অরক্ষিত দশা। ‘যমুনা’র আখ্যান রচনা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জীবন-সংগ্রাম প্রাণিত। এ তার জীবন-কথা ঠিক নয় যদিও। তার নানান সূত্র-খণ্ডের গ্রন্থিত ভাষ্য বরং। এক নারী-মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পীর ব্যক্তিগত লড়াই এই নাটকে উন্মোচিত। উদ্বোধনী প্রদর্শনীর সন্ধ্যায় যে-শিল্পী মুখোমুখি হয় এক দ্বন্দ্বময় দ্বিধায়- সেকি উন্মুক্ত করবে তার অতীত জীবন-সত্য? বন্ধুজন আর পরিবারকে বিপন্ন করার ঝুঁকি নেবে? নাকি নীরব থেকে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করবে আপন অস্তিত্বের?

নির্দেশক মোহাম্মাদ আলী হায়দার জানান, যমুনা-নাম্নী শিল্পীর, যে-কিনা তাঁর শিল্পকর্মে যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি-মৃত্যুর রূপায়ণ করেন- এই নাট্যের কেন্দ্রস্থ সত্তা-স্বরূপ। ভাস্কর্য-সকল আবির্ভূত হয় যেন মঞ্চে। যমুনা নির্দেশকের কাছে হয়ে ওঠে বাংলাদেশ- ভস্ম অপমান-শয্যা থেকে এক নারীর শিল্পী হয়ে ওঠার অভিযাত্রা কোথাও মিলে যায় স্বদেশের বাস্তবতার সঙ্গে। এই দেশ যেমন যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত হয়ে মুখোমুখি হয় অন্তহীন বিরুদ্ধতার। তাই বুঝি এখনও অনায়ত্ত তার ভস্মাধার থেকে উঠে এসে নবজীবন সৃজন- শিল্পে, সঙ্গীতে; যমুনা এভাবে হয়ে ওঠে প্রতীকপ্রতিমা যেমন সে তার বিভঙ্গ বাস্তব থেকে উত্তীর্ণ হয়; শিল্পরূপায়ণে নবীন প্রজন্মও তেমনি নব দেশ-সমাজ সৃজনে ক্ষান্তিহীন।

প্রবাস-জীবন আজ তো এক বিশ্ববাস্তবতা। তা নিয়ে অভ্যস্ত কোনো নীতি-বুলির মানে নেই আর। বরং দেখা যায়, নানা কারণে প্রবাসী হলেও জেগে ওঠে দেশ তাঁদের মনে- আপাত বিস্মৃতির অতল থেকে। ব্যক্তিগত বিপত্তিতে নাজেহাল হয়েও দেশ কোথাও তাদের স্মৃতির পরম নির্ভর হয়ে ওঠে। হারাধনের হারামণি-বৎ হারানিধি মেলে যেন। বুঝি এক ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি। জীবিকার বন্দী পায়ে পায়ে ডানা পায় কখনো বুঝি তার জীবন। নিজেকে হারায়ে খুঁজে ফেরার আত্মদায় অর্জিত হয় এভাবেও বুঝি।- জীবনেরে কবে আর কে রুধিতে পারে শেষ পর্যন্ত, জয় হোক মানুষের- তার অদম্য, দুর্মর জীবন অভীপসার। তাই কি প্রবাসীজনের নাট্যদলের নাম হয় ‘থিয়েটার ফোকস’? তখন একে আর সৌখিন নাগরিক বিলাস মাত্র লাগে না- অস্তিত্বের স্মারক হয়ে ওঠে এ নামকরণ। আর যখন তাদের নাট্য প্রণোদনা স্বদেশের বর্তমান বাস্তব-বিপত্তিতে; যুদ্ধাপরাধী বিচারে গঠিত ট্রাইবুনাল নিয়ে দেশ-বিশ্বজোড়া চলছে তো আরেক একাত্তর, যাকে বলে- কূটনৈতিক যুদ্ধ- দেশে জঙ্গী-সন্ত্রাসের মরিয়া অন্তর্ঘাতের যৌগপত্যে। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধে রক্তবীজ শত্রুর নিত্য রূপান্তরিত বিক্রম। তাই বুঝি নাটককারের মুক্ত ক্রোধ আর সুস্থ ঘৃণাও প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে ‘যমুনা’ রচনায়, রূপায়ণে। একাত্তরে গণহত্যা তার গণধর্ষণও যখন হতে পারে গবেষণা-তাত্ত্বিকতার নস্যাৎকারী প্রতিক্রিয়া। নিজেদের সমাজেও নারীর অধঃস্তনতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বিশ্ব নারীবাদী-মানবাধিকারেরা যার কৃতার্থ দোহার- যাকে বলে ভায়রাভাই।

‘যমুনা’ নাট্যে এক নারী তার ব্যক্তিগত লড়াইয়ে মুখোমুখি হয় আপন অস্তিত্বের সত্য-স্বরূপের। যেন সে হয়ে ওঠে বড় দুখিনী দুয়োরানী এই বাংলাদেশের প্রতীক-পুরাণ। জীবনের সত্যসার ভিন্ন শিল্পে রূপায়িত হয়ে পরে অন্য আর কী-ইবা!- ‘জীবনের প্রতারণা শিল্পে ছায়া ফেলে’ যে। জীবনের অমৃত শিল্প-নন্দন বলহীনের লভ্য নয়। বড়ই নির্মম কঠিন শিল্পের সেই সত্যসার।- সত্য যে কঠিন। তার সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যক্তিগতাও বড় পবিত্র হয় হয়ে ওঠে শোকাগ্নিশিখায়। ‘যমুনা’ নাটকে শিল্পী নারীটি নদীতে ভাসমান দুর্গা-মূর্তির প্রতিমানে খুঁজে পায় যেন নিজেকেই, তার আত্মস্বরূপ- চকিত বিদ্যুচ্চমণে যেন। আদি মাতৃদেবী প্রতিমায় উদ্ভাসিত হয় স্বদেশসত্তা- আর তার আত্মা। এই শনাক্তিকরণ হয়ে ওঠে ‘যমুনা’ নাট্যের মৌল নন্দন-অভিভব। মানবমনের আদি আর্কেটাইপের সংলগ্নতায়। মিথ-পুরাণ হতে পারে কতটা যে চির-চেতাবনি-রূপ-কুরূপ বিরূপ বিশ্ব বাস্তবতার প্রতিযোগী সৃজন প্রতিস্পর্ধায়। ব্যক্তি এভাবেই হয়ে ওঠে পুরাণ- প্রতিমা স্বদেশের সঙ্গে উপমিত সাদৃশ্যে। ধর্মীয় আমূল যত সংস্কারের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে, উল্লঙ্গিয়ে বুঝি এক নন্দন প্রজ্ঞাপারমিতায়।- চিরপ্রবহমান যমুনা নদীটিও যদি তাতে যুক্ত হতে পারতো- সে বড় আশ্চর্য বিস্ময় হতো। তবে যা হয়েছে, তাই যথেষ্ট।

নাট্যদল ‘বটতলা’, ‘দেশ নাটক’ সহায়তা করেছে বাংলাদেশে ‘যমুনা’ মঞ্চায়নে। নাট্যে দেশত্যাগী শিল্পী যমুনা ভাস্কর্য-কর্মে তার পুনর্জন্ম রূপায়ণ করে চলে। তার উদ্বোধনী প্রদর্শনী-পূর্ব প্রদোষকালে ঘটে তার আত্ম-আবিষ্কার, আত্মশনাক্তিকরণ। মুক্তিযুদ্ধকালের দুঃস্মৃতির মুখোমুখি হয় সে। শিল্পে তা প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিত উন্মোচন করবে কি সে- এতদিনে মরণান্তিক অবদমনে ঢাকা পড়ে আছে যে স্মৃতি- বীভৎসা। সত্যের হিরণ্ময় ঢাকনা খুলে মেলে ধরবে কি অন্ধকারের সেই উৎস- যা থেকে উৎসারিত শিল্পের যত আলা? সে বড় কঠিন, কুৎসিত-রূপ উদ্ঘাটন যে। অবমাননার গ্লাণিকর নরকের দহন। বলতে পারবে কি- ‘নরকের দাহ দাও, নরকের আত্মগ্লানি/ হে যমজীবন/ এই নিত্য অপঘাত দূর করো/... আমরা নরকে আছি অথচ সে জ্ঞান নেই মনে? ... কে দেবে ধিক্কার কাকে আজ?’

প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধ-নাট্যে অবমানিত নারী বীরাঙ্গনা নাম নিয়েও করুণায় অবসিত হতে থাকে; মানুষী কোনো ব্যক্তি পরিচয় হারিয়ে হয়ে ওঠে সংখ্যামাত্র। বাস্তব জীবনে, সমাজ-মনে যার কোনোই মানবিক অবয়ব থাকে না। অনিবার্য এক কালচার অব সাইলেন্স-এ ঢাকা পড়ে এহেন মানব-দুষ্কৃতি। যে কূট রণকৌশলে একদিন হয়েছিলো সে ধর্ষণ-যোগ্য নারী-শরীর মাত্র। শত্রুর সে পৌরুষ-বিকার সম্পূর্ণ হয় আপন সমাজ-পরিবারে তার দ্বিগুণ অবমান-দশায়- কঠিন বাস্তব লোকলজ্জার অমানুষিক গ্লাণি ধিক্কারে। বীরাঙ্গনা হয়ে ওঠে হেয়, অবজ্ঞেয় পতিতার পরিচয়-উল্কি। বিজয়-বীরত্বের পুরুষালি অহং-বিবরের জ্যান্ত কবরে পুঁতে ফেলেছি মুক্তিযুদ্ধে তার যত মূল্যের পরিমাপ। এতদিনে যদিও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জুটেছে তার মুক্তিযোদ্ধার। তবু হতে কি পেরেছি আমরা তার গরিমা অনুধাবন-যোগ্য? পারবে কি হতে এই দেশ-সমাজ তার সমকক্ষ- তাকে মানব মর্যাদাদানের কণামাত্র অধিকারীজন? তাই বুঝি একজন ফোরদৌসী প্রিয়ভাষিণী কি রমা দাশ হয়ে ওঠে নিরাপদ স্বীকৃতি-ধন্যা কেবল?

‘যমুনা’ নাট্যে এক নারী মুক্তিযোদ্ধা-শিল্পী উপস্থিত হয় মঞ্চে আমাদের যত অকৃতার্থ নপুংশকতার মুখোমুখি। ছোটবেলায় ছেচল্লিশে কলকাতায় তার দাঙ্গা-দুঃস্মৃতি যদিও তত নাট্য-অভিভব জাগায় না; সে রৌরব হাবিয়া দোজখ মঞ্চ-রূপায়ণে ব্যর্থই হয় বলা যায়। আমাদের সামাজিক মনে যে দুঃস্মৃতি কেবলি সাম্প্রদায়িকতায় কলুষিত। একাত্তরের অবমাননাও নাট্যে তত বাক্সময় হয় না। ভুলে থাকা, মনে না করার প্রতিরোধ-ব্যুহ আমাদের ভেদ ঠিক করতে পারে না।

বরং ভাস্কর্য-সমূহের জীবনায়ন নাট্যভাষায় রূপায়িত হয়। প্রবাসী নবীনারা ভালোই সম্পন্ন করে পুত্তলি-বৎ ভাস্কর্যের চরিত্রায়ণ। যদিও পথনাট্যের সরল রূপায়ণে তা অভিব্যক্ত, মঞ্চস্থ হয়- কোরিওগ্রাফির অভ্যস্ত চলনে। তাছাড়া প্রথমে অস্বস্তি লাগছিলো, দেশেও কেনো ইংরেজি বাচনে সম্পন্ন হবে নাটক? পরে দেখি ভাষার এই দূরত্ব সহায়কই হয়েছে বরং। বাংলা ভাষায় পৌনঃপুণিক অভ্যস্ত অপব্যবহারে জীর্ণ করে ফেলেছি তো তাবৎ মুক্তিযুদ্ধ আখ্যান- বিশেষত নারী-প্রসঙ্গ চর্বিত চর্চায় একঘেঁয়ে করে ছেড়েছি। এখানে ভাষার দূরত্ব তা ঘটতে দেয়নি- শিল্পের এক আড়াল তৈরি করেছে- যাতে করে দূর পথে নিকট হয়ে উঠেছে অধিক অনুভব-গম্য।

ভাস্কর্য-সকল মঞ্চ-রচনায় ভালোই প্রতিবেশ-দৃশ্য গড়েছে। আবহ ধ্বনি-সঙ্গীত বরং তত লাগসই হয়ে ওঠেনি। নাট্যের মূল অভিনেত্রী সাধ্যমতো প্রাণপাত করেছে অভিনয়ে- তার অদক্ষতা, অপারদর্শিতা বরং সহায়ক হয়েছে চরিত্রায়ণে। অধিক পারঙ্গমতা মেকি হয়ে উঠতে চায় তো।

সব মিলে ‘যমুনা’র ক’টি প্রদর্শনী এহেন সন্ত্রাস-কবলিত আরেক একাত্তরে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দিশেহারা নাট্য-পরিস্থিতিতে তা যেন মনে আনে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অকথিত ভাষ্য- অতিকথনের বাচালতায় বাক্যহীনা করে ছেড়েছি যে অমানিতায়, সর্বোচ্চ মূল্য-প্রদায়িকাদের।

‘যমুনা’ হয়ে ওঠেনি যে কেবল অভ্যস্ত প্রচলিত কোনো নারীবাদী আখ্যান-মাত্রও- নাটককার, নির্দেশক ও মূল অভিনেত্রীকে তার জন্যই অভিবাদন করি।

ড. বিপ্লব বালা : শিক্ষক ও সমালোচক