Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

হাবিব তানভির : ভারতীয় নাট্যের এক কিংবদন্তী

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

উপমহাদেশীয় নাগরিক থিয়েটার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সংকটটি বুঝছিল; উপনিবেশ-সূত্রে প্রাপ্ত নাট্য-আঙ্গিকটি স্বদেশে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত নানা নাট্যধরন-রীতির সঙ্গে ঠিক সাযূজ্য সঙ্গত নয়। তাতে করে অভিনেতৃ-নাট্যকার-নির্দেশক-দর্শক উভয়ে এক মৌলিক অভাববোধ জ্ঞাত কি অজ্ঞাতসারে করছিল? যদিচ নবলদ্ধ ইংরেজি শিক্ষা-সংস্কৃতি নতুন এক নাগরিক সমাজের পত্তন ঘটাচ্ছিল; তাতে অধিকাংশ তৃপ্ত-আচ্ছন্ন থেকেছিল দীর্ঘকাল। স্বদেশের সঙ্গে বিভেদ-বিচ্ছেদের অনতিস্পষ্ট প্রক্রিয়া বিষয়ে তত অবহিত তারা ছিলও না বা থাকলেও তাদের এই নবীণ-উন্মদনা হয়ত তেমন ব্যাহত হত না।

তবে বাংলা থিয়েটারে প্রাথমিক পর্যায়েই বিষয়টি অনুধাবন করতে দেখা যায়। মনমোহন বসু এ বিষয়ে মুখ খোলেন সবার আগে। বিষয় ও রীতিতে কী করে এই নতুন খেলনা আমাদের হয়ে উঠতে পারে, তার নানা নিদান খুঁজে ফেরেন। দুই মহাকাব্যের উত্তরাধিকারকে সর্বাগ্রে বিষয়-ভাণ্ডার হিসেবে শনাক্ত করেন তিনি। স্বদেশীয় যাত্রার বিবিধ উপাদানে ভূষিত করতে চান প্রয়োগ-রূপায়ণ প্রকরণে। যাতে জাতীয় যৌথমানস একটা স্বাবলম্বন পেতে পারে। গিরিশচন্দ্রের ভাষ্য ছিল: দর্শকের মর্মাশ্রয় করতে হলে ধর্মাশ্রয় করা চাই। ধর্মীয় পুনরুজ্জীবনের সামাজিক পটভূমি নিশ্চয় এর পেছনে ক্রিয়াশীল ছিল। তার সমূহ বিপদ অবশ্য পরে টের পাওয়া যায়। সেটা যদিও ঐতিহাসিক অনিবার্য বাস্তবতা ছিল। তবে সেতো অন্য প্রসঙ্গ।

শিশিরকুমার ভাদুড়ী অনেক পরে, গতশতকের পঞ্চাশের দশকে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক বলে যাত্রার কথা তোলেন। যদিও তার কোনো প্রয়োগ-রূপায়ণ করতে পারেন নি তিনি। তবে তিনি ছিলেন মিশ্র কলামাধ্যম হিসেবে নাট্যের এক সমন্বিত আদলের প্রথম রূপকার। নাগরিক থিয়েটারের প্রথম নির্দেশকও ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথই বিষয়টিকে সমগ্রভাবনায় অনুধাবন করে তার সৃজনশীল আখ্যান রচনা করেছেন বিবিধ বিচিত্র রূপ-রূপান্তরের মাহাত্ম্যে। উত্তরাধিকারের মানস ধারাপাতের অঙ্গাঙ্গী সংলগ্নতায়। তিনিই তো আমাদের প্রথম এবং প্রধান জাতীয় নাট্যকার।

চল্লিশের দশকে গণনাট্য সংঘ সন্ধান আর সূত্রপাত করে আরেক পন্থার। গ্রাম-নগরের এক বিনিময় মিথষ্ক্রিয়ায়। উপমহাদেশজুড়ে নাট্যের এক বিচিত্রবীর্য স্বদেশযাত্রার উদ্বোধন তাতে ঘটে। যদিও পতন-বন্ধুর সে যাত্রাপথ।

গতশতকের চল্লিশের দশকের শেষ থেকে উপমহাদেশে ‘গ্রুপ থিয়েটার’ চর্চার সূত্রপাত ঘটে। শম্ভু মিত্র রবীন্দ্রনাট্যের প্রয়োগ-রূপায়ণে সম্ভব করে তোলেন এক মুক্তধারা। সেই সূত্রে তিনি ক্রমে সংহত হন ভারতীয় নাট্যের এক অভিভাবনায়। ষাটের দশক থেকে এই ভাবন-বীজ উপমহাদেশজুড়ে রোপিত, ব্যাপ্ত প্রয়োগধারাপাত ঘাটায়। উৎপল দত্তও যাত্রায় উৎসাহী হন।

হাবীব তানভীর এই পটভূমিতে তার নাট্যচর্চায় এক সম্ভাবনার প্রয়োগ রূপায়ণ সম্পন্ন করেছেন। ভারতের নানা অঞ্চলে গ্রাম-শহরের বিচ্ছেদ বাস্তবতা বিবিধ, ভিন্নতর। ভারতীয় সংগীত নাটক আকাদেমি ১৯৭১ সালে ট্রাডিশনাল থিয়েটার নিয়ে এক গোলটেবিল আয়োজন করে। তাতে নানা রাজ্যের দিকপাল নাট্যজন মতবিনিময় করেন। সংস্কৃত ধ্রুপদী নাট্য, নানা অঞ্চলের লোকায়ত রীতিসমূহের সঙ্গে নাগরিক নাট্যের সম্পর্কসূত্র ও তার অভিজ্ঞতা এতে উঠে আসে। হাবিব তানভীর বলেন- ‘স্বদেশীয় যে কোনো আঙ্গিক বেছে নেয়া যায় যাতে অত্যন্ত কার্যকরভাবে প্রকাশ পেতে পারে নাগরিক বিষয়-ভাবনা। এর চেয়ে বেশি আর কোনো যুক্তি দেখানোর প্রয়োজন নেই। তবে কেউ-ই পুনরাবৃত্তি পছন্দ করেন না। ১৯৫৪ সালের ‘আগ্রাবাজার’ প্রয়োজনার পেছনেও আছে লোক-সংস্কৃতির প্রেরণা। তবুও ১৯৬৪ ও ১৯৭০-এর প্রযোজনায় অনিবার্যভাবে কিছু পার্থক্য, কিছু তফাৎ থাকতে বাধ্য। ফোক-ফর্মের ব্যবহারে আমার যে অভিজ্ঞতা তা আমাকে জানিয়েছে প্রকৃত লোক-অভিনেতাদের দিয়ে কাজ করানোর সময় কী করতে হবে। লোক অভিনেতাদের বাদ দিয়ে নাটকে একটা শহুরে চেহারা কেউ দিতে পারে। কিন্তু একজন শহরের নাটককার যদি একই ভাবনায় চলেন, লোক-ঐতিহ্যের কথাটা মাথায় রেখে, লোক-অভিনেতাদের যদি কাজে লাগান তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি অনেক বেশি সুফল পাবেন। লোক-আঙ্গিকের ছবিকে অটুট রেখে সেই আঙ্গিকের রূপান্তরণে তিনি সক্ষম হবেন অনেক বেশি। স্বভাবতই সেই আঙ্গিক আর সেই আঙ্গিক থাকে না। অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুই তার পরিণতি। এই তত্ত্বের ওপরে দাঁড়িয়েই কিন্তু আমাদের অধিকাংশ থিয়েটারকর্মী, এমনকি অসচেতনভাবেই কাজ করে চলেছেন। “‘মিট্রি কা গাড়ি’ করার সময়ে, অথবা ‘আগ্রাবাজার’, চাঁদনি চকের রাস্তায় আমি যখন লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজ করি তখনই এইরকম একটি ধারণায় উপনীত হয়েছিলাম। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নাটক কিন্তু লোক-আঙ্গিক। সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংযোগ সেখানে এই আঙ্গিকের কার্যকারিতা যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক। আমি অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে আজ বিশ্বাস করি, এই পরিস্থিতিতে ঐতিহ্যবাহী নাট্য-আঙ্গিকগুলিকে আরও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে হবে রাজনৈতিক ও সামাজিক নাটকে।”

হাবিব তানভীর ১৯৪৫ সালে বোম্বের গণনাট্য সংঘে একজন অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন। সংঘের নেতৃস্থানীয়জন ব্রিটিশ বিরোধিতার কারণে কারারুদ্ধ হলে তাকে সাংগঠনিক দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৫৪ সালে নয়াদিল্লির হিন্দুস্থানি থিয়েটারে যোগ দেন। একই সঙ্গে চিলড্রেন থিয়েটারে কাজ করেন, সেখানে প্রচুর নাটক লেখেন। এসময় তিনি অভিনেতৃ-নির্দেশক মনিকা মিশ্রর সঙ্গে পরিচিত হন, পরে তাদের বিবাহ হয়। ১৯৫৪ সালেই তার প্রথম বিশিষ্ট প্রযোজনা ‘আগ্রাবাজার’ মঞ্চস্থ হয়। এই নাট্যে তিনি স্থানীয়জন এবং দিল্লির ওখলা গ্রামের লোকশিল্পীদের যুক্ত করেন। জামিয়া মিল্লা ইসলামিয়ার ছাত্ররাও যোগ দেয়। এই সমন্বয় ভারতীয় থিয়েটারে প্রথম দেখা গেল। কোনো নির্দিষ্ট মঞ্চে নয়, অভিনয় অনুষ্ঠিত হয় একটি বাজারে। অদীক্ষিতজন এবং লোকশিল্পীদের এই অভিনব সমন্বয় পরে পরিণতি পায় ছত্তিশগড়ের লোকশিল্পীদের যুক্ত করে। ১৯৫৫ সালে তিনি ইংলন্ডের প্রখ্যাত রয়েল একাডেমি (RADA) তে অভিনয় বিষয়ে শিক্ষা নেন। নির্দেশনারপাঠ নেন ১৯৫৬ সালে ব্রিস্টল ওল্ড ভিক্টোরিয়া থিয়েটার স্কুলে। পরবর্তী দুবছর তিনি ইউরোপের নানা নাট্যক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯৫৬ সালে বার্লিন যান বারটল্ট ব্রেশটের মৃত্যুর কিছু পরে, সেখানে তিনি ৮ মাস ধরে বার্লিন আনসম্বল-এর নানা নাট্য প্রযোজন দেখেন। এটা তার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। নাট্যকর্মে স্থানীয় নাট্যবাচন যুক্ত করার ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে তাকে সহায়তা করে নানা সংস্কৃতির উপকথা ও মতাদর্শ নাট্যে ধারণ করার সৃজনবুদ্ধি খুঁজে পেতেও। উপস্থাপনা ও প্রয়োগকলায় সারল্য অর্জন করে নিরীক্ষায় যথা সামর্থ্যলাভ করেন তিনি। গভীরভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে হাবিব তানভীর ১৯৫৮ সালে দেশে ফেরেন এবং নাট্য-নির্দেশনা সার্বক্ষণিক ক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করেন। শূদ্রক-এর ‘মৃচ্ছকটিক’ অবলম্বনে ‘মিট্রি কা গাড়ি’ ছত্তিশগড়ী রীতিতে নির্মাণ করেন। ৬জন লোকশিল্পী এতে কাজ করেন। এরপর আর তিনি পেছনে ফিরে তাকান নি। মধ্য প্রদেশে ভোপালে ১৯৫৯ সালে পত্তন করেন ‘নয়া থিয়েটার’। ১৯৭০-৭৩ ছিল তাঁর প্রয়োগ-নিরীক্ষাকাল। তাঁর সকল প্রযোজনায় হিন্দী ও ছত্তিশগড়ী ভাষার যুগপৎ ব্যবহার শুরু হয়। স্থানীয় লোকসঙ্গীতরীতি ‘পাণ্ডবাণী’ নিয়েও তিনি কাজ করেন। ১৯৭২ সালে ছত্তিশগড়ী নাছরীতিতে ‘গাঁও কা নাম শ্বশুরাল’ প্রযোজিত করেন। ১৯৭৫ সালের ‘চরণদাস চোর’ ভারতীয় নাগরিক থিয়েটারে অভিনব এক নাট্যপ্রয়োগ। নাটকটি শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িত হয়। এছাড়া তিনি ৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। আটেনবোরার ‘গান্ধী’, ‘ব্লাক এক হোয়াইট’ প্রভৃতিতে।

বাবরী মসজিদ ভাঙন-পরবর্তীকালে ১৯৯০ সালে ধর্মীয় প্রতারণামূলক ঐতিহ্যবাহী ছত্তিশগড়ী নাটক ‘পোঙ্গা পণ্ডিত’-এর নবভাষ্য তুমুল প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করে। যদিও তিরিশের দশকে ছত্তিশগড়ী থিয়েটার আর্টিস্ট এই লোককথা-নির্ভর নাটক করেছিল। এবং তিনিও এটি ষাটের দশক থেকে করে আসছিলেন। সাম্প্রদায়িক সংগঠন আর.এস.এস নানা জায়গায় এই নাট্যের প্রদর্শনীতে বাধা দেয়।

১৯৯৩ সালে শেক্সপীয়রের ‘এ মিডসামার নাইট’স ড্রিম’-এর নবভাষ্য ‘কামদেওকা আপনা বসন্ত  ঋতু কা স্বপ্ন’ অভিনীত হয়। চিকাগো এ্যক্টর এসেম্বল-এর আমন্ত্রণে ১৯৯৫ সালে তিনি আমেরিকায় তার একমাত্র ইংরেজি নাটক  The Broken Bridge মঞ্চস্থ করেন। ২০০২ সালে ভোপাল গ্যাস ট্রাজেডি নিয়ে রচিত রাহুল ভার্মার রচনায় ‘জহরেলি হাওয়া’ নির্মাণ করেন।

সমগ্র নাট্যজীবনে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিবিধ ঐতিহ্যের উপস্থাপন করেন। সংস্কৃত নাট্যকার শূদ্রক, ভাস, বিশাখদত্ত, ভবভূতি যেমন তেমনি ইউরোপীয় ধ্রুপদী শেক্সপীয়র, মলিয়ের, গলডনি; আধুনিক মহাজন ব্রেশট, লোরকা, গর্কি, অস্কার ওয়াইল্ড; ভারতীয় রবীন্দ্রনাথ, আসগর ওয়াজাহাট, শংকর শেস, সফদার হাসমী, রাহুল ভার্মা, প্রেমচাঁদের গল্প। ছত্তিশগড়ী লোককথা তো বটেই।

তাঁর জীবন ও নয়া থিয়েটার নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়- ‘গাওন কে নাওন থিয়েটার’, ‘মোর নাওন হাবিব’।

রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস ও নাটক ‘বিসর্জন’ অবলম্বনে তাঁর রচনা ও নির্দেশনায় প্রযোজিত হয় ‘রাজরক্ত’, ২০০৬ সালে। তিনি তাঁর আত্মজীবনী রচনা করছিলেন ঊর্দুভাষায়। ২০০৯ সালে ৮ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

হাবিব তানভীর সঙ্গীত নাটক আকাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৯ সালে, পদ্মশ্রী ১৯৮৩ সালে, কালিদাশ সম্মান ১৯৯০-এ, সংগীত নাটক আকাদেমি ফেলোশিপ ১৯৯৬-এ, পদ্মভূষণ ২০০২-এ।

১৯৮২ সালে ‘চরণদাস চোর’ এডিনবরা আন্তর্জাতিক নাট্যউৎসবে ফ্রিনস ফার্স্টস এওয়ার্ড অর্জন করে। ২০০৭ সালে ব্রেশট ও লোকপ্রকরণের অভিনব নাট্যবাচন উদ্ভাবনায় তাঁকে সম্মাননা দেয়া হয়।

উপনিবেশ-উত্তর ভারতীয় থিয়েটারের নাগরিক স্বদেশীবাচন আবিষ্কারের দায়পালন অভিযাত্রায় হাবিব তানভীর  অমিত এক সৃজনকর্তা। তাঁর স্বীকৃতি বিশ্বজুড়েই ঘটেছে। তবে নিছক কোনো জাতীয়তাবাদী প্রণোদনায় তা সম্পন্ন হয় নি। স্থানীয় ছত্তিশগড়ী নানা রীতির ভূমিতে সংলগ্ন হয়েই বিশ্বের নাট্য-উত্তরাধিকার আত্মস্থ করে তার সৃজনশীল উদ্ভাবনা অভিনব এক ভারতীয় আন্তর্জাতিক নাট্যভাষ আয়ত্ত করেছে। মুক্ত এক নান্দনিক মনন প্রবর্তনায়ই তা অর্জিত হয়েছে। ভাষার বন্ধনও অনায়াসে উত্তরিত হয়েছে নাট্যের অমিত সামর্থ্য। আঙ্গিকের কোনো জাত্যাভিমানে উদ্বেজিত হয় নি তো তার সৃজনকল্পনা। নাগরিক নানাভাষী দর্শকসাধারণ তাই গ্রহণ করতে পেরেছে সেসকল নাট্য। রাজনৈতিক সামাজিক এক দায়বদ্ধতায় বহুস্তর ভোক্তাসংযোগের অভিপ্রায় থেকেই তাঁর এই স্বদেশীয় নানারীতির সৃজননিরীক্ষা। গণনাট্য সংঘের মৌল জনসম্পৃক্তির এষণা তাই আধুনিক কোনো সৌখিন আঙ্গিকবিলাসে তাঁকে উদভ্রান্ত করে নি। বাংলাদেশে যেমন দেখি দেশজ আঙ্গিকসৃজনের ঘোষণা উপেক্ষা করে চলে দর্শক সাধারণের সঙ্গে বিনিময় সংযোগের প্রাথমিক দায়টি। অনায়াসে ঘোষিত হয়, কোনো দর্শক তার আর অন্বিষ্ট নয়- এমনি সৃজনবিলাস ক্রমস্ফীত বাংলাদেশের মঞ্চে। দেশ- সমাজ-সময়-দর্শক কিছুই যেন আর তত বিবেচ্য থাকছে না।

আমরা ঢাকায় তাঁর ‘আগ্রাবাজার’ ও ‘চরণদাশ চোর’ দেখি নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের এক উৎসবে গত শতকের শেষ দশকে। অচেনা এক জনসমাজ আমাদের অজানা ভাষায় মঞ্চে প্রবল জীবন্ত, বাক্সময় হয়ে ওঠে মানবিক ক্রিয়াদির বিচিত্র স্বরসুরে, চলনবলনের ক্ষিপ্রতায়। চলচ্চিত্রের মতোই যেন এক আন্তর্জাতিক নাট্যভাষার নন্দন আস্বাদ তাতে করা গেল। ‘আগ্রাবাজার’ যেন বা প্রাকৃতিক সামাজিক নাট্য-আখ্যান হয়ে ওঠে। ‘চরণদাশ চোর’ লোকবাচনমুদ্রায়, ক্ষিপ্র নাট্যগতির তুখোড় উপস্থাপনে বিহ্বল করেছিল।

মনে হয়, উপমহাদেশে বাঙালি অধিক পরবাসিতায় বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় নানা রাজ্য-অঞ্চলের নাগরিকজন তুলনায় সম্পৃক্ত স্বদেশীয় সংস্কৃতি মানসে। নান্দনিক যোগসূত্র খুঁজে পেতে তাই বুঝি সম্ভপর হয়েছে তাদের। তার পেছনে রাজনৈতিক নান্দনিক দায়ের শক্ত পাটাতন ছিল বলেই।

বাঙালি সত্যিই বুঝি বাগাড়ম্বতায় যত পটু, নানা তত্ত্বনীতি ঘোষণায় তেমনি পারঙ্গাম। জনমানসযুক্ততায় কোথাও মৌলিক কোনো গলদ, খামতি কিংবা অন্তঃসারশূন্যতা বুঝি রয়েই গেছে।

কলকাতার বাঙালি উচ্চম্মন্যতায় গত শতকের আশির দশকে সর্বভারতীয় নাট্যসিদ্ধি দেখে প্রথম ধ্বস নামে। হুঁস ফেরে। আর আমরা আত্মমগ্নতায় অন্ধ উট পাখি, নাকি আজিকার বাজারি চাতুর্যে ডগমগ স্বেচ্ছাবন্দী?

ড. বিপ্লব বালা: নাট্যশিক্ষক, নাট্য-সমালোচক