Full premium theme for CMS
নটবর কুমার রায়
Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..
বড় অভিনেতা ছিলেন কুমার রায়। পরে হয়ে ওঠেন ভালো নির্দেশকও। উপমহাদেশীয় নাগরিক নাট্যের প্রধান পুরুষ শম্ভু মিত্র সৃজিত দৃশ্যকাব্যের সবসেরা এক অভিনেতা তিনি, যেমন কিনা তৃপ্তি মিত্র বা অমর গাঙ্গুলী। নাগরিক মঞ্চের বাংলা-বাচন উদ্ঘাটন করেন শম্ভু মিত্র- বহুরূপী আর রবীন্দ্রনাথের যৌগপত্যে। কুমার রায় ছিলেন সে নন্দন রূপায়ণের সমর্থ এক নটবর। বহুরূপীর শুরুর দিকেই দলে আসেন বন্ধু ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। তারপর রয়ে যান আমৃত্যু- ছন্নছাড়া সৃজনমত্ত ঋত্বিক চলচ্চিত্রের মোহিনী-মায়ায় ছেদ ঘটান মঞ্চ-ক্রিয়ায়।
কুমার রায়কে প্রথম দেখি রবীন্দ্রভারতীতে নাট্যশিক্ষক হিসেবে। শম্ভু মিত্র তখন বিভাগীয় প্রধান। রুদ্রপ্রসাদ খণ্ডকালীন। সফেদ কী নানা বর্ণাভ গেরুয়া পাঞ্জাবি আর ধূতি পরিহিত আধুনিক বাঙালি-বাবু যেন কুমার রায়। সৌখিন গুল্ফবিন্যাসে সুশ্রীকায়, নটসুলভ মার্জিত চলন-বলন। কমবয়সি একাগ্রমুগ্ধতায় আমরা তখন শম্ভু মিত্রাভিমুখী নিবিষ্ট নিমগ্ন। কুমার রায়কে সমীহ সৌজন্যে দূরে রাখি, তত ঘেঁষি না কাছে। অনতিতরুণ রূদ্রপ্রসাদ তার ক্ষিপ্র স্মার্টনেসে টেনে ধরেন- ‘এবং ইন্দ্রজিত’ নাট্য বিশ্লেষণে সত্ত্বাসংকটের ব্যক্তিগততায় যুক্ত করে করে। সেই টানে নিজেকে ‘নান্দীকার’-ভুক্তি ঘটাই। রবীন্দ্রভারতীতে সপ্তাহে দুদিন ছিল শম্ভু মিত্রের মুখোমুখি হবার টান-টান উত্তেজনা;- ‘প্রসঙ্গ নাট্য’ থেকে তার লেখায় ভাববাদিতা উল্লেখ করে প্রশ্নাতুর জিজ্ঞাসা যৌবনের তুমুল স্পর্ধায়। তারই প্রবল তাকদে মিত্র মহাশয়ের সঙ্গে ট্যাক্সিগামী হয়ে পার্কসার্কাস পার্কের ৬ তলায় তাঁর আত্মবাসধামে পোঁছে যাওয়া- মাসে ১/২ বার করে। সারা মাসজুড়ে তারই প্রস্তুতি চলতো, জিজ্ঞাসার জ্যাবদ্ধ ছিলায় সটান শিকা পাকানোয়।
কুমার রায়ের আধুনিক মঞ্চ, নির্দেশনা কী বাচনচর্চার ক্লাসেও তত স্পৃষ্ট হই না- যেন অসম এক সতীর্থজনের হাস্যকর নাবালক অহংদূরত্বে। একবার রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা ও রাণী’ নাট্যের বাছাই পর্বে সদ্যঅর্জিত মিত্রীয় আনুনাসিক উচ্চারণে তাঁর সপ্রশ্রয় মৃদুমুচকি হাসি- হয়তো মনে পড়ে যায় তাঁরও কবেকার আগেকার সমিল আবিষ্ট স্মৃতি।
ততদিনে দেখে ফেলেছি ‘রাজা অয়দিপাউস’, ‘রাজা’, ‘পুতুল খেলা’। একেক নাট্যে কুমার রায়েরও বিস্ময়মুগ্ধকর অভিনয়। ‘অয়দিপাউস’-এ কোরাসের দলপতির একক উচ্চারণের সম্ভ্রমময়তা বা ‘রাজা’-য় ঠাকুরদার শালীণ গ্রামীণ স্বতঃস্ফূর্তি আর ‘পুতুল খেলা’-য় নীরব উত্তীয়-বৎ প্রেমিকের অসুস্থপাত্তুর অভিমান-কম্প্র নিবেদন। সত্তাসমগ্রের তিনটি সত্যবাচন অভিনয়ে রূপ পায়। পরে ক্যাসেটে শোনা ‘রক্তকরবী’-র গোসাঁই আর ‘বিসর্জন’-র রাজা গোবিন্দমাণিক্য-র অভিনয়ে উপর্যুক্ত বিস্ময় বিস্তীর্ণ করে। অভিনয়ে মানবস্বভাবের বিবিধ বিচিত্র সম্প্রকাশের এমত নান্দনিক মুক্তি চির ঋণী করে রাখে।
তারপর শম্ভু মিত্র অনুপস্থিত, এমনকি তৃপ্তি মিত্র শাওলী মিত্র-হীন ‘বহুরূপী’তে কুমার রায়ের নির্দেশিত নাট্যমালা কতক দেখেছি। ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘কিনু কাহারের থেটার’, ‘গ্যালিলিও’ বা ‘সিন্দুক’। নাট্যের নান রূপায়ণ, সমর্থ প্রযোজনাও। তবে তাঁর ব্যক্তিগত সেই অভিনয়-মান আর অর্জিত হয় না। সৃজন-তার কোথায় যেন ছিঁড়ে গেছে। অভিনয় নির্দেশক-নির্ভর তো শেষ পর্যন্ত। ব্যক্তিগত সম্ভ্রমও তিনি হারিয়ে ফেলেন হয়তো, অন্তত আমাদের কারো কারো কাছে।
সর্বশেষ ‘স্যাস’ পত্রিকা-মারফত জানতে পারি, ক্ষমতার আরেক যক্ষপুরীর সংঘটনা ‘বহুরূপী’তেও। শম্ভু মিত্রকে ‘রক্তকরবী’-বৎ পুতুল-রাজা সাজানোর অসম্ভব অপ-তৎপরতার ক্লেদাক্ত কাহিনী। মিত্র-মহাশয় স্বভাব সঙ্গত মর্যাদায় সরে আসেন তাঁরই স্বপ্নকল্প সংগঠন থেকে, নিরুপায় এক বাধ্যতায়ই। যার সুফলভোগী কিনা ভালোমানুষীতায় সদা হাস্যমুখী নাট্যগুরুর একান্ত মুগ্ধভক্ত কুমার রায়। শম্ভু মিত্রকে ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটক দেখাতে মরিয়া হয়ে নির্মম মিথ্যাচারিতায় বাঁধেনি যার। তাই কি এসে গিয়েছিল তাঁর বাচন-চলনে মেফিস্টো-প্রতিম আদল কিংবা ‘চাঁদ বণিকের পালা’-র গুরু বল্লভাচার্যের আত্মপ্রতারক শঠতা, চতুরতা?- ‘জীবনের মিথ্যা শিল্পে ও স্বভাবে ছায়া ফেলে’- এই এক চিরসত্যের অনিবার্যতায়?
তবু, হয়তো এই নটও এক নিমিত্তমাত্র- জীবনের রঙ্গমঞ্চের কূট ক্রিয়ার অমোঘ সে নিয়তিরে তুমি রুধিবে কেমনে?
শিল্প ও বাস্তবের কঠিন এক সমগ্রতার সম্মুখে তাই বিনত মন- ‘উত্তরে থাকো মৌন’।
ড. বিপ্লব বালা : নাট্যশিক্ষক। নাট্যসমালোচক