Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বহু-অক্ষীয় অনিত্য পৃথিবীর বাস্তবতা : প্রত্যাখ্যানের ধারায় বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলা নিরীক্ষণ

Written by সৈয়দ জামিল আহমেদ.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

অনুবাদ : শাহমান মৈশান
‘বিক্রিয়া’-এই প্রবন্ধে গৃহীত যুগপৎ একটি শব্দ ও শব্দের সাধারণ দ্যোতনা-অতিক্রান্ত পরিভাষা। কেননা পশ্চিমা ইংরেজিভাষী দুনিয়ায় ‘উন্নয়ন নাট্য’ তথা সমাজের পরিবর্তনকামী নাট্যের বৈশিষ্ট্যময়তাকে সূচিত করে এমন দার্শনিক আবহে গঠিত শব্দ ‘ইন্টারভেনশন’-এর আদলে হস্তক্ষেপ, মধ্যবর্তিতা,  অন্তর্বর্তিতা, নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি প্রচলিত শব্দ উপেক্ষা করে, ক্রম-বিনির্মাণময় অর্থময়তার কারণেই বিক্রিয়া শীর্ষক পরিভাষাটি গৃহীত হয়েছে।  বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে বিশেষ্য পদ বিক্রিয়ার প্রথম ভুক্তিতে চারটি অর্থ নির্দেশ করা হয়েছে। যথা : ১. বিকৃতি ২. বিকার ৩. পরিবর্তন ৪.রূপান্তর। ‘বিকার’ ও ‘বিকৃতি’ উভয় শব্দের অর্থ হিসেবে অভিধানে উল্লিখিত হয়েছে অস্বাভাবিক অবস্থা, অস্বাভাবিক পরিবর্তন, অসুস্থতা, ব্যাধি, খারাপ হওয়া, পচা, পরিবর্তনে জাত বস্তু, রূপান্তর প্রভৃতি। আবার ‘পরিবর্তন’ শব্দটির অর্থ হিসেবে উল্লেখ আছে রূপান্তর, বদল, অবস্থান্তর,  সংস্কার প্রভৃতি। ‘বিক্রিয়া’ শব্দ-পরিভাষার বিচিত্র অভিব্যক্তির  সূত্র সন্ধানে  মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান  প্রণীত যথাশব্দ শীর্ষক ভাব-অভিধানে আরো উল্লিখিত হয়েছে বিশ্লেষণ, ব্যবচ্ছেদ, বিগঠন, বিঘটন, ভাঙন, অবিন্যাস, বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম, অরাজকতা, আত্তীকরণ, সংশোধন, বিকাশ, প্রগতি, প্রভৃতি (রহমান ১৯৯৩: ১৫, ১৮-১৯, ৪০)।

শব্দ-পরিভাষাটির বিচিত্র অভিব্যক্তির সূত্র সন্ধানে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, ‘বিক্রিয়া  যেমন সংস্কার, সংশোধন, বিকাশ, প্রগতি প্রভৃতির পরিবর্তন বা অবস্থান্তর বা রূপান্তরণকে সূচিত  করে তেমনি একই সাথে অস্বাভাবিক পরিবর্তন, ব্যাধি, পচন, অবিন্যাস, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা ও অনিয়মকেও দ্যোতিত করে। ‘ক্রিয়া’ শব্দটির সঙ্গে বিশেষ, বৈপরীত্য প্রভৃতি ভাবসূচক সংস্কৃত ‘বি’ উপসর্গ যোগে গঠিত ‘বিক্রিয়া’ শব্দের পরস্পর বিরোধী, পরস্পর অন্তর্বিষ্ট, পরস্পর সমান্তরাল উপরোক্ত অর্থাবলির বিচিত্র অভিব্যক্তির  বাস্তবতা নির্মিত হয়। আবার ‘ক্রিয়া’ শব্দের সঙ্গে যদি প্রাধান্য, আধিপত্য ইত্যাদি সূচক সংস্কৃত উপসর্গ ‘অধি’ যোগ করা হয় তাহলে গঠিত হয় নতুন শব্দ ‘অধিক্রিয়া’। পরস্পরবিরোধী পরিবর্তনমূলকতাকে সূচিত করতে সক্ষম ‘বিক্রিয়া’ ‘অধিক্রিয়ায়’ পরিণত হয়। কেননা শব্দের পক্ষপাতহীন বস্তুনিষ্ঠ অর্থের কোথাও অস্তিত্ব নেই। ‘বিক্রিয়া’ এবং ‘অধিক্রিয়া’ দুটোই ক্রিয়ার বিশেষ্য বা নাম পদ। এর সঙ্গে ক্রিয়া সম্পাদনকারী এবং তার লক্ষ্য, মাধ্যম, মতাদর্শ, ভাষা, ভূগোল, ধর্ম, তথা জীবন ও সংস্কৃতির বহুস্তরায়িত রাজনীতি জড়িয়ে থাকে। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ বানরের পিঠাবন্টন শীর্ষক লোকজ গল্পের অবতারণা করা যায়। এক টুকরা পিঠা নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত দুই কাককে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতার আশ্বাস দিয়ে এক বানর অবতীর্ণ হয় বিক্রিয়াশীল ভূমিকায়। দাঁড়িপাল্লার দুই দিকে টুকরো পিঠাকে দুই খণ্ড করে এমনভাবে সে রাখে যাতে বাম পাল্লা হেলে যায়। তখন ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য ডান পাল্লা থেকে ছিড়েঁ নিয়ে বানরটি নিজে খায়। ফলে, ডান পাল্লা আবার ভারসাম্য হারায়। এভাবে ভারসাম্যের অজুহাতে ক্রমাগত ডান-বাম পাল্লা থেকে বানরটি পিঠা খেতে খেতে প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে। অবশেষে ঝগড়ালিপ্ত কাক দুইটির জন্য প্রায় কিছুই থাকে না। তাই ‘বিক্রিয়া’ এবং ‘অধিক্রিয়ায়’ পরিণত ‘বিক্রিয়া’ বস্তুনিষ্ঠ নয়, আত্মনিষ্ঠ। এই আত্মনিষ্ঠতা অধিক্রিয়ারূপে কিংবা স্বতন্ত্ররূপে সর্বদাই উৎপাদন করে ‘প্রতিক্রিয়া’।  

[এখানে ছবি যাবে]

দ্যোতিত অর্থসমূহের বিবিধ সমস্যাগ্রস্ততা নিয়ে আবির্ভূত হয় ‘বিক্রিয়া’, কেননা পরিভাষাটি প্রতিরূপায়ণ দ্বারাও অমীমাংসিত। তাই এ সংক্রান্ত সচেতন অবগতির প্রয়োজনে গ্রিনের বক্তব্য ধার করে বলা যায়, সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি ও সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে  বিক্রিয়া পরিভাষাটির অর্থ কী, তা নির্ভর করে কীভাবে ও কার দ্বারা এটি অর্থায়িত হয় (Green 1992:3, উদ্ধৃত Thorpe 1998)। এই সচেতনতা সৃষ্টি হলে বিক্রিয়ার ধারণাটিকে পুনর্বার নিরীক্ষা করা যায় নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করে। যেমন রাহনেমা (Rahnema 1997 : 395) জিজ্ঞাসা করেন :

যে কোনো জীবন, এমনকি নিজের জীবন সম্পর্কেই যখন প্রায় কিছুই জানি না, তখন অন্যের জীবনে বিক্রিয়া করার আমরা কে, আমিই বা কে? এমনকি সেই সকল ক্ষেত্রেও, যেখানে আমরা বিক্রিয়া করি ভালোবাসা ও দায়িত্বের তাগিদে- সেখানেও এটা আগেই কীভাবে বলা সম্ভব যে, আমাদের বিক্রিয়া পর্যায়ক্রমে আমাদেরই প্রত্যাশার বিপ্রতীপ ফলাফল বয়ে আনবে না?

‘বিক্রিয়া’ ধারণাটির দেহে অমোচ্য অভিলেখে রচিত এই প্রশ্নাবলি ও সমস্যাসমূহ রাজনৈতিক সংগ্রামের এক নিখুঁত ক্ষেত্রসীমাকেই চিহ্নিত করে।

এ কথা বলার পরেও যে কেউই প্রশ্ন তুলতে পারেন, যেমন গৌতম বুদ্ধ সর্প-দংশনে শিকার এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয়ে প্রশ্নকিত হয়েছিলেন- “করবো কি করবো না”, এই বহুদৃষ্ট প্রশ্নে কেউ কি নিবিড় অনুধ্যানে নিমজ্জিত থাকবেন? নাকি সদা কল্যাণকামীদের  মতো ভালোবাসা ও করুণায় সিক্ত হয়ে বিক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হবেন? এই সব ক্ষেত্রে ক্রিয়া “পবিত্র ভূমির সীমায় অবস্থিত” (Rahnema 1997:395)। তাই পূর্বে উল্লেখিত ‘বি’, ‘প্রতি’, ‘অধি’ ক্রিয়া এবং বানরের পিঠাবন্টন সংক্রান্ত সমস্যাগ্রস্ততা পাস কাটিয়ে, ‘পবিত্র ভূমির’ অনির্ধারিত সীমানায় অবস্থিত প্রতারক ক্ষেত্র- যা প্রগতিশীল ব্র্যান্ডের বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলার সুজলা সুফলা ক্ষেত্র হিসেবে ভ্রম হয়- আমি এই প্রবন্ধে অনুবেক্ষণের ইচ্ছা পোষণ করি।

বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলার ‘প্রগতিশীল’ ব্র্যান্ডের ঠিকুজি সহজেই লব্ধ হতে পারে যদি আমরা ফিরে দেখি কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহার যেখানে বুর্জোয়া শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতি আক্রমণের সূচনা করে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেন:

আর আপনাদের শিক্ষাটা! সেটাও কি সামাজিক নয়? সামাজিক যে অবস্থার  আওতায় শিক্ষালাভ চলে, তা দ্বারা সমাজের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ হস্তক্ষেপ [বিক্রিয়া] মারফত, স্কুল ইত্যাদির মাধ্যমে কি সে শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় না? শিক্ষা ব্যাপারে সমাজের হস্তক্ষেপ [বিক্রিয়া] কমিউনিস্টদের উদ্ভাবন নয়। তারা চায় শুধু হস্তক্ষেপের [বিক্রিয়ার] প্রকৃতিটা বদলাতে, শাসকশ্রেণীর প্রভাব থেকে শিক্ষাকে উদ্ধার করতে (মার্কস ও এঙ্গেলস ২০০৮:৪৩)।    


পুনর্বার ইলেভেনথ থিসিস অন ফয়েরবাখ (ফয়েরবাখ সংক্রান্ত ১১তম পর্যালোচনা)-এ ফিরে যেতে পারি  যেখানে কার্ল মার্কস তর্ক তুলে ধরে বলেন, দার্শনিকগণ বহুমাত্রিক উপায়ে জগতকে শুধু ব্যাখ্যাই করেছেন, একে [এখন] পরিবর্তন করাই মুখ্য বিষয় (Marx 1977: 158)। পরিবর্তনকামী এই দর্শনের সূত্রে বার্টল্ট ব্রেখট  বিবৃত করেন যে, নাট্যকলা দার্শনিকদের জন্য একটি বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে ; কিন্তু শুধুমাত্র সেই দার্শনিকদের জন্য যারা জগতকে ব্যাখ্যাই করবেন না, একে পরিবর্তনও করবেন (Brecht 1964 : 72)। ওয়াল্টার বেনজামিন আরো সুনির্দিষ্টভাবে শিল্পীর কর্তব্য নির্ণয় করে বলেন, শিল্পী উপস্থাপন নয়, লড়াই করবে; দর্শক হিসেবে দর্শন করবে না, সরাসরি বিক্রিয়ায় যুক্ত হবে। তার  নিজের কাজের প্রদত্ত বিবরণীর মধ্যে সে এই কর্তব্যকে সংজ্ঞায়িত করবে (Benjamin 1978 : 223) । এই তর্করেখা অনুসরণে এটাই অনুমিত হয়েছে যে, বিক্রিয়াশীল কর্মী এমন কৌশল গ্রহণ করবে যা অধিপতিশীল মতাদর্শের পণ্যায়ন প্রতিরোধ  করে এবং রাষ্ট্রের হেজিমনির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয় (Barbar 2004)

মার্কসবাদী দর্শনের ধারা অনুসরণে, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের পরিবর্তে ‘অত্যাচারী-অত্যাচারিত’ যুগ্মবৈপরীত্যকে প্রধান প্রত্যয় হিসেবে গ্রহণ করে, পাওলো ফ্রেইরে (Freire 1996) সচেতনায়ন দ্বারা ‘নীরবতার সংস্কৃতির’ অচলায়তন  ভাঙার উদ্যোগ নেন। একই ধারায় অগাস্তো বোয়াল (Boal 1979) ‘বিপ্লবের মহড়ার’ লক্ষ্যে উদ্ভাবন করেন ‘দর্শকাভিনেতা’। পূর্বোল্লেখিত ‘পবিত্র ভূমির সীমায় অবস্থিত’ অনির্দিষ্ট এই জ্ঞানতত্ত্বীয় ভিত্তি থেকে উন্নয়ন নাট্য ও বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলার বিচিত্র আঙ্গিকগুলো পরিচালিত হয়। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের পরবর্তী পর্যায়গুলোতে এই ভিত্তিটি পরীক্ষিত হবে ‘বিক্রিয়ার’ ধারণা পুনর্লিখন প্রক্রিয়ার  মাধ্যমে এবং এর কার্যকারিতা নিরীক্ষিত হবে চারটি প্রত্যয় যথা: ‘অনিত্য’, ‘সামাজিক নাট্য’, ‘বহু-অক্ষীয় স্থানিকতা’  এবং ‘নিম্নবর্গের প্রতিরোধ’  বিশ্লেষণের মাধ্যমে।

অনিত্য

বৌদ্ধদর্শনে মুখ্যভাবে স্বীকৃত হয় অনিত্যতা অর্থাৎ কালের নিরবধি প্রবাহে সাধিত পরিবর্তনশীলতা। কাল হলো পরিবর্তনের নিয়ামক একক। বিশ্বসংসারের সবকিছুরই এ এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে, সরবাং অনিত্যাং- সবকিছুই নিয়ত পরিবর্তনশীল। আর তাই ‘বাস্তব’ গঠিত নয়, ক্রমাগত গঠনশীল; এটি নিশ্চল নয়, সতত সচল। দক্ষিণ এশীয় দর্শনে উপনিষদীয়-ব্রাহ্মণ্যবাদী ‘আত্মা’-মতবাদের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ মেরুতে বৌদ্ধবাদী চিন্তার অবস্থান। উপনিষদীয়-ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তায় বাস্তবতা গঠিত হয় সত্তা বা আত্মার ধারায়, যে সত্তা নিত্য ও অনন্য, যা বহির্মণ্ডলীয় পরিবর্তনশীলতার কেন্দ্রে স্থিত, যার সাথে আত্মা অসম্পৃক্ত কিংবা  ক্ষীণভাবে সম্পৃক্ত (Murti 1998 :10)। কিন্তু এদিক থেকে বৌদ্ধদর্শন আত্মাকে অস্বীকারের মাধ্যমে প্রতীয়মান করে যে, অন্তর্গত এবং নিত্য সত্তা বলে কিছু নেই, সমস্তই সতত পরিবর্তনশীল (ibid) অর্থাৎ অনিত্য।  

বৌদ্ধদর্শনের এক শাখা ‘প্রাসঙ্গিক মাধ্যমিক’ মতে, তিনটি মৌলিক পন্থার নির্ভরশীলতায় প্রপঞ্চ অস্তিত্ব লাভ করে। এই তিন মৌলিক পন্থাগুলো যথাক্রমে: (ক). কার্যকারণ ও শর্তাবলী (খ). সমগ্রের সাথে এর গাঠনিক উপাদানগুলোর সম্পর্ক, এবং (গ). মানসিক গঠন, গুণ আরোপন অথবা চিহ্নায়ন। সুতরাং অজ্ঞ বিশ্বাসের বিপরীতে আমরা দেখতে পাই, স্বকীয় ও স্বাধীন অস্তিত্ব নয়, প্রপঞ্চের পরম প্রকৃতি হলো এর নির্ভরশীলতা ও সম্পর্কযুক্ততা (Mansfield 1998)। আর যদি প্রপঞ্চ স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল হয় তাহলে বস্তুসমূহ হবে নিত্য, কারণ সেক্ষেত্রে সত্তাগতভাবে সেগুলো হবে অন্য প্রপঞ্চ হতে স্বাধীন এবং যেকোনো মিথস্ক্রিয়ার  প্রভাব-রহিত । এমনকি সেই বস্তুনিচয় প্রভাবিত করতেও হবে অক্ষম,  কেননা তখন সেগুলো হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ ও স্বয়ংকৃত (ibid)।  কিন্তু মানবিক অভিজ্ঞতায় এটি মিথ্যা প্রতীয়মান হয়। কেননা বস্তু ও কর্তার স্বাধীন অস্তিত্বের অনুপস্থিতির কারণেই কেবল বস্তু ও কর্তা পরস্পর সুচারুরূপে কার্যশীল হতে সক্ষম।

এটা যদি গ্রহণযোগ্য হয় যে, প্রপঞ্চ মৌলিকভাবেই নির্ভরশীলতা-সম্পর্কের একটি পরিবর্তনশীল সমষ্টি, তাহলে বলা যায়, নশ্বরতা আর পরিবর্তন তাদের মৌলিক স্তরে অন্তর্বিষ্ট। অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ হলো, এই সংজ্ঞায়িত সম্পর্ক, পরস্পর নির্ভরশীলতা ও তাদের ক্রমাগত পরিবর্তনশীল আন্তঃসম্পর্ক এমনই সর্বব্যাপী যে, সকল বস্তু আর কর্তাই নশ্বর, নিরন্তর বিকাশপ্রবণ, বিবর্ধনশীল এবং বিলীয়মান। সুতরাং আত্মনিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ উভয় প্রকার অস্তিত্বে রূপান্তর আর পরিবর্তন অন্তর্বিষ্ট (Mansfield 1998)। হোর্হে লুই বোর্হেস (Borges 1970 : 269) যেমন বলেন, ‘‘সময় হলো সেই পর্দাথ যার দ্বারা আমি নির্মিত। সময় এক নদী যা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় , কিন্তু আমিই  তো সেই নদী। সে এক বাঘ যা আমাকে গ্রাস করে, কিন্তু আমিই তো সে ব্যাঘ্র। এ তো সে আগুন যা আমাকে দগ্ধ করে, কিন্তু আমিই সে অগ্নি’’। এই চিত্রকল্পসমূহ চমৎকারভাবে হেরাক্লিটাস তাঁর পরিবর্তনশীলতার তত্ত্বের ব্যাখ্যায় প্রয়োগ করেন: একই নদীতে কেউই দ্বিতীয়বার অবগাহন করতে পারে না,  কোনো নশ্বর বস্তু একই অবস্থায় দ্বিতীয়বার স্পর্শও করা যায় না (অংশ ৪১, দ্রষ্টব্য Schechner 2002 : 22)। সুতরাং সচেতন ও স্বকীয় সঙ্কল্পশক্তির প্রয়োগ ব্যাতিরেকেও সমুদয় বস্তু ও সর্বজনই সদা-সর্বদা একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল ও তরল সংশ্রয়ের- প্রবহণের- উপাদানমাত্র।    

সচেতন বিক্রিয়ার সম্ভাব্যতা অস্বীকার না করেও এটা অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ যে, বিক্রিয়াকারী কর্তা, যে বিশ্বাস করে সে একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতা-সম্পর্কের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল, প্রকৃতপক্ষে সে একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল নির্ভরশীলতা-সম্পর্কের সমষ্টির বিরুদ্ধেই কার্যশীল যা একটি প্রবহণপ্রবণ অবস্থার অংশমাত্র। এমনকি কর্তা যদিও সকল বিরোধিতা অতিক্রম করতে সফল হয় এবং সে তার কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধনও করে, তথাপি শেষ পর্যন্ত এই সাধিত পরিবর্তন নিরন্তর পরিবর্তনশীলতার বলস্রোতে ভেসে যাবে। সুতরাং ‘পরিবর্তন’ও অনিবার্যভাবেই পরিবর্তনশীল।

সামাজিক নাট্য

ভিক্টর টার্নার ফ্রম রিচুয়াল টু থিয়েটার শীর্ষক গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, প্রতিটি সামাজিক ‘ব্যবস্থার’  অন্তর্গত রয়েছে একটি প্রাধান্য-পরম্পরা ‘বিন্যাস’, যেমন: গোত্র, পরিবার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দল, সম্প্রদায়, বর্ণ, পেশাজীবী গোষ্ঠী ইত্যাদি। এই বিন্যাসসমূহ বা দলসমষ্টির প্রতিটি, নিজস্ব স্বার্থ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায়, বিপরীতমুখী স্বার্থে অবতীর্ণ অপর দলসমষ্টির বিরোধিতার মুখোমুখি হয়। এই দ্বন্দ্বকে গণ্য করা যেতে পারে দুই পক্ষের বিরোধ হিসেবে, যার এক পক্ষ হিসেবে চি‎িহ্নত হতে পারে ‘অনির্ধারণ’ (যেমন : ইচ্ছা, সম্ভাব্যতা- যেটা ‘হতে পারে’ বা ‘হওয়া উচিত’) এবং অপর  পক্ষ, ‘নির্ধারণ প্রকৃতি’ (যেমন: নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো যা সমাজে বন্ধন সৃষ্টি করে কিংবা সমাজের গাঠনিক উপাদানগুলোকে একটি সামগ্রিক ঐকতানে সুসংহত করে)। ‘অনির্ধারণ’ ও ‘নির্ধারণ প্রকৃতির’ এই বিরোধের ফলশ্রুতিতে ক্রমেই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি নির্মিত হতে থাকে। টার্নার দ্বন্দ্বের এই ধরনকেই অভিহিত করেন ‘সামাজিক নাট্য’।

টার্নার দেখান যে, ক্রিয়ার একটি সার্বজনীন প্রক্রিয়ায় সামাজিক নাট্যের এই দ্বন্দ্ব চার স্তরে সংঘটিত হয়। দ্বন্দ্ব  সংঘটনের প্রথম স্তর হলো ‘চ্যুতি’- যেখানে অসন্তোষ প্রকাশ্য রূপ লাভ করে। একটি অধঃক্ষেপণ ক্রিয়ার মাধ্যমে ‘চ্যুতি’ রূপান্তরিত হয় দ্বিতীয়  স্তরে। এই স্তরে সৃষ্ট মারাত্মক পরিস্থিতি সামাজিক ঐক্যের সমগ্রতা কিংবা আংশিকতা হলেও করে হুমকিগ্রস্ত এবং ‘সংকট’ স্বপ্রকাশ্য হয়। ফলশ্রুতিতে, ‘প্রতিকার্য’ স্তরটি অতিদ্রুত সংকটের সুরাহা ও সংশোধনের উদ্যোগ  নেয় এবং ঐক্য পুনর্স্থাপনে সচেষ্ট হয়। এটি সাধারণত বিচারিক পদ্ধতির রূপ পরিগ্রহ করে যেমন : আদালত, শান্তি-আলোচনা, অনানুষ্ঠানিক ব্যক্তিগত পরামর্শ, সালিশ, আনুষ্ঠানিক বৈঠক, রাজনৈতিক কিংবা সামজিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ইত্যাদি । যদি সংশোধন প্রক্রিয়া সফল হয় এবং দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তিও ঘটে, তথাপি সামাজিক কাঠামো প্রশ্নের মুখে পড়ে অথবা সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে সমগ্র সমাজটাই পরিবর্তিত হয়। আর এর ফলে ‘নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো’র মধ্যে সূচিত হয় এক গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু যদি সংশোধন ক্রিয়া অকার্যকর হয়, যদি দ্বন্দ্বে অবর্তীণ ব্যক্তিবর্গ বিরোধ নিষ্পত্তি ও চ্যুতি পরিগঠনে ব্যর্থ হয়, তাহলে সৃষ্ট এক স্থায়ী ‘বিভাজন’ একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের অবতারণা করে।

টার্নার কর্তৃক অভিহিত ‘সামাজিক নাট্য’ সমাজের যন্ত্রণাগর্ভ এক পরিস্থিতির ভেতর থেকে উদ্ভূত হয়। আর এতে দৃষ্ট হয় যে, ‘নিয়মতান্ত্রিক কাঠামো’ সমাজের ‘বিরাজমান পরিস্থিতি’র কোনো একশিলা পাথরস্তম্ভ নয়- এটি বরং নির্মিত ও পুনর্নির্মিত হওয়ার এক ধ্রুপদী প্রক্রিয়া। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে বৌদ্ধদর্শনের মাধ্যমিক ঘরানাসঞ্জাত যুক্তির প্রত্যয়টি পুনর্যৌক্তিকতা লাভ করে যে, সবকিছুই সদা-সর্বদা একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল  সংশ্রয়ের অন্তর্ভুক্ত উপাদানমাত্র। অধিকতর গুরুত্বপূর্ণভাবে এটি অনুধাবনযোগ্য যে, ‘সামাজিক নাট্যে’র তৃতীয় পর্যায় হিসেবে কথিত ‘প্রতিকার্য’ মূলত একটি আত্মবাচক কার্যসাধন-পদ্ধতি যা সংকটময় তাবৎ পরিস্থিতি এবং এর সাথে যুক্ত সমুদয় কার্যসম্পাদকগণের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করে। এই পদ্ধতির কাজ মূলত সংকটের মোকাবিলা করা- সংকটের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনার মাধ্যমে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা থেকেও অর্থবহতা নির্মাণ করা। বারবারা মেয়ারহোফ-উত্তরকালে টার্নার উল্লেখিত সংকটের অবনমনের লক্ষ্যে সূচিত বিচারিক, ধর্মীয় বা অপর কোনো পদ্ধতিকে অভিহিত করছেন ‘সামষ্টিক আত্মবাচকতা’ হিসেবে- যে উপায়ে একটি দল প্রবৃত্ত হয় অনুবেক্ষণে, রূপায়ণে, অনুধাবনে, এবং অবশেষে সচেষ্ট হয় আত্মকর্মে (Turner 1982 : 85)। এ হলো নিবিড় চিন্তন ও সমস্যায়নের সময়- এতে চলে পুনর্নির্মাণ ও বিশ্লেষণ। সকল আঙ্গিকের পরিবেশনা বা পারফরমেন্স এই পর্যায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন  করে থাকে। এক্ষেত্রে টার্নারের বক্তব্য হলো :   

নাট্যাভিনয়, পুতুল নাচ ও ছায়ানাট্য, নৃত্যনাট্য ও পেশাদার গল্পকথনসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের পরিবেশনার মাধ্যমে  অনুসন্ধান করা হয় একটি সমাজের দুর্বলতাগুলো, নেতৃবৃন্দের প্রতি জবাবদিহির আহবান জানানো হয়, দীর্ঘলালিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাস স্খলিত হয়, বৈশিষ্ট্যমূলক দ্বন্দ্ব চিত্রায়িত হয় ও এর থেকে পরিত্রাণের রূপরেখা প্রস্তাবন হয় এবং জ্ঞাত পৃথিবীতে সেই সমাজের বর্তমান পরিস্থিতির একটি সাধারণ সমীক্ষা উপস্থাপন হয় (Turner 1982: 11)

এই বিশ্লেষণে,  বিচারিক ও ধর্মীয় প্রক্রিয়ার এক অতিবর্ধিত কিন্তু কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয় নাট্যকলা। কেননা এর মধ্যে আইনি-ক্রিয়া ও ধর্মীয় ক্রিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য বিধৃত থাকে। আমাদের গভীর মনে প্রায়শ উদিত প্রশ্নের মোকাবিলায় দেখি নাট্যকলা তদন্ত  করে, বিচার  করে, এমনকি শাস্তিও বিধান করে। নাট্যকলা  প্রশংসা করে, অলোকসামান্য দৃষ্টান্ত সংঘটন করে এবং একটি ‘অভিসম্বন্ধ-পরিধি’ও নির্ধারণ করে। তদনুযায়ী, নাট্যকলা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করে, নিরন্তর পরিবর্তনশীলতায় অবগাহিত মানবিক অস্তিত্বকে এটি নিরীক্ষণ করে এবং বৈধ করে ।

টার্নারের বিশ্লেষণ যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে স্বল্পবুদ্ধি দিয়েই অনুধাবন সম্ভব যে ‘প্রতিকার্য’ স্তরটি মূলত অন্তস্থিত এক বিক্রিয়া-সাধন পদ্ধতি। অর্থাৎ বিক্রিয়া সদা-সর্বদাই বিক্রিয়াবাদী কোনো কর্তার ইচ্ছাশক্তি-অতিক্রান্ত এক সামাজিক প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত।   অতএব, নাট্যকলার সমস্ত আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগতভাবেই বিক্রিয়াবাদী।

বহু-অক্ষীয় স্থানিকতা

পূর্ববর্তী যুক্তি-তর্কসমূহ আমাদেরকে ফিরিয়ে নেয় কর্তাভিত্তিক অবস্থান-গ্রহণ সংক্রান্ত প্রশ্নে ও বানরের সমস্যাগ্রস্ত বিক্রিয়ায়, কিন্তুু প্রত্যাবর্তন করা প্রয়োজন সেই সুজলা-সুফলা প্রতারক ভূখণ্ডে যেখানে ‘প্রগতিশীল’ বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলার একটি সুনির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ফলিত শিল্পকর্ম বিচরণ করে  ‘উন্নয়ন নাট্য’ অভিধায়। প্রেন্টকি ও সেলমান (Prentki and Selman 2000 : 8) এবং এরভেন (Erven 1992:13) প্রত্যেকেরই অভিন্ন মতৈক্য হলো যে, পাওলো ফ্রেইরের দর্শন, বিশেষত ‘মুক্তির অনুশীলনরূপে শিক্ষা’, এমন  একটি মৌল ক্ষেত্র প্রস্তুত করে যার ওপর উন্নয়ন নাট্যের অধিকাংশ ‘স্বপ্ন-সৌধ’ সমূহ নির্মিত হয়েছে। পেডাগজি অব দ্য অপ্রেসড বা অত্যাচারিতের শিক্ষা শীর্ষক সুপ্রসিদ্ধ ও গভীর প্রভাববিস্তারী গ্রন্থে ফ্রেইরে এমন একটি প্রক্রিয়া চিহ্নিত করেছেন যার মাধ্যমে অত্যাচারিতরা ঘুরে দাঁড়াতে এবং নিজেদের কর্তায় রূপান্তরিত করতে সক্ষম হতে পারে বলে মনে করা হয়।  

‘অত্যাচারী’ এবং ‘অত্যাচারিত’- এই শ্রেণিকরণ থেকে গৃহীত ‘অত্যাচার’ প্রত্যয়টি ফ্রেইরিয় দর্শনে প্রকৃতপক্ষে কোন অর্থকে দ্যোতিত করে? মৃত্যু-উত্তর ফ্রেইরের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলির ভাষায় তার দুই ঘনিষ্ট সহযোগীর নিবিড় পর্যবেক্ষণে ব্যক্ত হয়:

আধিপত্য ও অত্যাচারের মৌল প্রকাশ হিসেবে বর্ণবাদ, লিঙ্গবাদ অথবা শ্রেণি-শোষণকেই চিহ্নিত করেন [ফ্রেইরে]। কিন্তু তিনি এটাও মনে করেন যে, ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক অধিভুক্তি, জাতিগত পরিচয়, বয়স, আকৃতি এবং শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার বিচিত্র অঙ্গনেও অত্যাচার বিদ্যমান থাকে (Gadotti and Alberto 2002)

অতএব, এটাই প্রতীয়মান হয় যে, জেন্ডার, শ্রেণি ও বর্ণই হচ্ছে ফ্রেইরের প্রাথমিক ধারণাগত বর্গ। তবুও, কেউ যদি ফ্রেইরের পেডাগজি  গ্রন্থটি পুনরায় পাঠ করেন তাহলে এর জেন্ডার-অসংবেদনশীলতায় মারাত্মক বেদনাহত হতে পারেন। পেডাগজির কিছু পরিচ্ছেদে যখন তিনি অত্যাচারীদের ‘অধিপতি শ্রেণি’ (Freire 1996: 40) ও ‘অধিপতি অভিজাত’ এবং অত্যাচারিতদের ‘জনগণ’ হিসেবে অভিহিত করছেন তখন স্পষ্টতই এক নির্ভুল মার্কসবাদী কন্ঠস্বর শোনা যায়। তিনি বলেন, অভিজাত অধিপতিদের অস্তিত্বের অনিবার্য প্রয়োজনেই, তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে অত্যাচারিত জনগণ গঠিত (১৯৯৬ : ১১২)। অত্যাচারিতদের দ্যোতিত করতে তিনি অপর কিছু শব্দসমষ্টিও ব্যবহার করেছেন, যথা: ‘জীবনের অবনমন’ এবং ‘ধরিত্রীর হতভাগ্য’ (১৯৯৬:১১৪)।

ফ্রেইরের গ্রন্থগুলো নিরীক্ষায় পরিদৃষ্ট হয় যে, তাঁর দর্শনে ‘অত্যাচার’ প্রত্যয়টি দোলাচল ও অনির্দিষ্টতা দ্বারা আক্রান্ত।  কারণ এটি জেন্ডার, শ্রেণি, বর্ণ, কিংবা সাংস্কৃতিক ব্যবধানের মতো সুনির্দিষ্ট বর্গের প্রতি কেন্দ্রীভূত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে না। আবার পরিব্যাপ্তি দ্বারাও আক্রান্ত। কারণ এটি সম্ভাব্য সকল বর্গকেই অন্তর্ভুক্ত করতে তৎপর। পেডাগজি  গ্রন্থে  ফ্রেইরে বলছেন, প্রায়োগিক অর্থে অত্যাচার হলো পোষ-মানানো (১৯৯৬:৩৩)। প্রভুর চৈতন্যের প্রতি দাসগ্রস্ততাই শোষিতদের বিশিষ্টতা দান করে (১৯৯৬:৩১)। এই বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে তিনি হেগেল উদ্ধৃত করে বলেছেন, চৈতন্যের বিপরীতধর্মী দুটি আঙ্গিক বা ধরন রয়েছে। একটি স্বাধীন যার পরম স্বভাব হচ্ছে আত্মতা। অপরটি পরাধীন, অন্যের জন্য বেঁচে থাকাই যার নিয়তি। প্রথমটি হলো প্রভু অথবা ভূ-স্বামী, আর শেষেরটি হলো ভূমিদাস (Hegel 1910: 182)

ফ্রেইরিয় চিন্তার কেন্দ্রীয় প্রত্যয় এই যুগ্মবৈপরীত্যভিত্তিক কৌশলের সমস্যা হলো, শেষ পর্যন্ত এটি এমন একটি ব্যাখ্যামূলক পদ্ধতি হয়ে ওঠে যা মূলত কৃত্রিম পূর্ণাঙ্গতার মোড়কে আবৃত। এক্ষেত্রে যুগ্মবৈপরীত্যের দুটি বিচ্ছিন্ন অক্ষের মধ্যবর্তী পরস্পরের প্রতি  প্রবিষ্টশীল কোনো ক্ষেত্রই স্বীকার করা হয় না। অত্যাচারী-অত্যাচারিত এই যুগ্মবৈপরীত্যকে যদি উপনিবেশিক পরিপ্রেক্ষিতে নিরীক্ষা করা হয়, তাহলে সাম্রাজ্যবাদী ‘কেন্দ্র’ দ্বারা অত্যাচারিত উপনিবেশিক ‘প্রান্ত’ সংক্রান্ত একটি ছদ্ম-আখ্যানের মডেল নিমিষেই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ভৌগলিক ছদ্ম-আখ্যান হিসেবে কেন্দ্র-প্রান্ত ভিত্তিক যুগ্মবৈপরীত্যবাদের একটি যৌক্তিক অভিব্যক্তি ঘটে এমন কিছু সমস্যাগ্রস্ত তথা উদ্ভট যুক্তির আশ্রয়ে যার মধ্য দিয়ে দ্যোতিত হয় যে, উপনিবেশের সকল মানুষই প্রান্তিকায়িত আর সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রের কোনো মানুষের পক্ষেই প্রান্তিকায়িত হওয়া সম্ভব নয় (Ashcroft et al : 1995: 213)। যুগ্মবৈপরীত্যবাদের এই সমস্যা সংক্রান্ত এক বিশ্লেষণে অবতার ব্রাহ (Brah 1996 : 184) বলেন:

[এর] সবকিছুই অবলীলাক্রমে অনৈতিহাসিক ও বিশ্বজনীন নির্মাণরূপে অনুমিত হতে পারে। ফলে কোনো এক নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবির্ভূত এক যুগ্মবৈপরীত্য, সেই ক্ষেত্রের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কার্যাবলি ছদ্মাবরণে আবৃত করে ফেলতে সাহায্য করে মাত্র।  অর্থাৎ, যা প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠান, ডিসকোর্স ও অনুশীলনের ফলাফলমাত্র, সেগুলো ধ্রুব ও ইতিহাস-অতিক্রমী বিভাজন হিসেবে প্রতিরূপায়িত হয়ে যায়।      

এ বিষয়ে সচেতনভাবে জ্ঞাত হওয়া জরুরি যে, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের পরিচয় যে কোনো বদ্ধচিন্তায় স্থিরীকৃত সত্য থেকে অনেক দূরত্বে অবস্থান করে। এই পরিচয় গঠিত হয় প্রাত্যহিক জীবনের বস্তুগত আধারের অন্তঃস্থলে- গঠিত হয় সে সকল প্রাত্যহিক গল্পে যা আমরা আমাদের কাছে কথন করি এককভাবে এবং সামষ্টিকভাবে (Brah 1996 : 183)। নয়া-উপনিবেশিক বিশ্বায়িত  এই পৃথিবীতে, অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের যুগ্মবৈপরীত্যের নিশ্চল এক জড়রেখার দুই প্রান্ত বরাবরই শুধু ‘অত্যাচার’ ক্রিয়াশীল নয়। যেমন, জি-৮ নামে সংগঠিত দেশগুলো এবং দারিদ্র্য-পীড়িত বাংলাদেশ, নেপাল ও  ভুটানের মতো দেশগুলোর মধ্যবর্তী ক্ষেত্রে ভারতের মতো দেশগুলোর অবস্থান। এই মধ্যবর্তী দেশগুলো তাদের সুনির্দিষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যময়তায় অত্যাচারী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, ভূমিহীন কৃষকশ্রেণি চিহ্নিত হতে পারে অত্যাচারিত হিসেবে আর তাদের অত্যাচারী হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে উঠতি বণিক বুর্জোয়াশ্রেণি। কিন্তু ভূমিহীন কৃষকশ্রেণির মধ্যেও একাধিক অত্যাচারী-অত্যাচারিত সম্পর্ক চিহ্নিত করা যায়। যেমন: মুসলমান এবং হিন্দু (যেক্ষেত্রে ধর্মের ভিত্তিতে অত্যাচার সক্রিয় হয়)। আবার ‘নিম্ন’ উপবর্ণের হিন্দু যেমন চাষা-ধোপা এবং অপেক্ষাকৃত ‘উচ্চ’ উপবর্ণের হিন্দু  যেমন  কৈবর্ত  (যেক্ষেত্রে সামাজিক-ধর্মীয় স্তরবিন্যাসের ভিত্তিতে অত্যাচার সক্রিয় হয়)। পুনর্বার, নারী এবং পুরুষ (যেক্ষেত্রে ধর্মীয় ও শ্রেণিপার্থক্য নির্বেশেষে শুধু  জেন্ডার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যাচার সর্বব্যাপ্ত হয়ে ওঠে)। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, বাংলাদেশে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার সর্বপ্লাবী ধারায় কল্পিত রাজনৈতিক সম্প্রদায় (Anderson 1983:7) বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চাকমাদের সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। আর একইভাবে, জি-৮ রাষ্ট্রগুলো সৃষ্টি করে ক্ষুদ্রজাতিসত্তা, শ্রেণি, জেন্ডারভিত্তিক অত্যাচারের জাল। এটি অবতারণা করা জরুরি যে, অত্যাচারের এই জাল ‘বিকেন্দ্রিভূত’। এই বিকেন্দ্রিভূত বাস্তবতায়, একটি মাত্র পর্বতচূড়া কিংবা একটি সুনির্দিষ্ট কাঠামোর পরিবর্তে, সদা পরিবর্তনশীল সম্পর্কের প্রক্রিয়াস্বরূপ দৃষ্ট হয় অত্যাচার। আর অত্যাচারের মহাপ্রভুর আবাস কেবল হোয়াইট হাউস, ক্রেমলিন কিংবা তোরাবোরা পাহাড় নয়- শেষোক্ত দুটিরই পতন হয়েছে আর আমরা এখন প্রথমোক্তটির পতনের প্রতীক্ষায়- বলা বাঞ্ছনীয়, অধীর আগ্রহে- প্রহর গুনছি।

উন্নয়ন নাট্য সংক্রান্ত বিশ্লেষণাত্মক অনুধাবনের লক্ষ্যে উপনিবেশিক-সাংস্কৃতিক অধ্যয়নে নিরত সারা সুলেরির ভাষাকে পুনর্বিন্যাস করে বলা যায়:

যদি [উন্নয়ন নাট্য] যুগ্মবৈপরীত্যবাদকে উপেক্ষা করতে চায়, যেটি এর নিজস্ব পার্থক্যগত উপলব্ধির ভেতর ক্ষয় সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এর প্রয়োজন হলো, [ফ্রেইরিয়] দর্শন দ্বারা প্রভাবিত [অত্যাচারের ] একশিলা ভিত্তিক বিশ্লেষণ অতিক্রম করতে সক্ষম এমন এক বিকল্প ভাষা নির্ণয় করা। [...] [অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের] মধ্যকার যুগ্মবৈপরীত্যমূলক জড়ত্বের নিরীক্ষণের বদলে বরং- যেটি   অন্তর্গতভাবে একটি ইউরোকেন্দ্রিক কৌশল- [উন্নয়ন নাট্য] অধিকতর অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে সক্ষম হবে যদি এটি আধিপত্য ও আনুগত্যের মধ্যকার বিভাজক রেখার জড়ত্বকে ভেঙে দিতে পারে (Suleri 1995 : 112)

অত্যাচারী-অত্যচারিত- এই এক-অক্ষীয় যুগ্মবৈপরীত্যকে প্রত্যাখ্যান করা জরুরি- কারণটি যেমন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের (Spivak 1990 : 120) পর্যবেক্ষণে প্রমূর্ত হয়ে ওঠে: প্রতিটি সামাজিক-রাজনৈতিক ও মনো-দৈহিক প্রপঞ্চই সংগঠিত হয়, বয়নবদ্ধ হয় অজস্র গতিপ্রবাহ দ্বারা যেগুলো বিভঙ্গ, যেগুলো ধারাবাহিকতাহীন ও লক্ষ্যহীন, যেগুলো তাদের ইতিহাসকে অন্তর্গতভাবেই বহন করে এবং যার কোনো একটিও আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তাই এক-অক্ষীয় যুগ্মবৈপরীত্যবাদের পরিবর্তে ‘বহু-অক্ষীয় স্থানিকতা’র (Brah 1986:205) ধারণাকেই সক্রিয় করা অপরিহার্য। কেননা এটি স্বীকার করে বহু বর্গের যুগপৎ অবস্থান, যেমন: শ্রেণি, জেন্ডার, বর্ণ, ক্ষুদ্রজাতিসত্তা, যৌনতা, ধর্ম, ভাষা, বয়স, এবং এমন ভঙ্গি যার মধ্যে এই দ্যোতকগুলোর একটির সাথে আরেকটি ক্রমে ক্রমে জড়িয়ে যায় ক্ষমতার গ্রন্থিলতায় (Brah 1996 : 185)

ফ্রেইরিয় দর্শনে ক্ষমতা সমীকৃত হয় প্রতিষ্ঠান ও সংশ্রয়ের সাথে যা মানব জীবনের সামাজিক ও ব্যক্তিক কার্যক্রমের প্রত্যেকটি স্তরকেই নিয়ন্ত্রিত করে, পরিচালিত করে। এই সূত্র ধরে, তিনি পেডাগজি গ্রন্থে এক বিপ্লব-উত্তর অবস্থায় অত্যাচারিত ও বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের ‘ক্ষমতায় গমন’, ‘ক্ষমতা গ্রহণ’ (১৯৯৬ : ১১৬-১১৮), ‘ক্ষমতায় আসীন’ (১৯৯৬ : ১০৮ ,১১৮), ‘ক্ষমতা প্রয়োগ’ সম্পর্কে আলোচনা করেন- যেখানে সংলাপে অবতীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে অত্যাচারী অত্যচারের ক্ষমতাকে বর্জন করে (১৯৯৬ : ১০৭)। তাঁর দর্শনে ঐক্য, সহযোগিতা ও সংগঠনের মাধ্যমেই অত্যাচারিতরা ক্ষমতা অর্জন ও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। কিন্তুু ক্ষমতার জটিলতাপূর্ণ প্রকৃতি সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে অনুধাবিত হতে পারে যদি এটি ধারণা করা হয়, প্রথমত, বহুমুখী শক্তি-সম্পর্ক হিসেবে যা অন্তর্নিহিত থাকে সেই মণ্ডলে, যেটিতে তারা ক্রিয়াশীল এবং যেটি তাদের নিজস্ব সংগঠনকে বিধিবদ্ধ করে। দ্বিতীয়ত, একটি প্রক্রিয়া হিসেবে, যা অনিঃশোষিত সংগ্রাম ও সংঘর্ষমূলক বিরুদ্ধতার মাধ্যমে তাদেরকে রূপান্তর করে, সবলায়ন করে কিংবা তাদেরকে উল্টে ফেলে। তৃতীয়ত, আলম্ব হিসেবে যার মাধ্যমে শক্তি-সম্পর্কগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত একটি শৃঙ্খল বা পদ্ধতি গড়ে  তোলে, অথবা বিপরীতে, বিয়োজন ও দ্বন্দ্ব হিসেবে যা একে অপরকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। শেষত, কৌশল হিসেবে যেখানে তারা পরিণতি লাভ করে, যার সাধারণ নকশা  অথবা প্রাতিষ্ঠানিক স্ফটিকীকরণ সংস্থিত থাকে রাষ্ট্রযন্ত্রে, আইনের সূত্রবদ্ধতায়, বিচিত্র সামাজিক হেজিমনির মধ্যে (Foucault 1984 : 92-93)

একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতা হিসেবে, অস্তিত্বের সকল স্তরে অত্যাচারের বহুধাভিত্তিক অক্টোপাসিয় আঘাত ও অভিঘাত সম্পর্কে কোনো প্রশ্নেরই অবকাশ নেই। ‘তৃতীয় বিশ্বের’ বাস্তবতায় যে কারো জীবনের প্রত্যেকটি মুহূর্তই এই বহুমুখী আঘাতে-অভিঘাতে বিদীর্ণ হয়। কিন্তু যুগ্মবৈপরীত্যভিত্তিক সরল বিভাজন দ্বারা এই শতধাবিভক্ত অভিঘাতপূর্ণ অতাচারের বাস্তবতার বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হওয়াটা হবে অর্বাচীনতা। বরং, অত্যাচারের বিশ্লেষণ করা উচিত হবে বহুমুখী শক্তি-সম্পর্কের ফসল হিসেবে, অনিঃশেষিত সংগ্রাম ও সংঘর্ষমূলক বিরুদ্ধতার ফলাফল হিসেবে, আলম্ব-শৃঙ্খল হতে উৎপন্ন ক্ষরণ হিসেবে। আর এই বিকেন্দ্রিভূত জালভিত্তিক ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় আমরা প্রত্যেকেই নিপতিত, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। অবশেষে আমাদের চোখের তারায় একটি প্রশ্ন জ্বলে ওঠে: এমন কোনো অত্যাচারী আছে, যে একইসাথে অত্যাচারিতেরও যন্ত্রণা ভোগ করে না, অথবা এমন কোনো অত্যাচারিত আছে কি, যে একই সাথে অত্যাচারীও হয়ে ওঠে না?

নিম্নবর্গের নীরবতা ও প্রতিরোধ

উন্নয়ন নাট্যের অপর একটি গভীর ও প্রভাবপূর্ণ উৎস হলো অগাস্তো বোয়ালের থিয়েটার অব দ্য অপ্রেসড (১৯৭৯) বা অত্যাচারিতের নাট্য। পেটা, টিয়েটার এরেনা (দ্রষ্টব্য Erven 1992), নাইজেরিয়ার আবু কর্মশালা (দ্রষ্টব্য Etherton 1982), দারুস সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণনাট্য প্রক্রিয়া (দ্রষ্টব্য Mlama 1999), লেসোথোর মারোথলি নাট্য (দ্রষ্টব্য Mda 1993), বাংলাদেশের থিয়েটার সেন্টার ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের গণনাট্য কর্মসূচি (দ্রষ্টব্য বকুল ২০০১) সহ পৃথিবীর বহু স্থানে উন্নয়ন নাট্য ভিত্তিক কর্মকাণ্ডে অনুসৃত হয়েছে বোয়াল-উদ্ভাবিত এই বিশিষ্ট নাট্যপদ্ধতি। বোয়ালিয় পদ্ধতির কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হলো “দর্শকাভিনেতা” (Boal 1992: xxx), যাকে “সকর্মক দর্শক” (Schutzman and Cohen-Cruz 1994 : 238) হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বোয়ালের বিশ্লেষণ মতে, ব্রেখটের মনোযোগের প্রধান ক্ষেত্র হলো দর্শকের চিন্তা। ব্রেখটিয় ক্ষেত্র হতে আরো এক ধাপ এগিয়ে বোয়াল জোর দেন কর্মের প্রতি যেখানে কর্ম থেকে চিন্তা বিচ্ছিন্ন নয়। এই অনুপ্রেরণায় বোয়াল দর্শকের ‘প্রকৃত’ ভূমিকা সংক্রান্ত দর্শনে উপনীত হয়ে বলেন, নাট্যিক প্রপঞ্চে জড়সত্তা নয় দর্শক, বরং কর্তা, কুশীলব, নাট্য ক্রিয়ার রূপান্তরক (Boal 1979 : 122)। তাঁর নিজের ভাষায়, অত্যাচারিতের নাট্য একান্তভাবে কর্মে ব্রতী হয়: চরিত্র (অথবা অভিনেতার) প্রতি দর্শক কোনো দায়িত্ব অর্পণ করে না, তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে ক্রিয়া অথবা চিন্তা করতে। বিপরীতে, সে নিজেই মুখ্যচরিত্রের দায়িত্ব আলিঙ্গন করে, নাট্য ক্রিয়া পরিবর্তন করে, সমাধানের পথ নিরীক্ষা করে, পরিবর্তনের পরিকল্পনা আলোচনা করে- সংক্ষেপে, [বাস্তব জীবনে] সত্যিকারের কর্মের লক্ষ্যে নিজেকে প্রশিক্ষিত করে (Boal 1979 : 122)

যখন ‘মুক্ত’ দর্শকাভিনেতা ফোরাম থিয়েটারে ‘কর্মের সূচনা’ করে (Boal 1979 : 122), তখন তারা অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের মধ্যকার যুগ্মবৈপরীত্যের জড়রেখা বরাবর সঞ্চালিত ক্ষমতাকেই চিহ্নিত করে। যেমন পূর্বে বিশ্লেষিত হয়েছে, ‘শক্তি-সম্পর্কের বহুমুখিতা’ রূপেই সঞ্চালিত হয় ক্ষমতা। আর যদি ফোরামে অংশগ্রহণকারীগণ জীবনবাস্তবতায় দৃষ্ট অত্যাচারের এই বহুমুখিতাকে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণভঙ্গির মাধ্যমে প্রয়োগ না করতে পারেন, তাহলে ফোরাম থিয়েটার অনিবার্যভাবেই এক ভোঁতা ও ব্যর্থ অস্ত্রে রূপান্তরিত হবে, যার দ্বারা বোয়াল কথিত ‘বিপ্লবের মহড়া’ পরিচালনা হবে লক্ষ্যভ্রষ্ট।

সতর্ক ভঙ্গিতে পঠিত ম’দা (Mda 1993) রচিত হোয়েন পিপল প্লে পিপল-এ ফোরাম থিয়েটারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুটিত হয়। যেমন, অ্যালকোহলিজম নাটক (১৯৯৩ : ১৫৬-১৬৩)।  লেসোথোর একটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত রচনায়, সম্পূর্ণ নিজেদের অংশগ্রহণে ও বহিরাগত অনুঘটকের ন্যূনতম বিক্রিয়ায় প্রযোজিত এই নাটকে অত্যন্ত স্বল্পমাত্রিক সচেতনায়ন পরিলক্ষিত হয়। আবার জনগোষ্ঠীর সংক্ষিপ্ত কিন্তু বহিরাগত অনুঘটকের পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণ ভিত্তিক কোপানো কে মাল্টা (১৯৯৩ : ৯৮-১১৫) নাটকের প্রযোজনাতেও একই ফলাফল লব্ধ হয়  যাকে বলা যায়, অত্যন্ত স্বল্পমাত্রিক সচেতনায়ন । কিন্তু অনুঘটকের সর্বানুকূল বিক্রিয়ার  মাধ্যমে নির্মিত ফোরাম থিয়েটার ভিত্তিক দ্য ট্রেড ইউনিয়ন (১৯৯৩:১৪৩-১৫৬) নাটকের প্রযোজনায় অর্জিত হয় সর্বানুকূল  সচেতনায়ন। কারণ অ্যালকোহলিজম প্রযোজনায় দৃষ্ট পূর্ণ অংশগ্রহণ ও কোপানো কে মাল্টা প্রযোজনায় দৃষ্ট  পূর্ণ বিক্রিয়ার বিপরীতধর্মী প্রবণতাসমূহের মধ্যবর্তী সমন্বয় ঘটে দ্য ট্রেড ইউনিয়ন প্রযোজনায় (১৯৯৯ :১৭৩)। আর এটাই হলো সার বিষয়। ফোরাম থিয়েটারে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছাঁর জন্য অংশগ্রহণকারী/দর্শক/দর্শকাভিনেতার তুলনায় ‘জোকার’/সহায়ক/অনুঘটকের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিচালন (অথবা ‘বিক্রিয়া’) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম’দার (Mda 1993:173) পর্যবেক্ষণলব্ধ সিদ্ধান্ত হলো, ফোরাম থিয়েটারের অনুঘটককে অবশ্যই গ্রামবাসীর চেয়েও উচ্চমাত্রিক সমাজ-সচেতনতা সম্পন্ন হতে হবে। এই উচ্চমাত্রিক সমাজ-চেতনা ও বিশ্লেষণাত্মক সজ্ঞানতা ব্যতীত অনুঘটক নিজের বিক্রিয়াবাদী ভূমিকা কার্যকরভাবে পালন করতে পারবে না। আর তখন নাট্য প্রযোজনা সত্ত্বেও গ্রামবাসী থেকে যাবে অসচেতনায়িত। গুরুত্বপূর্ণ যে, ‘উচ্চমাত্রিক সমাজ-চেতনা’ মূলত মতাদর্শিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ‘প্রগতিশীল’ একটি ব্র্যান্ডমাত্র- এ এক অস্পষ্ট পরিভাষাছত্র যার ছায়ায় সুনিশ্চিতভাবেই ইসলামী জঙ্গিবাদ ব্যতীত, শান্ত-সৌম্য খ্রিস্টীয় ‘লিবারেশন থিওলজি’ থেকে বিপ্লবের অগ্নি-প্রজ্জ্বলিত মার্কসবাদের বিভিন্ন গতিধারার যে কোনো সংমিশ্রণই আশ্রয় নিতে পারে।

অবশ্যই, আপনাদের যে কেউই বর্ণিত যুক্তির বিপরীতে সরল যুক্তি প্রদর্শন করতে পারেন যে, বাংলাদেশের সুযোগ-সুবিধা সমৃদ্ধ শহরাঞ্চলের অধিবাসী, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মতো ততটা ‘মূর্খ’ নয়। অতএব, আমার যুক্তি শহরাঞ্চলে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু শহরাঞ্চল বলতেই বা কী? মেট্টোপলিটান সিটি, জেলা শহর, উপজেলা শহর ইত্যাদি প্রশাসনিক বর্গভিত্তিক সুস্পষ্ট বিভাজন কি ক্রমাগত বর্ধমান নগরায়ন এবং শহরের একটি সমস্যাহীন সুনিশ্চিত সংজ্ঞায়নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে না? বাংলাদেশের এই শহরকেন্দ্রিক স্তরবিন্যাসের সমান্তরালে ‘উচ্চমাত্রিক সমাজ-চেতনা’ও ক্রমাগত আপেক্ষিকতার ধাঁধায় পতিত হয়। আবার, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বাঙালি কিংবা ক্ষুদ্রজাতিসত্তাগত পরিপ্রেক্ষিতেও বৈচিত্র্য বিদ্যমান। এভাবে, গ্রামেরও একটি সমস্যাহীন সুনিশ্চিত সংজ্ঞায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ‘উচ্চমাত্রিক সমাজ-চেতনা’ আপেক্ষিকতার অনন্ত রাশিতে পরিণত হতে পারে। তাই ‘উচ্চমাত্রিক সমাজ-চেতনা’ শহর, গ্রাম, জাতি, শ্রেণি সর্বোপরি  মতাদর্শিকভাবে পক্ষপাতপূর্ণ বিচিত্র মানদণ্ডের প্রেক্ষিতে কোনো নির্দ্বন্দ্ব অনুসিদ্ধান্ত নয়!

বোয়াল বিশ্লেষণে ব্রতী হয়ে যখন দাবি করেন, কার্যকরতার দিক থেকে দর্শকাভিনেতা ‘জড়সত্তা’ নয়, ‘কর্তা’-তখন তিনি এটাই ধারণা করেন যে, নাট্য ক্রিয়ায় যুক্ত হলেই যে কোনো ‘জড়সত্তা’ ‘কর্তা’য় রূপান্তরিত হয়। তাঁর এই অনুমানলব্ধ চিন্তাসূত্র ধরে আমরাও তাঁর সাথে সেই ফাঁদে পতিত হই, বদ্রিয়াঁ-অনুসরণে গঠিত ও’ হানলন (O’ Hanlon 2000 :106) যাকে ‘‘আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক ব্যতিব্যস্ত ভীতি’’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নিম্নবর্গের কণ্ঠ শ্রুতিগোচর করতেই হবে। সেই কণ্ঠ শ্রুতিগোচর করার লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে আমরা আদাজল খেয়ে আমাদেরই নিজস্ব দৃশ্যকল্পের ব্যাখ্যা দ্বারা একে রুদ্ধ করে ফেলি বারংবার। নিম্নবর্গের রুদ্ধ নীরবতার ভার বহন করা আমাদের পক্ষে অসহনীয়। যেমন বদ্রিয়াঁ (Baudrillard 1983:28-29) বলেন, পশুদের নীরবতার সমান নিম্নবর্গের নীরবতা। এই নীরবতা অবহনীয়। রাজনৈতিক সমীকরণের এ এক প্রহেলিকা। এই প্রহেলিকা যে কোনো রাজনৈতিক সমীকরণকেই খারিজ করে দিতে সক্ষম। সবাই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু কখনোই নীরবতা হিসেবে নয়, সর্বদাই এই নীরবতাকে বাচলতায় বাঙময় করে তোলার জন্যই। আমাদের পক্ষে তো এটা স্বীকার করা অসম্ভব যে, নিুবর্গের নীরবতা সম্ভবত ফ্রেইরিয় ‘নীরবতার সংস্কৃতি’কে সূচিত করে না। একই সাথে এও স্বীকার করা অসম্ভব যে, নীরবতা দ্বারা সূচিত ‘নিস্ক্রিয়তা’ও নিশ্চিতভাবেই প্রতিরোধের অনুপস্থিতিকে সূচিত করে না। কারণ, হবসবম (Hobsbawm 1973 : 13) যেমন যুক্তি দেখান, ঐতিহ্যবাহী কৃষকশ্রেণির ‘স্বাভাবিক’ কৌশলই হলো নিস্ক্রিয়তা। মোকাবিলার প্রতিস্পর্ধী সাহস নিয়ে পুনর্বার বঁদ্রিয়ার (Baudrillard 1983 : 29-30) সাহচর্যে গিয়ে তাঁর সাথে মুখরিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া যায়: কে বলতে পারে কোনটি আজ জয়ী হচ্ছে: জনতার ওপর ক্রিয়াশীল ক্ষমতা দ্বারা সৃষ্ট ছদ্মরূপ, নাকি উল্টো, জনতার অব্যাহত প্রতিরোধে সৃষ্ট ছদ্মরূপ, যার দ্বারা  অন্তর্গতভাবে নিঃশেষিত হয়ে চলেছে ক্ষমতা?
 
নিম্নবর্গের কন্ঠ শ্রুতিগোচর করার ‘‘ব্যতিব্যাস্ত ভীতির’’ ফাঁদে পড়ে, শক্তিমত্ত ‘পুরুষালি’ কাণ্ডকীর্তি দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছে বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলা। এখানে নিবিড় প্রাসঙ্গিকতার সূত্রে তুলে ধরা যায় ও’হানলনের (O’ Hanlon 2000 :111) পর্যবেক্ষণ: স্বয়ংক্রিয় কর্তা-চালিকাশক্তি সম্পর্কে একটি ভ্রান্ত ধারণা হলো, এর নিজস্ব পুরুষালি অনুশীলনেরই রয়েছে একচেটিয়া বীরত্বের দাবি। অতএব, রাজপথে মিছিল, মিটিং, আন্দোলনের ক্ষেত্রগুলো ব্যতীত কোথাও শহীদের সত্যিকার উদ্যম পরিদৃষ্ট হতে পারে  না। উক্ত ভ্রান্তব্যাখ্যা এবং সদা কল্যাণকামী প্রেম ও করুণা, স্বয়ংক্রিয় কর্তা-চালিকাশক্তি তাড়িত বিক্রিয়াবাদী নাট্যকর্মীদের ভুলিয়ে দেয় যে, নিম্নবর্গ জনতা সদা-সর্বদাই প্রতিরোধের আঙ্গিকে বিক্রিয়ায় লিপ্ত। এই প্রতিরোধ ভিন্ন প্রকার: এই প্রতিরোধ বিক্ষিপ্ত সেই  ক্ষেত্রগুলোতে বিরাজমান যেগুলো আমরা সাধারণত ‘রাজনৈতিক’ হিসেবে চিহ্নিত করি না। এই প্রতিরোধের বসবাস সেই কর্মকাণ্ডে যা সাংস্কৃতিক ব্যবধান হিসেবে ভ্রম হয় (O’ Hanlon 2000:111)। এই যে ‘ভিন্নরূপী প্রতিরোধ’ অথবা ছদ্মবেশী, অনুচ্চ, অঘোষিত প্রতিরোধ, এগুলো দ্বারাই গঠিত নিম্নবর্গের অবরাজনীতির ক্ষেত্র (Scott 1990 : 198)। ছিচকে চুরি, ফুটপাথে অবৈধ বসতি স্থাপন থেকে শুরু  করে স্বেচ্ছাকৃত শ্রমমন্থরতা ও গুজব ছড়ানো  পর্যন্ত এই অবরাজনীতির ক্ষেত্র বিস্তৃত। এর সূত্রে  যুক্ত হতে পারে হোমি ভাবা’র (Bhabha 1994) ‘অনুকৃতি’র ধারণা যেটি অত্যাচারী ও অত্যাচারিত উভয়েরই এক দ্বি-ধার তলোয়ার, কারণ অনুকৃত মানুষ এক অসঙ্গতিপূর্ণ  চরিত্র যা উপনিবেশিক কর্তৃত্বকে একই সাথে দৃঢ়ীভূত ও বিঘ্নিত করে (Sharpe 1995 : 99)

নিম্নবর্গের কন্ঠ শ্রুতিগোচর করতে গিয়ে আমাদের নিজস্ব দৃশ্যকল্পের ব্যাখ্যা দ্বারাই একে রুদ্ধ করার পরিবর্তে আসুন আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে অনুধাবন করতে শুরু করি যে, “নিম্নবর্গের মানুষ মাত্রই ক্ষমতাহীন নয়” (Hobsbawm 1973: 13) এবং “জ্ঞানদানের জন্য আমাদেরকে জনতার খুব বেশি প্রয়োজন নেই: বিভ্রম ছাড়াই তারা নির্ভুলভাবে জানে; তারা [আমাদের] চেয়েও বেশি জানে এবং তারা তাদের নিজেদেরকে অভিব্যক্ত করতে নিশ্চিতভাবেই সক্ষম” (Foucault 1977 : 207)

উপসংহার: “কী করতে হবে?”

আজ যে-সমস্যামূহ আমি উত্থাপন করেছি, এ বিষয়ে যখন কয়েক বছর পুর্বে আমি আলোচনা করছিলাম, তখন ডেভিড কার (যিনি উন্নয়ন নাট্য বিষয়ে অত্যন্ত বিস্তৃৃত ও প্রশংসনীয়ভাবে মালাবি ও জাম্বিয়ার কাজ করেছেন) আমাকে সর্তক করেছিলেন এই বলে  যে, আমি চাল ধুতে গিয়ে ময়লা জলের সাথে চালও ফেলে দিচ্ছি। কিন্তু আমি এখন আক্রান্ত ফুকোর তপ্ত ভাষা দ্বারা- কোনো পরিস্থিতিতেই তাদের সেই সব কথায় কর্ণপাত করা উচিত নয় যারা বলেন: সংস্কার সাধন করতে তুমি যেহেতু সক্ষম নও, তাই সমালোচনা করো না। সমালোচনা অবরোহ ক্ষেত্র নয়, যেখানে এই মর্মে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া বাঞ্ছনীয় যে, তাহলে এখন কী করণীয় (Foucault 2002: 236)। অতত্রব, ভ­াদিমির ইলিচ লেনিনের সিদ্ধান্তঋদ্ধ ও বহুল পঠিত পুস্তিকা কী করতে হবে-এর অবতারণা আজ অদ্ভুত ও সেকেলে শোনাতে পারে, এমনকি রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজিও মনে হতে পারে। কিন্তু এই প্রশ্ন থেকে তো পালাবার কোনো পথ নেই- কেননা, প্রশ্ন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। অতএব, আসুন, আমরা আমাদের কর্মোদ্যম দিয়ে অতিক্রম করে যাই উন্নয়ন নাট্য (যা আজ অনেকাংশেই পায়খানা ও স্যানিটেশনের করুণাসিক্ত লটবহরে পরিণত) এবং অন্যান্য সকল ব্র্যান্ডের বিক্রিয়াবাদী নাট্যকলা (যা আজ অনেকাংশেই বিপ্লব ও বাসনার ছদ্মক্রিড়ায় পরিণত)। আসুন, আমরা আত্মগর্বী আনন্দের শিস বাজানো বন্ধ করি কেননা এ এক নিষ্ফলা আর্তির মতোই শোনাবে যে, আমরা বিরাজমান সামাজিক অবস্থা বদলে দিচ্ছি আর আমাদের এই বিক্রিয়াবাদী নাট্যচর্চা পরিবর্তন প্রতিষ্ঠা করতে তীব্র ফলপ্রসূ। তাই আসুন, আমরা এই সত্য স্বীকার করে নিই যে, সচেতন ও স্বকীয় সঙ্কল্পশক্তির প্রয়োগ ব্যতীতও আমরা অনিবার্যভাবেই একটি নিরন্তর পরিবর্তনশীল প্রবহণে অন্তর্ভুক্ত উপাদানমাত্র- আর এই বিক্রিয়া একটি চলমান গঠনকৌশল যা আমাদের জেহাদি প্রেম ও করুণার মুখাপেক্ষি না হয়েই মানব সমাজ দ্বারা নিরন্তর পরিচালিত হচ্ছে। দর্পচূর্ণ-বিনম্রমনে আমাদের এই সত্যও স্বীকার করতে হবে যে, নিম্নবর্গ জনতা ‘ভিন্ন প্রকার প্রতিরোধের’ আঙ্গিকে সদা-সর্বদাই বিক্রিয়ায় রত।

তাহলে আসুন, ফুকো যেমন বলেন, “আসা-যাওয়া, আদান-প্রদান, ভাব-বিনিময়, চিন্তা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ভিন্ন বিশ্লেষণপঞ্জির সুবিপুল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে” (২০০২:২৩৬) সমাজের বহু অক্ষ থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষমতা-সম্পর্কের নিরন্তর পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়াসমূহ নিষ্প্রাণ, নিঃশেষ ও নির্মূল করার পন্থা ও পদ্ধতি খুঁজে বের করি। এই বহু-অক্ষীয় ক্ষমতা-সম্পর্ক সমাজের সামগ্রিক অন্তর্জালের সঙ্গে অনিবার্যভাবেই জড়িত। আর আমরাও, বুদ্ধিজীবীর বেশে, সমাজের এই সামগ্রিক অন্তর্জালের মধ্যে সামাজিক চালিকাশক্তির মদদদাতা হিসেবে অস্তিত্বশীল। আমাদের এই অবস্থান, সমাজের সামগ্রিক এই অন্তর্জাল এবং এর বহু অক্ষ থেকে বিচ্ছুরিত ক্ষমতা-সম্পর্কই তো নিম্নবর্গ মানুষের ডিসকোর্স ও জ্ঞানকে ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত করে, নিষিদ্ধ করে, অবশেষে করে অকার্যকর (Focault 1971:207-208)

চিন্তাসূত্র
Anderson, B.(1983) Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism. London: Verso.

Ashcroft, B., Griffiths, G. and Tiffin, H. (1995) Introduction to Ethnicity and Indigeneity in B. Ashcroft, G. Griffiths and H. Tiffin (Eds) The Post-colonial Studies Reader. London: Routledge.

Barber, B. (2000) What is to be done? [Burning questions for our movement], electronic source, 21 March 2005 <http://www.eipcp.net/diskurs/d05/text/brucebarber01.html>

Baudrillard, J. (1983) In the Shadow of the Silent Majorities or, the End of the Social and Other Essays, translated by Paul Foss, John Johnston, and Paul Patton. New York: Semiotext(e) and Paul Virilio.

Benjamin, W. (1978) The Author As Producer in: W. Benjamin, Reflections: Essays, Aphorisms. Autobiographical Writings, translated by Edmund Japhcott, pp. 220-238. New York: Schocken Books).

Bhabha, H. K. (1994) The Location of Culture. London: Routledge.

Boal, Augusto (1979) Theatre of the Oppressed. London: Pluto Press.

Boal, Augusto (1992) Games for Actors and Non-actors. London: Routledge.

Bokul, S. A. (2001) Unnayan Theatre O Amader Charcha (in Bengali). Dhaka: Shamabesh.

Borges, J. L. (1970) A New Refutation of Time in: J. L. Borges, Labyrinths: Selected stories and other writings, Donald. A. Yates and James. E. Irby (Eds). London: Penguin.

Brah, A. (1996) Cartographies of Diaspora: Contesting Identities. London: Routledge.

Brecht, B. (1964) Brecht on Theatre: The Development of an Aesthetic, translated from the German and notes by John Willet. London: Methuen.

van Erven, E. (1992) The Playful Revolution: Theatre and Liberation in Asia. Bloomington: Indiana University Press.

Etherton, M. (1982) The Development of African Drama. London: Hutchinson University Library for Africa.

Freire, P. (1996) Pedagogy of the Oppressed, Myra Bergman Ramos (Tr.). Harmondsworth: Penguin.

Foucault, M. (1977) Language, Counter-Memory, Practice: Selected Essays and Interviews, Donald F. Bouchard (Ed.), Donald F. Bouchard and Sherry Simon (Tr.). Ithaca, NY: Cornell University Press.

Foucault, M. (1984) A History of Sexuality, Volume 1, Robert Hurley (Tr.). Harmondsworth: Penguin Books.

Foucault, M. (2002) Questions of Method, originally titled Round Table of 20 May 1978, in: Power: Essential Works of Foucault 1954-1984, volume 3, James D. Faubion (Ed.), Robert Hurley and others (Tr.), pp. 223-238. London: Penguin.

Gadotti, M. and Torres, C. A. (2002) Paulo Freire: A Homage, electronic source, 2 October 2002, <www.gseis.ucla.edu/cide/projects/Torres.pdf >

Haber, H. F. (1994) Beyond Postmodern Politics: Lyotard, Rorty, Foucault. Routeldge: New York.

Hegel, G. W. F. (1910) The Phenomenology of Mind, Volume I, J. B. Baillie (Tr.). London: Swan Sonnenschein & Co. Ltd.

Hobsbawm, E. J. (1973)        “Peasants and Politics”, Journal of Peasant Studies, Vol. I, pp. 3-22.

Mansfield, V. (1998) Time and Impermanence in Middle Way Buddhism and Modern Physics, a talk given at the Physics and Tibetan Buddhism Conference University of California, Santa Barbara January 30-31, 1998, BuddhaZine, electronic source 22 March 2005 <http://www.buddhanet.net/timeimpe.htm>

Marx, K. (1977)         Selected Writings. Oxford: Oxford University Press.

Mda, Z. (1993) When People Play People. London: Zed Books.­­­­­­­­­­­­

Mlama, P. M. (1991) Culture and Development: Popular Theatre Approach in Africa. Uppsala: Nordiska Afrikainstitutet.

Murti, T. R. V. (1998) The Central Philosophy of Buddhism: A Study of Mādhayamika System (originally published in 1955), (New Delhi, Munshiram Manoharlal).

O’Hanlon, R. (2000) Recovering the Subject: Subaltern Studies and Histories of Resistance in Colonial South Asia in: Mapping Subaltern Studies and the Postcolonial, Vinayak Chaturvedi (Ed.), pp. 72-115, (London, Verso).

Prentki, T. and Selman J. (2000) Popular Theatre in Political Culture: Britain and Canada in Focus. Bristol: Intellect.

Rahnema, M. (1997) Towards Post-Development: Searching for Signposts, A New Language and New Paradigms in: The Post-Development Reader, compiled and introduced by Majid Rahnema with Victoria Bowtree. Dhaka: University Press Limited.

Schechner, R. (2002) Performance Studies: An Introduction. London: Routledge.

Schutzman, M. and Cohen-Cruz, J. (1994) Glossary in: Playing Boal: Theatre, Therapy, Activism. London: Routledge.

Scott, J. (1990) Domination and the Arts of Resistance: Hidden Transcripts. New Haven: Yale University Press.

Sharpe, J. (1995) Figures of Colonial Resistance in: The Post-colonial Studies Reader, Bill Ashcroft, Gareth Griffiths and Helen Tiffin (Eds.). London: Routledge.

Spivak, G. C. (2000) The New Subaltern: A Silent Interview in: Mapping Subaltern Studies and the Postcolonial,Vinayak Chaturvedi (Ed.), pp. 324-340. London: Verso.

Spivak, G. C. (1990) The Intervention Interview in: The Post-colonial Critic: Interviews, Strategies, Dialogues, Sarah Harasym (Ed.). New York: Routledge.

Suleri, S. (1995) The Rhetoric of English India in: The Post-colonial Studies Reader, Bill Ashcroft, Gareth Griffiths and Helen Tiffin (Eds.), (London, Routledge).

Thorpe, S. (1998) Agency and the Discursive Construction of Crisis in Education, a paper prepared by Stephen T. Flinders University as an advance-release presentation for the Australian Association for Research in Education National Conference Adelaide, South Australia November-December, 1998, electronic source, March 21 2005 <http://www.aare.edu.au/98pap/tho98113.htm>

Turner, V. (1982) From Ritual to Theatre: Human Seriousness of Play. Philadelphia: University of Pennsylvania.

বকুল, শামসুল আলম, (২০০১) উন্নয়ন থিয়েটার ও আমাদের চর্চা, (ঢাকা: সমাবেশ)।

মার্কস, কার্ল ও ফ্রেডেরিক এঙ্গেলস, (২০০৮) কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহার, (কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড)।

রহমান, মুহাম্মদ হাবিবুর, (১৯৯৩) যথাশব্দ, (ঢাকা: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড)।

সৈয়দ জামিল আহমেদ : গবেষক। অধ্যাপক, নাটক ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শাহমান মৈশান: শিক্ষার্থী, নাটক ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়