Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

ঢাকা ঢাকা ডাক পাড়ি ।। ঢাকা গেছে কার বাড়ি [৩]

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আর নাটক করিস না: ধরা পইরা গেছে তোর অভিনয়

নাটক আর অভিনয় মানে তাহলে এই: যা-কিছু সত্যি নয়, মিথ্যা আর ভান আসলে? বাস্তবে আর জীবনে আমরা যদিও সর্বক্ষণ তাই করে চলি- তবু তাকে আমরা নিন্দাই করি, ছোট চোখে দেখি এই অভিনয়কে, মিথ্যাকে। সকলে চেষ্টা করি সর্বক্ষণ যাতে কেউ ধরতে না পারে আমাদের এই কাজ-কারবার। যদিও আমরা ঠিকই বুঝে যাই, ধরে ফেলি জীবনে একে অপরের অভিনয়। তবু সাধ্যমতো সকলেই চাই অপরে যেন তা না পারে ধরতে। নিরন্তর এই এক ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলাই চালিয়ে যাই আমরা। আর যে-যত অপরকে বোকা বানাতে পারে, ধরা না খায়, সে তত আয়-উন্নতি করে। এই হলো জীবনের, সভ্যতা-রাষ্ট্র-সমাজের মৌল প্রক্রিয়া: অভিনয় বা নাট্যক্রিয়াকলাদি। মঞ্চে মঞ্চে তারই পুনরাভিনয় হয় তাহলে? এই যে চলে এক চির-জীবননাট্য লীলা? অথচ সেই তাতেই কিনা আমাদের আনন্দ? আর তাই বুঝি, ভালো অভিনয় মানে ইউরোপীয় মতে ‘মেক বিলিভ’। মিথ্যাকে সত্য মনে করানো। তা করতে পারাই নাট্যশিল্পের পরমসিদ্ধি।

তবু মনে হয় নাকি, জীবনের যে-মিথ্যা মুখে অন্তত আমরা এত ছোট চোখে দেখি, সর্বক্ষণ লুকাতে চাই যা-কিছু, মঞ্চে কেন তারই পুনরাবৃত্তিতে আমাদের আনন্দ? একেই কিনা শিল্প বলে খুব একটা উচ্চমূল্য দিই, নন্দন নান্দনিক বলে অভিনন্দন জানাই। তা কেন, ব্যাপারখানা আসলে কি? নাট্য বা শিল্প-নন্দনের কাছে আমাদের অন্য কোনো আকাঙ্ক্ষা কি তাহলে সত্যিই নেই? সেই যে বলেছিলেন একদা পিকাসো: শিল্প হলো মায়া বা ইলিউশন- যা সত্য নয় মূলত মিথ্যাই, তবে তা হলো এমন এক মায়া বা মিথ্যা যা দিয়ে আমরা উন্মোচিত করি সত্যই- জীবনের, প্রকৃতির, বস্তুর, রূপের যত সত্য আছে তা প্রকাশ করি, আবিষ্কার করি, খুঁজে ফিরি যত সত্যসার- তার বহুবিচিত্র যত বিশ্বরূপ কুরূপ দর্শন। যত যা কিছু অধরা তাকেই নানা রূপে রীতিতে বাঁধতে চাই। আমরাও তো কথায় কথায় বলে থাকি: সত্যকে জানা চেনা প্রকাশ করাই শিল্পের মূল কাজ। তার জন্যই এত সব ফর্মের টেকনিকের উদ্ভাবনা। জীবনের, মনের বা ভাবনার যত সত্য-মিথ্যার জটিল জাল আছে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করাই নাকি শিল্পের কাজ। এই কি তাহলে সত্য? নাট্যেরও অন্বিষ্ট তাহলে এই তবে: সত্য সন্ধান আর তার প্রকাশ? তার সিদ্ধিতেই নান্দনিক সিদ্ধি: সত্যের অতল বহুরূপের সুলুকসন্ধান- তাকে একটা পদ্ধতি-প্রকরণে রূপায়ণ করা?

বাংলাদেশের মঞ্চেও কি তাই করে চলেছি আমরা, করতে চেয়েছি? নাটককে যে বলা হয় ‘সমাজের দর্পণ’- এ-ও কি সেই অর্থে?- যাতে আমরা নিজেদের দেখতে পাবো- আমাদের দেশ-সমাজ-বাস্তবের, ব্যক্তির মনেরবিশ্বের নানা রূপ-রূপায়ণ-রূপান্তর দেখতে পাবো? তা পাই কি, না কি তা সত্যিই চাই? একটা বিশেষ দেশ-সমাজ-সময়ের পটে কী কী করে চলি জীবনের বাস্তবে, মনে- তারই রূপায়ণ নানা রূপরীতি টেকনিকেই কি উপস্থাপিত হয়? কেমন তা হয়, কতটুকু হয়?

তবু কতটা কি করতে চাই বা না চাই তা-ই প্রতিফলিত, প্রকাশিত হয়, হয়ই। না হয়েই পারে না। বাংলা সিনেমায়ও যেমন ধরা পড়ে আমাদের এই দেশ-সময়ের কুশ্রী-কুরূপ বীভৎসার বিচিত্র বিকার- আমাদের নারকীয় জীবনবাস্তবের এক অন্যতর রূপায়ণ ঘটে তাতে। এই অর্থে নিশ্চয় মঞ্চেও নাট্যরূপ পায় জীবনের আরেক ভিন্ন মনেরই বিশ্ব। কল্পনা, নীতি-রুচি, আদর্শ-অনুকরণের প্রতিবিম্ব- যাতে ঢেকে রাখা, লুকিয়ে রাখা যায় দৈনন্দিন জীবনবাস্তবের জটিল-কুটিল মিথ্যা-ভানের দুই নম্বরী কাণ্ডকারখানা, তাণ্ডব। অভিনেতা আর দর্শককে যাতে মুখোমুখি হতে হয় না, দেখতে হয় না, বরং পালাতে চায় রিয়ালিটি থেকে, নিজের থেকে, সত্য থেকে।- এই চেহারাটা অন্তত ধরা পড়ে, রূপ পায়, মঞ্চে মঞ্চে।

তবু এই কি কেবল চাই আমরা নাট্যক্রিয়া থেকে? আমরা কি দেখতে চাই না মঞ্চে, আমার না-লুকানো, না-পালানো, না-ভোলানো স্বরূপ- বাস্তব জীবনের আর মনের বিশ্বের। বাজারের পণ্যায়ণ-সর্বস্ব এই যে আত্মরূপ আমাদের- সত্যিই তা দেখতে চাই না? নাট্যশিল্প কি সেই কঠিন দায় নিতেই চাইবে না? রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি বা বুদ্ধিজীবীর ভীষণসব প্রবন্ধের মতই কতকগুলো কথা-বুলি-নীতি-স্লোগানের উদ্গার করে চলবে কেবল মঞ্চ?

এতসব কথা মনে এলো, ফরিদপুরে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের উদ্যোগে, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের টাকায় করা ‘কর্মশালা-নাট্য প্রদর্শনী’ হন্তারক দেখে। মঞ্চে দেখা গেল অন্য নাটক। সত্যের মঞ্চে-না-দেখা ভিন্ন রূপায়ণ। নির্দেশক-নাট্যকার যখন ঢাকার কামালউদ্দিন কবির আর রতন দেব, আশা করা গেছিল ফরিদপুরের মঞ্চে দেখবো অভিনব এক নাট্য-কারিশমা: মঞ্চসজ্জা, পোশাক, কোরিওগ্রাফি, আলোক-সঙ্গীত-বাদন, বিশেষত নাটকের বা বিষয়ের এক চমকে দেওয়া জমকালো সৃজন-বাহাদুরী। যাকে বলে আধুনিক নান্দনিক রূপায়ণ যা দেখে ভিরমি খাবে দর্শক। ফরিদপুরে অন্তত আগে দেখি নি এমন এক উপস্থাপনা দেখবো ভেবেছিলাম।

অথচ পর্দা উঠলে দেখা গেল, মঞ্চে কয়েকটি মাত্র কাছাকাছি উচ্চতা-আকারের বাক্সো। ছাই রঙের ট্রাউজার আর মেটে রঙের ফতুয়া-পরা কয়েকজন রুগিকে ধরাধরি করে মঞ্চের বাঁ-পাশে রাখা দুই বাক্সে শোয়ায়। ডাকাডাকিতে নার্স-ডাক্তার আসে, মঞ্চে এসে অন্য-বাক্সে-রাখা ডাক্তারি গাউন পরে নেয়। রুগি দেখার পর, অপারেশন থিয়েটারে নিতে বলে রুগিকে। সবাই ধরাধরি করে, মঞ্চের ডানে অন্যদুটি বাক্সো কোণাকুণি করে রেখে, থিয়েটার-বেড করে ঘুরে এসে রুগিকে শোয়ায়। পিছনে ডাক্তার-নার্স পিছন ফিরে এ্যাপ্রোন পরে দাঁড়ায়। একটা ছবি তৈরি হয় অপারেশন থিয়েটারের- একই ডাক্তারি এ্যাপ্রোন-পরা অভিনেতাদের সরল লাইনে দাঁড়ানোয়। তারা এবার ফিরে রুগিকে পরীক্ষা করতে থাকে। নার্সদের ক্ষিপ্র হাতে একের পর এক যন্ত্রপাতি ডাক্তারদের হাতে দেয়ার পৌনঃপুনিক আদান-প্রদানে অপারেশনের দৃশ্যমায়া তৈরি হয়। নানা কোণ থেকে নীলাভ কম আলো, তবলার বিট, রুটিন মাফিক কথপোকথন আর যন্ত্রপাতি আদান-প্রদানের ক্রিয়াদিতে এই মায়া রূপায়িত হয়।

নির্বাচিত ক্রিয়াদি, পারস্পরিক চলাফেরার বিচিত্র শারীরিক গতিভঙ্গী, অবস্থান-composition স্বাভাবিকভাবেই যেন তৈরি হতে থাকে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতি, দৃশ্য- মূল নাট্যক্রিয়াবেগ যাতে গঠিত হতে থাকে এই নাট্যের এক নিজস্ব ভাষায়। দুই ডাক্তার-মনোবিদ কারণ খুঁজতে চান: একের পর এক একই ধরনের শারীরিক রসক্ষরণ কেন আত্মহন্তাদের? কোথায় এর সামাজিক কার্যকারণসূত্র? আমরা মঞ্চে জীবন্ত দুটি চরিত্র দেখি বয়স-পেশার বৈশিষ্ট্যসমেত। বাংলাদেশের মঞ্চে এরকম স্বভাবানুগ চরিত্রায়ণ তেমন চোখে পড়ে না। উচ্চকিত অভিনয়ের এক টাইপ-ভঙ্গী মঞ্চে  মঞ্চে ঘুরে ফেরে। মা-ছেলে-মেয়েদের পারিবারিক দৃশ্যটি অবশ্য অনেকটা প্রথানুগ ঠেকে। মা দুঃখ করেন সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে, সৎ রাজনীতির সংকটগ্রস্ত ছেলেটি বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে শক্তভাবে দাঁড়াতে চায়; মেয়ে অভিযোগ করে, ছেলেদের অধিক সুবিধার প্রশ্ন তোলে: বোনের চলাফেরায় সচেতন ভাইও কেন আর-সবার মতোই উদ্বিগ্ন হয় যা কি-না পুরুষসুলভ- এই কথা বলে। এই দৃশ্যে পারস্পরিক কথপোকথন নাটুকে সংলাপবৎ বানানোই লাগে। বরং নাট্যদলের দৃশ্যটি তুলনায় জীবন্ত। নানারকম প্রশ্ন তোলে এখানে নানাজনে: নাটক কেন? দর্শকের সঙ্গে কেমন যোগ চাই, নাট্যবিষয় কেন দর্শকেরও বিষয় হয়ে ওঠে না? নাটকের বিষয়-রীতিই-বা কেমন হওয়া চাই; কেন সকলে সময়মতো হাজির হয় না কিংবা নির্দেশকের সঙ্গে অভিনেতৃদের সম্পর্ক- এরকম নানা বিষয় উঠে আসে। বর্তমান বাস্তবতায় সিরিয়াস নাট্যদলের হয়তো কল্প এক চেহারা দেখতে পাই আমরা। কথপোকথন, চলাফেরায় বিচিত্র পারস্পরিক ক্রিয়াদি নাট্যের ভাষায় রূপায়িত হয়। দাঁড়িয়ে-বসে সংলাপ বলা কিংবা কোরিওগ্রাফির দেখানোপনায় নয় বরং চরিত্র-পরিস্থিতির স্বতস্ফূর্ত ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে দৃশ্য। হঠাৎ এক অভিনেতার আত্মহত্যার খবর আসে। সংখ্যালঘু-অভিনেতার সংকটবিষয়টি অবশ্য ঠিক বোঝা যায় না, নাট্যাবেগ তৈরি করা প্রতিক্রিয়ায় আর বাদ্যের আওয়াজে। দলীয় ক্ষমতা-রাজনীতির একটি দৃশ্য হাজতখানায় অভিনীত হয়। সন্ত্রাসের অভিযোগে সৎরাজনীতির ছেলেটির সঙ্গে দুই চেনা সন্ত্রাসীকেও ধরা হয়। তাদের সঙ্গে হাবিলদারের পরিচিত সখ্যমুদ্রাদি মজা দেয় আমাদের। এস.আইয়ের মারের মুখে সন্ত্রাসী দুজনের আস্ফালনও হাস্যরস তৈরি করে। অসহায় পুলিশ এগিয়ে এসে স্বগতোক্তি করে। বৈষয়িক লোভেই ফাঁদে আটকে পড়েছে সে ক্ষমতার হাতে। তাতে একটা আলাদা মাত্রা যুক্ত হয়। মস্তানরাও নিজেদের কথা বলতে পারতো। যদিও আমাদের কম বেশি জানা সে-কাহিনী। শিল্পে, নাট্যে অবশ্য আমরা চাই অজানা, নানা তথ্য-বিষয়-মাত্রা। সেসবও উঠে এসেছে কিছু কিছু।

কর্মশালায় নির্মিত ১ ঘন্টার এই নাটকে আমাদের আরদ্ধ গভীর নাট্যের একটা চরিত্র তৈরি হয়ে উঠেছে অনেকটাই- সেটাই বড় আশার কথা। থিয়েটারের অভ্যস্ত তরল নাটুকেপনার ভঙ্গী-সর্বস্বতার মধ্যে এই নাট্য দর্শকদের অন্য এক নাট্য-আদলের অভিজ্ঞতা দিয়েছে। বেশ মন দিয়েই তারা দেখেছে নাটক। বুঝতে-ভাবতে চেয়েছে, সায় দিয়েছে বিষয়ের সত্যতায়। বিশিষ্ট নাট্যভাষায় রূপায়িত হয়েছে বলে থিয়েটারের আস্বাদও পেয়েছে। এ নাটক এক অর্থে তো অভিনবই ছিল সব মিলে, তবু গ্রহণ যে করেছে দর্শক সেটাই বড় প্রমাণ এর সারবত্তার। ধ্বনি-সঙ্গীত অবশ্য তেমন সহায়তা করে নি নব এই নাট্য-রূপায়ণে। এত অল্পদিনে, এত অব্যবস্থার মধ্যে সেটা সম্ভব হয় নি বোঝা যায়। আলোর মহড়াও একবার মাত্র হয়েছে নাকি। অল্পকিছুমাত্র মঞ্চ উপকরণ- তা-ও নাকি অভিনয়ের দিন হাজির হয়েছে। তবু, তার মধ্যেই গোটাকয়েক নানা আকার-উচ্চতার বাক্সো দিয়ে কতরকম দৃশ্য-আসবাব সামগ্রী তৈরি করা হয়েছে। তবে মূল নাট্যবস্তু, আত্মহত্যা প্রবণতার রোগটি ভবিষ্যতে ঘটতে পারে বলা হয়। তবে এখনও কি তা ঘটছে না? কিংবা আত্মহত্যা মানে কি কেবল প্রাণে মরে যাওয়াই?- আত্মহত্যার নাই কি বিবিধ বিচিত্র ক্রিয়াদির এক প্রতীক ধরন?- অথবা আত্মহত্যা ভিন্ন উপায় কি- ‘তুমি আত্মহত্যা কর নি কেন’- এমত নানা প্রশ্ন, জিজ্ঞাসাও তোলা যেত। নাট্যকার-নির্দেশকের ইচ্ছেও নাকি ছিল, প্রাথমিক এই পাণ্ডুলিপি থেকে ক্রমে গঠিত হয়ে উঠবে নানা স্তর-মাত্রার এক সমগ্রতা;- তারা যে তা করতে পারেন নি তা-ও তো এক রিয়ালিটিই- বর্তমান গ্রুপ থিয়েটারের পতিতদশারই এক অরূপায়িত নাট্য সেটা। তার রূপায়ণই জরুরী কর্ম নয় কি আজ? নাটক নাকি দর্পণ যাতে নিজেদের ভালো করে দেখা যায়, চেনা-জানা যায়। যারা তা করছে আর দেখছে- এই দুই দলের জীবনচরিত বাস্তবতার বহু অপ্রদর্শিত, অনুদ্ঘাটিত যত স্বরূপ আছে- নিজেদের সেই স্বরূপনাট্য দেখতে চাই না কি মঞ্চে? তবে তা থেকে পালিয়ে বা সেই কঠিন কঠোর থেকে লুকানোর পাঁয়তারা কষে কি পার মিলবে শেষ পর্যন্ত?

তবে আত্ম আর বিশ্বরূপ দর্শনের সেই দর্পণ না হওয়া পর্যন্ত কোনো পাতানো ভোলানো নান্দনিকতায় মন ভরবে না আমাদের। ওসবের জন্য তো মিডিয়া-টিভি আছেই। মঞ্চে আমরা এডফিল্ম কি টেলিফিল্ম-মার্কা শিশু-ছেলে-মেয়ে-যুবা-বুড়া ভোলানো রঙ্লীলায় ভুলছি না। তার জন্যই বুঝি দর্শক আজ মঞ্চছাড়া। মঞ্চের কাজ মঞ্চকেই করতে হবে। বাজার-মিডিয়ার দোহাই দিলে চলবে না। জীবিকা-বাস্তবতা বলেও রেহাই নেই।

ভালো প্রযোজনা, যে দলেরই হোক, জানাজানি হয়েই যায়- দর্শক সে নাটক দেখে। এটা বোধহয় স্বাভাবিক ঘটনা। এর অন্যথা তেমন হয় না। প্রথমে হয়তো কম বয়সী নাট্যজন দেখে। তারপর তাদের মুখে মুখেই জানাজানি হয়। আর-সবাই জেনে যায়। ঢাকার বাইরের নাটকের কথাও এভাবে এক রকম জানা যায়। ঢাকায় কারো কারো মুখে বা লেখায়। বিশেষ উপলক্ষে বা উৎসবে ঢাকায় সেসব নাটকের অভিনয় হলে সবাই দেখতে পায়। তবে এ-ও তো দেখা যায়, ঢাকার উৎসবে বাইরের ভালো নাটক এলে নাট্যজন সকলে উৎসাহিত হয়ও না। এতে এক ধরনের ঢাকা-কেন্দ্রিক অহংকার কাজ করে নিশ্চয়। ঢাকার বাইরেও যে ভালো নাটক হয়, হতে পারে, এটা মনে করার একটা মনস্তাত্ত্বিক বাধা কাজ করে অনেকের মধ্যে। এই যেমন, বছর দুই আগে, ঢাকায় আইটিআই এর উৎসব হল। তাতে ঢাকার বাইরের বেশ কটি ভালো প্রযোজনা অভিনীত হয়; অথচ ঢাকার নানাদলের নাট্যজন দর্শক তেমন দেখা গেল না। এটা নিশ্চয় মন খারাপ করার মতো ঘটনা। নাট্যজনের নাট্য উৎসাহের গতিপ্রকৃতি দেখে তাই সন্দেহ জাগে। ভালো নাটকও দেখার মনটা ভেতর থেকে ঝিমিয়ে পড়ছে না তো! তাহলে আর সাধারণ দর্শক নাটক দেখতে উৎসাহী কেন আর কী করেই বা হবে?

আইটিআই উৎসবে চট্টগ্রামের নামী দল ‘তীর্যক’ এর নাটক হল দ্বাররুদ্ধ। নির্দেশক দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার। নিয়মিত ভালো নাটক করায় তার নাম আছে। নাটকটিও যে-সে কারো নয়- স্বয়ং জাঁ পল সার্ত্রের লেখা। মৃত্যু-পরবর্তী তিনজনের পারস্পরিক স্বীকারোক্তিতে নানা মানবিক অপরাধবোধের উন্মোচন ঘটে। সহজ কোনো চলতি নাটকীয় বাচন তো নয় এটা। প্রযোজনা, অভিনয়ে এহেন আখ্যান রূপায়ণ কেবল নির্দেশনার কারিশমায় সম্ভব নয়। তার জন্য অভিনেতৃদের অনেকখানি তদ্গত আত্মস্থতা চাই। অভিনয়ে সাধারণত যেটা ঘটে না। বহির্মুখী কতকগলো থিয়েটারি মুদ্রায় নির্মিত হয় প্রায়ই নাট্য। অন্য চরিত্র হয়ে ওঠা বা অভিনয় করতে গিয়ে শুরুতেই ঘটে যেন একধরনের আত্মবিচ্ছেদ। অভিনয় মানে আমাদের কাছে তো; যা সত্য নয় এমন এক অন্য চরিত্রের রূপায়ণ। দর্শকের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনই কেবল অন্বিষ্ট। স্বভাবত আমরা অভিনয়ে অভিনেতৃর বা কোনো ব্যক্তির আত্মপ্রকাশ কি উন্মোচন তাই দেখতে পাই না। অথচ সার্ত্রের এই নাটক কি সেভাবে করা যায়? নিজেকে বাদ দিয়ে? নিজের গভীর গোপন সব অনুভব অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে? এ নাট্যে অভিনেত্রী দুজন প্রাণপণে সংকট বোধ করতে চেয়েছেন, সচেতনভাবে না হলেও নিজেকে ছাড়া তা সম্ভব হত না নিশ্চয়। নির্দেশক বরং অভিনয়ে একধরনের ব্রেশটীয় নির্লিপ্ত সচেতন অভিনেতা থেকে গেছেন- সংকটধারণ ঠিক যেন করতেও চান নি। তাতে তার নিজস্ব দৈনন্দিন শারীরিক বা বাচনিক মুদ্রায় আবদ্ধ থেকেছেন। চরিত্রের কোনো আত্মপ্রকাশভঙ্গী আয়ত্ত করেন নি। তাতে বরং আর দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি-চরিত্রের সঙ্গে পারস্পরিক বিনিময়ের নাট্য রূপায়ণে বাধা হয়েছে। মিথষ্ক্রিয়া ঠিক ঘটে নি। তবু আখ্যানের জোরে এবং দুই অভিনেত্রীর সংলগ্নতায় নাট্য গঠিত হয়ে ওঠে। তবে এমনই জোর এই আখ্যানের, দর্শককেও নিজের মুখোমুখি করে ছাড়ে। আপনাপন অপরাধবোধের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। এতেই রূপায়ণের সাফল্য তারিফযোগ্য মনে হয়। যদিও দৃশ্যপট হিসেবে সাদাপর্দার আধিক্য লাগসই লাগে না। কালো ধূসর বা গাঢ় কোনো রঙ বুঝি আরো সঙ্গত হতো। ধ্বনি-সঙ্গীত আবহ আর আলোক প্রক্ষেপণ অবশ্য সহায়ক হয়ে ওঠে নাট্য রূপায়ণে। সব মিলে, বেশ একটা ভালো প্রযোজনা দর্শকদের মুগ্ধ, আবিষ্ট করে। এই নাটকের কৃতিত্ব তাই কম কথা নয়। অথচ, মহিলা সমিতিতে কতজন দর্শকই বা তা দেখলো! চট্টগ্রাম, তীর্যক বা ইকবাল হায়দারের পূর্ব সুনাম সত্ত্বেও?

উৎসবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ করে মীমাংচিনা। তাদের ভাষ্যমতে এটি ‘নব্য নৃগোষ্ঠী গবেষণা নাট্য’। গবেষণা, রচনা ও পরিকল্পনা ডঃ আফসার আহমেদ; নির্দেশনা- রশীদ হারুন। বর্ণনা-সংলাপ-সঙ্গীত-নৃত্য-বাদ্যে রূপায়িত আখ্যান, নাট্য। বহু ব্যবহৃত এই রীতি প্রায়ই ব্যর্থ, ক্লিশে হয়ে উঠেছে। আখ্যান হয়তো গবেষণায় নির্মিত। কিছু সুর, কৃত্য আচার অনুষ্ঠান-বিশ্বাসও হয়তো। তবু প্রকাশরীতিটি চেনা, দর্শক যেন অভ্যস্তও তাতে। এ রীতির অক্ষম অনুকরণ বা সৃজন মাহাত্মহীন অনাবশ্যক আরোপণে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপপ্রয়োগ মাত্র হয়ে থাকে। কিন্তু এ নাটকে সেটাই সঙ্গত লাগে। এ রীতিটাই লাগসই, খোলতাই লাগে। তবে একে কেন যে ‘নব্য নৃগোষ্ঠী গবেষণা নাট্য’ বলা হবে বোঝা মুশকিল। এ সব নবনামকরণ যে একধরনের ক্ষমতা-চরিত্রই প্রকাশ করে আমরা তা লক্ষ্য করি না। কোনো নৃগোষ্ঠীর নামে তা হলে তো তাকে প্রায় উপনিবেশিক চেনা আরোপণই বলতে হবে, নামকরণের এ ধরনের দখলদারিত্বের মুদ্রায়। যদি তারা বলে বসে, এ অধিকার আমাদের কে দিয়েছে?- তখনই তো বোঝা যাবে ক্ষমতাবান সংখ্যাগরিষ্ঠের চিরকালের এক রীতিই এখানে ব্যবহৃত হলো। আখ্যান-দ্বন্দ্বটিও সন্দেহজনক। গারো মেয়ে ঋষিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি ফিরে বাবাকে প্রাচীন গারো গল্পের অভিনয় করতে বলে। তাতে মান্দিকন্যা শেরানজিং এর সঙ্গে ঋষিকা নিজের জীবনের মিল খুঁজে পায়। আলোকিত নাগরিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি জীবন না কি তার সংস্কারবদ্ধ মান্দি জীবন- যেখানে তার বিবাহ পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে- তাকে সে ভালো না বাসলেও- কোনটা বেছে নেবে সে? এ দ্বন্দ্ব প্রায় তথাকথিত সভ্য-অসভ্যের চিরাচরিত ক্ষমতা-নির্মিত দ্বন্দ্ব। ঋষিকার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একটি মেয়ের, বিশেষত আদিবাসী মেয়ের কোনো সংকট-অভিজ্ঞতা এতে নেই। সবই তার রঙ্গীন আলোয় আলোময় ঠেকে! এটা নাট্যকারের ইচ্ছাপূরণের এক বানানো বাস্তব নয় কি? যে-কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গারো মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখা যাক না সে কী বলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানকার ভয়াল পুরুষ-ক্ষমতাধিপত্যে যে-কোনো ছাত্রীর যেখানে ‘আপনা মাঁসে হরিণা বৈরী’- অবস্থা, সেখানে ছাত্র-শিক্ষক অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয়-অরণ্যে কী যে আতঙ্কভীষণ ভয়ার্ত অবস্থা মেয়েদের- ‘হরিনা তেরি নিলয় ন জানি’! প্রতিদিনের সেই বাস্তবটা উবে যায় কি নব্য নৃগোষ্ঠী গবেষণা নাট্যের মিথ তৈরির বিলাসী রোখে? তখন একে ক্ষমতাধরের সৌখিন নন্দনপনা ছাড়া আর কী বলা যায়। অথচ, প্রযোজনাটি সুনির্মিত- যাকে বলে নান্দনিক। তাই বুঝি অধিক বিপজ্জনক। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর, বিভ্রান্তিসৃষ্টিক্ষম। ইউরোপের ওরিয়েন্টালিজমের মতো। রঙীন চশমায় নির্মিত। জানি নাট্যকার এটা সচেতনভাবে করেন নি। অজান্তে এক ক্ষমতাধর বাঙালির রাষ্ট্রীয় মানসই এতে প্রতিফলিত হয়েছে। গানে বাদ্যে নৃত্যে বর্ণনায় সংলাপ কথনে সঙ্গতিময় এই নাট্যের সকল আপাত নান্দনিক সুষমা তাই লক্ষ্যহীন নন্দনকলায় পর্যবসিত হয়ে পড়ে। তাতে খুব মন খারাপও লাগে। প্রযোজনার মুন্সিয়ানা ঢাকা পড়ে যেতে চায়। এর আগে জাহাঙ্গীরনগরের মেঘনাদ বধ দেখে মহা হতাশ হয়েছিলাম। এবারের নাট্য তার বিপরীত অভিঘাত জাগায়- কেবল আখ্যানদ্বন্দ্ব আর নামকরণ দ্বিধান্বিত করে।

ঢাকায় বগুড়া থিয়েটারের নাম আছে। বছর কয়েক আগে আমরা তাদের ভালো প্রযোজনা কথা পুণ্ড্রবর্ধন দেখেছি। সেবার আইটিআই উৎসবে বিদ্রোহী কৈবর্ত দেখি। সাইদুর রহমান লিপনের নির্দেশনায়। শুনেছিলাম লিপন তেমন সময় দিতে পারে নি। তাই মনে কিছু শঙ্কা ছিল। তবু জানি, বগুড়া থিয়েটারের তৌফিক হাসান ময়না তো আছে সংগঠক নির্দেশক। নাটক দেখে অবশ্য বোঝা যায়, অল্প সময়েই তৈরি করা হয়েছে। নির্দেশকের এ ধরনের নাট্য নির্মাণের পূর্ব অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আছে। তাতে নাট্য একরকম দাঁড়িয়ে গেছে। আখ্যানভাগ সরল রেখায় তৈরি। পরিচিত এক দ্বন্দ্ব-উপাখ্যান গ্রথিত হয়েছে তাতে। বর্ণনাত্মক-সংলাপ-দ্বন্দ্বের মিশ্র রূপায়ণ ভালোই বলা যায়। বোঝা যায়, অভিনেতৃসকল অভ্যস্ত এতে। সঙ্গীত ও বাদ্যের ব্যবহার লাগসই নাট্যমুদ্রায় রূপায়িত। প্রচলিত ও নাগরিক রীতির মেলবন্ধনও তারিফযোগ্য। মধ্যযুগে কৈবর্ত-বিদ্রোহ, তার জয়-পরাজয়ের সরল-ব্যাখ্যান এ নাট্যের আখ্যান। ঢাকার মঞ্চে এ প্রযোজনার দর্শক সংখ্যাও হতাশ করে। বগুড়া থিয়েটার ও সাইদুর রহমানের সুনাম আছে তো ঢাকার নাট্যজনের কাছে। তাহলে কেন তারা আগ্রহী হল না এ নাটক দেখতে তা ঠিক বোঝা গেল না। বর্তমানকার নাট্যজন-মানস কোন খাতে যে বইছে জানা দরকার। নইলে এর নিরাময়পন্থা পাওয়া যাবে না।

আমরা সবাই হয়তো জানি না, পাবনার চাটমোহরে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছেন আসাদুজ্জামান দুলাল, তার দল নিয়ে। মুক্ত নাটক রীতিতে প্রাণিত তারা। যদিও দেশজুড়ে মুক্তনাটকের অস্তিত্ব অনেকদিন ধরেই প্রায় নেই। এখানেই কৃতিত্ব আসাদুজ্জামান দুলালের। কেন্দ্রীয় প্রণোদনা অবসিত হলেও তিনি নিয়মিত নানাভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। দলের অভিনেতৃ-সকল নানান পেশার শ্রমজীবী মানুষজন। দিনমজুর, কারিগর, রিক্সাচালক- আরো নানা সব জীবিকা তাদের। ছাত্র, বেকার, ছোট ব্যবসায়ীও আছেন দলে। তারা প্রায় নিয়মিত গ্রামের উঠানে উঠানে, সাইকেল মিছিল করে হাটে-বাজারে, বটতলায় এবং তৈরি মঞ্চেও নাটক করেন। নানা সংখ্যার অভিনেতৃ একেক নাটকে। এর কারণ নিরীক্ষা কেবল নয়, বাস্তবতা- যখন যতজনকে পাওয়া যায় তাদের নিয়ে নাট্য নির্মাণ করা হয়। নাট্যরীতির নামকরণও তাই নানারকম- কমবাইন ফর্ম,  লিটল ফর্ম, সমন্বয় থিয়েটার নামে এসব করেন তারা। ভাগফল, নগর কের্তন, জলতরঙ্গ, লং-মার্চ, হামব্বা, কারসাজি, দি খানকাবাসি এসব হচ্ছে বিভিন্ন ফর্মে করা তাদের নাটক। মুক্ত নাটক প্রণোদিত শ্রেণী সংগ্রাম আজও তাদের দর্শন। তবে নাট্য আখ্যানে এই দর্শনের প্রথাগত বাঁধাধরা ছক ভেঙে দ্বন্দ্বের বহুরূপ প্রতীক রূপকের নন্দন আয়ত্ত করে চলেছে। গ্রাম সমাজের বিশ্বাস-ভাষা-প্রকাশরীতির নানা বাচন সন্ধান করছেন তারা।

সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ক্লাসরুমে আমরা দেখি তাদের লিটল ফর্মের- হামব্বা, কারসাজি আর কমবাইন ফর্মের দি খানকাবাসি। হামরা’য় তিন-চারজন মাত্র চরিত্র। দুটো গরু, রাখাল আর তার মালিকের আখ্যান। জবাইয়ের ভয়ে পালাচ্ছে দুই গরু। তাদের লোভ আর ভয় দেখিয়ে খোয়াড়ে ভরতে চাওয়া হয়। দুটি গরুও একরকম নয়- একজন বাস্তব বিবেচক, অন্যজন অধিক বেয়াড়া। পরে অবশ্য এই স্বভাব বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতির চাপে পড়ে। অল্প কিছু প্রপ্স, সেট, শরীরভঙ্গির মুদ্রায় নাট্য তৈরি হয়। কৌতূহল অক্ষুণ্ন থাকে সর্বক্ষণ- কী ঘটবে আগেই সব বোঝা যায় না। মূলে যদিও শ্রেণী সম্পর্কের এক ভিত্তি থাকে তবু বিশিষ্ট এক নাট্য আখ্যান রূপায়িত হয়। কারসাজি বর্তমানকার রাজনীতির ক্ষমতা প্রক্রিয়ার প্রতীকমাত্রা গড়ে তোলে আরও নানা জটিল, লাগসই নাট্য আখ্যান-ক্রিয়ায়। ম্যাজিকেল কারসাজির নাটকীয় মুদ্রায়। আর দি খানকাবাসী-তো প্রায় মহাকাব্যিক চরিত্র পেয়ে যায়- ক্ষমতা-রাজনীতির সর্বগ্রাসী আগ্রাসন গ্রামসমাজের গভীরে ঢুকে গেছে যে। জনগোষ্ঠীকে তা বিবিধ বিচিত্র সংস্কার-কৃত্যের জটিল জালে পেঁচিয়ে ধরে। নাটকে তার নানা স্তর রূপায়িত হয়। হাবিব তানভীরের প্রযোজনার কথা মনে পড়ায়। নিরক্ষর শ্রমজীবীর নাট্যনন্দন-চেতনা বিস্মিত করে। নাগরিক প্রথাগত মিথ্যা অভিনয়ের বিপরীতে সহজস্ফূূর্তির মানবিক নাট্য হয়ে ওঠে বলে।- সব মিলে এদের লাগাতার নাট্য-এষণা সম্ভ্রম জাগায়।-‘তবু আশা যেন মাতৃভাষা, চিরায়ুষ্মতী তন্বী’। যেমন তারা লেখে সুভেনিরে- ‘কানে কানে আশা দেয়, ভাষা দেয়, অভিজ্ঞতার আলো, বায়ু প্রাণ জাগায় ... ফিরে দেখার ... এগিয়ে যাবার’। ঠিক এতখানি সৃজনসামর্থ্য এই সময়ে এক উপজেলায় ঘটে চলেছে ভাবা যায়! বাজার আর মিডিয়ার সর্বগ্রাসের বাইরেও তবে নাটক আছে- নিজস্ব স্বয়ংভর এই নন্দনক্রিয়া ঢাকা-সর্বস্ব নাট্যজনের দেখার বাসনা হয় কি?

সিরাজগঞ্জের তরুণ সম্প্রদায়ের কথা কেউ কেউ শুনেছেন নিশ্চয়। তারা বেশ কিছু ভালো প্রযোজনা করেছে। ইবলিশ, ওরা কদম আলী নাকি আরণ্যক নাট্যদলের চেয়েও কম কিছু করে নি। এই দলে আমিনুর রহমান মুকুল কর্মশালা-ভিত্তিক এক প্রযোজনা করে- বাউথনামা- সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ অবলম্বনে বছর কয়েক আগে। শিল্পকলা একাডেমী এপ্রিল/০৬-এ জেলা শহরের কিছু প্রযোজনার প্রদর্শনী করে। এতে বাউথনামা-ও অভিনীত হয়। মুকুলের কতক কাজ আগেই আমরা দেখেছি। নাট্য নির্মাণে তার দক্ষতা নাট্যজন সবারই প্রায় জানা। এ নাট্যে আমরা তার প্রস্তুতিপর্বের শিক্ষানবিশী প্রয়োগ-দক্ষতা দেখতে পেলাম। দলীয় শরীর অভিনয়, গান, নাচ বাদ্যে নাট্যক্রিয়া ঘটে চলে। আখ্যান রূপায়িত হতে থাকে। অভিনয় দৃশ্যশ্রাব্য নানা উপাদানে নাটকীয় গতি তৈরি করে। উনিশ শতকের কৃষক বিদ্রোহ প্রচলিত গণসঙ্গীতের সুরে হওযায় কিছু অসঙ্গতি হয়তো তৈরি করে। কিংবা ধান কাটা বা পোলোয় মাছমারা জাতীয় নাট্যক্রিয়া সৃজনদৃশ্য ঠিক সর্বত্র তৈরি করে না। তবে পোলো হাতে কৃষকের দলে ভারি হবার বিদ্রোহ দৃশ্যটি যথা চিত্রকল্প রচনা করে। অভিনয়েও চরিত্রানুগ স্বভাবস্ফূর্তি মানসম্পন্ন লাগে। ভীত, সন্ত্রস্ত জমিদারবর্গের দৃশ্যটি, একটি গড়গড়া থেকে নানা নল লাগিয়ে বসে তামাক খাওয়ার নাট্যমুদ্রায় ভালোই তৈরি হয়। মাঝে মধ্যে বর্ণনার মুদ্রাদোষ বরং অনাবশ্যক লাগে। এই রীতি মুকুলকে মনে হয় পেয়ে বসেছে। বর্ণনাত্মক নাট্যরীতির নামে এই বহুব্যবহৃত ক্লিশে ছাপিয়ে গেছে দেখি সারাদেশের মঞ্চজুড়ে। প্রায় যেন ফ্যাশন হযে উঠেছে। অক্ষমের ছেলেমানুষিতা সহজ পথ খুঁজে পেতে সব সময় হয়তো নতুন এক মুদ্রাদোষে অভ্যস্ত হয়। একেক নাট্যকার বা নির্দেশকের প্ররোচনায় একেক অন্ধের যষ্টি হাতে তুলে নেয় হুজুগে বাঙালিজন। নতুন আরেক খেলনা না পাওয়া পর্যন্ত সহজ এ ঘোর কাটে না। বিরক্তির একশেষ না করে ছাড়ে না যেমন কোনো বাজার-ফ্যাশন।

নারায়ণগঞ্জের দল ঐকিক থিয়েটার। ঢাকায় তাদের প্রযোজনা দেখি অন্তর্যাত্রা। সাজেদুর রহমান চঞ্চল নির্দেশিত সম্মিলিত উদভাবনা এই প্রযোজনা। শুনেছি, নাট্যকলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ আর ভারতের বরোদা থেকে পি.এইচ.ডি- করা চঞ্চল ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ মাস ছয়েক যাওয়া-আসা করে এই রূপায়ণ করেন। সঙ্গীত-সংলাপ-কবিতা-বর্ণনায় শারীর বিচিত্র বিবিধ নৃত্ত-মুদ্রা যোগে নাট্যটি নির্মিত। মনে হয়, নির্দেশক আপ্রাণ মরিয়া ভাবন-অনুভাবন ব্যাখ্যান আরোপণের উচ্চাভিলাষে আখ্যান-বাচনটি গড়ে তুলেছেন। বলতে গেলে ব্রক্ষ্মাণ্ড-সৃজন থেকে শুরু হয় নাট্য। বিজ্ঞানের অনুমান-সিদ্ধান্তরাজি বয়ান করেন শরীরবাচনে, কাব্যছন্দে,সঙ্গীতের একক ও যূথবদ্ধতায়।

তারপর উপনিষীদিয় শ্লোক, চর্যাগীতিকা এলোমেলো পারম্পর্যে গীত হয়। মৌল আখ্যানটি শুরু হয় বুঝি চর্যাকালীন এক সংকটসূত্র থেকে। স্বদেশীয় বাস্তবতায় দিশেহারা এক সাধকদল সত্যের সন্ধানে বিশ্বপরিক্রমায় বের হন। কী সে সংকট-মাত্রা যার পন্থা স্বদেশে মিললো না বলে এই যাত্রা- সেই দ্বন্দ্বাতুর দশা খানিকটা সরল বুঝি। নতুন-পুরনো ন্যায়নীতির এক ক্ষমতা-বিরোধে সংঘটিত সে দ্বন্দ্ব। বিশ্বযাত্রা ঠিক ঐতিহাসিক সূত্রে নয় বরং নির্দেশকের নাট্যপাঠের প্রণোদনায় ঘটে। গ্রীসিয় ইডিপাসের বা শেক্সপীয়রীয় রাজা লিয়রের শরণ থেকে সত্য-পাঠ মেলে দেশচালনার। রাজা-প্রজা বিরোধের এক শ্রেণীদ্বন্দ্বচেতনা প্রায় পত্রিকা-প্রবন্ধ-ভাষণ-রাজনৈতিকতার অতিরেক বাচনে ব্যাখ্যাত হতে থাকে। সেই সঙ্গে শারীর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, অভিনয় ও কোরিওগ্রাফির মুহুর্মূহু রূপ-রূপান্তর। সংলাপ-বর্ণনা- ব্যাখ্যানের উচ্চকিত প্রচল রাজনীতিকথন ভারাক্লান্ত করে তুলতে চায় শ্রবণ-মনন। দৃশ্যক্রিয়ার গতিময়তা ও সঙ্গীত-ধ্বনির বিচিত্রতা বরং অনেকখানি প্রশমন করে দর্শক-উপভোক্তার মন, কান ও দৃষ্টি। যদিও মিতবাক নৈঃশব্দের অনুপস্থিতি ব্যহত করে ভারসাম্যময় কোনো নাট্য রূপায়ণে। শিল্পনন্দন ইশারা-ইঙ্গিতের সহায়তা-বিনা গঠিত হতে তো পারে না। একধরনের বিহ্বল বিমূঢ় দশা হয় দর্শকের অতিরেক এই আধিক্যে। যৌথ উদভাবনা বলা হলেও- নির্দেশকের তারুণা-যৌবনের অমিত উচ্চাশা গোটা প্রযোজনায় মুখ্য চরিত্র হয়ে ওঠে- সেই কৈশোরক আততি তারিফযোগ্যই লাগে। তবে সঙ্গীত পরিকল্পক ও গায়ন-বাদনকর্তা অসিত কুমার তার দল নিয়ে দাপটের সঙ্গে ধ্বনির এক পরিমণ্ডল গড়ে তোলেন- তার এই সামর্থ্য মুগ্ধ করে।

সবার উপরে অভিনেতৃ-কুশীলবের যৌথ অভিনয়ের শারীর-তাকদ বিস্ময় জাগায় ঢাকার দর্শকের মনে। এতখানি শ্রমনিষ্ঠা ঢাকার যে-কোনো দলেই আজ দুর্লক্ষ্য। নাট্যকর্মশালার সেই শারীর-পারঙ্গমতা ক্রমে অবসিত হয়ে আসছে তো। ঢাকা থিয়েটারের প্রবল প্রযোজনাসকল বা এস. এম. সোলায়মানের প্রযোজনার শারীরগতি কিংবা জামিল আহমেদের বিষাদসিন্ধু আজ প্রায় মিথ। বছর কয়েক ধরে কামালউদ্দিন নীলুর বিদেশী-অর্থে নির্মিত সিএটি-র প্রযোজনা আর ঢাকা থিয়েটারের নবীণ প্রযোজনা নিমজ্জন-এ নবীণ-নাট্যজনের শারীরিক ক্ষিপ্র-সামর্থ্য অন্তর্যাত্রা স্মৃতিতে মনে পড়ে।- ‘যৌবন রে তোর শিয়রে দংশায় নিঠুর কাল ভূজঙ্গ রে’- এই তো বাংলাদেশ ও তার মঞ্চের অধুনা-দশা।

সবশেষে বলি, বরিশালের শব্দাবলীর ষ্টুডিও থিয়েটার প্রযোজনা- নীল ময়ুরের যৌবন-কথা। সেলিনা হোসেনের আখ্যান সৈয়দ দুলালের নির্দেশনা। চর্যাপদকালীন ব্রাত্য বাঙালিজনকথা এটি। এমন আখ্যান বিশিষ্ট নাট্যমুদ্রায় রূপায়িত। অভিনয় ও প্রযোজনা সুরে, ভঙ্গীতে বাদ্যে, পোশাকে- শরীর-বাচিক এক ভাষা তৈরি করেছে। এ কাজে তাদের পূর্ববর্তী নানা প্রশিক্ষকের শিক্ষা সহায়ক হয়েছে নিশ্চয়। তবু নির্দেশক সৈয়দ দুলাল সৃজন রসায়নে নান্দনিক এক দৃশ্যকাব্য রূপায়ণ করেছেন। এক দশকাধিক যাবৎ বরিশালে বাংলাদেশের প্রথম এই ষ্টুডিও থিয়েটার প্রতি সপ্তাহে প্রায় নিয়মিত নাটক করছে। ঢাকার নাট্যজন কী বলবেন সমর্থ এই শক্তিমত্তকে?

ড. বিপ্লব বালা : নাট্যজন, শিক্ষক ও সমালোচক