Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর ...

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ওয়াহিদ ভাই চলে গেলেন। যাবার আগে দিন-তিনেক তিনি আমাদের জন্য তাঁর প্রস্থান-বার্তার সংকেত পাঠাচ্ছিলেন। নীরবে সেই সত্যিটা মেনে নিলেও মনের গহীনে বার বার একটা মসলিনের ঘোমটার ভেতর আশার অংকুর ছিল অস্তিত্বমান, যদিও কাঁপা কাঁপা। কয়েকদিন ধরে হাসপাতালের একটা অনাত্মীয় শয্যায় আমাদের সবচেয়ে চিন্তাধর ও কোমলকণ্ঠ কথক বাকহীন শুয়ে ছিলেন, অতএব তাঁর চলে যাওয়াকে তো বাস্তব বিচারে আকস্মিক বলা যাবে না। তবুও একান্তে যখন ভাবি, মনে হয় তা তো ততোধিক। শেষ যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে, ছায়ানট ভবনের অফিসে একটা ছোট সভা সমাপনের পর, বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিয়মিত আটপৌরে কথোপকথন- ‘আমাদের একটু আলাদা করে বসতে হবে’। সেই বসাটা হয় নি, ধারণা ছিল, আমার সাথে কী তাঁর আলাদা কথা, সেই বাক্যালাপ হয় নি। বিদায় নেবার সময় বাঙালি যেমন করে বলে ‘আসি’, তেমন রীতিও মানা হয় নি। অথচ ওয়াহিদ ভাই চলে গেলেন। আমাদের অনেক কথা তো ছিল, যে কথা হয়ত পুনরুক্তি যদিও তা নেহাতই প্রয়োজনীয়। দেশটায় রাজনৈতিক কর্মসূচির নামাবলি গায়ে অবরোধ চলছে, তারও আরো অনেকদিন আগে থেকে ওয়াহিদ ভাই ও আমরা যারা তাঁর সহগামী, অবরুদ্ধ বোধ করছি, দেশের প্রান্তর আর বাগান বিলীন হয়ে সেনানিবাস গড়ে উঠেছে দেশের জনসংখ্যাবৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সেগুলো সব সংরক্ষিত এলাকা, সারা বাংলাদেশ যেন এক অঘোষিত কারাগার, সেখানে ওয়াহিদুল হক এবং আমরা যারা তার পথকে অনুসরণীয় মানি, তারা বন্দী, আর বন্দীর সংখ্যার চেয়ে যেন প্রহরীর সংখ্যা আরও বেশি, আমপাতা-জামপাতা, নীল আর কালো জামার প্রহরী, এমন প্রহরার মধ্যে ওয়াহিদ ভাই বার বার সহজেই বুঝিয়ে দিতেন এই আমাদের জমি-জিরাত, অবিনাশী ঠিকানা।

কিন্তু আমি এমন কী কথার নেশার মধ্যে চলে যাচ্ছি! আসলে ওয়াহিদ ভাই কি এমন কোনো প্রপকের মধ্যে আমাদের চেতনপ্রক্রিয়াকে পরিচালনা করেছিলেন যে, ব্যক্তিগত শোক আর হারানোর কথা বলতে গিয়ে নিজের বাড়ির চারপাশে কী ঘটছে তা কোনোভাবেই পরিহার করা যায় না? আমি তো তাঁর মহাপ্রয়াণের ক্ষণটাকে ঘিরে কথা বলতে চাইছি। আঠারো জানুয়ারি ঢাকার বাইরে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছি। মুঠোফোন বাজল, ছায়ানটের সহকর্মী বেলাল জানাল- ওয়াহিদ ভাই বারডেম হাসপাতালে, নিবিড় পরিচর্যার প্রকোষ্ঠে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করার অবকাশ ছিল না। ঢাকায় ফিরেও আমার এক সহোদরার জরুরি চিকিৎসা নিয়ে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়তে হল যে, বারডেম-ওয়াহিদ ভাই ইত্যাদি মনের পর্দা থেকে সরে গিয়েছিল। সেই লজ্জা আর অপরাধবোধ নিয়ে বোধহয় বাইশে জানুয়ারি দর্শনার্থী হয়ে প্রথম হাসপাতালে গেলাম। দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে মানুষটি দেখা হলেই ডান হাতটা কাঁধের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে নানান কাজের কথা, পরিকল্পনার কথা বলতেন, তিনি নির্বাক শুয়ে আছেন, তা-ও সেই অতি চেনা আপনজনকে শনাক্ত করতে হবে নানা-রকমের চিকিৎসাজাগতিক যন্ত্রানুষঙ্গের ভেতর দিয়ে, এমন একটা প্রত্যক্ষতার অভিজ্ঞতায় সায় ছিল না মনের ভেতর দিকে। হাসপাতালের তিনতলার মাঝামাঝি চত্বরটায় পৌঁছেই অবশ্য অনুভব করেছি, নীরব ওয়াহিদ ভাই এখানেই আছেন অনেক শুভানুধ্যায়ী মানুষের করুণ চোখের পাতায়। আমি ঠিক আমার অনুভবটা প্রকাশ করতে পারব বলে মনে হয় না। হাসপাতালে ওই দৃশ্যটা ওই দিন, তারপরের দিন, তারও পরের দিন মোটামুটি একই চরিত্রের ছিল। নতুন যে দর্শনার্থী আসছেন, তাঁদের কেউ কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করছেন, সর্বসাম্প্রতিক অবস্থা কেমন; আমি নিজে শুধাই নি সে প্রশ্ন, অন্যরা যে অনুচ্চ স্বরে বলাবলি করছে তা থেকে জানা হয়ে যাচ্ছে, তার চেয়েও বড় কথা আমি অপেক্ষমান-উপবিষ্ট-দণ্ডায়মান-পায়চারীরত অনেক স্বজনদের চোখ-মুখ দেখেই বুঝে নিতে পারছিলাম, চারতলায় যে মানুষটি অচেতনায় সমর্পিত, তিনি কেমন আছেন, আশার দীপের সলতে কেমন স্বল্পালো ঘোর সৃষ্টি করছে। হাসপাতালের ওই অভিজ্ঞতার রোমন্থন করতে গিয়ে সেই মানুষটাকেই যেন আবার আবিষ্কার করি। এমন এক সকরুণ দৃশ্যসজ্জা কি আমি বা আমরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি? এত মানুষ ওখানে, তবু কোনো কোলাহল নেই, সবাই মিলে একটু-আধটু আলাপচারিতায় মগ্ন হলে যে শব্দ-আবহ সৃষ্টি হয়, তা-ও নেই, অথচ মুঠোফোনে সংবাদ লেন-দেন হচ্ছে, ডেকে আনা হচ্ছে সম্ভাব্য এক- দুই-তিন তরণকে, যাঁরা জৈবিক এবং প্রতীকী যুগপৎ অর্থে তাঁদের রক্ত দিয়ে ওই মানুষটির জন্য তাদের ভালোবাসা জানাবে। নানারকম জৈবরাসায়নিক প্রতিবেদনের কথা শুনছি, আমাদের প্রিয় রোগীর অবস্থা কেমন তা জানছি আমরা শুধুই নির্ধারিত কথোপকথনে, আমি লক্ষ করি নি কোনো অতিরিক্ত ঔৎসুক্য, কী হলো, কেমন আছেন, কী বলছেন চিকিৎসকরা, অক্সিজেন গ্রহণের তারতম্য এখন কেমন, এইসব প্রয়োজনীয় কথা একটা সাধারণ নিয়মে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের মাঝখানের সিঁড়ির ডান দিকে, বাম দিকে অনেক মানুষ, অধিকাংশই তরুণ-তরুণী, অনেকে আমাদের মত প্রায় পৌঢ়, সবাই প্রধানত নিশ্চুপ, নির্বিকার, কোনো এক অশনী-সংকেতের দূরাগত ধ্বনি বুঝি তারা শুনতে পেয়েছেন, তাই অন্তর্গত উদ্বেগ-তাড়নাকে শুধুই নিথরতার আবরণে ঢেকে রেখেছেন। আমি নিজেই এমন এক দৃশ্যের কুশীলব। সেই আমি চেনা বন্ধুদের দিকে তাকাচ্ছি ভাবলেশহীন, বন্ধুবর মুরশিদ, দু’জনে সদাই কথা বলি, কিন্তু কী আশ্চর্য ওই বন্ধু ও আত্মীয়বহুল করিডোরে আমরা চুপচাপ বসে আছি। অনেক্ষণ আগে থেকেই ওখানে বসেছিলেন, অথবা সদ্য এলেন এমন কাউকে হয়ত হাত ছুঁয়ে বলে দিয়েছি আমার কথা, তিনিও নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন নিঃশব্দ কথন কত সুগভীর হতে পারে! সাংস্কৃতিক সংগঠন কণ্ঠশীলন বা আনন্দধ্বনির শিল্পীরা-শিক্ষার্থীরা ভাষাহীন চোখ মেলে অথবা আধো-নয়নে তাকিয়ে আছে, বসে আছে সারিবদ্ধ হয়ে হাসপাতালের মেঝেতে, কারো কারো বিহ্বল কাঁধ আশ্রয় খুঁজেছে সতীর্থের বাহুতে, ক্ষীণ অশ্র“ধারা আমি দেখতে পেয়েছি, কিন্তু বুঝেছি ভেতরে আছে জোয়ারের টান। আর হাসপাতালের কর্মীরা, যাঁদের অনেকেই জানেন না, কে এই ওয়াহিদুল হক বা অহীদুল, তাঁরা এরা আগে তো কত সব খ্যাতিমান মানুষকে রোগী হিসেবে দেখেছে, দেখেছে কত দামী পোশাক-আশাক পরা অথবা ক্যাডার পরিবৃত দর্শনার্থী, অথচ এরা কারা, বসে আছে চুপচাপ, এত মানুষ, অথচ হট্টগোল নেই, ‘একবার এক মিনিটের জন্য দেখে আসি’ এমন অযাচিত অনুরোধের চাপ সৃষ্টি করছে না, তাঁরা বারডেমেরে ওই চিকিৎসক ও কর্মীরা তাই এমন ভিড়ের মধ্যে যাতায়াত করতে গিয়েও একবার বলছেন না- ‘এত লোক কেন, আপনারা নিচে যান, সরে দাঁড়ান’ ইত্যাদি। এমন দৃশ্য আমি কখনো দেখি নি।

ছাব্বিশে জানুয়ারি সকালে এবং বিকালেও হাসপাতালে গেছি। একই রকম সব সংলাপ। এইটা একটু ভালো, গায়ের তাপমাত্রা একটু নিম্নগামী ইত্যাদি। রাত দশটার দিকে কাছাকাছি ছিলাম। আর একবার যাব কিনা জানার জন্য ওই বেলালকেই আবার ফোন করলাম। ও বলল, দরকার নেই। সাতাশ তারিখ বিকেল তিনটায় একটা ক্লাশ শেষ করে বেরিয়েছি। ‘থিয়েটারওয়ালা’ সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার সহ ঢাকায় ফিরছি। হাসানের মুঠোফোনে সংবাদ এলো, বিপ্লব বালা জানিয়েছে- জীবন জীইয়ে রাখার যন্ত্রপাতি ডাক্তাররা সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাথে সাথে বেলালকে ফোন করলাম- একই তথ্য। চারটার দিকে হাসপাতালে পৌঁছে জানলাম, এখনও সবশেষ সংবাদ তৈরি হয় নি। একটু পরেই করিডোরের বদ্ধ বাতাসে ঘোষিত হলো সেই সংবাদ। ওই যারা বসেছিল মেঝেয়, সিঁড়িতে, আকুল অনুচ্চ রোদনের আলিঙ্গনে নিজের শোকটা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে, কী এক অসামান্য সৌহার্দ্য ও মৈত্রী ওয়াহিদ ভাই গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। স্তব্ধতা ও স্বজনবিয়োগের যে এক অশ্রুজীর্ণ সংস্কৃতির মহড়া চলছিল এ ক’দিন ধরে, সেখানে তখন অনুপ্রবেশ ঘটেছে আগ্রাসী গণমাধ্যমের, আরো অনেক মানুষ তখন, ওই যাদের গত কয়েকদিন ধরে দেখছি, ওরা কাঁদছে, সে যেন এক ধ্রুপদী কাঁদন, ওরা কেউ-ই পারিবারিকভাবে বা রক্তের সম্পর্কে ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছের মানুষ নয়। আর পার্থ, তাঁর পুত্র, সার্থক ওর নাম, কথায়, চলনে, প্রকাশভঙ্গিতে বিচলিত হবার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রুচিরা, মিতা, কী স্তব্ধ, অথচ অন্তরের ভূ-ভাগ যে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, সে তো বুঝতে পারছি। বুঝতে পারি না, কেমন করে এমন অভিজ্ঞতা সত্যি হয় যে, যারা বাস্তব বিচারে পর তারা আপনজনের জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারি, ওয়াহিদুল হকের জন্যই এমনটা সম্ভব ছিল। পরকে আপন বন্ধু করার রবীন্দ্রবাণীকে এর চেয়ে সুন্দরভাবে আর কোনোদিন মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি নি। একালের এক অক্লান্ত রবীন্দ্র বার্তাবাহকের মহাপ্রস্থান ঘটলো।

মহাপ্রস্থান নাটকের দ্বিতীয় পর্ব। পরের দিন আটাশে জানুয়ারি, সকাল সাড়ে নয়টায়, ছায়ানট ভবনে। হাসপাতালের দৃশ্যটাকে যদি বলি ‘সচরাচর দেখা যায় না। ঠিক কোনো সাধারণ মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা যাবে না’, তাহলে এই দ্বিতীয় পর্বের জন্য একটা বিশেষণই ব্যবহার করা যায়- ‘অনন্য’। এটা ওয়াহিদ ভাইয়ের একটা প্রিয় শব্দ। ছায়ানটের বিনির্মিত ব্যতিক্রমী স্থাপত্যের সংস্কৃতি ভবনের কেন্দ্রে ওয়াহিদ ভাই আকাশমুখী মুদিত নয়নে শায়িত। তাঁর চারপাশে অসংখ্য রক্তগোলাপ। এর আগে কোনোদিন গোলাপকে এত লাল মনে হয় নি, সে কি এ-জন্য যে, আমরা অজস্রজন যারা তাকে কাছ থেকে দেখেছি, সেই কবে থেকে কোনোভাবেই স্মরণ করতে পারি না, তাদের অন্তরের গভীর গহ্বরে যে এখন যে রক্তাক্ত অনুভূতি, তার সবটুকুকে ধারণ করতে চেয়েছে ওই রক্তগোলাপের সমাবেশ? ছায়ানট ভবনের এই অন্দর মহলের স্থাপত্যরীতিটা তো বেশ কিছুদিন ধরে আমাদের সকলের কাছে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, তার অসাধারণত্ব নিত্যদিনের দৃষ্টি পরিক্রমায় ঘরোয়া হয়ে উঠেছিল। আটাশে জানুয়ারির ওই প্রভাতে দোতলার খোলা জায়গা থেকে দেখছি, আমাদের সর্বজনের (ওখানে আমরা যারা সম্মিলিত হয়েছিলাম) পরম আত্মীয়, বান্ধব, দিশারী, নির্দেশক, গুরু ওই ওখানে পুষ্পপরিবৃত, সুস্থির, বলা যায় অবিচল, মানুষ আসছে, তাদের বেশিরভাগকে চিনি, হয়ত অনেকের নাম জানি না, হঠাৎ এসে জড়িয়ে ধরছে, ওই কোণায় একজন দু’জন নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে অথবা লুকাচ্ছে, সিঁড়িতে মানুষ, ত্রিমুখ ভঙ্গিমায়, উঠা-নামা-দাঁড়ানো, আরো ওপর পানে তাকাই, তিনতলায়, ছায়ানটের ছাত্র-ছাত্রী, তাদের অভিভাবক, নালন্দার শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাকর্মী, যারা আর কোনোদিন ওয়াহিদ ভাইয়ের হাসির, হাতের, কথনের পরশ পাবে না। ছায়ানট ভবনের এই স্থাপত্যকলা আমার কাছে তখন সুচিন্তিত কোনো ভাবনার নকশা থেকে অবলীলায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে, এই ভবন তখন এক পরাবাস্তব অস্তিত্ব অর্জন করেছে, জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে, নির্মাণ আর পুনর্নির্মাণের দ্বন্দ্বে ও মৈত্রীতে। এই নান্দনিকতার সর্বান্তঃকরণ বোধের জন্য ওয়াহিদ ভাই-এর চলে যাওয়াও যেন কী প্রবলভাবে সাংকেতিক! দোতলায় গান করছে তাঁর অনুসারী, শিক্ষার্থী, স্বজন, গলা বেসুরো হয়ে যায় এমন ভক্তকুল। তাদের মধ্যে আছেন প্রবীণ মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী, আছে শিশুশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের গান, ওয়াহিদ ভাইয়ের প্রিয় গান, আমাদের সবার প্রিয় গান, কত অনুষ্ঠানেই তো শোনা হয়েছে, একাকী গৃহকোণেও, প্রিয়জন-সংলগ্নতায়, তবে আজ কেন রবীন্দ্রধ্বনি এমন আলাদা মহিমা অর্জন করে! বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই পরিবেশনার কোনো বাঁধনজাত পরিকল্পনা নেই। একটা শেষ হবার সাথেই আর একজন অন্য একটা গানের স্থায়ীর দু’তিনটে শব্দ গাওয়ার সাথে সাথে সবাই যোগ দেয়। কোনো সুগ্রথিত বা সুনিশ্চিত তালিকা ছিল না। তাতে কোনো অসুবিধাও হলো না। রবীন্দ্রনাথের গানের এমন অর্থদ্যোতনা। এই বুঝি সুরের ঝর্ণাধারা। আপনজনের বিয়োগ-ব্যথায় ক্রন্দনের যে সংক্রামক ধারাবাহিকতা আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ, এই সুরের ধারা তাতে কোনো বিপর্যয় ঘটাচ্ছে না, এ যেন এক অসম যুগলবন্দি, তবুও অপূর্ব, অপরূপ। আমি প্রিয়জনের নির্জীব দেহের পাশে অনেকবার দাঁড়িয়েছি, অবরুদ্ধ কণ্ঠে, অন্য কারো হাতে হাত রেখে, কিন্তু এ কোন যাত্রী তিনি, আমাদের ওয়াহিদ ভাই, রবীন্দ্রনাথের গানের অবিরল স্রোতে তাঁর তরণী তিনি নিজে বেয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, আমরা কি জানাতে চাইছিলাম- আপনার শিক্ষণ, আপনার বাণী, আপনার অনুপ্রেরণা, সুরচর্চা, সমাজভাবনা, সুদ্ধতার জন্য নিরপেক্ষ সাধন- তার প্রতি বিস্বস্ত থাকব আমরা? এ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য, অভাবিত শ্রুতিনৈবেদ্য, বিদায় বেলার কাহিনী।

ছায়ানট থেকে শহীদ মিনার, ছায়ানটের প্রায় প্রতিটি ধূলিকণায় তিনি আশ্লিষ্ট হয়ে আছেন। কিন্তু ওয়াহিদুল হক সুস্থ সংস্কৃতি চর্চা ও সংগঠনের এমন এক কীর্তিমান ব্যক্তি যে তাঁর পদচারণা ছিল বহুবিচিত্র চত্বরে। আমি এই লেখায় কেবল দৃশ্যরচনায় সীমাবদ্ধ থাকতে চেয়েছি, তাই অন্য কোনো বিবরণী বা বিশ্লেষণে প্রসঙ্গান্তরিত হবার প্ররোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। ওয়াহিদুল হক ছিলেন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের এক অসামান্য সংগঠক, সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। তাই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শহীদ মিনারে যে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের ব্যবস্থা হয়েছিল, সামরিক রীতিতে সেখানে ওয়াহিদ ভাইয়ের প্রতি সম্মানসূচক গার্ড প্রদর্শন করা হয়। তা-ও আমাকে আপ্লুত করেছিল, যদি হাসপাতাল থেকে ছায়ানট পর্যন্ত যা কিছু নিবেদন সেখানে আনুষ্ঠানিকতা ছিল পলাতক, আন্তরিকতার পরম প্রাবল্যে। তারপর শহীদ মিনারের চত্বরে মনে হয়েছিল, এ এক যেন ১৩৪৮ সালের সেই বাইশে শ্রাবণ। কোনো ভাষণ নেই, কোনো ঘোষণা নেই, মানুষ আসছে, যেমন করে দখিনা আসে, পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইছে শিল্পীরা, চেনা-অচেনা। কিন্তু তাঁদের সবার চেনা, সবার প্রিয়, সবার আপন মানুষটির জন্য। আমার বিশ্বাস যেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে অস্বীকার করতে চায়। আমার মনে হচ্ছিল, ওয়াহিদ ভাই শুনতে পাচ্ছেন, তাঁর অনুসারীদের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, আমাদের প্রাণের গভীরে বেজে ওঠা রোদনের-হারানোর নিরন্তর ধ্বনি।

শফি আহমেদ : অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়