Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

বাংলাদেশের যাত্রাগান ও যাত্রাদল

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

যাত্রাগানের ইতিহাসে শ্রীচৈতন্যদেবের (১৪৮৬-১৫৩৩) প্রভাব ও অবদানকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এ-সময়েই যাত্রা তার শোভাযাত্রার খোলস ছেড়ে নাটমন্দিরের আঙিনায় ছড়িয়ে পড়ে। উৎসবকেন্দ্রিক পরিবেশনার বাইরে যাত্রা উপস্থিত হয় শ্রীচৈতন্যের সহজিয়া বৈষ্ণধর্ম প্রচারের মাধ্যম হিসেবে। পালাসম্রাট ব্রজেন্দ্রকুমার যেমন বলেছেন-

... চন্দ্রশেখর আচার্যের বাড়িতে শ্রীগৌরাঙ্গ যেদিন অদ্বৈত শ্রীরাম নিত্যানন্দ প্রভৃতি পারিষদদের [পাষিদ] নিয়ে রুক্নিনীহরণ পালাভিনয় করেছিলেন, যাত্রার ইতিহাসে সে দিনটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সহজতম সাধনপদ্ধতির প্রবক্তা শ্রীগৌরাঙ্গের মতো বাংলার মাটির বৈশিষ্ট্যকে কে এমনভাবে চিনেছিল? তিনি অনুভব করেছিলেন, হাজার বক্তৃতা করে বাংলার মানুষকে যা বোঝানো যাবে না, একবার যাত্রাভিনয় করে তাই কানের ভিতর দিয়া মরমে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায়। উনিশ শতকের শেষ পাদে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ বাংলার রঙ্গমঞ্চকে ধন্য করে গিয়েছিলেন। তার সাড়ে চারশো বছর আগে ভগবান শ্রীগৌরাঙ্গ যাত্রাশিল্পকে কৃতার্থ করে রেখেছেন। যতদূর জানা যায়, গোরাচাঁদের এই অভিনয়েই এদেশে সুসংবদ্ধ পালাভিনয়ের সূচনা।১
 
বডু-চণ্ডীদাস ১৫০০ সালে যখন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করেন, তখন শ্রীচৈতন্যদেবের বয়স মাত্র ১৪ বছর। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’র প্রভাব থাকলেও শ্রীচৈতন্যদেবের তাঁর গীতাভিনয়ে নিজস্ব অভিনয়পদ্ধতি সৃষ্টি করেছিলেন। সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য সত্ত্বেও তিনি সংস্কৃত নাটকের ধুপদ অভিনয়-পদ্ধতি গ্রহণ করেন নি। চারিদিকে দর্শকশ্রোতা, মাঝখানে আসরে নৃত্য, গীত ও কথার মাধ্যমে তিনি রুক্নিনীহরণ, ব্রজলীলা, রাবনবধ প্রভৃতি পালা পরিবেশন করেছেন। শোভাযাত্রা যে যাত্রা হয়ে উঠেছে, তা কৃষ্ণজন্মযাত্রার উৎসব উপলক্ষ্যে চৈতন্যদেবের অভিনয় থেকেই। চৈতন্যচরিত্রামৃত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে-

এই মত নানারঙ্গে চাতুর্মাস্য গেলা।
কৃষ্ণ-জন্ম-যাত্রায় প্রভু গোপবেশ হইলা॥
কৃষ্ণ-জন্ম-যাত্রা দিনে নন্দোমহোৎসব।
গোপবেশ হইলা প্রভু লইয়া ভক্ত সব॥২  

যাত্রাগানের বিকাশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। যাত্রার উৎপত্তি যেমন থিয়েটার তথা নাটকের আগে, যাত্রার বিকাশও তেমনি নাটকের আগেই শুরু হয়েছে। তাই নাটকের আলোচনা করতে গেলে যাত্রার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা এই যে, আমাদের দেশে নাটককেন্দ্রিক আলোচনার যাত্রার উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। নাট্যগবেষক ডক্টর বৈদ্যনাথ শীলের আলোচনা এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য-

বাংলা নাট্যসাহিত্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে আলোচনা করিতে হইলে সর্বপ্রথম যাত্রা সাহিত্যের আলোচনা করা প্রয়োজন। কেননা বাংলা নাটক মিশ্র সাহিত্য। ঊনবিংশ শতকে ইংরেজি রঙ্গমঞ্চ এবং ইংরেজি নাট্যসাহিত্যের প্রভাবে আমাদের বাংলা নাট্যসাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে বটে; কিন্তু তাহার পূর্বে আমাদের এই বাংলাদেশে যাত্রা নামে এক প্রকার নিজস্ব জনপ্রিয় অভিনেয় সাহিত্য ছিল।৩
 
গবেষক এখানে যাত্রাকে সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। অভিনেয় শিল্প হিসেবে শক্তিযাত্রা, রামযাত্রা নাথযাত্রা, পালযাত্রা, চৈতন্যযাত্রা প্রভৃতি নানান রীতির যাত্রার প্রচলন থাকলেও ষোড়শ শতকে শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে জন্ম নেয়া কৃষ্ণযাত্রাই অধিকতর স্থায়ী এবং জনপ্রিয় হয়। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের কেঁদুলি গ্রামের অধিবাসী শিশুরাম অধিকারী কৃষ্ণযাত্রাকে শিল্পসম্মতভাবে পরিবেশন করতে উদ্যোগী হন। তিনি ‘কালীয়দমনযাত্রা’র প্রবর্তন করেন। কৃষ্ণলীলার কালীয়দমন পর্বের অভিনয় জনপ্রিয় হতে থাকায় ‘কৃষ্ণযাত্রা’ তখন ‘কালীয়দমনযাত্রা’ নামেই পরিচিত হতে থাকে। এক্ষেত্রে শিশুরাম অধিকারীর অবদান সম্পর্কে জানা যায় তৎকালীন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক রাজেন্দ্রলাল মিত্রের রচনায়-

গত বিংশতি বৎসরের মধ্যে কবির হ্রাস পাইয়াছে। তাহার ত্রিংশৎ বৎসর পূর্ব হইতে যাত্রা বিশেষ প্রচলিত হইয়া আসিতেছিল। শিশুরাম অধিকারী নামা এক ব্যক্তি কেঁদুলী গ্রাম নিবাসী ব্রাহ্মণ তাহার গৌরব সম্পাদন করে। তৎপূর্ব হইতে বহুকালাবধি নাটকের জঘন্য অপভ্রংশ স্বরূপ একপ্রকার যাত্রা এতদ্দেশে বিদিত আছে। সংকীর্তন ও পরে কবির প্রচারের মধ্যে তাহার প্রায় লোপ হইয়াছিল। শিশুরাম হইতে তাহার পুনর্বিকাশ হয়।৪
 
শিশুরাম অধিকারীই নবযাত্রার প্রবর্তক। শিশুরাম অধিকারীর শিষ্য, বীরভূম জেলার রামবাটি গ্রামের পরমানন্দ অধিকারী (১৭৩৩-১৮২৩) যাত্রাগানের মাধ্যমে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটান। তিনি যাত্রায় সঙ্গীতের পাশাপাশি গদ্যসংলাপ প্রবর্তন করেন। ‘কালীয়দমনযাত্রা’র খ্যাতিলাভকারী শ্রীদামদাস অধিকারী ও সুবল অধিকারী নামের দুইভাইকে এই যাত্রার শেষ প্রতিনিধি বিবেচনা করা হয়। ‘কালীয়দমনযাত্রা’ এরপর ‘কৃষ্ণযাত্রা’ নামেই পরিচিতি অর্জন করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের (১৭১২-১৭৬০) ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের কাহিনী অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসুন্দর যাত্রা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এর পরে আসেন লোচন অধিকারী। তিনি অক্রুর সংবাদ ও নিমাই সন্ন্যাস পালা পরিবেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। হুগলী জেলার জিরাট গ্রামের বদন অধিকারী ছিলেন পরমানন্দ অধিকারীর শিষ্য। তিনি কালীয়দমন পালা গাইতেন। পরে তিনি নিজে দল গঠন করেন এবং ‘মান’, ‘দান’ ও ‘মাথুর’ পালা গেয়ে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। এরপর হুগলী জেলার জাহাঙ্গীরপাড়ার গোবিন্দ অধিকারী (১২০৫-১২৭৭) যাত্রাগানের মাধ্যমে গোটা বঙ্গদেশ জুড়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর রচিত ও পরিবেশিত কৃষ্ণযাত্রাগুলো হল কলঙ্কভঞ্জন, মানভঞ্জন, সুবলমিলন, যোগিমিলন, প্রভাসমিলন, ননীচুরি, গোষ্ঠবিহার, মুক্তলতাবলী, কৃষ্ণকালী, দানলীলা বা নৌকাবিহার, অক্রুর সংবাদ, অষ্টকালীয় নিত্যলীলা প্রভৃতি। এরপর বর্ধমান জেলার কাঁটোয়া নিবাসী পীতাম্বর অধিকারী এবং বিক্রমপুরের কালাচাঁদ পাল কৃষ্ণযাত্রার এই প্রবহমান ধারা অক্ষুণ্ন রাখেন।

উনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমি ধাঁচের থিয়েটারের প্রচলন হলে অভিনয়প্রিয় মানুষেরা সেই দিকে ঝুঁকে পড়ে। পক্ষান্তরে অশিক্ষিত আর অল্পশিক্ষিতদের হাতে পড়ে যাত্রা রুচি ও পরিবেশনার দিক দিয়ে ক্রমাবনতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। এসময়ে ‘সখের যাত্রা’র প্রচলনও বাড়তে থাকে। বিদ্যাসুন্দর’র পাশাপশি কলিরাজার যাত্রা তখন পরিবেশিত হত। এই ‘নতুন যাত্রা’ সম্পর্কে ‘সমাচার দর্পণ’ মন্তব্য করেছিল-

‘নূতন যাত্রা এইক্ষণে শ্রুত হইল যে, কলিকাতাতে নূতন এক যাত্রা প্রকাশ পাইয়াছে। তাহাতে অনেক২ ছদ্মবেশধারী আরোপিত বিবিধ গুণাগুণ বর্ণণাকারী মনোহর ব্যবহারী অর্থাৎ সঙ হইয়া থাকে। ... এ সকল সংক্রমে আগত একত্র মিলিত হইয়া বিবিধ বেশ বিন্যাস বিলাস হাস্য-রহস্য সম্বলিত অঙ্গভঙ্গ cyitmi নর্তন কোকিলাদি স্বর ন্যক্কৃত মধুর স্বরে গান নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাদন আশ্চর্য২ প্রশ্নোত্তর ক্রমে পরস্পর মৃদু মধুর বাক্যালাপ কৌশলাদির দ্বারা নানা দিগ্দশীয় বিজ্ঞাবিজ্ঞ সাধারণ সর্বজন মনোমোহন প্রভৃতি করেন। এই অপূর্ব যাত্রা প্রকাশে অনেক২ বিজ্ঞলোক উৎসুক এবং সহকারী আছেন। অতএব বুঝি ক্রমে২ ঐ যাত্রার অনেক প্রকার পরিপাটী হইতে পারে।৫
 
গোবিন্দ অধিকারীর সমসাময়িক যাত্রাওয়ালা কৃষ্ণকমল গোস্বামী (১৮১০-১৮৮৮) যাত্রার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে ব্রতী হন। ১৮৬০ সালে তাঁর রচিত স্বপ্নবিলাস ও দিব্যোন্মাদ পালার মাধ্যমে যাত্রা নতুন প্রাণ পায়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডেই ছিল তাঁর পালা পরিবেশনের অঞ্চল। তাঁর রচিত পালাদুটি ১৮৭২ ও ১৮৭৩ সালে ঢাকা থেকেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালাই যাত্রাসাহিত্যের প্রথম মুদ্রিত দলিল। এরপর ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিচিত্রবিলাস যাত্রাপালা। এই তিনটি পালা নিয়ে গবেষণা করে নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায় পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৬০ সালকে তাই আধুনিক যাত্রার আনুষ্ঠানিক অভিযাত্রার মাহেন্দ্রণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এই সময়ের আরেকটি যাত্রার কথা জানা যায় হৃদয়নাথ মজুমদার নামে ঢাকার এক আইনজীবীর স্মৃতিকথা থেকে। গবেষক মুনতাসীর মামুন এই স্মৃতিকথা থেকে তথ্য নিয়ে জানিয়েছেন যে-

যাত্রার জন্যে ঢাকা ছিল বিখ্যাত। সীতার বনবাস হলো ঢাকার প্রথম যাত্রা। তারপর একরামপুর থেকে স্বপ্নবিলাস নামে একটি যাত্রা মঞ্চস্থ হলো। এই যাত্রা শহরে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। স্বপ্নবিলাস-এর সাফল্যের পর একরামপুর থেকে পরপর মঞ্চস্থ হলো রাই-উন্মাদিনী ও বিচিত্রবিলাস। নবাবপুরের বাবুদের তখন বেশ নামডাক। যাত্রা প্রতিযোগিতায় তারাও পিছিয়ে থাকতে চাইলেন না। তাদের উদ্যোগে মঞ্চস্থ হলো ধনকুণ্ডু, নৌকাকুণ্ডু এবং ব্রাহ্মের গীতা। কিন্তু এর কোনোটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে নি।৬

ঢাকার শেষ এমেচার যাত্রা কোকিল সংবাদ। সুভাড্যার কয়েকজন ভদ্রলোক মিলে এর আয়োজন করেন। শহরে ছয়মাস এবং গ্রামাঞ্চলে প্রায় একবছর ধরে কোকিল সংবাদ চলেছিল।

হৃদয়নাথ মজুমদার সীতার বনবাস’কে ঢাকার প্রথম যাত্রা অভিহিত করেছেন। বিশিষ্ট ঔপন্যাসিক, গবেষক ও রাজনীতিবিদ সত্যেন সেন (১৯০৭-১৯৮১) একে নাটক হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং তা স্বপ্নবিলাস-এর আগে অভিনীত হয়েছিল বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন-

এ-বিষয়ে কোনই সন্দেহ নেই যে, কলকাতার পেশাদারী থিয়েটারের দলগুলি বছরের পর বছর এখানে এসে অভিনয় করার ফলেই এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে থিয়েটারের হুজুগ জেগে ওঠে। ঢাকায় বসাকরা বহুকাল আগে থেকে উৎসাহের সঙ্গে গান বাজনা চর্চা করে আসছিলেন। নাট্যাভিনয়ের তরঙ্গ তাঁদের মনে দোলা জাগিয়ে তুলল। সময়টা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। ঊনিশ শতকের শেষভাগে নওয়াবপুরের বসাক সম্প্রদায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সীতার বনবাস অবলম্বনে একটি নাটক মঞ্চস্থ করলেন। এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে একরামপুরের অধিবাসীরা কৃষ্ণকমল গোস্বামী রচিত স্বপ্নবিলাস নাটক অভিনয় করলেন। এই নাটক পরপর ছয় রাত্রি মঞ্চস্থ হয়। এই ঢেউ এবার গ্রামাঞ্চলেও গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৩২ সালে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার মোগরাপাড়ার (প্রাচীন সোনারগাঁ) সৌখিন ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরপর দুই রাত্রি স্বপ্নবিলাস-এর অভিনয় হয়েছিল।৭
 
সত্যেন সেন সীতার বনবাস’কে ঊনিশ শতকের শেষভাগে পরিবেশিত নাটক হিসেবে মনে করেছেন। কিন্তু এটি যদি স্বপ্নবিলাস-এর আগে অভিনীত হয় তাহলে এর অভিনয়কাল ১৮৬০ সালের আগে হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এ সময়ে কৃষ্ণকমল গোস্বামীর-র স্বপ্নবিলাস নামের যাত্রাপালা রচিত ও অভিনীত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া সীতার বনবাস থিয়েটারমঞ্চে অভিনেয় নাটক মনে না করে যাত্রামঞ্চে অভিনেয় পালা মনে করাই সঙ্গত। কারণ এটি প্রত্যন্ত গ্রামের খোলা মঞ্চে অর্থাৎ যাত্রামঞ্চে অভিনীত হওয়ার উপযোগী। বাঙালি সমাজ, ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রণী পুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) এই সীতার বনবাস-এর কাহিনীকার হিসেবে যাত্রার ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সীতার বনবাস-এর কথা গেজেটিয়ারে পাওয়া যায় এভাবে-

It was in 1862 that Purba-Banga-Ranga-Bhumi, a public theatre, was established in Dacca [Dhaka]. The Basaks of Nawabpur introduced the Jatra, and the first performance was Sitar Banobas. This was followed by Islampur Hindus, who staged Swapna Bilas. Swapna Bilas was written by Krishnakamal Goswami, a domiciled Hindu of Dacca. The drama or Jatra was re-staged at Murapara in 1882. Rai Kumudini [Unmadini] improved upon such Bengali Jatra dramas and composed songs and set them to musical tunes suitable for occation. Jatras used to be accompanied by Hindu Kheyal Thumri.

১৮৬৪ সালে অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শকুন্তলা গীতাভিনয় রচিত ও অভিনীত হয়। হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় এটিই প্রথম বাংলা গীতাভিনয়।৯  ঢাকায় এসময় নবাবপুরের বাবুদের সঙ্গে রেষারেষির রেশ ধরে সূত্রাপুর ও একরামপুরের বাবুরা মৈষুণ্ডির গোবিন্দ চক্রবর্তীর লেখা নারদ সম্বাদ বা প্রভাসলীলা পালা মঞ্চস্থ করেছিল। এরপর রামকুমার বসাকের পালা ধনকুণ্ড, নৌকাকুণ্ড, ব্রহ্মার গীত এবং গোবিন্দ চক্রবর্তীর অপর পালা কুণ্ডেশ্বরীর মিলন-ও তেমন জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে নি।১০

ঢাকায় কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালার আরো সংবাদ জানা যায় আলেকজান্ডার ফর্বেস সম্পাদিত দি বেঙ্গল টাইমস পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে। ১৮৮৭ সালে লেখা ‘থিয়েট্রিক্যাল’ শিরোনামের এই চিঠিতে প্রায় ১২ বছর আগের অর্থাৎ ১৮৭৫ সালে অনুষ্ঠিত কৃষ্ণকমলের যাত্রাপালার উল্লেখ রয়েছে। চিঠিতে বলা হয়-

Sir, Nawabpore is grand arena of histroinic display and aesthetic performance in Dacca, while in music, its excellence is unrivalled. More than a dozen years ago, when theartical performance had not attained that degree of perfection which it now boasts, and when its spread was not so universal as at present, it placed on the stage two or three pieces of country Jatras composed by Krishna Komal Goswame. Since, then, fasion has undergone a radical change. Jatra have vanished, yielding to operas. Same five or six years back, the Nawabpore company performed a beutiful piece entitled Sakuntala. This year that company has produced a piece entitled Utter Ramcharita, describing the later years of ramas life after his return from exile... ১১

এই চিঠিতে নবাবপুর কোম্পানি নামে একটি থিয়েট্রিক্যাল যাত্রা কোম্পানির তথ্য পাওয়া যায়। এই দলের জনপ্রিয় প্রযোজনা ছিল শকুন্তলা গীতাভিনয় ও উত্তর রামচরিত নামের দুটি পালা। থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানিগুলোর পরিবেশনা ছিল যাত্রা ও থিয়েটারের মিশ্রণ। এ ধরনের পরিবেশনা ছিল বেঙ্গল ক্রাউন থিয়েটারের লায়লা ও মজনু, রাজা বাহাদুর এবং মীরা বাঈ।১২
 
১৮৭০ সালের দিকে হাতে গোনা দু’তিনটি যাত্রা দল ছিল। বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার খোকসায় একটি যাত্রাদলের খবর পাওয়া যায়। এটি মহেশ ঠাকুরের দল নামেই পরিচিত ছিল। পরে জানিপুরের গোপী মাস্টারের যাত্রাদলও বিভিন্ন স্থানে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও বরদিতে যাত্রাদল ছিল বলে গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে-

The Jatra parties of Shelaidaha and Baradi of Kushtia were famous. Jatra parties from Calcutta would often entertain the people.১৩  

শিলাইদহের যাত্রা সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যায় রবীন্দ্র-গবেষক শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর রচনায়। কলকাতার থিয়েটারের ঢেউ সুদূর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে এসেও লেগেছিল। যাত্রার স্থানীয় দলগুলোই থিয়েটার করতে শুরু করে। আবার খ্যাতিমান দলগুলোর আগমন এবং পরিবেশনও ছিল যথারীতি। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন-

কলকাতায় সাধারণ বঙ্গ-রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পরেই শিলাইদহে যাত্রার দল নাট্যালয়ে রূপান্তরিত হয় ও প্রহাদচরিত্র অভিনয় করে। গোপীনাথ দেবের রাস ও দোলযাত্রায় প্রতি বৎসর গোপীনাথ-প্রাঙ্গণে শশী অধিকারী, মথুর সা প্রভৃতির যাত্রা, মুকুন্দ দাসের স্বদেশী যাত্রা হত।১৪
 
১৮৯৭ সালে ফরিদপুর জেলার পালঙ এবং সন্নিহিত গ্রামের স্কুলের ছাত্ররা যাত্রা দেখতে যায়। পালঙ গ্রামটি পরে মাদারীপুর জেলার এবং বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত। মহাভারতের কাহিনী উদ্ভূত এই পালা দেখার কারণে স্কুলের ছাত্ররা শাস্তি পেয়েছিল। এদের মধ্যে একজন ছাত্রকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ‘বেঙ্গল টাইমস’-এ ২৭ ডিসেম্বর ১৮৯৭ তারিখে লেখা পাঠক প্রতিবেদন থেকে এই ঘটনা উদ্ধার করা যায়-

Sir, great exitement prevails among orthodox Hindoos in Palang and adjacent villages in the district of Faridpur, on account of same very high-handed proceeding by the Headmaster of a school here. A party of School boys, with the permission of their parents and guardians, visited a jatra Performance, the subject of which was taken from the Mohabharata and was of a religious tendency. For this act the boys ware punished, and one was expleed from the school, pending the sanction of Inspector of schools, East Bengal. It is whispered that this arbitary course of conduct was in consequence of a hunt from the Barisal Congressman.
Yours faithfully
An on-looker15

 ঢাকার বাইরে প্রথম নাট্যাভিনয় অনুষ্ঠিত হয় বরিশালে। দুর্গাদাস কর রচিত স্বর্ণশৃঙ্খল (১৮৬৩) নাটকটি প্রকাশ করেন বৃন্দাবনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজকুমার দত্ত ছিলেন এর একজন প্রধান অভিনেতা। ‘ঢাকা প্রকাশ’ প্রত্রিকায় ‘বরিশালে নাটকাভিনয়’ শিরোনামে যে সংবাদ প্রকাশিত হয় তাতে প্রসঙ্গক্রমে যাত্রার উল্লেখ পাওয়া যায়-

নাটকাভিনয় দ্বারা যে দেশের অনেক উপকার হইতে পারে একথা এক্ষণ কাহাকেও বুঝাইতে হয় না, সকলেই উহার উপকারিতা স্বীকার করিবেন। এতৎপ্রদেশে অসার নাট্যক্রিয়া এবং যাত্রাগান দ্বারা যে সকল টাকার শ্রাদ্ধ হয় তাহার চতুর্থাংশ এ সকল সদুদ্দেশ্যে ব্যয়িত হইলেও শ্লাঘার বিষয় বটে। যাহা হউক এই ক্ষুুদ্র নগর বরিশালে যে, নাটকাভিনয় হইবে ইহা আমরা একদিনের জন্যেও মনে করি নাই।১৬
 
এ থেকে বোঝা যায় যে, স্বর্ণশৃঙ্খল-র আগেও ‘অসার নাট্যক্রিয়া’ এবং ‘যাত্রাগান’ প্রচলিত ছিল। ‘ঢাকা প্রকাশ’ এই ধরনের অভিনয়ের বদলে স্বর্ণশৃঙ্খল-র মতো রচিশীল নাটকের অভিনয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। এতে যাত্রার প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পেলেও এর অস্তিত্ব ও বহমানতাকে অস্বীকার করা হয় নি। এরপর আমরা ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’ পত্রিকায়ও যাত্রানুষ্ঠানের খবর পাই। পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-

‘অদ্য দুই বৎসর যাবৎ কুমারখালীবাসী যুবকেরা নাটকাভিনয়ের আমোদ অনুভব করিতেছেন। আমরা এ পর্য্যন্ত ঐ বিষয়ের কোন উল্লেখ করি নাই, এখানে একটি গীতাভিনয় ও একটি নাটকাভিনয়ের দল আছে। তন্মধ্যে নাটকাভিনয়ই উল্লেখের যোগ্য। স্বাভাবিক চিত্র, ঐকতান, বাদ্য প্রভৃতি নাটকাভিনয়ের উপাদান না থাকিলেও গত শারদীয় পূজার সময় শ্রীযুক্ত মনোমোহন বাবুর রচিত রামাভিষেক নাটকের যে অভিনয় করা হয়, তাহা সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হইয়াছে। শৈলুষগণ নাটকের উপকরণ প্রাপ্ত হইলে কলিকাতা মহানগরীতে অভিনয় করিলেও ঘৃণিত হন, এরূপ বোধ হয় না। বরং কোন কোন বিষয়ে বিশেষ প্রশংসাও লাভ করিতে পারেন। গীতাভিনয়ের গানগুলি যেমন সাধারণের হৃদয়গ্রাহী অন্য বিষয় তদ্রুপ নহে। গীতাভিনয়ের দলপতিরা, ক্রমে সতী, সাবিত্রী এবং কংসবধ প্রভৃতি প্রস্তাবের গীতাভিনয় করিয়াছেন। ইঁহারা পাবনা নিবাসী শ্রীযুক্ত বাবু নফরচন্দ্র পালের রচিত কন্যাবিক্রয় নাটকেরও অভিনয় করেন।১৭

রামাভিষেক নামের যে নাটকের কথা এখানে বলা হয়েছে তা যশোর নিবাসী প্রখ্যাত নাট্যকার মনমোহন বসু (১৮৩১-১৯১২) রচনা করেন ১৮৬৭ সালে। এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিনীত হয়েছে। ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’র প্রতিবেদনে আমরা কন্যাবিক্রয় নামের একটি গীতাভিনয়ের বিবরণ পাই। এটি যাত্রারই নামান্তর। ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’য় ফরিদপুরে এক মেলায় রামাভিষেক নাটক অভিনয়ের আগাম খবর দেওয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-

২৪-এ পৌষ ফরিদপুরের মেলা আরম্ভ হইবে। উদ্যোগের ধুমধাম হইতেছে। মেলাতে রামাভিষেক নাটকাভিনয় করা হইবে। তত্রত্য যুবকগণ দিবারাত্র পরিশ্রম করিয়া ভাব ও বাক্য অভ্যাস করিতেছেন। প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ শখের খাতিরে দাড়ি গোঁপ লোপ করিয়া যেখানে শৈলুয হইয়াছেন, সেখানে যে অভিনয়কার্য্য সুন্দররূপে নির্বাহ হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। শুনিলাম, মেলায় ৬০০ শত টাকা যাত্রার, ২০০ শত টাকা খেমটার ব্যয় নির্দ্ধারিত হইয়াছে, ইহার পর নাটকের ব্যয় ৩০০ শত। অদ্য এই পর্য্যন্ত।১৮

স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে, এ সময় নাটকের অর্থাৎ থিয়েটারের চেয়ে যাত্রার জন্যে অর্থবরাদ্দ থাকত বেশি পরিমাণে। এ থেকে যাত্রার গুরুত্বও অনুমান করা যায়। মহিষবাথান গ্রামে মঞ্চস্থ কুমারখালীর বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্য্যরে ধ্র“বচরিত্র নাটক১৯  প্রকৃত পক্ষে যাত্রাপালা। থিয়েটারমঞ্চে অভিনয়-উপযোগী নাটক হলেও গ্রামের পরিবেশে খোলা মঞ্চে উপকরণব্যতীত মঞ্চায়নের কারণে একে যাত্রাপালার আদলে রূপান্তরের বিকল্প নেই। তাই সেকালের গ্রামের অস্থায়ী মঞ্চে অভিনীত বিষয়কে নাটক বলা হলেও আসলে তা যাত্রা বলেই প্রতীয়মান। এ সময় ‘গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা’য় ধারাবাহিক প্রকাশিত কাঙাল হরিনাথ মজুমদার রচিত সাবিত্রী নাটিকা পাবনায় ব্রজলাল সরকারের বাড়িতে মঞ্চস্থ হয়েছিল। পাবনার মালঞ্চী এলাকা থেকে এই অভিনয়-সংবাদ চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা মুকুন্দলাল সরকার। পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিতে জানা যায়-

... আপনার সাবিত্রী নাটিকা মহদুদ্দেশ্যে পরিপূরক বিশেষ পৌরাণিক বিধায় তদভিনয় দর্শনে কি বৃদ্ধ, কি বালক, কি যুবক, স্ত্রী সকলেই বিশেষ সন্তোষ লাভ করিয়াছেন। যম রাজার দৃশ্যটি যে কি চমৎকার বোধ হয়, তাহা লিখিয়াও শেষ করিতে পারি না।২০
 
পরে এই নাটকটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি থিয়েটারের পাশাপাশি যাত্রামঞ্চে অভিনয়-উপযোগী পালা।

১৮৮৩ সালে ঢাকার ব্রাহ্মসমাজের আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত বিধানপল্লীতে অর্থাৎ বর্তমানে নিমতলীর কাছাকাছি কোনো স্থানে ধারাতলে স্বর্গধাম নামে একটি যাত্রাপালার আয়োজন হয়। বঙ্গচন্দ্র রায় সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু’ পত্রিকায় লেখা হয়- ‘অভিনয়ের ব্যাপারটা অতি সুন্দর জমাট হইয়া আসিতেছিল এমন সময় কয়েকটী মুসলমান ভ্রাতা অন্যায়রূপে চেঁচাইয়া সভা ভঙ্গ করিয়া দেয়’।২১  পরবর্তীকালে এই পত্রিকায় প্রকাশিত এই অভিনয়ের সমালোচনা-নিবন্ধ থেকে জানা যায়-

আমাদের বিগত সাম্বৎসরিক ব্রহ্মোৎসবের পর, বর্ত্তমান সময়ে পূর্ণ ব্রাহ্ম সনাতন এই পূর্ণ পূর্ব্ব বাঙ্গালার উদ্ধারের নিমিত্ত ব্যস্ত হইয়া অবতীর্ণরূপে যে প্রকার লীলা বিহার করিতেছেন, ব্রাহ্ম জননীর সেই নবলীলার অভিনয় কথঞ্চিৎ প্রদর্শন করিবার জন্য ধারাতলে স্বর্গধাম অভিনীত হয়। এই ধারাতলে স্বর্গধাম কোনও মুদ্রিত নাটকগ্রন্থ নহে। লীলাময়ী জননীর শরণাপন্ন হইয়া ঠিক তাঁহার প্রেরিত ভাবানুসারে কয়েকটি ‘দৃশ্য’ রচনা করিবার নিমিত্ত একটী ভ্রাতা চেষ্টা করেন এবং ভগবতীর আশীর্ব্বাদে তিনি অভিলষিত বিষয়ে কৃতকার্য্য হন। ৫ই আশ্বিন সোমবার অভিনয়ের দিন স্থির হয়। তাহার দুদিন মাত্র পূর্ব্বে এই বিষয়টির লেখা শেষ হয়। তাড়াতাড়ি অভিনয়ের সমস্ত আয়োজন হয়। সোমবার দুইশত টীকেট বিক্রয় হয় এবং রাত্রি একটার সময় অভিনয় আরম্ভ হয়।২২
 
ধরাতলে স্বর্গধাম যে যাত্রাপালা তা বোঝা যায় এর অভিনয়শুরুর সময় বিবেচনা করলে। যাত্রা যে মধ্যরাতে শুরু হয়ে সারারাত ধরে চলে, সে রেওয়াজ এখনও রয়েছে। তবে সে সময়ে দুইশত টিকেট বিক্রি হওয়া নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১৮৮৮ সালে রাজশাহী শহরে যাত্রানুষ্ঠানের খবর পাওয়া যায়। স্থানীয় থিয়েটারের চেয়ে যাত্রার প্রতি মানুষের আকর্ষণের তীব্রতা এবং সাংবাদিকের আক্ষেপ জানা যায় সেই সময়ে রাজশাহীর বোয়ালিয়া থেকে শ্রীনাথ রায় সম্পাদিত প্রকাশিত ‘হিন্দুরঞ্জিকা’র স্থানীয় সংবাদ কলাম থেকে-

সেদিন একদল যাত্রা আসিয়া সহরের প্রায় ৩০০ শতাধিক [৩শ’] টাকা শোষণ করিয়াছে-যাত্রাটী কিন্তু পদ্মপুরাণের শ্রেণীর অথচ স্থানীয় একটি থিয়েটারের দিকে কেহ একবার চাহিয়া দেখেন না; স্থানীয় লোকের একটু যতœ হইলে থিয়েটারটির যথেষ্ট উন্নতি হইতে পারে এবং লোকের নির্দ্দোষ আমোদ লাভের একটি প্রস্রবণ উন্মুক্ত হয়; কিন্তু দুঃখের বিষয় সেদিকে কাহারও চক্ষু যায় না। একেই বলে ‘মণি লুণ্ঠতি পাদেন কার্য্যে শিরসি ধার্য্যতে’।২৩
 
অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ সত্ত্বেও যাত্রার ব্যাপক প্রচলন ছিল উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। এসময় যাত্রায় অধিকারী, সূত্রধার, সংগীত, বাদ্য, ‘একানে’ বালকের গান, কৌতুক প্রভৃতি উপাদান সক্রিয় ছিল। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) তাঁর ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৫৮) পত্রিকায় যাত্রার সমালোচনা করে অনেক নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন। এসময়ের যাত্রা সম্পর্কে তিনি বলেছেন-

কালীয়দমন, বিদ্যাসুন্দর, নলোপাখ্যান প্রভৃতি যাত্রায় আমোদ আছে, কিন্তু তত্তাবৎ অত্যন্ত ঘৃণিত নিয়মে সম্পন্ন হইয়াছে, ইহাতে প্রমোদমত্ত ইতর লোক ব্যতীত ভদ্রসমাজের কদাপি সন্তোষ বিধান হয় না।২৪
 
আবার ‘এতদ্দেশীয় সর্ব্বসাধারণ ব্যক্তির প্রতি বিনয়পূর্ব্বক নিবেদন’ শীর্ষক রচনার মাধ্যমে তিনি প্রাচীন কবিগান ও কবিওয়ালার জীবনতথ্য প্রেরণের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাতে ‘সংকীর্ত্তন ও ঢপ ও কালীয়দমন যাত্রার সৃষ্টিকর্ত্তাদিগের জীবনচরিত ও পদাবলী’ সংগ্রহের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।  যাত্রা নিয়ে তিনি কবিতাও রচনা করিয়াছেন। তাঁর একটি কবিতায় আমরা যাত্রার কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পারি। কবি এখানে বলেছেন যে, যাত্রায় সূত্রধর থাকে, বাদ্যকর থাকে, সঙ্গীতশিল্পী থাকে, রঙ্গমঞ্চ থাকে, অভিনেতা (ভাঁড়) থাকে। তবে অধিকারীর একচ্ছত্র নির্দেশেই সকলে কাজ করে থাকে। কবির ভাষায়-

করিছে সকল সূত্র হয়ে সূত্রধর॥
জলধর বাদ্যকর বাদ্য করে কত।
সমীরণ সঙ্গীত করিছে অবিরত॥
ছয়কালে ছয়কাল হয় ছয়রূপ।
রঙ্গভূমে রঙ্গ করে ভাঁড়ের স্বরূপ॥
অধিকারী একমাত্র অখিল পালক।
আমরা সকলে তার যাত্রার বালক॥
[মায়া]২৬

উনিশ শতকের শেষভাগে বরিশাল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও যশোর অঞ্চলে যাত্রাগানের অনেক দল ছিল। প্রখ্যাত যাত্রানট সূর্য দত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন-

মূলত দলের প্রধান কার্যালয় ছিলো নৌকো। বিশাল নৌকো-যেন একটা গোটা বাড়ি। নৌকোগুলো এত পরিচিত ছিল যে, দেখেই বলা যেত, কোন দলের কোনটি। বছরের ৭/৮ মাস ওই ছিল যাত্রাশিল্পীদের ঘরবাড়ি। এক মোকাম থেকে আর এক মোকামের পথে নদীবক্ষে, নৌকাতেই চলত রিহার্সেল, গান-বাজনা।২৭
 
এ সময়ের দলগুলো সম্পর্কে বিস্তৃৃত তথ্য দূরে থাকুক, নামগুলোও জানা যায় না। প্রাপ্ত তথ্য মতে, বরিশালের মুকুন্দ দাসই প্রথম আনুষ্ঠানিক যাত্রাদল গঠন করেন। ১৯০৫ সাল বাংলার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বছর। এবছর বাংলা ভাগ হয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন তখন সারাদেশে প্রাণ পেতে থাকে। বরিশালে অশ্বিনীকুমার দত্তের নেতৃত্বে ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’ এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বরিশাল টাউন হলের একসভায় ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’-র সভাপতি অশ্বিনীকুমার দত্ত বলেছিলেন, ‘আমরা যেসব বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি, তা যদি কেউ যাত্রা আকারে গ্রামে-গ্রামে প্রচার করে, তাহলে আমাদের এইরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হয়’। মুুকুন্দ দাস এই বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ-বছরের মধ্যেই মাতৃপূজা নামে অভিনব এক যাত্রাপালা রচনা করেন এবং নিজে দল গঠন করে গ্রামে-গ্রামে গান করে বেড়াতে থাকেন। তাঁর এই দল ‘স্বদেশী যাত্রাপার্টি’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। মাতৃপূজা ছাড়াও তিনি কর্মক্ষেত্র, পল্লীসেবা, সমাজ প্রভৃতি পালার মাধ্যমে স্বদেশী বক্তব্য প্রচার করে ব্রিটিশ সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পালাগুলো নিষিদ্ধ হয় এবং তিনি কারানির্যাতন ভোগ করেন। ‘স্বদেশী যাত্রাপার্টি’ মুকুন্দ দাসের মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। তাঁর উদ্যোগে সিরাজগঞ্জে এবং মেদিনীপুরে আরও দুটি ‘স্বদেশী যাত্রাপার্টি’ গঠিত হয়েছিল।২৮  তাঁর মৃত্যুর পরে বরিশালের কালীচরণ নট্ট (১৮৯৪-১৯৫৪) মুকুন্দ দাসের পালাগুলো পরিবেশন করতেন। পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার কালিয়াগড়ে প্রতিষ্ঠিত ‘মুকুন্দ দাস সেবাশ্রমে’র সম্পাদক মনোরঞ্জন নট্ট মুকুন্দ দাসের যাত্রাপালাগুলো এখনও মাঝে মাঝে পরিবেশন করেন।

মুকুন্দ দাসের যাত্রাদলের অভূতপূর্ব সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে ঝালকাঠিতে ১৯০৬ সালে জন্ম হয় ‘নাগ-দত্ত-সিংহ-রায় কোম্পানি’-র। ঝালকাঠির কৃষ্ণকাঠি গ্রামের রজনীকান্ত নাগ, বাদলকাঠি গ্রামের মহেন্দ্রনাথ সিংহ এবং আরও দুই অধিকারীর কৌলিক পদবি ‘দত্ত’ ও ‘রায়’ অনুসারে এই দলের নাম রাখা হয়। এই দলে মুকুন্দ দাসের পালা ছাড়াও অহিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘সুরথ উদ্ধার’, ভোলানাথ কাব্যশাস্ত্রীর ‘কুবলায়শ্ব’ প্রভৃতি পালা পরিবেশিত হত। বছর খানেক পরে এই দলটি ভেঙে যায়। পরের বছর ১৯০৭ সালে এই দলের রজনীকান্ত নাগ ও মহেন্দ্রনাথ সিংহ মিলে গঠন করেন ‘নাগ-সিংহ কোম্পানি’। এবছর ফরিদপুর জেলার (বর্তমান শরিয়তপুর) নড়িয়ার মহেন্দ্রকুমার সেন ‘আদি ভোলানাথ অপেরা’ গঠন করেন । ‘গৃহপ্রতিষ্ঠিত দেবতা ভোলানাথের স্মরণে সংস্থার নামকরণ হয়’।২৯  এই দলটি তখন খুব খ্যাতি অর্জন করেছিল। এর কার্যালয় ছিল কোলকাতায়। অঘোরচন্দ্র ভট্টাচার্যের প্রহাদচরিত্র, পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের কালাপাহাড়, সৌরীন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায়ের মাটির মা প্রভৃতি পালা এই দলকে সে-সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়।

১৯০৭ সালে সালে ‘নাগ-সিংহ কোম্পানি’ ভেঙে গিয়ে গঠিত হয় দুটি নতুন দল- রজনীকান্ত নাগের ‘নাগ কোম্পাানি’ এবং মহেন্দ্রনাথ সিংহের ‘সিংহ কোম্পাানি’। সিংহ কোম্পানিতে তখনকার সময়ের বিখ্যাত গাইয়ে ভূষণ দাস ছিলেন মোশন মাস্টার। সূর্য দত্ত ছিলেন এ দলের ছেলে গাইয়ে বা শিশুশিল্পী। তিনি ধ্র“বচরিত্র পালায় ধ্র“বের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।

১৯০৯ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি নিবাসী রজনীকান্ত চক্রবর্তী গঠন করেন ‘ঠাকুর কোম্পানি’ নামের যাত্রাদল। এই দলের পঁচিশ শতাংশ অংশীদার ছিলেন মাছরঙ গ্রামের শশিভূষণ নট্ট। তিনি ছিলেন সেকালের প্রধান ও প্রথম বায়েন। এ দলেও সূর্য দত্ত কাজ করেছেন। সেকালের বিখ্যাত ‘ড্যান্সমাস্টার’ বসুড়ার রাইচরণ শীলও ছিলেন এই দলে। এই দলে হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পালা ‘মন্দিরা ও তারা’ খুব জনপ্রিয় হয়।

 ১৯১০ সালে ঢাকায় ‘অয়বাবু’ নামের এক ব্যক্তি একটি যাত্রাদল খোলেন। এই দল ‘অয়বাবুর দল’ নামে পরিচিতি পায়। এসময় নোয়াখালিতে ‘কেষ্টসাহার দল’ খুব জনপ্রিয় হয়। এর মালিক ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র সাহা। যশোরের নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল ‘নীলমাধবের দল’ নামে খ্যাতি অর্জন করে। ১৯১৪ সালে ঝালকাঠির মাছরঙ গ্রামের বৈকুণ্ঠনাথ নট্ট ‘মাছরঙ বৈকুণ্ঠ নাট্য সমাজ’ গঠন করেন। এর আগে ‘মাছরঙ বৈকুণ্ঠ সঙ্গীত সমাজ’ নামের একটি দল গঠিত হয়। এটিও যাত্রাপালা পরিবেশন করতে বলে জানা যায়। এই সময়ের যাত্রাদলগুলোর কথা জানা যায় ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র স্মৃতিচারণায়। ১৯৭৪ সালে ‘ছেলেবেলায় দেখা যাত্রার স্মৃতি’ প্রবন্ধে তিনি ষাট বছর আগের অর্থাৎ ১৯১৪ সালের স্মৃতি বর্ণনা করেছেন। এসময় তাঁর বয়স ছিল সাত বছর। সেই সাত বছর বয়সের স্মৃতিতে আমরা বাংলাদেশের কয়েকটি দলের নাম পাই। তিনি লিখেছেন-

পেশাদার যাত্রার দল আমাদের ছেলেবেলায় কটাই বা ছিল? কলকাতার প্রসন্ন নিয়োগী, মথুর সা, শশী অধিকারী, মতি রায়, শ্রীচরণ ভাণ্ডারী, আর পূর্ববঙ্গে বৈকুণ্ঠ নট্ট, ব্রজবাসী, উমানাথ ঘোষাল, ঠাকুর কোম্পানি, গুহ রায়। এছাড়া সারা বাংলায় সখের দলের অবশ্য সংখ্যা ছিল না।৩০
 
ব্রজবাসী, উমানাথ ঘোষাল এবং গুহ রায় নামের যাত্রাদলের বিস্তৃৃত পরিচয় পাওয়া যায় নি। ১৯১৫ সালে নারী পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল ‘লেডি কোম্পানি’ ঝালকাঠিতে গঠিত হয়। এর অধিকারী ছিলেন শ্রীমতী বোঁচা নামের এক নারী। নারীশিল্পীর অংশগ্রহণ শুরু হয় এই দলের মাধ্যমে। দলটি ‘বোঁচার দল’ নামেও পরিচিত হয়। ১৯১৬ সালে বরিশালে ‘পাষাণময়ী অপেরা’ গঠন করেন নথুল্লাবাদের স্বর্ণকুমার রায়, রমণীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় ও বাদলকাঠির রজনীকান্ত গুহ। ১৯১৮ সালে বরিশালের বিল্বগ্রামের কালীচরণ নট্ট প্রতিষ্ঠা করেন ‘বিল্বগ্রাম নট্টকোম্পানি’। ১৯২০ সালে নড়াইলে গৌরচন্দ্র প্রামাণিকের যাত্রাদল ‘গৌরপ্রামাণিকের দল’ নামে পরিচিত হয়। ১৯২৪ সালে ঝালকাঠির বৈকুণ্ঠনাথ নট্টের হাতে জন্ম নেয়া ‘নট্টকোম্পানি যাত্রা পার্টি’ দুইবাংলায় এখনও জনপ্রিয় দল হিসেবে গৌরব অক্ষুণœ রেখেছে। এসময় ফরিদপুরে জীবনবাবু নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে যাত্রার দল এসেছিল। তারা কালাপাহাড় বা ধর্মবিপ্লব পালার অভিনয় করে সুনাম অর্জন করে। ফরিদপুরের ওই পালার সফল মঞ্চায়নের সংবাদে প্রাণিত হয়ে ১৯২৫ সালে ঢাকার ফরাশগঞ্জে সৌখিন যাত্রার এই পালা মঞ্চায়ন করে বলে জানা যায়। ফরাশগঞ্জে বৈরাগীটোলা পাড়ায় হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লোকই সম্প্রীতির সঙ্গে বাস করত। একই সঙ্গে তারা পাড়ার যাত্রায় বা নাটকে অভিনয় করত। এই পাড়ার কালাপাহাড় বা ধর্মবিপ্রব পালার প্রযোজনা সম্পর্কে জানা যায় সত্যেন সেনের আলোচনায়-

বৈরাগীটোলার বেণী পোদ্দারের বাড়ির সামনে খোলা জায়গায় স্টেজ বেঁধে কালাপাহাড় বা ধর্মবিপ্লব নাটকের অভিনয় চলছিল। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত এই আসরে নাটকের নির্বাচনটা খুব ভাল হয়েছিল বলা চলে না। সাধারণ হিন্দুর কাছে কালাপাহাড়ের দেবমূর্তি ভাঙার বা ইসলামধর্ম গ্রহণের কাহিনীটা তেমন মুখরোচক হওয়ার কথা নয়। হিন্দুদের মনের মধ্যে যাই থাক না কেন, গোলমালটা কিন্তু এ নিয়ে উঠল না। বিতর্কটা উঠল একটা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে। নাটকে ছিল, কালাচাঁদ ওরফে কালাপাহাড় বাদশাহের মেয়ে দুলালীকে ভালবেসে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেছিল। হিন্দুরা আপত্তি তুলল, কথাটি সত্য নয়, আসলে দুলালীই প্রথমে কালাচাঁদকে ভালবেসেছিল। এই নিয়ে মুসলমান আর হিন্দু দর্শকদের মধ্যে ধুম তর্ক বেঁধে গেল। প্রথমে মুখেমুখে তর্ক, তারপর গালাগালি, হাতাহাতি, অবশেষে অভিনয়ক্ষেত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেল। অভিনয় মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তিনদিন এই অবস্থা বজায় রইল। কিন্তু অভিনয়প্রিয় ও শান্তিপ্রিয় লোকেরা নিঃশ্চেষ্ট হয়ে বসেছিল না। শান্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ইতিমধ্যেই দু’পক্ষে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। উভয়পই শান্তিকামী। কাজেই শান্তিপ্রতিষ্ঠার একটা ফর্মুলা পাওয়া গেল। উভয় পক্ষ একমত হয়ে স্থির করল যে, নাটক থেকে বিতর্কমূলক অংশটা বাদ দিতে হবে। নাটক কিন্তু চালাতেই হবে। এরপর এই নাটক দুই রাত্রি সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল।৩১
 
কালাপাহাড় বা ধর্মবিপ্লব পালাকে সত্যেন সেন নাটক বলেছেন। এটি আসলে যাত্রাপালা। ঐতিহাসিক এই পালার রচয়িতার নাম চয়ে পাগলা। মুসলমানদের মধ্যে তিনি প্রথম পালা রচনার প্রবৃত্ত হন এবং প্রথম মুসলিম পালাকার হিসেবে স্বীকৃত হন। এটি বিশের দশকের একটি জনপ্রিয় পালা। পেশাদার দল ছাড়াও সৌখিন দলে এই পালা অভিনীত হয়। বৈরাগীটোলার দর্শকগণ ধর্মানুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হয়ে কিছুটা সংশোধন করেও এই পালার মঞ্চায়ন অব্যাহত রাখে।

দলপরিক্রমায় আমরা দেখি যে, ১৯২৮ সালে বরিশালের বানারিপাড়ার কালিয়দমন গুহঠাকুরতা গঠন করেন ‘রণজিৎ অপেরা’। ১৯৩০ সালের পটুয়াখালীর মোজাহের আলী সিকদার চালু করেন ‘মুসলিম যাত্রা পার্র্টি’। এটিই মুসলিম পরিচালিত প্রথম যাত্রাদল। এই দলে সুরকার হিসেবে কাজ করেছেন বরিাশালের কেএম বশিরউদ্দিন। তাঁর বেশ কিছু পালাও এ দলে মঞ্চস্থ হয়েছে। মোজাহের আলী সিকদার ১৯৬৬ সালে ‘বাবুল যাত্রাপার্টি’ নামের আরেকটি যাত্রাদল গঠন করেন।

১৯৩১ সালে ফরিদপুরের নবদ্বীপচন্দ্র সাহা ‘শঙ্কর অপেরা পার্টি’ এবং ‘নবদ্বীপচন্দ্র সাহা যাত্রাপার্টি’ নামে দুটি যাত্রাদল গঠন করেন। ‘নবদ্বীপচন্দ্র সাহা যাত্রাপার্টি’তে অভিনয় করে সেকালে প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৮৪-১৯৩৬)। তাঁর জন্ম ফরিদপুরের লোনসিংহ গ্রামে, মৃত্যু ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতালে। ১৯২৩ সালে তিনি যাত্রাশিল্পে সম্পৃক্ত হন। হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের জয়লক্ষ্মী পালায় ‘বলাদিত্য’ চরিত্রে অভিনয়ের কারণে তিনি সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তাঁর অভিনয়-প্রতিভা সম্পর্কে জানা যায় গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষের রচনায়-

সুরেশচন্দ্রের অভিনয়ের যেমন জাদু ছিল, তেমনি নাট্যনির্দেশক বা শিক্ষক হিসেবে ছিলেন দক্ষ। আর এই কারণেই তিনি ‘সুরেশ মাস্টার’ হিসেবে খ্যাতি পান। মতিলাল রায় বা মুকুন্দ দাসের প্রতিভার পর বিংশ শতাব্দীর কয়েক দশকের মধ্যে সুরেশচন্দ্রের মতো প্রতিভার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় নি।৩২
 
সুরেশ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আরও তথ্য পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে লেখা ‘যাত্রার কথা’ নামে ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র স্মৃতিনিবন্ধে। তিনি লিখেছেন-

পূর্ববঙ্গে সুরেশ মুখার্জী নামে একজন অভিনেতা ছিলেন-বছর কুড়ি আগেকার কথা। আমি মঞ্চ ও পর্দায় বহু অভিনয় দেখেছি, কিন্তু সুরেশবাবুর সমকক্ষ অভিনেতা আজ পর্যন্ত বেশী দেখতে পাইনি। সেই উদাত্ত কণ্ঠ, সেই সুষ্পষ্ট বাচনভঙ্গি, সেই অচঞ্চল ব্যক্তিত্বকে ধরে রাখবার জন্য তখন কালীশবাবুর হাতে ক্যামেরা ছিল না, গ্রামোফোনের দৃষ্টিও তখন অতদূরে পৌঁছায়নি।৩৩
 
১৯৩২ সালে নারায়ণগঞ্জের মোগরাপাড়ায় সৌখিন ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণকমল গোস্বামীর স্বপ্নবিলাস-যাত্রার মঞ্চায়নের সংবাদ জানা যায়।৩৪  তবে এই যাত্রার পরিবেশনকারী দলের নাম জানা যায় নি।

১৯৩৪ সালে ফরিদপুরের সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘জাতীয় আনন্দ প্রতিষ্ঠান’ নামে একটি যাত্রাদল গঠন করেন। তাঁর ভাইপো পরেশনাথ মুখোপাধ্যায় দলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিন্ধ্যাবলী, লক্ষ বলি, আদিসূর, দাক্ষিণাত্য, তর্পণ, বঙ্গে বর্গী, রাখিবন্ধন, ছগনলাল, সপ্তমাবতার প্রভৃতি ছিল এই দলের জনপ্রিয় পালা। প্রত্যেক পালায় অভিনয় করতেন সুরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি ‘নব্যধারার অভিনয়কে প্রতিষ্ঠা দিয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার স্বীকৃতি পান’।৩৫  আমাদের দেশে কলকাতার বড়বড় দল আসত যাত্রাগান করতে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানায় চন্দ্রনাথ ধামে শিবচতুর্দশী মেলায় ১৯৩৭-৩৮ সালে যাত্রা দেখার স্মৃতি রয়েছে অমলেন্দু বিশ্বাসের। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে এই সময়ের দল এবং শিল্পীদের পরিচয় জানা যায়। তিনি লিখেছেন-

কলকাতার ভুটুয়া বালক সম্প্রদায়, রঞ্জন অপেরা, অর্ঘ্য অপেরা, ফরিদপুরের নড়িয়ার আদি ভোলানাথ অপেরা, ঢাকার নারায়ণগঞ্জের মথুর সাহ, নবদ্বীপ সাহার যাত্রাদল, বরিশালের নট্ট কোং প্রভৃতি পেশাদার যাত্রাদল আসর জমাত মেলায়। সেবারই প্রথম পেশাদার যাত্রাদলের পালানাটক দেখার সুযোগ হয় আমার। পালা ছিল বাজীরাও, শিবাজী, রূপসাধনা, বাংলার ছেলে, মায়াশক্তি, মান্ধাতা শুক্রাচার্য, ইত্যাদি। প্লেয়ার (তখন অভিনেতাদের প্লেয়ার বলা হত) ছিলেন কালীদমন গুহঠাকুরতা, ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ, সুরেশ মুখার্জী, ফণি, মতিলাল, ফণি গাঙ্গুলি, গণেশ গোস্বামী, নলিনী দাস, প্রভাত বোস, ক্ষেত্র চ্যাটার্জী, গুরুপদ ঘোষ, পঞ্চু সেন, সুনীল মুখাার্জী। নারীচরিত্রে রূপদানকারীদের তখন রানী বলা হত। সেই রানীদের মধ্যে রেবতীরানী, হরিপদ বায়েন, নিতাইরানী, সুদর্শনরানী, সুধীররানী, ছবিরানী প্রমুখ রানীর অভিনয় দেখতে পাই।৩৬
 
মানিকগঞ্জের কার্তিকচন্দ্র সাহা ১৯৪৪ সালে গঠন করেন ‘অন্নপূর্ণা যাত্রা পার্টি’। এই সময়ে দৌলতপুর থানার বিনোদপুরে ‘কানাই-বলাই অপেরা পার্টি’ নামের একটি সখের দল ছিল। তখনকার খ্যাতিমান যাত্রাশিল্পীদের মধ্যে সুধীররঞ্জন বসুরায়, গৌরগোপাল গোস্বামী, নীতীশচন্দ্র অধিকারী, আকালী হালদার প্রমুখের নাম শোনা যায়। নীতীশচন্দ্র অধিকারীর পুত্র, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী ‘কানাই-বলাই দলে’র শিশুশিল্পী এবং পরবর্তী সময়ে সহ-নির্দেশক হিসেবেও ভূমিকা রেখেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘জয়দুর্গা অপেরা’ খুবই আলোচিত ও নন্দিত একটি যাত্রাদল। ১৯৪৭ সালে এই দল গঠন করেন যতীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। এই দলে কোলকাতা থেকে অভিনেতারা আসতেন এবং মৌসুম শেষে ফিরে যেতেন। তিনি ১৯৫৫ সালে ‘ভোলানাথ অপেরা’ নামে আরেকটি দল গঠন করেছিলেন। ‘লেডি কোম্পানি’তে প্রথম নারীশিল্পী অংশ নিলেও ‘জয়দুর্গা অপেরা’র নৃত্যশিল্পী জ্যোৎস্নারানী দত্তর মাধ্যমে এই ধারা বিস্তার লাভ করে। কৌতুকাভিনেতা সূর্য দত্ত ছিলেন তাঁর পিতা। সূর্য দত্তের আরও তিন মেয়ে মায়ারানী দত্ত, ছায়ারানী দত্ত, দয়ারানী দত্ত এবং তিন ছেলে ননী দত্ত, গোপাল দত্ত ও দুলাল দত্তজ্জসকলেই ছিলেন যাত্রাজগতের বাসিন্দা। সূর্য দত্তের গোটা পরিবারই ছিল যাত্রাশিল্পে নিবেদিত। প্রথমে তাঁর মেয়েরা নাচতেন, পরে সকলেই চরিত্রাভিনয়ে সুনাম অর্জন করেন।

গোপালগঞ্জে যাত্রাদল গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। ‘রায়কোম্পানি যাত্রাপার্টি’ নামের এই দলের অধিকারী ছিলেন বিধুভূষণ রায়। এটি স্বাধীনতার পরেও কিছুদিন স্থায়ী হয়েছিল।

১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’ বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পে একটি উল্লেখযোগ্য দল হিসেবে পরিগণিত হয়। সিরাজগঞ্জের নারায়ণচন্দ্র দত্ত ছিলেন এই দলের অধিকারী। ১৯৬০ সাল থেকে এই দলে নারীশিল্পীরা অভিনয় করতে শুরু করে। বাবুল অপেরার পরে নারীশিল্পী সংযোজনের দিক থেকে দ্বিতীয় দল হল ‘বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’। এই দলে এসময়ে পরিচালক ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। নারীশিল্পী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ও জয়শ্রী প্রামাণিক ছাড়া এই দলে পুরুষশিল্পী ছিলেন তুষার দাশগুপ্ত, ঠাকুরদাস ঘোষ, কালী দত্ত, ফণীভূষণ, অমিয় সরকার প্রমুখ।

১৯৫৮ সালে গঠিত হয় ‘বাবুল অপেরা’। এর অধিকারী ছিলেন চট্টগ্রামের আমিন শরীফ চৌধুরী। এটি মূলত ‘বাবুল থিয়েটারে’র যাত্রা-রূপান্তর। বাবুল অপেরায় অন্য উদ্যোক্তারা ছিলেন সাদেকুন নবী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, রুনু বিশ্বাস প্রমুখ। প্রখ্যাত নট অমলেন্দু বিশ্বাস ছাড়াও এই দলের শুরুতে শিল্পী হিসেবে ছিলেন সাদেক আলী, নাজির আহমেদ, সাধনা চৌধুরী, মঞ্জুশ্রী মুখার্জী, বেণী চক্রবর্তী, ঊষা দাশ, মকবুল আহমেদ, এমএ হামিদ, জাহানারা বেগম, শান্তি দেবী প্রমুখ। জাহানারা বেগম এদেশের প্রথম মুসলিম নারীশিল্পী। অমলেন্দু বিশ্বাস জানিয়েছেন যে, ‘বাবুল অপেরা এদেশে নারী-পুরুষ সমন্বয়ে যাত্রাভিনয় প্রথার প্রচলন করে নিঃসন্দেহে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেন’।৩৭ এই সাহসী নারীশিল্পীদেও অন্যতম মঞ্জুশ্রী মুখার্জীর জন্ম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের বাবুল থিয়েটারে ১৯৫০ সাল থেকে অভিনয় শুরু করেন। ‘বাবুল থিয়েটার’ ‘বাবুল অপেরা’ নামে রূপান্তরিত হলে মঞ্জুশ্রী মুখার্জী এই দলের নায়িকা হন। এর আগে কোনও নারী নায়িকা-চরিত্রে অভিনয় করেননি। বাবুল অপেরাই প্রথম নারী-পুরুষ সম্মিলিত যাত্রাদল। নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস এই প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী সম্পর্কে বলেছেন, ‘এই টানা চৌত্রিশ বছর নৃত্যগীতপটীয়সী যাত্রানায়িকা মঞ্জুশ্রী মুখার্জী চট্টগ্রামের ভ্রাম্যমাণ যাত্রাদল বাবুল অপেরার যাত্রামঞ্চে এদেশের লক্ষ লক্ষ যাত্রারসিকদের মন বিচিত্র নাট্যভাবনার রঙে-রসে আপ্লুত করেছেন’।৩৮  চট্টগ্রামে যাত্রা আগেও ছিল। কলকাতা থেকে যাত্রাদল এসে চট্টগ্রামে গান শুনিয়ে যেত। গেজেটিয়ারে এরকম তথ্য পাওয়া যায়-

Jatra is product of the Hindu dramatic talents, having originated in Calcutta during the last century after Bengal emerged out of its Sanskrit shell. It became very popular among the Hindus and theHindu zaminders and merchants of Chittagong would indent Jatra parties during the winter season for popular entertainment. It became almost an annual feature for some of the Jatra parties of Calcutta to visit Chittagong in the winter season. Local Hindus of Patiya and Bhatikhan also organised some parties and went about entertaining the public.৩৯

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ‘জয়দুর্গা অপেরা’র ম্যানেজার গোপালকৃষ্ণ পাণ্ডে ১৯৬০ সালে ‘ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা’ এবং ১৯৬২ সালে ‘রয়েল ভোলানাথ অপেরা’ গঠন করেন। গোপাল পাণ্ডের (জ. ১৯২১) আদিনিবাস উড়িষ্যায়। যাত্রাজগতের দিকপাল গোপাল উড়ে-ও এসেছিলেন উড়িষ্যা থেকে। গোপাল উড়ের মতো গোপাল পাণ্ডের অবদানে বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর শৈশব কেটেছে উড়িষ্যায়, কৈশোর কেটেছে কলকাতায়। জয়দুর্গা অপেরার যাত্রা দেখতে এসে আর ফিরে যান নি। যাত্রার অধিকারী হিসেবে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। খ্যাতিমান যাত্রাশিল্পী চিত্ত পাল, দিগম্বর মালাকার, দীনেশ মাল, নগেন নন্দী, ননী চক্রবর্তী, মায়া চক্রবর্তী, রেখা চক্রবর্তী প্রমুখের হাতেখড়ি এই গোপাল পাণ্ডের হাতে।৪০

ময়মনসিংহের আবদুল হামিদ ১৯৬৬ সালে গঠন করেন ‘নবরঞ্জন অপেরা’। ১৯৬৭ সালে গঠিত ‘গীতশ্রী যাত্রা ইউনিটে’র অধিকারী ছিলেন চট্টগ্রামের গোপালচন্দ্র রুদ্র। ময়মনসিংহের আবদুল খালেক ভুঁইয়া একই বছর গঠন করেন ‘বুলবুল অপেরা’। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে ফরিদপুরের স্বপনকুমার সাহা ‘নিউ বাসন্তী অপেরা’ চালু করেন।

১৯৬৯ সালে গোপালগঞ্জের ধীরেন্দ্রকুমার বাকচী চালু করেন ‘দীপালি অপেরা’। তিনি ১৯৭২ সালে ‘আদি দীপালি অপেরা’ এবং ১৯৭২ সালে স্ত্রী বনশ্রী বাকচীর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় ‘১ নং দীপালি অপেরা’ গঠন করেন। তিনি এসময়ে ‘নব দীপালি অপেরা’ এবং ‘দীপ দীপালি অপেরা’ নামে আরও দুটি যাত্রাদল প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে পাঁচটি দলের অধিকারী হওয়া নিঃসন্দেহে যাত্রাশিল্পের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

১৯৭০ সালে বাগেরহাটের পরিমল হালদার প্রতিষ্ঠা করেন ‘জয়শ্রী অপেরা’। ‘নিউ গণেশ অপেরা’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। এর অধিকারী মানিকগঞ্জের গণেশচন্দ্র ঘোষ। হবিগঞ্জের লিপাই মিয়া একই বছরে গঠন করেন ‘কোহিনুর অপেরা’। ময়মনসিংহে ঐতিহ্যবাহী দল ‘সবুজ অপেরা’ গঠিত হয় ১৯৭২ সালে। প্রথম অধিকারী নুরুল ইসলাম হলেও পরে দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু এই দলটিকে জনপ্রিয় করেন এবং নানান প্রতিকূলতার মধ্যেও এখন পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছেন। এক সাক্ষাৎকারে দেলোয়ার হোসেন বাচ্চু বলেন-

বত্রিশ বছর ধরে দলটির হাল ধরে আছি। থিয়েটার করতাম। আমার ক্লাশমেট মামুনুর রশীদ নাট্যকার এবং পালাকার হিসেবে এখন দেশে-বিদেশে নন্দিত পুরুষ। কিন্তু আমি থিয়েটারের চেয়ে যাত্রাকে বেশি ভালবেসে এতগুলো বছর কাটিয়ে গেলাম। গোটা বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছি। দেশের সাধারণ মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। হয়তো নাগরিক সমাজ আমাকে চেনে না। কিন্তু যাত্রাপ্রিয় বাংলার মানুষ আমাকে চেনে। এগুলোই আমার একজীবনের অনেক পাওয়া!৪১

১৯৭২ সালে নড়াইলের শেখ খলিলুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন ‘রঙমহল অপেরা’। দলটি স্বাধীনতার পরে বেশ সক্রিয় ছিল। নওগাঁর খগেন লস্কর একই বছর গঠন করেন ‘রূপশ্রী অপেরা’। মানিকগঞ্জের ডা. ব্রজেন্দ্রকুমার মণ্ডলের ‘জগন্নাথ অপেরা’ ও ভানু সাহার ‘অম্বিকা যাত্রাপার্টি’ ও সাতীরার রামপদ সাহার ‘বিশ্বজিৎ অপেরা’, খুলনার ফজলুল করিম বিশ্বাসের ‘শিরিন যাত্রা ইউনিট’ এবছরে গঠিত নতুন যাত্রাদল। খুলনায় প্রথম দল হিসেবে ‘শিরিন যাত্রা ইউনিটকে’ পাওয়া গেলেও এখানকার যাত্রা-ঐতিহ্য অনেক পুরনো। জেলা গেজেটিয়ার থেকে জানা যায় যে, ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’র কাহিনী নিয়ে তখন যাত্রা পরিবেশিত হত। দুর্গাপূজার সময়ই ছিল তখন যাত্রার জন্যে উপযুক্ত। একাধিক রাতের জন্যে তখন যাত্রাগানের আসর বসত। নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম সকলেই একসঙ্গে বসে যাত্রা দেখত। স্থানীয় তিন-চারটি যাত্রাদলের কথাও জানা যায়-

There were three or four local Jatra parties, and occasionally parties of special skill were engaged from other districts. The charged Tk. 50 to Tk. 100 for a night's performance. The educated midle classes in Khulna, Bagerhat and Satkhira, and in advance village like Senhati, Mulghar and Magura, had also formed themselves into amateur dramatic societies their performances being given at night in houses built and set apart for the purpose.৪২

১৯৭৩ সালে নিরঞ্জন রায়ের ‘জোনাকী অপেরা’ যশোরে, আজিজুল আলম চৌধুরীর ‘আদি মিতালী অপেরা’ রাজশাহীতে জন্ম নেয়। ‘জোনাকী অপেরায় লাইসেন্স যশোর থেকে করা হলেও এর মালিকের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার বাজুনিয়ায়। তাই এটি গোপালগঞ্জ থেকেই পরিচালিত হত।

১৯৭৪ সালে যে সকল দলের জন্ম হয়, তা হল, ঢাকার করম আলী ভুঁইয়ার ‘বিজয়লক্ষ্মী অপেরা’, হবিগঞ্জের হারুনুর রশিদ খানের ‘হারুন অপেরা’, ফেনীর সেলিম চৌধুরীর ‘তরুণ যাত্রাপার্টি’, কুমিল্লার বদরুল চৌধুরীর ‘স্মরণিকা অপেরা’, খুলনার অখিলচন্দ্র দাসের ‘উত্তম অপেরা’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কালু মাস্টারের ‘বিশ্বরূপা অপেরা’, যশোরের তুষার দাশগুপ্তের ‘তুষার অপেরা’, মানিকগঞ্জের তাপস সরকারের ‘চারণিক নাট্যগোষ্ঠী’, সিরাজগঞ্জের নিরঞ্জনচন্দ্র কুণ্ডুর ‘বাণীশ্রী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠান’, বাগেরহাটের নুর মো. হাওলাদারের ‘বঙ্গশ্রী অপেরা’, কুষ্টিয়ার আলাউদ্দিন আহমদের ‘গীতাঞ্জলি অপেরা’, নারায়ণগঞ্জের আবদুল জব্বার ভুঁইয়ার ‘নবজাগরণ অপেরা’, গোপালগঞ্জের ধীরেন্দ্রকুমার বাকচীর ‘নব দীপালি অপেরা’ ও ‘দীপ দীপালি অপেরা’ এবং চট্টগ্রামের ললিতমোহন ঘোষের ‘নবারুণ নাট্যসংস্থা’। তুষার দাশগুপ্তের মৃত্যুর পরে ‘তুষার অপেরা’র অধিকারী হন তাঁর স্ত্রী শবরী দাশগুপ্তা।

তুষার দাশগুপ্তের জন্ম ১৯২৩ সালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা ফকিরহাট গ্রামে। চট্টগ্রামের দুই খ্যাতিমান যাত্রাভিনেতা মাচরণ ও বামাচরণের উৎসাহে তিনি যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৮ বছর বয়সেই তিনি যাত্রাদলে নাম লেখান। ১৯৫৪ সালে জয়দুর্গা অপেরায় যোগ দেন। এরপর তিনি গোকুলেশ্বরী অপেরা নামে একটি দল গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে যান বাবুল অপেরায়। ১৯৬০ সালে অমলেন্দু বিশ্বাসের সহযোগিতায় তিনি বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। পরে সৎসঙ্গ অপেরা নামে একটি দল তিনি গঠন করেন। তবে নিজের করা দুটি দলই সফল হয় নি। ১৯৭০ সালে গীতশ্রী অপেরায় কাজ করার সময়ে নবাগতা নায়িকা রীনারাণীকে বিয়ে করেন। এই রীনারাণীই পরবর্তীকালের জনপ্রিয় যাত্রানায়িকা শর্বরী দাশগুপ্ত। ১৯৭৪ সালে তিনি নিজের নামে তুষার অপেরা গঠন করেন। এই দল তাঁকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। তিনি যাত্রামঞ্চে আধুনিক উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন। দেশীয় পালা মঞ্চায়নের ব্যাপারে তিনি উদযোগী ছিলেন। পালাকার পরিতোষ ব্রহ্মচারী রচিত পালা কিওপেট্রা, দস্যুরানী ফুলন দেবী এবং রূপান্তরিত পালা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিরাজ বৌ অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ জানুয়ারি ৬৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মরণসভায় প্রবীণ যাত্রা-সংগঠন আসিরউদ্দিন বলেন, ‘তুষার দাশগুপ্তের মতো শিল্পীরা যাত্রার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।’৪৩ তুষার দাশগুপ্তের স্ত্রী শর্বরী দাশগুপ্তার জন্ম যশোরে। ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ সালে তিনি পরপর দুবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী জাতীয় যাত্রা উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। কিওপেট্রা, দস্যুরানী ফুলন দেবী প্রভৃতি পালায় তিনি স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

তাপস সরকারের পরে ‘চারণিক নাট্যগোষ্ঠী’র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন অমলেন্দু বিশ্বাস। ১৯৮৭ সালে অমলেন্দু বিশ্বাস মৃত্যুবরণ করেন। অমলেন্দু বিশ্বাসের জন্ম ১৯২৫ সালে ২৯ মে বার্মায়, পিতার কর্মস্থলে। পৈতৃক বাস চট্টগ্রামের কুমিরায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ বিমানবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে রেল বিভাগে চাকরিকালে তিনি বাবুল থিয়েটারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এটি ১৯৫৮ সালে বাবুল অপেরায় রূপান্তরিত হয়। যাত্রানাট তুষার দাশগুপ্তের প্রেরণায় অমলেন্দু বিশ্বাস এই দলের মাধ্যমে যাত্রায় আসেন। রাজা সন্ন্যাসী’, মাইকেল মধুসূদন, জানোয়ার, লেনিন, হিটলার প্রভৃতি পালায় তাঁর অভিনয় এখন কিংবদন্তীতুল্য। তাঁর সম্পর্কে দৈনিক ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় লেখা হয়-

যাত্রাঙ্গনের এই স্বাপ্নিক পুরুষ স্বীয় প্রতিভা, অধ্যবসায় ও সাধনার বলে যে স্তরে উপনীত হয়েছিলেন, তা শুধু ঈর্ষণীয়ই নয়, দুর্লভও বটে। সকলের মুখে মুখে তিনি প্রশংশিত হয়েছেন যাত্রাসম্রাট হিসেবে। প্রচারবিমুখ এই শিল্পপ্রাণ ব্যক্তিত্ব আজীবন সৃষ্টির নেশায় মেতে থেকেছেন, নব নব সৃষ্টির প্রেরণা ও আনন্দে নিজে যেমনি, অপরকে তেমনি বিমুগ্ধ করে গেছেন তিনি।৪৪
 
অমলেন্দু বিশ্বাস ছিলেন নটসূর্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য। যাত্রাশিল্পে অবদানের কারণে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী আয়োজিত যাত্রা-উৎসবে দুইবার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার (১৯৭৯) এবং একুশে পদক (১৯৮৯) লাভ করেন। তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস ও বাংলাদেশে যাত্রাসম্রাজ্ঞী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর কন্যা অরুণা বিশ্বাস চলচ্চিত্র অঙ্গনের জনপ্রিয় অভিনেত্রী। অমলেন্দু বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস এই দল পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন।

জ্যোৎস্না বিশ্বাসের জন্ম সিরাজগঞ্জ শহরের কালিবাড়ি রোড়ে ১৯৪৭ সালের ২ মে। বাবা গণেশচন্দ্র ধর ছিলেন সখের অভিনেতা। সৌখিন কৃষ্ণকীর্তন দলে গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যাত্রাজগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে বাসন্তী মুক্তমঞ্চ নাট্যপ্রতিষ্ঠানে দলীয় নৃত্যশিল্পী হিসেবে যাত্রাজগতে প্রবেশ করেন। প্রথম বছরেই ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ পালায় রত্নাবলী অর্থাৎ নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ে সুযোগ পান। ওই পালায় ছন্দক অর্থাৎ নায়ক চরিত্রে ছিলেন দল-পরিচালক অমলেন্দু বিশ্বাস। ১৯৬১ সালে তিনি অমলেন্দু বিশ্বাসকে বিয়ে করেন। অমলেন্দু বিশ্বাস ও তিনি চারণিক নাট্যগোষ্ঠী পরিচালনা করতেন। মাইকেল মধুসূদন পালায় তিনি দেবকী চরিত্রে অভিনয় করে দেশে-বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন। অমলেন্দু বিশ্বাসের মৃত্যুর পরে তিনি ‘চারণিক নাট্যগোষ্ঠী’র হাল ধরেছিলেন। অভিনেত্রী হিসেবেই তিনি খ্যাতি অর্জন করলেও দলের অধিকারী, নিদের্শক এবং পালাকার হিসেবেও যাত্রাশিল্পে অবদান রেখেছেন। তাঁর রচিত একমাত্র পালার নাম রক্তস্নাত একাত্তর (১৯৯৬)। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ সালের বিজয় উৎসব মঞ্চে প্রথম আসরায়ন-সহ চারণিক নাট্যগোষ্ঠীর মাধ্যমে এটি ২৭ বার আসরস্থ হয়।

১৯৭৫ সালে যে সকল দল গঠিত হয় তার মধ্যে বাগেরহাটের নুর মো. হাওলাদার ও আলাউদ্দিন আহমদ হারুমিয়ার যৌথ মালিকানায় ‘১ নং বঙ্গশ্রী অপেরা’, যশোরের প্রহাদ বিশ্বাস হিটলারের ‘বৈকালী অপেরা’ এবং বরিশালের সুভাষচন্দ্র সরকার মণ্টুর ‘তপোবন নাট্যসংস্থা’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বাগেরহাটের আফজাল হোসেন মোল্লার ‘জ্যোৎস্না অপেরা’ এবং মানিকগঞ্জের ফণী গোস্বামীর ‘আনন্দময়ী অপেরা পার্টি’ এসময়ে গঠিত হয়।

১৯৭৬ সালের উল্লেখযোগ্য দল হল প্রশান্তকুমার রায়ের ‘আদি সবুজ অপেরা’ (ময়মনসিংহ), এমএ চৌধুরীর ‘অগ্রদূত নাট্যসংস্থা’ (চট্টগ্রাম), শেখ বোরহানউদ্দিনের ‘বলাকা অপেরা’ (মানিকগঞ্জ), খোকন চৌধুরীর ‘নবচন্দন অপেরা’ (নারায়ণগঞ্জ), আফতাব উদ্দিনের ‘কোহিনুর অপেরা’ (মানিকগঞ্জ) এবং পাণ্ডব আলীর ‘বঙ্গলক্ষ্মী অপেরা’ (কুমিল্লা)। এছাড়া সাধুচরণ পণ্ডিত ও যুধিষ্ঠির মণ্ডলের যৌথ আধিকারিত্বে ‘বাসুদেব অপেরা পার্টি’ (মানিকগঞ্জ), আবদুস সালাম বাচ্চুুর ‘নিউ বলাকা অপেরা’ (বগুড়া), গিয়াসউদ্দিন আহমেদের ‘আজাদ অপেরা’ (নারায়ণগঞ্জ), মোতাহার মিয়ার ‘লিলি অপেরা’ (নোয়াখালী), প্রাণবল্লভ ঘোষের ‘উদয়ন নাট্যসংস্থা’ (চট্টগ্রাম), চুন্নু মিয়ার ‘নব বঙ্গশ্রী অপেরা’ (বাগেরহাট), শচীন ঘোষের ‘বঙ্গদিপালী অপেরা’ (মানিকগঞ্জ) প্রভৃতি দল এসময়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। বগুড়া জেলায় যাত্রাদল কম থাকলেও যাত্রা পরিবেশনের দিক দিয়ে বগুড়ার সুনাম রয়েছে। বিশেষত গীতিযাত্রা যেমন রূপবান, গুনাই, জরিনা সুন্দরী, আপন দুলাল প্রভৃতি পালা এই এলাকায় বেশ জনপ্রিয়। দেশবিভাগের আগেই বগুড়ায় যাত্রার বেশ চর্চা ছিল-

The district had its reputation in pre-partition days for folk songs and Jatras. The Muslims used to enjoy Jari, Bichar, Marfati, and Bayati songs and also Jatras depicting love-tales of village people. Hindus used to enjoy Kabi songs, Rashlila songa Baul songs Kirtan, Gambhira, Khemta and Jatras depicting Hindu mythological love of Radha and Krishna, avatarism of Nimai, and innumerable tales of love and war between virtue and vice. ৪৫

১৯৭৬ সালে গঠিত বঙ্গলক্ষ্মী অপেরায় নায়ক হিসেবে যোগ দেন কুষ্টিয়ার মেহবুব ইসলাম (১৯৫৬-১৯৯৪)। অকালমৃত্যু বরণকারী মেহবুব ইসলাম প্রতিভাবান অভিনেতা ছিলেন। তাঁর স্ত্রী তপতী ইসলামও একজন নন্দিত নায়িকা। এই সফল জুটি নবজাগরণ অপেরা, সত্যনারায়ণ অপেরা, বলাকা অপেরা প্রভৃতি দলে সুনামের সঙ্গে কাজ করেন। তপতী ইসলাম এখনও অভিনয় করে যাচ্ছেন। মেহবুব ইসলাম অভিনয়ের পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে অবদান রেখেছেন।

১৯৭৭ সালের উল্লেখযোগ্য দল-‘আনন্দ অপেরা’ (নিখিলকুমার রায়, পাবনা), ‘দি নবরঞ্জন অপেরা’ (শাহ আবদুল মন্নাফ, ময়মনসিংহ), ‘সাধনা অপেরা’ (আবদুল মালেক মোড়ল, খুলনা) এবং ‘মিতালী অপেরা’ (ডাবলু মিয়া, ময়মনসিংহ)। এছাড়া ‘লক্ষ্মণ দাস অপেরা’ (বীরেন্দ্র দাস, বরিশাল) এবং ‘নিশিবাণী অপেরা’ (খোকন চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জ) নামের দুটি দলও এসময়ে সক্রিয় ছিল। পাবনা জেলায় ‘আনন্দ অপেরা’ ছাড়া আর কোনো দলের নাম পাওয়া না গেলেও এই জেলার যাত্রাগানের ঐতিহ্য ছিল।

১৯৭৮ সালে গঠিত হয় গণেশচন্দ্র কুণ্ডুর ‘প্রতিমা অপেরা’ (যশোর), আরতিরাণী বিশ্বাসের ‘আরতি অপেরা’ (খুলনা), ডা. তোফাজ্জল হোসেনের ‘দি গীতাঞ্জলি অপেরা’ (কুষ্টিয়া), মতিউর রহমানের ‘তরুণ অপেরা’ (বরিশাল), নারায়ণচন্দ্র বিশ্বাসের ‘জনতা অপেরা’ (সিরাজগঞ্জ) প্রভৃতি জননন্দিত দল। আবু চেয়ারম্যানের ‘শামীম অপেরা’ (রংপুর), প্রদীপ বিশ্বাসের ‘প্রদীপ অপেরা’ (খুলনা), আহমদ সরদারের ‘ভদ্রা অপেরা’ (খুলনা), মহিউদ্দিন হাওলাদার মনিরের ‘আদি ঝর্না অপেরা’ (মাদারীপুর), শামসু মিয়ার ‘রূপালী যাত্রাপার্টি’ (কুমিল্লা) এ-বছর বেশ সুনাম অর্জন করে।

গোপালগঞ্জের জগদানন্দ ঠাকুরের ‘নরনারায়ণ অপেরা’, ময়মনসিংহের লাল মিয়ার ‘লায়ন অপেরা’, টাঙ্গাইলের অজিত সাহার ‘চলন্তিকা নাট্যসংস্থা’, বরিশালের আনিস আহমদের, ‘রূপাঞ্জলি নাট্যসংস্থা’, কুষ্টিয়ার শেখ আজিজুর রহমান ও আখতার সিদ্দিকীর ‘আদি গীতাঞ্জলি অপেরা’, নরসিংদীর আনোয়ার আলীর ‘সুমি নাট্যসংস্থা-১’ প্রভৃতি ১৯৭৯ সালের উল্লেখযোগ্য নতুন যাত্রাদল। এছাড়া খুলনার আবদুল মজিদ সরদারের ‘মিলন যাত্রা ইউনিট’, কুমিল্লার শামসুদ্দিন হাওলাদারের ‘রূপালী অপেরা’, দিনাজপুরের আমিনুল হক সরকারের ‘মিতালী অপেরা’, বরগুনার আলী আহমদের ‘নাসির অপেরা’ প্রভৃতি দল এ-সময়ের গঠিত দল হিসেবে ভূমিকা রাখে। অজিত সাহার ‘চলন্তিকা নাট্যসংস্থা’ ছাড়া টাঙ্গাইলে আর কোনো যাত্রাদলের তথ্য পাওয়া যায় না। গোলাম আম্বিয়া নূরীর প্রবন্ধ থেকে জানা যায়-

এই শতাব্দীর গোড়ায় টাঙ্গাইলের বেশ কয়েকটি অঞ্চলেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৌখিন পালাদলের বা যাত্রাসমষ্টির বিবরণ জনশ্র“তি থেকে পাওয়া যায়। ভুঁঞাপুরের সয় গ্রামের একটি দল, নিকরাইলের একটি দল, গোপালপুরের মাহমুদনগরের একটি দল, টাঙ্গাইলের পাতরাইল গ্রামের একটি দলের কথা শোনা যায় যারা অত্র অঞ্চলে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। তৎকালে টাঙ্গাইলের নাগরপুর গ্রাম যাত্রার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ত্রিশের দশকে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়িতে একটি পেশাদার যাত্রাদল গড়ে উঠেছিল। সমসাময়িককালের শিবপুর ও ঘারিন্দাতেও দুইটি খ্যাতিমান যাত্রাসমষ্টি গড়ে উঠেছিল।৪৬

টাঙ্গাইল জেলার খ্যাতিমান যাত্রাভিনেতা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বোয়ালীর বাঁশি মিয়া, কালিপুরের বিনোদ সাহা, নাগরপুরের নিকুঞ্জ সাহা, বিশ্বাস বেতকার কার্তিকচন্দ্র শীল, করটিয়ার ঠাকুরদাস পাল, আকুরটাকুরের অনিল বাগচী ও সুনীল বাগচী, পোড়াবাড়ির মতিলাল গৌড়, কাঞ্চনপুরের সিরাজুল ইসলাম খান মালা, শিবপুরের শিশির ভৌমিক এবং সন্তোষের গোপাল কর প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

১৯৮০ সালে যে সকল দল গঠিত হয় তার মধ্যে বগুড়ার আনিছুর রহমানের ‘রয়েল বীণাপাণি অপেরা’ এবং খুলনার আবদুল মালেক মোড়লের ‘দি সাধনা অপেরা’ উল্লেখযোগ্য। তবে এ সময় বিশিষ্ট নায়ক মানিক সেন নিজের নামে একটি দল গঠন করেন (মানিক অপেরা, যশোর)। দলটি অভিনয়ের ক্ষেত্রে সুনাম অর্জন করলেও বেশিদিন স্থায়ী হতে পারে নি। গোপালগঞ্জের আবুল খায়ের মিয়া গঠন করেন ‘বঙ্গবাণী অপেরা’। দলটি কয়েক বছর চালু ছিল। কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার অভিযোগ তাঁর নামে ছিল। পরবর্তী সময়ে এলাকার বিভিন্ন সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে এলাকায় তাঁর সামাজিক অবস্থান ক্ষুণœ হয়। একপর্যায়ে অগ্যাতনামা ব্যক্তিদের গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করলে দলটি বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৮১ সালে নতুন কোনো দলের সন্ধান আমরা পাই নি। ১৯৮২ সালে নোয়াখালীর আবদুল হাই মাস্টারের ‘ভাগ্যলিপি অপেরা’ এবং মানিকগঞ্জের সুকুমার কর্মকারের ‘নবপ্রভাত অপেরা’ দেশব্যাপী পরিচিতি অর্জন করে। এবছর আলফাজ মিয়ার ‘সবিতা অপেরা’ (সাতীরা), নির্মলকুমার সরদারের ‘সুদর্শন অপেরা’ (যশোর), সন্তোষকুমার বিশ্বাসের ‘স্বর্ণকলি অপেরা’ (সাতপাড়, গোপালগঞ্জ) নতুন পালা নিয়ে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় জনপ্রিয় হয়।

১৯৮৩ সালে মানিকগঞ্জের নারায়ণচন্দ্র মণ্ডলের ‘সত্যনারায়ণ অপেরা’ এবং যশোরের মফিজুল আলম খোকার ‘নিউ গীতশ্রী যাত্রা ইউনিট’ বেশ আলোড়ন তোলে। তবে জগদীশচন্দ্র বর্মণের ‘সারথী যাত্রা ইউনিট’ (যশোর) এবং সুকুমার সরদারের ‘দি তরুণ অপেরা’ও (যশোর) যাত্রামোদী দর্শকশ্রোতাদের মনোরঞ্জন করে।

১৯৮৪ সালে জন্ম নেয়া খোন্দকার আতাউর রহমানের ‘রাজনীলা নাট্যসংস্থা’ (ফরিদপুর), মোহম্মদ আলী চৌধুরীর ‘সোনালী অপেরা’ (গাজীপুর), খোন্দকার আলিমুজ্জামানের ‘আদি বলাকা অপেরা’ (ফরিদপুর), গৌরাঙ্গ বিশ্বাসের ‘অগ্রগামী নাট্যসংস্থা’ (রাজবাড়ী), মেহবুব ইসলামের ‘আর্য অপেরা’, (সাতীরা) এবং মো. নুরুল ইসলামের ‘জনতা যাত্রা ইউনিট’ (রংপুর) দেশের উল্লেখযোগ্য দলে পরিণত হয়। ‘অগ্রগামী নাট্যসংস্থা’র পরবর্তী অধিকারী হন তারাপদ কর্মকার। ‘আর্য অপেরা’র অধিকারীও বদল হয়। মেহবুব ইসলামের পরে মানিক মেম্বার এবং সর্বশেষ মজিবুর রহমান এর অধিকারী হন। ঢাকায় ননী চক্রবর্তীর ‘আদি অগ্রগামী যাত্রাসমাজ’, মাগুরায় নৃপেনবাবুর ‘উজ্জ্বল নাট্যসংস্থা’, গোপালগঞ্জের শৈলেন রায়ের ‘অঞ্জলি অপেরা’, মানিকগঞ্জের আবুল কালামের ‘কাকলী নাট্যসংস্থা’, কুমিল্লার আবদুর রশীদের ‘চাঁদনী অপেরা’, জামালপুরের হামিদ মণ্ডলের ‘আঞ্জু অপেরা’, নরসিংদীর মো. জালালউদ্দিনের ‘বাঁশরিয়া সৌখিন নাট্যদল’ এবছরে গঠিত বেশ জনপ্রিয় যাত্রাদল।

১৯৮৫ সালে গুরুত্বপূর্ণ দল হচ্ছে মানিকগঞ্জের ‘প্রগতি নাট্যসংস্থা’ (তমসের সিকদার) এবং ‘মধুমিতা নাট্যসংস্থা’ (আবদুর রহমান প্রধান)। ১৯৮৫ সালেই খুলনার দাকোপ থানার বাজুয়ার পরিতোষ ব্রহ্মচারী ‘সোনালী অপেরা’ নামে একটি যাত্রাদল করেন। তিনি জীবদ্দশায় দেশের শীর্ষস্থানীয় পালাকারে মর্যাদা পেয়েছিলেন। তাঁর রচিত কিওপেট্রা, দস্যুরানী ফুলন দেবী, এক যুবতী হাজার প্রেমিক, নদীর নাম মধুমতী, বিরাজ বৌ প্রভৃতি পালা অভিনীত হওয়ার কারণে দলটি এবছর আকর্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কুমিল্লার রতন মিয়ার ‘রূপশ্রী অপেরা’ এবং নেত্রকোণার রাধাচরণ সাহারায়ের ‘নবযুগ অপেরা’ও বেশ আলোচিত হয়। দীলু বণিক পরে এই দলটির অধিকারী হন। নবযুগ অপেরা গৌরাঙ্গ আদিত্য দেশের শ্রেষ্ঠ বিবেক শিল্পী হিসেবে পরিচিত হয়েছেন।

শিল্পী গৌরাঙ্গ আদিত্যের জন্ম মোহনগঞ্জ উপজেলায় ১৯৩৪ সালে। নিমাই সন্ন্যাস পালায় অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর যাত্রাজীবন শুরু হয়। বার-তের বছর বয়সে তিনি গানের তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ বীরেন্দ্রচন্দ্র গোস্বামীর কাছে। তারপর ময়মনসিংহে ওস্তাদ বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কাছে শিক্ষা নিয়ে যাত্রাদলে পেশাদার ‘বিবেক’ হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশে যাত্রাঙ্গনে শ্রেষ্ঠ ‘বিবেক’-শিল্পী হিসেবে তিনি সম্মানিত। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে তিনি নবযুগ অপেরা ছাড়াও বাবুল অপেরা, ভাগ্যলক্ষ্মী অপেরা, রয়েল ভোলানাথ অপেরা, চারণিক অপেরা, সবুজ অপেরায় একচ্ছত্র বিবেক হিসেবে যাত্রাশিল্পের সেবা করেছেন। যাত্রা থেকে অবসর নিয়ে এখন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সাধনা করেন। গান শেখানো তাঁর জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। নেত্রকোণায় ঝুমুরযাত্রার দল কিংবা পালাগানের দল থাকলেও পেশাদার যাত্রাদলের সংখ্যা বেশি নয়। কিন্তু এই এলাকার অনেক অভিনেতাই দেশের বিভিন্ন যাত্রাদলে কাজ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। নেত্রকোণার নারীশিল্পীদের সম্পর্কে জানা যায় ননীগোপাল সরকারের অনুসন্ধান থেকে-

স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে প্রফেশনাল যাত্রাপার্টি ছাড়া এমেচারে নারীদের কোনও অংশগ্রহণ ছিল না। তখন সুধীরবাবু, বিনোদবাবুর মতো ব্যক্তিরাই নারীচরিত্রে অভিনয় করতেন। রজব ও রশীদের মতো ব্যক্তিরা ড্যান্সার হিসেবে যাত্রার প্রথম দৃশ্য উন্মোচন করতেন। ... ভদ্রঘরের মেয়েরা নাটক বা যাত্রায় উৎসাহী হয়নি। তবে ময়মনসিংহ, জামালপুর এবং নেত্রকোণার নাটকপাড়ায় কিছু মহিলা যাত্রাশিল্পী পাওয়া যেত। ... নেত্রকোণায় কৃষ্ণা, ইলা, রীতা, ফরিদা, সাধনা, শিরিন, মাধবী, আঞ্জু প্রমুখ শিল্পী সাতপাই এলাকায় অবস্থান করে। এখানে একটি মিনি নাটকপাড়া গড়ে উঠেছে। রেলক্রসিং-এ বেশ কটি যাত্রা পোষাকের বিপণী রয়েছে। এগুলোকে কেন্দ্র করেই বর্তমানে নেত্রকোণা জেলার সর্বত্র এমেচার যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।৪৭
 
মানিকগঞ্জের হায়দার আলীর ‘নবরূপা অপেরা’ এবং ভোলার স্বপনবাবুর ‘স্বপন অপেরা’ ১৯৮৫ সালের আরও দুটি দল। ১৯৮৫ সালের ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পের জন্যে একটি অন্যরকম দিন। এদিন বাংলাদেশ টেলিভিশনে অমলেন্দু বিশ্বাস নির্দেশিত ও চারণিক নাট্যগোষ্ঠী প্রযোজিত মাইকেল মধুসূদন পালাটি সম্প্রচারিত হয়। এ পালার মাধ্যমে অমলেন্দু বিশ্বাস যাত্রাভিনেতা হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান। ১৯৯১ সালের ২৪ এপ্রিল পালাটি পুনঃপ্রচারিত হয়। এপালায় অমলেন্দু বিশ্বাস ও জ্যোৎস্না বিশ্বাস ছাড়াও অতুল রায়, হেম সেন, সুনীল মণ্ডল, রিপন বাড়ৈ, বাদল ঘোষ, সবিতা মল্লিক প্রমুখ শিল্পী অভিনয় করেন।

মানিকগঞ্জের কেএম হারুনুর রশিদ, সাকেলা বেগম এবং আ. জলিল সিকদার (তারা মিয়া) ১৯৮৬ সালে যথাক্রমে ‘মহানগরী যাত্রা ইউনিট’, ‘নিউ জয়ন্তী অপেরা’ এবং ‘আদি প্রগতি নাট্যসংস্থা’ গঠন করেন। দলতিনটি ছাড়াও এবছর জনপ্রিয় দল হিসেবে আবির্ভূত হয় যশোরের সাধনকুমার মুখার্জী গণেশের ‘চণ্ডী অপেরা’, গোপালগঞ্জের অসীমকান্তি বলের ‘চন্দ্রা অপেরা’, ময়মনসিংহের আবদুর রশিদ ফকিরের ‘বেঙ্গল অপেরা’, মাদারীপুরের এস আলম লাবুর ‘রতœশ্রী অপেরা’ এবং গোপালগঞ্জের সুধীর বিশ্বাসের ‘নিউ ফাল্গুনী নাট্য সংস্থা’। সাকেলা বেগমের ‘নিউ জয়ন্তী অপেরা’ পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জের এসএম ইকবাল রুমির আধিকারিত্বে পরিচালিত হয়।

১৯৮৭ সালের নতুন দল হচ্ছে নরসিংদীর সুমি অপেরা (শামসু হক), সাতীরার ‘কপোতা যাত্রা ইউনিট’ (নূর খাঁ চেয়ারম্যান), নেত্রকোণার ‘মহুয়া নাট্যসংস্থা’ (আদব আলী) এবং মানিকগঞ্জের ‘নিউ প্রতিমা অপেরা’ (শিপ্রা সরকার উমা ও সুশীল সরকার)। ১৯৮৮ সালে মাঠে নামে শহীদ মিয়ার ‘মণিহার অপেরা’ (নেত্রকোণা), আবদুল মান্নানের ‘শাহী অপেরা’ (নেত্রকোণা), সাত্তার মিয়ার ‘মণিহার যাত্রা ইউনিট’ (সাতীরা) এবং আজগর আলীর ‘দুর্বার অপেরা’ (নারায়ণগঞ্জ)।

১৯৮৯ সালে যাত্রামাঠে জনপ্রিয় দল হিসেবে আগমন ঘটে সাতীরার কার্তিকচন্দ্র দাশের ‘নিউ প্রভাস অপেরা’ এবং সাতীরার মিনতি বসু ও সুকল্যাণ বসুর যৌথ মালিকানায় ‘নাট্যমঞ্জরী যাত্রা ইউনিট’। এবছর জামালপুরের গোবিন্দলাল সাহার ‘সততা নাট্যসংস্থা’, নারায়ণগঞ্জের আনোয়ার হোসেনের ‘বিউটি অপেরা’, খুলনার গোষ্ঠবিহারী মণ্ডলের ‘রাজমহল অপেরা’, নাটোরের সোহরাব তালুকদারের ‘শিল্পীতীর্থ নাট্যসংস্থা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ‘রাজমহল অপেরা’র অধিকারী হন খুলনার শেখ বেলালউদ্দিন বিলু।

১৯৯০ সালে যশোরের শহিদুল ইসলামের ‘পারুল অপেরা’ নাটোরের মুজিবর রহমান সরদারের ‘বিশ্ববাণী যাত্রা ইউনিট’ এবং ঢাকায় মো. নজরুল ইসলামের ‘রাজধানী যাত্রা ইউনিট’ দল তিনটি বেশ জনপ্রিয় হয়। ঢাকায় গড়ে ওঠা মো. আবদুল হালিমের ‘আকাড়া নাট্যদল’ বেশকয়েকটি যাত্রাপালা পরিবেশন করে। এরকম একটি দল গঠিত হয় নেত্রকোণায়। স্থানীয় বিশিষ্ট নাট্যজন ননীগোপাল সরকারের ‘জনান্তিক নাট্যগোষ্ঠী’ বেশকয়েকটি পালা আসরস্থ করে যাত্রাদল হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে।

১৯৯১ সালে চারটি দলই ভালো দল হিসেবে মূল্য পায়। এগুলো হল- শাহনেওয়াজ ফিরোজ স্বপনের ‘মধুছন্দা যাত্রা ইউনিট’ (ফরিদপুর), শামসুল আলমের ‘দি সিজার্স যাত্রা ইউনিট’ (যশোর), কৃষ্ণারানী চক্রবর্তীর ‘রামকৃষ্ণ যাত্রা ইউনিট’ (বাগেরহাট) এবং আলমগীর হোসেনের ‘বিশ্বেশ্বরী নাট্যসংস্থা’ (ঢাকা)।

১৯৯২ সালে রাজধানী ঢাকায় জন্ম নেয় তিনটি দল। এগুলো হল- মানজুরুল ইসলাম লাভলুর ‘চন্দ্রা যাত্রা ইউনিট’, আলাউদ্দিন দেওয়ানের ‘তাজমহল যাত্রা ইউনিট’ এবং নয়ন চৌধুরীর ‘শিল্পী অপেরা’। এবছর মাগুরা জেলায় আত্মপ্রকাশ করে দুটি দল- আবদুস সালামের ‘উত্তরণ নাট্য সংস্থা’ এবং নাজমুল হোসেন ইকুর ‘মধুমতী নাট্যসংস্থা’। খুলনার শেখ আমজাদ হোসেনের ‘রংধনু লোকনাট্য’, ফরিদপুরের পারভীন জামানের ‘আদি বঙ্গশ্রী অপেরা’, রংপুরের আবদুল মান্নানের ‘উত্তরণ যাত্রা ইউনিট’ এবং সাতীরার আবদুল মান্নানের ‘মণিহার অপেরা’ এবছরের আলোচিত দল। ‘আদি বঙ্গশ্রী অপেরা’ বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের গাজী মান্নানের অধিকারিত্বে পরিচালিত হয়।

১৯৯৩ সালে চারটি দলের জন্মের খবর পাওয়া যায়। ‘পদ্মা যাত্রা ইউনিট’ (প্রদীপকুমার সাহা, যশোর), ‘দেশ অপেরা’ (মিলনকান্তি দে, ঢাকা), ‘চৈতালী অপেরা’ (অতুলপ্রসাদ সরকার, মাগুরা), ‘লক্ষ্মীভাণ্ডার অপেরা’ (রণজিৎ সেন, চট্টগ্রাম) এবং ‘আদমজী কিরণ নাট্যগোষ্ঠী’ (নূর মোহাম্মদ নুরু, নারায়ণগঞ্জ)। এর মধ্যে ‘পদ্মা’ এবং ‘চৈতালি’ খুবই জনপ্রিয় হয়। ‘দেশ অপেরা’ যশোর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিলেও মূলত ঢাকা শহরে বিভিন্ন পালা মঞ্চায়ন করে। ১৪০০ বঙ্গাব্দ থেতে প্রতি বছর বৈশাখ উদ্যাপন উৎসবে ঢাকায় ‘দেশ অপেরা’ যাত্রানুষ্ঠান করে আসছে। চলচ্চিত্রকার অনুপ সিংহ পরিচালিত ‘দি রিভার্স’ (ঋত্বিক ঘটকের জীবন অবলম্বনে) ছবির যাত্রা-অংশে দেশ অপেরার শিল্পীরা অভিনয় করে।

১৯৯৪ সালে জন্ম হয় মুন্সিগঞ্জের মো. নয়ন মিয়ার ‘শিল্পী শোভা অপেরা’ এবং নড়াইলের গোপালচন্দ্র পালের ‘কণিকা অপেরা’। ‘শিল্পী শোভা অপেরা’ মূলত গীতিধর্মী পালা আসরস্থ করে থাকে।

১৯৯৫ সালে সুভাষ চক্রবর্তীর ‘রাজমণি অপেরা’ (ফরিদপুর) বাদে যে তিনটি দলের জন্ম হয় সেগুলো গীতিধর্মী যাত্রার দল। দলতিনটি হল-‘সৌখিন গীতিনাট্য’ (মো. শামীম হোসেন, গাজীপুর), ‘তিনকন্যা অপেরা’ (বশির আহমেদ, যশোর) এবং ‘ঝুমুর টঙ্গী’ (নুরুল ইসলাম সবুজ, গাজীপুর)।

১৯৯৬ সালে দুটি গীতিধর্মী আর দুটি সাধারণ যাত্রাদলের জন্ম হয়। গীতিধর্মী দল দুটি হল মুন্সিগঞ্জের আরশাদ আলীর ‘বিনোদন ঝুমুর যাত্রা’ এবং কুমিল্লার আবদুল মতিন সরকারের ‘শাহীন অপেরা’। সাধারণ দল দুটি হল নেত্রকোণার আবুল হাশেমের ‘বন্ধন নাট্যসংস্থা’ এবং মানিকগঞ্জের সেকেন্দার আলীর ‘সূর্যমহল অপেরা’।

১৯৯৭ সালে তিনটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মাদারীপুরের এস আলম লাবুর ‘নিউ সবুজ অপেরা’, শরীয়তপুরের নার্গিস আক্তার লিপির ‘তাজমহল অপেরা’ এবং গাজীপুরের সুনীল চার্লস রডরিক্সের ‘নাগরী সৌখিন ঝুমুর শিল্পীগোষ্ঠী’। শেষোক্ত দলটি সৌখিন শিল্পীদের সমন্বয়ে গঠিত হলেও গীতিধর্মী পালা আসরস্থ করে বেশ জনপ্রিয় হয়।

১৯৯৮ সালে জন্ম নেয়া তিনটি দলই খ্যাতি অর্জন করে। এগুলো হল-‘কেয়া যাত্রা ইউনিট’ (মাসুম চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর), ‘তরুণ অপেরা’ (মো. নূরুল ইসলাম, চাঁদপুর) এবং ‘আনন্দ অপেরা’ (বাবর চান, যশোর)। শেষোক্ত দলটি পরে মোশাররফ হোসেন নয়নের মালিকানায় পরিচালিত হয়। ১৯৯৯ এবং ২০০০ সালে নতুন কোনো যাত্রাদলের জন্ম হয় নি। ২০০১ সালে নাটোরের মোসাদ্দেক আলীর ‘মৌসুমী অপেরা’র যাত্রা শুরু হয়।

যে-সকল দলের নাম, স্বত্বাধিকারীর নাম, জেলার নাম এবং গঠনের সময় জানা গেছে সেই দলগুলোই মূলত বিশ্লেষণে এসেছে। কিন্তু এর বাইরেও রয়ে গেছে অনেক সৌখিন এবং অপেশাদার যাত্রাদল। বিভিন্ন সময়ে গঠিত আরও যে-সকল দলের আংশিক তথ্য পাওয়া যায় তা হল- লক্ষ্মীনারায়ণ অপেরা (১৯৫৮), কমলা অপেরা (১৯৬৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), পান্না অপেরা (১৯৭২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া), ঝিনুক অপেরা (১৯৮১, হবিগঞ্জ), পূর্বাচল নাট্যসংস্থা (১৯৮৬, কিশোরগঞ্জ), রকি যাত্রা ইউনিট (১৯৯০, নেত্রকোণা), পলাশ নাট্যসংস্থা (১৯৯৮, নেত্রকোণা), নিউ লিলি অপেরা (১৯৯৮, কেয়া চৌধুরী), মহাশক্তি অপেরা, (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), নবারুণ অপেরা (সিরাজগঞ্জ), মঞ্জরী যাত্রা ইউনিট (নাটোর), কৃষ্ণাকলি অপেরা (নেত্রকোণা), শাপলা অপেরা (ময়মনসিংহ), প্রতিভা অপেরা (যশোর, রূপান্তর অপেরা (যশোর), ঝিনাইদহ যাত্রা পার্টি (ঝিনাইদহ), কোহিনুর যাত্রা পার্টি (সিলেট), ঝর্না যাত্রা পার্টি, (টাঙ্গাইল), ঝুমুর অপেরা (টাঙ্গাইল), বিশ্ববাণী অপেরা (ফেনী), শিল্পতীর্থ অপেরা (ফেনী), দীপালি যাত্রা পার্টি (নারায়ণগঞ্জ), নর্থবেঙ্গল যাত্রাপার্টি (রংপুর), মল্লিকা অপেরা (খুলনা), রাজলক্ষ্মী অপেরা (বরিশাল), শ্রীদুর্গা যাত্রা পার্টি (পাবনা), সাগর অপেরা (পাবনা), সূর্যমুখী অপেরা (পাবনা), লিপটন অপেরা (আমির সিরাজী), চলন্তিকা অপেরা (বাবুল আখতার), একতা অপেরা (মাগুরা), কাঞ্চন অপেরা (কাঞ্চন মিয়া), গীতালি অপেরা (যশোর), মিনার্ভা অপেরা (পটুয়াখালী), জয়ন্তী অপেরা (চট্টগ্রাম), সমাজ অপেরা, (সিরাজগঞ্জ), ফাল্গুনী অপেরা (বরিশাল), জোনাকী অপেরা (জ্যোৎস্না হায়দার, চাঁদপুর) প্রভৃতি।

পটুয়াখালীর জেলায় ১৯৫৩ সালে ‘নবারুণ অপেরা’ এবং ১৯৬৬ সালে ‘শ্রীকৃষ্ণ অপেরা’ নামের যাত্রাদল গঠিত হয়। দল দুটির স্বত্বাধিকারী ছিলেন যথাক্রমে মনোজ ঘোষ ও গণেশ দাশ। এছাড়া এই এলাকায় ‘হাসিনা অপেরা’, ‘সুবর্ণা অপেরা’, ‘আন্ধারমানিক অপেরা’ প্রভৃতি নামের বেশকিছু যাত্রাদল ছিল।

সুনামগঞ্জ জেলায় শাল্লা থানায় ১৯৯৬ সালে গঠিত ‘জয়দুর্গা নাট্য সংসদ’ মূলত ঢপযাত্রা পরিবেশন করে। মনসামঙ্গল এবং শ্মশানে মিলন পালাদুটি পরিবেশন করে এই দল সিলেট অঞ্চলে ব্যাপক সুনাম অর্জন করে। সিলেটের ‘আনন্দপুর সংসদ’, ‘আশালতা গোষ্ঠী’, ‘মহামায়া সম্প্রদায়’ প্রভৃতি পেশাদার দলও মূলত ঢপযাত্রা পরিবেশন করে থাকে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও যাত্রাদল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যাত্রানুষ্ঠানের খবর সংবাদপত্রের পাতায় নিয়মিত গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয় না। একসময় সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’, সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’, সাপ্তাহিক ‘পূর্বাণী’ ও মাসিক ‘ঝিনুক’ পত্রিকায় নিয়মিত যাত্রার সংবাদ ছাপা হত। মাত্র দুই-তিন জন যাত্রার লোকই এসকল পত্রিকায় সংবাদ ও প্রতিবেদন রচনা করত। তাই তাদের পছন্দের দলগুলোর কথাই বারবার এসেছে ওই সকল পত্রিকায়। কোনো কোনো দলের খবর কখনই পত্রিকায় ছাপা হয় নি। দল-মালিকরা তাঁদের কর্মকাণ্ডের দলিলপত্রও সংরক্ষণ করেন না। তাই যাত্রাদলের ক্রমবিকাশের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খ ও পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভবপর নয়। সামাজিক ও রাষ্ট্রিক নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশে এখনও যাত্রাদল টিকে আছে এবং নতুন দলের জন্ম হচ্ছে- এটি নিঃসন্দেহে স্বীয় ঐতিহ্যের প্রতি সাধারণ মানুষের চিরন্তন আকর্ষণের স্বাভাবিক প্রতিফল।

তথ্যসংকেত :
১.    ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রার একাল সেকাল, ইম্প্রেসন সিন্ডিকেট, কলকাতা, পৃ. ৮২
২.    কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যচরিতামৃত, মধ্যলীলা, ১৫শ পরিচ্ছেদ [উদ্ধৃতি : গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, বাংলা লোকনাট্য সমীক্ষা, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, দ্বি.প্র. ২০০০, পৃ. ১৬৩
৩.    বৈদ্যনাথ শীল, বাংলা সাহিত্যে নাটকের ধারা, দ্বি-সং, এ.কে. সরকার এন্ড কোংকেলকাতা, ১৯৭০, পৃ. ১-২
৪.    রাজেন্দ্রলাল মিত্র, বিবিধার্থ সংগ্রহ, মাঘ ১৮৫৯ [ উদ্ধৃতি: মণীন্দ্রলাল কুণডুু, বাঙালির নাট্যচেতনার ক্রমবিকাশ, সাহিত্যলোক, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ১৬৯]
৫.    সমাচার দর্পণ, ২৬ জানুযারি ১৮২২ (উদ্ধৃতি: মণীন্দ্রলাল কুণডু, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৯]
৬.    মুনতাসীর মামুন, ‘হৃদয়নাথের ঢাকা শহর’, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ঢাকা, ঈদসংখ্যা ১৯৭৬, পৃ. ১৪৪
৭.    সত্যেন সেন, শহরের ইতিকথা, স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃ. ৩৮-৩৯
৮.    ঢাকা জেলা গেজেটিয়ার, ১৯৭৫, পৃ. ৩৪২
৯.    হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ২২ মে ১৮৬৫ [উদ্ধৃতি : রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে পৌরাণিক নাটক, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, দ্বি-সং ১৯৯৩, পৃ. ৫৪]
১০.    মুনতাসীর মামুন, ঊনিশ শতকে ঢাকার মুদ্রণ ও প্রকাশনা, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৪, পৃ. ১১৭-১৮]
১১.    আলেকজান্ডার ফর্বেস (সম্পা.), ‘দি বেঙ্গল টাইমস’, ঢাকা, ১১ এপ্রিল ১৮৮৭ [উদ্ধৃতি : মুনতাসীর মামুন, ঊনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র, অষ্টম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃ. ২০২]
১২.    আলেকজান্ডার ফর্বেস (সম্পা.), প্রাগুক্ত, ঢাকা, ৭ ডিসেম্বর ১৮৯৪ [উদ্ধৃতি: মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৩]
১৩.    কুষ্টিয়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ১৯৭৬, পৃ. ৬১
১৪.    শচীন্দ্রনাথ অধিকারী, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ, জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৭৪, পৃ. ৪৭১
১৫.    আলেকজান্ডার ফর্বেস (সম্পা.), প্রাগুক্ত, ২ জানুয়ারি ১৮৯৮ [উদ্ধৃতি: মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৩]
১৬.    কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার (সম্পা.), ঢাকা প্রকাশ, ঢাকা, ৮ আগস্ট ১৮৬৯ [উদ্ধৃতি: মুনতাসীর মামুন, ঊনিশ শতকে বাংলাদেশের থিয়েটার, সুবর্ণ, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ৬৫]
১৭.    হরিনাথ মজুমদার (সম্পা.), গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা, কুষ্টিয়া, নবেম্বর, দ্বিতীয় প, ১৮৭২ [উদ্ধৃতি : মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৫-৬৬]
১৮.    হরিনাথ মজুমদার (সম্পা.), গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা, কুষ্টিয়া, দশম বর্ষ ৩৩ সংখ্যা ১৮৭৩ [উদ্ধৃতি : মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৯]
১৯.    হরিনাথ মজুমদার (সম্পা.), গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা, কুষ্টিয়া, দশম বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ১৮৭৩ [উদ্ধৃতি : মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭০]
২০.    হরিনাথ মজুমদার (সম্পা.), গ্রামবার্ত্তাপ্রকাশিকা, প্রাগুক্ত
 ২১.    বঙ্গচন্দ্র রায় (সম্পা.), বঙ্গবন্ধু, ৫ অক্টোবর ১৮৮৩ মুনতাসীর মামুন, ঊনিশ শতকে বাংলাদেশের বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ. ১৮৫]
২২.    বঙ্গচন্দ্র রায় (সম্পা.), বঙ্গবন্ধু, ২৮ অক্টোবর ১৮৮৩ [মুনতাসীর মামুন, প্রাগুক্ত]
২৩.    শ্রীনাথ রায় (সম্পা.), হিন্দুরঞ্জিকা [উদ্ধৃতি : মুনতাসীর মামুন, ঊনিশ শতকে বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িকপত্র, পঞ্চম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ. ১২৬]
২৪.    শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, কলকাতা, দ্বি-সং, পৃ. ২০২ [উদ্ধৃতি: গৌরীশঙ্কর ভট্টচার্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৬]
২৫.    ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, সংবাদ প্রভাকর, ১ শ্রাবণ ১২৬১ (জুলাই ১৮৫৪) [উদ্ধৃতি: বিনয় ঘোষ, সাময়িকপত্রে বাংলার সমাজচিত্র, দ্বিতীয় খণ্ড, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ১৫০]
২৬.    ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত, মায়া [উদ্ধৃতি: গৌরীশঙ্কর ভট্টচার্য, প্রাগুক্ত]
২৭.    সূত্রধার, ‘শতাব্দীর যাত্রাগান’, দেশ বিনোদন সংখ্যা, কলকাতা, ১৩৭৫, পৃ. ১০০৩
২৮.    গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৩১
২৯.    গৌরীশঙ্কর ভট্টাচার্য, প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৪২
৩০.    ব্রজেন্দ্রকুমার দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭
৩১.    সত্যেন সেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩-৪৪
৩২.    গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, ৩০০ বছরের যাত্রাশিল্পের ইতিহাস, পুষ্প প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৯৬, পৃ. ৩৭৯
৩৩.    ব্রজেন্দ্রকুমার দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১
৩৪.    সত্যেন সেন, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৯
৩৫.    গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ, প্রাগুক্ত
৩৬.    অমলেন্দু বিশ্বাস, বাংলাদেশের যাত্রাশিল্প, শ্রাবণ প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৩, পৃ. ১৪
৩৭.    অমলেন্দু বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৪
৩৮.    অমলেন্দু বিশ্বাস, ‘যাত্রানায়িকা মঞ্জুশ্রীকে বাঁচান’, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, ঢাকা, ১২ ফেব্র“য়ারি ১৯৮৭
৩৯.    চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ১৯৭৫, পৃ. ১৩৯
৪০.    যাত্রামালিক গোপাল পাণ্ডের কথা, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, ঢাকা, ৪ জুলাই ১৯৯১
৪১.    দেলোয়ার হোসেন বাচ্চুর সাক্ষাৎকার, নুরুল্লাপুর যাত্রার আসর, নবাবগঞ্জ, ঢাকা, ১৩ নভেম্বর ২০০২
৪২.    খুলনা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ১৯৭৮, পৃ. ৯১
৪৩.    ‘তুষার দাশগুপ্তের স্মরণে আলোচনা-সভা’, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬
৪৪.    শাহীন রেজা নূর, ‘পরলোকে যাত্রাশিল্পের অগ্রসেনানী অমলেন্দু বিশ্বাস’, দৈনিক ইত্তেফাক, ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৮৭
৪৫.    বগুড়া ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ১৯৭৯, পৃ. ৭৮
৪৬.    পাবনা ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, ১৯৭৮, পৃ. ৮০
৪৭.    গোলাম আম্বিয়া নূরী, ‘টাঙ্গাইলের জনসমাজ : নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি’, টাঙ্গাইল জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য (মুহম্মদ বাকের সম্পাদিত), জেলা পরিষদ, টাঙ্গাইল, ১৯৯৭, পৃ. ১৪০
৪৮.    ননীগোপাল সরকার, ‘লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডারে নেত্রকোণার যাত্রাপালা’, নেত্রকোণার লোকজগত (স্বপনকুমার পাল সম্পাদিত), স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, নেত্রকোণা, ২০০২, পৃ. ৩৭-৩৮,
৪৯.    টিভিতে যাত্রা শুরু, সাপ্তাহিক পূর্বাণী, ঢাকা, ২ মে ১৯৯১

ড. তপন বাগচী : কবি, গবেষক  ও সাংবাদিক।