Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

গ্রটস্কির থিয়েটার ল্যাবরেটরি : অভিনেতার আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

জর্জি গ্রটস্কি একজন অনন্য থিয়েটার শিল্পী। থিয়েটার চর্চায় তাঁর জীবন নিবেদিত। একটি স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম হিসেবে আধুনিক পৃথিবীতে থিয়েটারকে গ্রটস্কি শক্তিশালী ভিত্তিভূমির উপর দাঁড় করিয়ে আজ স্মরণীয়, কিংবদন্তী। তিনি থিয়েটার নিয়ে গভীর অনুসন্ধান, বহুকৌণিক পর্যালোচনা, চুলচেরা বিশ্লেষণ সর্বোপরি মানবীয় সম্ভাবনা ও শক্তির অসীমতা উপলব্ধি করে এক বৈশিষ্ট্যময় আঙ্গিকের থিয়েটার প্রবর্তন করেছেন। গ্রটস্কির এই বিশিষ্ট ধারার থিয়েটার চর্চা সমকালীন বিশ্বে থিয়েটার ল্যাবরেটরি হিসেবে খুবই সুপরিচিত। বহুল আলোচিত এই থিয়েটার ল্যাবরেটরিকে অনেক বিশ্লেষকই একটি গবেষণাগার হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু গ্রটস্কি নিজস্ব থিয়েটার চর্চার বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নামাঙ্কিতকরণকে যথার্থ মনে করেন না। তাঁর মতে এই গবেষণা শব্দটিকে বৈজ্ঞানিক গবেষণার আক্ষরিক অর্থে প্রয়োগ করা উচিত নয়। গবেষণা শব্দটিকে সবাই পেশাগত জায়গা থেকেই গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু একজন কাঠখোদাইকারী একটি নকশার ছাচ নিয়ে যেভাবে পুনঃখোদাই করে, আরেকটি নতুন জিনিস তৈরি করে, তাই বলে একে তো আর গবেষণা বলা যাবে না। প্রকৃতপক্ষে, শিল্পী এবং বিজ্ঞানীরা যেভাবে কাজ করে গ্রটস্কি সেভাবে কাজ করেন না। কাজের ধারা সম্পর্কে তাঁর অভিমতটা হলো, মুচি যেভাবে খুঁজে খুঁজে জুতোর মধ্যে ঠিক ছিদ্রটিতেই হাতুড়ি মারে ঠিক সেভাবে আমরা কাজ করি।

গ্রটস্কি তাঁর সময়ে উদ্ভূত চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের ফলে শিল্পের বিচিত্র শাখা-প্রশাখার সমস্ত ভাষার মাধ্যমে খিচুড়ি তৈরি হয়ে যায় বলে মত দিয়েছেন। আর এই সময়েই থিয়েটারের অস্তিত্বে তীব্র আঘাত আসে। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে গ্রটস্কি প্রশ্নাকূল হয়েছেন যে শিল্পের অন্যান্য মাধ্যম থেকে থিয়েটারের স্বাতন্ত্র্য কোথায়? এর বিশিষ্টতা কী? কিংবা কোথায় গুপ্ত আছে এর শক্তি? প্রশ্নবিদ্ধ গ্রটস্কির মননের গভীরেই জন্ম নেয় গবেষণা প্রত্যয়টি। তাঁর মতে শিল্পের সার্বিক প্রেক্ষাপটে থিয়েটারের স্থান অপরিবর্তনযোগ্য। আর কোনো শিল্প দিয়েই থিয়েটারের স্থানটি পূরণযোগ্য নয়।

থিয়েটার শব্দটি দিয়ে কী অর্থ বোঝায়? এই প্রশ্নের বিপরীতে গ্রটস্কি বলেন, এর অনেকগুলো উত্তর করা সম্ভব। পণ্ডিতগণের কাছে থিয়েটার হচ্ছে এমন একটা জায়গা যেখানে অভিনেতা সুনির্দিষ্ট পাণ্ডুলিপি আবৃত্তি করে, শারীরিক অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে দৃশ্যায়িত করে এবং দর্শকদের কাছে তা সহজেই বোধগম্য। এটা হলো নাট্যসাহিত্যের একটি প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে থিয়েটার শব্দটির ব্যাখ্যা। বুদ্ধিজীবীগণ ঠিক এই রকম থিয়েটারের পক্ষেই ওকালতি করেন। এখানে পাণ্ডুলিপিই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর গ্রটস্কি এই থিয়েটারকে পাণ্ডুলিপিভিত্তিক একটা পণ্ডিতি বা তর্ক বিতর্কের আয়োজনমাত্র বলে চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, পণ্ডিতদের থিয়েটারে অভিনেতাগণ পূর্বনির্ধারিত ও সমানুপাতিক মোকাবিলায় লিপ্ত হয়। মধ্যযুগীয় (Oratiocal Duel)  বা বাকযুদ্ধ শিল্পকেই পুনরুজ্জীবিত করা হয় এই থিয়েটারের মাধ্যমে।

থিয়েটারের দর্শকদের সম্বন্ধে রয়েছে গ্রটস্কির গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। তিনি বলেন, গড়পড়তা যেসব দর্শক থিয়েটারে যায় তাদের সকলের অভিমত হলো- প্রথমত এবং প্রধানত থিয়েটার হচ্ছে একটা বিনোদন মাধ্যম। প্রকৃতই যদি দর্শকরা থিয়েটারে মোকাবিলা বা মজা নিতে চায় সেক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি তাকে আগ্রহী করবে না। দর্শক তথাকথিত ভাঁড়ামি, ঠাট্টা, তামাশা, হাস্যরস মজা এগুলো নাটকের পাণ্ডুলিপিতেই পায়। এর বাইরে অতিরিক্ত কিছু পাওয়ার জন্য দর্শকের দৃষ্টিটা অভিনেতার সক্রিয়তার দিকেই প্রধানত নিবদ্ধ হবে। একটি স্বল্পবসনা তরুণীর দিকে কিছু দর্শকের দৃষ্টি পড়ে। এখানে প্রচলিত সংস্কৃতির মাপকাঠিতেই একে বিচার করা হয়। যা আসলে ব্যক্তিগত হতাশাকে জয় করার একটা মূল্য মাত্র বা ক্ষতিপূরণ মাত্র।

প্রায়ই দর্শকরা ইচ্ছাপোষণ করে যে, তারা এমন কিছু অনুষ্ঠান বা পরিবেশনায় যেতে চায় যেগুলো হবে নিবেদিত নাট্যদল। দর্শকরা এমন কোনো ট্র্যাজেডি দেখতে চায় যেখানে থাকবে করুণ পরিণতি, অবিশ্বাস্যতা বা অতি নাটকীয়তা। আর এটাই দর্শকের রুচি বা পছন্দ। এক্ষেত্রে দর্শকের এই প্রত্যাশাগুলো খুবই আপেক্ষিক। একদিকে দেখাচ্ছে সে একটা ভদ্র সমাজের মানুষ। যে সমাজে শিল্প একটা আশ্বাসের মতো। অন্যদিকে সে এমন কতকগুলো আবেগ, অনুভূতির অভিজ্ঞতা লাভ করে যা তাকে (দর্শক) একটা আত্মতৃপ্তি দেয়। দর্শকরা ট্র্যাজেডির চরিত্রগুলোর দুর্বিসহ, করুণ, নির্মম অবস্থা দেখে তীব্র ঘৃণা বা প্রেম অনুভব করে। কিন্তু দর্শকের এই অনুভূতি খুবই বাহ্যিক এবং শক্তিহীন। এক্ষেত্রে দর্শক মনে করে যে মহৎ একটা জায়গায় সে উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। আবেগের এ ধরনের শিক্ষামূলক জায়গাতেই গ্রটস্কি প্রশ্ন তুলেছেন, সন্ধিগ্ধ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর দেয়া একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন আন্তিগোনে নাটক দেখার সময় দর্শকদের অধিকাংশই আন্তিগোনের প্রতি অনুরক্ত থাকে কিন্তু থিয়েটারের বাইরে দর্শকদের মধ্যে যে ‘ক্রেয়ন’সুলভ প্রবণতা বা বৈশিষ্ট্য রয়েছে এর থেকে দর্শক মুক্ত থাকবে কী করে? প্রচলিত ধারার থিয়েটার প্রকৃতপক্ষে মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে না। মঞ্চে একটি নিষ্পাপ শিশুর দুর্দশা ও বিপন্নতা উপস্থাপন করে দর্শকদের মধ্যে একরৈখিক সহানুভূতি তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে অভিনেতা বা নির্দেশক একটি উচ্চমূল্যের কিন্তু নিষ্ফল নৈতিকতা মাত্র অনুভব করতে পারে। এর বাইরে, সীমা অতিরিক্ত কোনো তাৎপর্য এ ধরনের থিয়েটারে ধরা পড়ে না।

থিয়েটারের মানুষদের মধ্যেও থিয়েটার সম্পর্কে একটি একক, সমগ্র বা পরিপূর্ণ ধারণার অনুপস্থিতি রয়েছে বলে গ্রটস্কি বিবেচনা করেছেন। তাঁর মতে, সব অভিনেতাই মনে করে থিয়েটার বলতে তারা নিজেরাই সব কিছু। কিন্তু অভিনেতারা কখনোই এটা মনে করে না যে তারা একটা শৈল্পিক কৌশল বা প্রক্রিয়ায় অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম। এই দৃষ্টিভঙ্গি অভিনেতার মধ্যে এক ধরনের নির্লজ্জ আত্মতৃপ্তির জন্ম দেয়। যে আত্মতৃপ্তি তাকে একরকম ভাবনাহীন বা অদক্ষ বা জ্ঞানহীন ক্রিয়া সংঘটিত করতেই শুধু সক্ষম করে তোলে। যেমন মঞ্চে হাঁটা-চলা, বসা, সিগারেট ধরানো, পকেটে হাত ঢুকানো ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে অভিনেতার এইসব ক্রিয়া কোনো কিছু প্রকাশ করার জন্য কোনো অর্থই তৈরি করে না। গ্রটস্কি অভিনেতার এই প্রবণতাকে তথাকথিত খ্যাতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

দর্শক তখন অভিনেতাকে মঞ্চে এধরনের ক্রিয়া দেখে আঙুল উঁচিয়ে বলেন যে, উনি থিয়েটারের অমুক বা মি. এক্স। মঞ্চের শিল্প নির্দেশকদের সম্পর্কে গ্রটস্কি দু’ধরনের মূল্যায়ন করেছেন। একটি হলো নাট্যসাহিত্যের (লিটারেচার) অনুগত শিল্পনির্দেশক প্রসঙ্গে। তাঁর মতে, মঞ্চ পরিকল্পকদের কাছে থিয়েটার হলো প্লাস্টিক আর্ট এবং যার একটি ইতিবাচক ফল পাওয়া যায়। দেখা যায় মঞ্চের শিল্প নির্দেশকদের বেশিরভাগই সাহিত্যমূলক থিয়েটারকেই সমর্থন করেন। তারা মনে করে যে, অভিনেতা এবং থিয়েটারের নান্দনিক সাজসজ্জায় যুক্ত শিল্পীদের সবাই নাট্যসাহিত্যের অনুগত। প্রকৃতপক্ষে তারা নাটকের পাণ্ডুলিপির সংরক্ষিত বা সংকুচিত এলাকার মধ্যেই বিচরণ করে।  কার্যত মঞ্চের যারা প্রকৃত শিল্পনির্দেশক তারা মনে করে এটা একটা মোকাবিলাক্ষেত্র। এই রণক্ষেত্রে নাট্যকারের চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই পরিবর্তনযোগ্য। এই ধারার শিল্প নির্দেশকগণ নাট্যকারের চিন্তার সীমানা অতিক্রম করে এক বিস্তৃত এলাকায় প্রবেশ করেন। এর ফলে লেখকের কল্পনার দিগন্ত রেখা স্পষ্ট হয়, রহস্য দূরীভূত হয়। গ্রটস্কি আরো বলেছেন যে, পোলিশ ডিজাইনাররা তাঁর দেশের থিয়েটারে পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ শতকে প্লাস্টিক আর্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের বহুবিধ সম্ভাবনাকে এই ডিজাইনাররা কাজে লাগিয়েছে। যেটা কিছুটা হলেও নাট্যকার এবং প্রযোজকদের অনুপ্রাণিত করছিলো।

শিল্পনির্দেশকদের মাধ্যমে মঞ্চে প্রাধান্য বিস্তারের অভিযোগ সম্পর্কে গ্রটস্কি বলেছেন যে, এটা হচ্ছে একটা গাড়িকে শামুকের গতিবেগে চলার কারণে দোষারোপ করার মতো একটা অভিযোগ। ডিজাইনাররা অভিনেতা নির্দেশকদের ওপর যতটা না প্রাধান্য বিস্তার করে তারচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে মঞ্চের সাজ সজ্জায়। ডিজাইনারের লক্ষ্যটা গৎবাঁধা নয়, সৃজনশীল। গৎবাঁধা হলে একে একটা গভীর, অসীম অনুবীক্ষণ প্রক্রিয়ায় এনে সৃষ্টিশীল করতে হবে। গ্রটস্কি এক্ষেত্রে দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে, থিয়েটার হলো একটা রূপান্তর- ডিজাইনাররা তা স্বীকার করুক বা না করুক। থিয়েটার হলো জীবন্ত মানুষদের মাধ্যমে নিশ্চল, নির্বাক একটা উপস্থাপনা, থিয়েটার হলো একটা মুমেন্টাল থ্রিলিং।

গ্রটস্কি প্রশ্ন তুলেছেন যে, শেষ পর্যন্ত প্রযোজকদের কাছে থিয়েটারটা কী? তাঁর মতে, প্রযোজকরা অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে থিয়েটারে আসে। তারা একসময় নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন দেখতো যা প্রযোজনায় গিয়ে ঠেকে। অভিনেতা হিসেবে যে ব্যর্থ বা অভিনেত্রী যে একসময় যৌবনে প্রিমাডোনা ছিলো কিন্তু এখন সে বার্ধক্যে। মূলত এই সব কিছুই প্রযোজককে নাটক প্রস্তুত বা থিয়েটারে নিয়ে আসে। এটা আসলে তাদেরকে পৌরুষহীন জটিলতার দিকেই নিয়ে যায়। তারা আসলে প্রযোজনার কিছুই করতে পারে না।

সাহিত্যের নাক উঁচু অধ্যাপক যারা একাডেমির কাজে ক্লান্ত তারাই থিয়েটারে প্রযোজনা করতে আসে। এবং এ কাজে তারা নিজেদের মনে করে যোগ্য ও যথার্থ। তারা কি জানে নাটক (Drama) কী? এবং থিয়েটারের আর কী অর্থ হতে পারে যদি না পাণ্ডুলিপির উপলব্ধি তাদের না থাকে!

প্রযোজকরা এক ধরনের মনোবিশ্লেষণাত্মক উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত। তাদের কাজটা হচ্ছে বিচিত্র উপসর্গের উপশম করা। যেমন একজন মানুষ, রাজনীতিতে যার অতৃপ্তি রয়েছে। কিন্তু থিয়েটার প্রযোজনায় সেই মানুষটি এক ধরনের ক্ষমতা চর্চার স্বাদ অনুভব করতে পারে। এটা প্রযোজককে একাধিক ভুল ও অপব্যাখ্যার দিকে নিয়ে যায়। সত্যিই প্রযোজকদের চরম ক্ষমতালিপ্সা থাকে। যে কারণে তারা ক্ষমতার বশে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তথাকথিত বিপ্লবী ধারার নাটক মঞ্চস্থ করে। অবশ্যই এ কাজে প্রযোজক সৃজনশীল হতে চায়। সে কারণে তারা কম-বেশি সচেতনভাবে স্বায়ত্তশাসিত থিয়েটারের কথা বলে। স্বাধীন সাহিত্যকে প্রযোজক বিবেচনা করে প্রিটেক্সট (Pre-text) বা পূর্ব পাণ্ডুলিপি হিসেবে। কিন্তু এভাবে সৃজনশীল কাজ করাটা বিরল। অনেকেই একথা বলে তৃপ্ত হয় যে, থিয়েটার হলো সাহিত্যমূলক বা বৌদ্ধিক বা ওয়েগনারের তত্ত্ব মতে- বিচিত্র শিল্পের সংশ্লেষিত রূপ (Theatre is a total art - Wegner)। প্রকৃতপক্ষে এটা এক আশ্চর্যজনক সূত্র বা সমীকরণ। থিয়েটারের এই সূত্র পাণ্ডুলিপিকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে শ্রদ্ধা করতে শেখায় শুধু। এই সূত্র মতে, পাণ্ডুলিপি থিয়েটারের এক অলঙ্ঘনীয় উপাদান। আর এই সূত্র সাহিত্যমূলক থিয়েটার ও থিয়েটারের ভাষার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরিতে প্ররোচিত করে না। এইভাবে গ্রটস্কি থিয়েটার প্রযোজনা সম্পর্কে বিশ্লেষণী মতামত দিতে দিতে বলেন যে, একই কথা থিয়েটারের সঙ্গীত সম্পর্কেও প্রযোজ্য। এটা মৌলিক কোনো কাজ না, মন্তাজ (Montage) বা যৌগিক। গ্রটস্কি এই বক্তব্যকে আরো সম্প্রসারিত করে বলেছেন যে, এক ধরনের আকস্মিক পছন্দসই নানা উপাদানের সহযোগিতায় থিয়েটার কল্পনা করা হয় এবং এভাবেই প্রযোজকের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন ঘটে।

এইভাবে থিয়েটারের অসংখ্য সংজ্ঞা দেয়া যেতে পারে বলে গ্রটস্কি মনে করেন। তাঁর মতে এই প্রচলিত, গণ্ডিবদ্ধ কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। থিয়েটারের মধ্যে যে যোগ করবে না বরং অপসারণ (Eliminate not add) করবে। আত্মতাড়িত গ্রটস্কি বলেছেন, নিজেই আমরা নিজেকে জিজ্ঞাসা করবো যে, কোনগুলো ছাড়া থিয়েটার হয় না। কোন উপাদান ছাড়া থিয়েটার হয় না- এধরনের অনুসন্ধানে ব্রত হয়ে গ্রটস্কি কিছু প্রশ্ন জড়ো করেছেন এবং নিজেই উত্তর দিয়েছেন। যেমন : পোশাক এবং সেট ছাড়া কি থিয়েটারের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়? হ্যাঁ, পারা যায়।

প্লটের জন্য সঙ্গীত ছাড়াই কি থিয়েটার হতে পারে?

হ্যাঁ, পারে।

আলোকসজ্জা ছাড়া কি থিয়েটার হয়?

হ্যাঁ, অবশ্যই হয়।

সবশেষে একটি Text বা পাণ্ডুলিপি ছাড়া?

হ্যাঁ, সেটাও পারা যায়। থিয়েটারের ইতিহাস সেটা বলে। থিয়েটার শিল্পের বিবর্তনের ইতিহাসে পাণ্ডুলিপি এক সর্বশেষ উপাদান। গ্রটস্কি একে বিশদ করে বলেছেন যে, কতগুলো লোককে যদি কয়েকটি ঘটনা দিয়ে তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনের জন্য মঞ্চে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়, যেমন কমেডিয়া ডেল আর্তে দেখা যায়, সেক্ষেত্রে শব্দগুলো সজোর উচ্চারণ না করে শুধু বিড়বিড় করলেও একটা ভালো কিছু হবে।

কিন্তু অভিনেতা ছাড়া কি থিয়েটার কল্পনা করা যায়? এই প্রশ্নোত্তরে গ্রটস্কি বলেছেন, এ ধরনের কোনো উদাহরণ তাঁর জানা নেই। আবার, দর্শক ছাড়া কি থিয়েটারের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায়? এই পশ্নের উত্তরে গ্রটস্কি বলেছেন, মঞ্চাভিনয়ের জন্য কমপক্ষে একজন দর্শকের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিষয়টিকে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন যে, দর্শক এবং অভিনেতার মধ্যে যা কিছু ঘটে তাকেই থিয়েটার বলা যায়। আর সবকিছু সম্ভবত প্রয়োজনীয় কিন্তু অত্যাবশ্যক নয়। ধারাবাহিকভাবে প্রচলিত থিয়েটারে ব্যবহৃত সঙ্গীত, আলো, পোশাক-পরিচ্ছদ, মুখোশ, সেট ও সাজ-সরঞ্জামের মতো উপাদানগুলোর ব্যবহারে আকস্মিকভাবে থিয়েটার ল্যাবরেটরির সমৃদ্ধি ঘটে না। এ হচ্ছে নিরাভরণ ও চাকচিক্যহীন এক থিয়েটার, যা একজন দর্শক ও অভিনেতা ছাড়া আর সব কিছুই বর্জন করে। মঞ্চের প্লাস্টিক উপাদানগুলো অভিনেতার শরীর মাধ্যমে এবং শব্দ ও সঙ্গীতও অভিনেতার কণ্ঠস্বরের মাধ্যমেই এই থিয়েটার ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়। এই প্রসঙ্গে যেকোনো প্রকার সংশয়ের ঊর্ধে উঠে গ্রটস্কি বলেছেন, এর মানে এই নয় যে, এই থিয়েটার সাহিত্যের দিকে ফিরে তাকায়। গ্রটস্কি মনে করেন না যে, থিয়েটারের প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের মধ্যে সৃজনশীল কোনো কিছু থাকে। তাঁর থিয়েটার শুধু দর্শক এবং অভিনেতার দ্বারা গঠিত হয়। আর এই উভয়পক্ষের ওপরই গ্রটস্কির থিয়েটার নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে গ্রটস্কি দর্শককে পদ্ধতিগতভাবে প্রশিক্ষিত করে না তুলতে পারলেও অভিনেতাকে পেরেছেন।

আসলে গ্রটস্কির থিয়েটার ল্যাবরেটরিতে অভিনেতারা কীভাবে প্রশিক্ষিত হয় এবং অভিনয়ের ক্ষেত্রে তাদের কাজটা কী? গ্রটস্কি তাঁর এই কাজ সম্পর্কে বলেছেন যে, শরীরের অনেক গোপনীয়তা রক্ষা করে অভিনয় করতে সবাই পারে। কিন্তু একজন প্রকৃত অভিনেতা শরীরকে নিয়ন্ত্রণযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন। যে শরীর দিয়ে আধ্যাত্মিক ক্রিয়া করা সম্ভব। অভিনেতার এই আধ্যাত্মিকতা যদি টাকার জন্য কিংবা একান্তই দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য ব্যবহার করা হয়- গ্রটস্কির মতে তাহলে সেটা হবে নিছক বেশ্যাবৃত্তি। এ প্রসঙ্গে তাঁর মতে শত শত বছর ধরে কোনো না কোনোভাবে থিয়েটার বেশ্যাবৃত্তির মতোই ব্যবহৃত হচ্ছে। অপরপক্ষে, একজন পাপী যেভাবে একজন সাধকে পরিণত হয় ঠিক সেভাবেই একজন অভিনেতাও তার দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা থেকে এক পবিত্র, শক্তিশালী স্তরে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে পারে।

গ্রটস্কি একজন অবিশ্বাসী হয়েও পবিত্র অভিনেতার কথা বলেছেন। গ্রটস্কি বর্ণিত এই পবিত্রতা হলো মুক্তি ও প্রগতির পবিত্রতা। এই পবিত্রতা আসলে অভিনেতার প্রশিক্ষণ-পদ্ধতির নির্যাসের নামকরণ। এই প্রক্রিয়ায় অভিনেতা নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে, নিঃশেষ করে নিজেকে খাঁটি করে তোলে। এটা হলো একটা সাধনপ্রণালী যার মাধ্যমে অভিনেতার মনস্তাত্ত্বিক সকল বাধা দূরীভূত হয়। এই আত্মদগ্ধতার প্রক্রিয়ায় অভিনেতা নিজের প্রাত্যহিক পার্থিব প্রবৃত্তির উন্মোচন করে যেটা বিপরীতে দর্শকের মধ্যেও সঞ্চায়িত হয়। গ্রটস্কির থিয়েটার ল্যাবরেটরি প্রকৃতপক্ষে অভিনেতার মধ্যে জেগে থাকা এক অলৌকিক উদ্দীপনার শিরোনাম। মঞ্চে একজন পবিত্র অভিনেতা উদ্দীপিত হলেই বলা যায় যে, সে শরীর দেখাচ্ছে না নিজেকে উৎসর্গ করছে।

পবিত্র অভিনেতা (Holy Actor) বা নিবেদিত অভিনেতার মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছে বলে গ্রটস্কি উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- আত্মখনন, আত্মোন্মোচন ও আত্মোৎসর্গীকরণ।

এই উপাদানত্রয়ী অভিনেতাকে পৃথিবীর সাধারণ ও বহুল ব্যবহৃত কোনো জায়গার পরিবর্তে মানুষের স্বপ্ন ও বাস্তবতার এক বিশেষ সীমান্তরেখায় নিয়ে যায়। একজন কবির শব্দ বা ভাষা নির্মাণের মতোই একজন অভিনেতাকেও ধ্বনি ও শরীরভঙ্গির মাধ্যমে নিজস্ব মনোবিশ্লেষণাত্মক ভাষা তৈরি করতে পারতে হবে। গ্রটস্কির পবিত্র অভিনেতার গন্তব্য থিয়েটারের এই ভাষা নির্মাণের শেষতম বিন্দুর দিকে। গ্রটস্কির পবিত্র অভিনেতা এই থিয়েটার ভাষার শেষ বিন্দুতে এসে শরীরের উপর এক অলৌকিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। যেখানে অভিনেতার শব্দ, শরীর ও চিন্তা একটি সরলরেখার একই প্রকাশবিন্দুতে অবস্থান করে।

জর্জি গ্রটস্কির থিয়েটার ল্যাবরেটরি প্রকৃতপক্ষে এক দুঃসাধ্য কিন্তু সম্ভবপর থিয়েটারেরই সমার্থক। এক্ষেত্রে অভিনেতাই সবকিছু। প্রকৃতপক্ষে একজন পবিত্র অভিনেতা নিজের ভষ্মের মধ্যে ফিনিক্স পাখির মতোই উত্থিত হয়।

তথ্যসূত্র: Towerds a Poor Theatre : Jerzy Grotowski_ Methuen Ltd. London 1975

ইস্রাফিল শাহীন : নাট্যনির্দেশক। সহকারী অধ্যাপক, নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।