Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

পৌরাণিক নাটক

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

বাহিরের নাটক না পাইয়া রঙ্গাধ্যক্ষেরা স্বয়ং নাটক লিখিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। এ স্থলে রঙ্গাধ্যক্ষ রচিত নাটকের কতকগুলো প্রতিবাদী আছেন। তাঁহারা বলেন যে, বঙ্কিমবাবুর নভেল নাটকাকারে পরিণত হইয়া কতকটা নাটক হয়। দীনবন্ধুবাবুর নাটক কতকটা নাটক ছিল। তারপর পৌরাণিক গীত সম্মিলিত নাটক উদ্ভব হইয়া নাটকের দফা রফা হইতেছে। নাটকের কথা কহিতে হইলেই, এই সকল নাটকবিদ লোকেরা বিদেশীয় নাটক লইয়া তুলনা করেন। ইঁহাদের মধ্যে অধিকাংশ লোকেই বিদেশীয় নাট্যকারের ভিতর সেক্সপীয়ারের নাম জানেন। সেক্সপীয়ারের নাটক কি ও সে সকল নাটক কি ভাবাপন্ন, তাহার পরিচয় যদি এই সমালোচকদের দিতে হয়, তাহাতে অনেককেই ভাবিতে হইবে- শেক্সপীয়ারের নাম তুলিয়া কি সর্ব্বনাশই করিয়াছি; সেক্সপীয়ারের নাটক পড়ি নাই, তাঁহার নাটক কি ভাবাপন্ন, কিরূপে জানিব! এ সম্প্রদায়ের কথা এই পর্য্যন্ত। কৃতবিদ্য সম্প্রদায়ও আছেন, তাঁহারা পরীক্ষার খাতিরে Gervinus, Schiller, Goethe প্রভৃতির  নানা ভাষার নাটক সমালোচনা পড়িয়াছেন; কিন্তু সেই Schiller, Goethe- কৃত নাটকের উদার সমালোচনাতেও বুঝিতে বাকি আছে কি, যে, জাতীয় উচ্চ নাটক- জাতীয় হৃদয়ে সম্পূর্ণ অধিকার যাহার আছে- তিনিই লিখিতে সক্ষম হইয়াছেন। ইংরাজের শ্রেষ্ঠ নাটককার, যদি তিনি Schiller, Goethe হইয়া জর্ম্মাণ ভাষায় সেই সকল নাটক লিখিতেন, তিনি জর্ম্মাণ হৃদয়ে স্থান পাইতেন না, যথা Joan of Arc ইঁহাদের দ্বারায় সেক্সপীয়ারের উচ্চ প্রশংসা সত্বেও, জর্ম্মাণ তাহাদের নাটককার সিলারকেই উচ্চতর পদ প্রদান করেন; সিলারের কৃত ঔড়ধহ ড়ভ অৎপ দেখাইয়া বলেন যে, সেক্সপীয়ার পৃথিবীতে বিচরণ করেন অর্থাৎ পার্থিব স্থূলভাব লইয়া তাঁহার নাটক রচনা; উচ্চ প্রতিভার চালনায় পার্থিব স্থূলভাব হইতে যখন তিনি উড্ডীয়মান হইবার চেষ্টা পান, পার্থিব স্থূল আকর্ষণে ধড়াস করিয়া (comes down with a thud) পৃথিবীতে পড়িয়া যান। কিন্তু সিলার, যিশু-জননী কুমারী মেরীকে লইয়া মায়িক প্রেম অতিক্রমপূর্ব্বক মহাপ্রেমের কথা কহেন। সেই মহাপ্রেমে স্বদেশহিতকর প্রভা ও তাহার অভাবে পতন- Joan of Arc- এ সিলার অদ্ভুত প্রতিমা চিত্রিত করিয়াছেন। ব্যবসায়ী ইংরাজ, ভাবের প্রশংসা করিয়া সিলারের অনুবাদ করিয়াছিল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমালোকেরা জর্ম্মাণকে হিন্দুদিগের ন্যায় অপার্থিব স্বপ্নাচ্ছন্ন বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। ১৮৭০ খৃন্টাব্দে যখন ফরাসির সহিত জর্ম্মাণির যুদ্ধ সূচনা হয়, সমস্ত বিদেশিয় রাজনৈতিজ্ঞ ব্যক্তি ও যুদ্ধবিদ সৈন্যধ্যক্ষেরা স্বপ্নাচ্ছন্ন জর্ম্মাণিকে সংসার বিব্রত ফরাসি জয় করিবে স্থির সিদ্ধান্ত করেন। সম্ভবতঃ সমরাঙ্গণ প্রসিয়াই হইবে ভাবিয়া, সংবাদপত্রের সম্পাদকেরা বার্লিন অবধি মানচিত্র তাহার পাঠকদিগকে দেন। তাঁহাদের নিশ্চই ধারণা, বার্লিন অবধি ফরাসি সৈন্য যাইয়া সমর অবসান হইবে। কিন্তু ফল সম্পূর্ণ বিপরীত হইল। দুই একটি যুদ্ধের পর মানচিত্র পরিবর্ত্তিত করিবার নিমিত্ত সম্পাদকেরা ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। ফরাসি সৈন্য বীরবর নেপোলিয়নের (Nepoleon the Great) রাজ্যপিপাসোন্মাত্ত, কিন্তু বিসমার্ক চালিত প্রসিয়া সৈন্য পিতৃস্থান (Faderland) অর্জ্জন করিব এই স্বপ্নাচ্ছন্ন। এই স্বপ্নাচ্ছন্ন বিসমার্ক চালিত নিডল গণধারী প্রসিয়ার প্রভাব জগৎ দেখিল। এই স্বপ্নাচ্ছন্ন বিসমার্ক স্বপ্নাচ্ছন্ন প্রাসিয়ান কবি দীক্ষিত। জর্ম্মণির কবিতা পাঠে, রাজনীতি পাঠে, সামান্য ব্যক্তির সহিত সামান্য কথার ছলায় বিদেশী বুঝিবেন যে, জর্ম্মাণির স্বপ্নাচ্ছন্ন Faderland- স্বপ্নাচ্ছন্ন কবিকৃত উত্তেজিত। এই স্বপ্নাচ্ছন্ন জাতি, সাংসারিক বিরত্বে অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স প্রভৃতি পার্থিব বাসনা চালিত মহাবলবানজাতিকে তৃণবৎ ভস্মসাৎ করিয়াছে। কবিত্ব এই প্রকার জাতীয় বৃত্তির উত্তেজক। Faderland স্বপ্ন জর্ম্মাণির হৃদয়ে ছিল; কবির মনোহারিণী রচনায় তাহা বিকাশ পাইল।

Faderland শব্দে মাতৃভূমি বলিয়া যেরূপ পার্থিব বাসনা চালিত জাতি স্বদেশবৎসল হন, তাহা নয়। Faderland অর্থ যেখানে জর্ম্মাাণ আছে, পূর্ব্বপুরুষের ধর্ম্ম যেখানে চলিতেছে, সেই আত্মীয়; যেমন হিন্দুর আত্মীয় যেখানে হিন্দু আছে; নানা স্থানে বাস করিয়া নানা ভাষায় কথা কহিয়াও যেমন ইহুদীর এক ধর্ম্ম; সেইরূপ জর্ম্মাণের Faderland ভাব। ধর্ম্মাভাব, পার্থিবভাব নহে। এই ভাবাপন্ন হইয়া জর্ম্মাণি রুষিয়ার সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত ছিল। মনোগত বাসনা- রুষিয়ার বক্ষ হইতে পোল্যান্ডকে ছিন্ন করিয়া লইবে Faderland, Faderland স্বপ্নাচ্ছন্ন ভঙ্গ-স্বপ্ন পোল্যান্ডবাসীকে পৈতৃক স্বপ্ন আচ্ছন্ন করিবে।

জাতীয় বৃত্তি পরিচালনা ব্যতীত কবিতা বা নাটক জাতির হিতকর হয় না। ভারতবর্ষের জাতীয় মর্ম্ম- ধর্ম্ম। দেশহিতৈষিতা প্রভৃতি যত প্রকার কথা আছে, তাহাতে কেহ ভারতের মর্ম্ম ম্পর্শ করিতে পারিবেন না। ভারত ধার্ম্মিক। যাহারা লাঙ্গল ধরিয়া চৈত্রের রৌদ্রে হল সঞ্চালন করিতেছে, তাহারাও কৃষ্ণনাম জানে, তাহাদেরও মন কৃষ্ণনামে আকৃষ্ট। যদি নাটক সার্ব্বজনিক হওয়া প্রয়োজন হয়, কৃষ্ণনামেই হইবে। ইংরেজী ভানে, বিদেশীয় ভানে যাহারা সেই ভান করেন (তাঁহারা সেই ভানের মর্ম্ম বোঝেন না) সেই ভানে জাতীয় উন্নতি কখনও হইবে না। জাতীয় হৃদয়ের উপর উন্নতির ভিত্তি। সেই ভিত্তি কতদূর প্রগাঢ়, তাহা ইতিহাস পাঠে সম্পূর্ণ উপলব্ধি হইবে। হিন্দু ধর্ম্মের উপর বহু বিরূপ প্রবাহ বহিয়াছে। কোন কোন মুসলমান রাজার সংকল্পই ছিল, কাফের দূর করিবে। দিগি¦কব্যাপী বৌদ্ধধর্ম্ম হিন্দুস্থানে রহিয়াছে, তবু আজও আবাসস্থানের নাম হিন্দুস্থান। হিন্দুধর্ম্মমূল হিন্দু হৃদয়, হিন্দু ধর্ম্ম এতই বিজড়িত করিয়া রাখিয়াছে। অবস্থাগত প্রভাবে রাজ্য চূর্ণবিচূর্ণ হইয়াছে, অথচ হিন্দু হৃদয়ে হিন্দুধর্ম্মের সমান আরাধনা। যাঁহারা নাটক হয় না বলেন, তাঁহারা বলেন এই যে, কে কোথায় কাকে মারিল, কে কোথায় কাকে কাটিল, নাটকে ইহার বর্ণনা হউক। কোথায় কি সভা স্থাপনা হইল, কোথায় কি বক্তৃতা হইল, তাহা লইয়া নাটক হউক; শক্তিমান পুরুষেরা একবার নাটক লিখিয়া দেখুন, কতদূর তাহাতে কৃতকার্য্য হন; কদাচ হইবেন না। সকলেই জানেন, ফরাসি বড় প্রফুল্ল জাতি, কিন্তু তাহাদের নাটক পাঠে দেখিবেন যে, নিষ্ঠুরতাপূর্ণ বিপ্লবে (Revolution) গঠিত ফরাসি হৃদয় কঠোর নিষ্ঠুরতাপূর্ণ নাটক ভালোবাসে। অনুবাদে আমরা বুঝি যে, নিষ্ঠুর Spain এ-ও সেইরূপ। ষাঁড়ের নিষ্ঠুর যুদ্ধ (Bull-fight) স্পেনের আমোদ; হাস্যোদ্দীপক, স্ফূর্ত্তিদায়ক মিলনান্ত নাটক স্পেনের বিশেষ প্রিয় হইবে না। ‘ডনকুইকসট’- লোকে বলে যাহার তুল্য হাস্যোদ্দীপক রচনা আর নাই - তাহার হাস্যও মানবপীড়নে উদ্দীপিত হয়।

হিন্দুস্থানের মর্ম্মে মর্ম্মে ধর্ম। মর্ম্মাশ্রয় করিয়া নাটক লিখিতে হইলে ধর্ম্মাশ্রয় করিতে হইবে। এই মর্ম্মাশ্রিত ধর্ম্ম, বিদেশীর ভীষণ তরবারি ধারে উচ্ছেদ হয় নাই। আকবরের রাজনৈতিক প্রভাবেও সমভাবে আছে। সমালোচকেরাও কে কাকে কাটিল, কে কাকে মারিল, এইরূপ রচনা দ্বারা মর্ম্মাশ্রিত ধর্ম্ম উচ্ছেদ করিতে পারিবেন না।

তাহার পর মারা-কাটা লইয়া এমন কি নাটক লিখিবেন, যাহা ব্যাস রচিত ভারতে নাই? এখনও পাঁচ-সাতটা সেক্সপীয়ারকে আসিয়া শিখিতে হইবে, ব্যাস রচিত ভারতে কি কি ভাব আছে। ম্যাকবেথ, হ্যামলেট, ওথেলো, লীয়ার প্রভৃতি সেক্সপীয়ার রচিত উচ্চশ্রেণীর নাটক। এ সকল কঠোর নাটকেও পিত্রাদেশে মাতার মস্তকচ্ছেদন নাই, গর্ভস্থ শিশুবধ নাই এবং কোন জাতীয় কোন নাটক বা কবিতা সুপ্ত শিশুহন্তা অশ্বত্থামারও মার্জ্জনা নাই। এই বিশাল ভাবাপন্ন কার্য্যক্ষেত্র হইতে উদ্ধৃত নাটকের যিনি ঘৃণা করেন, তাঁহার বিরুদ্ধে এই মাত্র বলা যায় যে, তিনি কি বলিতেছেন, তাহা তিনি জানেন না।

যত জাতির যত উচ্চ গ্রন্থ আছে, সকলই Mythological অর্থাৎ পৌরাণিক গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত। পৌরাণিক গ্রন্থ অবলম্বনে হোমার; পৌরাণিক গ্রন্থ অবলম্বনে ভার্জ্জিল; খৃষ্টীয় পুরাণ অবলম্বনে মিলটন; পৌরাণিক গ্রন্থ অবলম্বনে বাঙ্গালায় মাইকেল। যিনি পৌরাণিক গ্রন্থের বল জানেন না, তিনি কাগজ, কলম ও ছাপাইবার খরচ লইয়া সমালোচনা করেন। মনুষ্য জীবনের দায়িত্ব তিনি বুঝেন নাই।

আগে বলিয়াছি যাঁহারা Mythological অর্থাৎ পৌরাণিক বলিয়া ঘৃণা করেন, কেবলমাত্র তাঁহারা জানেন যে, পুরাণে যাহা আছে, তাহা কোন জাতীয় কবি কল্পনায় অদ্যপি সৃষ্টি হয় নাই। ‘রাম’ কল্পনা দেখিয়া, যিনি নাটকের ঘৃণা করেন, তাঁহাকে সকলের জন্য জানা একটি গল্প বলিব! কুম্ভকর্ণ রাবণকে বলিল, ‘যদি তোমার সীতায় অভিলাষ ছিল, রাক্ষসীমায়া প্রভাবে কেন রামরূপ ধরিলে না?’ রাবণ উত্তর করিল,-‘আমি চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু রামরূপ ধরিতে গেলে রামরূপ ভাবিতে হয়, সেই ভাবনায় ‘তুচ্ছং ব্রক্ষ্মপদং পর-বধুসঙ্গ-প্রসঙ্গ কুতঃ’- অরে মূঢ়, রাম-ভাবনায় কি পরবধূর সঙ্গ ইচ্ছা থাকে?’ বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ কবি মাইকেল, ‘মেঘনাদে’ কবিগুরু বলিয়া বাল্মীকিকে নমস্কার করিয়াছেন। বলিয়াছেন,- ‘রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে’।

আমরা বলিয়াছি যে, কোন ভাষায় কোন উচ্চ গ্রন্থ পৌরাণিক বিষয় অবলম্বন ব্যতীত হয় নাই। মেরী কোরেলী আধুনিক, যাঁহার পুস্তক পাদরী বিদ্বেষী হইয়াও এক সংস্করণে দেড় লাখ বিক্রয় হয়,- খৃষ্টীয় পুরাণ, বাইবেল তাহার ভিত্তি। পৌরাণিক নাটক ভাল মন্দ হয় বা না হয়, এ কথার সমালোচনা হইতে পারে, কিন্তু পৌরাণিক নাটক যে উচ্চ শ্রেণীর নাটক হয় না, ইহা যিনি বলিতে চান, তাঁহার তুলনা তাঁহাতেই থাকুক।

নাটক লিখিতে হইলে- কতকগুলি চরিত্র লইয়া নাটক লিখিতে হয়। ঐতিহাসিক চিত্র যে সমালোচকেরা কতদূর জানেন, তাহা সেই সমালোচকেরাই বিদিত, আমরা আর কি পরিচয় দিব। ঐতিহাসিক নাটক দুই একখানি হইয়াছে; কৃতবিদ্য অনেক লোক  তাহার প্রশংসাও করিয়াছেন, কিন্তু সমালোচকেরা সে স্থানে নিস্তব্ধ ছিলেন। তাঁহারা নিরীহ, ইতিহাস বলিয়া একটা কথা আছে জানেন, তাহার ত কোন ধার ধারেন না; সুতরাং নিস্তব্ধ ছিলেন। আবার ঐতিহাসিক নাটক হইলেও সেইরূপ নিস্তব্ধ থাকিবেন। ইতিহাসবিদ কয়েকজন সকল মর্ম্ম বুঝিবেন, কিন্তু তাহাতে নাট্যকারের ব্যবসা চলিবে না।

কিন্তু না চলুক, যদি চরিত্র পাওয়া যাইত, যাহা পুরাণে নাই, তাহা হইলেও কথা ছিল। ঐতিহাসিক নাটক সমস্তই স্থানীয়। Shakespeare এর ঐতিহাসিক নাটক স্থানীয়। তাহার অপর জাতীয় অনুবাদ নাই। স্থানীয় প্রসঙ্গ স্থানেই চলিয়াছে। স্থানীয় সকলে সে কথা জানে বলিয়া চলিয়াছে। `War of the Roses’ ইংলন্ডের ঘরে ঘরে জানে, তাই সেই ঐতিহাসিক নাটক চলিয়াছে। কেবল ঐ সকল ঐতিহাসিক নাটক লিখিয়া শেক্সপীয়ার- শেক্সপীয়ার হইতেন না। আমরা একজামিনের খাতিরে ইংলন্ডের ইতিহাস পড়িয়াছি; সেই জন্য দুই একজনেরও রাজা-রাণীর বক্তৃতা ভাল লাগে, নচেৎ ভাল লাগিত না।
 
তারপর সামাজিক। দোষ-গুণ লইয়া নাটক রচিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাঙ্গালার গুণ দূরে থাকুক, বড় রকমের একটা দোষও নাই। দোষের ভিতর বড় জোর নাবালককে ঠকাইয়াছে, কেহ মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়াছে, কৌনসুলীর জেরাতে হটে নাই, গৃহে অস্ত্রহীন হইয়া দুই একজন পাইক ছিল, তাহাদের মারিয়া ডাকাইতি হইয়াছে, এই মাত্র দোষের চিত্র। লাম্পট্য দোষের বিবরণ,- দুই একটা বেশ্যা রাখিয়াছে, কেহ বা পরিবারস্থ থাকিয়া কুলাঙ্গানাকে বাহির করিয়াছে; কেহ বা পড়শীর কুলাঙ্গনা বাহির করিতে সক্ষম হইয়াছে। গুণের কথা,- বড় জোর কেহ পিতৃশ্রাদ্ধে কাঙ্গালী ভোজন করাইয়াছিল; রাস্তা নির্ম্মাণের জন্য টাইটেল আশে রাজাকে চাঁদা দিয়াছে। পৌরাণিক চরিত্র ত্যাগে এই সকল চরিত্র লইয়া নাটক লিখিতে বলেন। যাঁহারা বাঙ্গালায় বড় বড় চরিত্র- তাঁহারা ‘পলিসিবাজ’। স্বয়ং গোপনে থাকিয়া একজন ১৫ মাহিয়ানার প্রিন্টারকে খাড়া করিয়া মানহানির কয়েদ খাটা তাহার উপর দিয়া, কোন এক ম্যাজিষ্ট্রেটের অত্যাচার বর্ণনাপূর্ব্বক প্রবন্ধ লেখেন। এই সকল উচ্চ চরিত্র; অদ্যাবধি রাজদ্বারে সত্য কথা বলিতে কেহ সক্ষম হন নাই। যাহারা কাগজে লিখিয়াছেন, তাহারা থুতু খাইয়া মার্জ্জনা চাহিয়া দন্ড হইতে রক্ষা পাইবার চেষ্টা পাইয়াছেন। সামাজিক নাটকে ত এই সকল চরিত্র উঠিবে?

যাঁহারা পৌরাণিক নাটকের বিরোধী, তাঁহারা বুঝিতে পারিবেন যে, পৌরাণিক চরিত্র কিছুই তাঁহারা উপলব্ধি করেন নাই। যদি দেখিতেন ও বুঝিতে পারিতেন,- ব্যাস বাল্মীকি রচিত উচ্চ বা নীচ চরিত্রের বাঙ্গালায় অদ্যাবধি তুলনা হইবার সম্ভাবনা নাই, অপর কোন দেশে হইলেও হইতে পারে;- তিনি এই সকল চরিত্র নাটকে লিখিতে বলিবার আর প্রয়াস করিবেন না।

তারপর থিয়েটারে গান হয়। মাইকেল মধুসূদন কৃষ্ণকুমারী’তে আক্ষেপ করিয়াছেন যে, বালক দ্বারা স্ত্রী চরিত্র অভিনয় হয়, বালকের গায়ক হইবার সম্ভাবনা নাই, সেই জন্য কৃষ্ণকুমারী’র গান সব নেপথ্যে। ভিন্ন ভিন্ন নাটক অনেক তিনি দেখিয়াছিলেন। অনেক ভাষাই তিনি জানিতেন। তথাপি তিনি বাঙ্গালা ভাষার মধুরতার পক্ষপাতী ছিলেন এবং গানের একান্ত অনুগত। প্রকাশ্যে কৃষ্ণকুমারী’তে নটকে সম্বোধন করিয়া সে কথা বলিয়াছেন।

বিদেশীয়েরা অনেক বিষয়ে উন্নতি সাধন করিয়াছে; তথাপি কঠোর বৈজ্ঞানিক ফাদার লাফোঁর যিনি বক্তৃতা শুনিয়াছেন, তিনি শিখিয়াছেন যে, হিন্দু সঙ্গীতে যেরূপ মাধুরী আছে, তাহা আর কুত্রাপি নাই। ফাদার লাফোঁ দোষ ধরেন যে, হিন্দু সঙ্গীতে বড়ই মাধুরী, খালি মিষ্টি, একটু নিমকি নাই। ফাদার লাফোঁ চারি সঙ্গীতবিদের ঐকতানিক ধ্রুপদ সঙ্গীত শুনেন নাই। অস্থায়ী, অন্তরা, আভক ও সঞ্চার চারিজনে গীত হইলে তবে ধ্রুপদ গান হয়। তাঁহার কারণ এই,- যে গলায় অস্থায়ী গীত হইবে, সে গলায় অন্তরা ঠিক গীত হইবে না। যেমন ক্লেরিওনেটে  যে স্বর বহির্গত হয়, বেহালায় সেরূপ হয় না, তেমনি অস্থায়ী গাওনার গলায় অন্তরা হয় না। আভক, সঞ্চারও সেইরূপ ভিন্ন ভিন্ন গলায় গীত হওয়া উচিত। যিনি এই চারি গলায় অস্থায়ী, অন্তরা, আভক, সঞ্চার মেঘধ্বনি-গঞ্জিত মৃদঙ্গ সঙ্গীত ধ্রুপদ শুনিয়াছেন, তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পক্ষপাতী হইলেও বুঝিবেন যে, ধ্রুপদ (Vocal concert) মিলিত গলার গানের একটি অদ্ভূত সৃষ্টি। মিলিত গলার গানের অর্থাৎ ধ্রুপদ (Vocal concert) এর গানের নমুনা সকলেই শুনিয়াছেন। বাড়ীতে ভিক্ষুক আসিয়া গান করে, কতকটা একজন বালক গায়, কতকটা ভারী গলায় থাকে। আমরা একবার বৈষ্ণব ভিখারির গান শুনিয়াছিলাম, ‘কোথা তোর সই সখা, সেই বিশাখা, কোথায় রে তোর রাইকিশোরী’- বালক গাহিল; বেহালা বাজাইতে বাজাইতে বয়স্ক ভিখারী গাহিল, ‘কোথা তোর শিখিপুচ্ছ গুঞ্জমালা কোথায় রে হাতের বাঁশরী’। দু’জনে গাহিল, ‘কার ভাবে নোদেয় এস কাঙ্গাল বেশে গৌর হয়ে বলছ হরি’। আমরা এই অপূর্ব সঙ্গীত শুনিয়াছিলাম। যদি কেহ শুনিয়া থাকেন, তিনি আমাদের সহানুভূতি করিবেন।

আমাদের সমালোচকেরা বাঙ্গালা নাটক হইতে গান পরিত্যাগ করিতে বলেন; বোঝেন না- অপর ভাষায় গানে নাটক উপযোগী হৃদয়-ভাব ব্যক্ত করিবার শক্তির অভাব। সেই নিমিত্ত যে সকল ভাষার আদর্শ দিয়া বাঙ্গালা নাটকে গান থাকিলে বিরক্তি প্রকাশ করেন, তাঁহারা জানেন না যে, হিন্দু-সুর-রচয়িতার কতদূর হৃদয়-হারিণী প্রভাব। ইতালীর আবহাওয়া কতকটা ভারতবর্ষের মত। উচ্চ শিল্পের তথায় যত উন্নতি,- বিশেষতঃ সঙ্গীতে,- সেইরূপ অন্য কোন সভ্য প্রদেশে নাই। আবহাওয়ার সহিত হৃদয়ের ভাব পরিবর্ত্তনের সম্বন্ধে প্রবন্ধ প্রকাশের অভিলাষ রহিল। স্থানাভাবে এ প্রবন্ধ বন্ধ করিতে বাধ্য হইলাম। কিন্তু পরিশেষে কথা এই যে, মূর্খের সঙ্গে বলি রাজা স্বর্গে যান নাই- মূর্খ সমালোচকের সহিত আমরা নরকে যাইব না।

[রঙ্গালয় : ৩০ চৈত্র, ১৩০৭। ইংরেজি ১৯০১।]

গিরীশচন্দ্র ঘোষ : বাংলা রঙ্গমঞ্চের পুরোধা

[প্রবন্ধটি রথীন চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘গিরিশচন্দ্র ঘোষ : নাট্যপ্রবন্ধ সংগ্রহ’ গ্রন্থ থেকে পুনর্মূদ্রণ করা হলো-সম্পাদক]