Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আধখানা মানুষ

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আমরা সম্প্রতি এক প্রবল জঙ্গি নাটক তৈরি করে গিয়েছিলাম ডালহৌসি স্কোয়ারের প্রশস্ত রাজপথে অভিনয় করতে। নাটকটা লিখে আমার বিপ্লবী ফুসফুস বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিল। নাটকে আমি এক কৃষক বিদ্রোহের চিত্র তুলে ধরেছিলাম, এবং এ-ও দেখিয়েছিলাম বাবুদের  প্রভাব কাটিয়ে কী করে কৃষকরা বিদ্রোহের পথ ধরল। জপেনদা’র দ্বিপ্রহরিক নিদ্রা ভাঙিয়ে, দু’কাপ চা এবং এক প্যাকেট চারমিনার ঘুষ দিয়ে, তাঁকে নিয়ে গেলাম পথনাটিকার বীরত্বটা দেখাতে। নাটকটা জমেওছিল। এক ফুটপাথ মানুষ নাটক দেখে তারিফ করছিলেন। নাটক প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কৃষকরা জোতদারকে কোতল করবে করবে করছে, এমনি সময়ে প্রবল শব্দে দুটি বোমা ফাটল আমাদের ব্যূহের মধ্যে। ধোঁয়ায় অন্ধ হয়ে, বারুদের গন্ধে বার-দুয়েক ওয়াক তুলে আমি ছুটতে লাগলাম একদিকে। মনুমেন্টের কাছে এসে দেখি পেছনে ছুটে আসছেন জপেনদা’, উদভ্রান্ত তাঁর দৃষ্টি, ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল। আমরা মনুমেন্টের আড়ালে আত্মগোপন করলাম। ওদিকে ডালহৌসি স্কোয়ারে তখন খণ্ডযুদ্ধ বেধেছে, দর্শকরা মাস্তানদের সঙ্গে যুদ্ধে মেতেছেন।

কিছুক্ষণ জপেনদা’ অব্যক্ত ক্রোধে আমাকে নিরীক্ষণ করলেন। তারপর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন- আমার স্যান্ডেলজোড়া  গেল তোর জন্যে!

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম- বাহ, আমি কী করে জানব শালারা বোমা মারবে? জপেনদা’ রাগের চোটে কিছুক্ষণ নৃত্য করে বললেন- না, তুমি কচি খুকু, তুমি জানবে কীকরে! শহরের এই অবস্থা, টুঁ শব্দ করলে খুন করছে, আর তোমায় রাজভোগ খাওয়াবে! কেন, গেছলে কেন ওখানে কোমর নাচাতে?

এই অশ্লীল মন্তব্যে আমি ক্ষুণ্ন হলাম। ধরা গলায় বললাম- শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটারে বাঁধা পড়তে আমরা রাজি নই, গণনাট্য আন্দোলনকে নিয়ে যেতে হবে রাস্তার মোড়ে, জনতার মুখরিত সখ্যে।

পদীপিসির মতন কথা কইছিস কেন?- ধমকে ওঠেন জপেনদা’- শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটারে অভিনয় করলে নাটক প্রতিক্রিয়াশীল হয়, আর মুক্ত অঙ্গনে করলেই নাটক বিপ্লবী হয়ে ওঠে? কথাগুলো শোনাচ্ছে চণ্ডীমণ্ডপের বিশুখুড়োর মতন, যে ব্যাটা বড়ো থিয়েটারে ঢুকতেই ভয় পায়।

সে কথা নয়- আমি বাধা দিই- চেয়ারম্যান মাও বলেছেন, কার জন্য নাটক করছি সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। এমতাবস্থায় আমরা রাজপথে নেমে গিয়ে জনতার জন্য নাটক করতে চাই। আমার ভয় হলো জপেনদা’ আমায় চড় মারতে পারেন, তাই দু-পা পিছিয়ে গেলাম। হাতের কাছে আমায় না পেয়ে জপেনদা’ চিনেবাদাম কিনতে কিনতে বললেন- রাজপথে নেমে গিয়ে কোন জনতার জন্য আজকের নাটকটা করলি? কলকাতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কি তোর চেয়ে কম রাজনীতি শেখাতে পারে? আজকে যাদের জন্য ওই জঘন্য কদর্য থাবড়া-খাওয়ার-যোগ্য প্লে-টা করলি, তারাই তো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটারে এসে নাটক দেখেন। যাঁরা মুক্ত অঙ্গনে দেখেন, তাঁরাই রঙ্গনায় যান, তাঁরাই আসেন রবীন্দ্র সদনে, তাঁরাই শহরের পার্কে ভিড় করেন পথনাটিকা দেখতে। তাঁদের জন্য তোকে দয়া করে কষ্ট করতে হবে না। প্রাণে অত বিপ্লব জেগে থাকলে যা শ্রমিক-অঞ্চলে, যা গ্রামে, যেটা ছিল চেয়ারম্যান মাও-এর বক্তব্য। কলকাতা শহরের মধ্যেই ঘুরপাক খাব, আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থিয়েটারের চেয়ে গরম থিয়েটার ভালো এইসব ধাপ্পা দিয়ে বিপ্লবী সাজব, ওসব ফকড়েমি ছাড়, সুবিধাবাদী বেল্লিক কোথাকার! এই চা-ওলা, চা এত ঠাণ্ডা হুয়া কেন?

অতঃপর কিয়ৎকাল চা-ওলার সঙ্গে জপেনদা’র হিন্দিতে তর্ক, যদিও বোঝা যাচ্ছিল চা-ওলা মেদিনীপুরের লোক। এবং সেও পিতৃমাতৃহীন হিন্দিতে জবাব দিতে লাগল। হট্টগোল থামলে পর জপেনদা’ আমার দিকে তাকালেন খ্যাপাটে চোখে এবং চোয়াল নেড়ে নকল দাঁতের পাটি স্বস্থানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে বললেন- মাও ৎসে-তুং এর নামটা ওই পাপমুখে আনবার আগে নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন কর; জনতা বলতে মাও কী বুঝেছিলেন? শ্রমিক-কৃষক। তোরা কুঁড়ে পাতিবুর্জোয়ার দল ডালহৌসি স্কোয়ারে গিয়ে মাও-এর পথ ধরছিস, এটা মিথ্যে কথা। উপরন্তু শহরের মধ্যে এসব বিপ্লব খেলা করারই কথা ছিল না। মাও তা বলেননি। বেকুব, মূর্খ!

 আমিও এবার চটে উঠি। মানুষের শরীর তো। বলি- শহরে বিপ্লবী নাটক হবে না? মাও এমন কথা বলেছেন? বলতে পারেন?

বলতে পারেন! ভ্যাঙালেন জপেনদা’- গোরুও তো বই পেলে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। বইয়ের সঙ্গে সে সম্পর্কটাও তোদের নেই, খাদ্যখাদক সম্বন্ধও পাতাতে পারিসনি। মাও বলেন, লড়াইটা হবে গ্রামাঞ্চলে। শহরে আমরা করব আত্মরক্ষা, আক্রমণ নয়। শহরের আইনের চৌহদ্দির মধ্যে চলবে লড়াই।

কক্ষণো মাও এমন বলেননি- আমি বললাম- শত্রুর আইন মেনে চলতে হবে, একথা মাও বলতে পারেন না।

তৎক্ষণাৎ দাঁতে ড্রিল চালানো তির-কণ্ঠে জপেনদা’ বললেন- রচনাবলি চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৯৪, পার্টির ইতিহাস সম্পর্কে প্রস্তাব।

গড়ের মাঠে দাঁড়িয়ে রচনাবলির চতুর্থ খণ্ড আর কোথায় পাব? আর জপেনদা’র ক্যামেরা সদৃশ স্মৃতিশক্তির মারপ্যাঁচ আমার জানাই ছিল। তাই আর জবাব দিলাম না।

মোষের মতন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছিস কেন? গর্জে উঠলেন জপেনদা’ এবং সেই সঙ্গে চায়ের ভাড়টাকে আছড়ে  ভাঙলেন মনুমেন্টের গায়ে- আরো দশ-বিশটা প্রবন্ধের নাম করতে পারি, যেখানে মাও একই কথা বলেছেন।

পাছে উনি আবার পরিসংখ্যানে ব্যাপৃত হন, তাই আমি বলে উঠি- থাক, থাক, হয়েছে তো। এবং কেন বলেছিলেন বুঝলি তো আজ? জপেনদা’র সরোষ উক্তি- মার খেয়ে পাট হয়ে বুঝলি তো? সন্ত্রাসের রাজত্বে বেলেল্লাপনা চলে না, শহরে এসে দুটো খোঁচা মেরে কমিউনিস্ট হওয়া চলে না। নিজের ভালো বোঝো না, সংস্থা সংগঠন বোঝো না, কায়দা কৌশল বোঝো না, পিছু হঠতে শেখোনি, তোমরা আবার বড় বড় বাকতাল্লা মারো।

এই বলে জপেনদা’ দক্ষিণ দিকে হাঁটা দিলেন, আমিও পিছু নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে জপেনদা’ বলতে লাগলেন, আর যে নাটকটা দেখালি আজ ওটা কী?

ওটা নাটক- বলি আমি, জনতার সংঘবদ্ধ যুদ্ধের ছবি।

জপেনদা’ দেখলাম আবার বোঁ করে ঘুরে উত্তর দিকে হাঁটতে লাগলেন। বুঝলাম উনি পদব্রজে বালিগঞ্জ যাচ্ছেন না, উত্তেজিত পায়চারি করছেন মাত্র। বললেন- ওই সংঘবদ্ধ কথাটাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। তোর নাটকে নায়করা কোথায়? তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কোথায়? তাদের ব্যক্তিগত দোষগুণ সব কোথায় গেল?

আমি গম্ভীর হয়ে বলি- ব্যক্তিগত ইয়ের দিন গেছে। আজকের লড়াইয়ের নায়ক হচ্ছে সমষ্টিবদ্ধ জনতা। আমার নাটকে তাই সমষ্টিই হচ্ছে নায়ক, যূথবদ্ধ মেহনতি মানুষই হচ্ছে আমর সাবজেক্ট।

বাস্তব লড়াইয়ের নায়ক হচ্ছে সমষ্টি! তাই সাহিত্যের নায়কও হবে সমষ্টি?- শুধোলেন জপেনদা’, ভ্রুযুগলকে কেশসংলগ্ন করে, বাস্তবে সংঘবদ্ধ লড়ছে বলে নাটকেও বৈশিষ্ট্যহীন, ব্যক্তিহীন, অবয়বহীন একপাল লোক দেখাতে হবে? তোর মাথার ইসক্রুপগুলো টাইট আছে তো? তোর কাছে কি জীবন ও সাহিত্যে কোনো পার্থক্য নেই, বাস্তবে স্বপ্নে প্রভেদ নেই? এমন লোকদেরই তো পাগল বলে শুনেছি। রাঁচির টিকিট কেটে দেব?

এই কটুক্তি আমি গায়ে মাখলাম না, বললাম, বাস্তবের লড়াইটাকেই তো নাটকে দেখাতে হবে। তাকেই বলে বিপ্লবী বাস্তবতা।

আগ্যে না- খেঁকিয়ে উঠলেন জপেনদা’- বাস্তবের লড়াইটাকে দেখালেই নাটক হলো না। বাস্তব প্লাস আরো অনেক কিছু, তবেই ইকোয়াল টু নাটক। লেনিন পিসারেভকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, বিপ্লবীরা স্বপ্ন দেখতে শেখো। বাস্তবের সঙ্গে সেই স্বপ্নের হরগৌরী মিলন ব্যতীত নাটক হয় না, হয় প্যামফ্লেট। গোর্কির বিপ্লবী রোম্যান্টিসিজমের তত্ত্ব পড়েছিস? যাহা বাস্তবে ঘটে কেবল তাহাই নাটকের বিষয় নহে, যাহা ঘটিবে, ঘটা উচিত তাহাও বাস্তব, তাহাও নাটকের বিষয়। সম্প্রসারণ- গোর্কি একে বলেন বাস্তবের সম্প্রসারণ। এই সম্প্রসারিত বাস্তবই বিপ্লবী সাহিত্যের ভিত্তি। কিন্তু এর মধ্যে ব্যক্তিমানস আসছে কোথায়? আমার অধৈর্য প্রশ্ন- ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ভয়ভীতি দেখাবার প্রশ্ন উঠছে কেন? সমষ্টির মধ্যে ব্যক্তি লুপ্ত না হলে সংঘবদ্ধ যুদ্ধের জন্য শ্রমিক তৈরি হবে কেন, বিপ্লব হবে কেন?

জপেনদা’ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং চোখের দৃষ্টিতে সফেন হলাহল বিকীরণ করে বলেন- তুই সি.আই.এ-র এজেন্ট না তো?

আচমকা এমন কথায় আমি বিষম খেয়ে কাশছি, সেই সুযোগে জপেনদা’ হুংকার ছেড়ে বলেন- মহিষের পাল এসে বিপ্লব করে এটাতো সি.আই.এ-র কথা। বিপ্লবের জন্য উন্নতশির মানুষ লাগে না, লাগে হস্তীযূথ, পালবদ্ধ চিন্তাশক্তিহীন জানোয়ার- এসব কথা কয় সাম্রাজ্যবাদের ভাড়াটে প্রচারকরা। আর কার্ল মার্কস-এর কথা হচ্ছে বিপ্লবে ব্যক্তিত্বের প্রকৃত বিকাশ ঘটে। শ্রমিক কৃষককে পুঁজিপতিরা করে রাখে ব্যক্তিত্বহীন গোষ্ঠীবদ্ধ উৎপাদনী যন্ত্রমাত্র। তারা আধখানা হয়ে আছে। বিপ্লব তাকে এই পরিচয়হীনতা থেকে মুক্তি দেয়। জগন্নাথের রথের মতন যে সমষ্টিজীবন শ্রমিকের ব্যক্তিসত্তাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সেটাকে ধ্বংস করে শ্রমিক নূতন সমষ্টি গড়ে, সেখানে প্রত্যেকে পূর্ণ বিকশিত। তুই মাইরি জর্জ অরওয়েলের ফিরিওলা!

আমি একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। ততক্ষণে চারমিনার ধরিয়ে উকিলি কণ্ঠে জপেনদা’ বললেন, সমষ্টি দ্বিপ্রকার। এক, শোষণের সমষ্টি, তা শাসকশ্রেণী গড়ে তোলে শোষণের সুবিধার্থে; যেখানে শ্রমিক ও কৃষকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রী পিষ্ট ও চূর্ণ হয়। দুই, বিপ্লবী সমষ্টি, যেখানে শ্রমিক ও কৃষক মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, যেখানে তাদের স্বাতন্ত্র্য বিকশিত, যেখানে সমষ্টি ও ব্যষ্টির মধ্যে বিরোধ নেই, যেখানে প্রত্যেকে পরিপূর্ণ। তোদের অধিকাংশ নাটকে ওই শোষণের সমষ্টির প্রশংসা শুনি। সংঘবদ্ধ শ্রমিক বলতে তোরা শোষণের সংঘকে বড় করে তুলিস, হয়তো নিজেদের অজান্তে। তারপর আবার সাফাই গেয়ে বলিস; শ্রমিক যেহেতু সংঘবদ্ধ সেহেতু শক্তিমান। মারাত্মক প্রমাদ! যতক্ষণ শ্রমিক বর্তমানের নাটবল্টু মাত্র, সে আধখানা মানুষ মাত্র। তোরা বিপ্লবী সমষ্টির দিকে শ্রমিককে টানিস না, বর্তমান পাশবিক সমষ্টির গুণগান করে শ্রমিককে তার মধ্যেই তুষ্ট থাকতে বলিস। সুতরাং তোরা হলি মালিকের দালাল।

এ রকম গালাগাল খেতে আমার ভালো লাগল না। আমি ঈশানের মেঘাড়ম্বরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দ্রুত ঘরে ফেরার কথা বললাম।

কিন্তু জপেনদা’কে ততক্ষণে তত্ত্বে পেয়েছে। তিনি নির্বিকার চিত্তে বলে চলেন- তোরা শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস পড়িস না, বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ইতিহাসও পড়িস না। তাই বুঝিস না এ ব্যবস্থায় বঞ্চনা ও শোষণ কত দূর গেছে। তোরা জানিস না, অর্থনৈতিক রাহাজানির দাপটে শ্রমিক কৃষককে কোন পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে শয়তানরা, কীভাবে  তারা কেড়ে নিয়েছে শিক্ষাদীক্ষার অধিকার, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মানবতা। তোরা পাতিবুর্জোয়ারা ‘শ্রমিক’ বলতেই কেমন গদগদ ভাববিহ্বল গাধা হয়ে উঠিস। মাঝে আবার তোদের কৃষকে পেয়েছিল, ছাপার অক্ষরে লিখতে শুরু করেছিলি ‘কৃষকরাজ’ কায়েম করার কথা, ‘কৃষকের পায়ের কাছে বসে’ শিক্ষালাভ করার কথা। পাতিবুর্জোয়ার স্বপ্নালু চোখে শ্রমিক-কৃষককে দেখিস, শ্রমিকের চোখে দেখিস না। মাও বলেছিলেন, শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করো। তোরা সেদিকে মাড়াসনি কখনো। তোরা শ্রমিক বলতে বুঝিস শুধু সংঘবদ্ধ বিপ্লবী শক্তি। তোরা আড়াল করে রাখছিস শ্রমিকের বিধ্বস্ত ব্যক্তিসত্তা, এবং  এভাবে তোরা গোপন করে রাখছিস এই সমাজব্যবস্থার সর্র্বগ্রাসী শোষণের চেহারা। এক কথায় তোরা নাটকে শ্রমিক-কৃষকের খোশামুদি করিস, চাটুকারিতা করিস। লেনিন তোদের বলে গিয়েছিলেন, তোমরা শ্রমিককে বিপ্লবী চেতনা পৌঁছে দাও। অর্থাৎ তোরা শ্রমিকের রাজনৈতিক শিক্ষক, কিন্তু চাটুকার কি কখনো শিক্ষক হয়? তোষণ করে কি কখনো সশস্ত্র সংগ্রামের কথা শেখানো যায়? সমাজবিবর্তনের নিয়মগুলি একবার সম্যক বুঝতে পারলেই মানুষ আর সে নিয়মের অন্ধ বলি হতে রাজি হবে না, সে লড়াই করবে। কিন্তু সমাজবিবর্তনের নিয়মগুলো তোরা গোপন করে রাখিস। তোরাতো শ্রমিকের ধর্ষিত ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে মুখ খুলতেই রাজি নস। তোরাতো বর্তমানের সর্ববিধ্বংসী সমষ্টিজীবনের লীলা দেখে ফিঙে পাখির মতন আনন্দে নাচিস। কাল্পনিক বস্তির কাল্পনিক বিপ্লবী শ্রমিক তৈরি করে তোরা তাকে ফুল বেলপাতা দিয়ে পূজো করিস। বাস্তবের ভয়ঙ্কর বস্তির বাস্তব রক্তমাংসের শ্রমিকের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।

কী বলছেন আপনি?- আমি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠি- নাটকে শ্রমিকের দোষত্রুটি দেখাতে হবে?

শুধু দোষত্রুটি নয়- বললেন জপেনদা’- তার অধঃপতন, বেঈমানি, মদ্যপান, সংকীর্ণতা, হিংসা, দ্বেষ, নারীনির্যাতন, কিছুই বাদ যাবে না, যেমন বাদ যায়নি গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসে। প্রচণ্ড বীরত্ব, ধূর্ততা, শ্রেণীঘৃণা, সততা ও মহত্বের পাশে নিকৃষ্টতম গুণের সমাবেশ ঘটাতে হবে। শ্রমিক যা হবে তার সঙ্গে দেখাতে হবে শ্রমিক যা আছে। যাহা হইয়াছেন এবং যাহা হইবেন, দুই মূর্তিই সমগ্রাহ্য; তাকে বলে বিপ্লবী বাস্তবতা। গোর্কি ও ব্রেখট তাই বলেন।

কথাটা আমার কাছে অসহ্য হলো। অবশ্য মধ্যে উঁকি দিয়ে গেল বুড়ো ভলাসবের চেহারাটা, গোর্কির উপন্যাসের পাতা থেকে। সেই সঙ্গে মনে পড়ল ব্রেখট-এর ‘হাইলিগে য়োহানা’ নাটকের শ্রমিকদের বিবেকহীন আচরণ।

আমাকে চিন্তাক্লিষ্ট দেখে জপেনদা’ বললেন- জানি, জানি, সমস্যাটা বুঝি। শ্রমিকের ব্যক্তিগত মাৎসর্য আদি দোষ দেখালে রাজ্যের বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত, রাজনৈতিক দল এবং পত্রিকা শৃগালরব তুলবে, বলবে- শ্রমিকশ্রেণীকে অপমান করা হয়েছে। তা তো তুলবেই, ওরাও পাতিবুর্জোয়া, সুতরাং ওরাও পাতিবুর্জোয়ার ভাববিলাসী চোখে শ্রমিককে দেখে, শ্রমিকের পদতলে কৃত্রিম ভক্তিতে দণ্ডবৎ হয়ে বিপ্লবী চেতনা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব এড়ায়। কান দিস নে। ওদের চোখ দিয়ে শ্রমিককে দেখিস নে, শ্রমিকের চোখ দিয়ে শ্রমিককে দেখ। তখন দেখবি শ্রমিককে তুই বাইরে থেকে সমালোচনা করছিস না, নিজে শ্রমিক হয়ে আত্মসমালোচনা করছিস।

একটু থেকে অর্থাৎ দম নিয়ে উনি পুনরায় জ্ঞানোদগার করলেন- আমি অনেক ভেবে দেখেছি, শ্রমিক-কৃষক বলতেই ন্যাকা ভাবাবেগ যার জাগে, সে স্পষ্টতই শ্রমিকের সঙ্গে এক হতে পারছে না। এক হলে সে বুক ঠুকে বলত, যে শ্রমিক রাজনীতি-সচেতন নয়, সে মোটেই মহান নয়, সে ক্ষয়িঞ্চু সম্ভাবনা-সমষ্টি মাত্র, সে অনেক বিষয়েই জঘন্য রকমে পশ্চাৎপদ। শ্রমিকের সঙ্গে যে লেখক একীভূত, তার হাতে এটা নিজ শ্রেণীর সমালোচনা মাত্র, দূর থেকে যা থেকে বর্ষিত বাবুসুলভ গালাগাল নয়। কিন্তু যেই দেখি রামকৃষ্ণ মিশনমার্কা দরিদ্রনারায়ণ পূজার মতন শ্রমিকবর্গকে প্রণাম ঠোকার বহর, অমনি বুঝি এ পাতিবুর্জোয়া মাল, না পেরেছে শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ অর্জন করতে, না বুঝেছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। এ মাল ওদিকই মাড়ায়নি। এর কাছে শ্রমিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিজের করে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার পরিবর্তে এর আশ্রয় হলো শ্রমিক-প্রীতি বা শ্রমিক-দরদ, কাঙ্গালীভোজন করবার সময়ে যেমন কর্তাবাবুর  জাগে গরিবদরদ। এঁরাই হলেন পাতিবুর্জোয়াবাবু। স্বকর্মে যাওয়ার পথে গাছতলায় গজিয়ে ওঠা সিঁদুর মাখানো কালো পাথরে মাথা ঠেকাবার মতন, এঁরা ঈষৎ শ্রমিক-পূজা করে নিয়ে অন্যকে খুশি রাখেন, নিজেদেরও ধোঁকা দেন। টিপ করে ওই প্রণামটি করেই যাবতীয় পাতিবুর্জোয়া বজ্জাতিতে এঁরা গা ভাসান, অথচ এঁদের বিবেক থাকে নির্মল, কারণ প্রাভাতিক প্রণামটা তো সেরেই নিয়েছেন, ভোরের বেলায় স্নান সেরেই হাতে পৈতে জড়িয়ে মন্ত্রটাতো উচ্চারণ করেই নিয়েছেন। সুতরাং এঁদের মার্কসবাদী খেতাবটা কেড়ে নেয় কোন শালা? তোর নাটকেও তাই দেখলাম। কারুর কোনো আলাদা চেহারা নেই, চরিত্র নেই, বৈশিষ্ট্য নেই। স্টীমরোলার চালিয়ে সকলকে কাদা বানিয়ে একটা মুণ্ডুহীন মূর্তি গড়ে বুকে লিখি দিলি; বিপ্লব। ব্যস! পাতিবুর্জোয়ার প্রণাম ঠোকার আচার রক্ষিত হলো। আর তুই ভাবতে লাগলি কতবড় বিপ্লবী নাট্যকার হয়েছিস।

হঠাৎ জপেনদা’র বামচক্ষু বুজে গেল। ফস করে আমার কানের দ্বারদেশে ওষ্ঠাধর সংলগ্ন করে বললেন- হিশশ! পেছনে মামা। তোর পেছনে মামা।

মামা মানে যে গোয়েন্দা পুলিশ এটা আমার জানা ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি একটা মুশকো লোক অনতিদূরে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে উদাসীন থাকছে। ঊর্ধ্বমুখ হয়ে মনুমেন্টের উচ্চতা আন্দাজ করছে। সে মামা কিনা জানি না, কিন্তু আমরা ভাগনে হতে রাজি হলুম না। জপেনদা’ ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছেন, আমি সঙ্গ ধরলাম। প্রায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পর্যন্ত ওই স্থাপত্যভক্ত কৃষ্ণকায় ব্যক্তি পিছু পিছু এলো। সারাটা পথ জপেনদা’ খালি পায়ে কাঁকর-পাথর মাড়িয়ে মৃদু আর্তনাদ করলেন। পা পিছলে একবার পড়ে গেলেন, এবং অনবরত ধারালো স্ফূরিত কণ্ঠে শুধোতে থাকলেন- গেছে, না আছে?
 
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কাছে আসতে শুরু হলো বৃষ্টি, এবং মামাকে আর দেখা গেল না। জলে ভিজে আমরা দুই ঢোল পায়ে দক্ষিণ দিকে চলতে লাগলাম এবং জপেনদা’ উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলেন- তোর জন্য আমিও বোধহয় এরেস্ট হলাম। রাতটা কাটলে হয়। আর আজকাল জেলের যা অবস্থা! রাজবন্দী বলে খাতির করবে তেমনটা তো আর নেই। পিটিয়ে মারবে। সব এই তোর জন্য; হঠকারী, এজেন্ট প্রোভোকাটুর, শুয়ার! তোর জুতোজোড়া আমায় দে, হতভাগ্য পায়ের চেটো দুটো আর নেই।

তারপর আমার জুতো পরে হরিশ মুখার্জী রোডে পা দিয়েই বললেন- তাহলে প্রশ্নটা কী? প্রশ্ন হচ্ছে এই; বিপ্লবী প্রচারকদের প্রথম কাজ হলো শ্রেণীযুদ্ধ প্রচার করা, কিন্তু দ্বিতীয় কাজই হলো শ্রমিক-কৃষককে পূর্ণ স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে বিকশিত হতে সাহায্য করা।

এমন আকস্মিকভাবে যে উনি মুলতুবি প্রসঙ্গে প্রত্যাগমন করবেন, পশ্চাদ্ধাবনকারী সেই ভীষণদর্শন মামা বা শালাকে যে উনি বেমালুম বিস্মৃত হবেন, এ আমার জানা ছিল না। তাই খেই হারিয়ে আমি নীরবে নগ্নপদে হাঁটতে লাগলাম এবং পথের গহ্বর কাটাতে কাটাতে মনে মনে সে-এম-ডি-একে গাল পাড়তে লাগলাম।

জপেনদা’ আত্মগতভাবে বলতে বলতে চলেছেন- কার্ল মার্কস সম্পূর্ণ মানুষের এক আশ্চর্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সকল ইন্দ্রিয় ও বৃত্তির পূর্ণ চরিতার্থতায় মানুষ সর্বাঙ্গীন, সম্পূর্ণ, পরিপূর্ণ, সার্থক হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক মানুষের সংহতি ও সামঞ্জস্য গড়ে ওঠার কথা; কারণ মানুষ দেখতে চায়, শুনতে চায়, ঘ্রাণ নিতে চায়, স্বাদ গ্রহণ করতে চায়, অনুভব করতে চায়, ধ্যানে বসতে চায়, জানতে চায়, কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়, ভালোবাসতে চায়। এগুলো যেমন তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য, তেমনি অন্য সকলেরও একই বৈশিষ্ট্য থাকায় এগুলো মিলনের সেতু হবার কথা। এই পরিবেশে ব্যক্তিগত দুঃখ-বিরহ ও আনন্দের অনুভূতি নিয়ে দ্বারে এসে করাঘাত করে, কারণ পূর্ণবিকশিত মানুষরা যখন পরস্পরের কাছাকাছি দল বেঁধে থাকে, তখন ব্যক্তিগত দুঃখ কখনো সামাজিক বিরোধে পরিণত হয় না। ‘For sufferings, viewed humanly, is man’s self-enjoyment’, বলছেন মার্কস, পূর্ণাঙ্গ মানুষদের সমাজে দুঃখেও থাকে আনন্দলোকের বিহ্বল স্পর্শ। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে এইসব ইন্দ্রিয় ও বৃত্তির বিকাশ থেকে বঞ্চিত করে। সম্পত্তি, মূলধন, পুঁজি মানুষের সব বৃত্তিকে ভোঁতা করে একটিমাত্র বৃত্তিকে ফাঁপিয়ে ফুলিয়ে তোলে। সে বৃত্তি দখলের বৃত্তি, ধনের ওপর অধিকার বিস্তারের বৃত্তি। একটি সুন্দর জিনিস দেখার স্পৃহা কেড়ে নিয়ে, সে বস্তুর মূল্য কত এই বিচারে আমাদের প্রবৃত্ত করায়। মানুষ হয়ে যায় একপেশে, সংকীর্ণমনা, স্বার্থপর। অধিকাংশ মানুষ শুধু বৈষয়িক নয় মানসিক জগতে হয়ে পড়ে রিক্ত, হৃতসর্বস্ব ভিখিরি। এবং এইসব দেউলিয়া মানুষকে সমষ্টিবদ্ধ করলে দেখা দেয় পাশবিক হানাহানি, দ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতা। সুতরাং মার্কস বলছেন, এখানে আনন্দও পরিণত হয় দুঃখ; একজনের আনন্দে দশজনের  ঈষাদ্বেয় এবং ফলে সামাজিক দ্বন্দ্ব। দখলের বৃত্তি স্পষ্টতই সমষ্টি-বিরোধী। তাই সম্পত্তির অবলোপ মানে সকল মানবিক ইন্দ্রিয়ের মুক্তি, দখলের মুক্তি, মানুষের সর্ববিধ প্রবণতা ও শক্তির শৃঙ্খলমোচন: ‘The complete emancipation of all human sense and aptitudes.’ মানবসত্তা তার বহুবিধ বিধি থেকে আজ বিয়োজিত ; সে উত্তরাধিকার আমরা ফিরিয়ে আনব, তাই আমরা শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী, সমাজতান্ত্রিক মানবতাবাদী।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ততক্ষণে আমার মনে হচ্ছে আমরা হাঁটছি না, সাঁতার কাটছি, খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের সুখতলা খসে যাচ্ছে; আর কানের কাছে একশো উড়ের নামতার মতন মার্কস সাহেবের তত্ত্বকথা আমায় সকল বৃত্তির নাম ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু জপেনদা’কে সে-কথা বলবে কে?

এই জন্যেই তো মার্কস এবং এঙ্গেলস সংস্কৃতির কথা বলতে গেলেই বলেন শেক্সপীয়র আর বালজাকের কথা- জপেনদা’ উবাচ- কেন বলেন? তোর কী মনে হয়?

আমার কিছুই মনে হচ্ছিল না, তবু জপেনদা’র ভয়ে মুখগহ্বরের বৃষ্টির জলটা কুলকোচো করে ফেলে দিয়ে বললাম- ক্ল্যাসিকাল সাহিত্যে ব্যক্তির মহত্ত্ব আর মানুষের গরিমা জ্বলন্ত অক্ষরে বর্ণিত হয়েছে বলে।
 
হ্যাঁ- বললেন জপেনদা’- শ্রমিকশ্রেণীর খণ্ডিত বিধ্বস্ত ব্যক্তিত্বকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য তাঁরা অনবরত সেই যুগের সাহিত্যকে সর্বত্রগামী করার চেষ্টা করছিলেন যে-যুগে সাহিত্য বিপ্লবী বুর্জোয়া ব্যক্তির জয়গানে মুখর ছিল। মানুষ যে কত মহান, কত বিশাল, কত জটিল, কত সুন্দর, এ বার্তা  মেহনতি জনতার কাছে কোনোদিন পৌঁছায়নি। নব্য লেখকদের কাছে মার্কস-এর আবেদন; শেক্সপীয়র পড়ুন, আপনাদের রচনাকে শেক্সপীয়রাইজ করুন। ব্যক্তি-প্রতিভার নানা দিক সম্পর্কে মেহনতি জনতাকে অবহিত করুন, মানবতাবাদী সাহিত্যকে এনে দিন তাদের নাগালের মধ্যে। তুই জানিস কি গোড়ার দিকে রুশ বিপ্লবের নেতারা প্রোলেতারীয় সংস্কৃতির অস্তিত্বই স্বীকার করতে চাননি?

আমি চমকে উঠে পড়ে যাচ্ছিলাম সি-এম-ডি গর্তে। অনেক কষ্টে টাল সামলে বলি- সে কী!

স্মিতমুখে জপেনদা’ আমার বিপত্তিটাকে উপভোগ করে বললেন- ‘লেনিন রচনাবলি, খণ্ড ৩৩, পৃষ্ঠা ২৩০ দেখলেই বুঝবি।’ অন্ধকার, অজ্ঞানতা ও কুসংস্কার থেকে সদ্য নির্গত মেহনতি জনতাকে শুধু মার্কসবাদী তত্ত্ব পৌঁছে দিয়ে কোনো লাভ নেই, বলছেন লেনিন, তাকে এনে দাও আঠারো শতকের বুর্জোয়া বিপ্লবীদের নিরীশ্বরবাদী সাহিত্য, চারিদিক থেকে বিবিধ উপায়ে তাকে জাগাও। আর ৩১ খণ্ডের ৩১৭ পৃষ্ঠা পড়লে দেখবি লেনিন প্রোলেতারীয় সংস্কৃতিকে রীতিমতো ব্যঙ্গ করছেন; বলছেন, অতীতকে ছাঁটাই করার পরিবর্তে মার্কসবাদ গত দু’হাজার বছরের চিন্তা ও সংস্কৃতির মধ্যে যা কিছু মূল্যবান সব আত্মস্থ করে নিয়েছে, তার রূপান্তর ঘটিয়েছে। সেই জন্যেই মার্কসবাদ বিপ্লবী প্রোলেতারিয়তের মতাদর্শ, সেটাই মার্কসবাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য। এখন আবার আলাদা করে প্রোলেটকুলট-এর প্রয়োজন নেই। অনবরত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্তব্যে লেনিন প্রোলেতারীয় লেবেল আঁটা নব্য সোভিয়েত সাহিত্যকে ধূলিস্যাৎ করে পুশকিন-লেরমনতভ-তলস্তয়ের দিকে চোখ ফেরাতে বলেছেন। স্তালিন কী করেছিলেন? অতীত সাহিত্যের বিপুল প্রচার দিয়ে তাঁর কর্মকাণ্ড শুরু- শেক্সপীয়র, বায়রন, শেলি, গ্যেয়টে, শিলার, পুশকিন, গোগোল, তলস্তয়, চেকভ, উগোর লক্ষ লক্ষ বই প্রচার করে স্তালিন মার্কস-লেনিনের নির্দেশ কার্যকরী করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বিল-বেলোৎসেরকভস্কিকে লেখা চিঠিতে স্পষ্টই বলেছিলেন, সাহিত্য ও থিয়েটারের ক্ষেত্র পার্টির ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বৃহৎ; সুতরাং ‘বামপন্থী’, ‘দক্ষিণপন্থী’ প্রভৃতি পার্টিগত অভিধাগুলোকে দয়া করে সাহিত্যের ওপর চাপাবেন না। শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে পার্টি লাইনকে প্রয়োগ করার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন স্তালিন, কারণ যমালয়ের ধূমাচ্ছন্ন প্রদোষ থেকে নির্গত মেহনতি সোভিয়েত জনতার প্রথমেই দরকার ছিল শিল্পের মুক্ত বাতাস, যা প্রাণভরে টেনে নিয়ে সে ব্যক্তি হিসেবে মাথা উঁচু করে। পাস্তেরনাকের কবিতা ভালোবাসতেন স্তালিন এবং পাস্তেরনাক তাঁর ‘কিং লিয়ার’ উপন্যাসে সরাসরি স্তালিনকে হিংস্র আক্রমণ করলেও স্তালিন কবির কাজে বাধা দেননি। জামিয়াতিনের গায়ে কেউ হাত দেয়নি; বরং জামিয়াতিন দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলে স্তালিন নিজে হস্তক্ষেপ করে তাঁর প্রবাস বরণে সাহায্য করেছিলেন। ‘ডেজ অব দ্য তুর্বিনস’ নাটক নিষিদ্ধ করার দাবি উঠলে স্তালিন তা প্রতিহত করেছিলেন। স্তানিসলাভস্কিকে সম্মানিত করে হঠকারী প্রোলেট ও ফিউচারিস্টদের হাত থেকে মস্কো আর্ট থিয়েটারকে রক্ষা করেছিলেন। বলশয় ব্যালে ও অপেরাকে প্রাচীনের তপস্যায় নিযুক্ত থাকতে সাহায্য করেছিলেন স্তালিন। মায়াকভস্কি তাঁর ‘বেডবাগ’ নাটকে সাম্যবাদকে ব্যঙ্গ করলেও স্তালিন তাঁকে ‘সমাজতান্ত্রিক অধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি’ বলতে দ্বিধা করেননি। আইজেনস্টাইনকে সতীর্থদের ঈর্ষাদ্বেষ থেকে রক্ষা করে পুনরায় চলচ্চিত্র তৈরির কাজে ফিরিয়ে এনেছিলেন স্তালিন এবং সুদূর অতীত থেকে ইভান দ্য টেরিভল-এর ইতিহাস বেছে এনে রাশিয়ার ঋজু হয়ে উঠে দাঁড়াবার মহাকাব্য রচনার প্রস্তাব দেন স্তালিন। স্তালিনের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারকেই অভিনেতা চেরকাসভ বলেছেন অবিস্মরণীয়। গোর্কি লিখলেন বায়রন সম্পর্কে, তারপর চেকভ ও তলস্তয় সম্পর্কে। লুনাচার্স্কি লিখলেন চের্নিশেভস্কি, পুশকিন, স্ক্রিয়াবিন, বেকন, শেক্সপীয়র, জোনাথান সুইফট, হাইনে, ভাগনের, মার্সেল প্রুস্ত, চিত্রশিল্পী রেনোয়া এবং বার্নার্ড শ সম্পর্কে। স্তালিনের পরিচালনায় সারা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল অতীতের মহত্তম মানবতাদী শিল্পকীর্তির প্রচার। শ্রমিকশ্রেণীর সদ্যোত্থিত ঔৎসুক্য ও আগ্রহের আলিঙ্গনে সে শিল্পকে সমর্পণ। কেন এটা ঘটেছিল? কখনো ভেবে দেখেছিস কেন মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন এবং গোড়ায় স্তালিন আলাদা কোনো প্রোলেতারীয় শিল্পের কথাই ভাবেননি? কেন তাঁরা স্পষ্টাক্ষরেই বলে দিয়েছিলেন, পার্টির শাসন শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে চলবে না, শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্র পার্টির ক্ষেত্রের চেয়ে বৃহৎ?

আচমকা এই প্রশ্নগুলো করেই সব মাটি করেন জপেনবাবু- নইলে মনোযোগের ভান করে দু’চারটে হুঁ-হাঁ দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। প্রশ্নে বিব্রত হয়ে দ্রুত বললাম- কেননা বৃহৎই তো ক্ষেত্র সাহিত্য পার্টির!

[এর অর্থ হল কিনা ভাববার সময় ছিল না।]

জ্বলে উঠলেন জপেনদা’। ভিজে জামাটার কোনা দুটো নিঙড়ে তারস্বরে বললেন- তোমার মাথা! উল্লুক, তোমার কিস্যু হবে না, যাও ঘোড়ার ঘাস কাটো গে, কৃষকের পায়ের কাছে বসে। বহুবার লিখে গেছেন মার্কস ও এঙ্গেলস যে প্রোলেতারিয়ত হচ্ছে একমাত্র শ্রেণী যে শ্রেণীহীন সমাজ গড়বে। সুতরাং তাঁরা আলাদা কোনো প্রোলেতারীয় সাহিত্যের কথা ভাবেননি। তাঁরা মনে করেছিলেন প্রোলেতারিয়ত যে শিল্প সাহিত্য অবশেষে গড়বে তা সমগ্র সাম্যবাদী সমাজের শিল্প সাহিত্য। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন মনে করতেন শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব এক ক্ষণস্থায়ী পরিচ্ছেদ মাত্র; অতি দ্রুত সমাজ পরবর্তী স্তরে উপনীত হবে। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত এক সোভিয়েত পুস্তিকায় শুনি সোভিয়েত শ্রমিকশ্রেণীর রণধ্বনি; সোভিয়েত শাসন দুই বিপ্লবের মাঝে সামান্য বিরতি মাত্র, স্বল্প বিশ্রামকাল, যখন বিপ্লবের সেনাবাহিনী নিজেদের প্রস্তুত করবে পরের যুদ্ধের জন্য, যুদ্ধ প্রস্তুতির মাঝে শ্রমিক নূতন সংস্কৃতি গড়ে ফেলবে। তাও কি কখনো হয়? বিশেষত যে শ্রমিক সদ্য বেরিয়ে এসেছে অজ্ঞানতা-আঁধার থেকে। কিন্তু ব্যর্থ হলো, ফ্যাশিবাদের আঘাতে বিপ্লব পরাস্ত হলো মধ্য ইউরোপে। শুধুমাত্র ট্রটস্কি তখনো কোলবালিশের মতন আঁকড়ে রইলেন নিখিল-ইয়োরোপে বিপ্লবের আসন্নতার তত্ত্ব। স্তালিনরা বুঝলেন, শ্রমিকের একনায়কত্ব এক আস্ত ঐতিহাসিক অধ্যায় জুড়ে থাকবে, সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণ ঠেকাবে, দেশের অভ্যন্তরে শোষকদের অবশিষ্টাংশকে দমন করবে। আরে দেত্তেরি-

শেষোক্ত সমালোচনাটি বর্ষিত হল বর্ষণসিক্ত দেশলাইয়ের প্রতি, কারণ কাঠি জ্বলছে না। তখন আমার লাইটারে চারমিনার ধরিয়ে, বৃষ্টি থেমে যাওয়ার জন্য আকাশকে ব্যঙ্গাত্মক প্রণিপাত করে জপেনদা’ ফের কথার খেই ধরলেন কম্বুকন্ঠে [লোকটার গলাও ভাঙে না!]- কিন্তু সেখানেই সমস্যার শেষ নয়। শ্রমিকশ্রেণীর সংস্কৃতি গড়বে কে? শ্রমিকশ্রেণী। সে শ্রমিকশ্রেণীর মানসিক স্তর কোন পর্যায়ে? বুর্জোয়া যখন বিপ্লব করেছিল তার অনেক আগে থেকেই বুর্জোয়া মহাধনী সমাজের উচ্চতর পদগুলির অধিকারী, উচ্চশিক্ষিত, কালচার্ড। তাই ইংলন্ডে, জর্মনিতে, ফ্রান্সে বিপ্লবের পরে অবলীলাক্রমে বুর্জোয়া শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির কাজে মেতে উঠতে পেরেছিল। কিন্তু শ্রমিক কি বুর্জোয়া সমাজে সেই সুবিধা পেয়েছে যা বুর্জোয়া পেয়েছিল ফিউদাল সমাজে? একেবারেই না। বুর্জোয়া তো শ্রমিককে করে রেখেছে নিঃস্ব। শ্রমিকের ট্যাঁক খালি, তার বাসস্থানের পরিবর্তে রয়েছে বস্তি, শিক্ষাদীক্ষার পরিবর্তে অমানুষিক পরিশ্রম। এমনকী তার সুকুমার বৃত্তিগুলি পর্যন্ত দলিতমথিত। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক একটি জ্ঞানই লাভ করে; সেটা হচ্ছে বুর্জোয়া সমাজকে ধ্বংস করার প্রয়োজনীয়তা। শুধুমাত্র সেই চেতনার ওপর নির্ভর করে আস্ত একটা শ্রেণীর নূতন শিল্প-সাহিত্য গড়ে ওঠে না। তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব; তাই অতীতের যা কিছু মূল্যবান গোগ্রাসে গেলার পালা; তাই শ্রমিক-লেখক, শ্রমিক-কবি আবিষ্কারের ধুম, হোক না তারা কাঁচা বা অতি সরল। ভাঙা মন জোড়া দেওয়ার পালা আগে; তারপর না মহৎ সৃষ্টি। এখন গুরুতর সমস্যা হলো বিপ্লবের ঝটিকাকেন্দ্র ইয়োরোপ থেকে সরে এসেছে এশিয়ায়, আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায়, যেখানে শ্রমিক শতগুণ বেশি শোষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আধা-গ্রাম্য, গ্রামীণ আচার-নিয়মে শৃঙ্খলিত, গলা-পচা সমষ্টির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে বুর্জোয়া শোষণের সঙ্গে মিশে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, জমিদারি শোষণ, গুরুভার অতীতের শোষণ। এই গগনচুম্বী অচলায়তনকে ভাঙবার জন্য চীনের অবিস্মরণীয় অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক বিপ্লব; এশিয়ার বিধ্বস্ত মানবগোষ্ঠীকে সুস্থ, উন্নত, সৃষ্টিশীল ও সংগ্রামী চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করার প্রথম অভিযান, আধখানা মানুষকে পুরো করার লড়াই।

আমি স্থির করলাম একটা কিছু বলা দরকার। নইলে জপেনদা’ আবার খেপে উঠতে পারেন। বিজ্ঞতাজ্ঞাপক কিছু এ্যাঁ-উঁ ইয়ে করে আমি বললাম- চীনেও তো দেখলাম লু সুন, রোমাঁ রলাঁ, শেক্সপীয়র, বেঠোফেন নিয়ে আলোচনার হুজুগ। কিন্তু এসবের ফলে পুরাতন ঐতিহ্যের বন্ধন আরো দৃঢ় হয়ে উঠেছে না? তাহলে নূতন লেখক, নূতন চিন্তা, নূতন আঙ্গিক নিয়ে ভাববে কী করে? পুরাতন সাহিত্যের ঐতিহ্য পিঠে নিয়ে লেখক-নাট্যকারদের নিজের পিঠই তো ঝুঁকে পড়বে: হামাগুড়ি দিয়ে সে কী নূতন সৃষ্টি করবে মাথায় ঢুকছে না।

মাথায় তোর কিছুই কোনোদিনই ঢোকে না- মুখ ভ্যাঙালেন জপেনদা’- কিসের ঐতিহ্যের কথা বলছিস? সাহিত্যের ঐতিহ্যের বন্ধনে শ্রমিকশ্রেণী বাঁধা পড়েছে নাকি? ঐতিহ্যের ছিটেফোঁটাও সে পেয়েছে নাকি কখানো? তোর কি ধারণা বিপ্লবের আগে চীনের শ্রমিক পায়ের ওপর পা চাপিয়ে পিকিং অপেরা দেখেছে? তোর কি ধারণা কলকাতার বস্তিতে সন্ধ্যার পর সবাই বসে সুর করে রবীন্দ্রনাথ পড়ে? তোর কি ধারণা বাঙাালি শ্রমিক অবসর সময়ে বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে? তুই গাধা কি ভাবিস বিহারী শ্রমিক বিদ্যাপতির ঐতিহ্যে বাঁধা পড়ে আছে? যার স্বাদই ওরা পেল না, তাতে বাঁধা পড়তে যাবে কী উপায়ে? আসলে এটাও তোদের পাতিবুর্জোয়া বজ্জাতি। নিজেরা ওইসব পুরাতন মতামতটাকে শ্রমিক-কৃষকের মতামত বলে চালাচ্ছিস। মাও বলেন, শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করো। আর তোরা পাতিবুর্জোয়া চামারের দল নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটাকে শ্রমিকের বলে চালাতে চাস। তুই ঐতিহ্য ভোগ করেছিস বলে আর ঐতিহ্যের দরকার নেই, শ্রমিক-কৃষক যে তিমিরে আছে সে তিমিরেই থাকুক, এই তো তোর বিধান। তোরা রাশিয়ার সেই হঠকারী প্রোলেটকুল্টওয়ালাদের বংশধর, সেই লেবেদিনস্কি, ত্রেতিয়াকভ, প্লেতনেভ ইত্যাদি, যাদের ধমকে দিয়ে স্তালিনের পার্টি বলেছিল; তোমাদের চেয়ে শেক্সপীয়র পুশকিন, গ্যেয়টেকে শ্রমিকদের বেশি দরকার, কেননা তাঁরা মানুষের মনে গভীরতা সম্পর্কে শ্রমিককে অবহিত করবেন, মানুষের আবেগ অনুভূতির জটিলতা বোঝাবেন, মানুষ কত বড়, কত বিচিত্র, সেটা বোঝাবেন। প্রোলেটবাদীরা পাতিবুর্জোয়া; তারা নিজেদের চেতনার স্তরকে শ্রমিকদের চেতনার স্তর বলে চালাবার চেষ্টা করেছিল।

আমি আর জবাব দিয়ে জপেনদা’র গ্যাঁড়াকলের শিকার হতে রাজি হলাম না, ওঁকেই নিরুপদ্রব স্বগতোক্তি করতে দিলাম। তিনি বলে চললেন- তোদের নাটক-গল্প-কবিতাতেও দেখি ঘন ঘন এই পাতিবুর্জোয়া একদেশদর্শিতা। লড়াইয়ের কথা, শ্রেণীঘৃণা, উত্তেজনা, এসব অনেক সময়েই তোদের লেখায় থাকে- থাকবেই তো। কিন্তু অন্য দিকটা থাকে না। ব্যক্তিমানসের বিশ্লেষণটা থাকে না, মানবমনের জটিলতা থাকে না, জনতার খণ্ডিত মানসকে পূর্ণ করার সাধনাটা অনুপস্থিত। মানুষ বলতে সাতিন বা হ্যামলেটের যে শিহরণ, তোরা সেটা অনুভব করিস না। শ্রমিকশ্রেণীকে মঞ্চে তুলিস বিপ্লবের প্রাণহীন প্রতীক করে, তার মনের গহনে ঢোকার তোদের ধৈর্য বা আগ্রহ কোনোটাই নেই। তোদের শ্রমিক সঠিক স্লোগানটা দেয় ঠিকই, কিন্তু সে ভালোবাসে না, ভাবে না, হিংসাদ্বেষে কম্পিত হয় না, বদমাইশি করে না, সে যে মানুষ এটাই বোঝা যায় না। তোরা তাকে সেলাম ঠুকিস অনাত্মীয়ের মতন, অপরিচিতের মতন- ভদ্রতার খাতিরে, লোকাচারের স্বার্থে। শ্রমিকের ঘরের লোক হতে পারছিস না, তাই তোরা লিটল রাশিয়ান বা পাভেল সৃষ্টি করতে পারছিস না, পারছিস না জ্যাক লন্ডন বা ষ্টেফান হাইম বা চেন-চি-তুং-এর মতন লিখতে।

ভাবলাম এবার বোধহয় জপেনদা’ থামবেন; আমার গলির মোড়টাও এসে পড়েছে, ঘরেও তো ফেরা দরকার। আমি সটকান দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছি, এমন সময় উনি আমার হাত চেপে ধরলেন।

যাচ্ছিস কোন চুলোয় হতভাগা?- বললেন উনি করাত চালানো গলায়- বলচেলাম, এ দেশের সামন্ততান্ত্রিক সমষ্টি অক্টোপাসের মতন আঁকড়ে রেখেছে শ্রমিককে, কৃষককে, সমাজের গলিত শব জড়িয়ে ধরেছে সবাইকে, আর তোরা যারা অগ্রসর প্রচারবিদ, তোরা তো সেই পুঁজ ছড়ানো গোষ্ঠীজীবনকে আঘাত করিসই না, বরং দেখি অনেক সময়ে সেই সব মধ্যযুগীয় চিন্তাগুলোকে প্রশ্রয় দিস, কুসংস্কারকে আমল দিয়ে বসিস।

কখনো না- আমি রেগে উঠে বলি- এসব কী কথা? আমরা হয়তো শ্রেণীসংগ্রামকে যতটা গুরুত্ব দিই, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাকে ততটা দিইনি, কিন্তু কুসংস্কারকে আমল দিই, প্রশ্রয় দিই এটা মিথ্যা।

জ্ঞানত দিস না হয়তো- বলেন জপেনদা’- ভেবে চিন্তেই যে দিস তা হয়তো না। কিন্তু তোরা বাপ-নেওটা পাতিবুর্জোয়া নাড় গোপাল, অজান্তেই দিস, কারণ নিজেরাই তোরা নানা কুসংস্কারে বিশ্বাস করিস। তোরা নিজেরাই যে আধখানা মানুষ। তোদের মনের মধ্যেই যে দাদ আছে, চুলকানিটা যাবে কোথায়?

এরকম অসভ্য গাল খেয়ে আমি তৃষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করলেম, জবাব দিলাম না।

জপেনদা’ বলে চললেন- নানাভাবে ফুটে বেরোয় তোদের নোংরামি। এই যে নাটকটা আজ দেখালি, তাতে প্রথমেই শহুরে বাবুদের কৃষকদের হয়ে গাল দিলি কেন রে শয়তান? অনেক নাটকেই, বহু গল্পেই এটা দেখি। কেন রে? বিপ্লবের বার্তা তো শহরের ছেলেরাই নিয়ে যাবে গ্রামে, নিয়ে গেছেও। কুসংস্কারাচ্ছন্ন চাষি তাদের পদ্মবনে মত্ত হস্তী মনে করে, গ্রামের স্পন্দনহীন নিস্তরঙ্গ প্রাণহীন শান্তির বিঘ্ন মনে করে। তোরা সে গলায় গলা মেলাস কেন? চাষি কি সচেতন শহুরে কমরেডের চেয়ে অগ্রসর নাকি? চাষির পশ্চাৎপদতাকেও সমর্থন করতে হবে? বহুবার শুনি ইংরিজি কেতাব ছুঁলে সর্বনাশ হয়। জোতদারের কথাগুলো কেতাবের মারফৎ। নাটক-ফাটক যা লিখেছিস সব ওই কেতাবের দয়ায়। জোতদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তোরাও যদি ইংরিজি কেতাবের বিরুদ্ধে কোমর বাঁধিস, তাহলে তোরা চাষিদের অজ্ঞানতা আর কুসংস্কারের প্রহরী হয়ে দাঁড়ালি, জোতদারের ভাড়াটে দারোয়ান হয়ে দাঁড়ালি, এটা বুঝিস?

সেখানেই শেষ নয়, বললেন জপেনদা’, হঠাৎ হঠাৎ তোদের লেখায় দীর্ঘশ্বাস শুনি শহুরে গোলমালের বিরুদ্ধে। শহর থেকে দূরে গ্রামের কেরোসিন জ্বালা সন্ধ্যায় তোদের নায়ক হঠাৎ শান্তি পায়। সে হঠাৎ শহুরে বাবুদের স্বার্থপরতা আর চাষিদের ঔদার্য নিয়ে কথা কয়ে ওঠে। এমনকী সে মাথার ওপরে বৈদ্যুতিক পাখা বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গুহাবাসী সন্ন্যাসীর মতন। তোরা আবার মার্কসবাদী! এসব তো যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে গান্ধীর কথাবার্তার মতন। কে বলেছে শহুরে হট্টগোলের চেয়ে গ্রামের শান্তি ভালো? মার্কসবাদী একথা বলে না। সে বলে সমাজতন্ত্র সবচেয়ে ভালো, কিন্তু যদি সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম আর বুর্জোয়া সমাজের তুলনা হয়, তবে শহর সহস্রগুণ শ্রেয়। শহরের হট্টগোলে মার্কসবাদী দেখে যন্ত্রসভ্যতার সূত্রপাত, আর গ্রামের শান্তিকে সে মনে করে কবরের শাস্তি। শহুরে হট্টগোলে সে প্রাণের স্পর্শ দেখতে পায়, গ্রামের নৈঃশব্দে সে দেখে মৃত্যু। তাকেই বলে মার্কসবাদী। কে বলেছে বাবুদের তুলনায় চাষি উদার? চাষি ঢের বেশি সংগ্রামী, নির্মম, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন- এইটুকুই মার্কসবাদীরা স্বীকার করে। কিন্তু তার বাইরে কৃষক সংকীর্ণমনা, জমি-লোভী- এও শ্রমিকরা জানে, মার্কসবাদীর জানার কথা। ফ্যান আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রকে তোরা গাল দিস কেন রে বেকুব? সে তো চণ্ডীমণ্ডপের মান্ধাতারা দিয়ে থাকে প্রতি বৈকালে। তোরা কি শেষ পর্যন্ত মেশিনের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করবি ল্যাংটা বাবার মতন? চাষির কথা বলতে গিয়ে চাষি হয়ে যাস কেন? তোরা না শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিনিধি? চাষির দিকে অমন হাত জোড় করে ভক্তিভরে তাকাস কেন? তোরা না কমিউনিস্ট, যন্ত্রের ব্যাপকতর ব্যবহারের প্রবক্তা, যন্ত্রসভ্যতার অগ্রদূত?

আরো আছে- বললেন জপেনদা’- লেনিন ক্লারা জেটকিনকে বলেছিলেন, অনেক কমিউনিস্টকে নারীজাতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে পড়ে এক একটি দানব। তোরাও তাই। রোজ দু-চারটে করে নিদর্শন পাই নারী প্রশ্নে তোদের মালিকানার মনোভাবের। ভেতরে ভেতরে তোরা অনেকেই নারীকে মনে করিস সম্পত্তি। নইলে হঠাৎ হঠাৎ আজকের মেয়েদের বেশভূষা নিয়ে দুমদাম অমন মন্তব্য লিখে ফেলিস কেন? সেদিন এক বলিষ্ঠ গল্পের মাঝখানে দেখি ‘স্লাকস-পরা মেয়ে’ সম্পর্কে অশিষ্ট উক্তি যার সঙ্গে একটা অশিক্ষিত বর্বর জোতদারের কথাবার্তার কোনো প্রভেদ নেই। অনবরত তোদের গল্পে দেখি পরোক্ষ সতীত্বের জয়গান। যদিও তোরা জানিস এ সমাজে সতীত্ব মানে দাসত্ব। তোদের গল্পে মেয়েরা আপিসে চাকরি নিলেই সাহেবের লোভের শিকার হয়ে পড়ে; পরোক্ষে তোরা বলছিস আপিস বড় ভীষণ ঠাঁই, বাবা কুলবধু কুলবধু হয়ে থাক, হেঁসেলে যাও বা বাচ্চ বিয়োও! আরেক বিপ্লবী নাটকে মেয়েদের ধূমপান নিয়ে যে রসিকতা করা হয়েছে তা শুনলে কানে আঙুল দিতে হয়। কেন রে? পুরুষ সিগারেট খেতে পারে, মেয়ে পারে না কেন? মেয়ে সিগারেট খেলে চোখ কপালে তোলে ঘৃণ্যতম জীবগুলো যারা বিবাহ বিচ্ছেদের নাম শুনলে মূর্ছা যায়; তোরা এদের মুখপাত্র হয়ে উঠবি নাকি? নাটকে তোরা পদাঘাতে ভাঙবি হেঁসেল, আঁতুড়ঘরের প্রাচীর, সৃষ্টি করবি ইবসেনের নোরার বাঙালি ভাষ্যকে, মুক্তির ডাক বয়ে আনবি শৃঙ্খলিত মাতৃজাতির কাছে, সরোষে বলবি চুলোয় যাক আইনসংগত বেশ্যাবৃত্তি, নারী-পুরুষের প্রকৃত ভালোবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগে ভাঙো নারীর পায়ের বেড়ি। তা নয় চাকুরে মেয়ে, প্যান্টপরা মেয়ে, সিগারেট-খাওয়া মেয়ে, এদের নিয়ে ইতরসুলভ রসিকতা। এমনকী মাঝে মাঝে শহুরে প্রেম নিয়ে তোরা-।

হঠাৎ উনি থামলেন। আমার পেছনে কাকে দেখে ফিস ফিস করে বললেন- মামা, আবার মামা! এই বলেই গলির অন্ধকারে জপেনদা’ সাঁ করে হারিয়ে গেলেন। আমি ফিরে দেখি মামা নয়, পাড়ার শীতেশবাবু গামছা কিনছেন ফুটপাতের দোকান থেকে।

[লেখাটি ‘উৎপল দত্তের গদ্য সংগ্রহ ১, নাট্যচিন্তা’ থেকে পুনর্মূদ্রণ করা হলো]

উৎপল দত্ত: বাঙলানাট্যের প্রবাদ পুরুষ