Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট

Written by কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[গত ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিট্যুট, বাংলাদেশ কেন্দ্র আয়োজিত ‘আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব ও সেমিনার’। ‘শিকড়ের হোক ডানা’ এই স্লোগানের উৎসবের সেমিনারে দু’দিনে মোট তিনটি বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বিষয়গুলো ছিলো- ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’, ‘দেশজ নাটক: প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ’ এবং ‘নতুন সহস্রাব্দে দেশজ নাটক’। ‘দেশজ নাটকের অস্তিত্বের সংকট’ বিষয়ে কাজী সাইদ হোসেন দুলালের বক্তব্য প্রকাশ করা হলো থিয়েটারওয়ালা’র পাঠকদের জন্য]

নদী মাতৃক এই জনপদে অসংখ্যা নদী। মধুমতী, মহানন্দা, আত্রাই, নন্দকুজা, মুশাখা বারনই, পাগলা, নারদ, খলশাডাড়া, পদ্মা, মেঘনাসহ সমগ্র জনপদ নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। নদীর পাড়ে খেয়াঘাটের তীরে অসংখ্য একচালা, দোচালা, চৌচালা মঞ্চ, মঞ্চকে ঘিরে মেলা। পৌষ মেলা, মহরমের মেলা, পাঠা কাটার মেলা, মাঘি পূর্ণীমার মেলা, দোল পূর্ণিমার মেলা, শীব রাত্রির মেলা, চরকের মেলা, ফ্যাস কাটার মেলা, মোরগ লড়াইয়ের মেলা, মহাদেবের মেলা- অসংখ্য মেলা। মেলাকে ঘিরে হাজার পার্বণ। বটপাইকরের বিয়ে, পুতুলের বিয়ে, মাথায় প্রথম চিরুনী, ফ্যাস কাটা, স্বাদ খাওয়া, যাবতীয় পার্বণ বাঙালি জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ যেনো বার মাসে তের পার্বণ, পার্বণকে ঘিরে পরিপূর্ণ আমাদের জীবন। লোকাচারগুলোর মাঝে হাজার মানত। যেমন, ছেলে হলে মাদার পীরের হাতে দিব, মেয়ে হলে মহাদেবের থানে ভোগ দিব, সাপ দেখলে মনসার পূজো দেব, গোলাভরা ধান হলে গাজীর ভিটায় সিন্নি দেব, এ সবই আমাদের লোকসংস্কৃতিতে একে অপরের পরিপূরক।

এ প্রসঙ্গে আমার এক অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে। বছর তিনেক আগে, মনসার গান হচ্ছে। কাঁঠাল বাড়িয়ার নিত্যানন্দের বাড়িতে। সন্ধ্যার পরে গান হবে, নিত্যানন্দের আমন্ত্রণে নিত্যানন্দের বাড়ির দিকে যেতে রামজীবনপুর চৌধুরীদের জরাজীর্ণ পুকুর পাড়ে হঠাৎ সন্ধ্যার আলো আঁধারীতে সাপের ফনা তোলা দেখে আমি ও নিত্যানন্দ চমকিয়ে পিছিয়ে পড়ি। যাই হোক, সাপ তৎক্ষণাৎ স্থান পরিবর্তন করে চলে যায়। ঘটনাটি এমন একটি সময় যখন নিত্যানন্দের বাড়িতে মনসার গানে ভেসে আসছে মসনা বন্দনা, সুর ও গান, প্রণমহ বিষ হরি, বিশ্বরূপা বিশ্বেশ্বরী, তুমি দেবী জাগত জননী তুমি দেবী হর সুতা অস্তিকস্ব মুনির মাতা, নাগমাতা ভুবন মোহনী, তুমি শীবের নন্দিনী, ত্রিভুবনের উদ্ধারিনী, যোগমাতা যোগ সনাতনী। নিত্যানন্দের মনে তখন প্রগাঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, মা মনসা তাকে দর্শন দিয়েছে। নিত্যানন্দ আসরে পৌঁছে মঙ্গল ঘটের সামনে জড় হয়ে প্রণাম করে সেকি আকুতি তার। হারানো পুরের রহিমউদ্দিনের কোনো সন্তান হয় না, বিবাহিত জীবন ষোলটি বৎসর অতিবাহিত হয়েছে। সে অগ্নি নির্বাপনকারী, সন্তানদানে আর্শিবাদকারী পীর মাদারের মানত করেছিল। আঠার বৎসরের মাথায় রহিমুদ্দিনের প্রথম সন্তান হয়েছে। রহিমুদ্দিনের গৃহাঙ্গনে নারকেলের পাতার ছাউনি দিয়ে ঘেরা মাদার গানের আসর থেকে জুমল বলে ওঠে, সত্যিই যদি তুমি সন্তান দানকারী পীর হয়ে থাকো, চার যুগ ধরে তোমার সেবা করে আমার কেনো সন্তান হয় নাই, এই প্রশ্নের বিধান করো সভাজনে। সভাস্থলে রহিমুদ্দিন তার সদ্য নবজাতক শিশুকে মাদার পীরের কোলে তুলে দেয়। মাদারে তখন দশজনের উদ্দেশে বন্দনা করে। মাদার তখন গেয়ে ওঠে দেশ মাতার তরে-

‘জাগো, জাগো জননী
জাগো, জাগো, জাগো, জননী,
প্রথম ছন্দে অধম বন্দে
জন্মভূমির মাটি গো
যে মাটি ধুলি কণা
প্রতি ক্ষণে ক্ষণে
আহা প্রথম ছন্দে’

এরূপভাবেই আমাদের সামাজিক জীবনে লোকনাট্যের প্রভাব। লোকনাট্যের হাজার প্রকার শ্রেণীবিভাগ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, চাইপাড়ার চাইদের সমম্বয়ে লক্ষ্মীর গান, পদাবলীর গান, আবার শাঁখারী পাড়ার শাঁখারীদের মনসার গান, মাদারের গান। মণ্ডলপাড়ার হাজারী লাঠিয়াল দল, ঘোষপাড়ার ঘোষদের কৃষ্ণ কীর্তনের দল। অনেক আগে এইরূপ লোকদলগুলো পাড়াভিত্তিক গড়ে উঠেছিল। এ লোকদলগুলোর অভিনয়ের স্থান ছিল বটতলায় অথবা আটচালা, চৌচালা, দোচালা বা নদীর পাড়ে। নদীর পাড়ের কথা যখন উঠল তখন একটি জনশ্রুতির কথাই আলোচনা করা যাক। বার্ষির জীবনদানের আচিন ঘাটে উৎপত্তির কথা জানা যায়।

বার্ষি নামে কোনো এক কন্যা যমুনার ঘাটে আত্মাবিসর্জন দিয়েছিল। আমার এই দেহ যমুনার শ্রোত জলে যতদূর যাবে শুধু অন্ন আর পুষ্প বর্ষিত হবে। বার্ষির এই আর্তির পিছনে যে জনশ্রুতি লোকমুখে উচ্চারিত হয়, তা হচ্ছে, বার্ষির দেহ এসে মাটিতে মিশে যায়। সেই ফাল্গুন মাসের পনের তারিখে হিন্দু মুসলমান সকল জাতি বার্ষির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

বছর দশেক আগে পাটকেলী নাক গ্রামে অ্যামেচার যাত্রাদলের অভিনয় হবে। সেখানকার স্থানীয় লোকের আমন্ত্রণে আমি যাত্রা দর্শনে পাঠকেলী যাই। যাত্রা হবে ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’। যথারীতি যাত্রার চিরাচরিতভাবে কনসার্ট পড়েছে, আসর বন্দনা চলছে রমনীগণ দ্বারা, রুচিশীল একটি ব্যালট নৃত্যের পরে যথারীতি যাত্রাপালা শুরু হয়েছে। গরীবের বন্ধু, না হিন্দু না মুসলমান মানুষরূপী পোড়া চান্দ তখন অবিরাম প্রাঞ্জল অভিনয় করছে। হঠাৎ হৈ হৈ রৈ রৈ শব্দ। কী ব্যাপার! মঞ্চে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, তার দাবী, মঞ্চে এখন নৃত্য চালাতে হবে। দর্শককুল তখন অভিনয়ে এতোটাই মত্ত যে, তারা নৃত্য দেখতে চায় না। তারা পোড়া চান্দের নেতৃত্বে হাফশি জানোয়ারের উচ্ছেদ চায়। কিন্তু চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর হম্বিতম্বিতে  বাধ্য হয়ে মাতৃরূপীনী কৃষ্ণা কুমারী তার শাশ্বত মায়ের পোশাক ছেড়ে ডিস্কু প্যান্ট, শার্ট পরে নাচতে থাকলো। সংস্কৃতির এরূপ অবক্ষয় দেখে মনে কষ্ট নিয়ে ফিরে এলাম।

এই ঘটনার বছরখানিক পরে হয়তো হবে। আমাদের এলাকায় ঘোষপাড়াতে রেখারাণী সম্প্রদায়ের ‘মহাপ্রভুর নীলাচলে’ পালাটি চলছে। আমি এবং আমার এক বিদেশী বন্ধু যিনি সুইডেন থেকে এসেছেন তাকেসহ আসরে গিয়ে দেখি শ্রোতা মণ্ডলী আসরে এত আবেগ আপ্লুত যে, সমগ্র আসর জুড়ে একে অপরকে জড়িয়ে কান্নাকাটি করছে। মিনিট দশেক মনে হয় হবে আমি খেয়াল করে দেখি, আমার বুকের উপরের অংশও তখন ভিজে গেছে। আমাদের পাড়ার হোসেন মৌলভি, সেও কান্নাকাটি করছে। আমার বিদেশী বন্ধুটির কথায় হঠাৎ আমার খেয়াল হয়। সে আমাকে প্রশ্ন করছে- কী ব্যাপার কী হয়েছে? আমি তখন বোঝার চেষ্টা করি। বিষয়টি হচ্ছে মহাপ্রভুর সাথে মহাপ্রভুর এক শিষ্য সন্ন্যাসব্রত নিয়ে মহাপ্রভুর সাথে আছেন প্রায় ১১ বৎসর যাবৎ। একযুগ পূর্তি হলে শিষ্য সন্ন্যাস দীক্ষা পাবে। সন্ন্যাস ধর্মে আছে যিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করবেন তিনি সাতটি রিপু মেনে চলবেন- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মর্ষজ্য ইত্যাদি করা চলবে না। মহাপ্রভুর হরিতকি খাওয়ার অভ্যাস আছে। দুপুরের ভোজনের পর শিষ্যকে বলেছেন বাবা আমার জন্য একটু হরিতকি আনো তো। শিষ্য হরিতকি আনতে অনেক দূরে গেছে। শিষ্য মনে করেছে গুরুদেব তো রাতে খাওয়ার পর আমার কাছে হরিতকি খেতে চাইবে। আমি একটু বেশি নিয়ে য্ইা। যথারীতি রাতে খাওয়ার পর গুরু শিষ্যকে বলছেন, আমাকে একটু হরিতকি দাও। শিষ্য দুপুরে ট্যাকে রাখা হরিতকিটি বের করে দিয়েছে। হরিতকি দেখে গুরুদেব বলছে, তুমি সঞ্চয় করেছো, তোমার তো সন্ন্যাস ধর্ম হবে না। সনাতন ধর্মে আছে যদি কোনো মানুষ ধর্ম পালন করতে গিয়ে পালন করতে না পারে তবে সে হয় পাতকী (বাদুর)। তাই শিষ্য আসরে কান্নাকাটি করছে গুরু দেবের চরণ ধরে। এই দৃশ্য দেখেই দর্শকের এই কান্নাকাটি। আমার বিদেশী বন্ধুটি অবাক বিস্ময়ে বলেছিলেন- এ ধরনের লোকসংস্কৃতির প্রতিক্রিয়া আমি আর কখনও দেখি নি।

আমাদের লোকসংস্কৃতিতে সাধারণত চারণ ও পা ফাটা গোত্রের মানুষগুলোই লোকসংস্কৃতির চর্চা করে। যেমন বলা যেতে পারে, কৌচর পাড়ার সাজ্জাদ বাউল গান করে, ঔষধ বিক্রির জন্য হকারীও করে। আরইলের মামুনুর রশীদ সাজ্জাদ কিচ্ছা গান করে, কৃষি শ্রমিক, জামনগর গ্রামের দীনহীন আশরাফ আলী মনসার গান করে। এইরূপ হাজারো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই চারণগণ আমাদের বিবেচনায় শিক্ষিত নন। কিন্তু স্বশিক্ষিত এই চারণগণ রচনা করেন আমাদের লোকসংস্কৃতির সোপান। তাই যখন দেখি দাবিলার জহির উদ্দিন পলান উচ্চ মার্গের দেহতত্ত্ব দিয়ে মঞ্চে রচনা করেন প্রতি রজনীতে নিত্য নতুন যুগী পর্ব, গানের মাধ্যমে বিজ্ঞানভিত্তিক দেহতত্ত্বের বিশ্লেষণ, দশ মাস দশ দিন সন্তান মাতৃ গর্ভে কোন ক্ষণে কী রূপ ধারণ করে তা যখন অবলীলায় বলে চলে, তখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে না থেকে উপায় আছে?

পলাকদার যুগী পর্বের গানের কথাই যখন আসলো তখন ভয়াবহ একটি আগাম অশনী সংকেতের কথা বলা যাক। পলানদার বয়স এখন সত্তরের ঊর্ধে, যুগী পর্ব গানের কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি নেই, নেই কোনো অডিও বা ভিডিও। পলানদারের মৃত্যুর সাথে সাথে এই অঞ্চলের যুগী পর্ব গানের মৃত্যু ঘটবে। শুধু যুগী পর্ব গানের কথাই বলি কেনো, ‘ঈমান যাত্রা’ আজ প্রায় ত্রিশ বৎসর যাবৎ এ অঞ্চলে হয় না। মহরমের কারবালার উপরে এই কাহিনি, খুবই জনপ্রিয়, কিন্তু এর লিখিত কোনো কিছুই নেই। এমন আর একটি পালা পুঠিয়ার বিখ্যাত ‘মিছিল গান’ও আজ আর মঞ্চায়ন হয় না। এই একজন লোক জীবিত আছেন যারা এসব কাহিনি জানেন কিন্তু এর কোনো চর্চা বা পৃষ্ঠপোষকতা নেই। বিলুপ্তির পথে লোকসংস্কৃতি অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি।

বছর দুয়েক আগে বারানই মুছাখা নদীর কূল দিয়ে হোজা নদী পেরিয়ে সোজা পাগলা নদীর পাড় ধরে এগিয়ে ইতোমধ্যে তিনটি থানা পেরিয়েছি। একটি অনেক বড় বিলের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে ঠিকানা খোঁজার চেষ্টা করছি। একদেল যাত্রায় কোলদের বাড়ি। পথ ফুরায় না, পরিশ্রান্তের মত এগুচ্ছি। ধান, খাল আর বিল শুকনো নদীর পাড় ধরে হাঁটছি। হঠাৎ বিচিত্র ফসলের উৎপাদন প্রক্রিয়া দেখে বিস্মিত হই। আমাদের অঞ্চলে সাধারণত আলু হয় মাটির নিচে। এই জায়গায় এসে দেখি আলু মাটির উপরে। আমি একজন চাষীকে জিজ্ঞাসা করলাম সমস্ত আলু উপরে কেনো? এরা কীভাবে আবাদ করে? তিনি আমাকে বললেন, কচুরীপানা দিয়ে আলুর বীজ ঢেকে দেয়া হয় এবং তারই নিচে আলু হয়। আমি জায়গাটির নাম জিজ্ঞাসা করলাম। নামটি বখতিয়ারপুর। সামনে মান্দা থানা ডান পাশে আত্রাই বাম পাশে বাগমারা। তিন থানার মোহনা, বিচিত্র তাদের ভাষার ধরন- কখনও আপনি, আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই। ঠিকানা অনুসারে যে বাড়িতেই যাই কেউ এদেল যাত্রার কথা স্বীকার করে না। আমি অবাক হই। হঠাৎ দেখি বাড়িঘরহীন শূন্য একটি মাঠ। মাঠ থেকে ধূলো বালি মাখা তিনজন মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি তাদের একদেল যাত্রার শিল্পীদের কথা জিজ্ঞাসা করি। তারা বলে- আমরা প্রায় মাস তিনেক কাজ কামহীন একঘরে হয়ে থাকি। পরে ওত (কাফফারা) পঁচিশ টাকা করে দিয়ে সমাজের সবার কাছে মাফ চেয়ে সমাজে উঠি। আমরা আবার গান করতে গেলে ওরা আবার আমাদের একঘরে করবে। আমরা না খেয়ে মারা যাব। আমি ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করি, এতে কী এমন আছে একদেল যাত্রাতে, যাতে ওরা আপনাদের একঘরে করলো? তারা যে কাহিনি বর্ণনা করলো তা এ রকম দাঁড়ায়, আল্লাহর সঙ্গে মুশা নবীর যে বাহাজ (যুক্তিতর্ক) তা নিয়েই এই কাহিনি। কাহিনিতে শিষ্যরূপী মুশা নবী বস্তুবাদের পক্ষ নেন। আর গুরুরূপী আল্লাহ হর বা ঈশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। গোল বৃত্তাকার থেকে বেরিয়ে এসে চৌদিকে ঘুরে ঘুরে একদেল যাত্রা অভিনীত হত। তিন থানার মোহনার বিচিত্র আঞ্চলিক ভাষায় এই জনপ্রিয় লোকপালা আর কখনও আমাদের পালায় ফিরে আসতে পারবে কি না জানি না। এরূপ আরো একটি লোকপালা ‘নীল বরজের কিচ্ছা’। পানের বরজ আর মাটির স্বাস্থ্য কামনা করে গাওয়া হত এ গান। এখন আর এ গান মঞ্চায়িত হয় না। গোরুক্ষু নাথের গান, তাও আজ নেই।

নব জাতক গরুর সুস্থাস্থ্য কামনা করে গোয়াল ঘরে খোল করতাল আর জুড়ির মাধুর্য্য কণ্ঠে যা গীত হত তা আর হয় না। এরূপভাবে বিলুপ্তির পথে লোকপালার মাঝে প্রচলিত পালার যে বিবর্তন হচ্ছে তার দিকে একটু দৃষ্টি দেয়া যাক। আমেেদর দেশে একটি জনপ্রিয় লোকপালা আলকাব, যার লোকভিত্তিক অর্থ হচ্ছে- আল অর্থ খোঁজ, কাব- অর্থ ঠাট্টা। আলকাব আগে ছিল শীবের গাজন, পরে শীব গাজনের গীত, শীব গাজনের গীত থেকে আলকাব। আলকাব থেকে আজকের অতি আধুনিক কালে গম্ভিরা। আলকাবের একাল সেকালের একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আলকাবের রসাত্মক মঞ্চায়ন গর্ভবতী কন্যার উদ্দেশে ছড়া কাটা হতো ধাঁধার মতো করে।

দোল দোল দুলোনী
ছোট বেলার খেলোনী
পাকলে সুন্দর হয়
ন্যাংটা হয়ে হাটে যায়।
এর অর্থ তেতুল।

এখনকার কালে আলকাবের একটি অতি আধুনিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। মামা ভাগ্নির প্রেম প্রণয়ের কাহিনি ‘বাড়ির পাশে চম্পা নদীর গুলা কাইশার বন, সেই বনেতে মামা আমার মজাইল মন’ এই হচ্ছে সার্বিক অর্থে সামগ্রিক অবস্থা।

এ যাবৎ শীতের শুরুতে আমি এবং পুঠিয়া থিয়েটার-এর সম্পাদক লেমন করমদোশী নামক গ্রামে যাত্রা দেখতে গিয়েছিলাম। বলে রাখা ভালো, করমদোশী লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। সেখানে এখনও দশটির মতো লোকপালা বিদ্যমান। ‘নছিমনের পালা’, ‘যুগীপর্ব’, ‘মেহের নেগার পালা’, ‘মনসামঙ্গল’ , ‘মাদার’, ‘লক্ষ্মীর গান’, ‘পদাবলী’, ‘অরুণ শান্তি’ প্রভৃতি। একটি অসাম্প্রদায়িক অঞ্চল হিসেবে এটি সর্বজন স্বীকৃত। ছেলে বুড়ো মিলে বাড়িতে গানের আসর বসে। দীনহীন গায়কের বাড়িতে পানি চাইলে যত কষ্টই হোক বাঙালির রীতি অনুযায়ী বসতে পিড়ে, খাওয়ার জন্য গুড়, মুড়ি, পানি দেয়। এরূপ একটি অঞ্চলে প্যান্ডেলে হাউজি নামক জুয়া চলছে। মধ্যরাতে হাউজি শেষ হলে যাত্রার টিকিট বিক্রয় শুরু হয়।

হঠাৎ বিকট শব্দে সনাতনী কর্ণেট ফুলটের বদলে সাউন্ড বক্সের ক্যাসিও নামক যন্ত্রের উৎপাত শুরু হয়। মিনিট বিশেক চলার পর, কর্ণ ফাটা শব্দ বন্ধ হয়। হঠাৎ দেখি ‘রূপে আমার আগুন জ্বলে যৌবন ভরা অঙ্গে’ গান গেয়ে মঞ্চে ১০/১২ বৎসরের একটি মেয়ের নাচন কুদন। খেয়াল করে দেখি মা জননীর যৌবন আসতে অনেক দেরি। নৃত্যের নামে গোটা দশেক  যে নৃত্য মঞ্চে প্রদর্শিত হলো তা অশ্লীলতাকেও ছাড়িয়ে যায়। রাত্রের মধ্যপ্রহরে শুরু হলো যাত্রা পালা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। একটি দৃশ্য মঞ্চায়নের পরেই খেয়াল করে দেখি দর্শকগণ হাজার বছরের সংস্কৃতির শিকড়ে প্রবেশ করেছে। দ্রুত পালা শেষ করার লক্ষ্যে দৃশ্য বাদ দিয়ে অন্য দৃশ্যে যাওয়ার চেষ্টা করলে দর্শকগণ কর্তৃপক্ষকে চেপে ধরছে। হঠাৎ কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক নৃত্য গীত দাবী করলে কাহিনিতে প্রবেশ করা দর্শক দ্বারা বাধার মুখে আমি আর লেমন যাত্রা মঞ্চ থেকে ফিরে আসি। এ যদি হয় পূন্য ভূমির লোকনাট্যের আঙ্গিনার দৃশ্য তাহলে আমাদের লোকনাট্যের অবস্থা কী? আমাদের লোকসংস্কৃতির সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে অবস্থা এ রকম দাঁড়ায়- আগে বাঙালি ছিল মাছে ভাতে বাঙালি, গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু ছিল। মোটামুটি আগেকার দিনে মানুষের অভাব ছিল কম তাই গ্রামের সবাই মিলে লোকসংস্কৃতির চর্চা করতো। কিন্তু বর্তমানে গরীব হচ্ছে আরো গরীব, ধনী আরো ধনী হচ্ছে, শোষণ প্রক্রিয়ার এই পরিস্থিতিতে ধনীরা লোকসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেন না, তারা অন্য মাধ্যমে অবসর সময় কাটান। দ্বিতীয়ত: সংস্কৃতি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে, এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে লোকসংস্কৃতির কোনোরূপ পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বা দর্শকের বিভাজন এই অধঃপতনের একটি বড় কারণ। আগেকার দিনে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বা স্যাটেলাইট মাধ্যমগুলো ছিল না, তখন আপামর জনগণ লোকনাট্যকে একমাত্র অবলম্বন মনে করতো। এখন সে দর্শক ও চারণগণ বিভক্ত হয়েছে নানাভাবে। অপরদিকে মানুষ অসাম্প্রদায়িক। এখন নানাভাবে মৌলবাদের উত্থানের জন্য লোকসংস্কৃতি চর্চা বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।

গত ভাদ্র মাসে ৮/১০টি মনসার গান দর্শন শেষে জামনগর গ্রামে ভাসান গান শুনতে যাই। বেশ কিছু সাওতাল পরিবার এই ভাসান গানের আয়োজন করে। আয়োজক ও শ্রোতৃগণের যে আবেগ দর্শন করি দীনহীন মানুষের ২৫টি টাকা ভাসান গান দলকে দিতে না পারার যে আকুতি প্রত্যক্ষ করি, তা লোকনাট্যের শেকড়কেই মনে করিয়ে দেয়। তমাল তলায় জুম্মার নামাজের আগ পর্যন্ত মনসার গান দর্শনে হাজির উদ্দিন হাজীর যে শ্রদ্ধা দেখেছি এবং হাজির উদ্দিনের ভাষায়- ‘৫০ বছর ধরে এ গান দর্শন করে বছরের মানত দিয়ে যাই’ এই উক্তির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত জাতহীন বাঙালি জাতির প্রতিধ্বনী হয়। তখনই পিছন ফিরে দেখা। বছর দুয়েক আগে নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ লোকনাট্য উৎসবে মনসামঙ্গল গানে আশরাফ আলীর মূল ভূমিকায় ও সনৎ কুমার সেন শিষ্যের ভূমিকায় অভিনয় দেখে বলেছিলেন- এটাই বাঙালি সংস্কৃতির লোকনাট্য। সেলিম আল দীন আলকাব গানের নৃত্য দেখে বলেছিলেন- অসাধারণ শৈল্পিক এক নৃত্য, আমার মাথা নুইয়ে দেয়। একশত টাকা গায়েনের কর কমলে রেখে সেলিম আল দীন বলেছিলেন- এ শিল্প যতদিন বেঁচে থাকবে বাঙালির মাথা কেউ নোয়াতে পারবে না। মঞ্চ কুসুম শিমূল ইউসুফ মনসা গানে উচ্চ মার্গের নৃত্য ও কণ্ঠশীলন দেখে বলেছিলেন- আমার মাজা ভেঙে যাবে। যদি মা কৃপা করেন তবেই মনসামঙ্গল করতে পারবো।

শেষ বলে কোনো কথা লোকনাট্যে নেই। যে মঞ্চে চারণগণ প্রতি নিয়ত তৈরি করে নতুন নতুন পালা, কোনো অপপ্রয়োগ ধ্বংস করতে পারবে না আমাদের সেই লোকনাট্য। তবে বিলুপ্ত প্রায় নাট্যসংরক্ষণ আর্থিকভাবে অসচ্ছল লোকশিল্পীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক সহযোগিতা দান, মেধাবী লোকশিল্পীদের জাতীয়ভাবে সম্মান প্রদান, গ্রামে গ্রামে লোকপালা পরিবেশনের জন্য চৌকোণ খোলা মঞ্চ নির্মাণ, বাদ্য যন্ত্রসহ যাবতীয় উপকরণ সহযোগিতা প্রদান, কমপক্ষে সারাদেশে ১৫টি গবেষণা কেন্দ্র বা একাডেমি গঠন করে লোকনাট্যকে নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও আমাদের উপর বর্তায় আগামী প্রজন্মের জন্য।

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

কাজী সাঈদ হোসেন দুলাল: নাট্যজন। সদস্য, পুঠিয়া থিয়েটার, রাজশাহী।