Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

আদিবাসী নাট্যোৎসব ২০০৭ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ

Written by অনুলিখন.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

[থিয়েটারওয়ালা গত ০৬ এপ্রিল ২০০৭, শুক্রবার, সকাল ১০:১৫ মিনিটে এক্সপেরিমেন্টাল হল, শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকায় আয়োজন করে এক মুখোমুখি অনুষ্ঠানের। উন্মুক্ত এই মুখোমুখি অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘আদিবাসী নাট্যোৎসব ২০০৭ : সরাসরি দর্শকের মুখোমুখি কলাকুশলীগণ’। অনুষ্ঠানে ২-৬ এপ্রিল’০৭ অনুষ্ঠিত আদিবাসী নাট্যোৎসবে প্রদর্শিত কানিয়া (সাদরী থিয়েটার), তূঞ (হড় গায়ান দল), শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন (মণিপুরী থিয়েটার) ও হক্কানীর ধনপানা (জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল) নাটকের নাট্যকার-নির্দেশক ও কলাকুশলীগণ সরাসরি দর্শকদের মুখোমুখি হন। থিয়েটারওয়ালা সম্পাদক হাসান শাহরিয়ারের সঞ্চালনে অনুষ্ঠানটি একটানা চলে দুপুর ২টা পর্যন্ত। পাঠকদের জন্য মুখোমুখি অনুষ্ঠানটি অনুলিখন করে ছাপা হলো এই সংখ্যায়। অনুলিখন করেছেন, থিয়েটারওয়ালা’র সহকারী সম্পাদক সাইফ সুমন]

হাসান শাহরিয়ার
সুধি দর্শক, এখন ১০ টা ১৫ মিনিট। শুরুতেই অভিনন্দন, যাঁরা সঠিক সময়ে উপস্থিত হয়ে আমাদের অনৃষ্ঠানকে সুন্দর করার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আমি মঞ্চে আহ্বান করছি মামুনুর রশীদ, ঝিমিত ঝিমিত চাকমা, মান্নান হীরা, মলয় ভৌমিক, নিমাই তিরকী, ফয়েজ জহির, কর্ণেলিয়াস হাঁসদা, শুভাশিস সমীর ও বৃন্দাবন দাসকে। দর্শক-সমালোচকদের উদ্দেশে একটা কথা বলতে চাই, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এধরনের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে প্রথম যখন প্রশ্ন আহ্বান করি তখন কেউ-ই প্রশ্ন করতে চান না। কিন্তু শেষের দিকে প্রশ্নবন্যার মুখে পড়তে হয় সঞ্চালককে। তাই আজকে অনুরোধ করবো, প্রথম থেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে আপনারা প্রশ্ন করে যাবেন। আজকে যে-নাটকগুলো নিয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছি সেগুলো গত ৩ দিনে মঞ্চস্থ হয়েছে এবং দর্শক কেবল একবার করেই এগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন। অনেকে হয়তো সবগুলো দেখার সুযোগও পান নি। তাই আমি নির্দিষ্ট না করে যেকোনো নাটকের উপর প্রশ্ন করার জন্য অনুরোধ করছি।

বিপ্লব বালা
[নাট্যজন, নাট্যশিক্ষক। সদস্য- জিয়নকাঠি]
আমরা যে আদিবাসী নাট্যগুলো দেখলাম, সেগুলোকে আদিবাসী নাট্য বলছি কী অর্থে? এটা কি ঐ জনগোষ্ঠীর নাটক? মানে তাদের তৈরি, তাদের রীতিতে? আমরা দেখেছি তারা শুধু অভিনয় করেছেন- তাহলে কী অর্থে আদিবাসী নাট্য বলা হচ্ছে? এটা আমার মামুন ভাইয়ের কাছে প্রশ্ন।

মামুনুর রশীদ
[নির্দেশক-কানিয়া, তূঞ]
আমরা যেভাবে নাটকগুলো তৈরি করেছি সেটা হলো, প্রথমে আমরা একটা ওয়ার্কশপ করেছি। সেই ওয়ার্কশপে আমরা আদিবাসীদের কাছ থেকে কতগুলো কাহিনী শুনেছি, গল্প শুনেছি। তাদের যে নাট্যরীতি বা আঙ্গিকগুলো আছে, পারফরমিং আর্টের যে রীতিগুলো আছে, সেগুলো যদ্দুর সম্ভব দেখেছি। ওয়ার্কশপে ইমপ্রোভাইজ করে একটি নাটক করা হলো। সেখানে আমাদের নাট্যকাররা উপস্থিত ছিলেন। তখন তাদেরকে বলা হলো এগুলো থেকে নিয়ে কোনো স্ক্রিপ্ট করা যায় কিনা। তারা করে দিলেন। তারপর সেগুলো নিয়ে আমরা রিহার্সেলে যাই এবং পড়ে শোনাই, বাংলায়। শোনানোর পর সেটার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন দেখা দিল। তাদের রীতির সাথে মিলছে কিনা, জীবন-যাপনের সাথে মিলছে কিনা, ইত্যাদি আমরা দেখার চেষ্টা করলাম। তারপর আমরা সেগুলোর অনুবাদ করলাম, যার যার ভাষায়। পরে রিহার্সেল আর অভিনয় শুরু হয়। সাদরী নাটকটি বৃন্দাবন দাস লিখেছিলেন, পরে তা তাদের ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মান্নান হীরা যেটা লিখলেন, রিহার্সেলে গিয়ে দেখা গেল অনেক জায়গায় মিলছে না। পরে মলয় ভৌমিক আর কর্ণেলিয়াস হাঁসদাকে দিয়ে আরও কাজ করিয়ে নাটকটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেল তূঞ। এখন কথা হচ্ছে, নাট্যকার এবং নির্দেশক দুজনই বাঙালি বা ঐ আদিবাসী জাতিসত্তার ভাষাভাষী নন। কিন্তু এমন তো হয় যে আমরা ইংরেজি নাটক বাংলা অনুবাদ করে, বাংলার নির্দেশক, অভিনেতা-অভিনেত্রী দিয়ে করাচ্ছি, সেটাও কিন্তু একটা বাংলা নাটক হয়ে যাচ্ছে। তো আমাদের নাটকগুলো দেখে দর্শকদের যদি মনে হয় যে, ঐ আদিবাসীদের দৃষ্টি, তাদের জীবন-যাপনগুলো প্রকাশিত হয়েছে, তাহলে এটা একটা সূচনা হতে পারে। ইনফ্যাক্ট এগুলো ওয়েস্টার্ন রীতিতেই করা হয়েছে। এটা একটা বীজ বপন করা হলো মাত্র। এরপর কিন্তু তাদের নিজেদের নাটক নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে। এবং আমার মনে হয় তারা অনেকটাই প্রস্তুত হয়েছে নিজেরাই নিজেদের নাটক নির্মাণের জন্য। ধন্যবাদ।

তানসেন
[নাট্যজন, দৃশ্যপট]
মামুন ভাই বললেন এই নাটকগুলোতে আদিবাসীদের জীবন-যাপন, তাদের কৃষ্টি তুলে ধরা হয়েছে। তাহলে এক্ষেত্রে বনপাংশুল বা রাঢ়াঙ কিংবা মানগুলাকে কি আমরা আদিবাসী নাট্য বলবো?

মামুনুর রশীদ
এ-নাটকগুলো বাঙালি দ্বারা নির্মিত ও অভিনীত নাটক। এবং সেখানে যে ভাষাটা ব্যবহৃত হয়েছে সেটা মান্দি ভাষা নয়, বা সাঁওতালি ভাষা নয়, সেটা আমাদের বাঙালিদের আঞ্চলিক ভাষা। তাহলে এটা আদিবাসী নাটক কেন হবে? আমার মনে হয় এগুলো বাংলা নাটক।

কামালউদ্দিন কবির
[নাট্যজন, নাট্যশিক্ষক। সদস্য- জন্মসূত্র]
প্রথমেই অভিনন্দন জানাই শ্রদ্ধেয় নাট্যজন মামুনুর রশীদকে- এরকম একটি নাট্য উৎসব আয়োজন করার জন্য। আমরা এই প্রথম আমাদের দেশের জাতিবৈচিত্র্যের যে নাট্য সংস্কৃতি সেগুলোর সমাহার দেখতে পেলাম। আমরা, বিশেষ করে নাট্যকর্মীরা উৎসাহিত হয়েছি, অনেক কিছু জানতে পেরেছি। কিন্তু বিপ্লবদা’র প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা আমার মনে হয় আমরা পাই নি। অর্থাৎ এই নাটকগুলোকে আমরা আদিবাসী নাট্য বলবো কিনা। এটার সাথে আমি একটা প্রশ্ন যোগ করতে চাই, আজকের মুখোমুখি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ও আয়োজককে। সঞ্চালককে প্রশ্ন করতে চাই একারণে যে, থিয়েটারওয়ালা কেবল একটি নাট্যপত্রিকা নয়, এই সময়ের নাট্য চর্চার ক্ষেত্রে এটি একটা বড় রকমের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে নাট্যচিন্তার ক্ষেত্রে এবং নাট্যচিন্তার যে আদান প্রদান, সেটার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা পালন করছে এই থিয়েটারওয়ালা। আজকের আয়োজনটিও সেটার একটা উদাহরণ। সঞ্চালক সূচনা উপস্থাপনায় যেটা বললেন যে, আদিবাসীদের দ্বারা অভিনীত নাটক এবং খুব সচেতনভাবেই বললেন, কিন্তু আপনার ব্যানারে দেখা যাচ্ছে ‘আদিবাসী নাট্যোৎসব ২০০৭’- কোনো উদ্বৃতি চিহ্ন ছাড়াই। তো আমার প্রশ্ন হচ্ছে আপনি মনে করেন কিনা যে, আপনার আয়োজনের দিক থেকে, আপনার দায়িত্বের দিক থেকে যে এটা আদিবাসী নাট্য এবং সেই উৎসব নিয়ে আমরা কথা বলছি?

হাসান শাহরিয়ার
সরাসরি মুখোমুখি সঞ্চালক হাঃ হাঃ। ধন্যবাদ কবিরকে, আমিও যে প্রশ্নের বাইরে না, সেটা আমাকে ধরিয়ে দেবার জন্য। আমার দিক থেকে কথা হচ্ছে, আমি কিছু সিলেক্টিভ নাটক নিয়ে, তার কলাকুশলীদেরকে দর্শকের মুখোমুখি দাঁড় করাই। ঢাকার মঞ্চে নামা নতুন নাটক নিয়ে এর আগে আমি দুটো অনুষ্ঠান করেছি। কিন্তু মঞ্চে নতুন আসা সব নাটক সেখানে ছিল না। কোনো না কোনো ক্রাইটেরিয়া ঠিক করে আমরা নাটক নির্বাচন করেছি, কিন্তু নাম দিয়েছি- ঢাকার মঞ্চের আসা নতুন নাটকের মুখোমুখি অনুষ্ঠান (এই জাতীয়)। এটা হচ্ছে অনুষ্ঠানটির একটা শিরোনাম ঠিক করবার জন্য। এবার আদিবাসী নাট্যোৎসব হলো, প্রশ্ন থাকতে পারে এগুলো আদৌ আদিবাসী নাটক কিনা বা এধরনের উৎসবেরও আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এধরনের প্রশ্ন আজকের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের উদ্দেশে প্রযোজ্য হবে না। কারণ, আমরা ক্রাইটেরিয়া ঠিক করেছি, এই উৎসবে আদিবাসীদের দ্বারা অভিনীত নাটকগুলো নিয়ে কেবল মুখোমুখি হবো, অন্যগুলো নয়। এবং যেহেতু উৎসবে প্রদর্শিত নাটক, সেহেতু আমরা ব্যানারেও উৎসবটির কথা উল্লেখ করেছি। কিন্তু কোনোভাবেই থিয়েটারওয়ালা দাবী করছে না যে, এই আদিবাসীদের দ্বারা অভিনীত নাটকগুলো আদিবাসী নাট্য হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে। সংজ্ঞায়িত হবে কী হবে না, সেটা যারা মুখোমুখি হচ্ছেন তারা বলতে পারবেন। ধন্যবাদ।

কামালউদ্দিন কবির
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এবার আমরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, মানগুলা এবং রাঢ়াঙ এ ভিন্ন ক্যাপশন লাগানো হয়েছে। সেটা হলো যথাক্রমে- ‘হাজং নাটক মানগুলা’ এবং ‘সাঁওতালি নাটক রাঢ়াঙ’-এধরনের নাম নতুন করে দেয়ার কারণ কি?

মামুনুর রশীদ
আসলে এটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত ছিল বা এটা আদৌ ঠিক হয়েছে কিনা- এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। রাঢ়াঙ হচ্ছে সাঁওতালদের নিয়ে নাটক আর মানগুলা হচ্ছে হাজংদের নিয়ে নাটক। এখন- ‘হাজংদের নিয়ে নাটক মানগুলা’ এবং ‘সাঁওতাালদের নিয়ে নাটক রাঢ়াঙ’-এধরনের নাম দিলে হয়তো ঠিক হতো। কিন্তু যে নামই দিই না কেন, এটা দাবী করা যাবে না যে এগুলো হাজং বা সাঁওতালি নাটক।

বিপ্লব বালা
নাটক একটা শিল্প মাধ্যম। তার কাহিনী কাঠামো থাকে এবং তার উপস্থাপন থাকে। তো কাহিনী কাঠামো বা উপস্থাপন, এর কোনোটাই কি ঐ আদিবাসী গোষ্ঠীর? আপনি নিজেই বলছেন কাঠামোতে ইউরোপীয় ছাপ আছে। তাহলে এগুলো কী করে আদিবাসী নাট্য হবে?

মামুনুর রশীদ
না, কাহিনী কাঠামো কিন্তু ওদের উপস্থাপনায় হয়েছে। দেখবে নৃত্য বা সংগীতের যে ব্যবহার, সেটা আদিবাসীদের থেকেই উঠে আসা। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে ওদের সংস্কৃতিটা উঠে এসেছে কিনা, সেখানে কোনো নাগরিকের ছাপ আছে কিনা।

বিপ্লব বালা
সংস্কৃতিটা উঠেছে নাগরিক রীতিতে, রিয়েলিস্টিক রীতিতে, রিয়েলিস্টিক উপস্থাপনায়। ওরা যখন কাহিনী বলে তা কিন্তু অন্য কাহিনী বলে মনে হয়।

মামুনুর রশীদ
কাহিনী কাঠামোতে ন্যারেটিভ স্টাইল আছে, সেটা আমরা ব্যবহারও করেছি।

হাসান শাহরিয়ার
উত্তরের বৈচিত্র্যের জন্য আমরা বোধহয় নাটকগুলোর সাথে নির্মাণে আরও যারা জড়িত ছিলেন তাদের কথা শুনতে পারি। আমি নাট্যকার মান্নান হীরাকে বলতে অনুরোধ করছি।

মান্নান হীরা
[নাট্যকার- তূঞ]
আমি যে নাটকটির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম তার খানিকটা ব্যাখ্যা মামুন ভাই দিয়েছেন। প্রথমে সাঁওতালদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ হয়। ওয়ার্কশপে তাদের গান, নৃত্য, কিছু কিছু রিচ্যুয়াল এবং কিছু ইম্প্রোভাইজেশন- তাদের জীবনের নানা ঘটনা, অতীত ঘটনা, বর্তমান ঘটনা নানাভাবে ব্যাখ্যা হচ্ছিল। ওরা খুঁটে খুঁটে বলছিল, কীভাবে তারা নিপীড়িত হয় আবার কীভাবে ওরা আন্দোলন করে ইত্যাদি। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে একটি কাহিনী লেখার যখন সুযোগ হলো-

বিপ্লব বালা
ওদের নিজেদের কোনো কাহিনী উপস্থাপন দেখেছিলেন?

মান্নান হীরা
হ্যাঁ, দেখেছি।

বিপ্লব বালা
সেটা কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন?

মান্নান হীরা
সেটা নাটকের কোনো কোনো জায়গায় কাজে লাগিয়েছি।

বিপ্লব বালা
মানে সেই কাঠামো?

মান্নান হীরা
হ্যাঁ, কোনো কোনো জায়গায় লাগিয়েছি, সব জায়গায় না। অনেক জায়গাতে তো আমাদের রীতিটাই ব্যবহার করা হয়েছে। নির্দেশক এ ব্যাপারে ভালো বলতে পারবেন।

বিপ্লব বালা
কিন্তু আমাদের রীতিটা কী অর্থে বলছেন?

মান্নান হীরা
আমাদের বলতে আমরা ঢাকার মঞ্চে যেটা দেখি সেটার কথা বলছি।

মামুনুর রশীদ
আমি ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই, সেটা হচ্ছে, নাটকের একটা জায়গায় দেখেছেন যে ওরা কয়লাখনির অফিস থেকে ফিরে এসে দেখলো তাদের আর এখানে থাকা হচ্ছে না, তখন তারা একটা রিচ্যুয়াল করে- তারা আকাশ, বাতাস, প্রকৃতিকে বলছে- তোমরা আমাদের রক্ষা কর। নাটকে কিন্তু আমরা একেবারে ওদের রিচ্যুয়ালটাই রেখে দিয়েছি। ওরা বিপদগ্রস্থ হলে প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করে। সেটা কিন্তু হুবহু রেখে দিয়েছি। হুবহু মানে থিয়েটারের মত করে হুবহু। তারপর ‘সেহরাই’- মানে যে ভালো তীর মারতে পারে, সেটাকে হুবহু রেখেছি, বিভিন্ন উৎপাদনের সময় ওরা যে সংগীত করে সেগুলোকে রেখেছি ...

বিপ্লব বালা
এগুলো তো উপাদন হিসেবে এসেছে, কাঠামো হিসেবে না। মানে বিপদগ্রস্ত হলে ওরা কী করে, সেটা কি এসেছে?

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, বললাম না বিপদগ্রস্ত হলে যা করে, উৎপাদনের সময় যা করে, তার কিছু কিছু তো নাটকে এসেছে। শোন, ওদের মধ্যে ইনফ্যাক্ট ওয়েস্টার্ন থিয়েটার নেই।

বিপ্লব বালা
থাকার কথাও না।

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ, নেইও। কাঠামোর কথা যেটা বলছো, ওদের নাট্যরীতি বলতে ওরাল ট্র্যাডিশন আছে- কথক গল্প বলছে ইত্যাদি আর আছে নানা রকমের উৎসব পার্বণ। তাদের কারাম উৎসব হয়। আমরা সেটা নাটকে এনেছি, কিন্তু উল্লেখ করি নি যে কারাম উৎসব দেখাচ্ছি। কারণ কাহিনী কাঠামোতে যে রিচ্যুয়ালগুলো আনা গেছে, সেটা এনেছি। কিন্তু আমরা তৈরি করেছি মূলত নাটক, কৃত্য নয়।

জাহিদ রিপন
[নাট্যজন। সদস্য- স্বপ্নদল]
যে আলোচনাটা চলছে এটা সহজ, আমরা চাইলে এটা দীর্ঘায়িত করতে পারবো। আমার মনে হয়- যেটা জাতিগত থিয়েটার, যেটা এথনিক থিয়েটার নামে সারা বিশ্বে স্বীকৃত, সেটা যখন আমরা আধুনিক নাট্যকর্মীরা, আমরাই করবো বা ওদের সাথে মিলে করবো, তখন ওটা হবে নিউ এথনিক থিয়েটার বা নব্য জাতিগত থিয়েটার। বিষয়টা এভাবেই মীমাংসা করা যায় যে, জাতিগত থিয়েটার একান্তগত তাদের জীবন আচরণের সাথে সম্পর্কীত। আমরা যখন এটাকে আধুনিক মঞ্চে আনবো তখন তাদের সাথে নিয়েও করতে পারি অথবা আলাদাভাবেও করতে পারি, তখন সেটা নব্য জাতিগত থিয়েটার হবে। ধন্যবাদ।

হাসান শাহরিয়ার
নির্মাণের ব্যাপারে মলয়দাকে কিছু বলতে অনুরোধ করছি।

মলয় ভৌমিক
[নাট্যকার-তূঞ]
সাঁওতালি ভাষার যে নাটকটি ... আমি ভাষার কথাই বলছি, যেহেতু নাট্য কথাটা নিয়ে সমস্যা হয়েছে, আমি নাটক নিয়েই কথা বলি। প্রথম কথা হচ্ছে যাদের নিয়ে নাটক লিখবো, তাদের সম্পর্কে কিছু জানলাম না, বুঝলাম না, তা তো হয় না। একটা তথ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে যে সাঁওতাল ভাষাভাষীরা বসবাস করেন বা অন্য ভাষাভাষীরা, যেমন- সাদরী ভাষাভাষী আছেন, তারা নিশ্চিতভাবে আদিবাসী এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এই আদিবাসীদের উত্তরাঞ্চলে অবস্থান একশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে। কেউ রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার সময় কাজ করার জন্য এসেছিল। কেউ সাঁওতাল বিদ্রোহের পর পালানোর জন্য চলে এসেছিল। কেউ স্থানীয় জমিদারদের বনজঙ্গল কেটে চাষ উপযোগী করে দেয়ার জন্য এসেছিল। এভাবে তারা এসে খণ্ড খণ্ডভাবে অবস্থান নেন বিভিন্ন জায়গায়। তো এখানে আজকে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে সেটা কিন্তু এখানে যে আদিবাসী উপস্থিত আছেন, কর্ণেলিয়াস হাঁসদা, সাঁওতালি, তিনি দিতে পারতেন। কিন্তু আমার সন্দেহ আছে তিনি দিতে পারবেন কিনা। কারণ তাদের সত্তা বা সংস্কৃতিটা ঠিক যেভাবে বিকশিত হওয়ার কথা ছিল, সেটা ততটা হয় নি বলে আমার মনে হয়। এটা একটা সংকট বটে। এই সম্প্রদায়ের একটা উৎসব হয় ‘কারাম উৎসব’। কারাম উৎসবে দেখেছি সেখানে একটা গল্প বলা হয়- মানে বনের দেবতার প্রতি তাদের অর্ঘ্য উচ্চারিত হয়। কিন্তু ঐ গল্প বলার ঢংটিও আমার মনে হয়েছে যে, সেটা তাদের না। আবার ওখানে রামায়ণ যেভাবে বলা হয়, বা পাঁচালী যেভাবে বলা হয়, অনেকটা এরকমই। তাহলে তাদের নিজস্ব রীতি আমি কীভাবে উদ্ধার করবো বা জানবো কীভাবে? এই প্রক্রিয়ায় দুইমাস আগে তারা আরেকটি নাট্য নির্মাণ করেছে- সেটাও কর্ণেলিয়াস হাঁসদা করেছে, সেটাও তাদের পছন্দ মত, মানে তারা যেভাবে করতে চায় সেভাবেই করেছে। তাতেও দেখা গেছে তূঞ নাটকের মতই হয়েছে। এখন এটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবো? কী নাম দেব সেটা বড় কথা না, আমার মনে হয় তারা নিজস্ব রীতিকে কীভাবে অনুসন্ধান করবে সেটাই জরুরি। এখানে গত কয়েকদিনে কিছু সেমিনার হয়েছে, সেখানে দেখেছেন যে- তাদের বর্ণমালার সংকট আছে, ধর্মীয় বিষয় নিয়েও সংকট আছে। এমনও দেখা গেছে একদল কারাম উৎসব করলে অন্যদল করে না, এটা করার অধিকার তাদের নেই। তো আপনি আমি কী গবেষণা করবো? এধরনের অনেক সংকট তাদের মধ্যেও আছে। সেকারণেই আমরা মূলত নাটক করিয়েছি তাদেরকে দিয়ে। করতে করতে তারা যখন নিজেরা লিখতে পারবে, নির্দেশনা দিতে পারবে, তখন তারাই তাদের ঐতিহ্য থেকে সংযোজন করবে। এত দ্রুত বোধহয় কিছু হবে না।

ফয়েজ জহির
[নির্দেশক- হক্কানীর ধনপনা]
আসলে সময়ের সাথে সাথে ভাবনা চিন্তার পরিবর্তন হতে থাকে। মামুন ভাইয়ের সাথে আমি যখন প্রথম রাঙ্গামাটি যাই, তখন ১৫ দিন ছিলাম ওখানে। এই ১৫ দিনে চাকমা, তনচংগাসহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর সাথে পরিচয় হওয়ার একটা চেষ্টা ছিল। তারপর দীর্ঘ অপেক্ষার পর ’৯৮ এ হাক্কানীর ধনপনা নাটকটি করি যখন ওদের প্রথম আদিবাসী মেলা হয়, সেখানে। কিছু সংকট আছে, আমি বললে বুঝতে সুবিধা হবে। ওদের যে বিভিন্ন ফর্ম আছে- যেমন ডেংগুলি গান, এটা সারারাত ধরে হতে থাকে। এই ফর্মগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিজস্ব কিছু বাদ্যযন্ত্র আছে যেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন- হেংগম আছে, দুদুক আছে। দুদুকটা তাদের জীবনে বেঁচে থাকার সাথে যুক্ত। পাহাড়ীরা যখন চাষাবাদের জন্য দূরে চলে যায়, তখন যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে হচ্ছে এই দুদুক। বাঁশ দিয়ে করে একটা বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয়, আমরা সেটা ব্যবহার করেছি। এটা দিয়ে তারা জুম চাষের সময় পাখি তাড়ায়। আমরা মুড়ং বাঁশি ব্যবহার করেছি। পোশাকে আমরা অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর পোশাকও ব্যবহার করেছি, কারণ এই নাটকটি চাকমারা করলেও ওখানে যে আরো জাতিগোষ্ঠী আছে ওদেরও ভাবনা চিন্তা এটাতে জড়িত। তবে কাজ করতে গিয়ে আমিও দেখেছি ... একটু আগে মলয় দা’ও বললেন যে, তারা নিজেদের জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বাঙালি হয়ে যাবার চেষ্টা করেছে। আমি তাদের ওখানে ঘুরেছি এবং বলেছি যে, নাটকে আপনাদের রিচ্যুয়াল আনতে হবে। বানানো যেন মনে না হয়। আমি পোশাক, মিউজিক সব পরিকল্পনাতেই তাদের শিল্পীদের ইনভলব করেছি। তারপরও যেহেতু নিজেদের কালচার থেকে তারা অনেকটা বেরিয়ে এসেছে, ফলে প্রোডাকশনটা দেখলে অনেকটা নাগরিক থিয়েটারের ছাপ পাওয়া যায়।

হাসান শাহরিয়ার
ঝিমিত দা’র কাছে জানতে চাইবো আপনারা একজন বাঙালি এবং নাগরিক নির্দেশক দিয়ে কাজটা করিয়েছেন, তো এতে আপনাদের নাট্যটা কতটুকু বেরিয়ে এসেছে?

ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
[নাট্যজন। সদস্য- জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল]
ধন্যবাদ। আসলে নির্দেশক হিসেবে আমরা হয়তো বাঙালিকে নিয়েছি কিন্তু মূল ভাবনাটা আগাগোড়াই আমাদের। আমরা নাটক শুরু করি ১৯৮১ সাল থেকে। আগে আদিবাসীদের ভাষায় নাটক হতো না। এটা আমরা বাঙালিদের কাছ থেকে শিখেছি। পরে মামুন ভাই বললেন, তোমরা শুধু বাঙালিদের অনুকরণ করে নাটক করবে কেন, তোমাদের নিজস্ব যেসব শিল্পরীতি আছে সেগুলোকে কাজে লাগাও। এ ব্যাপারে জহির ভাইকেও বিশেষ ধন্যবাদ উনিও খুব সহযোগিতা করেছেন।

বিশ্বজিৎ ঘোষ
[নাট্যজন, নির্দেশক। সদস্য- ঢাকা পদাতিক]
আমার জানার ছিল যে, আপনারা পারফরমার সিলেক্ট করেছেন কোন পদ্ধতিতে?

কুমার প্রীতিশ বল
[নাট্যজন, নাট্যকার। সদস্য- ঢাকা পদাতিক]
আমরা এখানে তূঞ নাটকে দেখলাম বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, বাঙালিদের বোঝানোর জন্য। নাট্যকার-নির্দেশক বাঙালি বলেই এটা হয়েছে কিনা? আরেকটা প্রশ্ন, এখানে আদিবাসী নাট্য উৎসবে আদিবাসী নাটকের পাশাপাশি মানগুলা, রাঢ়াঙ আসলো কেন?

মঞ্জুর রশীদ বিদ্যুৎ
[নাট্যজন। সদস্য- ঢাকা পদাতিক]
আমার ২ টি প্রশ্ন। প্রথমটি মামুন ভাইয়ের কাছে- আমরা জানি উত্তরবঙ্গের বেশ ক’টি অঞ্চল থেকে বেশ কিছু ছেলে-মেয়েকে একটা জায়গায় এনে এই প্রোডাকশনগুলো করা হলো। তো এই উৎসব শেষ হয়ে গেল, ভবিষ্যতে এই নাটকগুলোর কনটিনিউশন কীভাবে থাকবে? মানে এই নাটকগুলোর ভবিষ্যত কী? আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন- আমরা সব সময়ই বলে থাকি, আদিবাসীরা নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে মেইন স্ট্রিম কমিউনিটির দ্বারা। এই নাটকগুলোও যেহেতু মেইন স্ট্রিম লোকদের দ্বারা নির্মিত, সেখানে আমরা দেখেছি অবচেতন মনেই অনেক বাঙালি সংস্কৃতি ঢুকে গেছে। আমরা কবে দেখতে পাবো যে, নাটক রচনা, নির্দেশনা সব কিছুতেই আদিবাসীরাই জড়িত? এর জন্য আমাদের করণীয় কী?

হাসান শাহরিয়ার
প্রথমে হাঁসদাকে অনুরোধ করবো বাংলা ভাষা এবং বাঙালি নির্দেশক নিয়ে কথা বলার জন্য।

কর্ণেলিয়াস হাঁসদা
সম্মানিত সুধি। প্রথমে আমার জোহার নিবেন। আসলে আমাদের সাঁওতাল সম্প্রদায়ে নাটক বা থিয়েটার ছিল না বা নেই বললেই চলে। আসলে বাংলাদেশে সাঁওতালিরা যেভাবে নির্যাতিত হচ্ছে সেটা তো বাঙালিদের দ্বারা এবং উপকৃতও হচ্ছে বাঙালিদের দ্বারা। এবং আমাদের এখানে বাঙালিও বাস করে, সাঁওতালিও বাস করে। যার জন্য এই দুই নাটকে বাংলা এবং সাঁওতালি ভাষা মিশিয়ে করা হয়েছে।

মামুনুর রশীদ
কুমার প্রীতিশ বল যে প্রশ্নটা করেছে তার উত্তরে বলি যে, নাটকে বাঙালি চরিত্র যে ক’টি আছে তারা বাংলায় বলেছে। আর তূঞ নাটকে সূত্রধরকে দিয়ে বাংলা বলিয়েছি, বাইল্যাঙ্গুয়েজ করার চেষ্টা করেছি, কমিউনিকেশনের স্বার্থে। দর্শকের সাথে কমিউনিকেট করার জন্য।

হাসান শাহরিয়ার
কিন্তু ঢাকার এই দর্শকের জন্য তো নাটকটা নির্মিত হয় নি। ওরা যেখানে দেখাবে তারা তো সাঁওতালি ভাষা জানে, তাই না?

মামুনুর রশীদ
ওখানে ওরা ঐ ভাষাতেই করবে। আর মঞ্জুর রশীদ যে জানতে চাইলেন, এগুলোর ভবিষ্যত কী? আমার কথা হচ্ছে একটা কাজ শুরু তো হলো। এর ভবিষ্যত কী হবে সেটা আপাতত আমারও জানা নেই। তবে এরপর যদি তাদের মধ্য থেকে ডিরেক্টর তৈরি হয়, নাট্যকার তৈরি হয় ... নাট্যকার হিসেবে এখানে কর্ণেলিয়াস আছেন, নিমাই তিরকী আছেন, দেখা যাক তারা যদি চালিয়ে যান তো এগুলো টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাদের মিউজিক আর নাচ বেশ সমৃদ্ধ। সব মিলিয়ে থিয়েটার তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ আছে। আরেকটা প্রশ্ন ছিল মানগুলা আর রাঢ়াঙ কেন এই উৎসবে বা ওদের নাটকগুলো আদিবাসী নাটক কিনা? আসলে আমাদের নূরলদীনের সারাজীবন কি বাংলা নাটক না? এটা তো ওয়েস্টার্ন ফর্মে লেখা এবং উপস্থাপন করা। এবং আমাদের নাগরিক থিয়েটার তো ওয়েস্টার্ন ফর্মেই হয়। কিন্তু যা উপস্থাপিত হয়, সেগুলো নিশ্চয়ই বাংলা নাটক। তো আদিবাসীদের দ্বারা অভিনীত নাটকগুলো আদিবাসী নাটক বললে ক্ষতি কী? ওদের যে রিচ্যুয়ালগুলো আছে সেগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে, কিন্তু সেগুলো নাটক না বা থিয়েটার না। এখানে যা করলো সেটা থিয়েটার করেছে, নাটক করেছে। এজন্যই বলছি আদিবাসী নাট্য। আর এই উৎসবে ওদের জীবনাচরণ বা বিদ্রোহ নিয়ে আমাদের নাগরিক দলগুলো যে নাটক করেছে তার মধ্যে দুটো নাটক রেখেছিলাম। এর বেশি কিছু না। আর দেবাশীষের প্রশ্নের উত্তর হলো- আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আদিবাসীদের এনে একটা ওয়ার্কশপ করেছি। সেখানে যাদেরকে মনে হয়েছে থিয়েটার করতে পারবে তাদেরকেই কাস্ট করেছি।

বিপ্লব বালা
তাহলে ওদের কোনো থিয়েটার নেই? এই প্রথম করা হলো?

মামুনুর রশীদ
হ্যাঁ।

বিপ্লব বালা
ওদের কোনো রকমের পারফরমেন্স নেই?

মামুনুর রশীদ
তাতো আছেই। কিন্তু পারফরমেন্স থাকা মানেই তো নাটক বা থিয়েটার থাকা না। ওদের কিছু ওরাল ট্র্যাডিশন আছে, নৃত্য, গান আছে। সেগুলোকে সমন্বয় করে আমরা থিয়েটার নির্মাণের চেষ্টা করেছি।

বিপ্লব বালা
কিন্তু ওদের অভিনয় দেখে তো মনে হলো অনেকেই বেশ শক্তিশালী অভিনেতা-অভিনেত্রী। সেটা কী করে হলো?

মামুনুর রশীদ
ওদের বডি লাইন কিন্তু সাংঘাতিক! ওরা প্রায় প্রত্যেকই কৃষি কাজ করে। আবার ওদের বার মাসে তের পার্বণ আছে। সেখানে ওরা নাচে, গায়। ফলে অভিনয়ের জন্য যে শরীর দরকার সেটা ওদের প্রায় তৈরি হয়েই আছে। এমন কি আমাদের যে অভিনয়টা তুলতে ১০ দিন লাগে, সেটা ওদের লাগে ১/২ দিন। ওদের বডি খুব রেসপন্স করে।

বিপ্লব বালা
ওদের যে বার মাসে তের পার্বণ আছে, সেগুলো দেখতে পেলে বেশি ভালো লাগতো না?

মামুনুর রশীদ
কিন্তু আমরা তো সেগুলোর উৎসব করি নি। থিয়েটার করতে চেয়েছি। তবে ওদের রিচ্যুয়ালের ব্যবহার হয়েছে সব নাটকগুলোতেই।

কামালউদ্দিন কবির
আমি ঝিমিত দা’কে প্রশ্নটা করতে চাই। ঝিমিত দা’ বলছিলেন আমাদের তো নাটক ছিল না। বাঙালি নাগরিক নাট্যশিল্পীদের কারণেই আমরা নাটক করলাম। এই কথার প্রতিধ্বনি মামুন ভাইয়ের কথাতেও পেয়েছি। এখন ঝিমিত দা’ কি আমাদের বাঙালি নাগরিক শিল্পীরা যেভাবে নাটক করি সেই নাটক ছিল না বলছেন (চাকমাদের)? এটা আমার প্রশ্ন। এই প্রসঙ্গে একটু মনে করিয়ে দিতে চাই ১৭৯৫ সালে লেবেদেফ যখন আমাদের এখানে একটা বিদেশি নাটক অনুবাদ করে প্রথম মঞ্চস্থ করলেন বাংলাতে এবং সেই নাটক থেকে আমাদের এখানে একটা ইতিহাস তৈরি হয়েছে ... অবশ্যই ভুল ইতিহাস যে বাংলা নাটকের শুরু হয়েছে ঐ মঞ্চ থেকে। তার মানে তখন মনে করা হয়েছিল যে, বাঙালিদের আসলে নাটক ছিল না। তো আপনাদের ব্যাপারটাও এমন কিনা? চাকমাদের নিজস্ব কোনো নাটক নেই? আরেকটা বিষয় বলি, সেটা আমার মন্তব্য বলতে পারেন। সেটা হলো ৪ টা নাটকের মধ্যে একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন টাতে আদিবাসী নাট্যের  ছোঁয়া পাওয়া যায়, অন্যগুলোতে আরেকটু গবেষণা করলে হয়তো ঐ নাট্যের কাছাকাছি যাওয়া যেত।

ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
আমাদের কোনো নাটক নাই, কিন্তু পারফরমেন্স আছে। মানে এই যে থিয়েটার বলছি সেটা আমাদের ছিল না। পারফরমিং আর্টের মধ্যে ডেংগুলি আছে, সামনে বিজু আসছে ইত্যাদি। যদিও সেগুলো দিন দিন বদলে যাচ্ছে। ওগুলোতেও অভিনয় আছে কিন্তু এমন থিয়েটারের মত করে না।

ফজলে রাব্বি সুকর্ণ
[নাট্যজন। সদস্য- স্বপ্নদল]
বান্দরবানের লুলাইনপাড়া, যেখানে মারমারা বাস করে, যারা বাংলা কিছুই জানে না, বোঝে না তাদের একটা থিয়েটার আছে, অনেকদিন ধরে চর্চা করে আসছে। সেখানে আমি একটা পালা দেখেছি, নাম জা। সেটা মন্দিরের সামনে হয়। তিনদিকে দর্শক বসে, এবং জা পরিবেশিত হয়। আরেকটা অভিজ্ঞতা আছে ধোবাওরা ঘোষ গ্রামের হাজংদের বাড়ির উঠানে এরকম একটা পালা দেখেছি মহীশাশুর বধ। সেখানেও দেখেছি পেছনে একটা স্ক্রীন, নাটকের সাথে সম্পর্কিত আল্পনা আঁকা, দর্শক বসে তিনদিকে। তো ঝিমিত দা’ যে বললেন ১৯৮১ সালের পর থেকে থিয়েটার হয়েছে তা বোধহয় না। তো আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায় যে ওরা ওখানে তিনদিকে দর্শক বসিয়ে থিয়েটার করে। আমার ঢাকার দুটো নাটকও মানগুলা আর রাঢ়াঙ তিন বা চারদিকে দর্শক বসিয়ে উপস্থাপন করা হয়। অথচ আদিবাসী নাটকগুলোকে প্রসেনিয়ামে উপস্থাপন করা হলো। কেন ওদেরকে কি ওদের মত করে উপস্থাপন করালে ভালো হত না? যে-কেউ জবাব দিতে পারেন।

ঝিমিত ঝিমিত চাকমা
আমি আবারও বলছি, আমাদের অনেক পারফরমেন্স আছে যা বংশ পরম্পরায় আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই যে থিয়েটার, যেটাকে থিয়েটার বলছি, সেটা পেয়েছি ১৯৮১ সালের পর থেকে।

মামুনুর রশীদ  
একটা নন ইস্যুকে ইস্যু করার প্রবণতা আমাদের এখানে অনেকের মধ্যে আছে। সেটা হলো কথায় কথায় আমাদের রীতি দেশজরীতি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা। কোনো শিক্ষিত বাঙালি কোনোদিন বলে নি যে আমাদের দেশে পালা, হাস্তর, গাজীর গান, কবি গান, যাত্রা, কীর্তন ইত্যাদি ছিল না। আমাদের সংস্কৃতিতে এই শিল্পগুলোর উপস্থিতি বহু আগে থেকেই। এগুলো লেবেদেফ আনেন নি। লেবেদেফ যেটা এনেছেন সেটা হলো থিয়েটার। এবং এই থিয়েটার শব্দটাই ওয়েস্টার্ন। ওয়েস্টার্ন থিয়েটারটাকে বাংলাদেশে ইনট্রুডিউস করেছেন লেবেদেফ, তো সেই ক্রেডিটটা তাকে দিতে আমাদের এত আপত্তি কেন? এগুলো আমার মনে হয় অযথা বিতর্ক তৈরি করা। আমাদের নাগরিক জীবনে যে শিল্পচর্চাটা করছি সেটা থিয়েটারই করছি। জারি গান করছি না, যাত্রা পালা করছি না, কবি গান বা এসব কিছুই করছি না। কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য থেকে, এই ফর্মগুলো থেকে আমরা অনেক কিছু নিচ্ছি এবং নিয়ে কিন্তু থিয়েটারটাই করছি। এটা স্পষ্ট হওয়া দরকার যে, আমাদের এখানে নাট্য ছিল, থিয়েটার কোনো সময়েই ছিল না। আর থিয়েটারটা লেবেদেফই ইনট্রুডিউস করেছে। আরেকটা কথা হলো যাই ইনট্রুডিউস করি না কেন, তা জীবনের সাথে মিশে যেতে হবে, জীবনাচরণের সাথে মিশে যেতে হবে। তবেই সেটা সার্ভাইভ করবে। আমাদের এই শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে কিছুদিন আগে লোকনাট্য উৎসব হয়েছে। একেবারে মূল ফর্মে, মূল শিল্পীরা করেছে। আমাদের ভালো লেগেছে, কিন্তু এটা আরও ভালো লাগে যখন ওরা ওদের ওখানে করে। সঙযাত্রা থেকে উপাদান নিয়ে আমি নাগরিক থিয়েটার করেছি সঙক্রান্তি। কিন্তু মূল সঙযাত্রা উপস্থাপন করতে গেলে ওদেরই করতে হবে এবং ওদের সামনেই করতে হবে। তো থিয়েটার তাকে ধ্বংস করতে পারবে না আবার সে-ও থিয়েটার ধ্বংস করতে পারবে না। আদান-প্রদান হবে, এনরিচ হবে কিন্তু কেউ কাউকে অস্বীকার করতে পারে না। কামালউদ্দিন কবির যে বললো যে- ভুল ইতিহাস রচিত হয়েছে, কথাটা ঠিক না। এদেশে ওয়েস্টার্ন প্রসেনিয়াম থিয়েটার প্রথম ইনট্রুডিউস করেছেন অবশ্যই লেবেদেফ। এর আগে এদেশে এ-ধরনের থিয়েটার ছিল না। এবং এ-ও বলি এধরনের থিয়েটার ছিল না বলে এটা মনে করার কারণ নেই যে আমরা শিল্পের দিক থেকে দরিদ্র ছিলাম।

হাসান শাহরিয়ার
আরেকটা প্রশ্ন ছিল, আদিবাসী নাটকগুলো তিনদিকে দর্শক দিয়ে করলেন না কেন?

মামুনুর রশীদ
কেবল শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন টা করা যেত। অন্যগুলো ওভাবেই তৈরি। কোনো না কোনো কারণে মূল হলে করতে হয়েছে বলে ওভাবে করেছি।

মলয় ভৌমিক
এ প্রসঙ্গে আমার একটা কথা আছে। সংস্কৃতিতে যদি বিনিময় না থাকে তাহলে সেই সংস্কৃতি কি বিকশিত হয়? আমি সাঁওতালদের সাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি ওরা সুখের সময় যে মুখভঙ্গি করে, দুঃখের সময়ও একই মুখভঙ্গি করে। তো যদি এক্সপ্রেশনে পরিবর্তন না আনে কী করে অন্যকে বোঝাবে? এই জায়গায় ওদের বিকশিত হওয়ার কি কোনো প্রয়োজন নেই? তাদের নিজস্ব সত্তার মধ্য থেকেই বিকশিত হতে হবে, কিন্তু বিকশিত হতে হবে তো? একটা জাতি অবিকশিত হতে পারে। আমরাও কি বিকশিতই ছিলাম? এক সময় আমরা অন্যদের দ্বারা বিকশিত হওয়ার পথ দেখেছিলাম। তারপর আমাদের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এসেছেন, মাইকেল এসেছেন, রবীন্দ্রনাথ এসেছেন। ওদের জীবনেও এমন বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজন আছে। আর তা পেতে হলে এখন যদি আমাদের কাছ থেকে তারা কিছু নেয় তাতে ক্ষতি কী? এই যে বলা হচ্ছে লেবেদেফের আগেও আমাদের নাট্য ছিল, সেটা বলার জন্যও তো আমাদের বিদ্যাসাগর, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ পেতে হয়েছে। তো আদিবাসীরাই একদিন বলুক না যে না ১৯৮১ সাল না তার আগে থেকেও তাদের নাট্য ছিল। আমি বাঙালি হিসেবে এটা বললে তো তাদের কোনো উপকার হবে না। ধন্যবাদ।

সৈয়দ শামসুল হক
[সব্যসাচী লেখক]
আমি আজকে আসলে এখানে এসেছি শুনতে। কারণ, শোনাটাও কিন্তু আমার কাজের একটা আবশ্যিক অংশ। সবার কথা শুনবো এবং এই শোনা থেকে ভাববো এবং এই ভাবনা থেকে হয়তো পরবর্তী কাজের কিছু সংকেত পাবো। যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, আদিবাসী- তাদের সম্পর্কে নাটকের মানুষেরা, শিল্পের মানুষেরা উৎসাহী হয়েছে কবে থেকে? এর ইতিহাস কিন্তু খুব নিকটে। এটা ২য় মহাযুদ্ধের পর থেকে যখন উপনিবেশগুলো স্বাধীন হতে শুরু করলো তখন থেকে। এবং স্বাধীনতা যখন পেলাম আমরা- কী ভারতে, কী আফ্রিকায়, কী ল্যাটিন আমেরিকায়- তখন যেটা হলো এই যে প্রাগ্রসর যারা, সংখ্যাগরিষ্ঠ যারা, তারা দৃষ্টি দিতে শুরু করেছে এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দিকে। এই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, এই আদিবাসীদের দিকে। এবং এটা আমার কথা না, সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন যে, এখানে একটা চাতুরী ঘটেছে- রাজনৈতিক চাতুরী ঘটেছে। সেটা হচ্ছে এই, যখন যারা দেশটা চালাচ্ছে, শাসন করছে, তারা দেখছে যে ঐখানে ছোট ছোট আগুন জ্বলছে। তখন এই অসন্তোষ, নির্যাতন, নিপীড়ন ঠেকাবার জন্য এই সাংস্কৃতিক গ্র“পগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক সময় অজান্তে, না জেনে এই বড় জনগোষ্ঠী থেকে সাংস্কৃতিককর্মী, বিশেষ করে নাট্যকর্মীরা, তারা এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে গেছে। গিয়ে বলেছে- তোমরা আমার ভাই, তোমাদের ভেতরে অনেক জিনিস আছে, তোমাদের শিল্পের ঐতিহ্য বেশ রিচ ... মানে একটা মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের মধ্যে। চাতুরীটা হচ্ছে- তাদেরকে দিয়ে তাদের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য কোনো রকম শক্তি তৈরি করা হয় নি। এবং আজকের আলোচনাতেও এসেছে যে, ওদের রিচ্যুয়ালগুলো- নাচ, গানগুলো ব্যবহার করে একটা রূপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে করে এটা ওদের থিয়েটার মনে হয়। কিন্তু এটার একটা অসুবিধার কথা বলি। আদিবাসীদের রিচ্যুয়ালগুলোর কিন্তু একটি বাস্তবিক শেকড় আছে। যেমন- কোনো একটা জনগোষ্ঠী যদি বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করার জন্য একটা নৃত্য করে থাকে, সেই নাচাটা কিন্তু নট এ্যাজ এন এন্টারটেইনমেন্ট। তারা বৃষ্টি আনার জন্য নাচে। সেটা যখন সেখান থেকে তুলে এনে মঞ্চে ব্যবহার করা হয়, তখন যদি এর প্রাসঙ্গিকতাটা না আনা যায়, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা মিনিংলেস হয়ে যাবে। শুধুই অলংকারের মত মনে হবে। আর শেকড় সন্ধান নিয়ে যে কথাগুলো শুনলাম- এটা কিন্তু ইদানিং বেশ চালু শব্দ মনে হচ্ছে। শেকড়ের মধ্যে কিন্তু অনেক পঁচা জিনিসও থাকে। আর শেকড়ের সন্ধান করা এটা আলাদা করে বলার কিছুই নাই। আমরা প্রত্যেকেই যে যেখানে কাজ করছি, যে মাধ্যমে কাজ করছি, কেউই শেকড়কে বাদ দিয়ে কাজ করছি না। সবাই মাটির উপর দাঁড়িয়েই কাজ করছি। সেই মাটিটাই শেকড়। যদি শেকড় ছিন্নই হতো তাহলে ওগুলো টিকলো কেন? যা হারিয়ে যায়, তা তার শক্তি নেই বলেই হারিয়ে যায়। শিল্পের ভেতরে যদি শক্তি থাকে, সেই শক্তির জোরেই সে টিকে যাবে। যাক এসব কথা। সব শেষে আমার একটা জানার ব্যাপার আছে- এই নাটকগুলো যখন ঐ ভাষায় ঐ মানুষগুলোর সামনে উপস্থাপিত হয় তখন তারা কীভাবে রেসপন্স করে? আমরা যখন ওদের সাথে কাজ করবো, তখন যেন খেয়াল রাখি, সচেতন থাকি যেন আমাদের ধ্যান-ধারণা বা কাঠামো ওদের উপর চাপিয়ে না দিই। ধন্যবাদ।

বিপ্লব বালা
মামুন ভাই বলার আগে আমি একটু বলি। হক ভাই শিল্পের টেকাটেকি নিয়ে বলছিলেন। আর্ট ফর্ম কি কেবল নিজের শক্তির জোরেই টেকে? আমরা কি জানি না, বুঝি না, বিশ্বে টিকে যাওয়া মানে কী বোঝায়? এই যে রাজনীতি, ক্ষমতা, এই ক্ষমতাই বলে দেয় কে টিকবে আর কে  টিকবে না।

সৈয়দ শামসুল হক
না টেকে এই জন্যই যে, কমিউনিকেট করতে পারে। যে-কোনো আর্টের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে টু কমিউনিকেট, টু মেক এ লিংক, টু ক্রিয়েট এ ব্রিজ। টেকাটা কোনো কৌশলের জন্য না, কোনো উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ার কারণে না। আর শিল্পে দেয়া নেয়ার অভ্যাসটা করতে হয়। উপন্যাস আমাদের ট্র্যাডিশনে ছিল না। কিন্তু আজকে উপন্যাসকে কি কেউ ওয়েস্টার্ন বলবে? যেহেতু সে কমিউনিকেট করতে পারছে, সেহেতু সে টিকে যাচ্ছে।

বিপ্লব বালা
কমিউনিকেশন প্রশ্নে যদি বলেন, তাহলে কমিউনিকেশন বাস্তবে কোনটা হয় বা কাদের সাথে হয়? আমাদের যে বিভিন্ন ফর্ম আছে সেগুলো কি কমিউনিকেট করে না? রাতের পর রাত ওরা এগুলো দেখে কি কমিউনিকেট না করলে? কিন্তু তারপরও সেগুলো হারিয়ে যাচ্ছে কেন? এখানে ক্ষমতা একটা ফ্যাক্টর না?

সৈয়দ শামসুল হক
আমরা প্রত্যেকেই কিন্তু কাজ করি একটা টার্গেট নিয়ে, যে, আমরা এদের সাথে কমিউনিকেট করতে চাই। যদি সেই কমিউনিকেটটা করতে পারি তাহলে আমার কাজ টিকে যাবে।

বিপ্লব বালা
কিন্তু আমাদের দেশের নানা রীতিতে কমিউনিকেশনে কোনো সমস্যা দেখছি না। তাহলে সেগুলো টিকছে না কেন? এটা তো ক্ষমতার প্রশ্ন।

সৈয়দ শামসুল হক
না ক্ষমতা না, আর যদি ক্ষমতা হয়ে থাকে সেটা শৈল্পিক ক্ষমতা।

বিপ্লব বালা
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষমতা না?

সৈয়দ শামসুল হক
না, এটা শিল্পের নিজস্ব ক্ষমতা। শিল্প রাজনৈতিক ক্ষমতায় যদি টিকতো, রাজনৈতিক প্রয়োজনে যদি টিকতো, তাহলে পৃথিবীর বহু দেশে সাংস্কৃতিক চেহারা অন্য রকম হতো।

কামালউদ্দিন কবির
যেহেতু টেকাটেকির একটা প্রসঙ্গ এসেছে, তাই বলতে হচ্ছে- নাট্যশিল্পটাই হচ্ছে সব কিছু গ্রহণ করে, তাতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য এগুলো কখনোই কোনো বাধা তৈরি করে না। আমরা গ্রহণ করছি, কমিউনিকেট করছে বলেই। এটা ঠিক আছে। কিন্তু টিকে যাওয়ার প্রসঙ্গে যদি বলি তাহলে বলতে হয় অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক চাপের ফলে অনেক কিছু টিকে যায়, আবার অনেক কিছু হারিয়ে যায়।

জাহিদ রিপন
এর সাথেই যুক্ত করে আমি একটু বলতে চাচ্ছি- এই টেকাটেকি প্রসঙ্গেই। টেকাটা শিল্পের শক্তিতে টিকবে কিনা এই বিষয়টা আধুনিককালে সত্যিই ভাববার বিষয় বলে মনে করি। আমরা আদিবাসীদের কাছে যাচ্ছি, ওদের শিল্পটা টেকানোর জন্য। এখন যদি আমরা না যাই, আর ১০/২০ বছর পর ওদের শিল্পটা যদি না টেকে, তখন কি বলবো যে ওদের শিল্পের শক্তি ছিল না? উপনিবেশ যেসব অঞ্চলে ছিল সেখানে শিল্পের শক্তিটাই একমাত্র শক্তি না, সেখানে রাজনৈতিক শক্তিটাও অনেকখানি কাজ করে, টিকে থাকার জন্য।

হাসান শাহরিয়ার
আমি আবার একটু আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে চাই। আমি বৃন্দাবন দাসের কাছে জানতে চাইবো তার আদিবাসী নাটক রচনার প্রক্রিয়াটা কী ছিল? আর নিমাই তিরকীর কাছে জানতে চাইবো, আপনি কি কেবল অনুবাদ করেছেন অনুবাদের স্বার্থে, নাকি নাটকটা আপনার মাটির, আপনার নিজস্ব নাট্য মনে হয়েছে বলে?

বৃন্দাবন দাস
[নাট্যকার- কানিয়া]
এখানে বিতর্কটা বেশ জমেছে যে- এটা আদিবাসী নাটক কিনা। এই নাটকটা লেখার দায়িত্ব যখন পাই তখন তাদের ওয়ার্কশপে যাই। সেখানে তারাই কাহিনীটা দাঁড় করিয়েছে, তাদেরই কাহিনী। আমি লিখেছি তাদেরই কাহিনী। তবে এটা ঠিক ওয়েস্টার্ন থিয়েটারের একটা প্রি-কন্সেপশন মাথায় ছিল। এটা আমি অস্বীকার করছি না। পাণ্ডুলিপি তৈরির পর ওরাই নাটকটা করেছে। সেখানে নির্দেশক যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে তার ফলে নাটকটা তাদের নাট্য হয়ে উঠেছে কিনা, সেটা তারা এবং দর্শক বলতে পারবেন। আর একটা প্রসঙ্গে আমি একটু বলতে চাই- এখানে একটা বিতর্ক উঠেছে যে, তাদের আদৌ কোনো থিয়েটার ছিল কিনা। ঝিমিত দা’ বলেছেন আমাদের কাছ থেকে থিয়েটারটা পেয়েছেন। সেটা নিয়েও তর্ক উঠেছে। কিন্তু আমার কাছেও মনে হয় দীর্ঘদিন ওনারা জীবন-যাপন যে প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে অতিবাহিত করেছেন, তাতে তাদের জীবনে আসলেই কি কোনো নাটক করার মতো সুযোগ ছিল? সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঝিমিত দা’ হয়তো অবচেতনভাবেই বলেছেন- ওনাদের কোনো থিয়েটার ছিল না। আর আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমার বাবা রামমঙ্গল নামে একটা পারফরমেন্স করতেন, গ্রামে। প্রতি মাসে অন্তত ১০টা পারফরমেন্স উনি করতেন। এটা ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে বন্ধ হয়ে গেল। মাসে ১টা, তারপর ৬ মাসে ১টা । এখন হয় না। অথচ সব ধর্মের মানুষ এটা উপভোগ করতেন, অনেকে বাবার কাছে শিখতে আসতেন। কিন্তু বাবার পর এখন ঐ পারফরমেন্সটা আর কেউ দেখে নি। চাটমোহরের কথা বলছি আমি, সেখানে এখন থিয়েটার করা যায় না, ওসি এসে ধরে নিয়ে যায়। হুলিয়া জারি করে ইত্যাদি। তো এভাবে যদি আগামী ২০/২৫ বছর চলে এবং থিয়েটারটা না হয়, পরে পরের প্রজন্মের কেউ যদি বলে যে আমাদের এখানে থিয়েটার নাই বা ছিল না, তাহলে তাকে কি দোষ দেয়া যাবে? সেকারণেই বলছি, ওদের আসলে এখন থিয়েটার বলতে যা বোঝায় তা নেই। এবং আমরা শুরু করলাম, হয়তো ওয়েস্টার্ন ফর্মেই শুরু করলাম, তারপর ওরা যদি নিজেরা শিক্ষিত হতে পারে, তারা তাদের রীতিটাকে ঠিকই আবিষ্কার করে নেবে। ধন্যবাদ।

নিমাই তিরকী
ছোটবেলা থেকেই আমি একটু সংস্কৃতিমনা ছিলাম। সুযোগ পেলেই এই দিকে কাজ করেছি। মামুন ভাই যখন এই নাটকের মহড়া চালান, তখন উনি আমাকে বললেন যে- নিমাই তুমি দায়িত্ব নাও, এটা অনুবাদ করো তোমাদের ভাষায়। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম। বৃন্দাবন দাস দা’র নাটক আমাদের সাদরী ভাষায় আনতে খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আমাদের ভাষায় দাড়ি, কমা, প্রশ্নবোধক চিহ্নগুলো মিলাতে পারছিলাম না। তবু একটা কিছু দাঁড় করিয়ে আমাদের ভাষার অন্যদের দেখালাম। ওনারা বললেন ভালোই হয়েছে। এর আগে আমি সাদরী ভাষায় একটা নাটক লিখেছিলাম। সেটা সমস্যা হয় নি। কিন্তু অনুবাদ করার সময় ঝামেলা হয়েছে। আমাদের যতি চিহ্ন আর আপনাদের যতি চিহ্ন এক না হওয়ার কারণে।

জনৈক
শুভাশিস সমীরকে প্রশ্ন, আপনি যে সুর ব্যবহার করেছেন, সেটা কিন্তু আসল মণিপুরী সুর না। আপনার কী মত?

শুভাশিস সমীর
আমি প্রথমে একটু আগের প্রসঙ্গ নিয়ে বলি- এরকম উৎসব যদি আবারও হয় তখন তার শিরোনাম ইংরেজিতে রাখার জন্য। এথনিক থিয়েটার ফেস্টিভাল বা বাংলায় করলে ‘নৃ-জাতিগত থিয়েটার উৎসব’ বলা যেতে পারে। এখানে আদিবাসী, উপজাতি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি মণিপুরী কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মণিপুরীদের আদিবাসী বা উপজাতি কোনোটাতেই ফেলা যাবে না। এই বিষয়টা একটু বলতে চাই যে, ভারতে মণিপুরী একটি বিকশিত জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশে তারা অভিবাসী- মাত্র আড়াই’শ বছর আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে আসাম, ত্রিপুরা হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তাই ব্যাপারটা এথনিক থিয়েটার বললে আর ঝামেলা থাকবে না। আরেকটি বিষয়, এখানে হক ভাই বলেছিলেন যে, আমরা কৃত্য বা রিচ্যুয়াল করে থাকি মঙ্গল কামনা বা পূণ্যলাভের জন্য, এবং সেভাবেই পারফরমেন্সগুলো করি। তা ঠিক আছে কিন্তু আমরা যখন পারফরমেন্স করি তখন কিন্তু সচেতন থাকি যে, একটা পারফরমেন্স করছি। এবং দর্শক এটা উপভোগ করছে, সেটা মাথায় থাকে। প্রশ্ন এসেছে যে, আমি নাটকে আসল সুর কেন রাখি নি। আমার উত্তর হচ্ছে মূল মণিপুরী যে সুর, সেটা এখনকার তরুণ-তরুণীরা কোনোভাবেই অক্ষুণ্ন রেখে গাইতে পারবে না। সেটা এতটাই ক্ল্যাসিক্যাল ঘরাণার সংগীত, যারা শুনেছেন বা রাসলীলা যারা দেখেছে তারা জানবেন। একজনকে শৈশব-কৈশর থেকে সেটিকে রপ্ত করতে হবে। একজন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ হিসেবে এখন সব কিছু বাদ দিয়ে এটার পেছনেই লেগে থাকাটা সম্ভব না। আমরা দেখেছি সৈয়দ জামিল আহমেদ ইসলাম উদ্দিন পালাকারের পারফরমেন্স অনুকরণ বা মডিফাই করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ইসলাম উদ্দিন পালাকার হয়ে ওঠা কিন্তু যায় নি। কারণ সেটা হওয়ার জন্য যে জীবন পদ্ধতি থাকা দরকার, যে সংগ্রাম থাকা দরকার, সংগ্রামের সাথে শিল্প-ভাবনাকে মেলানোর বিষয়টা, সেখানে যেতে আদৌ পারছি কিনা এটা একটা প্রশ্ন। আমি মণিপুরী হয়েও পরিবর্তিত হতে হতে মূল মণিপুরীর কাছে এখন আর যেতে পারবো কিনা সন্দেহ। তাই এমন একটা সুর ব্যবহার করেছি, যেটাতে পারফরমাররা অভ্যস্ত।

মলয় ভৌমিক
সমীরের কাছে একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি। কামালউদ্দিন কবির একটা বিষয় উত্থাপন করেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন প্রযোজনাটিকেই একমাত্র আদিবাসী নাটক মনে হয়েছে। আমার একটু জানার আছে- এটার কন্টেন্ট এবং ফর্ম ... এটা তো আর্যদের ব্যাপার। আর আমাদের এখানে আদিবাসীদের মূল কনফ্লিক্ট তো আর্যদের সাথেই। তাহলে কী অর্থে বলা হচ্ছে এটাকেই একমাত্র আদিবাসী নাটক মনে হয়েছে?

কামালউদ্দিন কবির
উৎসবে যে নাটকগুলো প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলোর সব ক’টিতেই ওয়েস্টার্ন থিয়েটারের ছাপ আছে এবং ওগুলো যারা নির্মাণ করেছেন তারাও একথাই বলেছেন। কিন্তু একমাত্র শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন নাটকটিতে রাধা-কৃষ্ণ বিষয়টা এবং মণিপুরী সংস্কৃতির সঙ্গে মিলে যাওয়া, সবটা মিলিয়ে ওদের নাটকই মনে হয়েছে।

শুভাশিস সমীর
অনেকে ভাবতে পারেন এই প্রোডাকশনে মুণিপুরী কোথায়? মণিপুরী আসলে অন্তরের দিক থেকে এবং রিদমের মধ্যে। এই প্রোডাকশনটা আমরা ৩০ জন অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়ে করেছিলাম- পৌনে ৩ ঘন্টার প্রোডাকশন ছিল। সেটি গ্রামের দর্শকদের জন্য। শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের ১৩ টি খণ্ড নিয়ে আমরা ২ বছর ধরে কাজ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে করতাম। এখন ঢাকায় যখন নাগরিক দর্শকের সামনে করবো, তখন এটাকে অনেক মডিফাই করে, মাত্র ৭ জন পারফরমার দিয়ে করিয়েছি। এখানে দেখবেন যে, রাধা-কৃষ্ণের চলনের ভঙ্গির মধ্যেই মণিপুরী নাচের ধরনটা রাখার চেষ্টা করেছি। মানে শরীরের মধ্যে ভাষাটা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। আর আমি যদ্দুর জানি রাধা-কৃষ্ণ একটা লোককাহিনী, সেটা আর্যদের না।

বিপ্লব বালা
বাংলাদেশের বৈষ্ণবদের কাছ থেকেই এই কাহিনী এসেছে। কাজেই এটা বাংলার জিনিস, কাহিনী, সুর এবং নাচ। কিন্তু বাঙালি সমাজে নাচ তো মরে গেছে। আর এই কাহিনীটাকে প্রান্তিক বলা ঠিক না। এই জনপদে কিন্তু কাহিনীটা পরিচিত এবং সুরটাও পরিচিত। মলয় দা’র কথা ধরে বলি- রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী আর্যদের না, আর্যরা পরে নিয়েছে। পরে নিয়ে ধর্মীয় বানিয়েছে। কিন্তু এটা তো প্রেম কাহিনী, লোককাহিনী।

আর আমি আগের একটা প্রসঙ্গে বলি- এখানে বলা হয়েছে শেকড়ে পঁচা আছে। হ্যাঁ, পঁচা আছে ভালোও আছে। আমরা ভালোর সন্ধান করতে বলছি। কিন্তু আমরা শেকড়হীনভাবে যা করছি, ডাল-পালা, ফুল-ফল- এগুলো তো পুরোটাই পঁচা। পচন ধরানোই তো মূল উদ্দেশ্য। বাজারের, ক্ষমতার মূল উদ্দেশ্য হলো একেকটা প্রোডাক্ট তৈরি করো আর পঁচাও। আর প্রোডাক্টের নাম দিতে হয় ‘নাটক’। কেন নাটক বলতে হবে কেন সবগুলোকে? যারা দেশীয় রীতির কথা বলছে, নিজস্ব রীতির কথা বলছে, তারা সব কিছুকে ‘নাটক’ নাম দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের নিজস্ব ফর্মের প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা নাম আছে। ওগুলোকে নাটক বলতে হবে কেন? নাটক তো শহরে আমরা যে চর্চাটা করছি সেগুলো।

জনৈক
[নাট্যজন। সদস্য- প্রাচ্যনাট]
আমার প্রথম প্রশ্ন বন্ধু সমীরের কাছে। আমার কাছে মনে হয়, জাতি, সে যত ক্ষুদ্রই হোক বা বড়ই হোক সেটা সংখ্যা দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। কোনো জাতি নিজেদের শিল্পচর্চা বিকাশের ক্ষেত্রে প্রান্তিক বলে আরেকটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক উপকরণ সংযুক্ত করা কতটুকু যৌক্তিক? আরেকটি প্রশ্ন ফয়েজ জহির ভাইকে- আপনার নির্দেশিত হক্কানীর ধনপনা-তে দেখলাম প্রত্যেকটি এন্ট্রি ও এক্সিট নৃত্য ও গীত দিয়ে হয়েছে। হয়তো পাহাড়ী সংস্কৃতির একটা ব্যাপার, কিন্তু নাচ বা গানের মাধ্যমে প্রবেশ ছাড়া ওদের জীবনের অন্য কিছু ব্যবহার করা যেত না?

জনৈক
এর সাথে আমি একটা প্রশ্ন করতে চাই, মলয় দা’কে- আপনি বলেছেন ‘অবিকশিত জাতিসত্তা’, তো ওদের থিয়েটারের বিকাশটা হয়তো হয় নি কিন্তু একটা জাতি আসলেই কি অবিকশিত থেকে গেছে? আমরা বাঙালি জাতিই তাহলে পূর্ণ বিকশিত জাতি বলতে পারবো? আমাদের মধ্যে মামুন ভাই নাটক লিখেন, সৈয়দ হক লিখেন, তাঁরা বিকশিত। আমরা তো লিখতে পারি না। ফলে আমরা কি অবিকশিত? আজকে যখন আমি সঞ্জীব দ্রং বা প্রশান্ত ত্রিপুরার লেখা পড়ি, আমার কাছে কখনোই মনে হয় না তাঁরা অবিকশিত।

মলয় ভৌমিক
আমি আপেক্ষিক অর্থে কথাটা বলেছি। কিছু অবস্থা বর্ণনার জন্য কোনো কোনো শব্দের আশ্রয় নিতেই হয়। আমি মূলে কোথায় যেতে চাচ্ছি সেটাই মুখ্য।

জনৈক (ঐ)
সেই জায়গাটা থেকেই আমার প্রশ্ন যে, আমরা কলম দিয়ে কাজ করবো, কিন্তু কলমটা যেন খুড় না হয়ে যায়। একটা জাতিসত্তা নিয়ে কাজ করা কিন্তু দুঃসাহসের ব্যাপার। আমি আপনি কিন্তু ঐ জাতির উত্তরাধিকার নই। উত্তরাধিকার সূত্রে ওরাই ঐ জায়গাটা অনুধাবন করতে পারলে ভালো হয়।

মেজবাহ কামাল
[অধ্যাপক]
আমি এই বিষয়টা নিয়ে একটু বলতে চাই, আসলে কোনো জাতিকে বা তার সংস্কৃতিকে অবিকশিত বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। এবং আমরা যেহেতু বড় জাতির প্রতিনিধিত্ব করি, সেখানে এটার মাধ্যমে আমাদের কর্তৃত্বের প্রকাশ হতে পারে। বরং তাদেরকে ডিজএ্যাডভানটেজড বা বাংলায় বললে সুবিধাবঞ্চিত বলা যেতে পারে।

জনৈক (ঐ)
সুবিধাবঞ্চিত কোন দিক থেকে?

মেজবাহ কামাল
রাষ্ট্রের দিক থেকে।

ইফতেখার পলাশ
[সাংবাদিক,  দৈনিক সমকাল]
আমার ধারাবাহিক ৩ টি প্রশ্ন আছে। এখানে সাঁওতালি যে নাটকটা হয়েছে- ওটার নামের উচ্চারণ একেকজন একেক রকম করেছেন। কর্ণেলিয়াস হাঁসদা বলবেন, এটার মূল উচ্চারণটা কী?

কর্ণেলিয়াস হাঁসদা
এর আসল উচ্চারণ ‘তূণ’, লিখেছি তূঞ।

মলয় ভৌমিক
আমরা আসলে নাম দেয়ার সময় চিন্তা করেছিলাম এমন একটা শব্দ, যে শব্দ বাংলাতেও আছে সাঁওতালি ভাষাতেও আছে। বাংলায় তূণ শব্দের অর্থ তীর রাখবার আধার, আর ওদের তূঞ অর্থ নিক্ষিপ্ত তীর। ওরা তূঞ লিখলেও উচ্চারণ করে তূণ।

ইফতেখার পলাশ
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন বৃন্দাবন দাস দা’র কাছে। কাণিয়া নাটকটার মধ্যে কুসংস্কারটা ফোকাস করা হয়েছে। ওদের ইন্টারনাল কনফ্লিকশনটা বেশি আনলে ভালো হতো না? কুসংস্কার তো সর্বজনীন বিষয়। এটা মুসলমানদের ভেতর আছে, হিন্দুদের ভেতর আছে আবার ওদের মধ্যেও আছে। এটাকে ফোকাস করার কারণ কী? আমার তৃতীয় প্রশ্ন- এটা প্রশ্ন না, আমার মন্তব্য বলতে পারেন। আমার মনে এই উৎসবে গ্র“প থিয়েটার ফেডারেশানকে ইনভলব করা উচিত ছিল। যদিও এখানে এ্যাকশন এইড, অক্সফাম-সহ অনেকে জড়িত, কিন্তু এধরনের নাটকের ভবিষ্যত কী হবে সেটা একটা বিষয়। এবং একারণে এখানে ফেডারেশান জড়িত থাকলে ভালো হত।

হাসান শাহরিয়ার
অনেক প্রশ্ন জমা হয়ে গেছে। আমি একটু মনে করিয়ে দিই। শুভাশিস সমীর উত্তর দেবে নিজেদেরকে প্রান্তিক বলা নিয়ে। তারপর ফয়েজ জহির, তারপর বুন্দাবন দাস।

শুভাশিস সমীর
প্রান্তিক বলেছি কোন জায়গা থেকে সেটা বুঝতে হবে। এখানে বসে নিজেদের প্রান্তিক বলেছি। এবং এর মানে এই না আমরা আমাদের প্রান্তিক বানিয়েছি। রাষ্ট্রই তার আচরণের মাধ্যমে প্রকাশ করে যে, আমরা প্রান্তিক। আমি যে প্রান্তিক বললাম, সেটা আমি স্বীকার করি না, আমি বোঝাতে চাচ্ছি ক্ষমতার ব্যবহার দিয়ে আমাদের প্রান্তিক বানানো হয়ে থাকে। ধন্যবাদ।

ফয়েজ জহির
অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রবেশ এবং প্রস্থানে নাচ ও সংগীতের পুনঃপুন ব্যবহার ছিল, সেটা স্বীকার করছি। চাকমারা নাচের জায়গাটায় একটু দুর্বল বা দেহের ভাষা প্রকাশের জায়গা থেকে তারা দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারে নি। তারা অনেক দূর দূরান্ত থেকে এসে মহড়া করে এবং ব্যাপারটা অনেক ব্যয়বহুলও বটে। এমনিতেই তারা অর্থনৈতিক সংকটে থাকে। তাই নিয়মিতভাবে শিল্প চর্চার সাথে জড়িত থাকাটা একটা সংকটের বিষয়। সেজন্য বিভিন্ন মুদ্রার নাচ বা গান করানোটা সম্ভব হয় নি। সেটা আয়ত্ব করতে যে সময় দিতে হয় সেটা ওদের দ্বারা দেয়া সম্ভব হয় নি।

বৃন্দাবন দাস
প্রশ্নটি ছিল কুসংস্কারকে কেন হাইলাইট করা হলো। আসলে যারা শক্তিশালী, যারা দখল করতে চায়, তারা বিভিন্ন সময় ধর্মকে, কুসংস্কারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। এটাই তুলে ধরতে চেয়েছি, কুসংস্কারকে হাইলাইট করতে নয়।

মেজবাহ কামাল
উৎসবে যে ৪ টি নাটক প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলো নিয়ে আমার একটু কমেন্ট আছে। প্রথমেই এই অনবদ্য প্রডাকশনগুলোর কলাকুশলী ও নির্মাতাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। প্রথমত, যে সাদরি নাটকটি দেখলাম সেখানে দেখা গেল আদিবাসী সমাজে ক্লাশ এক্সপ্লয়েটেশনটা খুব জোড়ালোভাবে এসেছে। এবং মনে হচ্ছে সেটাই বোধহয় শোষণের প্রধান ফল। কিন্তু আসলেই কি আদিবাসী সমাজগুলো এতটাই শ্রেণী বিভক্ত? নাটকে জানগুরু যাদের নিয়ে শোষণটা করে তারাই কি প্রধান শোষক, নাকি এখানে বাঙালি শোষকরা আছে? ওখানের শোষকরা কিন্তু বাঙালি শোষকদের কোলাবরেটর হিসেবে থাকে, নেপথ্যে বাঙালি শোষকরা থাকে। সেভাবে আনা যেত কিনা? দ্বিতীয়ত, সাঁওতালি যে নাটকটা হয়েছে, সেখানে যখন কয়লাখনি প্রসঙ্গটা এলো, তখন গোটা নাটকটাতেই একটা চমৎকার মাত্রা পেল। কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই যেন নাটকটা শেষ হয়ে গেল। মানে আরোপিতভাবে এলো এবং শেষ হয়ে গেল। কয়লাখনি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। আনু মুহম্মদ ভাই প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এই কয়লাখনি ওখানকার মানুষের কাছে কী, এই বিষয়গুলো আরো জোড়ালোভাবে আসতে পারতো বোধহয়। তৃতীয়ত, চাকমা নাটকের বেলায় আমার মনে হয়েছে একজন বাংলাভাষী সূত্রধর রাখা যেত কিনা?

ফয়েজ জহির
এই নাটকটি কিন্তু রাঙ্গামাটির দর্শকদের জন্য নির্মিত। এই উৎসবের জন্য নয়। ওখানে কিন্তু যারা বাঙালি আছেন, তারাও ভাষাটা বুঝতে পারেন। অসুবিধা হয় না।

মেজবাহ কামাল
আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে। আমার লাস্ট কমেন্ট। আমি খুবই মোহিত হয়েছি মণিপুরী নাটকটা দেখে। আমাদের জাতীয় পর্যায়ে যে প্রডাকশনগুলো হয়, এটা সেই মানে গেছে বলে আমার মনে হয়েছে। কিন্তু একটাই আক্ষেপ আমার কৃষ্ণের হাতে বাঁশি ছিল না। বাঁশি ছাড়া কৃষ্ণ হাঃ হাঃ। ধন্যবাদ।

হাসান শাহরিয়ার
মামুন ভাইয়ের কাছে কিছু প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। সবুর ভাই এবং আরো একজন প্রশ্ন করেছিলেন, এই যে উৎসব হয়ে গেল এই উদ্যোগটা ভালো, কিন্তু এই নাটকগুলোর ভবিষ্যৎ কী?

মামুনুর রশীদ
এই উৎসব আয়োজনে ধন্যবাদ যেমন পেলাম, তেমনি অনেক কথাও শুনতে হলো হাঃ হাঃ। কিন্তু আপনাদের কাছেও কি মনে হয় নি, যে নাটকগুলো প্রদর্শিত হলো, সেগুলো মোটামুটি মানে দাঁড়িয়েছে?

বিপ্লব বালা
ভালো মানের নাগরিক নাটক।

মামুনুর রশীদ
হাঃ হাঃ ভালো মানের নাগরিক নাটক। এখন এটার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি কোনো রকম নিশ্চয়তা দিতে পারি না। আমাদের প্রচেষ্টাই ছিল একটা স্কিল ট্রান্সফার- নাটক নির্মাণ, অভিনয় দক্ষতা এসব তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। সেটা যদি বিন্দুমাত্রও ছড়িয়ে দিতে পেরে থাকি, তাহলে সেটাই তাদের হাতে বিকশিত হবে। তারাই এর লালন-পালন করবে, তারাই এর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। সেটাতে সহযোগীর ভূমিকা আমি তো কেবল একলা পালন করবো না। এখানে অনেক নাট্যকর্মী আছেন, তারাও নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন, তারাও নিশ্চয়ই ওদেরকে সহযোগিতা করবেন। আর যে কথাটা উঠে এসেছে যে, এগুলো নাগরিক নাটক হয়েছে ... হ্যাঁ, কিন্তু এক সময় তারা নিশ্চয়ই এই নাগরিক নাটক করবে না। আজকে এখানে বিভিন্ন ফর্মের কথা বলা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, এই আলোচনা থেকে ওরা উদ্বুদ্ধ হবে এবং তাদের নিজস্ব নাট্য খুঁজে বের করবে। আমরা একটা উৎসব করেছি মাত্র, কিন্তু দায়টা যেন সবাই অনুভব করি। সবাই যেন সহযোগিতার হাত বাড়াই। সেদিন রামেন্দু দা’ বলেছেন- বিভিন্ন নাট্য উৎসবে যদি তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বা আপনারা যারা দলীয়ভাবে উৎসব করেন সেখানেও যদি আদিবাসীদের ডাকা হয় তাহলেও একটা বড় কাজ হয়।

আরেকটা কথা হলো নাটকগুলো দেখতে দেখতে আপনাদের কি মনে হয় নি যে, ভিন্ন ভাষায় ওরা কথা বলছে, যে ভাষাটা আমরা বুঝতে পারছি না অথচ এরা আমাদেরই দেশের লোক? আমরা একটা পপুলার স্লোগানের সাথে পরিচিত যে- আমরা সবাই বাঙালি। বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি। কিন্তু আসলেই যে আমরা সবাই বাঙালি না, এই যে বিভিন্ন জাতিবৈচিত্র্য আমাদের দেশে আছে, এই ভাবনাটাতো ঢুকেছে সবার মাথায়। এটা কম কী! একই দেশের ভেতর বাস করি অথচ তাদের সংস্কৃতিকে কেবল অস্বীকার করি তাই না, ধ্বংসও করি। তো এখন অন্তত একটা সহমর্মিতা যদি জাগ্রত হয়, তাহলেও আমি মনে করি এই উৎসব কিছুটা হলেও সফল হয়েছে।

হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আমরা অনুষ্ঠানের শেষের দিকে চলে এসেছি। শেষে একজন দর্শক হিসেবে মামুন ভাইয়ের কাছে আমার প্রশ্ন- আপনি যখনই নাটকে পুলিশ চরিত্রটি আনেন তখন পুলিশকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেন। কিন্তু এই সমাজে, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পুলিশের যে পাওয়ার এবং পাওয়ার এবিউজ করার কারণে জনগণ যে নিপীড়নের শিকার হয়, সেগুলো অনেক হালকা হয়ে যায়। আপনার আদিবাসী নাটকেও আমরা এমন একটা দৃশ্য দেখেছি। কেন আপনি পুলিশকে এত হালকা চালের মনে করেন?

মামুনুর রশীদ
ভালো প্রশ্ন। এই প্রশ্নে জবাব আমাকে বহুবার দিতে হয়েছে। বিশেষ করে রাঢ়াঙ নাটকের পর থেকে। আমরা কিন্তু ইংরেজ সাহেবদের নিয়ে যেমন কৌতুক করতাম, তেমনি আদিবাসীরাও বাঙালিদের নিয়ে কৌতুক করে। বিশেষ করে পুলিশকে নিয়ে। আমার নাটকগুলোতে এই ধরনের মনস্তাত্বিক বিষয় নিয়েই পুলিশের ক্যারেক্টরগুলো এসেছে। এটা হচ্ছে, ওরা, আদিবাসীরা পুলিশকে কীভাবে দেখছে। তবে হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভবিষ্যতে আর পুলিশকে এভাবে দেখাবো না হাঃ হাঃ।

হাসান শাহরিয়ার
ধন্যবাদ। আজকের আয়োজনের এখানেই ইতি টানতে চাচ্ছি। আজকের আয়োজন সফল করতে যারা সহযোগিতা করেছেন, দর্শক-আলোচক, সবাইকে ধন্যবাদ। আর ধন্যবাদ জানাই শিল্পকলা একাডেমীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের, যারা বরাবরই আমাদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আবারও দেখা হবে কোনো এক মুখোমুখি অনুষ্ঠানে। ধন্যবাদ।