Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

এক সৃজন-নটরাজ তিনি

Written by বিপ্লব বালা.

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

আমরা তখন ফরিদপুরে। বাতিকগ্রস্তের মত নাটক করছি। পুরনো ভাষায় ‘নাটকই ধ্যানজ্ঞান’। হা করে ঢাকার দিকে তাকিয়ে থাকি। আধুনিক ‘নিরীক্ষাধর্মী’ ‘ব্যতিক্রমী’ নাটকের কী কী সব কাণ্ড ঘটছে শুনতে পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল নাট্য-প্রতিযোগিতা হচ্ছে নাকি। আমাদের দুই অগ্রনায়ক তাতে যুক্ত হয়েছেন- পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর বাবুল রশীদী। পত্রিকা আর উড়ো খবরে মুহ্যমান দশা। মঞ্চে নানা রঙের বেলুন উড়ছে নাকি- শহরের চোখে জণ্ডিস হয়েছে- রঙ-বেরঙের। সার্টিফিকেট আগুনে জ্বেলে অভিনেতৃ নেমে পড়েছে মিলনায়তনে, কী কী সব বলছে আর করছে তারা।

আধুনিক কবিতার এক তোড় জেগেছে তো তখন। সংলাপ আর নাটকের নামেও তার সম্প্রকাশ ঘটছে। জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন, রোলার ও নিহত এল.এম.জি, রেভলিউশন ও খৃষ্টাব্দ সন্ধান- নাটকের নামেই যেন বিপ্লব। নাট্যকার সেলিম আল দীন, আল মনসুর। আমরাও ‘বাত্যাধ্বস্ত মানুষের সামান্য পাশে দাঁড়াতে’ নাটক করছি। পীযূষ দা’ ছুটিতে এসে আমাদের দিলেন আধুনিকতম নাট্যপাঠ- ঢাকা থিয়েটারকৃত দুটি নাটক- সেলিম আল দীনের সংবাদ কার্টুন’ আর হাবিবুল হাসানের সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ। অভিনব উপস্থাপনা- অংকের মতো মাপা চলাচল, ভঙ্গী, কম্পোজিশন। সংলাপ একটিও একটুও রদবদল চলবে না। নির্দেশকের অনম্য নির্দেশ- একচুল নড়চড় হবে না স্বরক্ষেপণ আর শরীর গতিক্রিয়াদি। সংবাদ কার্টুন-এ তবলার বোল যোগে চরিত্রাবলীর কার্টুনবৎ চলনবলন। প্ল্যাকার্ড, মুখোশ, বিচিত্র প্রপস নিয়ে অভিনয় উপস্থাপন। ছন্দ-বদ্ধ রঙ্গব্যঙ্গ নিপুণ কথামালা। অরাজক কিম্ভুত দেশকালের দৃশ্যকাব্য। এক লাফ দিয়ে যেন আধুনিক নাটকের প্রবর্তনা। সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ-এ নাট্যদলের মহড়া-পর্ব আখ্যানে নির্দেশক অনির্দেশ্য এক স্বৈরশাসকের প্রতিভূ। কথাবার্তায় দুষ্কালীন মধ্যবিত্ত জীবন বাস্তবতা। একেবারে তাজা জ্যান্ত সব কথা, বিষয়, ভাবনা। নির্মেদ, চোখা কাটা কাটা- কবিতার ধার তাতে। ফরিদপুরের দর্শকও অভিভূত অভিনব এক নাট্য-অভিজ্ঞতায়। আমরা তারপর ‘থিয়েটার’ পত্রিকায় প্রকাশিত একেক নাটক করে চলি। সেই সঙ্গে দলের লাগসই নাম নিয়ে চলি আবার পাল্টাই। ঘূর্ণিহাওয়ায় চোখে লাগে আঁধি- ‘অনুভব থিয়েটার’, ‘ব্রেখট থিয়েটার’, নাটকের কী বা নাম-বাহার- স্পার্টাকাস বিষয়ক জটিলতা, কিংশুক যে মরুতে, বিজন বাড়ি নেই, নিরঞ্জন ফিরে এসো। তারই তোড়ে তারপর হাজির হওয়া কলকাতায়, রবীন্দ্রভারতী নাট্য বিভাগে। এর আগে ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশিত সংবাদ কার্টুন ও সম্রাট ও প্রতিদ্বন্দ্বীগণ- অভিনয় পরবর্তী দর্শক-সমালোচক আর নির্দেশক-নাট্যকারের বাক বিনিময়। ফর্ম আর কনটেন্ট প্রশ্নে রাজনীতির সঙ্গে শিল্পের যোগ চাই নাটকে; কেবল কনটেন্ট বা কেবল ফর্ম কোনো কাজের কথা নয়। কলাকৈবল্যবাদী আর্ট ফর আর্ট সেকে বিশ্বাসী নয় ঢাকা থিয়েটার- ঘোষণা করা হয়। মায়ারহোল্ড, পিসকাতরের নাম করা হয় তাদের অন্বিষ্ট বোঝাতে। তখন বাতাসে উড়ছে ‘বৈপ্লবিকতা’। মাঝে দেশে ফিরে মুনতাসির ফ্যান্টাসী-র কথা শুনি। কেন যেন উৎসাহী হই না ’৭৫-পরবর্তীকৃত এই রঙ্গ-তামাশায়। লক্ষ্য এর শেখ মুজিব এমনও শুনি। এরপর শকুন্তলা- পুরাণের রাজনীতিক নন্দন-ভাষ্য, গদ্যের এক কাব্যভাষায়। সেলিম আল দীন কবি ছিলেন- শুনেছি নাকি ব্যর্থ কবি। নাটকের এক দীর্ঘ আখ্যানে, দীর্ঘ সংলাপে বর্ণনায় তাঁর ‘অবাঙমানসগোচর’ কাব্য-এষণা মুক্তি খুঁজছিল বুঝি। প্রাচ্য মহাদেশীয় মহাকাব্য নিয়ে মনের আড় ভাঙে শকুন্তলা-য়। আখ্যানের নব-ভাষ্য কাব্যভাষে অভিনব নাট্য-আস্বাদ সঞ্চার করে। বয়ঃসন্ধিকালীন পুরাণ-বালার শরীরমনোসংকট-আশ্লেষ এমত ভাষায় দিব্য-দূরত্ব অতিক্রম করে বাক্সময় কল্পপ্রতিম কাব্যবিভায় উদ্ভাসিত হয়। নান্দনিক উন্মোচন ঘটে শরীরী-সংরাগের। স্বর্গ-মর্ত মাঝে দোদুল্যমানার ত্রিশঙ্কু-দশা রাজনীতির ক্ষমতা-দ্বন্দ্বের যন্ত্রণায় বিদীর্ণ। আখ্যান-পটভূমি ক্ষমতা-সম্পর্কের চেনা ইতিহাস হয়ে ওঠে। ব্যষ্টি ও সমষ্টির ঘন টানাপোড়েন কাব্যভাষায় নাট্যআততি গড়ে তোলে। নাটকের এক অভিনব বাচনের সাক্ষাৎ তাতে ঘটে। প্রযোজনা ও অভিনয়গুণে দর্শক নাট্যের নব সৃজন মাহাত্ম্যে আপ্লুত, অভিভূত হয়। সেলিম আল দীনের নতুন পরিচয় মুগ্ধ করে তাকে। দৃশ্যকাব্যের নবীন এষণায় প্রণোদিত হয় দর্শক।

এরপরেই তো সেলিম আল দীনের ঐতিহাসিক নাট্য-প্রবর্তনার প্রাক-পর্বকাল: কিত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল আর হাত হদাই। সংলাপ-চরিত্রের আখ্যান-কাঠামো কিত্তনখোলা-য় অটুট, অক্ষুণ্ন। তবু কোথাও যেন বিচিত্র বিস্তার ঘটে গেছে পটভূমির বিন্যাসে। গোটা এক মেলার আসরে উঠে আসে আস্ত এক গ্রাম-সমাজ- তার বিবিধ সম্পর্কজালের সমগ্রতায়। তার মধ্যে বয়াতির আসর দোহারের ধুয়া ধরে নানা উপাখ্যানের বিচিত্র স্বরমাত্রায়। তাতে অন্যতর এক বুননে নাট্যক্রিয়ার একক কোনো আদলের বিস্তার ঘটায়- ভিতর থেকে অন্তর্ঘাত ঘটে ভিন্ন এক নন্দনের বুঝিবা। রাবীন্দ্রিক বিচিত্র নাট্য আখ্যানে অবলম্বিত খোলা পথ আর মেলার স্বদেশীয় এক ‘ওপেন স্পেস’- ইয়োরোপীয় মডেলের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে। বাংলা নাটকের এই এক বিন্যাস-আদলের ঐতিহ্য-ভূমির অনুগমন ঘটে যেন নবীন সৃজন প্রবর্তনায়। সমাজের সমষ্টি-পটের সঙ্গে ব্যক্তির মনের বিশ্ব আর বিচিত্র সম্পর্কের কেলাসিত বহুকৌণিকতা আখ্যানের একরৈখিকতা ভেঙে দেয়। বাদী-সংবাদী সিম্ফনির অর্কেষ্ট্রা শুনি দেখি নব এই দৃশ্যকাব্যরূপায়ণে। এটা নিছক প্রচলিত নাটকের গ্রামীণ জনপদের প্রসেনিয়াম মডেল বা গণনাট্যের সরল বাস্তবের চেনা নাট্য-আখ্যান আর থাকে না। নবান্ন নাটকের এপিসোডিক গড়নও নয় এর। সংলাপও স্বাভাবিকরীতির শীর্ণ গদ্য কথ্যবাচন নয়। আঞ্চলিক ভাষায় সঞ্চারিত হয় কাব্যের ভাবদ্যোতনা। অভিজ্ঞতায় নানা স্তরের মনের ভাষাই হয়ে ওঠে জীবন্ত কথ্য। ইদু কন্টাক্টরের সঙ্গে দ্বৈরথে ইশারা-ইঙ্গিতের নাট্যভাষায় ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধায় বহুস্তর উঠে আসে। তেমনি বনশ্রী-রবিদাসের সম্পর্কলীলা ক্ষমতার মুখোমুখি হয়ে মানব-ট্র্যাজেডির চেনা আখ্যানে অন্যতর আততি জাগায়। মানবমন আর মানব-সম্পর্কের চির এক নাটক নতুন ভাষা পায়। বেদেনী ডালিমনের সঙ্গে সোনাইয়ের ব্যর্থ প্রণয় ভিন্ন প্রতীক তৈরি করে। নাগরিক মধ্যবিত্ত গণদেবতা বা কবি উপন্যাস-পাঠের অভিজ্ঞতার সমান্তরালে এই নাটকে তার এক সম্প্রসারণ দেখতে পায়। গ্রামজীবন নিয়ে পূর্ববর্তী বাস্তবানুগ নাট্য-আখ্যানের সরল বয়ানে যার দেখা মেলে নি। ভিতর থেকেই এক বিস্তার ঘটেছে যেন কিত্তনখোলা-য়। উন্মুক্ত এক আসরে এভাবে উঠে আসে ছড়ানো দেশ-কাল- বহুমনের ভাব-অভিভবের অজস্র অনুপুঙ্খ-সমেত। বয়াতির মারফতি কথন ব্যাখ্যান সুরে সুরে উথাল পাথাল করে দেয় মানব-নাট্যের নিহিত ট্র্যাজিক-বেদন। দর্শক এই নাটকে বেরিয়ে আসে বুঝি প্রসেনিয়ামের অভ্যস্ত ঘেরাটোপ থেকে। সেলিম আল দীন ঘটিয়ে দেন এহেন এক নাট্য-বিস্তার।

সেলিম আল দীনের নন্দন অভিযান ক্রমে অভিব্যক্ত হয়ে ওঠে। কাব্য-দর্শনের মৌল অভিপ্রায়ের সঙ্গে আখ্যানের বিচিত্র ব্যাপ্তি-বিন্যাস কিত্তনখোলা-য় এক আধার গড়ে তোলে। কেরামতমঙ্গল-এ তা মহাকাব্যিক বিস্তার পায়। স্বদেশীয় ইতিহাসের নরক পার হওয়ার প্রণোদনা দান্তে অনুগামী বলে ঘোষণাও দেয়া হয়। নব এক বাংলা মঙ্গল-মহাকাব্য প্রণীত হয়। বাংলা জন-সমাজের সমগ্রতায় যাত্রী কেরামত নরকের পর নরক পার হয়ে চলে। স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে পরবর্তী দীর্ঘ এক কাল-অকাল যাত্রায় অমহাকাব্যিক সাধারণ্যে অসাধারণ এই প্রতি-নায়ক নবীন মঙ্গল-পুরাণ-প্রবর হয়ে ওঠেন। নষ্ট ভ্রুণ হয় তার উপার্জন। স্বদেশ-ইতিহাসের এমনই এক লাগসই প্রতীক-কল্প গঠিত হয় ট্র্যাজিক আর্ত উল্লাসে। কেরামত যেন একালের বাঙ্গাল-যীশু। সেলিম আল দীনের এই মহাকাব্যিক পরিক্রমণ সমাজ-ইতিহাসের পটভূমিতে খোলতাই লাগে। মধ্যবিত্তীয় নাট্য-অভ্যাস হকচকিয়ে যায় এমত বিস্তারণে। সে আর তার দিনানুদৈনিক খর্বতা ক্ষুদ্রতা থেকে এর নাগাল পায় না। প্রযোজনা-অভিনয়-আখ্যান-মঞ্চ কারিগরী তাকে বিমূঢ় বিহ্বল করে তোলে।

হাত হদাই-এ তিনি যেন নিজের ভূ-প্রতিবেশের এক সমুদ্র-পরিভ্রমণ কিস্সা বয়ান করেন। বৃদ্ধ এক নাবিক তার সপ্তসিন্ধু দশদিগন্তে পাড়ি জমানো ঝাঁপি খোলেন। জীবনের যত রস আর ক্ষার-নুন, অগ্নিদহন আশ্চর্য রসায়ণে মথিত মণ্ডিত হয়ে ওঠে। নোয়াখালির ভাষায় মনের কাব্য আর মনন-দর্শন অভিনব বাচন তৈরি করে। আঞ্চলিকতার সীমা তার সম্ভাবনার সৃজন-মাহাত্ম্যে উল্লঙ্ঘিয়া যায় যেন। জলজ প্রাণী কাছিম শিকারের মিথ-কথন পারস্পরিক প্রাণ দান-প্রতিদানের আদি অদ্বৈতের নন্দন জাগায়। সব মিলে আশ্চর্য এই সামুদ্রিক কথকতা বুনন করে অভিনব এক বিস্ময়-বিশ্ব।

চাকা নাটক থেকেই বুঝি সেলিম আল দীনের সৃজন উল্লাস-উল্লম্ফন অতি-নাটকীয় হয়ে ওঠে। একের পর এক নবতর আখ্যান-বিন্যাস উদ্ভাবন রূপায়ণ করে চলেন তিনি অমিত তাগদে। একই সঙ্গে তার বিবিধ বিচিত্র অভিনব নন্দন-তত্ত্ববিশ্বের নামকরণে মেতে ওঠেন সমান আতীব্র রোখে। সেটা একটা মুদ্রাদোষে পর্যবসিত হয় যেন। নবীন একেক রচনার অঙ্গাঙ্গী হয়ে ওঠে তার তাত্ত্বিক-ভাষ্য। একেক রূপায়ণ হকচকিয়ে ধন্দে ফেলে দেয় পাঠক-দর্শককে। এই তবে বাংলা জাতীয় নাট্যের আধুনিকতম গঠন-বিন্যাস? তার মনন-নন্দনের বাচন? এর সঙ্গে কোথায় কীভাবে কতটুকু যুক্ত নানা বিচিত্র বাংলা আখ্যানের, তার বিচিত্র ভাব-রূপ ভাষার বিন্যাস? আবহমানের যূথ এক সমাজ-মানসের আখ্যান বাচনের অনায়াস সারল্যের সঙ্গে এই জটিল গূঢ় অনুপুঙ্খ বিস্তৃত কথনের সম্বন্ধসূত্র কোথায় মেলে! শ্রুতিশ্রবণের সম্ভাবনা-সীমাই-বা আর কতদূর পর্যন্ত তানিত করা সম্ভব? নাগরিক উচ্চমননও তার কতটুকু ধারণক্ষম হতে পারে? পাঠের বেলাও যে অভিনিবেশের স্থৈর্যে তার পরা-বাচন আয়ত্ত-অসাধ্য লাগে। পরিবেশনায় বিচিত্র দৃশ্যরূপায়ণের অদ্বৈতে শ্রবণ তার স্বাধীকারে এমত হাইব্রিড ফলন কতদূর সম্ভব করে তুলতে পারে, নান্দনিক প্রযুক্তির এই সৃজন-উল্লম্ফনে? সকল লেখন-কথন রীতির মিশ্র এক দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তাত্ত্বিকতা পাঠক-দর্শককে কতটাই-বা সহায়তা করতে পারে। এই জটিল সান্ধ্য বয়ান-বাচনের দুর্ভেদ্য কেল্লার সামনে পড়ে মধ্যবিত্ত তার হীনমন্যতাজাত উচ্চমন্যতার আপ্রাণ দেখানেপনা নিয়েও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয় বুঝি। এহেন সৃজন-স্পর্ধা উপেক্ষা বা অস্বীকারের মুরোদ তার যদিও নেই। অষ্টাবক্র বিভঙ্গ নাগরিক যূথমানস এহেন রচনার আধুনিকতা উত্তর-আধুনিকতার বিতণ্ডা হট্টরোলে শব্দ-কথার আড়ালে আত্মরক্ষা করে বুঝি।

হাত হদাই পর্যন্ত বিষয়ের যে অঙ্গাঙ্গী সমাজ-সংলগ্নতার পায়ের তলার মাটি ছিল তা থেকে সরিয়ে রচনাকার আখ্যানের কাব্য-দর্শনের অবাঙমানসগোচর এক অধরা আয়ত্ত করার উড়াল-যাত্রায় ধাবমান যেন। বেদান্ত-বৈষ্ণব দর্শনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ অভিনব নান্দনিক অভীধায়, ভাষ্য প্রয়োগে এক সময় তিনি তার এই সকল নিত্য নবতর রচনাকে নাটক অভীধা থেকেও মুক্তি দেওয়ার কথা বলেন। চাকা নাটক তৎকালীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিয়ত বলি অজ্ঞাতনামা এক লাশের আখ্যান। উপন্যাস-প্রতীম অনুপুঙ্খতায়, জটিলতর মনন-বাচনে উপনীত হয় প্রাণকণার অস্তিত্ত্বের এক নিখিল ব্রক্ষ্মাণ্ড-জোড়া জিজ্ঞাসা-পারমিতায়। পঠনেও যা হয়ে ওঠে দুর্গম এক মানস নন্দন-অভিযাত্রা। দৃশ্যকাব্য শ্রবণ-দর্শনের অদ্বৈতে তা এক নিরুদ্দেশ যাত্রায় ধাবিত করে যেন। যদিও তাতে অভিনব এক নান্দনিক অভিঘাতের অভিজ্ঞতা ঘটে। অতলান্ত এক মনন-চংক্রমনের বিপন্ন বিস্ময় জাগায়। এই রসের যথা তাত্ত্বিক নামকরণ রচনাকার দেন নাই। সৈয়দ শামসুল হক তার এক সুবোধ সরল নাম দেন ‘কথানাটক’, বাংলা পরিবেশনার অভীধার সম্প্রসার ও নব প্রয়োগ ঘটিয়ে। যৈবতী কন্যার মন-এ অবশ্য দুই কালখণ্ডের পরিচিত চেনা সমাজ-ইতিহাসের পটভূমি আছে। যদিও তা ছাপিয়ে ভাসিয়ে নারীর সত্তাসংকট দার্শনিক বাচনে বিস্তারিত হয়ে ওঠে। যার নাগাল একবারের অভিনয় সন্দর্শন শ্রবণে মেলা ভার। আখ্যান-কাঠামোয় স্বর্গ-মর্ত-পাতালের সরল বয়ান, বিন্যাসেও অনতি জটিলতা। নান্দনিক এক মানস-যাত্রা তাতে ঘটে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের এক বাচন-গোয়ের্ণিকা বলা চলে বুঝি হরগজ কে। কথন-বয়ানের বিভঙ্গ-ভাষ্যে বিপর্যয়-বীভৎসার প্রতিস্পর্ধী হতে গিয়ে, স্থাপনা-ভাষ্কর্য-কোলাজের মিশ্র মাধ্যমের পয়েন্ট-কাউন্টার পয়েন্ট সত্তা-চেরা সপ্তসুরের অর্কেষ্ট্রায় ভয়াল ভীষণ উচ্চণ্ড নিনাদিত হয়ে ওঠে। ভাষার এহেন সামর্থ্য-জটিল রচনা কিনা বিভাষী এক নির্দেশক কর্তৃক ইয়োরোপীয় অতিচালাকিতে নির্বোধ বিমূঢ় করতে চায় দর্শককে। স্পর্ধিত বাহাদুরির এক ঠাট্টার জোকারি দেখায় তা। যদিও একটি প্রদর্শনীর অধিক ঘটে নি অহং-মুদ্রার এই আস্ফালন।

বনপাংশুল-এ মান্দাই জনগোষ্ঠীর পুরাণ ইতিহাসের মিথকল্পন একালের রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় জটিল এক পাঁচালীর বয়ান-বুনন করে। আখ্যানে আদিবাসী-কন্যার মানস বিভ্রমের ট্র্যাজিক বিপর্যাস অধিক নান্দনিক গ্রন্থনায় মণ্ডিত। তার পাশে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ব্যঙ্গচিত্রসুলভ কার্টুনবৎ ক্যারিকেচার লাগে। পারস্পরিক সমগ্রতার বাস্তব তাতে আলগা, বেমানান, লঘু হয়ে ওঠে যেন। ক্ষমতা-প্রতিভূ বাঙালির দৈনন্দিন সন্ত্রাস-বাস্তবতা তাতে চাপা পড়ে।

প্রাচ্য রচনা মঙ্গলকাব্যের এক উলট-পুরাণের নব-রূপায়ণ। ক্রম অপহৃত দাস্যতায় পর্যবসিত এক ক্ষেতমজুরকে স্বর্পদংশনে মৃতা নববধূ সর্বস্বনাস্তির অমায় নিক্ষেপ করলেও প্রতিশোধস্পৃহার মানব-বৃত্তি থেকে উত্তীর্ণ হয় সে এক প্রাচ্য উদ্বোধনের পারমিতায়। নাগরিকজনের আত্মসর্বস্ব মানস এই প্রত্যক্ষ-বোধের কী মতো যে নাগাল পায় তা নিশ্চয়ই গবেষণা-যোগ্য প্রকল্প হতে পারে। বিচ্ছিন্ন অতল-গহ্বর পার হয় সে কোন যাদুতে? শিল্পনন্দনের হাতে আছে বুঝি সর্বরোগহর সর্বঘটন-পটিয়সী কোনো যাদুকলা! এমনি এক একমেবাদ্বিতীয়ম কল্প-সংস্কারে সৌখিন, বিলাসী, দায়হীন আত্মপরায়ণ প্রমত্ত হয়ে উঠেছি আমরা।

নিমজ্জন-এর বিশ্ববিরূপ বীভৎসা- দর্শন পুনরাবৃত্ত অনুপুঙ্খ তথ্যায়নেও পাঠে সাধ্যমতো অনেকখানি ধরাছোঁয়ায় আয়ত্তগম্য হয়ে ওঠে। পরিবেশনায় যে রূপান্তরণই ঘটুক না কেন।

ধাবমান আর স্বর্ণবোয়াল-এ ভিন্ন দুই জগৎ-আখ্যান রচিত হয় ভাবনা ও ভাষার অর্ধনারীশ্বর অদ্বৈতে। পরিবেশনার দৃশ্যশ্রবণের সাধ্য নিয়ে কী এক মল্লযুদ্ধেই না জানি অবতীর্ণ হতে আহ্বান করবে তা আমাদেরকে! তার কষ্টকল্পনায়ও রোমাঞ্চ হয়। অহো! অপেক্ষা করে আছে বুঝি অভূতপূর্ব কোনো নন্দন-অভিজ্ঞতার। পুত্র- রচনার আপাত সরল বাচনের পরিবেশনার বেলাও একই অভিভাব জাগে মনে।

তবুও সব মিলে সেলিম আল দীন তার নাটক ও রচনায় বাংলা থিয়েটারের সম্ভাবনা উদ্ভাবন রূপায়ণের মহাকাব্যিক বিস্তারে পৌরাণিক এক চরিত্র হয়ে উঠেছেন যেন। বাংলাদেশের থিয়েটারের প্রধান এক অর্জন তাঁর এহেন সৃজন-সামর্থ্য। উপকূলীয় ভূখণ্ডের সামুদ্রিক চারিত্র্য যেন-বা এমত নন্দনকল্প রচনার যথা উপমান হতে পারে। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ গঠনে তার স্বভাব-প্রবণতা যতই কেন উচ্চাবচ পতন-বন্ধুর অভিযোগে জর্জরিত হোক ঐতিহাসিক বিচারের ক্ষমাহীন বিবেচনায়। গ্রাম থিয়েটার পরিকল্পনায় তার সদিচ্ছা ও আবেগস্পর্ধাও প্রয়োগে কী সামাজিক নন্দন ফলন সম্ভব করলো তার পরিমাপও করা হবে নিশ্চয় কালের নিদারুণ সম্মার্জনী-পাতে।

তবু জয় হোক বাংলা নন্দনের একালের এক দামাল নটরাজের- অমিত যাঁর রূপায়ণ অন্বিষ্ট। কোনো নিন্দাপঙ্ক তার ব্যত্যয় ঘটবে না জানি- এমনি তার সৃজন-মাহাত্ম্য।

তিনি একালের এক সৃজন প্রতীক-প্রতিভূর মর্যাদায় চির আসীন থাকবেন।

ড. বিপ্লব বালা: নাট্যশিক্ষক, নাট্য-সমালোচক