Bookmaker Bet365.com Bonus The best odds.

Full premium theme for CMS

কবরখানা

Блогът Web EKM Blog очаквайте скоро..

ছেঁড়া মাদুরে শায়িত জপেনদা দশ স্তুপ বই-এর আড়ালে প্রায় অদৃশ্য হয়েছিলেন। তেমনি সটান শুয়ে থেকে শুধোলেন, ‘থিয়েটার কি ইয়ার্কির জায়গা’?
আমি এবং মধু আকাশ থেকে পড়লাম। মাত্র আগের দিন সন্ধেয় আমরা ব্রেখট্-এর বিপ্লবী নাটক ‘আর্টরো উই’-এর বাংলা অনুবাদের এক দুঃসাহসিক প্রযোজনা করে বিদ্বজ্জনের প্রশংসা কুড়িয়েছি। আমার বগলে রয়েছে আজকের স্টেটস্ম্যানখানা, তাতে নাট্যসমালোচকের অকুণ্ঠ সাধুবাদ বর্ষিত হয়েছে। জপেনচন্দ্রও নাটক দেখতে গিয়েছিলেন এবং মঞ্চ থেকে তাঁর ‘বেড়ে!’, ‘শোভান্তরি!’ ‘মৃত্তিকে রে বাবা মৃত্তিকে!’ প্রভৃতি মন্তব্যও আমরা শুনেছিলাম। কাজেই না আজ মধু এবং আমি তাঁর বিস্তারিত প্রশংসা শুনতে গুটি গুটি উপস্থিত। আর সেক্ষেত্রে প্রথমেই তাঁর বক্রোক্তি চপেটাঘাতের মতন গণ্ডদেশে এসে লাগতে দু’জনেই আমরা বিহ্বল হয়ে পড়লাম।

‘জবাব দিচ্ছিস না যে?’ বললেন জপেনাদা, তেমনি শুয়ে শুয়ে কড়িকাঠ দেখতে দেখতে। ‘থিয়েটারটা কি রোয়াক পেয়েছ?’

মধু কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘ব্রেখট্ কি ইয়ার্কি?’

জপেনদার হাড্ডিসার বুক আবেগে ওঠানাম করতে লাগল। ব্রেখট্ ইয়ার্কি হতে যাবেন কেন? জিগ্যেস করছি তোদের কথা- এ শহরের বিটল ইন্টোলিকচ্যুয়াল মূর্খদের কথা। ব্রেখট্-এর নাটক বলেই কাল কিছু কিছু কেয়াবাত ধ্বনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে ইচ্ছা করছিল স্টেজে উঠে তোদের একেকটাকে ঘাড় ধরে নামিয়ে দিই।

আমরা সংকুচিত হয়ে মাদুরে বসলাম। মধু একবার আলগোছে জপেনদার পা টিপতেও শুরু করেছিল, কঙ্কালের দীর্ঘ পদাঘাতে নিরস্ত হল।

কিয়ৎকাল পরে নকল দাঁতের খট-খট শব্দ করে জপেনদা বললেন, ‘ব্রেখট্ নাটক লিখতেন কেন?’

‘মানুষকে রাজনীতি ও সমাজ সম্পর্কে সচেতন করতে, এ সমাজকে বদলাবার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে’- আমি বললাম।

‘তোরাও সেইজন্যেই নাটকটা করলি তো?’

‘অবশ্যই।’

‘তাহলে বলি... তোদের বাঙালি দর্শক এক অক্ষরও বুঝতে পারেনি, সমাজও চেনেনি, রাজনীতিও বোঝেনি। বরং আগে যা-ওবা বুঝত, তোদের অভিনব নাট্য-পরীক্ষার চড়কিপাকে পড়ে তাও গুলিয়ে ফেলেছে।’ ধড়মড় করে জপেনদা উঠে বসতে আমরা চমকে পিছিয়ে গেছি। আঙুল তুলে জপেনদা বললেন, ‘কোনো কোনো নিরেট অশিক্ষিত বুদ্ধিবাজ বলে থাকে, ব্রেখট্ করছি এদেশের মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটাবার জন্য। চেকভ, ’শ, শেক্সপিয়ার, সবার সঙ্গে এদেশের মানুষের পরিচয় ঘটাতে তারা ব্যস্ত। এদেশের মানুষ মানে, এদেশের বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ব্রেখট্, ’শ, চেকভ, শেক্সপিয়ারকে খুব ভালোভাবে চেনেন কেতাব মারফৎ। অন্তত থিয়েটারের মালদের চেয়ে অনেক ভালো চেনেন। ওসব পেঁয়াজিতে ভবি ভোলে না। ব্রেখট্-এর উদ্দেশ্য আর তোদের উদ্দেশ্য যদি এক হয়, তবেই ব্রেখট্-এর নাটক করা যায়, নচেৎ কখনো নয়। ব্রেখট্ বিপ্লব প্রচার করেছেন। তাঁর বাংলা প্রযোজনার একটি এবং কেবলমাত্র একটিই রেজোঁ দেত্রে থাকতে পারে... ওঃ, বেনাবনে ফরাসি মুক্ত কেন যে ছড়াচ্ছি?- ব্রেখট্ বঙ্গানুবাদের একটিই কারণ, অস্তিত্বের একটিই যুক্তি থাকতে পারে- বাংলা ভাষ্যেও বিপ্লব প্রচারিত হবে। এবং বিপ্লব প্রচারের একটি ক্ষেত্র আছে, সেটি মজদুর-কিষাণ-মধ্যবিত্ত জনসমষ্টি। অর্থাৎ বিপ্লবটা এমনভাবে প্রচারিত হবে যেন মজুর-কৃষক-কর্মচারীর বোধগম্য হয়। বিপ্লব প্রচার করছি অথচ এমন ঢঙে করছি যাতে বিপ্লবী শ্রেণীরা বুঝতে না পারে, এর চেয়ে হাস্যকর গর্দভসুলভ মিথ্যাচার আর কী হতে পারে আমি জানি না।

মধুর এবার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। ধরা গলায় বলল, না আমরা তো বিপ্লব প্রচারের উদ্দেশ্যেই, মানে, হিটলারের অভ্যুথান সম্পর্কে নাটক দেখে যাতে মানুষ ফ্যাসিবাদের চরিত্র বুঝে নিতে পারে, ভারতের জরুরী অবস্থা ও ইন্দিরাশাহীর গোড়ার কথাগুলো সম্বন্ধে সজাগ হয়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ’... জপেনদা দাঁত খিঁচোতেই মধু থামল। ‘তা সেটা ‘আর্টরো উই’ নাটক দেখে এদেশের রাম শ্যাম যদু মধু কী করে বুঝবে? ‘উই’ তো রূপক নাটক। বাইরে তো সেটা শিকাগোর মার্কিন-ইটালিয়ান দস্যুদের কীর্তি-কাহিনী।

কিন্তু ভেতরের গল্পটা...

ভেতরের গল্প! ভেতরের গল্পের কোনো ঘটনাই যে দর্শক জানে না, সে কী মাথামুণ্ডু বুঝবে? বাইরের গল্পে ডগ্স্বরোর আত্মসমর্পণ দেখে তারা বুঝে ফেলবে এটা হচ্ছে হিটলারের ব্ল্যাকমেইল এবং হিন্ডেনবুর্গের আত্মসমর্পণ? এদেশের মানুষ কি হিন্ডেনবুর্গের কুষ্ঠি-ঠিকুজি জেনে বসে আছে? সিসেরো শহরকে নিজেদের কয়ায়ত্ত করছে শিকাগোর দস্যুরা, এটা দেখে দর্শকরা হিটলারের অষ্ট্রিয়া দখল বুঝে নেবে? ডালফীটের করুণ অবস্থা দেখে অষ্ট্রিয়ান রাষ্ট্রপতি ডলফুসের পরিণতি বুঝে নেবে সবাই? ডলফুসের নাম শুনেছে ক’জন? দস্যুদের দলপতি উই নিজের বিশ্বস্ত সহকারী রোম্যাকে হত্যা করাচ্ছে; এ থেকে বাংলার দর্শক কী করে বুঝবে যে হিটলার বিশ্বস্ত সহকারী রোম্যাকে হত্যা করাচ্ছে? এ থেকে বাংলার দর্শক কী করে বুঝবে যে হিটলার তার ঝটিকা বাহিনীর নেতা রোম্যাকে হত্যা করেছিলেন? রোম্যা নামে ইতিহাসে কেউ যে ছিল সেটা এদেশে জানে ক’জন? উই-রা গুদাম পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে; সুতরাং হিটলারদের রাইখ্স্টাগ পোড়াবার ঘটনা বাংলার দর্শকের মনে পড়বে, এটা কোন গাধা বলেছে তোদের? বাইরের মাফিয়ার কাহিনীটা বুঝতেই যেকোনো বাঙালি দর্শক গলদঘর্ম হয়ে যাবে, সেখানে পদে পদে জর্মন ইতিহাসের লুকানো ইঙ্গিতগুলো তার চোখে স্পষ্ট হবে কোন অলৌকিক যোগাযোগে? তার ওপর তোদের বিচিত্র দাবি- মাফিয়া এবং জর্মনির ইতিহাস ভেদ করে দর্শককে পৌছুতে হবে ভারতের জরুরী অবস্থার বিচারে। আক্কেলগুলো কোনব্যাংকে জমা রেখেছিস বল তো? ত্রিবিধ রূপকের এই গোলক ধাঁধায় মানুষ তো খাবি খাবে!’ আমরা কাতরভাবে উত্তরের জন্য শূন্যে হাতড়াচ্ছি দেখে জপেনদা আরো খোলাসা করে বললেন, ধর কোনো ভারতীয় নাট্যকার একটি রূপক নাটকে দেখালেন এক অর্ধোলঙ্গ সন্ন্যাসীকে একদল খদ্দরের টুপি পরা মস্তান হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে, কারণ সন্ন্যাসীটা প্রতি পদে বাধা দিচ্ছে। শহরটাকে দুই মস্তানদের দল দু’ভাগ করে শান্তিতে যে যার বদমাইশি করতে চাইছে, কিন্তু উলঙ্গ সাধুটা বাদ সাধছে। শেষকালে দেখা গেল এক মস্তান নেতাদের নির্দেশে গুলি ঝেড়ে দিল, সন্ন্যাসী ‘হায় রাম’ বলে ইহলীলা সম্বরণ করলেন। এটা বুঝতে ভারতীয় দর্শকের কোনো অসুবিধে নেই, কারণ, যে রাজনৈতিক ঘটনার কথা এখানে প্রচ্ছন্নভাবে আসছে সেটা সবার জানা। সবাই বুঝবে সন্নাসী হচ্ছেন গান্ধী, দুই মস্তানের দল হচ্ছে যথাক্রমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, যে শহর তারা ভাগাভাগি করে ভোগ করতে চাইছে, সেটা আসলে ভারতবর্ষের প্রতীক। কিন্তু এ-নাটকটা যদি কেউ জর্মন ভাষায় অনুবাদ করে বার্লিনে অভিনয় করে তবে জর্মন দর্শক কী বুঝবে? তারা তো একটা নিছক রূপকথাই দেখবে। তাই তারা ঐ নাটক বার্লিনে অভিনয় করবে না কস্মিনকালেও, তারা নিজেদের দর্শককে শ্রদ্ধা করে, নিজ দর্শকের সেবায় তারা মগ্ন। কিন্তু এই পোড়া দেশে সবই সম্ভব। ভারতের ফ্যাসিবাদ বোঝাবার জন্য এখানে জর্মন রূপক অভিনীত হয়! জর্মন ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল দুরূহ দুর্বোধ্য খুঁটিনাটিতে ভরা নাটক দেখতে হবে বাংলার দর্শককে ইন্দিরার ভাবগতিক বোঝাবার জন্য? আসলে ওইসব একান্ত জর্মন ঘটনা দিয়ে তোরা বাংলার দর্শকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত গুলিয়ে দিচ্ছিস, তার দৃষ্টি ঝাপটা করে দিচ্ছিস, তাকে বেকুব বানাচ্ছিস। আসলে তোরা ব্রেখটের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অন্তর থেকে মেনে নিসনি, প্রচারটা তোদের উদ্দেশ্যই নয়। তোরা ব্রেখট্ অভিনয় করছিস ইন্টেলেকচুয়াল সাজবার জন্য, পশ্চাদ্দেশে ‘বিদগ্ধ’ লেবেল এঁটে জাতে উঠবার জন্য। ব্রেখট্ সারাজীবন, তোদের মতন খেতাবের কাঙালদের বলতেন কফ্লোস হুণ্ডু, মুণ্ডুহীন কুকুর, উচ্চশিক্ষিত মহলের কুকুর হতে চাস, কিন্তু তোদের মাথায় নেই ওরা আমল দিচ্ছে না, কুকুর বলেই মানছে না।

সক্কালবেলায় কুকুর গালাগাল শুনে মেজাজটাই গেল খিঁচড়ে। যথাসম্ভব তিক্তস্বরে বললাম, ‘তা বিদেশি নাটক অভিনয় করার দরকার নেই? আন্তর্জাতিক দরজা-জানালা বন্ধ করে অন্ধকূপে বসে থাকব?

জপেনদা কিয়ৎকাল আনমনা তাকিয়ে রইলেন। আমি ভেবেছি কথা তাঁর কানে যায়নি এবং আরেকটু উঁচু পর্দায় আবার বলতে গেছি, এমন সময় শান্তকণ্ঠে জপেনদা বলছেন, ‘মাঝে মাঝে ভাবি তুই কি সত্যিই অমন নিরেট ইডিয়ট, না নির্বুদ্ধিতার ভান করা সি.আই.এ এজেন্ট?’

‘কেন! কেন এমন বলছেন?’ আমার সরোষ প্রশ্ন।

‘কেননা কথা হচ্ছিল প্রত্যক্ষ প্রচারনাট্য সম্পর্কে, ব্রেখটের রাজনৈতিক নাটক সম্পর্কে’ জপেনদার বিনয়ী উত্তর- ‘আর আপনি অতি সেয়ানা কইমাছের মতন পিছলে অন্য বিষয়ে চলে গেলেন, ইয়োরোপীয় ক্ল্যাসিক সাহিত্যের প্রশ্নে চলে গেলেন। মহাশয়, আমি এটা জানি শেক্সপিয়ার মলিয়ের, গ্যোয়টে, ইবসেন, গোর্কি, চেকভ, ’শ-সব আমাদের। সে-ব্যাপারে মহাশয়ের দুশ্চিন্তার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু রাজনৈতিক নাটকের উদ্দেশ্য কিনা রাজনীতি আরো ব্যাখ্যা করা, প্রাঞ্জল করা, খোলাসা করা। সেস্থানে মহাশয়রা এমন নাটক করলেন যেখানে রাজনীতি আরো জটিল হল, ধাঁধা হল, হিং টিং ছট হল, এরকম পশ্চিম জর্মন সমরবাদী সরকারের দালালি আর কতদিন চালাবেন, প্রভুপাদ? মাকসমুলার ভবনের আর কত টাকা পকেটে পুরবেন, তপোধন?’

মোলায়েম খিস্তির জ্বালা সামলাচ্ছি, এমন সময়ে আরো বিগলিত স্বরে জপেনদা বললেন, ‘ব্রেখটকে যদি সত্যিই বাংলায় আনতে চান জনাবে আলি, যদি তেমন হিম্মৎ সত্যিই ধরেন জনাব-এ-ফজল, তবে, আর্টুরো উইকে দৃষ্টান্ত ধরে ইন্দিরাবাই নামক মেয়ে-ডাকাতের আধুনিক একটি চম্বল-কাহিনী ফাঁদুন না হুজুর-ই-ওয়ালা। অথবা স্বমূত্রপায়ী এক বিচিত্র গেছো ডাকাতের সর্বাধুনিক রূপক করুন না, যার প্রতিপক্ষ ওই কাঠের ঘোড়ায়-চড়া ইন্দিরাবাই এবং মাথায় রুমাল বাঁধা স্ববিঘোষিত হনুমান। ডাকাতদলের খেয়োখেয়ি, লুঠ ভাগের দরাদরি, আর ঘন ঘন প্রাণনাশের প্রয়াস- এসবের জন্য শিকাগোয় যাবার আর কি দরকার, মেহেরবান? নাসাগ্র থেকে দৃষ্টিটা একটু তুললেই সব চোখে পড়বে ঘরের কাছে। হিটলারের গল্প বাঙালি দর্শকের কাছে আনতে গেলে অনেক সহজ, অনেক টীকাভাষ্য-সম্বলিত, অনেক সুগম গল্প ধরতে হবে, এটা কি বিশদ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে, রহমান?

চার মিনার ধরিয়ে সামনের এক স্তুপ বইয়ে মাথা ঠেকালেন জপেনদা সাষ্টাঙ্গ প্রণামের ভঙ্গিতে। ‘সর্বত্র এক’- বললেন তিনি ভক্তি গদগদ আকুল কণ্ঠে- ‘সবর্ত্র আপনাদের গেরুয়া বসন আর ন্যাড়া মাথা দেখছি, অবধুত! আপনারা ছেয়ে ফেলেছেন থিয়েটার, চলচ্চিত্র, সাহিত্য- সব। যাত্রায় পর্যন্ত উপস্থিত হয়েছিলেন এমনি এক মহাপাদ, ব্রেখট্ করে বিপ্লব আনবেন বলে। লোকে বোঝেনি- ছোটলোক কিনা! ভালো ছবি দেখতে যাই, দেখি আপনাদের লীলা সেথাও। কিছু বুঝতে পারি না। বিপ্লবী ছবি হচ্ছে এমন আধুনিক ঢঙে যে এদেশের বিপ্লবী শ্রেণীরা সেগুলো দেখছে না। ক্রুফো, গদার-এর বাক্যচ্ছটায় ভুলি- আমার ক্যামেরা একটি রাইফেল- ছুটে যাই তাঁদের কীর্তি দেখতে, বুঝি যে সুউচ্চ প্রতিভারা ছাড়া কেউ তাঁদের ছবি বুঝতে পারবে না। ফিলিম সোসাইটির আলোচনা শুনি- সেই আন্তোনিওনি; সেই ক্রুফো, সেই বের্গমান, সেই গদার, সেই ভিসকন্তি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, ভুলেও কোনো স্বামীজী সোভিয়েত চলচ্চিত্রের উল্লেখ করেন না, করেন না বন্দারচুকের আলোচনা, কারণ রুশ ইতরেরা ছবি করে ইতরদের জন্য। মার্কিন চলচ্চিত্রের কোনো সুখ্যাতি করা সেখানে বেআইনি, স্ট্যানলি ক্রেমার অচ্ছুৎ, কপোরো অন্তজ্য, শ্লসিংগার ব্রাত্য, কারণ তারা এমন নীচাশয় যে ছবি করে জনসাধারণের জন্য। ফিলিম সোসাইটি নামক মঠে ফ্রান্স এবং ইটালির বাইরে কোনো জগৎ নেই, একমাত্র ফ্যাসিস্ত বের্গমান বাদে। বুলগেরীয় ছবি ‘রাষ্ট্ররক্ষা আইনের সংশোধনী’ বোমার মতন ফাটে কলকাতার উৎসবে, কোনো ধ্যানমগ্ন ধূর্জটি নয়ন মেলেন না, কোনো সমালোচক এক লাইন লেখেন না। তাঁদের কারা যেন বলে দিয়েছে, পূর্ব ইয়োরোপ নামে ভৌগোলিক ভূখন্ড থাকতে পারে, কিন্তু চলচ্চিত্রের বিচারে ওসব মরুভূমি। ‘জেড’ এবং ‘অবরোধ’ ছবি তুফান তোলে ইতরদের হৃদয়ে। ততোধিক তোলে ‘অপারেশন ডে ব্রেক’ ছোটলোক দর্শকরা হাততালিতে ফেটে পড়ে, নাৎসি সেনার ওপর গেরিলারা গুলি চালালে স্লোগানে মুখর হয়- ঠিক সেই কারণেই সিদ্ধ পুরুষরা নির্বিকার থাকেন, ছোটোলোকের চেঁচামেচিতে সায় দিলে তাঁরা ধর্মচ্যুত হবেন। এবং ফের তাঁরা নিজ নিজ নাভিমূলে দৃষ্টি নিবন্ধ করে সবচেয়ে দুর্বোধ্য, সবচেয়ে ক্লান্তিকর, সবচেয়ে শ্রেণীবিচ্ছিন্ন কিছু ছবির চিন্তায় মগ্ন হন। দুর্বোধ্যতার অনুশীলন চলছে। চেষ্টিত জটিলতাকে আর্ট বলে চালাচ্ছে। অন্তঃসারশূন্য কসরৎকে শাশ্বত শিল্প বলে প্রচার করছে। কলকাতার বুদ্ধিগর্বী চিত্রপ্রাঙ্গণে শূদ্রের প্রবেশাধিকার নেই, ব্রাহ্মণের বর্ণদন্তে সে প্রকম্পিত।

‘সাহিত্যের আলোচনায় আর যাচ্ছি না। কবিতা একদা ছিল একান্তভাবে জনতার নিজস্ব। হাটে-বাজারে কবিয়াল গিয়ে গেয়ে শোনাত যে কবিতা, সে আজ বুদ্ধিজীবীর পাঠাগারে বন্দী, কতিপয় ইন্টেলেকচুয়ালের পাঠ্য, ধোঁয়াটে নানা বিলাপের অবোধ্য প্রকাশের রক্তশূন্য মাধ্যম।

কিন্তু চমকে উঠেছিলাম নাট্যশালায় বন্ধ্যা বুদ্ধবাজির হস্তক্ষেপে। নাটকের কোনো অর্থ নেই, অর্থহীনতাই হচ্ছে নাটক- এই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া স্লোগান নিয়ে নাট্যশালায় চড়াও হয়েছিলেন অনেকে, ক্ষয়িষ্ণু পশ্চিম ইয়োরোপের এবসার্ড থিয়েটার, ফিজিক্যাল থিয়েটার, মায় থিয়েটার অ্যাজ থেরারি! তারারা কেন শোনে না, ইন্দ্রজিৎ যে কে, ঈশ্বরবাবু কেন এলেন না, প্যান্টাফটাস মানে কী এইসব সুগভীর দার্শনিক জিজ্ঞাসা উত্থাপিত হচ্ছিল এই সেদিন পর্যন্ত বাংলা রঙ্গমঞ্চের একাংশে এবং ইতরজনেরা থিয়েটার ছেড়ে দলে দলে ধাবিত হচ্ছিল রঙিন হিন্দি ছবি দেখতে, কেননা গাঁটের পয়সা গচ্চা দিয়ে কেউ শিরঃপীড়া বাধাতে চায় না। কারুর এত সময় নাই যে তৃতীয় শ্রেণীর বিকারগ্রস্ত মার্কিন নাটক ‘উই গট রিদম’ থেকে চুরি-করা বাংলা বিলাপ শুনবে, মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও হতাশার তিন-ঘন্টাব্যাপী চটকানো খই গিলবে। শুনছি এইসব নাট্যবিদের কেউ কেউ ইদানীং মত পাল্টেছেন, দু-চারটে সংগ্রামী নাটক লিখেছেন। উত্তম কথা। কিন্তু যে ক্ষতি তাঁরা পূর্বে করেছেন তা সামলাতে নাট্য-আন্দোলনকে আরো বেশ কয়েক বছর হিমসিম খেতে হবে। জনগণকে এঁরা থিয়েটার থেকে তাড়িয়েছেন, থিয়েটারকে নিয়ে গেছেন সমাজের উচ্চস্তরের যক্ষাগ্রস্ত পরিবেশে। ফলে ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে বারবধুর বারস্বামীরা, রাসভবিহারীরা। যে বাণিজ্যিক মঞ্চ কোনঠাসা হয়ে গিয়েছিল নাট্য আন্দোলনের সর্বাত্মক আক্রমণে, গুণ্ডা, সিদ্ধার্থ রায় আর ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয়পুষ্ট হয়ে। এঁদের একজনের নাটকে শুনিসনি বামপন্থী আন্দোলনের প্রতি শ্লেষ আর উপহাস? দেখিসনি কলকাতার মিছিল ‘কাকাতুয়ার মাথায় ঝুঁটি’ স্লোগান দিতে দিতে মঞ্চ পরিক্রমা করছে?

‘আমি জিগ্যেস করি- কে এদের অধিকার দিয়েছে চলচ্চিত্র, কাব্য, নাট্যশালাকে বুদ্ধিবাজ পরগাছাদের পায়ে বিসর্জন দিয়ে আসতে?’ চেয়ারম্যান মাও-এর কথা স্মরণ কর- কার জন্য শিল্প সাহিত্য, এটাই মূল প্রশ্ন, আর সব গৌণ। উচ্চতম দার্শনিক আইডিয়াকেও পরিবেশন করতে হবে শ্রমিক-কৃষকের বোধগম্য করে। আর এঁরা সরলতম বস্তাপচা আইডিয়াগুলোকেও খুব খেটে দুর্বোধ্য করে তোলেন, পাছে শ্রমিক-কৃষক বুঝে ফেলে। বিশেষ করে নাট্যশালায় এই আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে, ড্রাগখাওয়া বিকারগ্রস্ত যৌনবীর কিছু বুর্জোয়া বুদ্ধিবাজের নেতৃত্বে- আর এদেশের কিছু স্বল্পবুদ্ধি শাদা-চামড়া-ভজা দালাল তার অক্ষম পুনরাবৃত্তি করে মৌলিকতার দাবি জানাচ্ছে।’

‘আধুনিক নাট্যশালার পরীক্ষা-নিরীক্ষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু?’ আমি বলি, বিশেষ সন্দেহের সুরে।

‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাকে বলে না!’ দাঁত খিঁচোলেন জপেনদা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিরিয়াস নাট্যকর্মী। যারা থিয়েটারকে ভাবে অবাধ যৌনসংগম এবং এল-এস-ডির আখড়া, তারা পরীক্ষা-টরিক্ষা করে না। তারা চেষ্টা করছে মার্কিন যুবশক্তির মেরুদ- ভাঙতে, কামানের খোরাক সৃষ্টি করতে, পরের ভিয়েৎনামের ফৌজ তৈরি করতে। এ সবের শুরু ১৯৫৯ সালে গ্রীনীচ ভিলেজে এলেন কাপ্রোর তথাকথিত হ্যাপেনিং থেকে। হ্যাপেনিং মানে আকস্মিক একটা ঘটনা, নাটক-ফাটক নয়। দর্শদের বলা হল, ঘন্টা বাজলেই সবাই উঠে দাঁড়াবেন, সব কাপড় জামা খুলে ফেলবেন, উলঙ্গ হয়ে নাচবেন, তারপর পাশের ঘরে যাবেন। নানা ড্রাগের অলৌকিক নেশায় আচ্ছন্ন দর্শকরা তাই করলেন। পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন পর্দায় একটি নগ্ন নারীর চলচ্চিত্র আর কক্ষের মধ্যস্থলে সেই নারীই সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় নৃত্য করছে। আর কাপ্রো এবং তার পাঁচ সহ-অভিনেতা কক্ষের নানাস্থানে কেউ ছবি আঁকছেন, কেউ গিটার বাজাচ্ছেন, কেউ উচ্চেঃস্বরে প্রন্থ পাঠ করছেন, কেউ-বা হাত-পা ছুঁড়ছেন- সবাই একসঙ্গে। উলঙ্গ দর্শকবৃন্দের কোনো উপায় নেই কোনো একদিকে মনোনিবেশ করে। ব্যস, তারপর হ্যাপেনিং শেষ। সঙ্গে সঙ্গে রণোন্মাদ মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বজোড়া উল্লাস- নূতন নাট্যধারা জন্ম নিয়েছে, ব্রেখট্রা কোন রসাতলে যে এবার ডুবে যাবেন তার ঠিকানা নেই। কাপ্রোর দেখাদেখি অবতীর্ণ হলেন চিত্রকর জিম ডাইন। তিনি মঞ্চে বসে ছবি আঁকতে থাকলেন। হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘যা করছি এ আমার বড় পছন্দ।’ বলেই রঙের একটি বাটি তুলে ঢক্ ঢক্ করে রং খেয়ে ফেললেন, অন্য দু’টো বাটির রং ঢেলে ফেললেন নিজের মাথায়। তারপর যে ক্যানভাসে ছবি আঁকছিলেন, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে ভেদ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন, নেপথ্যের দিকে- আরেকটি মহান হ্যাপেনিং- এর যবনিকা পড়ল, এবং দেশ জুড়ে বুদ্ধিজীবীরা বাহবা দিয়ে উঠলেন।

‘এর নাম থিয়েটার?’ মধুর প্রশ্ন।

‘এর নাম অবক্ষয়’, বললেন জপেনদা। রোমক সাম্রাজ্য যখন পতনের মুখে তখন হত এরকম অর্জি, উলঙ্গ নারী পুরুষের মদোন্মত্ত বিহার, আর তাকে মুমূর্ষু সাম্রাজ্যের ভাড়াটে দার্শনিকরা বলতেন, ঈশ্বর-উপাসানা। আজ বিশ্ব পুঁজিবাদের অন্তিমকাল। আবার সেই অর্জির পথে চলেছে। পুঁজিবাদী আর্ট। কাপ্রোর ফরাসি অনুগামী জ্যাঁ-জাক লেবেল নাটক করলেন এইরকম- দুটি নগ্ন নারী দেয়ালে ছবি আঁকছে আর লেবেল নিজে মেয়েদুটির নগ্ন পাছায় ছবি আঁকছেন। টিভি আর পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে লেবেল এটাকে বললেন, নূতন নাট্যশালার প্রথম আবির্ভাব। বললেন, আমরা যুক্তি-বিবেচনার বিরুদ্ধে, মার্কসবাদী ডায়ালেকটিকস-এর বিরুদ্ধে, পশ্চিম ইয়োরোপের মানবতাবাদী ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে। বললেন, সব ধ্রুপদী ঐতিহ্য ভাঙতে হবে কেননা ক্ল্যাসিক্যাল মানেই বুর্জোয়া আর্ট। ইতিহাসের জ্ঞানও এই লেবেল সাহেবের নেই- ক্ল্যাসিক্যাল আর্টের বেশির ভাগটাই যে দাসসমাজ ও ফিউদাল সমাজে সৃষ্ট, বুর্জোয়ার দ্বারা নয়, এটাও তাঁর জানা নেই। সবশেষে লেবেল সাহেব বললেন, শিল্প হচ্ছে বিষ্ঠা, আর্ট ইজ শিট। শুনতে পাচ্ছিস ফ্যাসিবাদের কণ্ঠ, হিটলার গোয়েবেলসদের কালাপাহাড়ি তত্ত্বের প্রতিধ্বনি? আর্ট মাত্রেই আবর্জনা, আর্ট কথাটা শুনলেই পিস্তল টানতে ইচ্ছে করে। মার্কসবাদও বিপজ্জনক, পশ্চিম ইয়োরোপের বুর্জোয়া-মানবতাবাদী মহৎ শিল্পসাহিত্যও পোড়াতে হবে! হুবহু রোজেনবের্গ-গোয়েবেলস-এর পুনরাবৃত্তি। কাপ্রোলেবেলরা নয়া নাৎসি, ধ্বসে যাওয়া পুঁজিবাদের বিকৃত-মস্তিষ্ক মস্তান। পুঁজিবাদের কবরখানা থেকে উঠে আসা কিছু শবদেহ।

‘এইসব নগ্নদেহ সংস্কৃতির শত্রুদের মাঝে বোধকরি নিউ ইয়র্কের জুলিয়ান বেক ও জুডিথ মালিনা এসেছিলেন সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ও ক্ষমতা নিয়ে। তাঁদের লিভিং থিয়েটারে ছিল আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আইডিয়া। তাঁদের ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ নাটকে চমকপ্রদ কল্পনাশক্তি ও বক্তব্য, যদিও সহস্র দৈনিক কসরতের ঠেলায় সে বক্তব্য সাত হাত মাটির তলায় কবরস্থ হয়ে পড়ল। ইন্টেলেকচুয়াল সাজবার রিরংসায় দেখতে দেখতে বেক ও মালিনা তলিয়ে গেলেন হিপি কালচারে। গাঁজা হশিশ, এল-এস-ডি সেবন করে, অবাধ যৌনসংগমে গা ভাসিয়ে, জারজ সন্তানদের জন্ম দিয়ে লিভিং থিয়েটারের অভিনেতৃবৃন্দ বিচিত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন এস্ট্যাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে। আদতে করলেন আত্মহত্যা। মার্কিন শাসকগোষ্ঠীই যে এই রকম আত্মঘাতী বিদ্রোহের উশকানিদাতা, বিদ্রোহীরা ড্রাগ খেয়ে পাগল হলে এস্ট্যাব্লিশমেন্ট যে রক্ষা পায়, এটা পুঁজিবাদী মুলুকের বিষণ্ন ধনীর দুলালদের কে বোঝাবে? অচিরেই বেক ও মালিনা বলতে শুরু করলেন, নাটকের কথাই হচ্ছে শিল্পে বাধা; সুতরাং কথা বাদ। তার পরিবর্তে চিৎকার, গোঙানি, বিদঘুটে ঘোঁৎকার, এইসব হবে নাটকের ভাষা। আর অভিনেতারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে নানা আকৃতি সৃষ্টি করবেন, সেটাই হচ্ছে অভিনয়। ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা, যোগ, বৌদ্ধধর্মের বাহ্যজ্ঞানলোপ ও ধ্যান, এইসব নাকি লিভিং থিয়েটারের আশ্রয়। যে জন্য একঘেঁয়েমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে লাখোপতি মার্কিন পুঙ্গবরা হরে-কৃষ্ণ-রাম ভজতে এদেশে আসেন- সেই সঙ্গে সাইড বিজনেস হিসেবে কিছু গুপ্তচরবৃত্তি- ঠিক সেই বড়লোকি বিলাসে ডুবলেন বেক ও মালিনা। মার্কিন মহাবিদ্রোহীরা সব একই বাঁশবনের শেয়াল। তাঁরা সকলে অকস্মাৎ হিন্দুধর্মের মধ্যে মহা মহা সব সত্য আবিষ্কার করেন, সকলে হশিশ খেয়ে দিবারাত্র চক্ষু ঢুলঢুল করে রাখেন, সকলে যখন যাকে পান তাঁর সঙ্গে রমণে লিপ্ত হন। এবং এইরকম জীবনযাপনকে তাঁরা বলেন, এস্ট্যাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ! আসলে এরা ওই এস্ট্যাব্লিশমেন্ট নামক শবদেহেরই পচে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি, ওই মৃতদেহের শেষ বিষ্ঠা, তার শেষ বমির চিহ্ন। নিউ লেফট্ নাম নিয়েছেন তারা। লেফট্ কথার এমন অপমান আর হতে পারে না। এবং স্মরণ রাখবি- এই লেফটের মধ্যে একজনও শ্রমিক নেই, একজনও না। সব বড়োলোকের বখাটে ছেলে এবং মার্কিন বুদ্ধিজীবী। বেক ও মালিনা এই শ্রমিকবিরোধী প্রতিবিপ্লবী যোনিকীটদের মতাদর্শই এনে চাপালেন থিয়েটারে। জুডিথ মালিনা স্পষ্টই বলেছেন, শ্রমিক-টমিককে আমাদের থিয়েটারে দরকার নেই, আমরা চাই শিক্ষিত মানুষকে। ‘শিক্ষিত’ কথাটা লক্ষ্য কর। এডুকেটেড মেন। তারা নাকি লিভিং থিয়েটারের নাটক দেখে বুঝে ফেলবে সমাজের গলদ কোথায়, এবং সমাজকে বদলে দেবে। চাতুরিটা বোঝ। বেক ও মালিনা নিজেদের বলেন আনার্কিস্ট, নৈরাজ্যবাদী, এবং সে-নৈরাজবাদ একান্তভাবে শিক্ষিতের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে। আপামর মার্কিন জনগণের মধ্যে সেসব কথা ছাড়িয়ে গেলে সত্যিই বিপ্লব হয়ে যাবে যে! সে কি এস্ট্যাব্লিশমেন্টের সেবাদাসরা সইতে পারেন? অবশ্য বেক ও মালিনার আশঙ্কার কোনো কারণ ছিল না। লিভিং থিয়েটার এমন শিক্ষিত প্যাঁচপয়জারে মঞ্চ প্রকম্পিত করতে লেগেছিল যে, শ্রমিকরা ও থিয়েটারের চৌকাঠ মাড়ায়নি কোনোকালে। র্ধ না লিভিং থিয়েটার প্রযোজিত ‘মিস্ট্রিজ’ নাটক। সে-নাটকের প্রোগ্রামে বেক লিখলেন, ভারতীয় যোগীরা আমাদের আদর্শ, কারণ তাঁরা সমাহিত, সামাজিক বা রাজনৈতিক সংগ্রামে তাঁরা জড়ান না- দে ডু নট এনগেইজ ইন স্যোশাল অর পলিটিক্যাল স্ট্রাগলস। অহো, কি বুদ্ধি! গোড়াতেই গুপ্তকথা ফাঁস! রাজনৈতিক সংগ্রামে জড়ানোটাই হচ্ছে যত নষ্টের মূল। সবাই সংগ্রাম ছেড়ে ধ্যানমগ্ন হও, এমনিতে না পারলে গাঁজা খেয়ে হও, তাহলেই এস্ট্যাব্লিশমেন্টে জব্দ হয়ে যাবে। বুর্জোয়ার এরকম প্রত্যক্ষ ও নির্লজ্জ সেবা আর কেউ পেরেছে করতে?

‘তারপর নাটক শুরু হল। মানে, শুরু হল এবং হল না। মঞ্চে এক অভিনেতা দাঁড়িয়ে আছেন, এবং আধঘন্টা তিনি নির্বাক নিশ্চল দাঁড়িয়েই রইলেন। এই আধঘন্টার নিরেট নীরবতা বোধকরি দর্শকদেরও হিন্দু যোগীর মতন সমাহিত করে ফেলার জন্য। তারপর হঠাৎ অভিনেতাদের বিকট চিৎকার, মঞ্চে ও প্রেক্ষাগৃহে ছুটোছুটি। আবার হঠাৎ নীরবতা; এবং হিন্দু সন্ন্যাসীর ন্যায় স্বয়ং জুলিয়ান বেকের মঞ্চে পদ্মাসনে উপবেশন। বেক এবার তাঁর রাজনৈতিক কর্তব্যটা দ্রুত সেরে ফেললেন, পরপর দ্রুত বলে গেলেন, ভালো করে বাঁচো, যুদ্ধ বন্ধ কর, আণবিক বোমা নিষিদ্ধ কর, কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত কর, নিজেকে বদলাও, এখুনি স্বাধীনতা চাই। ব্যস, মহান থটস্ অফ বেক খতম, রাজনৈতিক দায়িত্ব সম্যক পালিত। অতঃপর অভিনেতারা পাস্পরকে জড়াতে শুরু করলেন, মাঝে মাঝে সুউচ্চ ও ধ্বনিতে ফেটে পড়লেন, যোগব্যায়াম প্রদর্শন করলেন।  অতঃপর দর্শকের পিলে চমকে দিয়ে এক অভিনেতা আর্তচিৎকার করে উঠলেন এবং ধপাস করে পড়ে গেলেন। তখন ধপধপ অন্যেরাও মরে গেলেন। মঞ্চভর্তি সব লাশ। জুলিয়ান বেকের দার্শনিক চিন্তা এক স্টেজ মৃতদেহে পর্যবসিত হল। নাটক শেষ। থিয়েটার এক কবরখানা। পুঁজিবাদের কবরখানা থেকে এ থিয়েটারের জন্ম।

‘এই মনোভাব নিয়ে এঁরা ব্রেখট্-এর ওপর চড়াও হয়েছিলেন। সফোক্লিসের ‘আন্তিগোনের’ একটি ভাষ্য তৈরি করেছিলেন ব্রেখট্। লিভিং থিয়েটার সেটি নিয়ে, কথা সব ছাাঁটাই করে, দৈনন্দিনের শার্ট ও জীন্সের প্যান্ট পরে চেঁচামেচি ও জড়াজড়ি করে গ্রীক ট্র্যাজেডি পরিস্ফূট করলেন। কলকাতাতেও দেখছি গুরু কুর্তা আর পেন্টুলন পরে রোমান পরিবেশ সৃষ্টির মূর্খ প্রয়াস। নকল করতে হলে বেক আর মালিনা ধরা কেন? সত্যিকারের ইয়োরোপীয় প্রযোজকদের ধরাই উচিত নয় কি? নাকি যেন-তেন প্রকারে মার্কিন অবক্ষয়কে এদেশে চালু করার পেছনে কোনো অর্থলোভ কাজ করছে?

‘বেকদের অধঃপতনের চূড়ান্ত নিদর্শন তাঁদের ‘প্যারাডাইস নাও’ নাটক। ‘ইয়েল থিয়েটার’ পত্রিকায় এ নাটক সম্বন্ধে বেক নিজে লিখেছেন, আফিম-মারিজুয়ানা-হেরোইন প্রভৃতি ড্রাগ খেয়ে তবে আমরা অভিনয় করি এবং এভাবে আমরা নিজ নিজ দেহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করি। এবং ড্রাগ-মাতাল হবার ফলেই বোধকরি মঞ্চের ওপর মূত্রত্যাগ, মলত্যাগ এবং দু-এক রজনীতে ধর্ষণ পর্যন্ত করতে পারলেন অভিনেতৃগণ। শৌচাগার এবং থিয়েটারের পার্থক্য ঘুচে গেছে এদের কাছে, উঠে গেছে বেশ্যালয় এবং নাট্যশালার সীমারেখা। এই নাটক বিস্মিত দর্শক প্রথম দেখলেন উলঙ্গ নর-নারীর জড়াজড়ি এবং মঞ্চে তাদের স্তপাকৃত দেহ, যাকে বেক বলেন রাভ-পাইল। দর্শকদের থেকেও কেউ কেউ উঠে কাপড় জামা খুলে সেই মাংসের পাহাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। সে রকম এক দর্শক, মাইকেল টমাস, লিখেছেন, ওই স্তুপে প্রবেশ করে তিনি যাকে নারী ভেবে জাপটে ধরে স্পর্শসুখ পেলেন, পরে মঞ্চে আলো প্রখর হতে দেখলেন সে একটি বালক।

‘এক ন্যাক্কারজনক গণমৈথুনকে নাটক বলে চালাচ্ছিলেন বেক। জুডিথ মালিনা বলার স্পর্ধা রাখেন যে, এ-নাটক নাকি দর্শক মাত্রে মানুষকে বিপ্লবী বানাতে চায়।- ইট ইজ আ প্লে দ্যাট ওয়ান্টস টু মেইক রেভ্যুলেউশনারিজ অব পিপল অন দ্য স্পট! বিপ্লবী বলতে জুডিথ বোধহয় লালসার দাস কোনো পশু বোঝেন। সেই সঙ্গে জুডিথ মালিনা তিন পৃষ্ঠা ধরে বোঝালেন যে বিপ্লবী বলতে তিনি অবশ্যই অহিংস বিপ্লব বোঝেন- নন-ভায়োলেন্ট রেভ্যুলিউশন। সেকথা বলার দরকার ছিল না। ড্রাগ খাওয়া মার্কিন শ্বেতচর্ম ধনী নিউ লেফটের কাছ থেকে আর কিছু আশাই কেউ করে না। জুডিথ কিন্তু ছাড়েন না। বলে চলেন, শত্রু বলে আর কিছু নেই, শত্রুকে মিত্র করে ফেলবে লিভিং থিয়েটারের নাটক। অর্থাৎ মঞ্চের ওপর অভিনেত্রীকে বিষ্ঠাত্যাগ করতে দেখলে, বা কুড়ি-পঁচিশজন নারী-পুরুষের গণ-রমণ দেখলেই সাম্রাজ্যবাদী সাম্রাজ্য ছেড়ে দেবে, পুঁজিপতি ধন বিলিয়ে দেবে, এফ-বি-আই’র কর্তারা সন্নাসী হয়ে বনে চলে যাবে! ড্রাগ না খেলে এমন বুদ্ধিদৃপ্ত কথা বোধহয় বেরুতেই পারে না। ‘ইয়েল থিয়েটার’ পত্রিকায় দেখছি, ‘মিস্ট্রিজ’ নাটকের এক অভিনয়ের সময়ে জনৈক দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলেছিলেন, ভিয়েৎনাম মরে যাচ্ছে, আর আপনারা বিবস্ত্র হওয়াটাকে মনে করছেন খুব রসিকতা? আমি শুধু ভাবি অমন সমাজসচেতন মানুষ পথ ভুল করে লিভিং থিয়েটারের পাগলাগারদে টিকিট কিনে ঢুকেছিলেন কেন?’

আমি আর মধু চমকিত। এসব তো আমরা কখনো শুনিনি। আমি একবার অস্ফূট স্বরে বললাম, ‘কিছু কিছু বাংলা নাটকে ইদানীং দেখছি ওই সব হাত-পা ছুঁড়ে নানা চিত্র সৃষ্টির চেষ্টা রয়েছে। আমি ভাবতাম সেসব মৌলিক-’

‘মৌলিকের নিকুচি করেছে,’ বললেন জপেনাদা, ‘নকল করা আর বিনা স্বীকৃতিতে মেরে দেয়া তোদের মজ্জার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ঢাক পিটোচ্ছে লিভিং থিয়েটারের। যত ‘পরীক্ষা’ চলছে ওই বিধ্বস্ত দেশে, সবই বেকের পদাঙ্ক ধরে। দেখনা ওদের বড় গর্বের ওপেন থিয়েটার যা কিনা চাইকিন আর ফেল্ডম্যানের নেতৃত্বের এই দশক পর্যন্ত জ্বালিয়েছে সত্যিকারের বিপ্লবী থিয়েটারকে। ওদের ‘সার্পেন্ট’ বা ‘টার্মিনাল’ নাট্য প্রযোজনার কথা ভাব। সেই নগ্ন নারীপুরুষের জাপটাজাপটি, সেই যোগ আর প্রাণায়াম, সেই প্লটবিহীন ছুটোছুটি, চিৎকার। এঁদের নাটকে কিছু কথা থাকে, কিন্তু চাইকিন স্পষ্ট বলেছেন, সে-কথার উচ্চারণ এমন বিকৃত ও চিৎকৃত হবে যাতে তার আক্ষরিক অর্থটা কেউ বুঝতেই না পারে। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, তাহলে কথা রাখা কেন? লিভিং থিয়েটারের মতন ‘আ-উ-ই’ রাখলেই হত! এঁদের ‘সার্পেন্ট’ নাটকের এক দৃশ্যে উলঙ্গ নরনারীর গণমৈথুন চলে চল্লিশ মিনিট ধরে। এবং এঁদের স্পষ্ট ঘোষণ-আমরা নাটক করি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য অর্থাৎ শ্রমিক নামক জন্তুটিকে এদের দরকার নেই।

‘তেমনি শেখনারের পারফর্মেনস গ্রুপ। কী শক্তিমান পরিচালক। অথচ ধসের সঙ্গে সঙ্গে নিজেও গিয়ে হাজির হলেন নারকীয় অন্ধকারে। তাঁর ‘দিওনিসুস ইন সিকসটি-নাইন’ নাকি কালজয়ী প্রযোজনা, মার্কিন বোদ্ধাদের পক্ষাঘাতগ্রস্থ বিচারে। তার শুরুতেই উলঙ্গ নরনারীর ছটফটানি, জড়াজড়ি, যৌনলীলার অতিবাস্তব অভিনয়, এবং সেই মাংসের তাল থেকে দেবতা দিওনিসুস বেরিয়ে এলেন- এই নাকি তাঁর ভূমিষ্ট হবার নাটকীয় রূপায়ণ। পরের দৃশ্যে থীবস-অধিপতি পেনথেউসকে পরাস্ত করে দিওনিসুস বলছেন, আত্মসমর্পণের নিদর্শন স্বরূপ তুমি আমার জননেন্দ্রিয় মুখমধ্যে ধারণ কর। আমাদের পিতার ভাগ্য যে প্রযোজনা করতে গিয়ে এটা মঞ্চে ঘটাননি শেখনার, ঘটিয়েছিলেন নেপথ্য। কিন্তু পরমুহূর্তে অন্য ভীষণতর কাণ্ড ঘটে। উলঙ্গ অভিনেতা ও অভিনেত্রীরা দর্শকদের ওপর হামলে পড়েন, তাঁদের কামনা জাগ্রত করার যাবতীয় যত পদ্ধতি কামশাস্ত্রে আছে সব প্রয়োগ করতে থাকেন, এবং ফলে অনেক রজনীতেই অস্বাভাবিক সব কাণ্ড ঘটেছিল, শেখনারের নিজের তাই জবানবন্দী। শেখনার লিখেছেন, ক্রমবর্ধমান হারে দর্শকরা অভিনেত্রীদের সঙ্গে সংগমের চেষ্টা করতে লাগলেনও... অনেক সময়ে অন্ধকার কক্ষে কুৎসিত সব কা- ঘটতে থাকল। অভিনেত্রীরা দর্শকের অঙ্গে হাত বুলোতে অস্বীকার করতে লাগল। একটি অভিনেত্রী স্পষ্ট বলে দিল, ‘আমি কোনো বৃদ্ধের সঙ্গে যৌনসঙ্গমের জন্য নাট্য দলে আসিনি।’ এটা পাবি প্রকাশিত নাটক ‘দিওনিসুস ইন সিকসটি-নাইনের’ ভূমিকায়। তেমনি তাঁর ‘পাবলিক ডমেইন’  গ্রন্থের ২২৮ পৃষ্ঠায় শেখনার এও স্বীকার করেছেন যে, এরকম গণ-উন্মাদনা জাগানোটা এক ধরনের ফ্যাসিবাদ, কারণ আউশভিটস্ এর হত্যালীলা ও নুরেমবের্গে নাৎসিদের উচ্ছৃঙ্খলগুলিও একই রকম উন্মত্ততার ফল। এই ‘পাবলিক ডমেইন’ বই-এর প্রকাশক নিউ ইয়র্কের ববস- মেরিল; প্রকাশ কাল ১৯৬৯ সাল। জ্ঞানপাপী শেখনার তিনি জানেন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি হিটলারের ভূমিকায় অবতীর্ণ। আর উদাহরণ বাড়াচ্ছি না, মার্কিন মুলুকে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার বলতেই বোঝায় ফ্যাসিস্ত থিয়েটার’।

জপেনদা হঠাৎ উঠে পড়লেন, পায়চারি করতে লাগলেন চার বর্গ ফুট জায়গার মধ্যে, তারপর মোটা দু’টো বইয়ে হোঁচট খেয়ে থামলেন। তীক্ষ্ণকণ্ঠে আবার বক্তৃতার খেই ধরলেন, ‘পুঁজিবাদী সভ্যতার অন্তিমকাল উপস্থিত। পশ্চিমা নবনাট্যের সর্বাঙ্গে পচা মৃতদেহের গন্ধ। সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ হচ্ছে সংস্কৃতির শেষ অবস্থা, গঙ্গাযাত্রা, নিদানকাল। এদের শুরু আর্তোদের ‘নিষ্ঠুরতার নাটক’ থেকে। এরা হচ্ছে ইওনেস্কো, বেকেট, পিন্টারদের সুযোগ্য উত্তরসূরী।

ইওনেস্কোদের উদ্দেশ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশের বলিষ্ঠ নাট্য আন্দোলনের পথ রোধ করা, যাতে পশ্চিম ইয়োরোপে ব্রেখটদের মহৎ প্রভাব ছড়িয়ে না পড়ে। তাঁরা থিয়েটারকে করলেন চ্যাংড়ামির হায়াহীন আড্ডা। কিমিতি-জ্যামিতি-দুর্মতি প্রভৃতি নানা দুর্বোধ্য নামের আড়ালে তাঁরা বলতে চাইলেন- নাটকের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য থাকা উচিত নয়। এই এক গোয়েবেলসীয় বাক্যে তাঁরা নস্যাৎ করতে চাইলেন সফোক্লিস-শেক্সপিয়ার থেকে গোর্কি-’শ-ইবসেন-চেকভ পর্যন্ত পুরো ইয়োরোপীয় ঐতিহ্য। বেক-চাইকিন-শেখনাররা সেই তত্ত্বকেই তার স্বাভাবিক পরিণতি পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেছেন মাত্র। ইওনেস্কোরা বলেছিলেন, নাটক অর্থহীন হবে; বেকরা বলছেন নাটকে ভাষাই থাকবে না। ইওনেস্কোরা বলেছিলেন, পুরো নাট্য-ঐতিহ্যটাই ভুল পথে চলে গেছে; বেকরা বলছেন, আর্ট বিষ্ঠামাত্র। পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ইওনেস্কোয়-বেকে। বিপ্লবী নাট্য-আন্দোলনকে ছলে-বলে-কৌশলে রুখতে গিয়ে ইওনেস্কোর ইয়ার্কি আর বেকদের ফ্যাসিবাদের জন্ম। এখন ওই কমিউনিস্ট-বিদ্বেষী থিয়েটারের রকবাজ ইওনেস্কো কেঁদে কেঁদে বলতে পারবেন না, মঞ্চে ব্যাপক যৌনলীলা আমরা চাইনি। অবশ্যই চেয়েছিলেন। সোভিয়েত বিদ্বেষ, ব্রেখট্ বিদ্বেষ, সাম্যবাদ-বিদ্বেষ এবং নিম্নশ্রেণীর ঈর্ষা ওই ইওনেস্কো সাহেবদের নিয়ে গিয়েছিল এমন এক হট্টমালার দেশে, যেখান থেকে সোজা প্রশস্ত রাজপথ চলে গেছে আফিম আর সংগমের বেশ্যালয় পর্যন্ত। লক্ষ্য করিস, মার্কিন ফ্যাসিস্ত নাট্যবিদদের একজনও কৃষ্ণাঙ্গ নন, অতগুলো দলের একজন সদস্যও কালো মানুষ নন। সবটাই শ্বেতাঙ্গ ধনী এবং শ্বেতাঙ্গ চিন্তাবিদদের মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে বদ্ধ ডোবায় ঢেউ-এর মতন। ভিয়েৎনামে যত পদাহত হয়েছে শ্বেতাঙ্গের সা¤্রাজ্যবাদী কুত্তা, ততই সে স্বদেশে কামড়ে ধরেছে সংস্কৃতির টুঁটি।’

মধু কিছু পড়াশোনা করে। তাই সে হঠাৎ বিদ্যে ফলাতে গেল, ‘সব দোষ আমেরিকানদের ঘাড়ে চাপাচ্ছেন! পোলান্ডের গ্রোতোভস্কির কোনো হাত নেই এই সর্বনাশে?’

‘গ্রোতোভস্কি!’ গর্জন করে উঠলেন জপেনাদা, ইয়ার্সি গ্রোতোভস্কিকে টেনে আনলি এই যৌনব্যাধিগ্রস্ত পরিবেশে? গ্রোতোভস্কির নামটা ওই মার্কিন যৌনবিশারদরা ঘন ঘন নেয় বলে তুই গোরু ভাবছিস গ্রোতোভস্কি ওদের জাতভাই?’

‘না, গ্রোতোভস্কিও দুর্বোধ্য কিনা, তাই বলছিলাম’, আমতা আমতা করল মধু।

‘কোন আঁটকুড়ির ব্যাটা তোকে বলেছে গ্রোতোভস্কি দুর্বোধ্য? চেঁচালেন জপেনদা, ‘তুই জানিস কী গ্রোতোভস্কি সম্পর্কে? তুই বুঝিস কী?’

আমি বিড়বিড় করে বললাম , ‘না, যত বোঝেন সব আপনি!

ভাগ্যিস জপেনদা শুনতে পাননি। তিনি একনাগাড়ে বলে চলেছেন, ‘মার্কিন পণ্ডিতদের কাছে গ্রোতোভস্কি দুর্বোধ্য হলেই তিনি যে নিজের পোলিশ দর্শকের কাছে দুর্বোধ্য হবেন তা তো নয়। ক্যাথলিক প্রতীক এবং ব্যঞ্জনায় তাঁর নাটক ভরপুর। তাঁর নাট্যশালায় প্রবেশ করলেই অভিনেতারা দর্শকদের যে রুটি বিলি করেন, সেটাও হোলি ইউকারিন্তের ঐতিহ্যবাহী একটি আচার, যীশুর দেহরূপ আহার করে ক্যাথলিকরা পূর্ণতা লাভ করে। গ্রোতোভস্কির ‘বিশ্বস্ত যুবরাজ’ নাটকের কাহিনী আটশো বছর পূর্বেকার পোলিশ ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। তাঁর ‘ফিগুরিস’ নাটক যেকোনো ক্যাথলিককে কাঁদিয়ে দেবে। যাঁরা ক্যাথলিক নন, কিন্তু অন্য জাতি সম্বন্ধে, ধর্ম সম্বন্ধে শ্রদ্ধাশীল তাঁরা কাঁদবেন। প্রাচীন পোলান্ডের এক গ্রামে গতরে খাটা একদল ক্ষেত-মজুর স্থির করেছে তারা যীশুর জীবনী অভিনয় করবে এবং গ্রামের যে হাবা আজন্ম-নির্বোধ, সকলের যে উপহাসের পাত্র, সে করবে যীশুর পার্ট। নাটকের অভিনয় চলতে চলতে কোনো এক সময়ে যীশুর সারল্য, স্বর্গীয় মহিমা, বিশাল ভালোবাসা সব ওই নির্বোধ লোকটির অস্ফূট উচ্চারণে প্রকাশ পেতে লাগল। ক্রমশ নির্বোধের বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হল। একটু পরে বোঝার উপায় থাকে না যীশুই নির্বোধ ছিলেন, না নির্বোধেরাই যীশু। এই মহান প্রতিভার সঙ্গে তুলনা করছিস মার্কিন নটচ্যাঙড়াদের, যারা নাটকের সংলাপেই বিশ্বাস করে না? ইয়োরোপীয় জনগণের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে অবগাহন করে তবে গ্রোতোভস্কি এসেছেন আধুনিক নাট্যপরীক্ষায়। তাঁর সঙ্গে তুলনা করছিস ছিন্নমূল গঞ্জিকাসেবী কিছু মস্তানের, যারা মঞ্চে প্রস্রাব করে, মলত্যাগ করে?’

মধু বলল, ‘ঘাট হয়েছিল, আর বলব না।’

জপেনদা আবার পায়চারি করে বললেন, ‘অনুবাদ নাটকের জোয়ার ডেকেছে বাংলার মঞ্চে। অনুবাদ নিশ্চই করতে হবে, তাই বলে এমন বাড়াবাড়ি কি ভালো? যেকোনো মার্কিন বটতলার নাটককে বাংলা রূপ দিলেই হল? তাও সেই নাটকেও যতটা সাহসের পরিচয় আছে, সেটুকুও বাংলায় আনবার মুরোদ নেই বাঙালি পাতিবুর্জোয়ার। এই তো দেখলাম সেদিন-তৃতীয় শ্রেণীর মূল নাটক ‘জিগার-জ্যাগার’; তাতে ছিল নায়কের মা বেশ্যাবৃত্তি করে পেট চালান; বাংলা রূপে তাঁকে মা করা হয়নি, পালিকা মাসি করা হয়েছে, পাছে মাতৃরূপী দেবীর হীন আচরণে কলকাতার পাতিবুর্জোয়া দর্শকের আত্মতুষ্টি ব্যাহত হয়, পাছে সে চমকে ওঠে! অথচ ‘জিগার-জ্যাগার’ নামক মূল্যহীন নাটকে এটুকুই যা ছিল দার্ঢ্য। এই রকম কাপুরুষতা নিয়ে পশ্চিমা নাটকের মুখোমুখি হওয়াই অশোভন। মাকসমুলার ভবন নামক আধা-ফ্যাসিস্ত পশ্চিম জর্মনির সংস্থার দাক্ষিণ্যে অকিঞ্চিৎকর নামগোত্রহীন কিছু নাটকের অভিনয় করে চলেছে একটি নাট্যসংস্থা। কেন রে? ব্রেখট্ ডুরেনমাটি-ভাইসের পাশে ওই সব চতুর্থ শ্রেণীর পশ্চিম জর্মন আবর্জনা ভারতে নিয়ে আসার কী এমন প্রয়োজন পড়ল? প্রয়োজনটা স্পষ্ট হয় যখন সে-দলের পরিচালক প্রকাশ্য জনসমাবেশে ঘোষণা করেন: পূর্ব জর্মন সমাজতান্ত্রিক সরকার হচ্ছে সংস্কৃতির শত্রু কারণ ওদেশে নাটকের ওপর বিধিনিষেধ আছে; আসল বাধাহীন লাগামহীন গণতন্ত্র আছে পশ্চিম জর্মনিতে’!

’সে কি!’ আমরা সমস্বরে বলি।

‘হ্যাঁ, স্বকর্ণে শুনেছি’, বললেন জপেনদা, ‘ভদ্রলোককে প্রশ্ন কর- গণতন্ত্রই যদি থাকবে পশ্চিম জর্মনিতে, তবে সেখানে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি কেন? কেন সেখানে বাডের-মাইনহফ গোষ্ঠীর বাছা বাছা কমিউনিস্টদের জেলের মধ্যে হত্যা করা হয়? কেন সে-সরকারের বড়ো বড়ো পদে বসে আছেন যুদ্ধপরাধী মনুষ্যেতর নাৎসি জানোয়াররা? আরো জিগ্যেস কর- পূর্ব জর্মনিতে নাটকের ওপর বিধিনিষেধ আছে এই মহামূল্য সা¤্রাজ্যবাদী কাহিনীটি বাংলাদেশে প্রচার করার ভার ওই ভদ্রলোক নিয়েছেন কত মার্কের বিনিময়ে? তিনি পূর্ব জর্মনি গেছেন কবার? পশ্চিম জর্মনিকেই বা কতটুকু দেখেছেন? কোন ভালো নাটকটা পশ্চিম ইয়োরোপে অভিনীত হয়েছে যা কয়েক মাসের মধ্যে পূর্ব জর্মনিতেও অভিনীত হয়নি? অন্যপক্ষে ক’টি পূর্ব জর্মন নাটক অভিনীত হয়েছে পশ্চিমে? স্ট্রিটমাটের বা বোলৎস এর নাম শুনেছে পশ্চিম জর্মনির মানুষ? বিধিনিষেধ তো যত দেখছি উগ্র জাতিবিদ্বেষী, কমিউনিস্ট-বিরোধী পশ্চিম জর্মন সরকারই আরোপ করে চলেছে সেই ১৯৪৫ সাল থেকে। সে আধানাৎসি সরকার ব্রেখট্কে প্রায় নিষিদ্ধ করে রেখেছিল, পিসকাটরকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লৌহযবনিকায় ঘিরে রেখেছিল, তাকে সংস্কৃতির পরিপোষক বলে সার্টিফাই করছেন বাংলার ওই পরিচালকপ্রবর! এটুকু বুঝলাম, পশ্চিম জর্মন ফ্যাসিস্তরা নাটকের পরিপোষক না হোক, ওই বাঙালি পরিচালক মহোদয়ের পরিপোষক নিঃসন্দেহে।

‘এসব দেখেই ভাবনা হয়। পশ্চিমা পুঁজিবাদের কবরখানা থেকে খাবলা খাবলা পচা মাংস যাঁরা ভারতে নিয়ে আসছেন, তাঁরা অচিরে এদেশে বেক-চাইকিনের স্বেচ্ছাচারও আমদানি করতে পারেন। পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ হচ্ছে অপক্ক বাঙালি পাতি বুর্জোয়ার এক প্রিয় খেলা। তার পুরো সুযোগ নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা। শেখনার ক’টি অভিনয় করে গেছেন এদেশে; সঙ্গে সঙ্গে বিদেশের মুখাপেক্ষী মৌলিকতাহীন একদল লোক তাঁর পদলেহী চেলা হয়ে পড়েছেন। পূর্ণ উদ্যমে তাঁরা পারফর্মেনস দলের অঙ্গভঙ্গি অনুকরণ করতে লেগেছেন। এর পরিণতি তো মঞ্চে বিষ্ঠাত্যাগ এবং গণধর্ষণে! অনুবাদ নাটকের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার বান ডাকলে বিপদের কথা। বেনোজলে কারুর উপকার নেই, শুধু দেশের ফসল ডুবে যায়, পঁচে যায়।’

আমারা উঠে পড়ি কেটে পড়ার জন্য। কিন্তু এগুতে পারি না, দরজা আগলে দ-ায়মান ভূষ-ীর মাঠের কারিয়া পিরেত। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘পশ্চিমা পুঁজিবাদ কথাকে আর ভাবপ্রকাশের মাধ্যম করতে সাহস পাচ্ছে না, চাইছে কথা হোক ভাব গোপন করার অস্ত্র, সব কিছু গুলিয়ে দেয়ার হিং টিং ছট, জনগণের মাথা ঘুরিয়ে দেয়ার অসংলগ্ন কিছু শব্দ। একটা বই পড়ছিলাম- কেনেথ হাডসনের ‘জার্গন অফ দ্য প্রোফেশনস্’।- বইটা জপেনদা কুড়িয়ে নিলেন ঘরের কোণ থেকে। ‘এই দেখ পশ্চিমের আধুনিক সমাজতাত্ত্বিকের ভাষা উদ্ধৃত করেছেন হাডসন। বলতে হবে, একটি ছেলে ও একটি মেয়ের প্রেম হল, বিয়ে হল। সমাজবিজ্ঞানী লিখছেন, their libidinal impulses being reciprocated, they activated their individual erotic drives and interpreted them in the same frework of reference!,

‘এসব কী?’ মধু বলল।

‘এ সব হচ্ছে জরাগ্রস্ত পশ্চিমা পুঁজিবাদের প্রলাপ। ধর এ অর্থনীতিবিদদের রিপোর্ট attempts which require at the theoretical, historical and predictive levels the formulation of consumptive and savings functions manifested in propensity to save schedules contained in various levels of income!, মানে বুঝলি?’

‘পাগল নাকি !’ আমি বলি, ‘কী করে মানে বুঝব?’

‘মানে হচ্ছে- আয় বেশি হলে লোক বেশি খরচ করে আর আয় কম হলে কম খরচ করে! পাণ্ডিত্যটা বোঝ। সবচেয়ে সহজ কথাটাকে এমন অর্থহীন শব্দের জিমন্যাস্টিকে পরিণত করার বৈদগদ্ধটা বিচার কর। অর্থনীতি বা সমাজতত্ত্ব যেন জনতার বোধগম্য না হয় তার জন্য কী আকুলিবিকুলি। সেই মানসিকতাই কাজ করছে বহু পশ্চিমা চলচ্চিত্র ও নাটকে। দেউলিয়াপনা ঢাকবার জন্য দুর্জ্ঞেয় সাজা। ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে মনের গলিত কুষ্ঠ ঢেকে রাখা। পরস্পরহীন তাৎপর্যহীন ধ্বনির ধুলিঝড়। বেক ও মালিন তাই করছেন যা মার্কিন অর্থনীতিবিদরা করছেন। চাইকিন ও শেখনারও ঠিক ওইটিই করছেন। এবং ঠিক সেই মানসিকতাই বের্গমেন আদি চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে গেছে অবোধ্য কিছু ছবির মালা গাঁথবার শোচনীয় গবেষণায়। সাধু সাবধান! এঁদের ফাঁদে যে পা দেবে নিছক একটু ইন্টেলেকচুয়াল প্যাঁচ কষবে না, মূলত সে সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের অংশীদার হবে, সে মার্কিন বা পশ্চিম জর্মন ফ্যাসিস্তদের হুকুমবরদারে পরিণত হবে।’

দুর্বোধ্যতার এই আন্তর্জাতিক ব্যাখ্যা শুনে আমরা থ। মধু বলল, ‘না এ বিষয়ে আমরা সতর্ক যে, অনুবাদ-নাট্য কখনো মৌলিক নাটকের পরিবর্তে হতে পারে না। নিজের দেশকালের মৌলিক নাটকের দায়িত্ব এড়াবার জন্য অনবরত খ্যাত-অখ্যাত উত্তম-অধম বিদেশি নাটকে জীবন কাটাব-এটা যে এক ধরনের আত্মহত্যা, এটা আমরা জানি। কিন্তু উপায়ট কী? দেখছেন না, আজকের কলকাতায় পঁচাত্তরভাগ নাটক অনুবাদ বা রূপায়ণ? যে নাটক প্রথম বাক্য থেকেই একান্তভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিড-ওয়েস্ট অঞ্চলের স্বাদে-বর্ণে-গন্ধে ভরপুর, অবলীলাক্রমে সে নাটককেও ঘাড়ে ধরে ধুতি চাদর পরিয়ে বাঙালি বানানো হচ্ছে। যে নাটকের পটভূমিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মার্কিন বিমানবাহিনীর ফ্যাসিবিরোধী বীরত্ব, তাকেও হাতুড়ি মেরে দুমড়ে মুচড়ে বাংলার এক রেল দুর্ঘটনার পরিবেশে গুঁজে দেয়া হচ্ছে। হাস্যকর তার ফলাফল, উদ্ভট তার সংলাপ। তবু হাল ছাড়েন না নাট্যবীররা। বাঙালি নাট্যকারের আন্তরিক বাংলা নাটক খুঁজে বার করার পরিশ্রম কেউ স্বীকার করবেন না।

‘কিন্তু কবরটা কী?’

‘করবিটা কী?’ পালটা শুধোলেন জপেনদা, ‘এতদিন গণনাট্য করছিস, আর এটা জানিস না? তোর নিজের লোকগাথা, উপকথা আর মহাকাব্যে অবগাহন কর। মাইকেল মধুসূদন যে এদেশের নাটককে কী দিয়ে গেছেন আজ পর্যন্ত তার হিসেব কেউ করল না। তোরা মাইকেল থেকে ফের আরম্ভ কর। মাইকেল পশ্চিমকে চিনতেন এ যুগের অর্ধশিক্ষিত নাট্যবিদদের থেকে ঢের ঢের বেশি। তিনি পশ্চিমের শুধু সেইসব বিরাটকায় কবিদের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন যাঁরা গুরু পদের যোগ্য। তাঁর পাঠ হোমার-ভার্জিলের কাছে, মূল গ্রীক ও লাতিনে। তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন শেক্সপিয়ার ও মিলটন। সেই সঙ্গে মূল ইটালিয়ানে দান্তে, মূল সংস্কৃতে কালিদাস, এবং খাঁটি বাংলায় কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস এবং মৈথিলীতে জয়দেব, বিদ্যাপতি। তিনি ভারতের মার্গ সংগীতে অধিকারী ছিলেন, এবং শোরি মিঞা ও নিধুবাবুর টপ্পা মুখে বন্ধুদের গেয়ে শোনাতেন। সর্বোপরি বাংলার লোককাব্যে তাঁর দখল ছিল বিস্ময়কর, যা ‘ব্রজাঙ্গনার’ রূপরীতিতে সম্যক প্রকাশিত। দেশজ সংস্কৃতির এই গভীর চেতনা নিয়ে মাইকেল অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি করে প্রায় শত বৎসরের বাংলা নাটক ও যাত্রাপালার মূল কাঠামো তৈরি করে দিয়ে গেছেন। গৈরিশ ছন্দ মাইকেলের দান। সে-ভাষায় ধ্বনির বৈচিত্র্য আছে, ছন্দের নানা চলন আছে, পৌরুষ আছে, আছে কোমলতা। কিন্তু কোথাও নেই অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা, বা পাতিবুর্জোয়া বিদগ্ধতা। কী বিদ্যুৎ গতিতে সে-ভাষা বাংলার গ্রামগঞ্জের গভীরে ছড়িয়ে গেল তার পরিমাপ পাবি যাত্রার ইতিহাস পাঠ করলে, এমনকী যেকোনো জেলার বৃদ্ধ চাষির দৈনন্দিন গুরুগম্ভীর ভাষা শুনলে। একটা কুসংস্কার চল্লিশের দশক থেকে নাট্য আন্দোলনে ব্যাপ্ত হয়েছে যে চাষি নাকি আঞ্চলিক কথ্য ভাষায় নাটক হলে, তবে বুঝতে পারে। চাষির সামনে যে কস্মিনকালে যায়নি একমাত্র শহুরে বুদ্ধিবাজের মুখ থেকেই বেরুতে পারে এহেন নিরেট উক্তি। এক অঞ্চলের ভাষায় নাটক হলে অন্য অঞ্চলের চাষি যে কিছুই বুঝবে না ওটা ওই বিশারদদের মূর্খতা। উপরন্তু কোনো জেলার ‘পাতোয়া’ বা ডায়ালেক্ট, অর্থাৎ কথ্য ভাষা শুনলে কৃষক- দর্শকরা যে সাধারণত টিটকিরি সহযোগে হেসে ওঠেন, কখনো বা মৌনী হয়ে নীরব প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন, এটা নিজে মফঃস্বলে নাটক করতে না গেলে কারুর জানার উপায় নেই। না! চাষি তার নিজের কথা ভাষা শুনতে যাত্রা বা থেটার দেখতে আসে না। মাইকেলের পর থেকে তারা থেটারে আসে কাব্যঝংকার শুনে রোমাঞ্চিত হতে। থিয়েটার যাত্রা তাদের কাছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পবিত্র-সমাবেশ। মাইকেল অব্যর্থ শরসন্ধানে বাংলার কৃষকজগতের সাংস্কৃতিক হৃৎপিণ্ড বিদ্ধ করেছেন। তিনি সেই ভাষা আবিষ্কার করেছেন যা কৃষকের মহত্তম আকাঙ্ক্ষাগুলির প্রতিধ্বনি, তার জটিলতম প্রার্থনার পূরণ। সেই ঐতিহ্য চলে আসছিল অপ্রতিহত গতিতে। বাংলা নাট্যশালার গদ্য-নাটকও ছিল কাব্যিক অতিশয়োক্তির গীতিময় আসর। রবীন্দ্রনাথে এসে সেই ধারার প্রচণ্ডতম বিস্ফোরণ। কাব্যনাট্য নাট্যশালার লেখকরাও ভাবতে পারতেন না নিছক মামুলি ‘কেমন আছ’ ‘ভালো আছির’ মধ্যে নাটককে আবদ্ধ রাখার কথা। ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘নর-নারায়ণ’ মাইকেলি কাব্যে রচিত; কিন্তু তাঁর গদ্যনাট্য ‘আলমগীরের’ ভাষাও ছন্দোময়। মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ পড়ে দেখ, পড় শচীন সেনগুপ্তের ঐতিহাসিক নাটকগুলি। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ- বাংলা নাট্যশালার সেই জনপ্রিয় নাট্যকাব্যের ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। এসেছে কতকগুলি অশিক্ষিত অপদার্থ যৌনব্যবসায়ী, বারবধু আর সাহেব-বিবি-গোলামের সিফিলিটিক পসরা নিয়ে। ফিরিয়ে আন সেই ফর্ম, সেই কাব্যছন্দোময় রূপরীতি, যেটা ছিল একাধারে বুদ্ধিদৃপ্ত এবং জনপ্রিয়। পদাঘাতে দূর করে দে যৌনব্যবসায়ীদের। ঘাড় ধরে বার করে দে হঠাৎ-নবাব সব বুদ্ধিবাজদের, যারা দুর্বোধ্যতার অনুস্বার-চন্দ্রবিন্দুর ধমকে থিয়েটার থেকে তাড়াতে চাইছে শ্রমিক-কৃষককে। বেহুদার মতন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দোরে নাটক ভিক্ষা না করে মাইকেল থেকে শিশিরকুমার পর্যন্ত যে ঐতিহ্য, তাকে আঁকড়ে ধর এবং সেই ঐতিহ্যকে এক ধাক্কায় দশ বছর এগিয়ে দে নতুন বৈপ্লবিক বিষয়বস্তু যোজনা করে। সেই মাইকেলি ফর্ম ধরে নেমে যা লক্ষ মানুষের জমায়েতে, আর সেই ফর্মে বল বিপ্লবের কথা, শ্রেণীসংগ্রামের কথা, শ্রমিক কৃষকের মরণজয়ী সংগ্রামের কথা। পশ্চিমা কবরখানার নাটক নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া করিস নে।

আবেগে নিজের বুকে মাইকেলি ছন্দে করঘাত করলেন জপেনদা, এবং পরমুহূর্তে কেশে, খাবি খেয়ে, হাঁপিয়ে, শুয়ে পড়লেন মেঝেতে, এবং আমরা ‘জল’, ‘পাখা’, ‘ডাক্তার’, প্রভৃতি শব্দে কোলাহল করে উঠলাম।

[লেখাটি ‘উৎপল দত্তের গদ্য সংগ্রহ ১, নাট্যচিন্তা’ থেকে পুনর্মূদ্রণ করা হলো]

উৎপল দত্ত: বাঙলানাট্যের প্রবাদ পুরুষ